alt

সাময়িকী

অটোগ্রাফ

ফারহানা সিনথিয়া

: বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বাইরে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে।তার আগে এলোমেলো ঝড় পাতার নাচন তুলেছিল। হালকা গোলাপি শাড়ি পরা শবনম হোসেনকে অপরূপ সুন্দর লাগছে। শবনম হোসেনের পায়ের কাছে সাদা রঙের পারশিয়ান বেড়াল আড়মোড়া ভাঙলো। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়েও কানে আসছে বিসমিল্লাহ খানের সানাইয়ের সুর। খুব সম্ভবত নিচের তলায় কেউ শুনছে।

‘আমার সবচেয়ে মূল্যবান অটোগ্রাফটি দিয়েছিলাম মাত্র ষোলো বছর বয়সে।’

আমি চোখে সন্দেহ নিয়ে শবনম হোসেনের দিকে তাকালাম। তিনি আমার মনের সন্দেহ যেন পড়তে পারলেন। প্রতিক্রিয়ায় তার ঠোঁট চাপা হাসি। চোখে যেন কৌতুক ঝিলিক দিচ্ছে। অল্প বয়সী মেয়েরা যেমন কুটকুট করে হাসে ঠিক তেমন কিছু গোপন করা হাসি তার মুখে। কিশোরী মেয়ে যেমন বেফাঁস কথা বলে হাসে তেমন ভঙ্গিতে হাসছেন।

আমি পত্রিকায় একসময় ক্রাইম বিটের রিপোর্টার ছিলাম। আমার প্রকাশিত একটি খুনের ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট ভুল প্রমাণিত হয়।এরপরে আমাকে দেয়া হয়েছে সাপ্তাহিক কড়চায় সেলিব্রেটিদের সাক্ষাৎকার লেখার অ্যাসাইনমেন্ট। আমি খুব ভালো করে জানি এই কাজ আমাকে শাস্তিস্বরূপ দেয়া হয়েছে। তবে আমি চাই যেকোনো মূল্যে হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করব।

আমি বলেই ফেললাম, ‘কিন্তু মিসেস রহমান আপনি বিখ্যাত হয়েছেন মধ্য তিরিশে এসে। আপনার অটোগ্রাফের দাম হাঁকানোর মতো গুণগ্রাহী এত আগে আপনার সন্ধান পেয়ে গেল?’

‘আমি আমার স্বামীর পদবি নেইনি। আমি এখনো বাবার পদবি দিয়েই পরিচিত। যাই হোক যে কথা বলছিলাম, ধরুন, আপনার কলমের খোঁচায় আপনার সর্বস্ব হারানোর উপক্রম হলো, তাহলে অটোগ্রাফ সবচেয়ে দামি নয়?’

‘আপনি ধোঁয়াশা করছেন মিস হোসেন। পুরো গল্পটা বলবেন না?’

‘অবশ্যই বলবো। কোনো রকম লুকোছাপা ভণিতা করব না।’

‘আপনাকে অফ দ্য রেকর্ড একটা প্রশ্ন করি? কখনো প্রেম-ভালোবাসার প্রস্তাব পাননি? এটা আমি অবশ্যই ছাপবো না।’

‘সাংবাদিকতায় অফ দ্য রেকর্ড বলে কিছুই নেই। তবে আপনাকে একটা কথা বলি, প্রেম তো কত লোকেই করতে চায়; গুণের কদর কজন করে বলুন? এই কঠিন সত্য আমি অনেক আগেই জেনেছি। সেজন্যেই বলতে পারেন জনপ্রিয়তার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময়ে কখনোই পা ফসকায়নি।জনপ্রিয়তার সিঁড়ি খুব অদ্ভুত।ওপরে ওঠার সময়ে যাদের সাথে আপনার দেখা হবে নিচে নামার সময়েও একই মুখ আপনি আবার দেখবেন। সেজন্যেই আমি সাবধানী ছিলাম। পা ফসকায়নি কখনোই।’

এই কথা বলে হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে তিনি বললেন, ‘এই যে এতক্ষণ এসে বসেছেন আপনাকে কেউ চা-কফির কথা বলেনি।এটা কোনো কথা? কী নেবেন বলুন? চা-কফি না কোল্ড ড্রিংক?’, বলে হেসে শবনম আঁচলঠিক করলেন। বাইরে মাগরিবের আজান দিয়েছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি হয়তো মাথায় কাপড় দেবেন।

আঁচল ঠিক করে তিনি বাড়ির কাজের সহকারীকে ডাক দিলেন। তার কাছে বসে থাকা বেড়ালটা বিরক্ত হয়ে উঠে চলে গেল।এত কথায় তার বোধ হয় ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছে।

‘আপনি ব্যস্ত হবেন না।’

‘খবরের কাগজের সাংবাদিককে বসিয়ে রেখে খালি মুখে পাঠালে অনর্থ হয়ে যাবে।বলা যায় না আপনি আগামীকাল এভাবে লিখলেন- ‘গিয়েছিলাম হালের জনপ্রিয় লেখক শবনম হোসেনের বাড়িতে। আধ ঘণ্টা পরে তিনি দেখা দিলেন। তার বাড়িতে এক গ্লাস জল সাধলেন না অথচ লিভিং রুমের মশারা দিব্যি আমার রক্ত পান করল। এভাবেই মধ্যবিত্তের রক্ত চুষে নাম কামায় বুর্জোয়া লেখক’। বলে খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়লেন।

‘কী যে বলেন? এভাবে কেউ লেখে নাকি?’

‘আপনি এই সাক্ষাৎকারে কঠিন কিছু শব্দ ব্যবহার করবেন বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়েত, ক্লাস স্ট্রাগল। শুনুন আপনাকে একটা মজার কথা বলি। ভারি ইংরেজি বা অন্য ভাষার শব্দব্যবহার করে আজকাল অনেকেই জ্ঞানী সাজতে চায়। অবশ্য তাদেরও দোষ নেই। একটা কথা আছে না গেয়ো যোগী ভিখ পায় না। ঠিক তেমন অন্য দেশের বুলি বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় আপনি যা লিখবেন অর্থ না বুঝলেও ঠিক একদল সহমত ভাই জোগাড় হয়ে যাবে।’

আমার ততক্ষণে এই অটোগ্রাফের গল্প শোনার নেশা ভালো করে জেঁকে বসেছে। তিনি কাউকে বিয়ে করেছিলেন? একেবারে অল্পবয়সের ভুল। কাবিননামার করা স্বাক্ষরকেই অটোগ্রাফ বলে চালাচ্ছেন?

এই সাক্ষাৎকার ছাপতে পারলে আমার নাম হবে। নিজেকে সেই মুহূর্তে কিছুটা স্বার্থপর মনে হলো। নিজের ব্যক্তিগত লাভের জন্যে আমি অন্যের গোপনীয় কাহিনী লিখছি। আমি ঠিক করলাম গল্পটা এমনভাবে লিখব যেন রগরগে না শোনায়।

কিছুক্ষণ বাদেই গৃহ সহকারী ফেরত এলো টি-সেট নিয়ে।বনেদি বাড়িতে এমন ফুলেল নকশা করা টি-সেট দেখা যায়। চা ঢেলে প্রশ্ন করলেন- ‘চিনি কয় চামচ।’

আমি এক চামচ বলে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন আমরা গল্পে ফেরত যাবো।

চা দিয়ে তিনি বললেন, ‘এই টি-সেট আমার নানা বাড়ির। মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। নানুর বিয়েতে উপহার পাওয়া এই টি-সেট অক্ষত ছিল।মজার ব্যাপার হচ্ছে যে টি-সেট আমার নানি তার জীবদ্দশায় ব্যবহার করেননি আমি দিব্যি সেসব প্রতিদিন ব্যবহার করছি। আসলে কি জানেন? বেঁচে থাকার চেয়ে বড় কোনো উপলক্ষ হয় না।তুলে রেখে লাভ কী বলুন!’

‘এই চায়ের কাপ নিয়েই তো চমৎকার ছোটগল্প হতে পারে।’

‘সে তো পারেই। যাই হোক আমি অটোগ্রাফের গল্পে ফেরত যাই। আমি তখন ক্লাস টেনেপড়ি। আমার বাবা-মা ঠিক করলেন ভারতে বেড়াতে যাবেন। সেই উপলক্ষে আমার পাসপোর্টের আবেদন করতে হবে। পাতার পর পাতা সাদা কাগজ ভরে উঠল আমার কচি হাতের স্বাক্ষরে। সত্যি কথা জানেন জীবনের প্রথম সিগনেচার যেন নিজের আইডেন্টিটির অংশ। যেখানেই কাগজ পেতাম সেখানেই সই করতাম।

‘তখনও পাসপোর্ট অফিসে এমন দালালের দৌরাত্ম্য ছিল?’

‘থাকবে না কেন? তবে আমার মায়ের ছাত্রের বাবা পাসপোর্ট অফিসের বড় কর্তা ছিলেন। আমাদের ঘুষ দিতে হয়নি। আমরা নিয়ম মেনেই জমা দিয়েছিলাম।ধানম-ির একটা স্টুডিও থেকে আমার পাসপোর্টের ছবি তোলা হয়েছিল।’

‘আমি আপনার গল্পে ইন্টেরাপ্ট করছি না তো?’

‘না প্রশ্ন করবেন। আসলে আমরা বর্ণনার সময়ে অনিচ্ছাকৃতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ডিটেল বলতে ভুলে যাই।তখন অন্য কেউ প্রশ্ন করলে বেশ সুবিধা হয়।’

‘প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত সম্পদ আসলে সাপের বিষের মতো।’

‘সেটা কেমন?’

‘আপনি জানেন সাপের বিষ থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন হয়। আপনি জানেন থ্রম্বোসিস, আর্থ্রাইটিস আর ক্যান্সারের ওষুধের উপাদান সাপের বিষ। বিষেবিষক্ষয় বলে একটা কথা আছে না? ঠিক তেমন।’

আমি ভেবে পেলাম না অটোগ্রাফের সাথে সাপের বিষের সম্পর্ক কোথায়?

তিনি বলে চলেছেন, ‘আপনার চিকৎসার যখন প্রয়োজন হবে আপনার বিত্ত আপনার জীবনদায়িনী ভূমিকা নেবে। সাপের বিষ থেকে কর্কট রোগের ওষুধ উৎপাদনের মতো। সাপের বিষ কীভাবে কাজ করে জানেন? সাপের বিষ আসলে নিউরোটক্সিন।অর্থাৎ আপনার নার্ভ সিগন্যাল পাঠাতে বাঁধার সৃষ্টি করবে।ধীরে ধীরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে মানুষ মারা যাবে।ঠিক তেমনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আপনার নার্ভাস সিস্টেম অর্থাৎ পারিবারিক গঠনে আঘাত করবে।ধীরে ধীরে হিংসা আর হানাহানিতে নিকট আত্মীয়দের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হবে। সম্পর্কেরমৃত্যু হবে।’

আমার বাবা খুব অল্প বয়সে মারা যান। দীর্ঘদিন রোগে ভোগেননি। বিছানায় পড়ে রইলেন না।হাসপাতালে গেলেন। সেখান থেকেই শেষ যাত্রায় গোরস্থান। ঠিক তখনই আমি পৃথিবীর অন্য একটা রূপ দেখলাম। আমার চাচা একটি স্ট্যাম্প পেপারনিয়ে হাজির হলেন যেখানে আমার স্বাক্ষর করা। সেই স্ট্যাম্প পেপারে লিখা ওকালতনামা অনুযায়ী আমার যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি আমি সজ্ঞানে চাচার কাছে হস্তান্তর করেছি। বাবারঅসম্ভবে চাচা সেই সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবেন।

আমি বলেছিলাম না অতিরিক্ত সম্পদ হচ্ছে সাপের বিষের মতো। আমার চাচা ধনবান মানুষ ছিলেন। সেই বিষ যেন পরিবারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ল। আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না স্বাক্ষর আমি কবে করলাম। আমার বাবার একমাত্র কন্যাসন্তান হবার সুবাদে আমি বিপুল সম্পদের অধিকারী। আমার মা আশ্চর্য হয়ে গেলেন।

চাচা প্রথমে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করার একটা চেষ্টা করলেন। আমার মামারা বাঁধা দিলেন। তিনি যাবার সময় বাড়ির দরজার দাঁড়িয়ে বলে গেলেন আমার মা আর আমাকে তিনি পথের ভিখারি করে তবে ছাড়বেন। আমার চাচা মোক্ষম সময়ে কাগজ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। ভেঙে যাওয়া দেয়ালের ইট খুলে নিয়ে যেতে সুবিধা হয়। সেই সময়ে আমার মা আর আমি হতবিহ্বল অবস্থায় ছিলাম।

ধানম-িতে আমাদের দোতলা বাড়ি আছে। সেই বাড়ির এক তলা ভাড়া দেয়া ছিল। মা বাবার ব্যবসার পার্টনারদের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। যেন তার প্রাপ্য অংশ থেকে আমরা বঞ্চিত না হই।

বাবার ব্যবসার অংশীদারেরা আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

মায়ের দুশ্চিন্তা তাতেও যায় না। তিনি জানেন আমাদের মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয় বেহাত হয়ে যাবে। এই ভয় আমাদের কুরে কুরে খেতে লাগল।ধরুন আপনার সাথে হুট্ করে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া আপনি অথৈ পাথারে পড়বেন। তবুও সামলে নিতে শিখে যাবেন।যদি আপনার কোনো খারাপ খবরের অপেক্ষা করতে হয় সেটা একটা ভয়ংকর ব্যাপার। আপনার হাতে কিছু নেই অথচ ভয়টা আপনাকে সবর্দা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।এর চেয়ে খারাপ বোধ করি কিছুই হয় না।

ভর দুপুরে আমরা মা-মেয়ে শুয়ে আছি বিছানায়। বিজবিজ শব্দে এসি চলছে। এমন সময় মা বললেন, ‘আমাদের এই আয়েশের জীবন থেকে দূরে থাকার মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে।’

আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, ‘আমি জেনেশুনে আমাদের এতো বড় ক্ষতি করিনি।বাবার অফিসে স্ট্যাম্প পেপার দেখে হয়তো অসাবধানে আমি স্বাক্ষর করেছিলাম। আমার ধারণা আমার বাবার সেক্রেটারি ভদ্রলোক এর সাথে জড়িত ছিলেন। বাবার স্টাডি থেকে আমার সই করা স্ট্যাম্প পেপার আমার চাচাকে দিয়েছিলেন।’

আমার মা বিছানা থেকে উঠে বসলেন, ‘কী বলছো এসব?’

মায়ের মনে হয়তো ক্ষীণ আশার একটা সম্ভাবনা ছিল যে স্বাক্ষর নকল। আমার মুখে স্বীকারোক্তি সকল হিসাব ওলটপালট করে দিলো। মা দুই হাতে মাথা ধরে বসে রইলেন। এমন সময় বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠল।

মা ধাতস্থ হয়ে দরজা খুলতে গেলেন। আমিও মায়ের পেছনে পেছনে গেলাম। সাদা দাড়িওয়ালা চশমা পরা মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।

মাকে সালাম দিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ভেতরে আসতে পারি?’

‘আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না।’

‘আপনি তো প্রয়াত মশিউল হোসেনের স্ত্রী। আপনার স্বামী আমার ল ফার্মকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।’

মা ভদ্রলোককে ঘরে এনে বসালেন। তিনি নিজের পরিচয় দলেন জেড আই খান পান্না নামে। আমি ছোট মানুষ তাঁকে চিনতাম না। এখন তো সবাই তাকে চেনেন।

আমার বাবা তার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি আমার মায়ের নাম রেজিস্ট্রি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। একটা দানপত্র বের করে দেখালেন।

আমার মা খুশিতে কেঁদে ফেললেন।

ভদ্রলোক মাকে আশ^স্ত করে জানালেন, ‘আমার বাবা হয়তো একমাত্র সন্তানের সুরক্ষার জন্যই এই পথ বেছে নিয়েছিলেন।’

মা তাকে আমার চাচার ঘটনা বললেন। ভদ্রলোক শিউরে উঠলেন পুরোটা শুনে।

সেই যাত্রায় আমরা মহাবিপদ থেকে রক্ষা পেলাম।

আমি বললাম, ‘তারপর? আপনি এই ঘটনা কোনো উপন্যাসে ব্যবহার করেননি?’

‘না। করিনি।সত্য কথা শোনায় বক্তৃতার মতো আর মিথ্যেশোনায় কবিতার মতো।সবাই তো কবিতা শুনতে চায়।’

আমি বললাম, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন।সবাই কবিতা শুনতে চায়।মিথ্যে জেনেও শুনতে চায়।সত্য কথা শোনার সাহস আমাদের সবার থাকে না।তবে আপনি অকপটে যা বলেছেন তা আমি অবশ্যই লিখব।’

শবনম হোসেন হাসলেন। তার দুই চোখে হাসির ঝিলিক দেখা গেল। তিনি আমাকে এগিয়ে দিলেন।

আমি দরজায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘একটা কথা বলুন তো সবাইকে রেখে আমাকেই বা কেন এই গল্প বলতে গেলেন?’

বাম চোখের ভ্রু ঈষৎ উঁচু করে বললেন, ‘আপনাকে একটা গোপন কথা বলি আমাকে নিয়ে লেখা যতগুলো হেডলাইন হয়েছে সব আমার জানা মতেই হয়েছে। এই ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি।’

আমি হেঁটে যাচ্ছি গাড়ির দিকে। শবনম হোসেনেরউপন্যাসে থাকে আলোর গল্প।সর্বভেদী আলো যা আঁধার কেটে তার উপস্থিতি জানান দেয়। ল্যাম্প পোস্টের আলোতে শবনম হোসেনের আবছা সিলুয়েট দেখা যাচ্ছে। অপরাহ্ণের অন্ধকারে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার জীবনের আঁধারের গল্পটা আমি জেনে গেছি।

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দাউদ হায়দার: স্বকীয় ও নির্বাসিত

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

আলবেয়ার কামুর গল্পে অস্তিত্বের নিষ্ঠুরতা

ছবি

উপন্যাসের জন্মবীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কানাগলি

ছবি

পার্ল এস বাক-এর কবিতা

ছবি

হোসে এচেগারাই স্প্যানিশ আলোকবর্তিকা

ছবি

নববীণায় বাজে নতুনের জয়গান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের ‘করুণা’ ঘিরে কিছু কথা

ছবি

গীতাঞ্জলির ইতিবৃত্ত ও বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ

ছবি

রবীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ ও ‘ছিন্নপত্র’

ছবি

নিউ নেদারল্যান্ডস: জার্র্সি এবং লেনাপি জনগোষ্ঠী

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বকুলীর সেইরাত

ছবি

আকাশের প্রান্ত

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

মুখ

ছবি

বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি

ছবি

অগ্রজ দাউদ হায়দারের মহাপ্রয়াণ

ছবি

নারী যখন পাঠক নারী যখন লেখক

সাময়িকী কবিতা

মিত্র

ছবি

মৃত্যুর মৃদু উত্তাপ : পথের শেষ কোথায়

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বেলাল চৌধুরীর কবিতা

ছবি

পাঠের আগ্রহ থাকলে বইয়ের অভাব হয় না

ছবি

রবীন্দ্রগানে শঙ্খ ঘোষের মন

ছবি

ফার্স্ট টিউসডে’স : আমার প্রথম মঙ্গলবার সন্ধ্যার গন্তব্য

ছবি

আজ লাবণ্যর বিয়ে

ছবি

সংস্কৃতির পরম্পরা, অভিঘাত-অভিজ্ঞান ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ

ছবি

তুষার গায়েন-এর কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

tab

সাময়িকী

অটোগ্রাফ

ফারহানা সিনথিয়া

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

বাইরে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে।তার আগে এলোমেলো ঝড় পাতার নাচন তুলেছিল। হালকা গোলাপি শাড়ি পরা শবনম হোসেনকে অপরূপ সুন্দর লাগছে। শবনম হোসেনের পায়ের কাছে সাদা রঙের পারশিয়ান বেড়াল আড়মোড়া ভাঙলো। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়েও কানে আসছে বিসমিল্লাহ খানের সানাইয়ের সুর। খুব সম্ভবত নিচের তলায় কেউ শুনছে।

‘আমার সবচেয়ে মূল্যবান অটোগ্রাফটি দিয়েছিলাম মাত্র ষোলো বছর বয়সে।’

আমি চোখে সন্দেহ নিয়ে শবনম হোসেনের দিকে তাকালাম। তিনি আমার মনের সন্দেহ যেন পড়তে পারলেন। প্রতিক্রিয়ায় তার ঠোঁট চাপা হাসি। চোখে যেন কৌতুক ঝিলিক দিচ্ছে। অল্প বয়সী মেয়েরা যেমন কুটকুট করে হাসে ঠিক তেমন কিছু গোপন করা হাসি তার মুখে। কিশোরী মেয়ে যেমন বেফাঁস কথা বলে হাসে তেমন ভঙ্গিতে হাসছেন।

আমি পত্রিকায় একসময় ক্রাইম বিটের রিপোর্টার ছিলাম। আমার প্রকাশিত একটি খুনের ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট ভুল প্রমাণিত হয়।এরপরে আমাকে দেয়া হয়েছে সাপ্তাহিক কড়চায় সেলিব্রেটিদের সাক্ষাৎকার লেখার অ্যাসাইনমেন্ট। আমি খুব ভালো করে জানি এই কাজ আমাকে শাস্তিস্বরূপ দেয়া হয়েছে। তবে আমি চাই যেকোনো মূল্যে হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করব।

আমি বলেই ফেললাম, ‘কিন্তু মিসেস রহমান আপনি বিখ্যাত হয়েছেন মধ্য তিরিশে এসে। আপনার অটোগ্রাফের দাম হাঁকানোর মতো গুণগ্রাহী এত আগে আপনার সন্ধান পেয়ে গেল?’

‘আমি আমার স্বামীর পদবি নেইনি। আমি এখনো বাবার পদবি দিয়েই পরিচিত। যাই হোক যে কথা বলছিলাম, ধরুন, আপনার কলমের খোঁচায় আপনার সর্বস্ব হারানোর উপক্রম হলো, তাহলে অটোগ্রাফ সবচেয়ে দামি নয়?’

‘আপনি ধোঁয়াশা করছেন মিস হোসেন। পুরো গল্পটা বলবেন না?’

‘অবশ্যই বলবো। কোনো রকম লুকোছাপা ভণিতা করব না।’

‘আপনাকে অফ দ্য রেকর্ড একটা প্রশ্ন করি? কখনো প্রেম-ভালোবাসার প্রস্তাব পাননি? এটা আমি অবশ্যই ছাপবো না।’

‘সাংবাদিকতায় অফ দ্য রেকর্ড বলে কিছুই নেই। তবে আপনাকে একটা কথা বলি, প্রেম তো কত লোকেই করতে চায়; গুণের কদর কজন করে বলুন? এই কঠিন সত্য আমি অনেক আগেই জেনেছি। সেজন্যেই বলতে পারেন জনপ্রিয়তার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময়ে কখনোই পা ফসকায়নি।জনপ্রিয়তার সিঁড়ি খুব অদ্ভুত।ওপরে ওঠার সময়ে যাদের সাথে আপনার দেখা হবে নিচে নামার সময়েও একই মুখ আপনি আবার দেখবেন। সেজন্যেই আমি সাবধানী ছিলাম। পা ফসকায়নি কখনোই।’

এই কথা বলে হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে তিনি বললেন, ‘এই যে এতক্ষণ এসে বসেছেন আপনাকে কেউ চা-কফির কথা বলেনি।এটা কোনো কথা? কী নেবেন বলুন? চা-কফি না কোল্ড ড্রিংক?’, বলে হেসে শবনম আঁচলঠিক করলেন। বাইরে মাগরিবের আজান দিয়েছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি হয়তো মাথায় কাপড় দেবেন।

আঁচল ঠিক করে তিনি বাড়ির কাজের সহকারীকে ডাক দিলেন। তার কাছে বসে থাকা বেড়ালটা বিরক্ত হয়ে উঠে চলে গেল।এত কথায় তার বোধ হয় ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছে।

‘আপনি ব্যস্ত হবেন না।’

‘খবরের কাগজের সাংবাদিককে বসিয়ে রেখে খালি মুখে পাঠালে অনর্থ হয়ে যাবে।বলা যায় না আপনি আগামীকাল এভাবে লিখলেন- ‘গিয়েছিলাম হালের জনপ্রিয় লেখক শবনম হোসেনের বাড়িতে। আধ ঘণ্টা পরে তিনি দেখা দিলেন। তার বাড়িতে এক গ্লাস জল সাধলেন না অথচ লিভিং রুমের মশারা দিব্যি আমার রক্ত পান করল। এভাবেই মধ্যবিত্তের রক্ত চুষে নাম কামায় বুর্জোয়া লেখক’। বলে খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়লেন।

‘কী যে বলেন? এভাবে কেউ লেখে নাকি?’

‘আপনি এই সাক্ষাৎকারে কঠিন কিছু শব্দ ব্যবহার করবেন বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়েত, ক্লাস স্ট্রাগল। শুনুন আপনাকে একটা মজার কথা বলি। ভারি ইংরেজি বা অন্য ভাষার শব্দব্যবহার করে আজকাল অনেকেই জ্ঞানী সাজতে চায়। অবশ্য তাদেরও দোষ নেই। একটা কথা আছে না গেয়ো যোগী ভিখ পায় না। ঠিক তেমন অন্য দেশের বুলি বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় আপনি যা লিখবেন অর্থ না বুঝলেও ঠিক একদল সহমত ভাই জোগাড় হয়ে যাবে।’

আমার ততক্ষণে এই অটোগ্রাফের গল্প শোনার নেশা ভালো করে জেঁকে বসেছে। তিনি কাউকে বিয়ে করেছিলেন? একেবারে অল্পবয়সের ভুল। কাবিননামার করা স্বাক্ষরকেই অটোগ্রাফ বলে চালাচ্ছেন?

এই সাক্ষাৎকার ছাপতে পারলে আমার নাম হবে। নিজেকে সেই মুহূর্তে কিছুটা স্বার্থপর মনে হলো। নিজের ব্যক্তিগত লাভের জন্যে আমি অন্যের গোপনীয় কাহিনী লিখছি। আমি ঠিক করলাম গল্পটা এমনভাবে লিখব যেন রগরগে না শোনায়।

কিছুক্ষণ বাদেই গৃহ সহকারী ফেরত এলো টি-সেট নিয়ে।বনেদি বাড়িতে এমন ফুলেল নকশা করা টি-সেট দেখা যায়। চা ঢেলে প্রশ্ন করলেন- ‘চিনি কয় চামচ।’

আমি এক চামচ বলে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন আমরা গল্পে ফেরত যাবো।

চা দিয়ে তিনি বললেন, ‘এই টি-সেট আমার নানা বাড়ির। মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। নানুর বিয়েতে উপহার পাওয়া এই টি-সেট অক্ষত ছিল।মজার ব্যাপার হচ্ছে যে টি-সেট আমার নানি তার জীবদ্দশায় ব্যবহার করেননি আমি দিব্যি সেসব প্রতিদিন ব্যবহার করছি। আসলে কি জানেন? বেঁচে থাকার চেয়ে বড় কোনো উপলক্ষ হয় না।তুলে রেখে লাভ কী বলুন!’

‘এই চায়ের কাপ নিয়েই তো চমৎকার ছোটগল্প হতে পারে।’

‘সে তো পারেই। যাই হোক আমি অটোগ্রাফের গল্পে ফেরত যাই। আমি তখন ক্লাস টেনেপড়ি। আমার বাবা-মা ঠিক করলেন ভারতে বেড়াতে যাবেন। সেই উপলক্ষে আমার পাসপোর্টের আবেদন করতে হবে। পাতার পর পাতা সাদা কাগজ ভরে উঠল আমার কচি হাতের স্বাক্ষরে। সত্যি কথা জানেন জীবনের প্রথম সিগনেচার যেন নিজের আইডেন্টিটির অংশ। যেখানেই কাগজ পেতাম সেখানেই সই করতাম।

‘তখনও পাসপোর্ট অফিসে এমন দালালের দৌরাত্ম্য ছিল?’

‘থাকবে না কেন? তবে আমার মায়ের ছাত্রের বাবা পাসপোর্ট অফিসের বড় কর্তা ছিলেন। আমাদের ঘুষ দিতে হয়নি। আমরা নিয়ম মেনেই জমা দিয়েছিলাম।ধানম-ির একটা স্টুডিও থেকে আমার পাসপোর্টের ছবি তোলা হয়েছিল।’

‘আমি আপনার গল্পে ইন্টেরাপ্ট করছি না তো?’

‘না প্রশ্ন করবেন। আসলে আমরা বর্ণনার সময়ে অনিচ্ছাকৃতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ডিটেল বলতে ভুলে যাই।তখন অন্য কেউ প্রশ্ন করলে বেশ সুবিধা হয়।’

‘প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত সম্পদ আসলে সাপের বিষের মতো।’

‘সেটা কেমন?’

‘আপনি জানেন সাপের বিষ থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন হয়। আপনি জানেন থ্রম্বোসিস, আর্থ্রাইটিস আর ক্যান্সারের ওষুধের উপাদান সাপের বিষ। বিষেবিষক্ষয় বলে একটা কথা আছে না? ঠিক তেমন।’

আমি ভেবে পেলাম না অটোগ্রাফের সাথে সাপের বিষের সম্পর্ক কোথায়?

তিনি বলে চলেছেন, ‘আপনার চিকৎসার যখন প্রয়োজন হবে আপনার বিত্ত আপনার জীবনদায়িনী ভূমিকা নেবে। সাপের বিষ থেকে কর্কট রোগের ওষুধ উৎপাদনের মতো। সাপের বিষ কীভাবে কাজ করে জানেন? সাপের বিষ আসলে নিউরোটক্সিন।অর্থাৎ আপনার নার্ভ সিগন্যাল পাঠাতে বাঁধার সৃষ্টি করবে।ধীরে ধীরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে মানুষ মারা যাবে।ঠিক তেমনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আপনার নার্ভাস সিস্টেম অর্থাৎ পারিবারিক গঠনে আঘাত করবে।ধীরে ধীরে হিংসা আর হানাহানিতে নিকট আত্মীয়দের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হবে। সম্পর্কেরমৃত্যু হবে।’

আমার বাবা খুব অল্প বয়সে মারা যান। দীর্ঘদিন রোগে ভোগেননি। বিছানায় পড়ে রইলেন না।হাসপাতালে গেলেন। সেখান থেকেই শেষ যাত্রায় গোরস্থান। ঠিক তখনই আমি পৃথিবীর অন্য একটা রূপ দেখলাম। আমার চাচা একটি স্ট্যাম্প পেপারনিয়ে হাজির হলেন যেখানে আমার স্বাক্ষর করা। সেই স্ট্যাম্প পেপারে লিখা ওকালতনামা অনুযায়ী আমার যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি আমি সজ্ঞানে চাচার কাছে হস্তান্তর করেছি। বাবারঅসম্ভবে চাচা সেই সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবেন।

আমি বলেছিলাম না অতিরিক্ত সম্পদ হচ্ছে সাপের বিষের মতো। আমার চাচা ধনবান মানুষ ছিলেন। সেই বিষ যেন পরিবারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ল। আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না স্বাক্ষর আমি কবে করলাম। আমার বাবার একমাত্র কন্যাসন্তান হবার সুবাদে আমি বিপুল সম্পদের অধিকারী। আমার মা আশ্চর্য হয়ে গেলেন।

চাচা প্রথমে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করার একটা চেষ্টা করলেন। আমার মামারা বাঁধা দিলেন। তিনি যাবার সময় বাড়ির দরজার দাঁড়িয়ে বলে গেলেন আমার মা আর আমাকে তিনি পথের ভিখারি করে তবে ছাড়বেন। আমার চাচা মোক্ষম সময়ে কাগজ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। ভেঙে যাওয়া দেয়ালের ইট খুলে নিয়ে যেতে সুবিধা হয়। সেই সময়ে আমার মা আর আমি হতবিহ্বল অবস্থায় ছিলাম।

ধানম-িতে আমাদের দোতলা বাড়ি আছে। সেই বাড়ির এক তলা ভাড়া দেয়া ছিল। মা বাবার ব্যবসার পার্টনারদের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। যেন তার প্রাপ্য অংশ থেকে আমরা বঞ্চিত না হই।

বাবার ব্যবসার অংশীদারেরা আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

মায়ের দুশ্চিন্তা তাতেও যায় না। তিনি জানেন আমাদের মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয় বেহাত হয়ে যাবে। এই ভয় আমাদের কুরে কুরে খেতে লাগল।ধরুন আপনার সাথে হুট্ করে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া আপনি অথৈ পাথারে পড়বেন। তবুও সামলে নিতে শিখে যাবেন।যদি আপনার কোনো খারাপ খবরের অপেক্ষা করতে হয় সেটা একটা ভয়ংকর ব্যাপার। আপনার হাতে কিছু নেই অথচ ভয়টা আপনাকে সবর্দা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।এর চেয়ে খারাপ বোধ করি কিছুই হয় না।

ভর দুপুরে আমরা মা-মেয়ে শুয়ে আছি বিছানায়। বিজবিজ শব্দে এসি চলছে। এমন সময় মা বললেন, ‘আমাদের এই আয়েশের জীবন থেকে দূরে থাকার মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে।’

আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, ‘আমি জেনেশুনে আমাদের এতো বড় ক্ষতি করিনি।বাবার অফিসে স্ট্যাম্প পেপার দেখে হয়তো অসাবধানে আমি স্বাক্ষর করেছিলাম। আমার ধারণা আমার বাবার সেক্রেটারি ভদ্রলোক এর সাথে জড়িত ছিলেন। বাবার স্টাডি থেকে আমার সই করা স্ট্যাম্প পেপার আমার চাচাকে দিয়েছিলেন।’

আমার মা বিছানা থেকে উঠে বসলেন, ‘কী বলছো এসব?’

মায়ের মনে হয়তো ক্ষীণ আশার একটা সম্ভাবনা ছিল যে স্বাক্ষর নকল। আমার মুখে স্বীকারোক্তি সকল হিসাব ওলটপালট করে দিলো। মা দুই হাতে মাথা ধরে বসে রইলেন। এমন সময় বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠল।

মা ধাতস্থ হয়ে দরজা খুলতে গেলেন। আমিও মায়ের পেছনে পেছনে গেলাম। সাদা দাড়িওয়ালা চশমা পরা মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।

মাকে সালাম দিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ভেতরে আসতে পারি?’

‘আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না।’

‘আপনি তো প্রয়াত মশিউল হোসেনের স্ত্রী। আপনার স্বামী আমার ল ফার্মকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।’

মা ভদ্রলোককে ঘরে এনে বসালেন। তিনি নিজের পরিচয় দলেন জেড আই খান পান্না নামে। আমি ছোট মানুষ তাঁকে চিনতাম না। এখন তো সবাই তাকে চেনেন।

আমার বাবা তার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি আমার মায়ের নাম রেজিস্ট্রি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। একটা দানপত্র বের করে দেখালেন।

আমার মা খুশিতে কেঁদে ফেললেন।

ভদ্রলোক মাকে আশ^স্ত করে জানালেন, ‘আমার বাবা হয়তো একমাত্র সন্তানের সুরক্ষার জন্যই এই পথ বেছে নিয়েছিলেন।’

মা তাকে আমার চাচার ঘটনা বললেন। ভদ্রলোক শিউরে উঠলেন পুরোটা শুনে।

সেই যাত্রায় আমরা মহাবিপদ থেকে রক্ষা পেলাম।

আমি বললাম, ‘তারপর? আপনি এই ঘটনা কোনো উপন্যাসে ব্যবহার করেননি?’

‘না। করিনি।সত্য কথা শোনায় বক্তৃতার মতো আর মিথ্যেশোনায় কবিতার মতো।সবাই তো কবিতা শুনতে চায়।’

আমি বললাম, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন।সবাই কবিতা শুনতে চায়।মিথ্যে জেনেও শুনতে চায়।সত্য কথা শোনার সাহস আমাদের সবার থাকে না।তবে আপনি অকপটে যা বলেছেন তা আমি অবশ্যই লিখব।’

শবনম হোসেন হাসলেন। তার দুই চোখে হাসির ঝিলিক দেখা গেল। তিনি আমাকে এগিয়ে দিলেন।

আমি দরজায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘একটা কথা বলুন তো সবাইকে রেখে আমাকেই বা কেন এই গল্প বলতে গেলেন?’

বাম চোখের ভ্রু ঈষৎ উঁচু করে বললেন, ‘আপনাকে একটা গোপন কথা বলি আমাকে নিয়ে লেখা যতগুলো হেডলাইন হয়েছে সব আমার জানা মতেই হয়েছে। এই ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি।’

আমি হেঁটে যাচ্ছি গাড়ির দিকে। শবনম হোসেনেরউপন্যাসে থাকে আলোর গল্প।সর্বভেদী আলো যা আঁধার কেটে তার উপস্থিতি জানান দেয়। ল্যাম্প পোস্টের আলোতে শবনম হোসেনের আবছা সিলুয়েট দেখা যাচ্ছে। অপরাহ্ণের অন্ধকারে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার জীবনের আঁধারের গল্পটা আমি জেনে গেছি।

back to top