alt

সাময়িকী

সিরীয়-মার্কিন লেখক

ওসামা অ্যালোমারের একঝুড়ি খুদে গল্প

অনুবাদ: ফজল হাসান

: বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

শিল্পী : শতাব্দী জাহিদ

ভূমিকা

‘তিনি (ওসামা অ্যালোমার) জাদুকরী কল্পনাশক্তির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে গভীর, নৈতিক এবং অকথিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়গুলো অল্প কথায় তুলে ধরেন।’

এভাবেই সিরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ওসামা অ্যালোমারের অল্প কথার গল্প সম্পর্কে বিশ্বনন্দিত অণুগল্প লেখিকা লিডিয়া ডেভিস মন্তব্য করেছেন এবং বিশ্ব সাহিত্যের পাঠকমহলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, ইতোমধ্যে অ্যালোমার অণুঅল্প লেখায় পারঙ্গমতা অর্জন করেছেন এবং লেখক হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি মনে করেন, অণুগল্প হলো একধরনের গুলি, যা অত্যন্ত তীব্র গতিসম্পন্ন। ফ্রান্ৎস কাফকা, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং আর্থার রেবোঁর অল্প কথার গল্প তাঁকে অণুগল্প লেখায় প্রভাবিত করেছে।

ওসামা অ্যালোমার একাধারে একজন অণুগল্প লেখক, কবি এবং প্রাবন্ধিক। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় এবং লেখক হবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে শরণার্থী হিসেবে ২০০৮ সালে তিনি সপরিবারে আমেরিকায় যান। জীবিকার তাগিদে প্রথম আট বছর ট্যাক্সি চালক ছিলেন। কিন্তু সেই সময় কাজের মাঝে ফুরসৎ পেলেই কাগজ ও কলম নিয়ে লিখতে বসতেন। অবশেষে ২০১৭ সালে তিনি ‘রাইটার-ইন-রেসিডেন্সি’ লাভ করেন। তাঁর প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘ও ম্যান’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে এবং প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ম্যান সেইড দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। আরবি ভাষায় প্রকাশিত তাঁর অন্যান্য ছোটগল্প সংকলনের মধ্যে রয়েছে ‘টাঙ টাই’ (২০০৩) এবং ‘অল রাইটস্ নট রিজার্ভড্’ (২০০৮)। এছাড়া তাঁর ঝুড়িতে রয়েছে ইংরেজিতে অনূদিত অণুগল্প সংকলন ‘ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান’ (২০১৪) এবং ‘দ্য টীথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ (২০১৭)। তিনি ২০০৭ সালে মিশরের ‘নাজলা মুহাররম শর্ট স্টোরি’ প্রতিযোগিতায় শিরোপা লাভ করেন। আরবি ভাষায় লেখা তাঁর সাহিত্য আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয় এবং বিবিসি অ্যারাবিক সার্ভিসে প্রচারিত হয়। ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর লেখা অণুগল্প ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’, ‘ওয়ার্ডস্ উইদাউট বর্ডার্স’, ‘প্যারিস রিভিউ’ এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে, যেমন ‘নুন’, ‘কঞ্জাংশন’, ‘দ্য কফিন ফ্যাক্টরি’, ‘দ্য আউটলেট’ (‘ইলেকট্রিক লিটারেচার’-এর ব্লগ) এবং ‘লিটারেরি রিভিউ’, প্রকাশিত হয়। বর্তমানে তিনি শিকাগোতে বাস করেন।

অনূদিত খুদে গল্পগুলো লেখকের ‘দ্য টীথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ গল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত, যা আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সি জে কলিন্স।

জীবনের যাত্রা

আমি মানুষের ভিড়ের মাঝে হেঁটেছি, হাজার হাজার কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে তাকে খুঁজেছি। তাকে খোঁজার জন্য আমি পাহাড়-পর্বত ও উপত্যকা, সাগর ও সমতল ভূমি অতিক্রম করেছি। ভিড়ের মাঝে খোঁজার সময় আমি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে হেঁটেছি। আমার সঙ্গে ছিল কম্পাস এবং দশটিরও বেশি মানচিত্র। আমি সব দিকে তাকিয়ে দেখেছি। আমার শরীর বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছিল এবং উৎকণ্ঠা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আমি উত্তর দিকে আমার চলার পথ অব্যাহত রেখেছি। প্রচ- ঠা-া আমাকে প্রায় মেরে ফেলেছিল... হে সৃষ্টিকর্তা... সে কোথায়?... সে কোথায়? আমি যতটা সম্ভব চিৎকার করেছি... চারপাশ থেকে প্রশ্নবোধক চিহ্নরা আমাকে ডেকেছে। তার সম্পর্কে আমি পথচারীদের জিজ্ঞেস করেছি। আমি মানুষের মাঝে হেঁটেছি এবং আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ডেকেছি, ‘তুমি কোথায়, আমার প্রিয়? আমি অনুনয়-বিনয়ের সঙ্গে বলেছি: আমাকে তোমার মুখ দেখাও।’

শুধু উদাসীনতা এবং জীবনের নিষ্প্রভ ছন্দ আমাকে জবাব দিয়েছে।

একটু একটু করে আমার বয়স বাড়তে থাকে... আমি আমার বেশিরভাগ ওজন হারিয়েছি। আমার পা আগের তুলনায় অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমি একটি লাঠি কিনি এবং তাকে খুঁজে বের করার জন্য অনেক বছর আগে শুরু করা যাত্রা আমি চালিয়ে যাই। আমি এমন স্থানগুলোতে গিয়েছি, যেখানে অশরীরীরা কখনো যেতে পারেনি। আমি পাথর এবং ভয়ের তৈরি গুহায় বিশ্রাম নিয়েছি। আমি বন্য জীবজন্তু থেকে পালিয়েছি, যারা আমাকে নিজেদের ক্ষুধা মেটানোর জন্য যৎসামান্য খাদ্য বানাতে প্রায়প্রস্তুত ছিল। আমি পৃথিবী অতিক্রম করেছি, পূর্ব এবং পশ্চিমে... উত্তর এবং দক্ষিণে... আমার টলতে থাকা পায়ের পদক্ষেপ আমার ভুল সৌভাগ্যের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। আমি নিচে পড়ে গিয়েছিলাম... তারুণ্যের উৎসাহ নিয়ে বার্ধক্য আমার শরীরে বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করেছে। আমার মাথা রক্তাক্ত হয়েছে। আমি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে মাথা উঁচু করে রেখেছি এবং ক্লান্তি আর অবসাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, যা আমার মাথা নিচে নামাতে চেষ্টা করছিল। আমি দূরের দিগন্তের দিকে তাকিয়েছি- আশা ছিল আমি হয়তো একদিন তার কোনো চিহ্ন দেখতে পাবো। হতাশার জলাভূমি আশা-আকাক্সক্ষার ঝলমলে হ্রদের তীর ঘিরে রেখেছিল, যেন গিলতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমি সমস্ত শক্তি নিয়ে আমার দুর্বল হাত দুটি অতীতের দিকে প্রসারিত করেছি এবং আমার তারুণ্যের শক্তি থেকে যা কিছু আহরণ করা সম্ভব, তার সবটুকুই সংগ্রহ করেছি।

শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানবতার সন্ধান লাভের আশায় আমি আমার কম্পিত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকি এবং একসময় আমার যাত্রা অব্যাহত রাখি।

মানসিক প্রাচীর

আমি মানসিক প্রাচীরের চূড়ায় উঠেছিলাম, যা আমাকে এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছ থেকে আলাদা করেছিল। কিন্তু আমি সেই চূড়া থেকে নিচে পড়ে যাই এবং আমার পা ভেঙে যায়। কর্মকর্তা প্রাচীরের উপর দিয়ে তাকিয়ে আমাকে দেখেন। তিনি অপমানের পা দিয়ে আমার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানকে লাথি মারেন এবং আমাকে জেলে নিক্ষেপ করেন। পরদিন তিনি তাঁর প্রাসাদকে মানসিক বৈদ্যুতিক প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলেন!

অবতরণকারী!

যে এলিভেটরটি উপরের তলায় যাচ্ছিল, সে নিচের সর্বনিম্ন তলায় ধাবমান তার সহকর্মীর দিকে তাকায় এবং তাচ্ছিল্যপূর্ণ কণ্ঠে তাকে বলল, ‘অবতরণকারী!’

কিন্তু কিছুক্ষণ পর তাদের ভূমিকা পরিবর্তিত হয় এবং তার সঙ্গে তাদের নামও।

পর্দা বন্ধ করা

আমি বারান্দার মোটা ভারি পর্দা টেনে দেই, যেন আমার প্রতিবেশীরা আমার চার স্ত্রী এবং আমার যুবতী মেয়েদের দেখতে না পারে। তারপর আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আবিষ্কার করি যে, এটাই হলো অন্য পুরুষদের স্ত্রী এবং তাদের যুবতী মেয়েদের দেখার জন্য একটি নিখুঁত ব্যবস্থা!

তারা আমার দিকে জিভ বের করে আছে!

যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন সব সময় আমি বুড়ো মানুষদের দিকে তাকিয়ে হাসতাম। এখন আমি বুড়ো হয়েছি এবং আমার যৌবনের সমস্তস্মৃতিরা আমার দিকে জিভ বের করে আছে। তারা নিজেদের ভুরু নাচাতে শুরু করেছে এবং বলছে, ‘এই যে বুড়ো!’

৯৯তম বিশ্ব থেকে দেখা দৃশ্যাবলি

শহরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে আমি দেখেছি স্বাধীনতা চত্বরে মানুষের জিহ্বা একসঙ্গে বেঁধে রাখা রয়েছে। জিহ্বাগুলো যেন বিশাল আফিম-ফুলের তোড়া, যা সাজসজ্জা হিসেবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

আমি শুনতে পাচ্ছি ক্রমাগত যুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত একটি দেশের মনোবল ভেঙে পড়া আতঙ্কিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস।

আমি দেখতে পাচ্ছি তরুণ জীবনের উজ্জ্বল ¯্রােতধারা একটি মৃত সাগরে গিয়ে পড়ছে।

আমি দেখতে পাচ্ছি অলসতা হাজার হাজার মুখোশ পড়ে সীমাহীন ছদ্মবেশী যাত্রায়...

আমি মানুষের মুখাবয়ব পড়ার চেষ্টা করি... ব্যক্তিগত গাড়িতে এবং সাধারণ যানবাহনে... আশেপাশের মহল্লায় এবং অলিগলিতে... মানব দাসত্বের ইতিহাস বর্ণনা করা ছেঁড়া মোটা বই, যেগুলো থেকে কালি শুকিয়ে যাচ্ছে।

আর তাই আমি আমার যাত্রা পুনরায় শুরু করেছি এবং হাঁটতে হাঁটতে গুনগুন করছি।

আমাদের দেশের নিয়ম-কানুন

যখন আমি দেখলাম যে, কোনো ধরনের অনুসন্ধানের সম্মুখীন না হয়ে সেসব দেশের নাগরিকরা কীভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে- তাদের স্যুটকেস খুলতে হয়না, নিরাপত্তাকর্মীদের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির সম্মুখীন হতে হয় না; তাদের শুধু পরিচয়পত্র দেখাতে হয় এবং চটজলদি তা জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে হয়, যেন হাসি ও বিনীত কথাবার্তা তাদের চারপাশে একটি সোনালি ফিতার মতো আবদ্ধ করে রেখেছে- যখন আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে এসব দেখেছি, তখন আমি আমাদের দেশের নিয়ম-কানুনের কথা চিন্তা করেছি, যেখানে আমি সীমান্ত অতিক্রম করে ভাইয়ের দেশে যেতে চাইলে আমাকে অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ এবং জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে বাধ্য করা হয়।

শান্তি চুক্তি

শক্তিশালী এবং দুর্বল লোক একটা শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে; দুর্বল লোকটি স্বাক্ষর করা দলিল একটা সোনার ফ্রেমে বাঁধাই করেছে এবং তার বাড়ির সামনের কক্ষে ঝুলিয়ে রেখেছে। ছবি এবং নিবন্ধসহ ঘটনাটি জনসাধারণের কাছে প্রচার করার জন্য সে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছে। সে মনে করেছে যে, তার পুনর্জন্ম হয়েছে। অন্যদিকে শক্তিশালী লোকটি তার দলিলটি শিশুর মল পরিস্কার করার জন্য ব্যবহার করেছে।

মহামূল্যবান

বছরের পর বছর খোঁজাখুঁজি করার পরে আমি অবশেষে সেই আকাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছেছি, যেখানে আমি স্বাধীনতা দেখতে পাবো। প্রদর্শনের জন্য তাকে একটি জাদুঘরে রাখা হয়েছে, চারপাশ কাঁটা তারে ঘেরা এবং হাজার হাজার ভারি অস্ত্রধারী লোকেরা পাহারা দিচ্ছে। তাকে দেখে আমার কাছে দুঃখী এবং ক্ষত-বিক্ষত মনে হলো। যখন আমি একজন পাহারাদারকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি এখানে কেন, তখন পাহাদার আমার হাত ধরে কাছে টেনে ফিসফিস করে বলল, ‘তিনি মহামূল্যবান।’

বিস্ফোরণ... বিস্ফোরণ...

ফাতি সোফায় বসে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে খবর দেখছিলেন। তখন গাড়ি বোমা হামলায় নিহতদের সংবাদ সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছিল। ক্ষত-বিক্ষত দেহ এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ শুনে আহতরা কাঁদছেন।

নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় কাতর ফাতি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি দেশের পরিস্থিতি যা হয়েছে, তা দেখে ভীষণ দুঃখিত। তাঁর স্ত্রীর চোখ ভেজা এবং বাচ্চারা স্তব্ধ হয়ে টেলিভিশনের পর্দার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর অসম্ভব ঘটনা: প্রথমটির মতো একই জায়গায় বোমা লুকিয়ে রাখা অন্য আরেকটি গাড়ি বিস্ফোরিত হয় এবং বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজে টেলিভিশনের পর্দা ফেটে যায়। জ্বলন্ত কাঁচের টুকরো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং ঘটনাস্থলেই ফাতির একটি শিশু মারা যায়। বাকিরা সবাই বিভিন্নভাবে আহত হয়। দেশজুড়ে একই ঘটনা ঘটেছে এবং সেই মুহূর্তে যারা খবর দেখছিলেন, তারা অনেকেই বিস্ফোরণের শিকার হয়েছেন। অন্য যে কোনো দুর্যোগের মতো এটিও ছিল জাতীয় দুর্যোগ।

সারা দেশের সমস্ত পরিবার তৎক্ষণাৎ তাদের টেলিভিশনের সংবাদ চ্যানেল বন্ধ করে দেন এবং চলচ্চিত্র, সোপ অপেরা, গান ও শৌখিনভাবে ক্যামেরায় তোলা ছবির প্রদর্শনী দেখায় নিজেদের ব্যস্ত রাখেন। একটু একটু করে মানুষ ভুলে যাচ্ছে রাজনীতি আর তার বিয়োগান্তক পরিণতি। দেশ চরম সুখের জোয়ারে জেগে ওঠে এবং চিরদিন সবাই সুখে-আনন্দে বাস করে।

কে কাকে নেতৃত্ব দেয়

গাধাটি তার ভ্রমণকারী বিক্রেতা মনিবকে পিঠে নিয়ে কয়েক মিটারও হাঁটেনি। হঠাৎ সে থেমে যায় এবং একটুও নড়ে না। মনিব তার দুই পা দিয়ে গাধাকে চাটি মারে, কিন্তু তার চেষ্টা বৃথা যায়। সে নেমে তার সর্বশক্তি দিয়ে গাধার লাগাম ধরে টানতে থাকে, কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হয় না। সে তার মনে আসা প্রতিটি অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে গাধাকে অভিশাপ দিতে শুরু করে।

গাধা প্রতিবাদে গর্জে ওঠে, ‘আমার মনে হয় এবার আপনার উচিত আমাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া! আপনি জানেন যে, আমি এখান থেকে একটুও নড়ব না, যতক্ষণ না আপনি আমাকে আপনার পিঠে বহন করেন। কারণ আমি আপনাকে এতগুলো বছর নীরবে বহন করেছি। খুব অদ্ভুত ব্যাপার স্যার, তাই না! আমরা গাধা গোষ্ঠী সারা জীবন ধরে যে অধঃপতন ও লজ্জার সম্মুখীন হই, তার বিরুদ্ধে একবারও কি আমরা বিদ্রোহ করার অধিকার রাখি না? আমাদের অধিকারের বিষয়ে আপনার সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব নয় এবং আমরা কীভাবে আমাদের সম্প্রদায়কে রক্ষা করব, যখন আপনি একটি অদ্ভুত ভাষায় কথা বলেন এবং আপনার কণ্ঠস্বর কদর্যতার শীর্ষে পৌঁছে! তাই বিদ্রোহ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আপনারা প্রাকৃতিকভাবে নিজেদের বুদ্ধিমান প্রজাতির প্রাণি বলে মনে করলে বিষয়টা বুঝতে পারতেন!’

অন্ধকার দিক

মানুষ একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে যে অনেক নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে এবং ভয়ঙ্কর অপরাধ করে, তার জন্য চাঁদ মানুষকে শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে। তাই চাঁদ নিজের আলোকিত দিকটি লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে মানুষেরা তাদের আচরণকে সংযত করে এবং যুক্তিতে ফিরে আসে। আর তাতেই এই চন্দ্রগ্রহণ। কিন্তু চাঁদের অপার বিস্ময় জাগে, যখন সে লক্ষ কোটি মানুষকে তার অন্ধকার দিকের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছে।

পিসার মিনার

চারপাশে খুঁতখুঁতে দৃষ্টিতে তাকিয়ে পিসা শহরের বিখ্যাত মিনারটি বলল: ‘শত শত বছর পেরিয়ে গেছে এবং আমার চারপাশের সবকিছু এখনো হেলে আছে। কী করে এই অদ্ভুত ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটবে?’

সবচেয়ে বড় পাহাড়

রাতটা ছিল বেশ পরিষ্কার। শহরের ঢালু সরু গলিতে এবং যারা রাত জেগে থাকতে পছন্দ করত, তাদের বাড়ির আলো পাহাড় জুড়েছড়িয়ে পড়েছিল। তবে কিছু সংখ্যক বাতি আলাপ-আলোচনায় মগ্ন ছিল।

আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে একটা বাতি তার বন্ধুকে বলল, ‘অই বাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ, যেগুলো বিশাল পাহাড়কে ঘিরে রয়েছে। এরকম অনেক বাতি আছে! যেদিকে তাকাও না কেন, সবদিকে বাতির ছড়াছড়ি দেখতে পাবে। আমরা সংখ্যায় ওদের মতো এত বেশি নই কেন?’

অগণিত তারার দিকে মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা করার সময় তার বন্ধু জবাবে বলল, ‘সম্ভবত এ কারণে যে, সবচেয়ে বড় পাহাড়ের বাসিন্দাদের সংখ্যা আমাদের বাসিন্দাদের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।’

আলো এবং রঙধনু

অসংযত আলো এক রাশ বিরক্তি নিয়ে রঙধনুকে বলল, ‘তুমি ভীষণ কাপুরুষ!’

জবাবে রঙধনু ধীরস্থির, শান্ত গলায় বলল, ‘বোকাদের জন্য আমার অন্তরে যথেষ্ট জায়গা আছে।’

পুষ্পশোভিত দিন

সপ্তাহের দিনগুলো তর্ক করছিল যে, কোনটি সবচেয়ে বিশিষ্ট এবং ‘পুষ্পশোভিত দিন’ উপাধি পাওয়ার যোগ্য। তাদের তর্ক এতটাই তিক্ত হয়ে উঠেছিল যে, তারা একে অপরের কাছ থেকে আরও বেশি দূরে সরে যেতে শুরু করে। আর তাই জীবনের যাত্রা ধীর থেকে আরও ধীর গতিতে চলতে থাকে।

ছবি

ফিলিস্তিনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে অণুগল্প

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

শিল্পী সুনীল কুমারের ‘পথের গল্প’-এর স্বরূপ

ছবি

রাত গভীর

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

‘এ নয় আঁখিজল’

জ্যৈষ্ঠের পদাবলি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কাব্যগ্রন্থে নীলদ্রোহের রেখাপাত

ছবি

নার্গিস-নজরুলের স্মৃতিধন্য দৌলতপুরে একদিন

ছবি

যেভাবে ভেঙেছিল এক মৌনতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

নজরুল সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের প্রেক্ষিত

ছবি

স্বাধীনতার কবি নজরুল

ছবি

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রতিভা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দাউদ হায়দার: স্বকীয় ও নির্বাসিত

ছবি

অটোগ্রাফ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

আলবেয়ার কামুর গল্পে অস্তিত্বের নিষ্ঠুরতা

ছবি

উপন্যাসের জন্মবীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কানাগলি

ছবি

পার্ল এস বাক-এর কবিতা

ছবি

হোসে এচেগারাই স্প্যানিশ আলোকবর্তিকা

ছবি

নববীণায় বাজে নতুনের জয়গান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের ‘করুণা’ ঘিরে কিছু কথা

ছবি

গীতাঞ্জলির ইতিবৃত্ত ও বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ

ছবি

রবীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ ও ‘ছিন্নপত্র’

ছবি

নিউ নেদারল্যান্ডস: জার্র্সি এবং লেনাপি জনগোষ্ঠী

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বকুলীর সেইরাত

ছবি

আকাশের প্রান্ত

tab

সাময়িকী

সিরীয়-মার্কিন লেখক

ওসামা অ্যালোমারের একঝুড়ি খুদে গল্প

অনুবাদ: ফজল হাসান

শিল্পী : শতাব্দী জাহিদ

বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

ভূমিকা

‘তিনি (ওসামা অ্যালোমার) জাদুকরী কল্পনাশক্তির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে গভীর, নৈতিক এবং অকথিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়গুলো অল্প কথায় তুলে ধরেন।’

এভাবেই সিরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ওসামা অ্যালোমারের অল্প কথার গল্প সম্পর্কে বিশ্বনন্দিত অণুগল্প লেখিকা লিডিয়া ডেভিস মন্তব্য করেছেন এবং বিশ্ব সাহিত্যের পাঠকমহলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, ইতোমধ্যে অ্যালোমার অণুঅল্প লেখায় পারঙ্গমতা অর্জন করেছেন এবং লেখক হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি মনে করেন, অণুগল্প হলো একধরনের গুলি, যা অত্যন্ত তীব্র গতিসম্পন্ন। ফ্রান্ৎস কাফকা, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং আর্থার রেবোঁর অল্প কথার গল্প তাঁকে অণুগল্প লেখায় প্রভাবিত করেছে।

ওসামা অ্যালোমার একাধারে একজন অণুগল্প লেখক, কবি এবং প্রাবন্ধিক। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় এবং লেখক হবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে শরণার্থী হিসেবে ২০০৮ সালে তিনি সপরিবারে আমেরিকায় যান। জীবিকার তাগিদে প্রথম আট বছর ট্যাক্সি চালক ছিলেন। কিন্তু সেই সময় কাজের মাঝে ফুরসৎ পেলেই কাগজ ও কলম নিয়ে লিখতে বসতেন। অবশেষে ২০১৭ সালে তিনি ‘রাইটার-ইন-রেসিডেন্সি’ লাভ করেন। তাঁর প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘ও ম্যান’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে এবং প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ম্যান সেইড দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। আরবি ভাষায় প্রকাশিত তাঁর অন্যান্য ছোটগল্প সংকলনের মধ্যে রয়েছে ‘টাঙ টাই’ (২০০৩) এবং ‘অল রাইটস্ নট রিজার্ভড্’ (২০০৮)। এছাড়া তাঁর ঝুড়িতে রয়েছে ইংরেজিতে অনূদিত অণুগল্প সংকলন ‘ফুলব্লাড অ্যারাবিয়ান’ (২০১৪) এবং ‘দ্য টীথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ (২০১৭)। তিনি ২০০৭ সালে মিশরের ‘নাজলা মুহাররম শর্ট স্টোরি’ প্রতিযোগিতায় শিরোপা লাভ করেন। আরবি ভাষায় লেখা তাঁর সাহিত্য আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয় এবং বিবিসি অ্যারাবিক সার্ভিসে প্রচারিত হয়। ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর লেখা অণুগল্প ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’, ‘ওয়ার্ডস্ উইদাউট বর্ডার্স’, ‘প্যারিস রিভিউ’ এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে, যেমন ‘নুন’, ‘কঞ্জাংশন’, ‘দ্য কফিন ফ্যাক্টরি’, ‘দ্য আউটলেট’ (‘ইলেকট্রিক লিটারেচার’-এর ব্লগ) এবং ‘লিটারেরি রিভিউ’, প্রকাশিত হয়। বর্তমানে তিনি শিকাগোতে বাস করেন।

অনূদিত খুদে গল্পগুলো লেখকের ‘দ্য টীথ অব দ্য কম্ব অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ গল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত, যা আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সি জে কলিন্স।

জীবনের যাত্রা

আমি মানুষের ভিড়ের মাঝে হেঁটেছি, হাজার হাজার কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে তাকে খুঁজেছি। তাকে খোঁজার জন্য আমি পাহাড়-পর্বত ও উপত্যকা, সাগর ও সমতল ভূমি অতিক্রম করেছি। ভিড়ের মাঝে খোঁজার সময় আমি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে হেঁটেছি। আমার সঙ্গে ছিল কম্পাস এবং দশটিরও বেশি মানচিত্র। আমি সব দিকে তাকিয়ে দেখেছি। আমার শরীর বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছিল এবং উৎকণ্ঠা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আমি উত্তর দিকে আমার চলার পথ অব্যাহত রেখেছি। প্রচ- ঠা-া আমাকে প্রায় মেরে ফেলেছিল... হে সৃষ্টিকর্তা... সে কোথায়?... সে কোথায়? আমি যতটা সম্ভব চিৎকার করেছি... চারপাশ থেকে প্রশ্নবোধক চিহ্নরা আমাকে ডেকেছে। তার সম্পর্কে আমি পথচারীদের জিজ্ঞেস করেছি। আমি মানুষের মাঝে হেঁটেছি এবং আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ডেকেছি, ‘তুমি কোথায়, আমার প্রিয়? আমি অনুনয়-বিনয়ের সঙ্গে বলেছি: আমাকে তোমার মুখ দেখাও।’

শুধু উদাসীনতা এবং জীবনের নিষ্প্রভ ছন্দ আমাকে জবাব দিয়েছে।

একটু একটু করে আমার বয়স বাড়তে থাকে... আমি আমার বেশিরভাগ ওজন হারিয়েছি। আমার পা আগের তুলনায় অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমি একটি লাঠি কিনি এবং তাকে খুঁজে বের করার জন্য অনেক বছর আগে শুরু করা যাত্রা আমি চালিয়ে যাই। আমি এমন স্থানগুলোতে গিয়েছি, যেখানে অশরীরীরা কখনো যেতে পারেনি। আমি পাথর এবং ভয়ের তৈরি গুহায় বিশ্রাম নিয়েছি। আমি বন্য জীবজন্তু থেকে পালিয়েছি, যারা আমাকে নিজেদের ক্ষুধা মেটানোর জন্য যৎসামান্য খাদ্য বানাতে প্রায়প্রস্তুত ছিল। আমি পৃথিবী অতিক্রম করেছি, পূর্ব এবং পশ্চিমে... উত্তর এবং দক্ষিণে... আমার টলতে থাকা পায়ের পদক্ষেপ আমার ভুল সৌভাগ্যের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। আমি নিচে পড়ে গিয়েছিলাম... তারুণ্যের উৎসাহ নিয়ে বার্ধক্য আমার শরীরে বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করেছে। আমার মাথা রক্তাক্ত হয়েছে। আমি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে মাথা উঁচু করে রেখেছি এবং ক্লান্তি আর অবসাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, যা আমার মাথা নিচে নামাতে চেষ্টা করছিল। আমি দূরের দিগন্তের দিকে তাকিয়েছি- আশা ছিল আমি হয়তো একদিন তার কোনো চিহ্ন দেখতে পাবো। হতাশার জলাভূমি আশা-আকাক্সক্ষার ঝলমলে হ্রদের তীর ঘিরে রেখেছিল, যেন গিলতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমি সমস্ত শক্তি নিয়ে আমার দুর্বল হাত দুটি অতীতের দিকে প্রসারিত করেছি এবং আমার তারুণ্যের শক্তি থেকে যা কিছু আহরণ করা সম্ভব, তার সবটুকুই সংগ্রহ করেছি।

শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানবতার সন্ধান লাভের আশায় আমি আমার কম্পিত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকি এবং একসময় আমার যাত্রা অব্যাহত রাখি।

মানসিক প্রাচীর

আমি মানসিক প্রাচীরের চূড়ায় উঠেছিলাম, যা আমাকে এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছ থেকে আলাদা করেছিল। কিন্তু আমি সেই চূড়া থেকে নিচে পড়ে যাই এবং আমার পা ভেঙে যায়। কর্মকর্তা প্রাচীরের উপর দিয়ে তাকিয়ে আমাকে দেখেন। তিনি অপমানের পা দিয়ে আমার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানকে লাথি মারেন এবং আমাকে জেলে নিক্ষেপ করেন। পরদিন তিনি তাঁর প্রাসাদকে মানসিক বৈদ্যুতিক প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলেন!

অবতরণকারী!

যে এলিভেটরটি উপরের তলায় যাচ্ছিল, সে নিচের সর্বনিম্ন তলায় ধাবমান তার সহকর্মীর দিকে তাকায় এবং তাচ্ছিল্যপূর্ণ কণ্ঠে তাকে বলল, ‘অবতরণকারী!’

কিন্তু কিছুক্ষণ পর তাদের ভূমিকা পরিবর্তিত হয় এবং তার সঙ্গে তাদের নামও।

পর্দা বন্ধ করা

আমি বারান্দার মোটা ভারি পর্দা টেনে দেই, যেন আমার প্রতিবেশীরা আমার চার স্ত্রী এবং আমার যুবতী মেয়েদের দেখতে না পারে। তারপর আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আবিষ্কার করি যে, এটাই হলো অন্য পুরুষদের স্ত্রী এবং তাদের যুবতী মেয়েদের দেখার জন্য একটি নিখুঁত ব্যবস্থা!

তারা আমার দিকে জিভ বের করে আছে!

যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন সব সময় আমি বুড়ো মানুষদের দিকে তাকিয়ে হাসতাম। এখন আমি বুড়ো হয়েছি এবং আমার যৌবনের সমস্তস্মৃতিরা আমার দিকে জিভ বের করে আছে। তারা নিজেদের ভুরু নাচাতে শুরু করেছে এবং বলছে, ‘এই যে বুড়ো!’

৯৯তম বিশ্ব থেকে দেখা দৃশ্যাবলি

শহরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে আমি দেখেছি স্বাধীনতা চত্বরে মানুষের জিহ্বা একসঙ্গে বেঁধে রাখা রয়েছে। জিহ্বাগুলো যেন বিশাল আফিম-ফুলের তোড়া, যা সাজসজ্জা হিসেবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

আমি শুনতে পাচ্ছি ক্রমাগত যুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত একটি দেশের মনোবল ভেঙে পড়া আতঙ্কিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস।

আমি দেখতে পাচ্ছি তরুণ জীবনের উজ্জ্বল ¯্রােতধারা একটি মৃত সাগরে গিয়ে পড়ছে।

আমি দেখতে পাচ্ছি অলসতা হাজার হাজার মুখোশ পড়ে সীমাহীন ছদ্মবেশী যাত্রায়...

আমি মানুষের মুখাবয়ব পড়ার চেষ্টা করি... ব্যক্তিগত গাড়িতে এবং সাধারণ যানবাহনে... আশেপাশের মহল্লায় এবং অলিগলিতে... মানব দাসত্বের ইতিহাস বর্ণনা করা ছেঁড়া মোটা বই, যেগুলো থেকে কালি শুকিয়ে যাচ্ছে।

আর তাই আমি আমার যাত্রা পুনরায় শুরু করেছি এবং হাঁটতে হাঁটতে গুনগুন করছি।

আমাদের দেশের নিয়ম-কানুন

যখন আমি দেখলাম যে, কোনো ধরনের অনুসন্ধানের সম্মুখীন না হয়ে সেসব দেশের নাগরিকরা কীভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে- তাদের স্যুটকেস খুলতে হয়না, নিরাপত্তাকর্মীদের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির সম্মুখীন হতে হয় না; তাদের শুধু পরিচয়পত্র দেখাতে হয় এবং চটজলদি তা জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে হয়, যেন হাসি ও বিনীত কথাবার্তা তাদের চারপাশে একটি সোনালি ফিতার মতো আবদ্ধ করে রেখেছে- যখন আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে এসব দেখেছি, তখন আমি আমাদের দেশের নিয়ম-কানুনের কথা চিন্তা করেছি, যেখানে আমি সীমান্ত অতিক্রম করে ভাইয়ের দেশে যেতে চাইলে আমাকে অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ এবং জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে বাধ্য করা হয়।

শান্তি চুক্তি

শক্তিশালী এবং দুর্বল লোক একটা শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে; দুর্বল লোকটি স্বাক্ষর করা দলিল একটা সোনার ফ্রেমে বাঁধাই করেছে এবং তার বাড়ির সামনের কক্ষে ঝুলিয়ে রেখেছে। ছবি এবং নিবন্ধসহ ঘটনাটি জনসাধারণের কাছে প্রচার করার জন্য সে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছে। সে মনে করেছে যে, তার পুনর্জন্ম হয়েছে। অন্যদিকে শক্তিশালী লোকটি তার দলিলটি শিশুর মল পরিস্কার করার জন্য ব্যবহার করেছে।

মহামূল্যবান

বছরের পর বছর খোঁজাখুঁজি করার পরে আমি অবশেষে সেই আকাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছেছি, যেখানে আমি স্বাধীনতা দেখতে পাবো। প্রদর্শনের জন্য তাকে একটি জাদুঘরে রাখা হয়েছে, চারপাশ কাঁটা তারে ঘেরা এবং হাজার হাজার ভারি অস্ত্রধারী লোকেরা পাহারা দিচ্ছে। তাকে দেখে আমার কাছে দুঃখী এবং ক্ষত-বিক্ষত মনে হলো। যখন আমি একজন পাহারাদারকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি এখানে কেন, তখন পাহাদার আমার হাত ধরে কাছে টেনে ফিসফিস করে বলল, ‘তিনি মহামূল্যবান।’

বিস্ফোরণ... বিস্ফোরণ...

ফাতি সোফায় বসে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে খবর দেখছিলেন। তখন গাড়ি বোমা হামলায় নিহতদের সংবাদ সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছিল। ক্ষত-বিক্ষত দেহ এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ শুনে আহতরা কাঁদছেন।

নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় কাতর ফাতি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি দেশের পরিস্থিতি যা হয়েছে, তা দেখে ভীষণ দুঃখিত। তাঁর স্ত্রীর চোখ ভেজা এবং বাচ্চারা স্তব্ধ হয়ে টেলিভিশনের পর্দার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর অসম্ভব ঘটনা: প্রথমটির মতো একই জায়গায় বোমা লুকিয়ে রাখা অন্য আরেকটি গাড়ি বিস্ফোরিত হয় এবং বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজে টেলিভিশনের পর্দা ফেটে যায়। জ্বলন্ত কাঁচের টুকরো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং ঘটনাস্থলেই ফাতির একটি শিশু মারা যায়। বাকিরা সবাই বিভিন্নভাবে আহত হয়। দেশজুড়ে একই ঘটনা ঘটেছে এবং সেই মুহূর্তে যারা খবর দেখছিলেন, তারা অনেকেই বিস্ফোরণের শিকার হয়েছেন। অন্য যে কোনো দুর্যোগের মতো এটিও ছিল জাতীয় দুর্যোগ।

সারা দেশের সমস্ত পরিবার তৎক্ষণাৎ তাদের টেলিভিশনের সংবাদ চ্যানেল বন্ধ করে দেন এবং চলচ্চিত্র, সোপ অপেরা, গান ও শৌখিনভাবে ক্যামেরায় তোলা ছবির প্রদর্শনী দেখায় নিজেদের ব্যস্ত রাখেন। একটু একটু করে মানুষ ভুলে যাচ্ছে রাজনীতি আর তার বিয়োগান্তক পরিণতি। দেশ চরম সুখের জোয়ারে জেগে ওঠে এবং চিরদিন সবাই সুখে-আনন্দে বাস করে।

কে কাকে নেতৃত্ব দেয়

গাধাটি তার ভ্রমণকারী বিক্রেতা মনিবকে পিঠে নিয়ে কয়েক মিটারও হাঁটেনি। হঠাৎ সে থেমে যায় এবং একটুও নড়ে না। মনিব তার দুই পা দিয়ে গাধাকে চাটি মারে, কিন্তু তার চেষ্টা বৃথা যায়। সে নেমে তার সর্বশক্তি দিয়ে গাধার লাগাম ধরে টানতে থাকে, কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হয় না। সে তার মনে আসা প্রতিটি অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে গাধাকে অভিশাপ দিতে শুরু করে।

গাধা প্রতিবাদে গর্জে ওঠে, ‘আমার মনে হয় এবার আপনার উচিত আমাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া! আপনি জানেন যে, আমি এখান থেকে একটুও নড়ব না, যতক্ষণ না আপনি আমাকে আপনার পিঠে বহন করেন। কারণ আমি আপনাকে এতগুলো বছর নীরবে বহন করেছি। খুব অদ্ভুত ব্যাপার স্যার, তাই না! আমরা গাধা গোষ্ঠী সারা জীবন ধরে যে অধঃপতন ও লজ্জার সম্মুখীন হই, তার বিরুদ্ধে একবারও কি আমরা বিদ্রোহ করার অধিকার রাখি না? আমাদের অধিকারের বিষয়ে আপনার সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব নয় এবং আমরা কীভাবে আমাদের সম্প্রদায়কে রক্ষা করব, যখন আপনি একটি অদ্ভুত ভাষায় কথা বলেন এবং আপনার কণ্ঠস্বর কদর্যতার শীর্ষে পৌঁছে! তাই বিদ্রোহ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আপনারা প্রাকৃতিকভাবে নিজেদের বুদ্ধিমান প্রজাতির প্রাণি বলে মনে করলে বিষয়টা বুঝতে পারতেন!’

অন্ধকার দিক

মানুষ একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে যে অনেক নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে এবং ভয়ঙ্কর অপরাধ করে, তার জন্য চাঁদ মানুষকে শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে। তাই চাঁদ নিজের আলোকিত দিকটি লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে মানুষেরা তাদের আচরণকে সংযত করে এবং যুক্তিতে ফিরে আসে। আর তাতেই এই চন্দ্রগ্রহণ। কিন্তু চাঁদের অপার বিস্ময় জাগে, যখন সে লক্ষ কোটি মানুষকে তার অন্ধকার দিকের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছে।

পিসার মিনার

চারপাশে খুঁতখুঁতে দৃষ্টিতে তাকিয়ে পিসা শহরের বিখ্যাত মিনারটি বলল: ‘শত শত বছর পেরিয়ে গেছে এবং আমার চারপাশের সবকিছু এখনো হেলে আছে। কী করে এই অদ্ভুত ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটবে?’

সবচেয়ে বড় পাহাড়

রাতটা ছিল বেশ পরিষ্কার। শহরের ঢালু সরু গলিতে এবং যারা রাত জেগে থাকতে পছন্দ করত, তাদের বাড়ির আলো পাহাড় জুড়েছড়িয়ে পড়েছিল। তবে কিছু সংখ্যক বাতি আলাপ-আলোচনায় মগ্ন ছিল।

আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে একটা বাতি তার বন্ধুকে বলল, ‘অই বাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ, যেগুলো বিশাল পাহাড়কে ঘিরে রয়েছে। এরকম অনেক বাতি আছে! যেদিকে তাকাও না কেন, সবদিকে বাতির ছড়াছড়ি দেখতে পাবে। আমরা সংখ্যায় ওদের মতো এত বেশি নই কেন?’

অগণিত তারার দিকে মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা করার সময় তার বন্ধু জবাবে বলল, ‘সম্ভবত এ কারণে যে, সবচেয়ে বড় পাহাড়ের বাসিন্দাদের সংখ্যা আমাদের বাসিন্দাদের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।’

আলো এবং রঙধনু

অসংযত আলো এক রাশ বিরক্তি নিয়ে রঙধনুকে বলল, ‘তুমি ভীষণ কাপুরুষ!’

জবাবে রঙধনু ধীরস্থির, শান্ত গলায় বলল, ‘বোকাদের জন্য আমার অন্তরে যথেষ্ট জায়গা আছে।’

পুষ্পশোভিত দিন

সপ্তাহের দিনগুলো তর্ক করছিল যে, কোনটি সবচেয়ে বিশিষ্ট এবং ‘পুষ্পশোভিত দিন’ উপাধি পাওয়ার যোগ্য। তাদের তর্ক এতটাই তিক্ত হয়ে উঠেছিল যে, তারা একে অপরের কাছ থেকে আরও বেশি দূরে সরে যেতে শুরু করে। আর তাই জীবনের যাত্রা ধীর থেকে আরও ধীর গতিতে চলতে থাকে।

back to top