alt

সাময়িকী

‘এ নয় আঁখিজল’

আহমেদ ফরিদ

: বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

কাজী নজরুল ইসলাম

চোখের জল নিয়ে যার জন্ম তাঁর নাম দুখু মিঞা হবে এটাই হয়তো ললাট লিখন। আর ললাট লিখন মলাটের মতো যেমন বইকে পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে রাখে দুখু মিঞার জীবনকেও দুখ সারা জীবন আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। বাবা ফকির আহমদ মারা যান তাঁর অল্প বয়সেই। তিনি সামান্য জমি-জিরেতের মালিক ছিলেন, দরগার খাদেমগিরি ছিল তাঁর আয়ের দ্বিতীয় উৎস। তাঁর সংসার ছিল বিশাল। সেই বাবা যখন তাঁকে অল্প বয়সের রেখে মারা যান মাথার উপর নুরু’র যতোটুকু ছায়া ছিল তা সরে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই মা জাহেদা খাতুন চাচা বজলুল করিমকে বিয়ে করলে নুরুর মাথার উপর থেকে শেষ ছায়াটুকুও সরে যায়। দুখু মিয়া দুখের বরপুত্র হিসেবেই দুখকে সাথে নিয়ে এ ধরাধামে আগমন করেন। বাবা নেই, মা থেকেও নেই, অভাব অনটন তার নিত্য সঙ্গী। ক্ষুণিœবৃত্তি নিবৃত্তির জন্য, বেঁচে থাকার জন্য চাই অবলম্বন। পড়–য়া থেকে সর্দার পড়–য়া, মসজিদের-মাজারের খাদেমগিরি, লেটো দলে অভিনয়, গান লেখা, পালা লেখা, বিভিন্ন জায়গায় গৃহভৃত্যের কাজ আর কত কী! লেটো দলে কাজ করার সময় থেকেই তাঁর সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় মেলে। দারিদ্র্যকে নুরু জয় করতে পারেননি, উল্টো দারিদ্রই তাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রাখে, চিরদিনের জন্যই। আঁখিজলে ভাসতে ভাসতে দারিদ্র্যকে তিনি পরাজিত করেন অন্যভাবে, দারিদ্র্যকে বন্ধু বানাতে পেরেছিলেন বলেই তিনি লিখতে পেরেছিলেন- হে, দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান।

প্রতিভাবান নুরু একাধিকবার পড়াশোনার চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেননি। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। শিয়ারশোল স্কুলে পড়ার সময় মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি দেয়া হতো তাকে। সেই সময়ের পাঁচ টাকা, চাট্টিখানি কথা নয়! মেট্রিক পরীক্ষার মাত্র কয়েক মাস আগে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধে যাওযার সময় পকেটে করে নিয়ে যান এক তরুণীর চুলের কাঁটা। পুরো সৈনিক জীবনে সেই কাটাটিকে চোখের জলে আঁকড়ে ধরে থাকেন নজরুল- এমনকি সৈনিক জীবন থেকে ফেরত আসার পরও। কিন্তু ‘কে সে সুন্দর কে?’ সেই সুন্দরী ছিল এক হিন্দু দারোগার মেয়ে- দু’জনের আবার জাতপাত মেলে না। চোখের জলে সেই ব্যর্থ প্রেমকে আঁকড়ে ধরে ‘সকল কাটা ধন্য করে ফুটবে সেদিন ফুটবে’ আশা নিয়ে নজরুলকে বেঁচে থাকতে হয় অনেক দিন। কী জানি সেই ব্যর্থ প্রেমের কারণেই কি না একদিন সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে তিনি আত্মবিসর্জনের জন্য সৈনিকের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন!

নার্গিস উপখ্যান

নার্গিসের আসল নাম সৈয়দা খাতুন। তাকে পরিবারের সদস্যগণ যুবরাজ নামে ডাকত। ভাইয়েরা আদর করে ডাকতেন যুবরাজ, যুবী নামে। পুস্তক ব্যাবসায়ী আলী আকবর খানের সাথে কুমিল্লার দৌলতপুরে বেড়াতে গিয়ে পরিচয় হয় আলী আকবর খানের ভাগ্নি সৈয়দা খাতুন ওরফে যুবরাজের। যুবরাজ দেখতে ভালো, শিক্ষিতা আবার হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানও গাইতে পারে। ব্যস আর পায় কে। রোমান্টিক কবি নজরুল যুবরাজের প্রেমে পড়ে যান। সেই প্রেম থেকে পরিণয়। যুবরাজের মামা আলী আকবর খানও সম্ভবত চেয়েছিলেন এরকম একটা কিছু ঘটুক। ততক্ষণে নজরুল হবু বউয়ের নাম পরিবর্তন করে নাম দেন নার্গিস, নার্গিস আসার খানম- ইরানী ফুল। সেই নার্গিসের সাথে নজরুলের বিয়ে। বিয়েতে নজরুলের সাতকূলের কেউ উপস্থিত নেই। মহাধূমধামে পঁচিশ হাজার টাকা দেনমোহরে বিয়ে হয়ে যায়। বিপত্তি ঘটে বাসররাতে। মিলনের রাতটি তাদের নিকট বিষরাতে পরিণত হয়। নজরুল ভোরবেলায় তার সাথে থাকা বরযাত্রীদেরেক নিয়ে পাক-কাদার সুদীর্ঘ পথ মাড়িয়ে চলে আসেন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে। নজরুর আর দৌলতপুরমুখী হননি।

নজরুল ছিলেন চাল-চুলোহীন আর বাউন্ডেলে। নার্গিস মামাবাড়ি থাকলেও মামারা ছিলেন অবস্থাপন্ন আর বনেদী। তাদের বাড়িতে চকমিলানো সার সার ঘর ছিল দ্বিতল ভবন ছিল চালচলনে ঠাটবাট তো ছিলই। বাউন্ডেলে নজরুলকে নিয়ে তাদের অযাচিত কৌতূহলের সীমা ছিল না। গ্রাম অঞ্চলে সাধারণত যা ঘটে থাকে। ওমা বরের মা-বাপ, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন কই? বিয়েতে বর কী দিল? বিয়ের পর বর বউ নিয়ে থাকবে কই? বরের কি চাকরি আছে? বর বউকে খাওয়াবে কী ইত্যাদি ইত্যাদি। এ প্রশ্নগুলো হয়তো নার্গিসের মনেও উঁকি দিয়ে থাকতে পারে। বাসর রাতে তারই কি কোনো প্রভাব পড়েছিল। নার্গিস কোনো মেয়েলী প্রশ্ন করেছিল, নজরুলের দারিদ্র্য নিয়ে এমন কিছু বলেছিল- যা আতœ-সম্মান সচেতন কবিকে আহত করে।

নজরুল নার্গিসকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আকবর আলী খানের এক পত্রের জবাবে লেখেন- সাধ করে পথের ভিখিরি সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ক্ষুদ্র আত্মা অমানুষ হয়ে যাইনি। আপনজনের কাছ হতে পাওয়া এমন অপ্রত্যাশিত আঘাত, এতো হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙে দিয়েছে।

নজরুলের সেই আপনজন সেই সময় কে ছিল? নিশ্চয়ই তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রী নার্গিস। নজরুল ভিখিরি সেজেছেন অর্থাৎ চরম দরিদ্র অবস্থায় বিয়ে করেছেন। নার্গিস নজরুলের সেই দারিদ্র্যকে নিয়ে হয়তো কোনো কটাক্ষ করে থাকতে পারেন। যে দারিদ্র্য কবিকে ‘খৃস্টের সম্মান’ দিয়েছ। সেই দারিদ্রকে নিয়ে কটাক্ষ কবি সইবেন কেনো! চোখের জলে কবি তাঁর কিশোরী দেবীকে বিসর্জন দেন।

বিসর্জিত নার্গিস ও নজরুলের পথ পানে তার জীবনের একটা বড়ো অংশ কাটিয়ে দেন। তিনি আঁখিজলে অপেক্ষা করতে থাকেন। ততদিনে তিনি এক পরিণত যুবতী। নিজের প্রচেষ্টায় আরো লেখাপড়া শিখে লেখালেখি শুরু করেন। রচনা করেন কবিতা আর উপন্যাস। চোখের জল দিয়ে লেখা তাঁর কবিতা আর উপন্যাসে এক বিরহী বঞ্চিতা নারীর করুণ আর্তি তুলে ধরা হয়। নার্গিসের জন্য নজরুল নিজে কেঁদেছেন, সারাজীবন কাঁদিয়েছেন নার্গিসকেও। এ যেনো আঁখিজলের খেলা।

প্রিয় পুত্র বুলবুলকে নজরুল হারান মাত্র পৌনে চার বছর বয়সে। তিনি তাঁকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসতেন। পুত্রের অসুস্থতায় তিনি প্রায় পাগল হয়ে যান। তাঁকে সারিয়ে তোলার জন্য সন্ন্যাসী, পীর-ফকির কার না দ্বারস্থ হন নজরুল। কিন্তু প্রিয় পুত্রকে সারিয়ে তুলতে পারেননি। বসন্ত রোগে বুলবুল যখন মারা যায় তখন তাকে সমাধীস্থ করার মতো পয়সা নজরুলের হাতে ছিল না। তিনি এদিক ওদিক ছুটছেন, লোক পাঠাচ্ছেন টাকা সংগ্রহের জন্য কিন্তু টাকা মিলছে না। কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের এক দয়ালু কর্মকর্তা এগিয়ে এসে সে যাত্রায় তাকে রক্ষা করেন। শুধু আঁখিজলে পুত্রকে বিদায় করেন নজরুল? না, ‘এ নয় আঁখিজল’।

পুত্র বুলবুলকে কবি এতোটাই ভালোবাসতেন যে, তাঁর শোক ভুলতে গিয়ে তিনি ভক্তিমূলক গান লিখতে আরম্ভ করলেন। তিনি আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। নজরুল সেসময় তার মৃত ছেলেকে দেখতে থাকেন। বাগিচার বুলবুলি তার ফুলশাখাতে দোল দিতে থাকে। কবির মানসিক সুস্থতার অবনতি হতে থাকে তখন থেকেই। কবি কী তখন থেকেই হ্যালুনিসেশনে ভুগতে থাকেন। তার সৃজনশীলতা সেই সময় থেকেই নষ্ট হতে শুরু করে।

লেখালেখির জন্য তার আগে বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত তিনিই প্রথম জেলখাটা কবি। ধুমকেতুতে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ লিখে ১৯২২ সালে তিনি প্রথম জেল জীবনের সূত্রপাত করেন। তিনি লেখেন-

‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারীর শক্তি চাড়াল’।

এ স্বর্গ হচ্ছে ভারতবর্ষ আর শক্তি চাড়াল হচ্ছে ইংরেজ রাজশক্তি। তিনি দেবী দূর্গাকে আহ্বানের আড়ালে ভারতবাসীকে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার আহ্বান জানা। এ কবিতা প্রকাশিত হলে ব্রিটিশ সরকারকে সংক্ষুদ্ধ করে। সরকার নজরুলের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ আনে। ভারতীয় দ-বিধির ১২৩ ধারায় রাজদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে কবিকে এক বছর সশ্রম কারাদ-ে দ-িত করা হয়। জেলে বসেই তিনি লিখে ফেলেন- ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামক’ অগ্নিঝরা প্রবন্ধ। ‘দোলনচাপা’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা তিনি জেলে বসেই লেখেন।

জেলকোড ভাঙার জন্য কবির বিরুদ্ধে আরো একটি অভিযোগ আনা হলেও সরকার কোনো এক অজানা কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে।

নজরুল ঔপনিবেশিক শাসন আমলে শাসকদের বিরুদ্ধ সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতীক। তার লেখা আর আত্মত্যাগ ভারতীয় কবি-সাহিত্যিকদেরেক স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন করে ভূমিকা রাখতে শেখায়।

আর্থিক অনটন কখনো কবির পিছু ছাড়ে নাই। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির সাথে সাথে আর্থিক অবস্থারও অবনতি হতে থাকে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবগণও এসময় দূরে সরে যায়। তাঁকে সাহায্যের জন্য গঠন করা হয় ‘নজরুল সাহায্য কমিটি’। সেই কমিটি বিভিন্ন উৎস হতে টাকা-পয়সা উঠিয়ে কবি পরিবারকে সাহায্য করে। কিছুদিন পর সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। কবির আর্থিক দূরবস্থা চলতে থাকে কবিকে বাংলাদেশে আনার আগ পর্যন্ত। নজরুলের তেহাত্তরতম জন্মদিনের একদিন আগে তৎকালীন সরকার ১৯৭২ সালের ২৪ মে তারিখে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। প্রথমবারের মতো কবি অভাবমুক্ত একটা জীবনের সুযোগ পেলেন বটে; সেই অভাবমুক্ত জীবনের স্বাদ নেয়ার ক্ষমতা তাঁর রইল না। তাঁর গানকে বাংলাদেশের রণসংগীত ঘোষণা করা হয়, তাঁকে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করা হয়, জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কবি ততদিনে সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে ‘ফুলের জলসায়’ নীরব হয়ে গিয়েছেন।

আখিজলের কবি তাঁর আঁখিজল দিয়ে বাংলা সাহিত্যে যে আল্পনা এঁকে গিয়েছেন তার সৌন্দর্য বাঙালি জাতি উপভোগ করবে হাজার বছর কিংবা অনন্তকাল ধরে।

ছবি

ফিলিস্তিনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে অণুগল্প

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

শিল্পী সুনীল কুমারের ‘পথের গল্প’-এর স্বরূপ

ছবি

রাত গভীর

ছবি

লোরকার দেশে

জ্যৈষ্ঠের পদাবলি

ছবি

ওসামা অ্যালোমারের একঝুড়ি খুদে গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কাব্যগ্রন্থে নীলদ্রোহের রেখাপাত

ছবি

নার্গিস-নজরুলের স্মৃতিধন্য দৌলতপুরে একদিন

ছবি

যেভাবে ভেঙেছিল এক মৌনতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

নজরুল সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের প্রেক্ষিত

ছবি

স্বাধীনতার কবি নজরুল

ছবি

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রতিভা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দাউদ হায়দার: স্বকীয় ও নির্বাসিত

ছবি

অটোগ্রাফ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

আলবেয়ার কামুর গল্পে অস্তিত্বের নিষ্ঠুরতা

ছবি

উপন্যাসের জন্মবীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কানাগলি

ছবি

পার্ল এস বাক-এর কবিতা

ছবি

হোসে এচেগারাই স্প্যানিশ আলোকবর্তিকা

ছবি

নববীণায় বাজে নতুনের জয়গান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের ‘করুণা’ ঘিরে কিছু কথা

ছবি

গীতাঞ্জলির ইতিবৃত্ত ও বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ

ছবি

রবীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ ও ‘ছিন্নপত্র’

ছবি

নিউ নেদারল্যান্ডস: জার্র্সি এবং লেনাপি জনগোষ্ঠী

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বকুলীর সেইরাত

ছবি

আকাশের প্রান্ত

tab

সাময়িকী

‘এ নয় আঁখিজল’

আহমেদ ফরিদ

কাজী নজরুল ইসলাম

বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

চোখের জল নিয়ে যার জন্ম তাঁর নাম দুখু মিঞা হবে এটাই হয়তো ললাট লিখন। আর ললাট লিখন মলাটের মতো যেমন বইকে পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে রাখে দুখু মিঞার জীবনকেও দুখ সারা জীবন আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। বাবা ফকির আহমদ মারা যান তাঁর অল্প বয়সেই। তিনি সামান্য জমি-জিরেতের মালিক ছিলেন, দরগার খাদেমগিরি ছিল তাঁর আয়ের দ্বিতীয় উৎস। তাঁর সংসার ছিল বিশাল। সেই বাবা যখন তাঁকে অল্প বয়সের রেখে মারা যান মাথার উপর নুরু’র যতোটুকু ছায়া ছিল তা সরে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই মা জাহেদা খাতুন চাচা বজলুল করিমকে বিয়ে করলে নুরুর মাথার উপর থেকে শেষ ছায়াটুকুও সরে যায়। দুখু মিয়া দুখের বরপুত্র হিসেবেই দুখকে সাথে নিয়ে এ ধরাধামে আগমন করেন। বাবা নেই, মা থেকেও নেই, অভাব অনটন তার নিত্য সঙ্গী। ক্ষুণিœবৃত্তি নিবৃত্তির জন্য, বেঁচে থাকার জন্য চাই অবলম্বন। পড়–য়া থেকে সর্দার পড়–য়া, মসজিদের-মাজারের খাদেমগিরি, লেটো দলে অভিনয়, গান লেখা, পালা লেখা, বিভিন্ন জায়গায় গৃহভৃত্যের কাজ আর কত কী! লেটো দলে কাজ করার সময় থেকেই তাঁর সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় মেলে। দারিদ্র্যকে নুরু জয় করতে পারেননি, উল্টো দারিদ্রই তাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রাখে, চিরদিনের জন্যই। আঁখিজলে ভাসতে ভাসতে দারিদ্র্যকে তিনি পরাজিত করেন অন্যভাবে, দারিদ্র্যকে বন্ধু বানাতে পেরেছিলেন বলেই তিনি লিখতে পেরেছিলেন- হে, দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান।

প্রতিভাবান নুরু একাধিকবার পড়াশোনার চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেননি। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। শিয়ারশোল স্কুলে পড়ার সময় মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি দেয়া হতো তাকে। সেই সময়ের পাঁচ টাকা, চাট্টিখানি কথা নয়! মেট্রিক পরীক্ষার মাত্র কয়েক মাস আগে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধে যাওযার সময় পকেটে করে নিয়ে যান এক তরুণীর চুলের কাঁটা। পুরো সৈনিক জীবনে সেই কাটাটিকে চোখের জলে আঁকড়ে ধরে থাকেন নজরুল- এমনকি সৈনিক জীবন থেকে ফেরত আসার পরও। কিন্তু ‘কে সে সুন্দর কে?’ সেই সুন্দরী ছিল এক হিন্দু দারোগার মেয়ে- দু’জনের আবার জাতপাত মেলে না। চোখের জলে সেই ব্যর্থ প্রেমকে আঁকড়ে ধরে ‘সকল কাটা ধন্য করে ফুটবে সেদিন ফুটবে’ আশা নিয়ে নজরুলকে বেঁচে থাকতে হয় অনেক দিন। কী জানি সেই ব্যর্থ প্রেমের কারণেই কি না একদিন সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে তিনি আত্মবিসর্জনের জন্য সৈনিকের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন!

নার্গিস উপখ্যান

নার্গিসের আসল নাম সৈয়দা খাতুন। তাকে পরিবারের সদস্যগণ যুবরাজ নামে ডাকত। ভাইয়েরা আদর করে ডাকতেন যুবরাজ, যুবী নামে। পুস্তক ব্যাবসায়ী আলী আকবর খানের সাথে কুমিল্লার দৌলতপুরে বেড়াতে গিয়ে পরিচয় হয় আলী আকবর খানের ভাগ্নি সৈয়দা খাতুন ওরফে যুবরাজের। যুবরাজ দেখতে ভালো, শিক্ষিতা আবার হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানও গাইতে পারে। ব্যস আর পায় কে। রোমান্টিক কবি নজরুল যুবরাজের প্রেমে পড়ে যান। সেই প্রেম থেকে পরিণয়। যুবরাজের মামা আলী আকবর খানও সম্ভবত চেয়েছিলেন এরকম একটা কিছু ঘটুক। ততক্ষণে নজরুল হবু বউয়ের নাম পরিবর্তন করে নাম দেন নার্গিস, নার্গিস আসার খানম- ইরানী ফুল। সেই নার্গিসের সাথে নজরুলের বিয়ে। বিয়েতে নজরুলের সাতকূলের কেউ উপস্থিত নেই। মহাধূমধামে পঁচিশ হাজার টাকা দেনমোহরে বিয়ে হয়ে যায়। বিপত্তি ঘটে বাসররাতে। মিলনের রাতটি তাদের নিকট বিষরাতে পরিণত হয়। নজরুল ভোরবেলায় তার সাথে থাকা বরযাত্রীদেরেক নিয়ে পাক-কাদার সুদীর্ঘ পথ মাড়িয়ে চলে আসেন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে। নজরুর আর দৌলতপুরমুখী হননি।

নজরুল ছিলেন চাল-চুলোহীন আর বাউন্ডেলে। নার্গিস মামাবাড়ি থাকলেও মামারা ছিলেন অবস্থাপন্ন আর বনেদী। তাদের বাড়িতে চকমিলানো সার সার ঘর ছিল দ্বিতল ভবন ছিল চালচলনে ঠাটবাট তো ছিলই। বাউন্ডেলে নজরুলকে নিয়ে তাদের অযাচিত কৌতূহলের সীমা ছিল না। গ্রাম অঞ্চলে সাধারণত যা ঘটে থাকে। ওমা বরের মা-বাপ, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন কই? বিয়েতে বর কী দিল? বিয়ের পর বর বউ নিয়ে থাকবে কই? বরের কি চাকরি আছে? বর বউকে খাওয়াবে কী ইত্যাদি ইত্যাদি। এ প্রশ্নগুলো হয়তো নার্গিসের মনেও উঁকি দিয়ে থাকতে পারে। বাসর রাতে তারই কি কোনো প্রভাব পড়েছিল। নার্গিস কোনো মেয়েলী প্রশ্ন করেছিল, নজরুলের দারিদ্র্য নিয়ে এমন কিছু বলেছিল- যা আতœ-সম্মান সচেতন কবিকে আহত করে।

নজরুল নার্গিসকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আকবর আলী খানের এক পত্রের জবাবে লেখেন- সাধ করে পথের ভিখিরি সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ক্ষুদ্র আত্মা অমানুষ হয়ে যাইনি। আপনজনের কাছ হতে পাওয়া এমন অপ্রত্যাশিত আঘাত, এতো হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙে দিয়েছে।

নজরুলের সেই আপনজন সেই সময় কে ছিল? নিশ্চয়ই তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রী নার্গিস। নজরুল ভিখিরি সেজেছেন অর্থাৎ চরম দরিদ্র অবস্থায় বিয়ে করেছেন। নার্গিস নজরুলের সেই দারিদ্র্যকে নিয়ে হয়তো কোনো কটাক্ষ করে থাকতে পারেন। যে দারিদ্র্য কবিকে ‘খৃস্টের সম্মান’ দিয়েছ। সেই দারিদ্রকে নিয়ে কটাক্ষ কবি সইবেন কেনো! চোখের জলে কবি তাঁর কিশোরী দেবীকে বিসর্জন দেন।

বিসর্জিত নার্গিস ও নজরুলের পথ পানে তার জীবনের একটা বড়ো অংশ কাটিয়ে দেন। তিনি আঁখিজলে অপেক্ষা করতে থাকেন। ততদিনে তিনি এক পরিণত যুবতী। নিজের প্রচেষ্টায় আরো লেখাপড়া শিখে লেখালেখি শুরু করেন। রচনা করেন কবিতা আর উপন্যাস। চোখের জল দিয়ে লেখা তাঁর কবিতা আর উপন্যাসে এক বিরহী বঞ্চিতা নারীর করুণ আর্তি তুলে ধরা হয়। নার্গিসের জন্য নজরুল নিজে কেঁদেছেন, সারাজীবন কাঁদিয়েছেন নার্গিসকেও। এ যেনো আঁখিজলের খেলা।

প্রিয় পুত্র বুলবুলকে নজরুল হারান মাত্র পৌনে চার বছর বয়সে। তিনি তাঁকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসতেন। পুত্রের অসুস্থতায় তিনি প্রায় পাগল হয়ে যান। তাঁকে সারিয়ে তোলার জন্য সন্ন্যাসী, পীর-ফকির কার না দ্বারস্থ হন নজরুল। কিন্তু প্রিয় পুত্রকে সারিয়ে তুলতে পারেননি। বসন্ত রোগে বুলবুল যখন মারা যায় তখন তাকে সমাধীস্থ করার মতো পয়সা নজরুলের হাতে ছিল না। তিনি এদিক ওদিক ছুটছেন, লোক পাঠাচ্ছেন টাকা সংগ্রহের জন্য কিন্তু টাকা মিলছে না। কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের এক দয়ালু কর্মকর্তা এগিয়ে এসে সে যাত্রায় তাকে রক্ষা করেন। শুধু আঁখিজলে পুত্রকে বিদায় করেন নজরুল? না, ‘এ নয় আঁখিজল’।

পুত্র বুলবুলকে কবি এতোটাই ভালোবাসতেন যে, তাঁর শোক ভুলতে গিয়ে তিনি ভক্তিমূলক গান লিখতে আরম্ভ করলেন। তিনি আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। নজরুল সেসময় তার মৃত ছেলেকে দেখতে থাকেন। বাগিচার বুলবুলি তার ফুলশাখাতে দোল দিতে থাকে। কবির মানসিক সুস্থতার অবনতি হতে থাকে তখন থেকেই। কবি কী তখন থেকেই হ্যালুনিসেশনে ভুগতে থাকেন। তার সৃজনশীলতা সেই সময় থেকেই নষ্ট হতে শুরু করে।

লেখালেখির জন্য তার আগে বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত তিনিই প্রথম জেলখাটা কবি। ধুমকেতুতে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ লিখে ১৯২২ সালে তিনি প্রথম জেল জীবনের সূত্রপাত করেন। তিনি লেখেন-

‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারীর শক্তি চাড়াল’।

এ স্বর্গ হচ্ছে ভারতবর্ষ আর শক্তি চাড়াল হচ্ছে ইংরেজ রাজশক্তি। তিনি দেবী দূর্গাকে আহ্বানের আড়ালে ভারতবাসীকে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার আহ্বান জানা। এ কবিতা প্রকাশিত হলে ব্রিটিশ সরকারকে সংক্ষুদ্ধ করে। সরকার নজরুলের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ আনে। ভারতীয় দ-বিধির ১২৩ ধারায় রাজদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে কবিকে এক বছর সশ্রম কারাদ-ে দ-িত করা হয়। জেলে বসেই তিনি লিখে ফেলেন- ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামক’ অগ্নিঝরা প্রবন্ধ। ‘দোলনচাপা’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা তিনি জেলে বসেই লেখেন।

জেলকোড ভাঙার জন্য কবির বিরুদ্ধে আরো একটি অভিযোগ আনা হলেও সরকার কোনো এক অজানা কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে।

নজরুল ঔপনিবেশিক শাসন আমলে শাসকদের বিরুদ্ধ সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতীক। তার লেখা আর আত্মত্যাগ ভারতীয় কবি-সাহিত্যিকদেরেক স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন করে ভূমিকা রাখতে শেখায়।

আর্থিক অনটন কখনো কবির পিছু ছাড়ে নাই। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির সাথে সাথে আর্থিক অবস্থারও অবনতি হতে থাকে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবগণও এসময় দূরে সরে যায়। তাঁকে সাহায্যের জন্য গঠন করা হয় ‘নজরুল সাহায্য কমিটি’। সেই কমিটি বিভিন্ন উৎস হতে টাকা-পয়সা উঠিয়ে কবি পরিবারকে সাহায্য করে। কিছুদিন পর সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। কবির আর্থিক দূরবস্থা চলতে থাকে কবিকে বাংলাদেশে আনার আগ পর্যন্ত। নজরুলের তেহাত্তরতম জন্মদিনের একদিন আগে তৎকালীন সরকার ১৯৭২ সালের ২৪ মে তারিখে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। প্রথমবারের মতো কবি অভাবমুক্ত একটা জীবনের সুযোগ পেলেন বটে; সেই অভাবমুক্ত জীবনের স্বাদ নেয়ার ক্ষমতা তাঁর রইল না। তাঁর গানকে বাংলাদেশের রণসংগীত ঘোষণা করা হয়, তাঁকে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করা হয়, জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কবি ততদিনে সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে ‘ফুলের জলসায়’ নীরব হয়ে গিয়েছেন।

আখিজলের কবি তাঁর আঁখিজল দিয়ে বাংলা সাহিত্যে যে আল্পনা এঁকে গিয়েছেন তার সৌন্দর্য বাঙালি জাতি উপভোগ করবে হাজার বছর কিংবা অনন্তকাল ধরে।

back to top