alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৮

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

: বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

ফুয়েন্তে বাকেরোজ গ্রামে গার্সিয়ার জন্মস্থানের যাদুঘর: কাসা মুজেও ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা

(পূর্ব প্রকাশের পর)

সিয়েরা নেভাদা, আলহাম্বরা ও ফ্লেমেনকোর মায়ায় ভুলে গিয়েছিলাম গ্রানাদার নিসর্গের আরেকটি খ- জলপাই বাগানকে। প্রথমদিন বিমানবন্দর থেকে শহরে আসার পথে দেখেছিলাম জলপাই গাছের সারি, এরপর তা আর দেখা হয়নি। লোরকার কবিতায় বারবার উঠে এসেছে জলপাই ও কমলা গাছ। গ্রানাদা শহরের পথেপ্রান্তরে ছড়িয়ে আছে অগণন কমলা গাছ। তবে জলপাই গাছের দেখা পেতে হলে যেতে হবে শহরের বাইরে গ্রামে।

নাবিল ও নাতাশা বরাবরই নিসর্গের প্রতি অনুরক্ত। তারা কদিন ধরেই বলছিল- গ্রানাদা শহর খুব সুন্দর, কিন্তু তার ইতিহাস খুব বোরিং, এর বাইরে যেয়ে আমরা চাই নেচারকে দেখতে, এনজয় করতে। বললাম- আমিও নিসর্গের পূজারী, যার মাঝে আছে বিশুদ্ধ সৌন্দর্য। চল, আমরা নিসর্গের মাঝে ঘুরে আসি। দুজনে মিলে বের করল এক অলিভ গার্ডেন ট্যুর, আর আমার মতামত নিয়ে ট্যুরের বুকিং দিয়ে দিল। শহরে ইতিহাসের ধূসর আবহাওয়া থেকে বাইরে প্রকৃতির নির্মল হাওয়ায় একটু নিঃশ্বাস নেয়া যাক।

আজ ভোরে সবার ঘুম ভাঙল একটু দেরিতে। তাই হোটেলের ব্রেকফাস্ট খাওয়া হলো না। এতে নাবিল ও নাতাশা বেশ খুশি। হোটেলের ব্রেকফাস্ট ভালই, তবে বাইরের ক্যাফেতে খাওয়া তাদের খুব পছন্দ। সে ইচ্ছে পূরণের এক সুযোগ আসল। বাইরে বের হয়ে দেখি অগণিত ক্যাফে, কোনটি ছেড়ে কোনটিতে যাব। নাবিল নাতাশাই নিয়ে গেল একটিতে, ক্যাফে দে আন্দালুসিয়া- নামটিই সম্ভবত তাদের পছন্দ হয়েছে। গ্রানাদার ঐতিহ্যবাহী এক ক্যাফে, বেশ পুরনো, কিন্তু সুন্দর আসবাবপত্র, দেয়ালে তৈলচিত্র, নকশা করা টেবিল ক্লথ, আর চমৎকার ব্যালকনি- সব দিকে আভিজাত্যের ছাপ। ফাঁকে ফাঁকে ফুলের টবে ফুটে আছে জেরেনিয়ম, জেসমিন, টিউলিপ, তাদেরকে হালকাভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে ভোরের মিষ্টি রোদ। ফুলের সুবাসের সাথে মিশে আছে সদ্য গ্রাইন্ড করা কফি আর অমলেটের ঘ্রাণ। ম্যানেজার ফ্রান্সিসকো অরতিজ, সকালের ব্যস্ততার মাঝেও খুবই প্রফুল্ল, আমাদেরকে সহাস্যে ভেতরে নিয়ে গেল। পুরো ক্যাফে মানুষে ভরপুর। এর মধ্যে কেউ টেবিল খালি করে যাবে বলে মনে হলো না। কারণ, এখানে সব কিছু সার্ভ করা হয় অনেক সময় নিয়ে, আর এরা ব্রেকফাস্ট করে খুব আয়েস করে, ধীরেসুস্থে। অরতিজ বলল, তোমরা এখন অর্ডার দিতে পার, খাওয়া তৈরি হতেই একটি টেবিল খালি হয়ে যাবে, তাহলে তোমাদের সময় একটু সেভ হবে। এর মধ্যে বারান্দায় বসে গ্রানাদার ভোর দেখতে পার, বা ভেতরে ক্যাফেও ঘুরে আসতে পার। একটু পরে আমরা আরো ব্যস্ত হয়ে যাব, তখন শুরু হবে সেকেন্ড ব্রেকফাস্ট। আমি বললাম, এটি আবার কী? অরতিজের সহাস্য জবাব, স্পেনে অনেকে দু’টি ব্রেকফাস্ট করে। ৭টা থেকে ৯টা প্রথম ব্রেকফাস্ট, নিজের বাসায়, হালকা ব্রেকফাস্ট, মিষ্টি জাতীয় কিছু খেয়ে নেয়, যেমন দুধের সাথে সিরিয়াল, কফিও থাকে। ১০টা থেকে ১১টা দ্বিতীয় ব্রেকফাস্ট, বাসার বাইরে ক্যাফেতে। অনেক অফিসে দ্বিতীয় ব্রেকফাস্টের জন্য ৩০ মিনিটের বিরতি দেয়া হয়। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, দুটি ব্রেকফাস্ট দূরে থাক, আমেরিকাতে আমরা অনেক সময় একটি ব্রেকফাস্টও নিতে পারি না। সকালে অফিসে যাওয়ার পথে অনেকে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে ব্রেকফাস্ট সারে। অনেক নারী এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালাচ্ছে, অন্যহাতে মেকআপ নিচ্ছে, সাথে ফোনে চলছে মিটিং। এ যেন এক ইঁদুর দৌড়। অরতিজ বলল, স্পেনে সবাই নিজেকে ও পরিবারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এরপর আসে বন্ধু-বান্ধব। কাজের গুরুত্ব সবার শেষে। আমি বললাম, আমেরিকাতে অর্ডার অফ প্রিফারেন্স পুরো উল্টো- কাজ সবার আগে, এর পরে অন্য সব।

আবার আমাদের ব্রেকফাস্টে ফিরে আসি। আমরা দেখতে লাগলাম কী কী অর্ডার দেয়া যায়। নতুন জায়গায় এ এক সমস্যা, বিশেষ করে খাবারের বেলায়, কী নেয়া যায়। নাবিল সব সময় চমকদার কিছু নিতে চায়, সে অর্ডার দিল পিনছো দে তরতিয়া- অলিভ অয়েল দিয়ে সবজি মিশ্রিত অমলেট, সাথে কর্ন ব্রেড। নাতাশা অর্ডার দিল মানতেকুইয়া ই মারমেলাদা- মাখন ও জ্যাম দিয়ে পাউরুটি। ফারজানা অর্ডার দিল তরতিয়া দে পাতাতাস- আলু মিশ্রিত অমলেট। আমি অর্ডার দিলাম পান কন তোমাতে- টমেটো দিয়ে পাউরুটি। সবাই নিলাম ফলের রস, যা তাজা ফল- কমলা, ডালিম, আপেল থেকে নির্যাসিত। অর্তিজ বলল, কফি দেয়া হবে একটু পরে, যাতে এটি ফ্রেশ থাকে। এখানে বিভিন্ন প্রকারের কফির বীন আছে, কোনো একটি বেছে নিতে হয়। পরে তা সামনের গ্রাইন্ডারে গ্রাইন্ড করে সেদ্ধ করা হয়। সেজন্য কফির স্বাদ থাকে খুবই সতেজ ও তৃপ্তিকর। কফিতে চুমুক দিতে দিতে দেখতে থাকলাম আশেপাশের সবাইকে। সবাই খাচ্ছে, কথা বলছে, হাসছে, মাঝে মাঝে তর্কও হচ্ছে, কিন্তু কারো কোনো রাগ নেই। মনে হলো সবাই সুখী, প্রাণোচ্ছল।

ক্যাফে থেকে বের হয়ে দেখতে লাগলাম ভোরের গ্রানাদাকে- যা এর মধ্যেই জেগে উঠেছে নতুন এক দিনের জন্য। মানুষের মেলা শুরু হয়ে গেছে। বেশিরভাগ যাচ্ছে কাজে- হেঁটে, সাইকেলে, বাসে, ট্রামে, কারে। ছাত্রছাত্রীরা যাচ্ছে তাদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দেখা গেল আরেক ধরনের মানুষের ¯্রােতধারা- যাদের হাঁটা-চলা ও ইতিউতি তাকানোতেই বোঝা যায় তারা পর্যটক। ১০-১৫ জনের কোনো এক দল গাইডকে অনুসরণ করে যাচ্ছে বিশেষ কোনো গন্তব্যে। অনেকে ঘুরছে হপ-অন-হপ-অফ বাসে করে। বেশিরভাগ হেঁটে হেঁটে সব দেখছে। স্যুভেনির শপের ঝাঁপি খুলে গেছে। মোড়ের ডিলাররা বসে আছে টিকিট হাতে- সব ধরনের টিকেট- আলহাম্বরা, মিরাদর সান নিকোলাস, আলবাইসিন, সেক্রোমন্তে- এর গাইডেড ট্যুর। আর আছে ফ্লেমেনকো শো-এর হরেক রকম টিকেট। তবে এখনো শুরু হয়নি প্লাজার কাছে গিটার, ভায়োলিন বাজানো। শুরু হয়নি জিপসিদের নাচ-গান।

টেক্সিতে ৩০ মিনিট পথ পাড়ি দিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম সিয়েরা নেভাদার পাদদেশে, জলপাই বাগান ঘেরা এক গ্রাম আকুলাতে। এখানে ওমেড কোম্পানির অনেকগুলি জলপাই বাগানের একটিতে আমাদের ট্যুর। সাথে আছে জলপাই প্রক্রিয়াজাত করে জলপাই তেল উৎপাদন করার এক প্ল্যান্ট। ফ্লোরে অর্কিডের টব ও দেয়ালে চিত্রকর্মে সুন্দর করে সাজানো ওমেড অফিসের লবিতে আমরা এসে বসলাম। আমাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, কারণ ট্যুর শুরু হবে একটায়, আমরা একটু আগে চলে এসেছি। একে একে অনেকে আসছেন। ঠিক একটার সময় আসল আমাদের গাইড ক্রিস্টিনা, খুবই সপ্রতিভ, চমৎকার ইংরেজি বলে। এসে সবাইকে স্বাগত জানালো, আর একে একে আমাদের পনের জনের সবাইর সাথে পরিচিত হলো। তারপর ওমেড কোম্পানির নীতি, পরিকল্পনা ও সাফল্য নিয়ে এক ছোট বিবরণী দিল। একটু গর্ব করে বলল, স্পেন সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জলপাই উৎপাদন করে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জলপাই এ দেশেই উৎপাদিত হয়। সর্বশেষে বলল, হিসেব-নিকেশ এখন থাক। জলপাই নিয়ে বাকি কথা বলব জলপাই বাগানে দাঁড়িয়ে।

ক্রিস্টিনাকে অনুসরণ করে কয়েক মিনিট হেঁটে আমরা পৌঁছলাম এক জলপাই বাগানে। দিগন্ত-বিস্তৃত জলপাই গাছের সারি, মাঝে মাঝে পপলার গাছের ছায়া, সবাইকে কোলে করে রেখেছে সিয়েরা নেভাদা, তার চূড়াগুলি বরফে ঢাকা। স্পেনীয় শব্দ সিয়েরা নেভাদা অর্থই হলো বরফ-ঢাকা পর্বতমালা। এ পর্বতমালা, ওপরে বরফের প্রলেপ, নিচে জলপাই বাগান- সূর্যের উজ্জ্বল আলো সবাইকে মিলিয়ে সৃষ্টি করেছে এক মনোরম দৃশ্যের। গ্রানাদার সূর্যের আলো সবসময় চোখ-ধাঁধানো, তবে জলপাই বাগানের সবুজে তাকে মনে হচ্ছে অনেক বেশি ¯িœগ্ধ।

ক্রিস্টিনা যে বাগানে নিয়ে আসল তার গাছগুলির বয়স ১০ বছর। অন্য পাশে আছে ২০ বছর, ৩০ বছরের পুরনো গাছ। তারা ৪০ বছর পর্যন্ত গাছ থেকে জলপাই আহরণ করে। এর পর গাছ তুলে ফেলে নতুন গাছ লাগানো হয়। ক্রিস্টিনা আমাদের একটি নতুন বাগানে নিয়ে গেল- গত বছরই মাত্র গাছ লাগানো হয়েছে, জলপাই ধরবে আরো ২ বছর পরে। নতুন গাছের জলপাইয়ের মান সবচেয়ে ভালো। গাছের বয়স বাড়ার সাথে ফলনের মান ও পরিমাণ কমে আসে।

মনে পড়ে গেল চা বাগানে ৩২ বছর আগে কাজ করার স্মৃতি। ক্রিস্টিনা জলপাই গাছের যে বৈশিষ্ট্যগুলি বলল তা চা গাছের সাথে বেশ মিলে যায়। তবে চা গাছে লাগে উঞ্চতা ও প্রচুর বৃষ্টি, জলপাই গাছে উঞ্চতা ও শুষ্ক আবহাওয়া।

নাতাশা জিজ্ঞেস করল, জলপাই গাছে পানি দিতে হয় না? ক্রিষ্টিনা বলল, হ্যাঁ। জলপাই গাছে পানি দিতে হয় মাটির নিচে ড্রিপিং সেচের মাধ্যমে, যাতে পানি গাছের গভীর শেকড়ে পৌঁছে। গ্রানাডা খুবই শুষ্ক জায়গা- বৃষ্টি হয় কম, আজ ২৭ ডিসেম্বর, এ মাসে বৃষ্টি হয়েছে মোট ১ ইঞ্চি, সারা বছর মোট বৃষ্টির পরিমাণ ১৪ ইঞ্চির মতো। আমি বললাম, দেশে চা-বাগানে ছিলাম, জায়গাটির নাম শ্রীমঙ্গল, সেখানে সারা বছর বৃষ্টি হয় ১০০ ইঞ্চি, গ্রানাদার সাত গুণ। ক্রিস্টিনা বিস্ময়ে চোখ বড় করে বলল, ইউ মিন হানড্রেড ইঞ্চ? আমি বললাম, হ্যাঁ। কোনো কোনো বছর এর চেয়েও বেশি হয়। সে চিৎকার করে উঠল, ‘ওয়াও’।

ক্রিস্টিনা এরপর আমাদের নিয়ে গেল একাকী দাঁড়িয়ে থাকা এক বিরাট গাছের সামনে। ভাবলাম পপলার গাছ। সে বলল, এটি একটি জলপাই গাছ, বয়স ১০০ বছরের বেশি। শতায়ু মানুষ দেখেছি কম, শতবর্ষী গাছ আরো কম। ক্রিস্টিনা যোগ করল, এ গাছটিতে জলপাই ধরে খুব কম, মানও ভাল নয়। আমরা এটি রেখেছি শুধু প্রদর্শনীর জন্য।

শুষ্ক প্রান্তরে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা শতায়ু এ জলপাই গাছটির কথাই যেন বলেছেন লোরকা:

বিশুষ্ক প্রান্তরে

এক জলপাই গাছ

চলমান

এক

জলপাই গাছ।১

জলপাই বাগানে কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে দেখার পর সবাই গেলাম আধুনিক এক প্ল্যান্টে। ক্রিস্টিনা তা দেখানোর পাশাপাশি সব কিছুর সুন্দর বর্ণনা করে চলল। সেখানে ট্রাক্টরে করে আনা হচ্ছে বাগান থেকে সদ্য তোলা জলপাই, ঢালা হচ্ছে বর্গাকার এক ট্যাঙ্কে, তা পরিষ্কার ও বাছাই হচ্ছে এক মেশিনে, কনভেয়র বেল্ট তা নিয়ে যাচ্ছে পরবর্র্তী ধাপে। অনেকগুলি স্তর পেরিয়ে শেষ ধাপে বের হচ্ছে অলিভ অয়েল।

প্ল্যান্ট দেখানো শেষ করে ক্রিস্টিনা আমাদের নিয়ে গেল অয়েল টেস্টিং রুমে। সে আমাদের ব্যাখ্যা করল অলিভ অয়েলের প্রকারভেদ ও তার কারণ। বোতলে সাজানো আছে বিভিন্ন প্রকারের অলিভ অয়েল- একে একে ছোট কাপে করে ক্রিস্টিনা প্রথমে মুখে দিল- তারপর দিল সবাইকে। এক্সট্রা ভার্জিন, ভার্জিন ও রেগুলার, প্রতিটির মাঝেও বিভিন্ন প্রকারের অলিভ অয়েল। সবাই একে একে মুখে নিয়ে তাদের মতামত দিল কোনটির স্বাদ কেমন। আমি বললাম, সবগুলিই আমার কাছে মনে হচ্ছে একই রকম। শুনে সবাই হেসে উঠল।

এখানে প্রকৃতি ও প্রযুক্তি এক সাথে দেখে আমরা বের হয়ে আসলাম। দুপুরের কড়া রোদ, কিন্তু তেমন গরম লাগছে না। একটা হালকা আমেজ হাওয়ায় ও আমাদের মনে।

জলপাই বাগান ট্যুর শেষ হওয়ার পর নাতাশা ও নাবিল বলল, সিয়ারা নেভাদার রিজর্টে যাবো। এটি স্কিয়িং ও মাইন্টেন হাইকিং এর জন্য বেশ জনপ্রিয়। তারা গুগল ম্যাপে দেখল এখান থেকে টেক্সিতে মাত্র ৪৫ মিনিটের পথ। আমি বললাম, সিয়ারা নেভাদা এখান থেকেই খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে। সেখানে যাওয়ার কী দরকার আছে? নাতাশা বলল, আমি স্কিয়িং করব। নাবিল বলল, আমি মাউন্টেন হাইকিং করব। আমি বললাম, দেখ, এগুলি এত সোজা নয়। তার জন্য দরকার আগের কিছু প্র্যাকটিস, যা তোমাদের নাই। দু’জনই প্রতিবাদ করে বলল, আমরা অনেকবার আরলিংটন মলের আইস রিংয়ে আইস স্কেটিং করেছি। কাজেই আমরা পারব। আমি বললাম, দেখ, আইস স্কেটিং আর স্কিয়িং এক জিনিস নয়। স্কিয়িং অনেক বেশি রিস্কি। তুমি যদি ঠিকমত কন্ট্রোল করতে না পার তাহলে একলাফে তোমরা সিয়ারা নেভাদা থেকে আলহাম্বরায় চলে যেতে পারো। আমরা বিদেশে বেড়াতে এসেছি, এখানে হাত-পা ভাঙলে বিরাট সমস্যা। মাউন্টেন হাইকিং কম ঝুঁকিপূর্ণ, তবে তার জন্য অনেক সময় লাগবে, মনে কর কমপক্ষে একদিন, বা বেশি। আমাদের হাতে এরকম সময় নাই। ওরা বলল, তোমরা খুব প্রোটেকটিভ। সব কিছুতে ভয় পাও। আমি বললাম, আমরা প্রোটেকটিভ, কারণ তোমাদেরকে নিরাপদে রাখতে চাই। দেখ, আমার এক ভাল আইডিয়া আছে, তোমরা ভেবে দেখতে পার।

বললাম, গ্রামে যখন ঘুরতে বের হয়েছি, তাহলে আর একটু ঘুরি। আজ যাই এক বিশেষ গ্রামে, এক বিশেষ ব্যক্তির স্মৃতি-জড়ানো বাড়ি দেখতে। নাবিল বলল, সে ব্যক্তিটি কে? আমি বললাম, একটু সাসপেন্স থাকুক। তোমরা গেলেই দেখতে পাবে।

সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার বরফ-গলা-জল-বিধৌত এক সমতল-ভূমি লা ভেগা, তার বুকে সিয়েরা থেকে বের হয়ে প্রবাহিত হেনিল নদী। উর্বর এ এলাকায় ছড়িয়ে আছে এসপারাগাস, তামাক আর ভুট্টার ক্ষেত, মাঝে মাঝে পপলার গাছের সারি। গ্রানাদা শহর থেকে ১২ মাইল দূরের এই নিসর্গের মাঝে এক গ্রাম ফুয়েন্তে বাকেরোজ বিখ্যাত হয়ে আছে, কারণ এখানেই ৫ জুন, ১৮৯৮ সালে লোরকার জন্ম, ছোট এক বাড়িতে, যা আজ এক জাদুঘর: কাসা মুজেও ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা।

এখানে পৌঁছেই সামনের পার্কে দেখলাম লোরকার এক ভাস্কর্য: শিল্পী কায়েতানো আনিবেল এর ১৯৮০ সালের সৃষ্টি। আর পাশের একটি বাড়ির বাইরের পুরো দেয়াল জুড়ে লোরকার দু’টি বিশাল ছবি, তার একটিতে লোরকা বাজাচ্ছেন পিয়ানো। স্পষ্টত এটিই লোরকার জন্মস্থান ও জাদুঘর। ভেতরে ঢুকে যোগ দিলাম ৮ জনের একটি দলে, গাইড ঘুরে দেখাচ্ছেন আর সাথে চলল বর্ণনা। প্রবেশেই ছিমছাম বসার ঘর, সে আমলের আসবাবপত্র, বেশ বনেদী, পুরো বাসার মেঝেতে সুন্দর টাইলস বসানো। লোরকার বাবা-মায়ের কামরায় গেলাম, তাঁদের পাশের কামরায় লোরকার দোলনা ও দাঁড়ানোর চেয়ার। শিহরিত হয়ে উঠলাম- এখানেই লোরকার জন্ম, এখানেই শিশুকালে তাঁর খেলা ও বেড়ে ওঠা। পাশেই পিয়ানো রুম, যা মনে হলো পুরো বাসার সবচেয়ে সুন্দর কক্ষ। এখানে বেশ কারুকাজ করা কাল রঙের বড় এক পিয়ানো- বাজাতেন মূলত লোরকার মা, যিনি ছিলেন একজন ভাল পিয়ানোবাদক। লোরকার কাছে তাঁর স্কুল শিক্ষয়িত্রী মা ছিলেন আদর্শ, যাঁকে অনুসরণ করে জীবনকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মার হাত ধরে লোরকার পিয়ানো শেখা। লোরকা প্রথম জীবনে সঙ্গীত শিখেছেন, এটি তাঁর নেশা ও পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন। সঙ্গীত তাই গভীর প্রভাব রেখেছে লোরকার কবিতায়।

এরপর গেলাম খাবার ঘরে, দেখলাম- ফায়ারপ্লেস, টেবিল-চেয়ার, কোনায় রাখা এক গ্রামোফোন ও সাথের স্লেটের রেকর্ড। পাশেই রান্নাঘর। এরপর উঠলাম দোতলায়, যা অতীতে ছিল শস্য রাখার গোলাঘর, আর এখন লোরকার কাজের সংরক্ষণ ও প্রদর্শনী কক্ষ। এখানে দেখলাম তাঁর আঁকা বিভিন্ন স্কেচ, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে তোলা বিভিন্ন ছবি এবং তাঁর বিভিন্ন বইয়ের পোস্টার। এক আলাদা কাঁচ-ঢাকা শেলফে রাখা আছে বিভিন্ন পুতুল, যেগুলি স্থান পেয়েছিল লোরকা রচিত এক পুতুল নাটকে। ম্যানুয়েল দ্য ফাইয়া ও হারমেনেহিলদো-র সহযোগিতায় ৬ জানুয়ারি, ১৯২৩ লোরকা এ পুতুল নাটকের আয়োজন করেন। এটি আয়োজিত হয় তাঁর গ্রানাদার ৩১ এসেরা ডেল ক্যাসিনো ঠিকানার বাসায়।

নাবিল ও নাতাশা একটি ব্যাপারে খুব খুশি, কারণ এখানে জাদুঘরের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। এমনিতেই ওরা ছবি তুলতে চায় না, বিপরীতে আমার ছবি তোলার বাতিক, অনেকটা নেশার মতো। আর আমি ভ্রমণের এসব ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে আনন্দ পাই, যার ঘোর বিরোধী নাবিল নাতাশা। তারা বলে ফেসবুকে দিলে তাদের প্রাইভেসি নষ্ট হয়, যা তারা চায় না। দুই প্রজন্মের চিন্তা ধারায় কী প্রভেদ!

সবশেষে গেলাম বাসার পেছনের পাকা উঠোনে, যার চারপাশ ঘিরে আছে এক সুন্দর বাগান। আমার ছেলেমেয়েরা একটি জিনিস দেখে বেশ মজা পেয়েছে, আর তা হল উঠোনের এক কোণে রাখা সে আমলের এক কুয়া, আর সাথে পানি তোলার জন্য কপিকলে ঝুলানো দড়ি-বাঁধা বালতি; পাশে সবুজ রঙের একটি টিউবওয়েল। এক পাশের মাঝামাঝি জায়গায় গাছের সারির মাঝে লোরকার এক আবক্ষ মূর্তি, তার মুখে স্মিত হাসি, যেন আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছেন। সবাই ছবি তুললাম লোরকার সাথে, আর মনে মনে তাঁকে জানালাম আমাদের শ্রদ্ধা, ভালবাসা। (চলবে)

জবভ:

১. চধরংধলব ংরহ পধহপরড়হ, সঙ্গীতবিহীন প্রান্তর

ছবি

ফিলিস্তিনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে অণুগল্প

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

শিল্পী সুনীল কুমারের ‘পথের গল্প’-এর স্বরূপ

ছবি

রাত গভীর

ছবি

‘এ নয় আঁখিজল’

জ্যৈষ্ঠের পদাবলি

ছবি

ওসামা অ্যালোমারের একঝুড়ি খুদে গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কাব্যগ্রন্থে নীলদ্রোহের রেখাপাত

ছবি

নার্গিস-নজরুলের স্মৃতিধন্য দৌলতপুরে একদিন

ছবি

যেভাবে ভেঙেছিল এক মৌনতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

নজরুল সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের প্রেক্ষিত

ছবি

স্বাধীনতার কবি নজরুল

ছবি

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রতিভা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দাউদ হায়দার: স্বকীয় ও নির্বাসিত

ছবি

অটোগ্রাফ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

আলবেয়ার কামুর গল্পে অস্তিত্বের নিষ্ঠুরতা

ছবি

উপন্যাসের জন্মবীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কানাগলি

ছবি

পার্ল এস বাক-এর কবিতা

ছবি

হোসে এচেগারাই স্প্যানিশ আলোকবর্তিকা

ছবি

নববীণায় বাজে নতুনের জয়গান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের ‘করুণা’ ঘিরে কিছু কথা

ছবি

গীতাঞ্জলির ইতিবৃত্ত ও বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ

ছবি

রবীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ ও ‘ছিন্নপত্র’

ছবি

নিউ নেদারল্যান্ডস: জার্র্সি এবং লেনাপি জনগোষ্ঠী

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বকুলীর সেইরাত

ছবি

আকাশের প্রান্ত

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৮

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

ফুয়েন্তে বাকেরোজ গ্রামে গার্সিয়ার জন্মস্থানের যাদুঘর: কাসা মুজেও ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা

বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

সিয়েরা নেভাদা, আলহাম্বরা ও ফ্লেমেনকোর মায়ায় ভুলে গিয়েছিলাম গ্রানাদার নিসর্গের আরেকটি খ- জলপাই বাগানকে। প্রথমদিন বিমানবন্দর থেকে শহরে আসার পথে দেখেছিলাম জলপাই গাছের সারি, এরপর তা আর দেখা হয়নি। লোরকার কবিতায় বারবার উঠে এসেছে জলপাই ও কমলা গাছ। গ্রানাদা শহরের পথেপ্রান্তরে ছড়িয়ে আছে অগণন কমলা গাছ। তবে জলপাই গাছের দেখা পেতে হলে যেতে হবে শহরের বাইরে গ্রামে।

নাবিল ও নাতাশা বরাবরই নিসর্গের প্রতি অনুরক্ত। তারা কদিন ধরেই বলছিল- গ্রানাদা শহর খুব সুন্দর, কিন্তু তার ইতিহাস খুব বোরিং, এর বাইরে যেয়ে আমরা চাই নেচারকে দেখতে, এনজয় করতে। বললাম- আমিও নিসর্গের পূজারী, যার মাঝে আছে বিশুদ্ধ সৌন্দর্য। চল, আমরা নিসর্গের মাঝে ঘুরে আসি। দুজনে মিলে বের করল এক অলিভ গার্ডেন ট্যুর, আর আমার মতামত নিয়ে ট্যুরের বুকিং দিয়ে দিল। শহরে ইতিহাসের ধূসর আবহাওয়া থেকে বাইরে প্রকৃতির নির্মল হাওয়ায় একটু নিঃশ্বাস নেয়া যাক।

আজ ভোরে সবার ঘুম ভাঙল একটু দেরিতে। তাই হোটেলের ব্রেকফাস্ট খাওয়া হলো না। এতে নাবিল ও নাতাশা বেশ খুশি। হোটেলের ব্রেকফাস্ট ভালই, তবে বাইরের ক্যাফেতে খাওয়া তাদের খুব পছন্দ। সে ইচ্ছে পূরণের এক সুযোগ আসল। বাইরে বের হয়ে দেখি অগণিত ক্যাফে, কোনটি ছেড়ে কোনটিতে যাব। নাবিল নাতাশাই নিয়ে গেল একটিতে, ক্যাফে দে আন্দালুসিয়া- নামটিই সম্ভবত তাদের পছন্দ হয়েছে। গ্রানাদার ঐতিহ্যবাহী এক ক্যাফে, বেশ পুরনো, কিন্তু সুন্দর আসবাবপত্র, দেয়ালে তৈলচিত্র, নকশা করা টেবিল ক্লথ, আর চমৎকার ব্যালকনি- সব দিকে আভিজাত্যের ছাপ। ফাঁকে ফাঁকে ফুলের টবে ফুটে আছে জেরেনিয়ম, জেসমিন, টিউলিপ, তাদেরকে হালকাভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে ভোরের মিষ্টি রোদ। ফুলের সুবাসের সাথে মিশে আছে সদ্য গ্রাইন্ড করা কফি আর অমলেটের ঘ্রাণ। ম্যানেজার ফ্রান্সিসকো অরতিজ, সকালের ব্যস্ততার মাঝেও খুবই প্রফুল্ল, আমাদেরকে সহাস্যে ভেতরে নিয়ে গেল। পুরো ক্যাফে মানুষে ভরপুর। এর মধ্যে কেউ টেবিল খালি করে যাবে বলে মনে হলো না। কারণ, এখানে সব কিছু সার্ভ করা হয় অনেক সময় নিয়ে, আর এরা ব্রেকফাস্ট করে খুব আয়েস করে, ধীরেসুস্থে। অরতিজ বলল, তোমরা এখন অর্ডার দিতে পার, খাওয়া তৈরি হতেই একটি টেবিল খালি হয়ে যাবে, তাহলে তোমাদের সময় একটু সেভ হবে। এর মধ্যে বারান্দায় বসে গ্রানাদার ভোর দেখতে পার, বা ভেতরে ক্যাফেও ঘুরে আসতে পার। একটু পরে আমরা আরো ব্যস্ত হয়ে যাব, তখন শুরু হবে সেকেন্ড ব্রেকফাস্ট। আমি বললাম, এটি আবার কী? অরতিজের সহাস্য জবাব, স্পেনে অনেকে দু’টি ব্রেকফাস্ট করে। ৭টা থেকে ৯টা প্রথম ব্রেকফাস্ট, নিজের বাসায়, হালকা ব্রেকফাস্ট, মিষ্টি জাতীয় কিছু খেয়ে নেয়, যেমন দুধের সাথে সিরিয়াল, কফিও থাকে। ১০টা থেকে ১১টা দ্বিতীয় ব্রেকফাস্ট, বাসার বাইরে ক্যাফেতে। অনেক অফিসে দ্বিতীয় ব্রেকফাস্টের জন্য ৩০ মিনিটের বিরতি দেয়া হয়। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, দুটি ব্রেকফাস্ট দূরে থাক, আমেরিকাতে আমরা অনেক সময় একটি ব্রেকফাস্টও নিতে পারি না। সকালে অফিসে যাওয়ার পথে অনেকে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে ব্রেকফাস্ট সারে। অনেক নারী এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালাচ্ছে, অন্যহাতে মেকআপ নিচ্ছে, সাথে ফোনে চলছে মিটিং। এ যেন এক ইঁদুর দৌড়। অরতিজ বলল, স্পেনে সবাই নিজেকে ও পরিবারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এরপর আসে বন্ধু-বান্ধব। কাজের গুরুত্ব সবার শেষে। আমি বললাম, আমেরিকাতে অর্ডার অফ প্রিফারেন্স পুরো উল্টো- কাজ সবার আগে, এর পরে অন্য সব।

আবার আমাদের ব্রেকফাস্টে ফিরে আসি। আমরা দেখতে লাগলাম কী কী অর্ডার দেয়া যায়। নতুন জায়গায় এ এক সমস্যা, বিশেষ করে খাবারের বেলায়, কী নেয়া যায়। নাবিল সব সময় চমকদার কিছু নিতে চায়, সে অর্ডার দিল পিনছো দে তরতিয়া- অলিভ অয়েল দিয়ে সবজি মিশ্রিত অমলেট, সাথে কর্ন ব্রেড। নাতাশা অর্ডার দিল মানতেকুইয়া ই মারমেলাদা- মাখন ও জ্যাম দিয়ে পাউরুটি। ফারজানা অর্ডার দিল তরতিয়া দে পাতাতাস- আলু মিশ্রিত অমলেট। আমি অর্ডার দিলাম পান কন তোমাতে- টমেটো দিয়ে পাউরুটি। সবাই নিলাম ফলের রস, যা তাজা ফল- কমলা, ডালিম, আপেল থেকে নির্যাসিত। অর্তিজ বলল, কফি দেয়া হবে একটু পরে, যাতে এটি ফ্রেশ থাকে। এখানে বিভিন্ন প্রকারের কফির বীন আছে, কোনো একটি বেছে নিতে হয়। পরে তা সামনের গ্রাইন্ডারে গ্রাইন্ড করে সেদ্ধ করা হয়। সেজন্য কফির স্বাদ থাকে খুবই সতেজ ও তৃপ্তিকর। কফিতে চুমুক দিতে দিতে দেখতে থাকলাম আশেপাশের সবাইকে। সবাই খাচ্ছে, কথা বলছে, হাসছে, মাঝে মাঝে তর্কও হচ্ছে, কিন্তু কারো কোনো রাগ নেই। মনে হলো সবাই সুখী, প্রাণোচ্ছল।

ক্যাফে থেকে বের হয়ে দেখতে লাগলাম ভোরের গ্রানাদাকে- যা এর মধ্যেই জেগে উঠেছে নতুন এক দিনের জন্য। মানুষের মেলা শুরু হয়ে গেছে। বেশিরভাগ যাচ্ছে কাজে- হেঁটে, সাইকেলে, বাসে, ট্রামে, কারে। ছাত্রছাত্রীরা যাচ্ছে তাদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দেখা গেল আরেক ধরনের মানুষের ¯্রােতধারা- যাদের হাঁটা-চলা ও ইতিউতি তাকানোতেই বোঝা যায় তারা পর্যটক। ১০-১৫ জনের কোনো এক দল গাইডকে অনুসরণ করে যাচ্ছে বিশেষ কোনো গন্তব্যে। অনেকে ঘুরছে হপ-অন-হপ-অফ বাসে করে। বেশিরভাগ হেঁটে হেঁটে সব দেখছে। স্যুভেনির শপের ঝাঁপি খুলে গেছে। মোড়ের ডিলাররা বসে আছে টিকিট হাতে- সব ধরনের টিকেট- আলহাম্বরা, মিরাদর সান নিকোলাস, আলবাইসিন, সেক্রোমন্তে- এর গাইডেড ট্যুর। আর আছে ফ্লেমেনকো শো-এর হরেক রকম টিকেট। তবে এখনো শুরু হয়নি প্লাজার কাছে গিটার, ভায়োলিন বাজানো। শুরু হয়নি জিপসিদের নাচ-গান।

টেক্সিতে ৩০ মিনিট পথ পাড়ি দিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম সিয়েরা নেভাদার পাদদেশে, জলপাই বাগান ঘেরা এক গ্রাম আকুলাতে। এখানে ওমেড কোম্পানির অনেকগুলি জলপাই বাগানের একটিতে আমাদের ট্যুর। সাথে আছে জলপাই প্রক্রিয়াজাত করে জলপাই তেল উৎপাদন করার এক প্ল্যান্ট। ফ্লোরে অর্কিডের টব ও দেয়ালে চিত্রকর্মে সুন্দর করে সাজানো ওমেড অফিসের লবিতে আমরা এসে বসলাম। আমাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, কারণ ট্যুর শুরু হবে একটায়, আমরা একটু আগে চলে এসেছি। একে একে অনেকে আসছেন। ঠিক একটার সময় আসল আমাদের গাইড ক্রিস্টিনা, খুবই সপ্রতিভ, চমৎকার ইংরেজি বলে। এসে সবাইকে স্বাগত জানালো, আর একে একে আমাদের পনের জনের সবাইর সাথে পরিচিত হলো। তারপর ওমেড কোম্পানির নীতি, পরিকল্পনা ও সাফল্য নিয়ে এক ছোট বিবরণী দিল। একটু গর্ব করে বলল, স্পেন সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জলপাই উৎপাদন করে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জলপাই এ দেশেই উৎপাদিত হয়। সর্বশেষে বলল, হিসেব-নিকেশ এখন থাক। জলপাই নিয়ে বাকি কথা বলব জলপাই বাগানে দাঁড়িয়ে।

ক্রিস্টিনাকে অনুসরণ করে কয়েক মিনিট হেঁটে আমরা পৌঁছলাম এক জলপাই বাগানে। দিগন্ত-বিস্তৃত জলপাই গাছের সারি, মাঝে মাঝে পপলার গাছের ছায়া, সবাইকে কোলে করে রেখেছে সিয়েরা নেভাদা, তার চূড়াগুলি বরফে ঢাকা। স্পেনীয় শব্দ সিয়েরা নেভাদা অর্থই হলো বরফ-ঢাকা পর্বতমালা। এ পর্বতমালা, ওপরে বরফের প্রলেপ, নিচে জলপাই বাগান- সূর্যের উজ্জ্বল আলো সবাইকে মিলিয়ে সৃষ্টি করেছে এক মনোরম দৃশ্যের। গ্রানাদার সূর্যের আলো সবসময় চোখ-ধাঁধানো, তবে জলপাই বাগানের সবুজে তাকে মনে হচ্ছে অনেক বেশি ¯িœগ্ধ।

ক্রিস্টিনা যে বাগানে নিয়ে আসল তার গাছগুলির বয়স ১০ বছর। অন্য পাশে আছে ২০ বছর, ৩০ বছরের পুরনো গাছ। তারা ৪০ বছর পর্যন্ত গাছ থেকে জলপাই আহরণ করে। এর পর গাছ তুলে ফেলে নতুন গাছ লাগানো হয়। ক্রিস্টিনা আমাদের একটি নতুন বাগানে নিয়ে গেল- গত বছরই মাত্র গাছ লাগানো হয়েছে, জলপাই ধরবে আরো ২ বছর পরে। নতুন গাছের জলপাইয়ের মান সবচেয়ে ভালো। গাছের বয়স বাড়ার সাথে ফলনের মান ও পরিমাণ কমে আসে।

মনে পড়ে গেল চা বাগানে ৩২ বছর আগে কাজ করার স্মৃতি। ক্রিস্টিনা জলপাই গাছের যে বৈশিষ্ট্যগুলি বলল তা চা গাছের সাথে বেশ মিলে যায়। তবে চা গাছে লাগে উঞ্চতা ও প্রচুর বৃষ্টি, জলপাই গাছে উঞ্চতা ও শুষ্ক আবহাওয়া।

নাতাশা জিজ্ঞেস করল, জলপাই গাছে পানি দিতে হয় না? ক্রিষ্টিনা বলল, হ্যাঁ। জলপাই গাছে পানি দিতে হয় মাটির নিচে ড্রিপিং সেচের মাধ্যমে, যাতে পানি গাছের গভীর শেকড়ে পৌঁছে। গ্রানাডা খুবই শুষ্ক জায়গা- বৃষ্টি হয় কম, আজ ২৭ ডিসেম্বর, এ মাসে বৃষ্টি হয়েছে মোট ১ ইঞ্চি, সারা বছর মোট বৃষ্টির পরিমাণ ১৪ ইঞ্চির মতো। আমি বললাম, দেশে চা-বাগানে ছিলাম, জায়গাটির নাম শ্রীমঙ্গল, সেখানে সারা বছর বৃষ্টি হয় ১০০ ইঞ্চি, গ্রানাদার সাত গুণ। ক্রিস্টিনা বিস্ময়ে চোখ বড় করে বলল, ইউ মিন হানড্রেড ইঞ্চ? আমি বললাম, হ্যাঁ। কোনো কোনো বছর এর চেয়েও বেশি হয়। সে চিৎকার করে উঠল, ‘ওয়াও’।

ক্রিস্টিনা এরপর আমাদের নিয়ে গেল একাকী দাঁড়িয়ে থাকা এক বিরাট গাছের সামনে। ভাবলাম পপলার গাছ। সে বলল, এটি একটি জলপাই গাছ, বয়স ১০০ বছরের বেশি। শতায়ু মানুষ দেখেছি কম, শতবর্ষী গাছ আরো কম। ক্রিস্টিনা যোগ করল, এ গাছটিতে জলপাই ধরে খুব কম, মানও ভাল নয়। আমরা এটি রেখেছি শুধু প্রদর্শনীর জন্য।

শুষ্ক প্রান্তরে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা শতায়ু এ জলপাই গাছটির কথাই যেন বলেছেন লোরকা:

বিশুষ্ক প্রান্তরে

এক জলপাই গাছ

চলমান

এক

জলপাই গাছ।১

জলপাই বাগানে কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে দেখার পর সবাই গেলাম আধুনিক এক প্ল্যান্টে। ক্রিস্টিনা তা দেখানোর পাশাপাশি সব কিছুর সুন্দর বর্ণনা করে চলল। সেখানে ট্রাক্টরে করে আনা হচ্ছে বাগান থেকে সদ্য তোলা জলপাই, ঢালা হচ্ছে বর্গাকার এক ট্যাঙ্কে, তা পরিষ্কার ও বাছাই হচ্ছে এক মেশিনে, কনভেয়র বেল্ট তা নিয়ে যাচ্ছে পরবর্র্তী ধাপে। অনেকগুলি স্তর পেরিয়ে শেষ ধাপে বের হচ্ছে অলিভ অয়েল।

প্ল্যান্ট দেখানো শেষ করে ক্রিস্টিনা আমাদের নিয়ে গেল অয়েল টেস্টিং রুমে। সে আমাদের ব্যাখ্যা করল অলিভ অয়েলের প্রকারভেদ ও তার কারণ। বোতলে সাজানো আছে বিভিন্ন প্রকারের অলিভ অয়েল- একে একে ছোট কাপে করে ক্রিস্টিনা প্রথমে মুখে দিল- তারপর দিল সবাইকে। এক্সট্রা ভার্জিন, ভার্জিন ও রেগুলার, প্রতিটির মাঝেও বিভিন্ন প্রকারের অলিভ অয়েল। সবাই একে একে মুখে নিয়ে তাদের মতামত দিল কোনটির স্বাদ কেমন। আমি বললাম, সবগুলিই আমার কাছে মনে হচ্ছে একই রকম। শুনে সবাই হেসে উঠল।

এখানে প্রকৃতি ও প্রযুক্তি এক সাথে দেখে আমরা বের হয়ে আসলাম। দুপুরের কড়া রোদ, কিন্তু তেমন গরম লাগছে না। একটা হালকা আমেজ হাওয়ায় ও আমাদের মনে।

জলপাই বাগান ট্যুর শেষ হওয়ার পর নাতাশা ও নাবিল বলল, সিয়ারা নেভাদার রিজর্টে যাবো। এটি স্কিয়িং ও মাইন্টেন হাইকিং এর জন্য বেশ জনপ্রিয়। তারা গুগল ম্যাপে দেখল এখান থেকে টেক্সিতে মাত্র ৪৫ মিনিটের পথ। আমি বললাম, সিয়ারা নেভাদা এখান থেকেই খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে। সেখানে যাওয়ার কী দরকার আছে? নাতাশা বলল, আমি স্কিয়িং করব। নাবিল বলল, আমি মাউন্টেন হাইকিং করব। আমি বললাম, দেখ, এগুলি এত সোজা নয়। তার জন্য দরকার আগের কিছু প্র্যাকটিস, যা তোমাদের নাই। দু’জনই প্রতিবাদ করে বলল, আমরা অনেকবার আরলিংটন মলের আইস রিংয়ে আইস স্কেটিং করেছি। কাজেই আমরা পারব। আমি বললাম, দেখ, আইস স্কেটিং আর স্কিয়িং এক জিনিস নয়। স্কিয়িং অনেক বেশি রিস্কি। তুমি যদি ঠিকমত কন্ট্রোল করতে না পার তাহলে একলাফে তোমরা সিয়ারা নেভাদা থেকে আলহাম্বরায় চলে যেতে পারো। আমরা বিদেশে বেড়াতে এসেছি, এখানে হাত-পা ভাঙলে বিরাট সমস্যা। মাউন্টেন হাইকিং কম ঝুঁকিপূর্ণ, তবে তার জন্য অনেক সময় লাগবে, মনে কর কমপক্ষে একদিন, বা বেশি। আমাদের হাতে এরকম সময় নাই। ওরা বলল, তোমরা খুব প্রোটেকটিভ। সব কিছুতে ভয় পাও। আমি বললাম, আমরা প্রোটেকটিভ, কারণ তোমাদেরকে নিরাপদে রাখতে চাই। দেখ, আমার এক ভাল আইডিয়া আছে, তোমরা ভেবে দেখতে পার।

বললাম, গ্রামে যখন ঘুরতে বের হয়েছি, তাহলে আর একটু ঘুরি। আজ যাই এক বিশেষ গ্রামে, এক বিশেষ ব্যক্তির স্মৃতি-জড়ানো বাড়ি দেখতে। নাবিল বলল, সে ব্যক্তিটি কে? আমি বললাম, একটু সাসপেন্স থাকুক। তোমরা গেলেই দেখতে পাবে।

সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার বরফ-গলা-জল-বিধৌত এক সমতল-ভূমি লা ভেগা, তার বুকে সিয়েরা থেকে বের হয়ে প্রবাহিত হেনিল নদী। উর্বর এ এলাকায় ছড়িয়ে আছে এসপারাগাস, তামাক আর ভুট্টার ক্ষেত, মাঝে মাঝে পপলার গাছের সারি। গ্রানাদা শহর থেকে ১২ মাইল দূরের এই নিসর্গের মাঝে এক গ্রাম ফুয়েন্তে বাকেরোজ বিখ্যাত হয়ে আছে, কারণ এখানেই ৫ জুন, ১৮৯৮ সালে লোরকার জন্ম, ছোট এক বাড়িতে, যা আজ এক জাদুঘর: কাসা মুজেও ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা।

এখানে পৌঁছেই সামনের পার্কে দেখলাম লোরকার এক ভাস্কর্য: শিল্পী কায়েতানো আনিবেল এর ১৯৮০ সালের সৃষ্টি। আর পাশের একটি বাড়ির বাইরের পুরো দেয়াল জুড়ে লোরকার দু’টি বিশাল ছবি, তার একটিতে লোরকা বাজাচ্ছেন পিয়ানো। স্পষ্টত এটিই লোরকার জন্মস্থান ও জাদুঘর। ভেতরে ঢুকে যোগ দিলাম ৮ জনের একটি দলে, গাইড ঘুরে দেখাচ্ছেন আর সাথে চলল বর্ণনা। প্রবেশেই ছিমছাম বসার ঘর, সে আমলের আসবাবপত্র, বেশ বনেদী, পুরো বাসার মেঝেতে সুন্দর টাইলস বসানো। লোরকার বাবা-মায়ের কামরায় গেলাম, তাঁদের পাশের কামরায় লোরকার দোলনা ও দাঁড়ানোর চেয়ার। শিহরিত হয়ে উঠলাম- এখানেই লোরকার জন্ম, এখানেই শিশুকালে তাঁর খেলা ও বেড়ে ওঠা। পাশেই পিয়ানো রুম, যা মনে হলো পুরো বাসার সবচেয়ে সুন্দর কক্ষ। এখানে বেশ কারুকাজ করা কাল রঙের বড় এক পিয়ানো- বাজাতেন মূলত লোরকার মা, যিনি ছিলেন একজন ভাল পিয়ানোবাদক। লোরকার কাছে তাঁর স্কুল শিক্ষয়িত্রী মা ছিলেন আদর্শ, যাঁকে অনুসরণ করে জীবনকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মার হাত ধরে লোরকার পিয়ানো শেখা। লোরকা প্রথম জীবনে সঙ্গীত শিখেছেন, এটি তাঁর নেশা ও পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন। সঙ্গীত তাই গভীর প্রভাব রেখেছে লোরকার কবিতায়।

এরপর গেলাম খাবার ঘরে, দেখলাম- ফায়ারপ্লেস, টেবিল-চেয়ার, কোনায় রাখা এক গ্রামোফোন ও সাথের স্লেটের রেকর্ড। পাশেই রান্নাঘর। এরপর উঠলাম দোতলায়, যা অতীতে ছিল শস্য রাখার গোলাঘর, আর এখন লোরকার কাজের সংরক্ষণ ও প্রদর্শনী কক্ষ। এখানে দেখলাম তাঁর আঁকা বিভিন্ন স্কেচ, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে তোলা বিভিন্ন ছবি এবং তাঁর বিভিন্ন বইয়ের পোস্টার। এক আলাদা কাঁচ-ঢাকা শেলফে রাখা আছে বিভিন্ন পুতুল, যেগুলি স্থান পেয়েছিল লোরকা রচিত এক পুতুল নাটকে। ম্যানুয়েল দ্য ফাইয়া ও হারমেনেহিলদো-র সহযোগিতায় ৬ জানুয়ারি, ১৯২৩ লোরকা এ পুতুল নাটকের আয়োজন করেন। এটি আয়োজিত হয় তাঁর গ্রানাদার ৩১ এসেরা ডেল ক্যাসিনো ঠিকানার বাসায়।

নাবিল ও নাতাশা একটি ব্যাপারে খুব খুশি, কারণ এখানে জাদুঘরের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। এমনিতেই ওরা ছবি তুলতে চায় না, বিপরীতে আমার ছবি তোলার বাতিক, অনেকটা নেশার মতো। আর আমি ভ্রমণের এসব ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে আনন্দ পাই, যার ঘোর বিরোধী নাবিল নাতাশা। তারা বলে ফেসবুকে দিলে তাদের প্রাইভেসি নষ্ট হয়, যা তারা চায় না। দুই প্রজন্মের চিন্তা ধারায় কী প্রভেদ!

সবশেষে গেলাম বাসার পেছনের পাকা উঠোনে, যার চারপাশ ঘিরে আছে এক সুন্দর বাগান। আমার ছেলেমেয়েরা একটি জিনিস দেখে বেশ মজা পেয়েছে, আর তা হল উঠোনের এক কোণে রাখা সে আমলের এক কুয়া, আর সাথে পানি তোলার জন্য কপিকলে ঝুলানো দড়ি-বাঁধা বালতি; পাশে সবুজ রঙের একটি টিউবওয়েল। এক পাশের মাঝামাঝি জায়গায় গাছের সারির মাঝে লোরকার এক আবক্ষ মূর্তি, তার মুখে স্মিত হাসি, যেন আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছেন। সবাই ছবি তুললাম লোরকার সাথে, আর মনে মনে তাঁকে জানালাম আমাদের শ্রদ্ধা, ভালবাসা। (চলবে)

জবভ:

১. চধরংধলব ংরহ পধহপরড়হ, সঙ্গীতবিহীন প্রান্তর

back to top