alt

সাময়িকী

রাত গভীর

এলিজা খাতুন

: বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

মেসের সদস্যরা দেড়-হাতি বারান্দায় বসে তুমুল আড্ডায়। নূরজান মেসের কাছাকাছি এসে আভাস পায়- সম্ভবত রান্নার দুরবস্থা আড্ডার বিষয়বস্তু। প্রাচীরের ভেতরে এসে আরও স্পষ্ট হয়, অনুমান ঠিকই। নূরজানকে দেখতে পেয়ে মতিন বলে, যাক বাঁচালে বুজান!

শুক্রবার ছুটির দিন, দীর্ঘ বারান্দা জুড়ে বিশ বাইশ জন বসে আছে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে। মোমেন নামে নতুন সদস্য বলে, নূরী বু আজ না এলে আমার উপরেই চুলোয় আগুন দেবার ভার পড়ছিল। ভাগ্যিস এলে! একথা বলেই বারান্দা থেকে নেমে নূরজানের সামনে রাজ দরবারের স্টাইলে কুর্ণিশ করতে শুরু করে। বাকিরা হো হো করে হেসে ওঠে।

নূরজান বোঝে, নিশ্চয়ই নূরজানকে নিয়ে মেসে আলোচনা হয়েছে ইতোমধ্যে। নূরজান যখন কাজ শুরু করেছিল এই মেসের সারিবদ্ধ পাঁচটি রুমে পনেরোটা সিট ছিল। পরে নতুন রুম হয়েছে আরও। বর্ধিত এল-শেপড মেসে এখন গড়ে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ জন বোর্ডার।

এদের মধ্যে একজন সরকারি অফিসের কেরানি, কয়েকজন কলেজ পড়ুয়া ছাত্র, একজন ড্রাইভার, একজন চাকরি-প্রত্যাশী পরীক্ষার্থী, বাকিরা পার্শ্ববর্তী গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেহাত কম নয়, জনা বিশেকের মতো। সন্ধ্যায় ওরা এক জোট হয়ে গল্প-আড্ডায় মেতে গেলে- বটগাছের নিচের গ্রাম্যমেলা বা গঞ্জের গোটা হাটের কোলাহল উঠে আসে এই কলোনিতে।

আরিফ, সাংবাদিক মতিনসহ কদিন হলো নতুন এসে উঠেছে সদ্য ব্যস্ত হয়ে ওঠা একজন উকিলও; নাম পাতালু, আদিবাসী। তার উকিলী মেজাজে কথার মধ্যে কথার মারপ্যাঁচ বেশি এজন্য মেসের সদস্যরা পাতালু নামটাকে প্যাঁচালু ডাকে। উচ্চারণে আরেকটু সুবিধার্থে ডাকতে শুরু করেছে ‘প্যাঁচাল দা’ বলে। অবশ্য নামের বিকৃতির দরুন কোনো আপত্তি বা নতুন প্যাঁচ বাধাননি তিনি। উকিলী ঢঙে কথার কারণে মেসের অন্য সদস্যরা প্যাঁচালুর উপর বিরক্ত হলেও, কোট-কাচারির গল্পে শ্রোতা হিসেবে অমনোযোগী নয় নূরজান।

মাঝে মাঝে হাস্যরহস্যে নূরজান বলে, আমরা বিপদে পরলি আমাগের হয়ে ওকালতি করবেন তো পাতালু দা? আবার কোনো কোনো দিন বলে, এই ঘিঞ্জি শহরে দম আটকে আসে গো দাদা, একদিন দ্যাকপেন আপনাগের পাহাড়ে চলে গেছি। না, নূরজান বিকৃত নামে ডাকে না। আইনের কথাবার্তা গুরুত্ব দিয়ে শোনার জন্য নূরজানকে পাতালু দা ভক্তিশ্রদ্ধাও করে কম নয়। যদিও কেরানি-মহব্বত ভাই নূরজানের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে কটু ভাষায় এটা সেটা হুকুম করে, তার ধরণ দেখে অন্য সদস্যদের ধারণা করতে অসুবিধা হয় না সরকারি অফিসে আমলাদের ফরমায়েস খাটা কর্মচারী সুযোগ-সুবিধা পেলে তারও প্রভুত্ব দেখাতে মন চায়।

মেস-নিবাসি মূলত এদের প্রত্যেকেরই ন্যূনতম খরচে থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা এর চেয়ে আর কোনো মেস বা হোস্টেলে নেই আশেপাশে। ছুটির দিনে মেসের প্রত্যেক সদস্য উপস্থিত থাকায় হৈচৈ অনিবার্য। এই দিনে মেস ম্যানেজার দুপুরের খাবারের তালিকায় মাংস রাখে।

নূরজান এই মেসে পুরোনো রান্নার মানুষ। নূরজানকে এরা এতটা আপন এতটা অধিকার ফলাবার স্থানে বসিয়েছে যে, ধরাবাধা নিত্যদিনের রান্না ছাড়াও, যে কেউ যখন তখন আবদার করে বসে দ্বিধাহীন; নূরি বু লেবু-পাতা কাঁচা ঝাল, সরষে দিয়ে আম মাখাও তো, নূরি বু নারকেল কোরা দিয়ে মুড়ি মাখাও তো ইত্যাদি। সময় সুযোগ হলে ওদের কেউ কেউ আবার নূরজানকেও মুরগি ছিলে দেয়, টিউবওয়েলে জল টেনে দেয়। মতিন রসুনের খোসা ছাড়িয়ে সহায়তা করছে আজ। প্রায় চার-পাঁচ বছর আগে মেসে রান্নার কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল নূরজান। অধিকাংশ দিনই দুপুরের রান্নাসহ সব কাজ গুছিয়ে, বিকেলে নকশীঘরে সেলাইয়ের কাজে যায় নূরজান। দলবেঁধে সেলাই করে নকশিকাঁথা। ৪০-৪৫ জনের দল। দেশবিদেশে সুনাম কুড়োনো কাঁথার ব্যবসায় নকশিঘরে মহাজনের অর্ডার অনুযায়ী কাজের চাপ থাকে বছরভর। অথচ গতকাল শুনেছে সেলাই কাজ থেকে বিদায় করে দেবে নূরজানকে। সে নাকি এটা ওটা দাবি তুলে অন্য সেলাই-কর্মীদের উসকে তোলে।

নূরজান মেসের সদস্যদের খাবার অসুবিধায় ফেলেনি কোনোদিন। খাটিয়ে মেয়ে। একসাথে অল্প সময়ের ভেতরে অনেক কাজ করে উঠতে পারে। নূরজানকে নূরী’বু বলে ডাকে এরা।

মোমেনের কুর্ণিশ করা স্টাইলে নূরজান হাসি থামাতে পারেনি এখনও। নূরী’বু তাড়াতাড়ি রান্না চাপাও তো, কদিন ধরে খাওয়া দাওয়ার বেহাল দশা, বলে মতিন। নূরজান দেরি না করে রান্নার কাজে লেগে যায়। নূরজান জানে সদস্যরাগোসল-খাওয়া সেরে ফোন হাতে নিয়ে যার যার চৌকিতে গা গড়ায়। বাড়িতে কথা বলে। কেউ আবার কাগজ কলম নিয়ে বসে; বেতনের টাকাপয়সা খরচের হিসাব করে। অনেকে পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়। ভিন্ন ভিন্ন বাসনে খাবার বেড়ে সবার ঘরে ঘরে দিতে হয় দুপুর দুটোর ভেতরে।

এদের মধ্যে আরিফ আলাদা। তাল মিলিয়ে হাসি-তামাসায় যোগ দেয় না। টিউশনি করে কয়েকটি, আর চাকরির বিজ্ঞাপন খুঁজে আবেদন লেখে সপ্তাহে দু’তিনটি। দুপুরে সবাই খেতে বসলে, আরিফ তখন রুমের এক কোণে নিজের বেডে বসে পেপারের বিজ্ঞাপন কাটে কাঁচি দিয়ে। মেসের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মানুষগুলোর দিনাতিপাত এমনই।

আজ নূরজান আরিফকে গোসলের জন্য তাগাদা দেয়। ভাইজান একোনও কাগজপত্তর নিয়ে পড়ে আছেন? গোশল খাওয়া লাগবে না? কাজে মগ্ন থাকার মাঝ থেকে আরিফ চমকে তাকায় নূরজানের দিকে। নূরজান আবার বলতে থাকে, সগুলির খাবা শেষ হলি এঁটোকাঁটা পইষ্কার কইরে বাসনপত্তর ধুয়ে তারপর আমার নিস্তার, সময়ের কাজ সময়ে করেন না ক্যান বুজিনে। আমার হয়েছে যত জ্বালা।

নূরজানের অদ্ভুত অভিব্যক্তি আরিফকে ভাবায়। তাকে যত দ্যাখে, নতুন অভিজ্ঞতা জন্ম নেয় তত। সবার প্রতি নূরজানের খবরদারি-রাগ যেন একটা অধিকার থেকে বের হয়ে আসে। কী সেই অধিকার? কী সেই টান? রক্তের সম্পর্কের কেউ তো না। যা কিছু কাজ তার, সব তো টাকার বিনিময়ে! ক’টাকাই-বা বেতন দেওয়া হয় তাকে?

রান্না করে রেখে চলে যেতেই পারে। কেন সবাইকে ঠেলেঠুলে খেতে বসার তাগাদা করে? কেন সবার ভালো মন্দ খোঁজখবর নেয়? সে কি বেতনের বদলে? তা তো নয়! তাহলে নূরজানের মানবতা? টান? সবার প্রতি ভালোবাসা? সবাই তার কাছে আপনজন? কে সে! মা, বোন, স্ত্রী, প্রিয়তমা? এসব ভাবতে ভাবতে আরিফ আবার কোথায় যেন হারায়। ইদানীং ভাবনা চলে আসে যে কোনো বিষয়ে। ভাবনাগুলো লিপিবদ্ধ করে সময়-অসময় তোয়াক্কা না করেই। সম্মুখের কাগজপত্রগুলো গোছাতে থাকে আনমনে।

নূরজান আরিফের খাবারের পাত্র ওর সামনে বেডের উপরে রেখে বলে, বেড়ালে মুখ দিয়ে দিলি আজকেও পেটে দড়ি পড়বে, খেয়ে দেয়ে সারাদিন ধ্যান করেন। গোসল সন্ধ্যেবেলা করলিও চলবে।

আরিফ অবাক তাকিয়ে থাকে নূরজানের দিকে। কখন যে এ মেয়েটি মেস মেম্বারদের অভিভাবকের মতো হয়ে গেছে কেউ ভেবে দ্যাখেনি। কোনো কোনো দিন সকালে টিউশনে যেতে গা-ঢিল স্বভাব দেখে নূরজান বলে, আরিফ ভাই ওঠেন, দেরি হয়ে যাবেনে, একনো তো চাকরি জোটেনি। দু’চারটে ছাত্তর পড়ায়ে তবু হাত খরচ, পেট খরচ চলতিছে, না থাকলে জ্বালা বোঝবেন।

নূরজান খেয়াল করে ফ্যাক্টরির কাজ করা আঠারো-কুড়ি সদস্যের হাসি-তামাশার মাত্রা কমে গেছে ইদানীং, প্রত্যেকের মুখাবয়বে ভর করেছে দুঃশ্চিন্তা। ফ্যাক্টরির সিনিয়র কর্মী হিসেবে জাহিদুলের বুদ্ধি পরামর্শ মনোযোগে শুনছে অন্যরা। নূরজানও শোনে, এই তো সেদিনই এক হাঁড়ি চা বানিয়ে নিয়ে সবাইকে মগে, গ্লাসে, বাটিতে চা ঢেলে দিতে দিতে ওদের আলাপের মধ্যে বলে ফেলেছিল- আমারে নেবেন আপনাগের আন্দুলনে?

মেসের লম্বা বারান্দার এক প্রান্তে ওরা ক’দিন ধরে যে মগ্ন আছে বকেয়া মজুরি আদায় আর রোজগার নিয়ে টিকে থাকার গুরুগম্ভীর আলাপচারিতায়; তারই প্রভাবে কি নূরজানের মুখে এমন ভারি ভারি কথা!?

আরিফের কোনো উত্তর না পেয়ে নূরজান রাগমিশ্রিত স্বরে বলে যায়-

আরে বাপু সব রেখে গেলাম, খাইলে খাও না খাইলে না। আমার কাজ আছে ম্যালা। মাঠে ভাঙাড়ির গাদায় যাবো এট্টু।

মেস থেকে বেরিয়ে মহল্লার ভেতরের ঢালাই রাস্তা ছেড়ে বামে মোড় নিতেই মাঠসংলগ্ন টিনের ভাঙাড়ি দোকানের বাইরে ছিপিহীন পরিত্যক্ত বোতলের স্তূপ। নূরজান অত্যাশ্চর্য দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে থেকে বসে পড়ে। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে, মহল্লা থেকে কুড়িয়ে এনে ভাঙ্গাড়ির দোকানের সামনে জমাকৃত পরিত্যক্ত শত শত বোতলের ভেতরে তলায় লেগে থাকা তেল ফোঁটায় ফোঁটায় নিংড়ে নিতে শুরু করে সে।

নিজের মনে বিড় বিড় করে- বর্ষা-বানের সময় কাজ নেই। কী করবো! ইকেনে ঘণ্টাখানেক বোতলের তেল নিংড়াতি বসলি আড়াইশোর মতো তেল পাওয়া যায়। তাই-বা কম কী? এখন তেলের যা দাম! শুনতিছি বাজার থেকে তেল উধাও। তাছাড়া চাল থেকে শুরু করে সব জিনিসের যে দাম! ব্যাটারা গোডাউনে পুরে রেখেছে, যত দিন যাবে ওগুলো নাকি হীরে জহরতের মতোন দাম হবে। মাইনসের মুখের আহার গুদামে আটকায়ে রাখলি তাগের নাকি পরকালে জাহান্নামের আগুনে পোড়ানো হবে। আল্লা কি দেখতি পায় না আমাগের পেটের মদ্দি হাবিয়া দোজোখ? একলা জীবন, এইটুকুই তো পেট! তাই কী জ্বালা! একটা দিন বসে থাকলি দানা জোটে না, ওয়াক্ত আসলেই পেটের মদ্দি দাউ দাউ শুরু করে!

দুপুর গড়াতেই নকশিঘরে পৌঁছে দ্যাখে সবাই গোল হয়ে বসা। ওদের চিন্তিত দেখে নূরজান জিজ্ঞাসা করে কী হয়েছে? পরস্পর কয়েকজন জবাব দেয়, আমাগের একোন আর দরকার নেই। হেতো নোক রাকবে না। বিশজন মাইনষের কাম যদি একখান যন্তরে এক নিবিষে হয়্যে যায়, তেবে তারা হেতো নোক খাটাবে কী করতি?

নূরজানের রাগ ও তেজমিশ্রিত কথা- হেতোকাল আমাগের হাতের কারুকাজ দেকায়্যে হাজার হাজার কাস্টমার জোগাড় কইরে‌্য নিয়ে একোন আমাগের প্রয়োজন ফুরোয়েছে তাইতো? একোন কম সময়ে বেশি আয় করা লাগবে তাইতো? এই যে আমাগের হাতে গড়া নকশিঘর দুনিয়ার কাছে এত সুনাম হয়েছে, এর পেছনে আমাগের রক্ত পানি হয়েছে, একোন তাড়ায়ে দেবে? বললিই হলো?

নূরজানের কথায় গুঞ্জন শুরু হলো অন্যদের মধ্যে। কিছুদিন আগে নূরজান শুনেছিল-নকশিফোঁড়েরমেশিন চালু করা বিষয়ে সুপারভাইজারের সাথে মহাজনের আলাপচারিতা। ক্রেতার চাহিদা পূরণ হবে তাড়াতাড়ি। নূরজান জিজ্ঞেস করে- এখন মহাজনও কি একেবারে জবাব দিয়ে দেছে?

ওদের মধ্যে একজন বলে, তা জানিন্যে, সুপারভাইজার কয়ে গেলো আইজগের যার যেটুকু সেলাই বাকি আছে সবাই মিলে সেটুকু করে শেষ করো।

এরই মধ্যে মানেজারের কামরা থেকে হঠাৎ শোরগোল শোনা যায়। নকশিঘরে জড়ো হওয়া ওরা সারিবদ্ধ এগিয়ে যায়। ম্যানেজারের সাথে গলা ধাক্কাধাক্কি চলছে বানু মুন্ডার। বানুর তিন মাসের মজুরি পাওনা। নতুন সুতো নিতে গেলে বাধা দেয় মহাজনের লোক। বানু মুন্ডা আগের মজুরি দাবি করলে ওর গায়ে হাত ওঠায়। এ কথা শোনামাত্র ক্ষেপে ওঠে সবাই। একপর্যায়ে প্রত্যেকে নিজেদের পাওনা মজুরির দাবি তোলে।

সুপারভাইজার এসে তার কামরায় ঢোকে। নূরজান খানিক এগিয়ে যায়, সুপারভাইজারের কামরার দরজার সামনে ফাঁকা জায়গায় মাটিতে বসে পড়ে। নূরজানের দেখাদেখি একে একে অন্যরা সবাই বসে যায় দরজা ঘেরাও করে। হৈ চৈ চলতে থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বয়ষ্ক রাশিদা খালা সবাইকে থামিয়ে সুপারভাইজারের উদ্দেশ্যে বলে, মহাজনকে খবর দাও। খাতা দেখে যার যার কাজের টাকা মেটায় দিক।

বেলা বেড়ে চলে, দুপুর গড়ায়, এমন সময় একটি মাইক্রোবাসের আগমনে সবাই উৎসুক হয়ে জড়ো হয় মাইক্রোবাসটির চারপাশে। গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে স্যুট-টাই পরিহিত লম্বা সুঠামদেহী লোকটি বিনয়ের স্বরে বলল- খুব শিঘ্রই প্রত্যেকের বকেয়া পরিশোধ করে দেওয়া হবে। মহাজনের হয়ে সে দায়িত্ব নিচ্ছে এ কথাও জানায়। তার আরও কথাবার্তায় বোঝা যায় নকশীকাঁথা কেনার বড়সড় একজন বিদেশি বায়ারের এজেন্ট সে।

লোকটির কথার ধাঁচে তার কথাবার্তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে এরা সবাই একে একে স্পষ্ট হয়, কাজে বহাল থাকছে না আর কেউ। এতগুলো জীবন্ত কর্মীর জায়গা দখল করে নিচ্ছে যন্ত্রটা। তবু প্রত্যেকে নিজেকে বুঝ দেয় এই ভেবে যে, আগের পাওনা মজুরিটা ভালোয় ভালোয় পেয়ে যাক অন্তত। জোরালো কণ্ঠগুলো একটু একটু করে ভাটা পড়ছে; ব্যাপারটা খেয়াল করেছে বোধহয় গাড়িতে আসা লোকটি।

সুঠামদেহী অজ্ঞাত লোকটির চোখ-মুখের ভাষা পড়তে পারে নূরজান- “তোদের জব্দ করা একটা তুড়ির কাজ”। একটু বাদেই ধুলো উড়িয়ে চলে গেলো আচমকা আসা গাড়িটা।

নূরজান দাঁড়িয়ে থাকে হতভম্বের মতো। অন্যরাও। এরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে। বেশিরভাগ দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার।

শ্যামনগরের হারু চাচা বলে, ‘হাদে আমার মেইয়্যে বিয়ে দিলাম পাতাখালি, গাঙ্গের পানতে মেইয়্যের ঘর ভাসায়ে নে গেছে। তারে এককান ঘর বান্ধ্যে দিতি হবে, নয়তো মেইয়্যের সংসার টেকপে না। পাওনা টাকার আশায় দিন গুনতিছি।’

সুলেখা আক্তার বলে, ‘গাবুরায় আমার ভিটেমাটি-ঘর, ছাগল-গরু সব ছেলো। যে বছর স্বামী মইরলো, সে বছরই গাঙ্গের জলে বুড়্যে গেছে সব। সেখানতে চলে এসে চারডে বাচ্চা নিয়ে ইকানে বস্তিতি উটিচি। নকশা সেলাই করে যা পাতাম কোনরকম চারটে ভাত ফুটোয়ে বাচাগুনোর মুখে দিতি পারতাম। হেকোন কী করবো?’

রাশিদা খালা, সবাই যাকে নুলো খালা ডাকে, চোখের কোণ মুছে বলে,

‘বাপ আমার বিয়ের সময় যৌতুকের টাকা দিতি পারেনি বলে গ-গোল করতি করতি শাওড়ি দা’-এর কোপ বসায়ে দেলো হাতে, সেখানতে এ হাতে কিছু করতে পারিনে। সবাই আমার নুলো কয়ে ডাকে। বাম হাতে নকশি তুলি; তাতে কী! সক্কলের চাইতে বেশি কারুকাজ পারি। অথচ মজুরির বেলায় কম দেয়। তা দিক, তাও তো চলছিলো। একোন কী করবো!’

কথাগুলো বলে আরো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রাশিদা খালা।

রাতের রান্নার জন্য নূরজান মেসে পৌঁছে শোনে গ-গোল হয়েছে ফ্যাক্টরিতে। সতেরো-আঠারো জন ফ্যাক্টরি-কর্মী অল্প বিস্তর কাটাছেঁড়া নিয়ে মেসে ফিরলেও, জাহিদুল গুরুতর আহত। ব্যান্ডেজ করা হাত গলায় ঝোলোনো। পা তুলে খুব একটা হাঁটতে না পারায় তার খেয়াল রাখতে নূরজান ভোর থেকে সন্ধ্যা এমনকি কোনোদিন সন্ধ্যারাতঅব্দি থাকে বেশ ক’দিন ধরে।

রাত-বিরেতে একজন জোয়ান-যুবতির দীর্ঘক্ষণ অবস্থানে যে ভীষণ সর্বনাশ ঘটে যাচ্ছে সমাজের, তা নিয়ে মেসের সদস্যরা যতটা বিচলিত নূরজান তারও বেশি নির্লিপ্ত। নূরজানের কাছে এটাই মুখ্য যে, জাহিদুলের পাশে পরিবার পরিজন কেউ নেই, তার সুস্থ হয়ে উঠতে নূরজান তো আছে। কিন্তু কেন নূরজানের এত দায়! কীসের এত ঠেকা! কী লাভ!

দুপুরে ঘরবাড়ি ঝাড়– দেয়া, ভাত বসানো, ভাজি-ভর্তা, ডাল, ঝোল তরকারি তিন পদ করে নূরজান জাহিদুলের হাতের কাছে গুছিয়ে রাখে সব খাবার। জিজ্ঞাসা করে, গায়ে পানি ঢালবেন, নাকি ভেজা গামছায় গা মুছে দেবো? জাহিদুল চুপ করে থাকে।

নূরজান তার কাঁধে জাহিদুলের হাত তুলে নেয়, জাহিদুল হালকা ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গোসলখানার ভেতর পর্যন্ত যায়। দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে কাত হয়ে মগে পানি তুলতে যাবে এমন সময় হাটুর ভাঁজে ব্যথা অনুভব। ‘আহ্’ শব্দ শুনে বাইরে দাঁড়ানো নূরজান হন্তদন্ত ভেতরে যায়।

কিছু জিজ্ঞাসার প্রয়োজন মনে করে না নূরজান। দেয়ালে ঝুলে থাকা ঝিঙ্গের খোসায় সাবানের টুকরা ঘসে নিয়ে জাহিদুলের বুক পিঠ কচলে দেয়। মগে পানি তুলে জাহিদুলের মাথায় হাত নেড়ে নেড়ে ধুয়ে দেয়। হাঁটু ভাঁজ করে বসতে না পারায় জাহিদুল দেয়ালে ভর করে সুবোধ ছেলের মতো দাঁড়িয়েই থাকে। নূরজান পুনরায় খোসায় সাবান ঘসে নিয়ে জাহিদুলের হাতে-পায়ে সাবান মাখিয়ে ধুয়ে দেয়। জাহিদুল কী যেন ভেবে বলে, কাল থেকে গোসল একাই করতে পারবো। নূরজান বুঝতে পারে জাহিদুলের অস্বস্তি হচ্ছে। জাহিদুল দ্বিধান্বিত স্বরে বলে, এইটা ভালো দেখায় না নূরি বু।

এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ায় না নূরজান। বলে অন্য কথা- ‘আপনাগের ফ্যাক্টরির মতো আমাগের নকশিঘরেও আন্দুলন দরকার। আসেন স¹লে মিলে একসাথে নামি’।

জাহিদুল বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে নূরজানের মুখে। গামছায় গা মুছিয়ে কাঁধের ভরে জাহিদুলকে ঘরের দিকে নিয়ে যায়। খাবার প্লেট, চিরুনি, গ্লাস এনে রাখে হাতের কাছে।

বিকেলে আরেকবার এসে খাবার পানি তুলে দেয়, বাইরের শুকনো কাপড় ঘরে উঠিয়ে জিজ্ঞাসা করে আর কোনো দরকার আছে কি না। দু’একদিন ইচ্ছে হলে দু’কাপ চা বানিয়ে জাহিদুলের সামনে বসে। সাধারণত বিকেলে কেউ থাকে না মেসে। যার যার কর্মস্থল থেকে ফিরতে সন্ধ্যা।

নূরজানের আসতে দেরি হয়েছে আজ। বিকেলের কাজ শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ মেঘ। জাহিদুল একবার সতর্ক করেছে, আবহাওয়া ভালো থাকতেই যেন কাজ শেষ করে ফিরে যেতে পারে নূরজান। সে কথায় নূরজানের কোনো ভ্রুক্ষেপ না থাকার খেসারত এই যে, সন্ধ্যা হওয়ার আগেই তুমুল বৃষ্টি, এখন অন্ধকারে বিদ্যুৎহীন।

জাহিদুল বারান্দায় চৌকিতে বসে দেখছে বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা কেমন বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি করে বৃত্তাকারে প্রসারিত হচ্ছে। নূরজান রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আলোময় জায়গায় বসে নাগরিক বৃষ্টির দর্শক-শ্রোতা হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে উঠোনে পানি জমে থৈ থৈ। মৃদু ¯্রােত। নূরজান যে জাহিদুলের পেছনে এসে বসেছে তা টের পায় নূরজানের কথায়-

জানেন ভাইজান এরাম পানিতি ছোটকালে পাড়ার মেইয়ে ছেলে একসাথে কাদাপানি চটকায়ে আমোদ করতাম। অবশ্যি বেশিরভাগ সময় মাইয়্যেগুলো উঠোনে হৈ-হুল্লোড় করে বর্ষায় চান করতাম। আর মদ্দানোকগুলো যেতো মাঠে। ওগের হাডুডু খেলার চোটে সেকেনে কাদাপানির থকথকে গদি হয়ে যেতো। বড় ভালো খেলতো ক’জনা।

কিন্তু গ্যাঞ্জাম গ-গোল যে হয় না সে কথাও ঠিক না। একবার বড় গ-গোল হয়্যেলো। তার পরেত্তে গিরামে আর খেলা নেই, উঠে গেছে। গিরামে পলিটিশ ঢুইকে খায়্যে ফেললো সব। মাঠ নিয়ে পলিশি, মানুষ নিয়ে পলিশি। এখন সব টাকা পয়সাওয়ালা বাবুরা উকেনে বিশাল বিল্ডিং তুলেছে। তাগের ভাই বিরাদারেরা সেকেনে ব্যপসা খুলে বয়েছে।

জাহিদুল বলে- তুমি দেখছি অনেক খবর রাখো। নূরজান উত্তর দেয়- কী যে কন ভাইজান! পলিটিশ সবাই বোঝে।

উঁই পোকার ঢিবিতে খোঁচা দিলে উঁই পোকা বেরিয়ে আসার মতো আরো কথা হুড়মুড় করে বের হয়ে আসে নূরজানের মুখ থেকে-

জানেন ভাইজান, শহরের বস্তিতি চইলে আসার পর গিরামের সেইসব দিনের কথা কাউরে কতি পারিনি আজ পর্যন্ত। বাপের ভাঙাচোরা ছোট্ট মুদি দোকানে বসতাম ছোটবেলায়। আব্বা দুপুরে বাড়ি ভাত খাতি গেলে আমারে বসায়ে থুয়ে যেতো।

একদিন এরকমই বাদলা দিন। খাড়া দুপুর। ঝমঝমায়ে বৃষ্টি আইসে পড়লো চারদিক আন্ধার কইরে। কিডা জানতো সেদিন আমার জীবনেও কালো আন্ধার এসে ছোবল বসায়ে দেবে! চারিদিকি পানিতে ভরে উঠেছে। চোখের পলকে রাস্তায় পানি জমে গেলো। হঠাৎ করে হোন্ডায় করে তিনজন লোক এসে সিগারেট নেলো। পয়সাও দেলো। বর্ষার ঠেলায় তারা আর যায় না। হোন্ডা টেনে আনে আমাগের দোকানের চালার নিচে। তারা বিড়ি ধরায়ে দোকানের মাচায় পা ওঠায়ে বসে। আমার মনডা কিরাম জানি খচ খচ কইরে উঠলো। দোকান থেইকে নাম্যে বেরোয়ে যাবো ভাবতি ভাবতি তিনডে শকুন ঝাঁপায়ে পড়লো। দোকানের ঝাঁপি নামায়ে। আমার আকাশ পাতাল চিরেফাঁড়ে দেলো। তারা এক একজন সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ায় আর আমারে নিয়ে হাত বদল করে। উল্টে পাল্টে কুকুরের মতো খুবলে নেয়। করাতে কাঠ ফাঁড়ার মতো চিরে দেয় গোপন দেহ। ওড়না গোজা মুখ থেকে গোঙানোর আওয়াজ পৌঁছায় না কারো কানে। আল্লারে ডাকিছি জান-পরাণ দিয়ে। মুখ দিয়ে শব্দ বের না হলিও আল্লার তো শুনতি পাবার কতা। কেউ শোনেনি।

গলা ভারি হয়ে যায় নূরজানের। চোখ দুটো আকাশের মতো উদার হয়ে ওঠে। জল ঝরিয়ে ভাসিয়ে দেয় নূরজানের পুরুট গ্রীবা। জাহিদুল পাথরের মতো অনড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে বারান্দার নিচে জমে ওঠা জলের উপরে জলের ফোঁটায় সৃষ্ট অজ¯্র ছোট ছোট ঢেউয়ের দিকে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে গাঢ় হতে থাকে অন্ধকার। বাইরে থেকে একটা শোরগোল ভেসে আসে। মতিন জোর পায়ে এসে নূরজানকে বলে, নূরি বু তোমার এত রাত পর্যন্ত মেসে থাকা ঠিক হয়নি, যাও ঘরে যাও তো এখুনি, কিছু একটা গ-গোল হয়েছে, অনেক মানুষ আসছে মেসের দিকে।

নূরজান ব্যাপারটা আঁচ করতে পারে, চোখে-মুখে রাগ-ক্ষোভের চিহ্ন তার। মোটা ভরাট স্বরে বলে, একটা আধমরা মানুষের কাছে কাউরে না কাউরে তো থাকা লাগবে। শিক্কিত লোক হয়্যিছে সব। গায়ে চামড়া চকচক করলিই, আর গতরের কাপড় ফক ফক করলিই সভ্য হওয়া যায়!

নূরজানের এরকম ক্ষেপে ওঠা দেখে মহিদুল কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

কালবিলম্ব না হতেই হুড়মুড় করে প্রাচীরের ভেতর এমনকি বারান্দায় উঠে এলো একদল অচেনা প্রাণি; যাদের মুখগুলো আলাদা করে দেখার-চেনার ফুরসত জোটেনি। “ব্যাভিচারী মেয়েলোক” বলে তেড়ে আসে তারা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নূরজানের সমস্ত শরীর ভেসে গেলো দুমদাম মার, ঘুষি, আঘাতের তা-বে। মাথার খুলিটা খুলে দিতে পারলে বোধহয় চুল টেনে হেঁচড়ানোর নরক যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়া যেত। কিন্তু খুলিটাকেই ওরা ছাড়বে কেন? সমাজের অনিষ্টকারী সে। তারা কোনোভাবেই বরদাস্ত করবে না, কোনোভাবেই সমাজে অনিষ্ট হতে দেবে না... সর্বোপরি চেষ্টা করবে, সমাজচ্যুত করবে প্রয়োজনে।

তা-ব চললো। আধা ঘণ্টার মতো। ওরা চলে গেছে, আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাল লাভা গড়াতে গড়াতে যেমন কালো ঠা-া হয়ে আসে, ওরকম নিস্তব্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মেস। মতিন আর জাহিদুল হতভম্ব, আচমকা ঘটে যাওয়া তা-বে। দুজনের উপর একেবারেই চোটপাট হয়নি তা নয়।

সমস্ত রাত গুমোট, গরম বাতাস, চারিদিকে কেবল ধ্বংসযজ্ঞ, তীব্র যন্ত্রণা। নিথর নূরজান, অথচ তার ¯œায়ু উথালপাথাল ক্ষিপ্র।

মেসের সব বোর্ডার রাতে কে কখন ফিরেছে, কেউ আর দেখা পায়নি নুরজানের। আরিফ, মতিন, জাহিদুল, পাতালু দা, এমনকি মেসের সব সদস্যরা যে নূরজানকে যখন তখন স্মরণ করে, তাদের অনুভবে বিমর্ষতার মাত্রা কার কতটুকু বলা গেল না আলাদা করে।

ঠিক কত দিন মাস বছর পেরিয়েছে; তা অনির্ণেয়।

ফ্যাক্টরিতে কর্মীদের বিক্ষোভ চলছে।

কোনো এক ভোরে ফ্যাক্টরির মেইন গেটে দাবি-দাওয়া নিয়ে গেট ভাঙচুরের উপক্রম, এমন সময়ে মাস্ক পরিহিত এক যুবতি প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে দারোয়ানের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে চাবি ছিনিয়ে নেয়। তালা খুলে দিতেই মানব-¯্রােতপ্রবাহ, বাইরে থেকে ভেতর দিকে। জাহিদুলের চোখ পড়তেই আরেকবার দেখার চেষ্টা করে। মাস্ক-আবৃত, তবু চোখ জোড়া আর আবয়ব চেনা চেনা মনে হতেই জাহিদুলের স্মরণে আসে নূরজানের কথা ‘আসেন স¹লে মিলে... ’। কিন্তু সে রাতের পর পাতালু দা’র মুখে শোনা গেছে- নূরজান পাহাড়ে চলে যেতে চেয়েছিল!!

কোথায় সে!!

ছবি

ফিলিস্তিনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে অণুগল্প

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

শিল্পী সুনীল কুমারের ‘পথের গল্প’-এর স্বরূপ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

‘এ নয় আঁখিজল’

জ্যৈষ্ঠের পদাবলি

ছবি

ওসামা অ্যালোমারের একঝুড়ি খুদে গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কাব্যগ্রন্থে নীলদ্রোহের রেখাপাত

ছবি

নার্গিস-নজরুলের স্মৃতিধন্য দৌলতপুরে একদিন

ছবি

যেভাবে ভেঙেছিল এক মৌনতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

নজরুল সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের প্রেক্ষিত

ছবি

স্বাধীনতার কবি নজরুল

ছবি

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রতিভা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দাউদ হায়দার: স্বকীয় ও নির্বাসিত

ছবি

অটোগ্রাফ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

আলবেয়ার কামুর গল্পে অস্তিত্বের নিষ্ঠুরতা

ছবি

উপন্যাসের জন্মবীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কানাগলি

ছবি

পার্ল এস বাক-এর কবিতা

ছবি

হোসে এচেগারাই স্প্যানিশ আলোকবর্তিকা

ছবি

নববীণায় বাজে নতুনের জয়গান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের ‘করুণা’ ঘিরে কিছু কথা

ছবি

গীতাঞ্জলির ইতিবৃত্ত ও বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ

ছবি

রবীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ ও ‘ছিন্নপত্র’

ছবি

নিউ নেদারল্যান্ডস: জার্র্সি এবং লেনাপি জনগোষ্ঠী

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বকুলীর সেইরাত

ছবি

আকাশের প্রান্ত

tab

সাময়িকী

রাত গভীর

এলিজা খাতুন

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

মেসের সদস্যরা দেড়-হাতি বারান্দায় বসে তুমুল আড্ডায়। নূরজান মেসের কাছাকাছি এসে আভাস পায়- সম্ভবত রান্নার দুরবস্থা আড্ডার বিষয়বস্তু। প্রাচীরের ভেতরে এসে আরও স্পষ্ট হয়, অনুমান ঠিকই। নূরজানকে দেখতে পেয়ে মতিন বলে, যাক বাঁচালে বুজান!

শুক্রবার ছুটির দিন, দীর্ঘ বারান্দা জুড়ে বিশ বাইশ জন বসে আছে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে। মোমেন নামে নতুন সদস্য বলে, নূরী বু আজ না এলে আমার উপরেই চুলোয় আগুন দেবার ভার পড়ছিল। ভাগ্যিস এলে! একথা বলেই বারান্দা থেকে নেমে নূরজানের সামনে রাজ দরবারের স্টাইলে কুর্ণিশ করতে শুরু করে। বাকিরা হো হো করে হেসে ওঠে।

নূরজান বোঝে, নিশ্চয়ই নূরজানকে নিয়ে মেসে আলোচনা হয়েছে ইতোমধ্যে। নূরজান যখন কাজ শুরু করেছিল এই মেসের সারিবদ্ধ পাঁচটি রুমে পনেরোটা সিট ছিল। পরে নতুন রুম হয়েছে আরও। বর্ধিত এল-শেপড মেসে এখন গড়ে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ জন বোর্ডার।

এদের মধ্যে একজন সরকারি অফিসের কেরানি, কয়েকজন কলেজ পড়ুয়া ছাত্র, একজন ড্রাইভার, একজন চাকরি-প্রত্যাশী পরীক্ষার্থী, বাকিরা পার্শ্ববর্তী গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেহাত কম নয়, জনা বিশেকের মতো। সন্ধ্যায় ওরা এক জোট হয়ে গল্প-আড্ডায় মেতে গেলে- বটগাছের নিচের গ্রাম্যমেলা বা গঞ্জের গোটা হাটের কোলাহল উঠে আসে এই কলোনিতে।

আরিফ, সাংবাদিক মতিনসহ কদিন হলো নতুন এসে উঠেছে সদ্য ব্যস্ত হয়ে ওঠা একজন উকিলও; নাম পাতালু, আদিবাসী। তার উকিলী মেজাজে কথার মধ্যে কথার মারপ্যাঁচ বেশি এজন্য মেসের সদস্যরা পাতালু নামটাকে প্যাঁচালু ডাকে। উচ্চারণে আরেকটু সুবিধার্থে ডাকতে শুরু করেছে ‘প্যাঁচাল দা’ বলে। অবশ্য নামের বিকৃতির দরুন কোনো আপত্তি বা নতুন প্যাঁচ বাধাননি তিনি। উকিলী ঢঙে কথার কারণে মেসের অন্য সদস্যরা প্যাঁচালুর উপর বিরক্ত হলেও, কোট-কাচারির গল্পে শ্রোতা হিসেবে অমনোযোগী নয় নূরজান।

মাঝে মাঝে হাস্যরহস্যে নূরজান বলে, আমরা বিপদে পরলি আমাগের হয়ে ওকালতি করবেন তো পাতালু দা? আবার কোনো কোনো দিন বলে, এই ঘিঞ্জি শহরে দম আটকে আসে গো দাদা, একদিন দ্যাকপেন আপনাগের পাহাড়ে চলে গেছি। না, নূরজান বিকৃত নামে ডাকে না। আইনের কথাবার্তা গুরুত্ব দিয়ে শোনার জন্য নূরজানকে পাতালু দা ভক্তিশ্রদ্ধাও করে কম নয়। যদিও কেরানি-মহব্বত ভাই নূরজানের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে কটু ভাষায় এটা সেটা হুকুম করে, তার ধরণ দেখে অন্য সদস্যদের ধারণা করতে অসুবিধা হয় না সরকারি অফিসে আমলাদের ফরমায়েস খাটা কর্মচারী সুযোগ-সুবিধা পেলে তারও প্রভুত্ব দেখাতে মন চায়।

মেস-নিবাসি মূলত এদের প্রত্যেকেরই ন্যূনতম খরচে থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা এর চেয়ে আর কোনো মেস বা হোস্টেলে নেই আশেপাশে। ছুটির দিনে মেসের প্রত্যেক সদস্য উপস্থিত থাকায় হৈচৈ অনিবার্য। এই দিনে মেস ম্যানেজার দুপুরের খাবারের তালিকায় মাংস রাখে।

নূরজান এই মেসে পুরোনো রান্নার মানুষ। নূরজানকে এরা এতটা আপন এতটা অধিকার ফলাবার স্থানে বসিয়েছে যে, ধরাবাধা নিত্যদিনের রান্না ছাড়াও, যে কেউ যখন তখন আবদার করে বসে দ্বিধাহীন; নূরি বু লেবু-পাতা কাঁচা ঝাল, সরষে দিয়ে আম মাখাও তো, নূরি বু নারকেল কোরা দিয়ে মুড়ি মাখাও তো ইত্যাদি। সময় সুযোগ হলে ওদের কেউ কেউ আবার নূরজানকেও মুরগি ছিলে দেয়, টিউবওয়েলে জল টেনে দেয়। মতিন রসুনের খোসা ছাড়িয়ে সহায়তা করছে আজ। প্রায় চার-পাঁচ বছর আগে মেসে রান্নার কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল নূরজান। অধিকাংশ দিনই দুপুরের রান্নাসহ সব কাজ গুছিয়ে, বিকেলে নকশীঘরে সেলাইয়ের কাজে যায় নূরজান। দলবেঁধে সেলাই করে নকশিকাঁথা। ৪০-৪৫ জনের দল। দেশবিদেশে সুনাম কুড়োনো কাঁথার ব্যবসায় নকশিঘরে মহাজনের অর্ডার অনুযায়ী কাজের চাপ থাকে বছরভর। অথচ গতকাল শুনেছে সেলাই কাজ থেকে বিদায় করে দেবে নূরজানকে। সে নাকি এটা ওটা দাবি তুলে অন্য সেলাই-কর্মীদের উসকে তোলে।

নূরজান মেসের সদস্যদের খাবার অসুবিধায় ফেলেনি কোনোদিন। খাটিয়ে মেয়ে। একসাথে অল্প সময়ের ভেতরে অনেক কাজ করে উঠতে পারে। নূরজানকে নূরী’বু বলে ডাকে এরা।

মোমেনের কুর্ণিশ করা স্টাইলে নূরজান হাসি থামাতে পারেনি এখনও। নূরী’বু তাড়াতাড়ি রান্না চাপাও তো, কদিন ধরে খাওয়া দাওয়ার বেহাল দশা, বলে মতিন। নূরজান দেরি না করে রান্নার কাজে লেগে যায়। নূরজান জানে সদস্যরাগোসল-খাওয়া সেরে ফোন হাতে নিয়ে যার যার চৌকিতে গা গড়ায়। বাড়িতে কথা বলে। কেউ আবার কাগজ কলম নিয়ে বসে; বেতনের টাকাপয়সা খরচের হিসাব করে। অনেকে পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়। ভিন্ন ভিন্ন বাসনে খাবার বেড়ে সবার ঘরে ঘরে দিতে হয় দুপুর দুটোর ভেতরে।

এদের মধ্যে আরিফ আলাদা। তাল মিলিয়ে হাসি-তামাসায় যোগ দেয় না। টিউশনি করে কয়েকটি, আর চাকরির বিজ্ঞাপন খুঁজে আবেদন লেখে সপ্তাহে দু’তিনটি। দুপুরে সবাই খেতে বসলে, আরিফ তখন রুমের এক কোণে নিজের বেডে বসে পেপারের বিজ্ঞাপন কাটে কাঁচি দিয়ে। মেসের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মানুষগুলোর দিনাতিপাত এমনই।

আজ নূরজান আরিফকে গোসলের জন্য তাগাদা দেয়। ভাইজান একোনও কাগজপত্তর নিয়ে পড়ে আছেন? গোশল খাওয়া লাগবে না? কাজে মগ্ন থাকার মাঝ থেকে আরিফ চমকে তাকায় নূরজানের দিকে। নূরজান আবার বলতে থাকে, সগুলির খাবা শেষ হলি এঁটোকাঁটা পইষ্কার কইরে বাসনপত্তর ধুয়ে তারপর আমার নিস্তার, সময়ের কাজ সময়ে করেন না ক্যান বুজিনে। আমার হয়েছে যত জ্বালা।

নূরজানের অদ্ভুত অভিব্যক্তি আরিফকে ভাবায়। তাকে যত দ্যাখে, নতুন অভিজ্ঞতা জন্ম নেয় তত। সবার প্রতি নূরজানের খবরদারি-রাগ যেন একটা অধিকার থেকে বের হয়ে আসে। কী সেই অধিকার? কী সেই টান? রক্তের সম্পর্কের কেউ তো না। যা কিছু কাজ তার, সব তো টাকার বিনিময়ে! ক’টাকাই-বা বেতন দেওয়া হয় তাকে?

রান্না করে রেখে চলে যেতেই পারে। কেন সবাইকে ঠেলেঠুলে খেতে বসার তাগাদা করে? কেন সবার ভালো মন্দ খোঁজখবর নেয়? সে কি বেতনের বদলে? তা তো নয়! তাহলে নূরজানের মানবতা? টান? সবার প্রতি ভালোবাসা? সবাই তার কাছে আপনজন? কে সে! মা, বোন, স্ত্রী, প্রিয়তমা? এসব ভাবতে ভাবতে আরিফ আবার কোথায় যেন হারায়। ইদানীং ভাবনা চলে আসে যে কোনো বিষয়ে। ভাবনাগুলো লিপিবদ্ধ করে সময়-অসময় তোয়াক্কা না করেই। সম্মুখের কাগজপত্রগুলো গোছাতে থাকে আনমনে।

নূরজান আরিফের খাবারের পাত্র ওর সামনে বেডের উপরে রেখে বলে, বেড়ালে মুখ দিয়ে দিলি আজকেও পেটে দড়ি পড়বে, খেয়ে দেয়ে সারাদিন ধ্যান করেন। গোসল সন্ধ্যেবেলা করলিও চলবে।

আরিফ অবাক তাকিয়ে থাকে নূরজানের দিকে। কখন যে এ মেয়েটি মেস মেম্বারদের অভিভাবকের মতো হয়ে গেছে কেউ ভেবে দ্যাখেনি। কোনো কোনো দিন সকালে টিউশনে যেতে গা-ঢিল স্বভাব দেখে নূরজান বলে, আরিফ ভাই ওঠেন, দেরি হয়ে যাবেনে, একনো তো চাকরি জোটেনি। দু’চারটে ছাত্তর পড়ায়ে তবু হাত খরচ, পেট খরচ চলতিছে, না থাকলে জ্বালা বোঝবেন।

নূরজান খেয়াল করে ফ্যাক্টরির কাজ করা আঠারো-কুড়ি সদস্যের হাসি-তামাশার মাত্রা কমে গেছে ইদানীং, প্রত্যেকের মুখাবয়বে ভর করেছে দুঃশ্চিন্তা। ফ্যাক্টরির সিনিয়র কর্মী হিসেবে জাহিদুলের বুদ্ধি পরামর্শ মনোযোগে শুনছে অন্যরা। নূরজানও শোনে, এই তো সেদিনই এক হাঁড়ি চা বানিয়ে নিয়ে সবাইকে মগে, গ্লাসে, বাটিতে চা ঢেলে দিতে দিতে ওদের আলাপের মধ্যে বলে ফেলেছিল- আমারে নেবেন আপনাগের আন্দুলনে?

মেসের লম্বা বারান্দার এক প্রান্তে ওরা ক’দিন ধরে যে মগ্ন আছে বকেয়া মজুরি আদায় আর রোজগার নিয়ে টিকে থাকার গুরুগম্ভীর আলাপচারিতায়; তারই প্রভাবে কি নূরজানের মুখে এমন ভারি ভারি কথা!?

আরিফের কোনো উত্তর না পেয়ে নূরজান রাগমিশ্রিত স্বরে বলে যায়-

আরে বাপু সব রেখে গেলাম, খাইলে খাও না খাইলে না। আমার কাজ আছে ম্যালা। মাঠে ভাঙাড়ির গাদায় যাবো এট্টু।

মেস থেকে বেরিয়ে মহল্লার ভেতরের ঢালাই রাস্তা ছেড়ে বামে মোড় নিতেই মাঠসংলগ্ন টিনের ভাঙাড়ি দোকানের বাইরে ছিপিহীন পরিত্যক্ত বোতলের স্তূপ। নূরজান অত্যাশ্চর্য দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে থেকে বসে পড়ে। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে, মহল্লা থেকে কুড়িয়ে এনে ভাঙ্গাড়ির দোকানের সামনে জমাকৃত পরিত্যক্ত শত শত বোতলের ভেতরে তলায় লেগে থাকা তেল ফোঁটায় ফোঁটায় নিংড়ে নিতে শুরু করে সে।

নিজের মনে বিড় বিড় করে- বর্ষা-বানের সময় কাজ নেই। কী করবো! ইকেনে ঘণ্টাখানেক বোতলের তেল নিংড়াতি বসলি আড়াইশোর মতো তেল পাওয়া যায়। তাই-বা কম কী? এখন তেলের যা দাম! শুনতিছি বাজার থেকে তেল উধাও। তাছাড়া চাল থেকে শুরু করে সব জিনিসের যে দাম! ব্যাটারা গোডাউনে পুরে রেখেছে, যত দিন যাবে ওগুলো নাকি হীরে জহরতের মতোন দাম হবে। মাইনসের মুখের আহার গুদামে আটকায়ে রাখলি তাগের নাকি পরকালে জাহান্নামের আগুনে পোড়ানো হবে। আল্লা কি দেখতি পায় না আমাগের পেটের মদ্দি হাবিয়া দোজোখ? একলা জীবন, এইটুকুই তো পেট! তাই কী জ্বালা! একটা দিন বসে থাকলি দানা জোটে না, ওয়াক্ত আসলেই পেটের মদ্দি দাউ দাউ শুরু করে!

দুপুর গড়াতেই নকশিঘরে পৌঁছে দ্যাখে সবাই গোল হয়ে বসা। ওদের চিন্তিত দেখে নূরজান জিজ্ঞাসা করে কী হয়েছে? পরস্পর কয়েকজন জবাব দেয়, আমাগের একোন আর দরকার নেই। হেতো নোক রাকবে না। বিশজন মাইনষের কাম যদি একখান যন্তরে এক নিবিষে হয়্যে যায়, তেবে তারা হেতো নোক খাটাবে কী করতি?

নূরজানের রাগ ও তেজমিশ্রিত কথা- হেতোকাল আমাগের হাতের কারুকাজ দেকায়্যে হাজার হাজার কাস্টমার জোগাড় কইরে‌্য নিয়ে একোন আমাগের প্রয়োজন ফুরোয়েছে তাইতো? একোন কম সময়ে বেশি আয় করা লাগবে তাইতো? এই যে আমাগের হাতে গড়া নকশিঘর দুনিয়ার কাছে এত সুনাম হয়েছে, এর পেছনে আমাগের রক্ত পানি হয়েছে, একোন তাড়ায়ে দেবে? বললিই হলো?

নূরজানের কথায় গুঞ্জন শুরু হলো অন্যদের মধ্যে। কিছুদিন আগে নূরজান শুনেছিল-নকশিফোঁড়েরমেশিন চালু করা বিষয়ে সুপারভাইজারের সাথে মহাজনের আলাপচারিতা। ক্রেতার চাহিদা পূরণ হবে তাড়াতাড়ি। নূরজান জিজ্ঞেস করে- এখন মহাজনও কি একেবারে জবাব দিয়ে দেছে?

ওদের মধ্যে একজন বলে, তা জানিন্যে, সুপারভাইজার কয়ে গেলো আইজগের যার যেটুকু সেলাই বাকি আছে সবাই মিলে সেটুকু করে শেষ করো।

এরই মধ্যে মানেজারের কামরা থেকে হঠাৎ শোরগোল শোনা যায়। নকশিঘরে জড়ো হওয়া ওরা সারিবদ্ধ এগিয়ে যায়। ম্যানেজারের সাথে গলা ধাক্কাধাক্কি চলছে বানু মুন্ডার। বানুর তিন মাসের মজুরি পাওনা। নতুন সুতো নিতে গেলে বাধা দেয় মহাজনের লোক। বানু মুন্ডা আগের মজুরি দাবি করলে ওর গায়ে হাত ওঠায়। এ কথা শোনামাত্র ক্ষেপে ওঠে সবাই। একপর্যায়ে প্রত্যেকে নিজেদের পাওনা মজুরির দাবি তোলে।

সুপারভাইজার এসে তার কামরায় ঢোকে। নূরজান খানিক এগিয়ে যায়, সুপারভাইজারের কামরার দরজার সামনে ফাঁকা জায়গায় মাটিতে বসে পড়ে। নূরজানের দেখাদেখি একে একে অন্যরা সবাই বসে যায় দরজা ঘেরাও করে। হৈ চৈ চলতে থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বয়ষ্ক রাশিদা খালা সবাইকে থামিয়ে সুপারভাইজারের উদ্দেশ্যে বলে, মহাজনকে খবর দাও। খাতা দেখে যার যার কাজের টাকা মেটায় দিক।

বেলা বেড়ে চলে, দুপুর গড়ায়, এমন সময় একটি মাইক্রোবাসের আগমনে সবাই উৎসুক হয়ে জড়ো হয় মাইক্রোবাসটির চারপাশে। গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে স্যুট-টাই পরিহিত লম্বা সুঠামদেহী লোকটি বিনয়ের স্বরে বলল- খুব শিঘ্রই প্রত্যেকের বকেয়া পরিশোধ করে দেওয়া হবে। মহাজনের হয়ে সে দায়িত্ব নিচ্ছে এ কথাও জানায়। তার আরও কথাবার্তায় বোঝা যায় নকশীকাঁথা কেনার বড়সড় একজন বিদেশি বায়ারের এজেন্ট সে।

লোকটির কথার ধাঁচে তার কথাবার্তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে এরা সবাই একে একে স্পষ্ট হয়, কাজে বহাল থাকছে না আর কেউ। এতগুলো জীবন্ত কর্মীর জায়গা দখল করে নিচ্ছে যন্ত্রটা। তবু প্রত্যেকে নিজেকে বুঝ দেয় এই ভেবে যে, আগের পাওনা মজুরিটা ভালোয় ভালোয় পেয়ে যাক অন্তত। জোরালো কণ্ঠগুলো একটু একটু করে ভাটা পড়ছে; ব্যাপারটা খেয়াল করেছে বোধহয় গাড়িতে আসা লোকটি।

সুঠামদেহী অজ্ঞাত লোকটির চোখ-মুখের ভাষা পড়তে পারে নূরজান- “তোদের জব্দ করা একটা তুড়ির কাজ”। একটু বাদেই ধুলো উড়িয়ে চলে গেলো আচমকা আসা গাড়িটা।

নূরজান দাঁড়িয়ে থাকে হতভম্বের মতো। অন্যরাও। এরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে। বেশিরভাগ দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার।

শ্যামনগরের হারু চাচা বলে, ‘হাদে আমার মেইয়্যে বিয়ে দিলাম পাতাখালি, গাঙ্গের পানতে মেইয়্যের ঘর ভাসায়ে নে গেছে। তারে এককান ঘর বান্ধ্যে দিতি হবে, নয়তো মেইয়্যের সংসার টেকপে না। পাওনা টাকার আশায় দিন গুনতিছি।’

সুলেখা আক্তার বলে, ‘গাবুরায় আমার ভিটেমাটি-ঘর, ছাগল-গরু সব ছেলো। যে বছর স্বামী মইরলো, সে বছরই গাঙ্গের জলে বুড়্যে গেছে সব। সেখানতে চলে এসে চারডে বাচ্চা নিয়ে ইকানে বস্তিতি উটিচি। নকশা সেলাই করে যা পাতাম কোনরকম চারটে ভাত ফুটোয়ে বাচাগুনোর মুখে দিতি পারতাম। হেকোন কী করবো?’

রাশিদা খালা, সবাই যাকে নুলো খালা ডাকে, চোখের কোণ মুছে বলে,

‘বাপ আমার বিয়ের সময় যৌতুকের টাকা দিতি পারেনি বলে গ-গোল করতি করতি শাওড়ি দা’-এর কোপ বসায়ে দেলো হাতে, সেখানতে এ হাতে কিছু করতে পারিনে। সবাই আমার নুলো কয়ে ডাকে। বাম হাতে নকশি তুলি; তাতে কী! সক্কলের চাইতে বেশি কারুকাজ পারি। অথচ মজুরির বেলায় কম দেয়। তা দিক, তাও তো চলছিলো। একোন কী করবো!’

কথাগুলো বলে আরো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রাশিদা খালা।

রাতের রান্নার জন্য নূরজান মেসে পৌঁছে শোনে গ-গোল হয়েছে ফ্যাক্টরিতে। সতেরো-আঠারো জন ফ্যাক্টরি-কর্মী অল্প বিস্তর কাটাছেঁড়া নিয়ে মেসে ফিরলেও, জাহিদুল গুরুতর আহত। ব্যান্ডেজ করা হাত গলায় ঝোলোনো। পা তুলে খুব একটা হাঁটতে না পারায় তার খেয়াল রাখতে নূরজান ভোর থেকে সন্ধ্যা এমনকি কোনোদিন সন্ধ্যারাতঅব্দি থাকে বেশ ক’দিন ধরে।

রাত-বিরেতে একজন জোয়ান-যুবতির দীর্ঘক্ষণ অবস্থানে যে ভীষণ সর্বনাশ ঘটে যাচ্ছে সমাজের, তা নিয়ে মেসের সদস্যরা যতটা বিচলিত নূরজান তারও বেশি নির্লিপ্ত। নূরজানের কাছে এটাই মুখ্য যে, জাহিদুলের পাশে পরিবার পরিজন কেউ নেই, তার সুস্থ হয়ে উঠতে নূরজান তো আছে। কিন্তু কেন নূরজানের এত দায়! কীসের এত ঠেকা! কী লাভ!

দুপুরে ঘরবাড়ি ঝাড়– দেয়া, ভাত বসানো, ভাজি-ভর্তা, ডাল, ঝোল তরকারি তিন পদ করে নূরজান জাহিদুলের হাতের কাছে গুছিয়ে রাখে সব খাবার। জিজ্ঞাসা করে, গায়ে পানি ঢালবেন, নাকি ভেজা গামছায় গা মুছে দেবো? জাহিদুল চুপ করে থাকে।

নূরজান তার কাঁধে জাহিদুলের হাত তুলে নেয়, জাহিদুল হালকা ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গোসলখানার ভেতর পর্যন্ত যায়। দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে কাত হয়ে মগে পানি তুলতে যাবে এমন সময় হাটুর ভাঁজে ব্যথা অনুভব। ‘আহ্’ শব্দ শুনে বাইরে দাঁড়ানো নূরজান হন্তদন্ত ভেতরে যায়।

কিছু জিজ্ঞাসার প্রয়োজন মনে করে না নূরজান। দেয়ালে ঝুলে থাকা ঝিঙ্গের খোসায় সাবানের টুকরা ঘসে নিয়ে জাহিদুলের বুক পিঠ কচলে দেয়। মগে পানি তুলে জাহিদুলের মাথায় হাত নেড়ে নেড়ে ধুয়ে দেয়। হাঁটু ভাঁজ করে বসতে না পারায় জাহিদুল দেয়ালে ভর করে সুবোধ ছেলের মতো দাঁড়িয়েই থাকে। নূরজান পুনরায় খোসায় সাবান ঘসে নিয়ে জাহিদুলের হাতে-পায়ে সাবান মাখিয়ে ধুয়ে দেয়। জাহিদুল কী যেন ভেবে বলে, কাল থেকে গোসল একাই করতে পারবো। নূরজান বুঝতে পারে জাহিদুলের অস্বস্তি হচ্ছে। জাহিদুল দ্বিধান্বিত স্বরে বলে, এইটা ভালো দেখায় না নূরি বু।

এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ায় না নূরজান। বলে অন্য কথা- ‘আপনাগের ফ্যাক্টরির মতো আমাগের নকশিঘরেও আন্দুলন দরকার। আসেন স¹লে মিলে একসাথে নামি’।

জাহিদুল বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে নূরজানের মুখে। গামছায় গা মুছিয়ে কাঁধের ভরে জাহিদুলকে ঘরের দিকে নিয়ে যায়। খাবার প্লেট, চিরুনি, গ্লাস এনে রাখে হাতের কাছে।

বিকেলে আরেকবার এসে খাবার পানি তুলে দেয়, বাইরের শুকনো কাপড় ঘরে উঠিয়ে জিজ্ঞাসা করে আর কোনো দরকার আছে কি না। দু’একদিন ইচ্ছে হলে দু’কাপ চা বানিয়ে জাহিদুলের সামনে বসে। সাধারণত বিকেলে কেউ থাকে না মেসে। যার যার কর্মস্থল থেকে ফিরতে সন্ধ্যা।

নূরজানের আসতে দেরি হয়েছে আজ। বিকেলের কাজ শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ মেঘ। জাহিদুল একবার সতর্ক করেছে, আবহাওয়া ভালো থাকতেই যেন কাজ শেষ করে ফিরে যেতে পারে নূরজান। সে কথায় নূরজানের কোনো ভ্রুক্ষেপ না থাকার খেসারত এই যে, সন্ধ্যা হওয়ার আগেই তুমুল বৃষ্টি, এখন অন্ধকারে বিদ্যুৎহীন।

জাহিদুল বারান্দায় চৌকিতে বসে দেখছে বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা কেমন বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি করে বৃত্তাকারে প্রসারিত হচ্ছে। নূরজান রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আলোময় জায়গায় বসে নাগরিক বৃষ্টির দর্শক-শ্রোতা হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে উঠোনে পানি জমে থৈ থৈ। মৃদু ¯্রােত। নূরজান যে জাহিদুলের পেছনে এসে বসেছে তা টের পায় নূরজানের কথায়-

জানেন ভাইজান এরাম পানিতি ছোটকালে পাড়ার মেইয়ে ছেলে একসাথে কাদাপানি চটকায়ে আমোদ করতাম। অবশ্যি বেশিরভাগ সময় মাইয়্যেগুলো উঠোনে হৈ-হুল্লোড় করে বর্ষায় চান করতাম। আর মদ্দানোকগুলো যেতো মাঠে। ওগের হাডুডু খেলার চোটে সেকেনে কাদাপানির থকথকে গদি হয়ে যেতো। বড় ভালো খেলতো ক’জনা।

কিন্তু গ্যাঞ্জাম গ-গোল যে হয় না সে কথাও ঠিক না। একবার বড় গ-গোল হয়্যেলো। তার পরেত্তে গিরামে আর খেলা নেই, উঠে গেছে। গিরামে পলিটিশ ঢুইকে খায়্যে ফেললো সব। মাঠ নিয়ে পলিশি, মানুষ নিয়ে পলিশি। এখন সব টাকা পয়সাওয়ালা বাবুরা উকেনে বিশাল বিল্ডিং তুলেছে। তাগের ভাই বিরাদারেরা সেকেনে ব্যপসা খুলে বয়েছে।

জাহিদুল বলে- তুমি দেখছি অনেক খবর রাখো। নূরজান উত্তর দেয়- কী যে কন ভাইজান! পলিটিশ সবাই বোঝে।

উঁই পোকার ঢিবিতে খোঁচা দিলে উঁই পোকা বেরিয়ে আসার মতো আরো কথা হুড়মুড় করে বের হয়ে আসে নূরজানের মুখ থেকে-

জানেন ভাইজান, শহরের বস্তিতি চইলে আসার পর গিরামের সেইসব দিনের কথা কাউরে কতি পারিনি আজ পর্যন্ত। বাপের ভাঙাচোরা ছোট্ট মুদি দোকানে বসতাম ছোটবেলায়। আব্বা দুপুরে বাড়ি ভাত খাতি গেলে আমারে বসায়ে থুয়ে যেতো।

একদিন এরকমই বাদলা দিন। খাড়া দুপুর। ঝমঝমায়ে বৃষ্টি আইসে পড়লো চারদিক আন্ধার কইরে। কিডা জানতো সেদিন আমার জীবনেও কালো আন্ধার এসে ছোবল বসায়ে দেবে! চারিদিকি পানিতে ভরে উঠেছে। চোখের পলকে রাস্তায় পানি জমে গেলো। হঠাৎ করে হোন্ডায় করে তিনজন লোক এসে সিগারেট নেলো। পয়সাও দেলো। বর্ষার ঠেলায় তারা আর যায় না। হোন্ডা টেনে আনে আমাগের দোকানের চালার নিচে। তারা বিড়ি ধরায়ে দোকানের মাচায় পা ওঠায়ে বসে। আমার মনডা কিরাম জানি খচ খচ কইরে উঠলো। দোকান থেইকে নাম্যে বেরোয়ে যাবো ভাবতি ভাবতি তিনডে শকুন ঝাঁপায়ে পড়লো। দোকানের ঝাঁপি নামায়ে। আমার আকাশ পাতাল চিরেফাঁড়ে দেলো। তারা এক একজন সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ায় আর আমারে নিয়ে হাত বদল করে। উল্টে পাল্টে কুকুরের মতো খুবলে নেয়। করাতে কাঠ ফাঁড়ার মতো চিরে দেয় গোপন দেহ। ওড়না গোজা মুখ থেকে গোঙানোর আওয়াজ পৌঁছায় না কারো কানে। আল্লারে ডাকিছি জান-পরাণ দিয়ে। মুখ দিয়ে শব্দ বের না হলিও আল্লার তো শুনতি পাবার কতা। কেউ শোনেনি।

গলা ভারি হয়ে যায় নূরজানের। চোখ দুটো আকাশের মতো উদার হয়ে ওঠে। জল ঝরিয়ে ভাসিয়ে দেয় নূরজানের পুরুট গ্রীবা। জাহিদুল পাথরের মতো অনড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে বারান্দার নিচে জমে ওঠা জলের উপরে জলের ফোঁটায় সৃষ্ট অজ¯্র ছোট ছোট ঢেউয়ের দিকে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে গাঢ় হতে থাকে অন্ধকার। বাইরে থেকে একটা শোরগোল ভেসে আসে। মতিন জোর পায়ে এসে নূরজানকে বলে, নূরি বু তোমার এত রাত পর্যন্ত মেসে থাকা ঠিক হয়নি, যাও ঘরে যাও তো এখুনি, কিছু একটা গ-গোল হয়েছে, অনেক মানুষ আসছে মেসের দিকে।

নূরজান ব্যাপারটা আঁচ করতে পারে, চোখে-মুখে রাগ-ক্ষোভের চিহ্ন তার। মোটা ভরাট স্বরে বলে, একটা আধমরা মানুষের কাছে কাউরে না কাউরে তো থাকা লাগবে। শিক্কিত লোক হয়্যিছে সব। গায়ে চামড়া চকচক করলিই, আর গতরের কাপড় ফক ফক করলিই সভ্য হওয়া যায়!

নূরজানের এরকম ক্ষেপে ওঠা দেখে মহিদুল কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

কালবিলম্ব না হতেই হুড়মুড় করে প্রাচীরের ভেতর এমনকি বারান্দায় উঠে এলো একদল অচেনা প্রাণি; যাদের মুখগুলো আলাদা করে দেখার-চেনার ফুরসত জোটেনি। “ব্যাভিচারী মেয়েলোক” বলে তেড়ে আসে তারা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নূরজানের সমস্ত শরীর ভেসে গেলো দুমদাম মার, ঘুষি, আঘাতের তা-বে। মাথার খুলিটা খুলে দিতে পারলে বোধহয় চুল টেনে হেঁচড়ানোর নরক যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়া যেত। কিন্তু খুলিটাকেই ওরা ছাড়বে কেন? সমাজের অনিষ্টকারী সে। তারা কোনোভাবেই বরদাস্ত করবে না, কোনোভাবেই সমাজে অনিষ্ট হতে দেবে না... সর্বোপরি চেষ্টা করবে, সমাজচ্যুত করবে প্রয়োজনে।

তা-ব চললো। আধা ঘণ্টার মতো। ওরা চলে গেছে, আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাল লাভা গড়াতে গড়াতে যেমন কালো ঠা-া হয়ে আসে, ওরকম নিস্তব্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মেস। মতিন আর জাহিদুল হতভম্ব, আচমকা ঘটে যাওয়া তা-বে। দুজনের উপর একেবারেই চোটপাট হয়নি তা নয়।

সমস্ত রাত গুমোট, গরম বাতাস, চারিদিকে কেবল ধ্বংসযজ্ঞ, তীব্র যন্ত্রণা। নিথর নূরজান, অথচ তার ¯œায়ু উথালপাথাল ক্ষিপ্র।

মেসের সব বোর্ডার রাতে কে কখন ফিরেছে, কেউ আর দেখা পায়নি নুরজানের। আরিফ, মতিন, জাহিদুল, পাতালু দা, এমনকি মেসের সব সদস্যরা যে নূরজানকে যখন তখন স্মরণ করে, তাদের অনুভবে বিমর্ষতার মাত্রা কার কতটুকু বলা গেল না আলাদা করে।

ঠিক কত দিন মাস বছর পেরিয়েছে; তা অনির্ণেয়।

ফ্যাক্টরিতে কর্মীদের বিক্ষোভ চলছে।

কোনো এক ভোরে ফ্যাক্টরির মেইন গেটে দাবি-দাওয়া নিয়ে গেট ভাঙচুরের উপক্রম, এমন সময়ে মাস্ক পরিহিত এক যুবতি প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে দারোয়ানের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে চাবি ছিনিয়ে নেয়। তালা খুলে দিতেই মানব-¯্রােতপ্রবাহ, বাইরে থেকে ভেতর দিকে। জাহিদুলের চোখ পড়তেই আরেকবার দেখার চেষ্টা করে। মাস্ক-আবৃত, তবু চোখ জোড়া আর আবয়ব চেনা চেনা মনে হতেই জাহিদুলের স্মরণে আসে নূরজানের কথা ‘আসেন স¹লে মিলে... ’। কিন্তু সে রাতের পর পাতালু দা’র মুখে শোনা গেছে- নূরজান পাহাড়ে চলে যেতে চেয়েছিল!!

কোথায় সে!!

back to top