alt

সাময়িকী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

অসামান্য গদ্যশৈলীর রূপকার

হরিপদ দত্ত

: বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী/ জন্ম : ২৩ জুন ১৯৩৬

রাজনৈতিক প্রবন্ধ সাহিত্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠক মননে শ্রেণি-শাসিত সমাজ সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি করা। যে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে পাঠক বসবাস করে সেই সমাজ সম্পর্কে এক ধরনের অজ্ঞতা, অস্পষ্টতা বা অমনোযোগিতায় আচ্ছন্ন থাকে তারা। রাজনৈতিক প্রবন্ধ সমাজের গতি-প্রকৃতির স্বরূপটি উদঘাটন করে পাঠকের সামনে তুলে ধরে এবং সে সম্পর্কে কৌতূহলী পাঠককে তাদের সামাজিক দায়-দায়িত্ব বোধের আলোর সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। রাজনীতি অবশ্যই একটি জটিল বিষয়। তাই এ বিষয়টিকে পাঠকের সামনে বিশ্লেষণ করতে গেলে কেবল তত্ত্ব নির্মাণই প্রধান কাজ নয়, লেখকের ভাষা বা গদ্যশৈলীটিও হতে হবে শিল্পগুণে অন্বিত। জটিল শব্দ চয়ন, বাক্য-বিন্যাস কুয়াশাচ্ছন্ন ভাব দ্বারা বিষয়বস্তুকে দুর্বোধ্য করে তুললে রচনার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। গদ্যের জটিলতার কারণে যদি বিষয়বস্তুর ভেতর পাঠক প্রবেশ করতে না পারলো, তবে লেখক নিজের জন্য তো নয়, পাঠকের জন্যও কোনো সুসংবাদ বহন করতে পারেন না। যেহেতু রাজনৈতিক প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নিছক জ্ঞানের চাষাবাদ নয়, শ্রেণি বিভাজিত সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করে রাজনীতির সঠিক পথটিকে নির্দেশ করা, সেহেতু সেখানে রচয়িতার গদ্যরীতি ও প্রাঞ্জলতা দাবি করে। প্রাঞ্জলতার অর্থ এই নয়, তা জলো বা শ্রীহীন গদ্যকলা কৌশল।

বাংলাদেশের সাহিত্যে রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধ তথা প্রগতিশীল রাজনৈতিক প্রবন্ধের ইতহাস খুব বেশি পুরাতন নয়। যদিও এর সূত্রপাত অভিভক্ত বাংলায় তবু নিজস্ব ধারাটি তৈরি হয়েছে পঞ্চাশের দশকের ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে। প্রকৃত অর্থে এর চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে স্বাধীনতা-উত্তরকালে। কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধি চর্চার ধারা থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক বুদ্ধি চর্চার ধারাটি যে স্বতন্ত্র তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ষাটের দশকের শেষ দিকে। কেননা পশ্চিমবঙ্গে দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসন এবং পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ) পাকিস্তানি শাসনে থাকার ফলে বাংলার দুটি অংশেরই সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপরীতির পরিবর্তন ঘটে। কেবল রাজনৈতিক বাস্তবতা নয়, সাংস্কৃতিক তথা বাংলাভাষার সাহিত্যের বিষয় এবং রূপগত স্বতন্ত্রধারাটিও স্পষ্ট হয়ে পড়ে সে সময়। রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে গোপাল হালদার, বিনয় ঘোষ, আবু সায়ীদ আইয়ুব এবং আরো অনেকে বিষয়-ভাবনা এবং রূপান্তরীতির বিবর্তন ঘটিয়েছেন। কিন্তু বাঙালি জাতির আলাদা রাষ্ট্রের দীর্ঘ জন্ম-যন্ত্রণা এবং জন্মের ধারাবাহিক কম্পন-প্রকম্পনের মধ্য দিয়েই নতুন অভিযাত্রার স্বতন্ত্র রূপ রাজনৈতিক ধারাটি প্রবন্ধ সাহিত্যে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যায় ড. আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, রণেশ দাশগুপ্ত, সরদার ফজলুল করিম, দেবেন শিকদার, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে ফরহাদ মজহার, আহমদ ছফা এবং আরো অনেককে। আমার লেখার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ধারার লেখা-লেখির বিষয় ভাবনা নয়, রূপরীতি তথা গদ্য স্টাইলটি। তবে এটিও সত্য, সাহিত্যের রূপরীতি শূন্য আকাশের মেঘের মতো ভাসমান কিছু নয়, বিষয় ভাবনাকে আশ্রয় করেই তাঁর বিকাশ ঘটে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধের প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে কতগুলো লক্ষণ স্পষ্ট। বিপুলসংখ্যক লেখাই দুর্বোধ্য, অস্পষ্ট, নিরস, কুহকী এবং অলংকারবর্জিত অসুন্দর গদ্যে তৈরি। কারো কারো গদ্যরীতিটি আক্রমণাত্মক। এর ফলে গদ্য হয়ে পড়েছে সৌন্দর্যহীন, কর্কশ এবং স্থ’ূল। দু’একজনের গদ্যরীতি মিষ্টি কথায় আক্রান্ত বা প-িত্যের ভারে গম্ভীর থাকায় পাঠকের জন্য পঠন-পাঠনে দূরতিক্রম্য। এমন বহু রচনাই পাওয়া যায়, সে সবের রচয়িতাগণের উদ্দেশ্যে মহৎ। কিন্তু নিজেদের অভ্যাস হেতু রচনা হয়ে ওঠে উদাসীন গদ্য বা ক্লান্ত গদ্যের রূপ। বিষয় ভাবনা অপূর্ব হওয়া সত্ত্বেও বহু রচনার গদ্যের রূপরীতি কুয়াশাচ্ছন্ন ভাববাদ প্রচারের গদ্যরীতিতে আক্রান্ত। এর ফল দাঁড়ায় এই যে, পাঠক শ্রেণি বুঝতে পারেন না প্রবন্ধকার কী বলতে চাচ্ছেন। বামপন্থি রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়েও ব্যক্তিবাদের অহংবোধ আক্রান্ত গদ্যরীতির প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে পাঠককে লেখক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়। রাজনীতি তথা প্রগতিবাদের কথা বলতে গিয়ে চাতুর্যপূর্ণ বাকভঙ্গি প্রয়োগ করে বাংলাদেশে কেউ কেউ তরুণ পাঠক শ্রেণিকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন।

এই যে চারপাশে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সেসব অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গেই অতিক্রম করতে পেরেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমার পক্ষে তাঁর সম্পর্কে লেখা অনেকটা দুঃসাধ্য। কেননা তাঁর সাহিত্য চিন্তা, সমাজচিন্তা এমনকি ব্যক্তিগত প্রবন্ধ থেকেও রাজনীতিকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। ভাষা যে জীবন বিচ্ছিন্ন নয়, রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়, তা টের পাওয়া যায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ পাঠ করলে। আর এই যে রাজনীতির জীবন কথক, তাঁর গদ্যরীতিটিও একেবারেই আলাদা এবং নিজস্ব। কথা সাহিত্যের ভুবনে তাঁর বিচরণের অভিজ্ঞতা রয়েছে বলেই অথবা দীর্ঘদিনের গদ্যচর্চার ফলে নিজের জন্য আলাদা একটি গদ্যের ভুবন বা রূপরীতি তিনি আবিষ্কার করে নিয়েছেন গদ্যটি তাঁর পরিপাটি বলেই জটিলতামুক্ত। জটিল শব্দ চয়ন বা বাক্য বন্ধন তাঁর স্বভাবে নেই। ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী অধ্যাপক হিসেবে তাঁর গদ্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের আশঙ্কা ছিল কিন্তু তা ঘটেনি। এমনকি প্রচলিত তৎসম শব্দের বহুল ব্যবহার এবং সংস্কৃত প্রত্যয় বা ধাতুজাত শব্দও তিনি যথাসম্ভব পরিহার করেছেন। ব্যাকরণের শব্দতত্ত্ব ও রূপতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর সচেতনতা অবাক করার বিষয়। কেননা তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন না।

সমাজবাদী দর্শনের আলোকে প্রবন্ধ রচনা অত্যন্ত জটিল সাহিত্যকর্ম। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের জটিল প্রক্রিয়ায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে পূর্বে শনাক্ত করতে হয়, তারপর শুরু নিজের লেখাটি। কাজটি অনেকটা নিষ্কাম সাধনার মতো। কাজ করা কিন্তু ভোগের তৃষ্ণাকে দমন করা। খ্যাতির মোহ সেখানে অদৃশ্য। কেননা সমাজবাদী রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নিজের জন্য বা আত্মরতির জন্য সাহিত্য রচনা করেন না, উদ্দেশ্যটা হচ্ছে সমাজ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জানেন তাঁর লেখালেখির উদ্দেশ্য পাঠকের স্নায়ুতে মাদক রস কিংবা আমোদ-প্রমোদ রস প্রবেশ করানো নয়, পাঠকের চিন্তার অনুশীলন দ্বারা সামাজিক সত্যের সামনে দাঁড় করানো। আমার মনে হয় সামাজিক সেই সত্যকে জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই তিনি সাহিত্য জীবনের শুরুতে কথা সাহিত্যের নির্মাণ কাজে হাত দিয়েও সরে আসেন প্রবন্ধ সাহিত্যে। কারণ, তাঁর চোখের সামনে তখন পঞ্চাশের আর ষাটের দশক। এ দেশের মানুষের মুক্তি প্রত্যাশা প্রকাশের পরিপক্ব কাল। এমনি কালে তৃণমূল মানুষ ও নতুন তৈরি হতে থাকা দুর্বল মধ্যবিত্তের জন্য রাজনীতির সঠিক পথের আবশ্যকতাই ছিল জরুরি, কবিতা কিংবা গল্পের চেয়ে। আর সেই পথটা হলো সমাজব্যাখ্যা। সেই উদ্দেশ্য থেকেই বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভ, পরিশীলিত রুচি এবং ধারালো যুক্তিকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর শিল্প নির্মাণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেন। একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠক যদি তাঁর রচনা পাঠক করেন তবেই লেখকের শিল্প কৌশলটি ধরতে পারবেন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুমূলক বস্তুবাদের সূত্র-উপসূত্র এবং অনুগামী সূত্রগুলোকে তিনি প্রথমেই ছড়িয়ে দেন চলমান সমাজ জীবন ও রাজনীতিতে। তারপর গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন সমাজস্থিত শ্রেণিগুলোর আচরণ ও গতি-প্রকৃতি। নিরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণের পর বিশ্লেষণের কাজে হাত দেন তিনি। এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তির কাজ-কর্ম ও জীবনকে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বমূলক কৌশলে এবং শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করে। ‘তাজউদ্দীন আহমদের অবস্থান’, ‘জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ভূমিকা’, ‘শেখ মুজিবের অঙ্গীকার’, ‘বিদ্যাসাগরের কাজ’, ‘আমার পিতার মুখ’ ইত্যাদি প্রবন্ধ তার দৃষ্টান্ত।

যে কোন লেখাই (প্রবন্ধ) যখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখতে বসেন তখন তাঁর গদ্য রূপটি হয়ে ওঠে একের ভেতর বহুর রূপ। কখনো গল্পের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় কিংবা কখনো কবিতার শব্দ ও ছন্দের অনিবার্য বিন্যাসে সমাজের স্বপ্ন ও আগামী কল্পনার রূপকে নিজের করে নিয়ে তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। তাঁর রচনায় ‘উত্তম পুরুষ’ রীতিতে বলা গদ্য এবং ‘সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ’ থেকে বলা গদ্যগুলো পাঠ করলে বোঝা যায়, গদ্যরীতিটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের জন্যই উপযুক্ত। তাই মনোযোগী এবং কৌতূহলী পাঠক ভুলে যান তিনি গদ্য কবিতা নাকি গল্প নয়তো প্রবন্ধ পাঠ করছেন। প্রবন্ধের গঠনরীতিটি যে মন্ময় বা তন্ময় উপবিভাগ রয়েছে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্যের ভিতর তা মিলেমিশে একাকার হয়ে সম্পূর্ণ আলাদা রীতিতে পরিণত হয়। সেই গদ্যরীতিটিই তাঁর নিজস্ব কণ্ঠস্বর। তাঁর এই গদ্যশৈলীর পেছনে কাজ করে নিজস্ব গভীর শ্রেণিজ্ঞান বা শ্রেণি চেতনা। সেই জ্ঞানে ঋদ্ধ বলেই তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে ওঠে আসা পাঠক শ্রেণি এবং সাধারণ মানুষের বোধ বা অনুভবের ভাষাকে বুঝতে পারেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সে কারণেই ‘কুমু’কে বুঝতে পারতেন, তার ভাষাকেও বুঝতে পারতেন এবং নির্দেশ করতে সক্ষম হয়েছেন, কোথায় কুমুর বন্ধন। মোটকথা শ্রেণিটা যত সত্য, ঠিক ততটাই জরুরি সেই শ্রেণি বিশ্লেষণের জন্য উপযুক্ত গদ্যরীতি। তাঁর গদ্য পাঠ করলে বুঝতে কঠিন হয় না যে, কেবল বিষয় ভাবনায়ই নয়, গদ্যের শিল্পরীতির সঙ্গে ক্রমাগত দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে প্রচলিত গদ্যের রূপান্তর ঘটিয়ে নিজের কৌশলটি আত্মস্থ করেছেন লেখক শ্রমে ও মেধায়।

আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করার মতো বাংলাদেশ তো বটেই, পশ্চিম বাংলায়ও বহু পাঠক আছেন যারা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাজনৈতিক দর্শনে আগ্রহী এবং তাঁর গদ্যের মুগ্ধ পাঠক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত খ্যাতিমান অধ্যাপক অমলেন্দু দে’র মন্তব্য হচ্ছে, ‘দ্যাখো, মি. চৌধুরীর গদ্য বলার ঢঙটি কিন্তু চমৎকার। রাজনীতির শুকনো কথাগুলোকে তিনি কি করে যেনো খাঁটি শিল্প বানিয়ে ফেলেন। আজকাল অমনটা কলকাতায়ও খুব একটা দেখা যায় না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যখন দূর বা নিকট অতীতের ইতিহাসের কথা লেখেন তখন তিনি নিছক তথ্য সন্ধানী ঐতিহাসিক ব্যক্তি হয়ে ওঠেন না। নিরাসক্তভাবে সমাজের চালচিত্রও রূপায়ন করেন না। নিষ্পাপ দর্শকের মতো কেবল চোখ ভরে দেখেই যান না। ক্ষুধাতুরের মতো শুধু ইতিহাসের আস্বাদ গ্রহণ করেন না। তিনি ঘটনা বা তার কার্যকারণের উপর আলোকসম্পাৎ করে পাঠককে নিজের বোধের অংশীদার করে নেন। যেমন, ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের কথা তিনি এভাবে বাণীবন্ধন করেন, ‘আমি উৎপাটিত নই, আমি বেড়ে উঠবো বৃক্ষের মতো, শেকড় প্রোথিত থাকবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভূমিতে, আকাক্সক্ষা ছিল এটাও।’ (বায়ান্নর আন্দোলন : নিঃরাজনৈতিক পৃ. ৪১)। গদ্যের এই বাণীভঙ্গিটি আবেগাত্মক অথচ প্রত্যয় দৃঢ় বাণীর মিশ্রণে তৈরি হয়েছে। পাঠকের স্বপ্ন ও উত্তেজনা সত্তার সঙ্গে একাকার হয়ে যায় এই কারণে যে, বিষয়বস্তুর সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিত্বও মিশে একাকার হয়ে গেছে। রচনার সঙ্গে লেখক ব্যক্তিত্বের মেলবন্ধনের বিষয়টি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রতিটি প্রবন্ধে ছড়িয়ে আছে। ‘লেনিন কেন জরুরী’ প্রবন্ধে তাঁকে পাওয়া যায় কী অসীম বিশ্বাসে দৃঢ়। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় লেখক চিত্তে ক্ষোভ-দুঃখ সৃষ্টি হয় কিন্তু আপন বিশ্বাসকে, ব্যক্তিত্বকে বিপর্যয়ে ঠেলে দেন না তিনি। তিনি লিখলেন, ‘যতদিন পৃথিবীতে শোষণ থাকবে ততদিন তিনি থাকবেন। মূর্তি ভাঙলেও তিনি অমর হয়ে রইবেন।...পৃথিবী যদি শোষণশূন্য হয় কখনো, লেনিন তখনও থাকবেন। তখন থাকবেন ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে।’ (নির্বাচিত প্রবন্ধ: পৃ. ২৭৬)। বাক্যটিতে বা অনুচ্ছেদটিতে কোথাও আবেগের উচ্ছ্বাস নেই, নাটকীয় বাণীবিন্যাসও নেই, রোমান্টিক অলীক স্বপ্নও নেই। আছে বিশ্ববাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে দূরদর্শী মানুষের চূড়ান্ত ব্যক্তিত্বের হিসেব। এই ব্যক্তিত্বই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে দাঁড় করিয়ে দেয় তাঁর শিল্প মানসে। তাই তাঁর গদ্য হয়ে ওঠে জনগণের শিল্প সম্পত্তি।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্যের মধ্যে যে শব্দ ব্যঞ্জনা, সেখানে তাঁর শিল্পের বহুমাত্রিকতা ধরা পড়ে। ‘বামদের পারা না-পারা’ প্রবন্ধে তিনি এভাবেই সাজান তাঁর বাক্যকে অসাধারণ শব্দ ব্যঞ্চনায়, ‘উপমহাদেশের বিজ্ঞান তেমন এগুতে পারেনি। যন্ত্র এসেছে বিজ্ঞান ততটা আসেনি। তার কারণ গভীরভাবে প্রোথিত ভাববাদ।’ (বায়ান্নর আন্দোলন : নিঃরাজনৈতিক পৃ. ৯৯)। বাক্যস্থিত ‘যন্ত্র’ এবং ‘বিজ্ঞান’ শব্দ দু’টির বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা পাঠককে গভীর তাৎপর্যের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ‘যন্ত্র’ আর্থিক উন্নয়ন ঘটায় আর ‘বিজ্ঞান’ ঘটায় আত্মার উন্নতি। ছোট একটি বাক্য এবং ক্ষুদ্র দুটি শব্দ মিলে লেখক যেভাবে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেন তা কেবল তার শিল্প মেধারই পরিচয় নয়, গভীর জীবন ও সমাজ প্রজ্ঞারও পরিচয়। লেখকের শিল্পের মাধ্যম এই নিজস্ব গদ্য স্টাইলটি ছড়িয়ে আছে তাঁর অপরাপর রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধে। ‘বাঙালিকে কে বাঁচাবে’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের সত্যমিথ্যা’, ‘জাতীয়তাবাদের স্বভার চরিত্র’, ‘বাইরে বুর্জোয়া ভেতরে সামন্ত’, ‘সালচল্লিশের স্বাধীনতা’ ইত্যাদি অসংখ্য প্রবন্ধের শিল্প-পোশাক এই গদ্যশৈলী। প্রবন্ধের শিরোনাম নির্বাচনেও লেখককে পাই আমরা অলংকার শাস্ত্রের ঋদ্ধ শিল্পী হিসেবে। ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন, সাম্যের ভয়’, ‘নোরা, তুমি যাবে কোথায়’ বা ‘বেকনের মৌমাছির’। প্রবন্ধের এ ধরনের কাব্যিক নামকরণ অবশ্যই বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের নতুন মাত্রা।

রচনার স্টাইল রচয়িতার মানস ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। সেই ব্যক্তিত্বের কারণেই রচনা হয়ে ওঠে ব্যাকরণ শুদ্ধ, ভাষায় গভীর, বুদ্ধিতে সূক্ষ্ম, চিন্তায় পরিচ্ছন্ন, প্রকাশভঙ্গিতে স্নিগ্ধ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাজনৈতিক ধারার গদ্যের ভাষাটি তাঁর অর্জিত ব্যক্তিত্বেরই প্রতিফলন। সেই ব্যক্তিত্বের কারণেই তিনি তাঁর গদ্যের নির্মাণক্ষেত্রে কারিগরি বিদ্যাটি অর্জন করেছেন। তাই তিনি রাষ্ট্র আর সমাজকে নিজস্ব যে কৌশলে পর্যবেক্ষণ করেন, পাঠককেও দেখবার আর বুঝবার সেই ভঙ্গিটি শিখিয়ে দেন। বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধকারদের মতো তিনি অর্জিত পা-িত্য, মেধা, জ্ঞান নিয়ে জনগণের শ্রদ্ধা আর ভক্তির পাত্র সেজে আত্মজ্ঞানের প্রচারক হয়ে নিজেকে অসামান্য করে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেন না। অন্যদিকে ভাবনিষ্ঠ প্রবন্ধকারদের মতো লঘুকল্পনা আর হাস্যরসের রসিকজনও সাজেন না। উভয়ের সংমিশ্রণে তিনি হয়ে ওঠেন আপন ব্যক্তিত্বের ভিতর দিয়ে সৃষ্টিশীল গদ্যের রূপকার। পাঠকের একেবারে চেনা মানুষ। আপন মানুষ। বুর্জোয়া নন, উদারবাদী বুর্জোয়া নন; সামাজিক ন্যায় ও ঔচিত্যবোধের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অতি কাছের মানুষ।

২৩ জুন প্রিয় এই ব্যক্তিত্বের ৯০তম জন্মদিন মর্মান্তিক দেশভাগের হতভাগ্য শিকার আমি। ভিন্দেশের নাগরিক হয়েও স্বদেশ ভুবনের পিছুটান এড়ানো সম্ভব হয়নি। হয়ত হবেও না আমৃত্যু। শ্রদ্ধেয় স্যারকে জন্মদিনে জানাই অফুরান শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।

ছবি

আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

দুই ঋতপার কিসসা এবং এক ন্যাকা চৈতন্য

ছবি

অন্যজীবন অন্যআগুন ছোঁয়া

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কবিজীবন, দর্শন ও কাব্যসন্ধান

ছবি

পিয়াস মজিদের ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’

ছবি

নজরুলের নিবেদিত কবিতা : অর্ঘ্যরে শিল্পরূপ

ছবি

বাঘাডাঙা গাঁও

ছবি

বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বিষয়ভাবনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

পথকবিতা: লোকবাংলার সাধারণ কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

ক্ষমতার ভাষার বিপরীতে মাতৃভাষার সাধনা

ছবি

ফিলিস্তিনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে অণুগল্প

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

শিল্পী সুনীল কুমারের ‘পথের গল্প’-এর স্বরূপ

ছবি

রাত গভীর

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

‘এ নয় আঁখিজল’

জ্যৈষ্ঠের পদাবলি

ছবি

ওসামা অ্যালোমারের একঝুড়ি খুদে গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কাব্যগ্রন্থে নীলদ্রোহের রেখাপাত

ছবি

নার্গিস-নজরুলের স্মৃতিধন্য দৌলতপুরে একদিন

ছবি

যেভাবে ভেঙেছিল এক মৌনতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

নজরুল সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের প্রেক্ষিত

ছবি

স্বাধীনতার কবি নজরুল

ছবি

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রতিভা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দাউদ হায়দার: স্বকীয় ও নির্বাসিত

ছবি

অটোগ্রাফ

tab

সাময়িকী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

অসামান্য গদ্যশৈলীর রূপকার

হরিপদ দত্ত

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী/ জন্ম : ২৩ জুন ১৯৩৬

বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

রাজনৈতিক প্রবন্ধ সাহিত্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠক মননে শ্রেণি-শাসিত সমাজ সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি করা। যে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে পাঠক বসবাস করে সেই সমাজ সম্পর্কে এক ধরনের অজ্ঞতা, অস্পষ্টতা বা অমনোযোগিতায় আচ্ছন্ন থাকে তারা। রাজনৈতিক প্রবন্ধ সমাজের গতি-প্রকৃতির স্বরূপটি উদঘাটন করে পাঠকের সামনে তুলে ধরে এবং সে সম্পর্কে কৌতূহলী পাঠককে তাদের সামাজিক দায়-দায়িত্ব বোধের আলোর সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। রাজনীতি অবশ্যই একটি জটিল বিষয়। তাই এ বিষয়টিকে পাঠকের সামনে বিশ্লেষণ করতে গেলে কেবল তত্ত্ব নির্মাণই প্রধান কাজ নয়, লেখকের ভাষা বা গদ্যশৈলীটিও হতে হবে শিল্পগুণে অন্বিত। জটিল শব্দ চয়ন, বাক্য-বিন্যাস কুয়াশাচ্ছন্ন ভাব দ্বারা বিষয়বস্তুকে দুর্বোধ্য করে তুললে রচনার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। গদ্যের জটিলতার কারণে যদি বিষয়বস্তুর ভেতর পাঠক প্রবেশ করতে না পারলো, তবে লেখক নিজের জন্য তো নয়, পাঠকের জন্যও কোনো সুসংবাদ বহন করতে পারেন না। যেহেতু রাজনৈতিক প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নিছক জ্ঞানের চাষাবাদ নয়, শ্রেণি বিভাজিত সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করে রাজনীতির সঠিক পথটিকে নির্দেশ করা, সেহেতু সেখানে রচয়িতার গদ্যরীতি ও প্রাঞ্জলতা দাবি করে। প্রাঞ্জলতার অর্থ এই নয়, তা জলো বা শ্রীহীন গদ্যকলা কৌশল।

বাংলাদেশের সাহিত্যে রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধ তথা প্রগতিশীল রাজনৈতিক প্রবন্ধের ইতহাস খুব বেশি পুরাতন নয়। যদিও এর সূত্রপাত অভিভক্ত বাংলায় তবু নিজস্ব ধারাটি তৈরি হয়েছে পঞ্চাশের দশকের ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে। প্রকৃত অর্থে এর চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে স্বাধীনতা-উত্তরকালে। কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধি চর্চার ধারা থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক বুদ্ধি চর্চার ধারাটি যে স্বতন্ত্র তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ষাটের দশকের শেষ দিকে। কেননা পশ্চিমবঙ্গে দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসন এবং পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ) পাকিস্তানি শাসনে থাকার ফলে বাংলার দুটি অংশেরই সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপরীতির পরিবর্তন ঘটে। কেবল রাজনৈতিক বাস্তবতা নয়, সাংস্কৃতিক তথা বাংলাভাষার সাহিত্যের বিষয় এবং রূপগত স্বতন্ত্রধারাটিও স্পষ্ট হয়ে পড়ে সে সময়। রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে গোপাল হালদার, বিনয় ঘোষ, আবু সায়ীদ আইয়ুব এবং আরো অনেকে বিষয়-ভাবনা এবং রূপান্তরীতির বিবর্তন ঘটিয়েছেন। কিন্তু বাঙালি জাতির আলাদা রাষ্ট্রের দীর্ঘ জন্ম-যন্ত্রণা এবং জন্মের ধারাবাহিক কম্পন-প্রকম্পনের মধ্য দিয়েই নতুন অভিযাত্রার স্বতন্ত্র রূপ রাজনৈতিক ধারাটি প্রবন্ধ সাহিত্যে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যায় ড. আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, রণেশ দাশগুপ্ত, সরদার ফজলুল করিম, দেবেন শিকদার, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে ফরহাদ মজহার, আহমদ ছফা এবং আরো অনেককে। আমার লেখার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ধারার লেখা-লেখির বিষয় ভাবনা নয়, রূপরীতি তথা গদ্য স্টাইলটি। তবে এটিও সত্য, সাহিত্যের রূপরীতি শূন্য আকাশের মেঘের মতো ভাসমান কিছু নয়, বিষয় ভাবনাকে আশ্রয় করেই তাঁর বিকাশ ঘটে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধের প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে কতগুলো লক্ষণ স্পষ্ট। বিপুলসংখ্যক লেখাই দুর্বোধ্য, অস্পষ্ট, নিরস, কুহকী এবং অলংকারবর্জিত অসুন্দর গদ্যে তৈরি। কারো কারো গদ্যরীতিটি আক্রমণাত্মক। এর ফলে গদ্য হয়ে পড়েছে সৌন্দর্যহীন, কর্কশ এবং স্থ’ূল। দু’একজনের গদ্যরীতি মিষ্টি কথায় আক্রান্ত বা প-িত্যের ভারে গম্ভীর থাকায় পাঠকের জন্য পঠন-পাঠনে দূরতিক্রম্য। এমন বহু রচনাই পাওয়া যায়, সে সবের রচয়িতাগণের উদ্দেশ্যে মহৎ। কিন্তু নিজেদের অভ্যাস হেতু রচনা হয়ে ওঠে উদাসীন গদ্য বা ক্লান্ত গদ্যের রূপ। বিষয় ভাবনা অপূর্ব হওয়া সত্ত্বেও বহু রচনার গদ্যের রূপরীতি কুয়াশাচ্ছন্ন ভাববাদ প্রচারের গদ্যরীতিতে আক্রান্ত। এর ফল দাঁড়ায় এই যে, পাঠক শ্রেণি বুঝতে পারেন না প্রবন্ধকার কী বলতে চাচ্ছেন। বামপন্থি রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়েও ব্যক্তিবাদের অহংবোধ আক্রান্ত গদ্যরীতির প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে পাঠককে লেখক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়। রাজনীতি তথা প্রগতিবাদের কথা বলতে গিয়ে চাতুর্যপূর্ণ বাকভঙ্গি প্রয়োগ করে বাংলাদেশে কেউ কেউ তরুণ পাঠক শ্রেণিকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন।

এই যে চারপাশে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সেসব অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গেই অতিক্রম করতে পেরেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমার পক্ষে তাঁর সম্পর্কে লেখা অনেকটা দুঃসাধ্য। কেননা তাঁর সাহিত্য চিন্তা, সমাজচিন্তা এমনকি ব্যক্তিগত প্রবন্ধ থেকেও রাজনীতিকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। ভাষা যে জীবন বিচ্ছিন্ন নয়, রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়, তা টের পাওয়া যায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ পাঠ করলে। আর এই যে রাজনীতির জীবন কথক, তাঁর গদ্যরীতিটিও একেবারেই আলাদা এবং নিজস্ব। কথা সাহিত্যের ভুবনে তাঁর বিচরণের অভিজ্ঞতা রয়েছে বলেই অথবা দীর্ঘদিনের গদ্যচর্চার ফলে নিজের জন্য আলাদা একটি গদ্যের ভুবন বা রূপরীতি তিনি আবিষ্কার করে নিয়েছেন গদ্যটি তাঁর পরিপাটি বলেই জটিলতামুক্ত। জটিল শব্দ চয়ন বা বাক্য বন্ধন তাঁর স্বভাবে নেই। ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী অধ্যাপক হিসেবে তাঁর গদ্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের আশঙ্কা ছিল কিন্তু তা ঘটেনি। এমনকি প্রচলিত তৎসম শব্দের বহুল ব্যবহার এবং সংস্কৃত প্রত্যয় বা ধাতুজাত শব্দও তিনি যথাসম্ভব পরিহার করেছেন। ব্যাকরণের শব্দতত্ত্ব ও রূপতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর সচেতনতা অবাক করার বিষয়। কেননা তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন না।

সমাজবাদী দর্শনের আলোকে প্রবন্ধ রচনা অত্যন্ত জটিল সাহিত্যকর্ম। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের জটিল প্রক্রিয়ায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে পূর্বে শনাক্ত করতে হয়, তারপর শুরু নিজের লেখাটি। কাজটি অনেকটা নিষ্কাম সাধনার মতো। কাজ করা কিন্তু ভোগের তৃষ্ণাকে দমন করা। খ্যাতির মোহ সেখানে অদৃশ্য। কেননা সমাজবাদী রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নিজের জন্য বা আত্মরতির জন্য সাহিত্য রচনা করেন না, উদ্দেশ্যটা হচ্ছে সমাজ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জানেন তাঁর লেখালেখির উদ্দেশ্য পাঠকের স্নায়ুতে মাদক রস কিংবা আমোদ-প্রমোদ রস প্রবেশ করানো নয়, পাঠকের চিন্তার অনুশীলন দ্বারা সামাজিক সত্যের সামনে দাঁড় করানো। আমার মনে হয় সামাজিক সেই সত্যকে জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই তিনি সাহিত্য জীবনের শুরুতে কথা সাহিত্যের নির্মাণ কাজে হাত দিয়েও সরে আসেন প্রবন্ধ সাহিত্যে। কারণ, তাঁর চোখের সামনে তখন পঞ্চাশের আর ষাটের দশক। এ দেশের মানুষের মুক্তি প্রত্যাশা প্রকাশের পরিপক্ব কাল। এমনি কালে তৃণমূল মানুষ ও নতুন তৈরি হতে থাকা দুর্বল মধ্যবিত্তের জন্য রাজনীতির সঠিক পথের আবশ্যকতাই ছিল জরুরি, কবিতা কিংবা গল্পের চেয়ে। আর সেই পথটা হলো সমাজব্যাখ্যা। সেই উদ্দেশ্য থেকেই বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভ, পরিশীলিত রুচি এবং ধারালো যুক্তিকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর শিল্প নির্মাণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেন। একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠক যদি তাঁর রচনা পাঠক করেন তবেই লেখকের শিল্প কৌশলটি ধরতে পারবেন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুমূলক বস্তুবাদের সূত্র-উপসূত্র এবং অনুগামী সূত্রগুলোকে তিনি প্রথমেই ছড়িয়ে দেন চলমান সমাজ জীবন ও রাজনীতিতে। তারপর গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন সমাজস্থিত শ্রেণিগুলোর আচরণ ও গতি-প্রকৃতি। নিরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণের পর বিশ্লেষণের কাজে হাত দেন তিনি। এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তির কাজ-কর্ম ও জীবনকে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বমূলক কৌশলে এবং শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করে। ‘তাজউদ্দীন আহমদের অবস্থান’, ‘জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ভূমিকা’, ‘শেখ মুজিবের অঙ্গীকার’, ‘বিদ্যাসাগরের কাজ’, ‘আমার পিতার মুখ’ ইত্যাদি প্রবন্ধ তার দৃষ্টান্ত।

যে কোন লেখাই (প্রবন্ধ) যখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখতে বসেন তখন তাঁর গদ্য রূপটি হয়ে ওঠে একের ভেতর বহুর রূপ। কখনো গল্পের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় কিংবা কখনো কবিতার শব্দ ও ছন্দের অনিবার্য বিন্যাসে সমাজের স্বপ্ন ও আগামী কল্পনার রূপকে নিজের করে নিয়ে তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। তাঁর রচনায় ‘উত্তম পুরুষ’ রীতিতে বলা গদ্য এবং ‘সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ’ থেকে বলা গদ্যগুলো পাঠ করলে বোঝা যায়, গদ্যরীতিটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের জন্যই উপযুক্ত। তাই মনোযোগী এবং কৌতূহলী পাঠক ভুলে যান তিনি গদ্য কবিতা নাকি গল্প নয়তো প্রবন্ধ পাঠ করছেন। প্রবন্ধের গঠনরীতিটি যে মন্ময় বা তন্ময় উপবিভাগ রয়েছে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্যের ভিতর তা মিলেমিশে একাকার হয়ে সম্পূর্ণ আলাদা রীতিতে পরিণত হয়। সেই গদ্যরীতিটিই তাঁর নিজস্ব কণ্ঠস্বর। তাঁর এই গদ্যশৈলীর পেছনে কাজ করে নিজস্ব গভীর শ্রেণিজ্ঞান বা শ্রেণি চেতনা। সেই জ্ঞানে ঋদ্ধ বলেই তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে ওঠে আসা পাঠক শ্রেণি এবং সাধারণ মানুষের বোধ বা অনুভবের ভাষাকে বুঝতে পারেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সে কারণেই ‘কুমু’কে বুঝতে পারতেন, তার ভাষাকেও বুঝতে পারতেন এবং নির্দেশ করতে সক্ষম হয়েছেন, কোথায় কুমুর বন্ধন। মোটকথা শ্রেণিটা যত সত্য, ঠিক ততটাই জরুরি সেই শ্রেণি বিশ্লেষণের জন্য উপযুক্ত গদ্যরীতি। তাঁর গদ্য পাঠ করলে বুঝতে কঠিন হয় না যে, কেবল বিষয় ভাবনায়ই নয়, গদ্যের শিল্পরীতির সঙ্গে ক্রমাগত দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে প্রচলিত গদ্যের রূপান্তর ঘটিয়ে নিজের কৌশলটি আত্মস্থ করেছেন লেখক শ্রমে ও মেধায়।

আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করার মতো বাংলাদেশ তো বটেই, পশ্চিম বাংলায়ও বহু পাঠক আছেন যারা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাজনৈতিক দর্শনে আগ্রহী এবং তাঁর গদ্যের মুগ্ধ পাঠক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত খ্যাতিমান অধ্যাপক অমলেন্দু দে’র মন্তব্য হচ্ছে, ‘দ্যাখো, মি. চৌধুরীর গদ্য বলার ঢঙটি কিন্তু চমৎকার। রাজনীতির শুকনো কথাগুলোকে তিনি কি করে যেনো খাঁটি শিল্প বানিয়ে ফেলেন। আজকাল অমনটা কলকাতায়ও খুব একটা দেখা যায় না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যখন দূর বা নিকট অতীতের ইতিহাসের কথা লেখেন তখন তিনি নিছক তথ্য সন্ধানী ঐতিহাসিক ব্যক্তি হয়ে ওঠেন না। নিরাসক্তভাবে সমাজের চালচিত্রও রূপায়ন করেন না। নিষ্পাপ দর্শকের মতো কেবল চোখ ভরে দেখেই যান না। ক্ষুধাতুরের মতো শুধু ইতিহাসের আস্বাদ গ্রহণ করেন না। তিনি ঘটনা বা তার কার্যকারণের উপর আলোকসম্পাৎ করে পাঠককে নিজের বোধের অংশীদার করে নেন। যেমন, ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের কথা তিনি এভাবে বাণীবন্ধন করেন, ‘আমি উৎপাটিত নই, আমি বেড়ে উঠবো বৃক্ষের মতো, শেকড় প্রোথিত থাকবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভূমিতে, আকাক্সক্ষা ছিল এটাও।’ (বায়ান্নর আন্দোলন : নিঃরাজনৈতিক পৃ. ৪১)। গদ্যের এই বাণীভঙ্গিটি আবেগাত্মক অথচ প্রত্যয় দৃঢ় বাণীর মিশ্রণে তৈরি হয়েছে। পাঠকের স্বপ্ন ও উত্তেজনা সত্তার সঙ্গে একাকার হয়ে যায় এই কারণে যে, বিষয়বস্তুর সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিত্বও মিশে একাকার হয়ে গেছে। রচনার সঙ্গে লেখক ব্যক্তিত্বের মেলবন্ধনের বিষয়টি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রতিটি প্রবন্ধে ছড়িয়ে আছে। ‘লেনিন কেন জরুরী’ প্রবন্ধে তাঁকে পাওয়া যায় কী অসীম বিশ্বাসে দৃঢ়। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় লেখক চিত্তে ক্ষোভ-দুঃখ সৃষ্টি হয় কিন্তু আপন বিশ্বাসকে, ব্যক্তিত্বকে বিপর্যয়ে ঠেলে দেন না তিনি। তিনি লিখলেন, ‘যতদিন পৃথিবীতে শোষণ থাকবে ততদিন তিনি থাকবেন। মূর্তি ভাঙলেও তিনি অমর হয়ে রইবেন।...পৃথিবী যদি শোষণশূন্য হয় কখনো, লেনিন তখনও থাকবেন। তখন থাকবেন ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে।’ (নির্বাচিত প্রবন্ধ: পৃ. ২৭৬)। বাক্যটিতে বা অনুচ্ছেদটিতে কোথাও আবেগের উচ্ছ্বাস নেই, নাটকীয় বাণীবিন্যাসও নেই, রোমান্টিক অলীক স্বপ্নও নেই। আছে বিশ্ববাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে দূরদর্শী মানুষের চূড়ান্ত ব্যক্তিত্বের হিসেব। এই ব্যক্তিত্বই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে দাঁড় করিয়ে দেয় তাঁর শিল্প মানসে। তাই তাঁর গদ্য হয়ে ওঠে জনগণের শিল্প সম্পত্তি।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্যের মধ্যে যে শব্দ ব্যঞ্জনা, সেখানে তাঁর শিল্পের বহুমাত্রিকতা ধরা পড়ে। ‘বামদের পারা না-পারা’ প্রবন্ধে তিনি এভাবেই সাজান তাঁর বাক্যকে অসাধারণ শব্দ ব্যঞ্চনায়, ‘উপমহাদেশের বিজ্ঞান তেমন এগুতে পারেনি। যন্ত্র এসেছে বিজ্ঞান ততটা আসেনি। তার কারণ গভীরভাবে প্রোথিত ভাববাদ।’ (বায়ান্নর আন্দোলন : নিঃরাজনৈতিক পৃ. ৯৯)। বাক্যস্থিত ‘যন্ত্র’ এবং ‘বিজ্ঞান’ শব্দ দু’টির বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা পাঠককে গভীর তাৎপর্যের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ‘যন্ত্র’ আর্থিক উন্নয়ন ঘটায় আর ‘বিজ্ঞান’ ঘটায় আত্মার উন্নতি। ছোট একটি বাক্য এবং ক্ষুদ্র দুটি শব্দ মিলে লেখক যেভাবে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেন তা কেবল তার শিল্প মেধারই পরিচয় নয়, গভীর জীবন ও সমাজ প্রজ্ঞারও পরিচয়। লেখকের শিল্পের মাধ্যম এই নিজস্ব গদ্য স্টাইলটি ছড়িয়ে আছে তাঁর অপরাপর রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধে। ‘বাঙালিকে কে বাঁচাবে’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের সত্যমিথ্যা’, ‘জাতীয়তাবাদের স্বভার চরিত্র’, ‘বাইরে বুর্জোয়া ভেতরে সামন্ত’, ‘সালচল্লিশের স্বাধীনতা’ ইত্যাদি অসংখ্য প্রবন্ধের শিল্প-পোশাক এই গদ্যশৈলী। প্রবন্ধের শিরোনাম নির্বাচনেও লেখককে পাই আমরা অলংকার শাস্ত্রের ঋদ্ধ শিল্পী হিসেবে। ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন, সাম্যের ভয়’, ‘নোরা, তুমি যাবে কোথায়’ বা ‘বেকনের মৌমাছির’। প্রবন্ধের এ ধরনের কাব্যিক নামকরণ অবশ্যই বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের নতুন মাত্রা।

রচনার স্টাইল রচয়িতার মানস ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। সেই ব্যক্তিত্বের কারণেই রচনা হয়ে ওঠে ব্যাকরণ শুদ্ধ, ভাষায় গভীর, বুদ্ধিতে সূক্ষ্ম, চিন্তায় পরিচ্ছন্ন, প্রকাশভঙ্গিতে স্নিগ্ধ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাজনৈতিক ধারার গদ্যের ভাষাটি তাঁর অর্জিত ব্যক্তিত্বেরই প্রতিফলন। সেই ব্যক্তিত্বের কারণেই তিনি তাঁর গদ্যের নির্মাণক্ষেত্রে কারিগরি বিদ্যাটি অর্জন করেছেন। তাই তিনি রাষ্ট্র আর সমাজকে নিজস্ব যে কৌশলে পর্যবেক্ষণ করেন, পাঠককেও দেখবার আর বুঝবার সেই ভঙ্গিটি শিখিয়ে দেন। বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধকারদের মতো তিনি অর্জিত পা-িত্য, মেধা, জ্ঞান নিয়ে জনগণের শ্রদ্ধা আর ভক্তির পাত্র সেজে আত্মজ্ঞানের প্রচারক হয়ে নিজেকে অসামান্য করে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেন না। অন্যদিকে ভাবনিষ্ঠ প্রবন্ধকারদের মতো লঘুকল্পনা আর হাস্যরসের রসিকজনও সাজেন না। উভয়ের সংমিশ্রণে তিনি হয়ে ওঠেন আপন ব্যক্তিত্বের ভিতর দিয়ে সৃষ্টিশীল গদ্যের রূপকার। পাঠকের একেবারে চেনা মানুষ। আপন মানুষ। বুর্জোয়া নন, উদারবাদী বুর্জোয়া নন; সামাজিক ন্যায় ও ঔচিত্যবোধের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অতি কাছের মানুষ।

২৩ জুন প্রিয় এই ব্যক্তিত্বের ৯০তম জন্মদিন মর্মান্তিক দেশভাগের হতভাগ্য শিকার আমি। ভিন্দেশের নাগরিক হয়েও স্বদেশ ভুবনের পিছুটান এড়ানো সম্ভব হয়নি। হয়ত হবেও না আমৃত্যু। শ্রদ্ধেয় স্যারকে জন্মদিনে জানাই অফুরান শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।

back to top