ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৯
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আজ ভোরের সূর্য ও আকাশ ঢাকা পড়ে আছে মেঘে- মেঘমেদুর হয়ে আছে আমাদের মনটাও, মন ঠিকই ধরে ফেলেছে- বিদায় জানাতে হবে প্রিয় দুজনকে- গ্রানাদা ও লোরকাকে। তাই যেন বেজে উঠেছে এক বিদায় রাগিনী।
গ্রানাদায় আমাদের শেষ গন্তব্য হলো লোরকার শেষ যাত্রার স্থান।
শহর ছেড়ে পাড়ি দিলাম আবার গ্রামের পথে। দু’পাশের মনোরম দৃশ্য- ছোট ছোট পাহাড়ের গায়ে সারি সারি বাড়ি, তার নিচে জলপাই বাগান, মাঝে মাঝে পপলার ও পাইন গাছ, দূরে সিয়ারা নেভাদা পর্বতমালা- দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম। ৩০ মিনিট পরেট্যাক্সি এসে থামল আলফাকার পাহাড়ের পাদদেশে ভিজনার গ্রামে, একটি পার্কের সামনে- সামনে বড় করে লেখা-‘পার্কে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা’। পার্কের ভেতরে ঢুকতেই পড়ে এক গোল চত্বর, যা সাদা-কালো নুড়ি পাথরে নকশা করে মোড়া। চত্বরের দেয়ালে অনেকগুলি নীল-সাদা টাইলস, তার উপর লোরকার কবিতার পংক্তি। জনপ্রিয় অনেক কবিতা শিরোনাম দেখে চিনতে পারলাম। পার্কটির মাঝখানে সুন্দর এক ফোয়ারা, পাশে বসার বেঞ্চি। আর চারদিকে পাইন ও পপলার গাছের সারি।
পাহাড়ের পাদদেশের চত্বর থেকে বেরিয়ে আমরা ওপরে উঠতে লাগলাম। নুড়ি বিছানো আঁকা-বাঁকা এক সরু রাস্তা পপলার বনের মাঝখান চিরে ওপরে উঠে গেছে। আলফাকার ও ভিজনার-এর মাঝামাঝি এসে রাস্তাটি দ্রুত বাঁক নেয়, এসে পড়ে একটি ঢালু জায়গায়, বারানকো দে ভিজনার এলাকায়, যার সবদিকে পাইন গাছের সারি। রাস্তা হতে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে নিচে তাকাতেই দেখা যায় উপত্যকার ঘর-বাড়ি ও জলপাই গাছ, পাশেই সিয়েরা নেভাদার অপূর্ব নীল-সাদা পর্বতমালা, সে নীল-সাদাই যেন ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে নীল-সাদা হয়ে। ছবির মতো সুন্দর, পবিত্র এ নিসর্গের কোলে কি কাউকে হত্যা করা যায়, তাও স্পেনের শ্রেষ্ঠ কবিকে? অথচ এখানেই গৃহযুদ্ধের সময় হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এখানেই এই নিবিড় পাইনকুঞ্জে লোরকার জীবন ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। সে তারিখ ১৮ আগস্ট বা ১৯ আগস্ট, ১৯৩৬। আমাদের সামনের কোনো এক পাইন গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে আছেন কবি গভীর এক অভিমানে। সাথে ঘুমিয়ে আছেন আরো হাজারো মানুষ, যারা লোরকার সাথে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়েছেন, তাই সবার জন্য একটি স্মৃতি-ফলকই দাঁড়িয়ে আছে এখানে: “খঙজঈঅ ঊজঅঘ ঞঙউঙঝ, সবাই ছিল লোরকা”
আমাদের মন গভীর বিষাদে ভরে গেল লোরকার জন্য, আর নাম না জানা সবার জন্য। নাবিল ও নাতাশা তাদের নিয়ে আসা ফুলগুচ্ছ এ স্মৃতিফলকের বেদিতে আস্তে করে রেখে দিল। আমি ও ফারজানাও হাত দিলাম তাদের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে। এক লোরকাকে দেখতে এসে মিলল হাজার লোরকার সমাধি- সবাই মিশে গেছে লোরকার সাথে তারই প্রিয় গ্রানাদার মাটিতে।
এ এলাকায় অনেক অনুসন্ধান হয়েছে, কিন্তু লোরকার দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি। এর কথাই কি তিনি কল্পনা করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর আগেই:
আমি টের পেলাম তারা আমাকে খুন করেছে।
কাফে, গোরস্থান ও গির্জা তন্ন তন্ন করে তারা খুঁজল আমাকে,
উঁকি দিল পিপায় আর দেরাজে,
তিনটি কঙ্কাল ল-ভ- করে উপড়ে আনল সোনার দাঁত
কিন্তু তারা আমাকে আর কখনো খুঁজে পেল না,
আমাকে তারা খুঁজে পায়নি?
না। আমাকে তারা আর খুঁজে পায়নি।১‘
লোরকার হত্যা গ্রানাদার রক্তপাতের ধারায় আরেকটি অধ্যায় যোগ করল। আটশ’ বছরের শাসন শেষে মুরদের পরাজয় ও গ্রানাদা থেকে বিতাড়ন, মারিয়ানা পিনেদার প্রকাশ্য মৃত্যুদ- কার্যকর, স্পেনীয় ইনকুইসিছিঁওর নিষ্ঠুরতা, আর স্পেনের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ- গ্রানাদার অপরাধের এ ধারার শেষ মর্মান্তিক শিকার স্বয়ং লোরকা। আপন মাটিতে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যা গ্রানাদাকে চির অপরাধী করে রাখল, যার কথা বলেছেন স্পেনের আরেকজন বড় কবি আনতোনিয়ো মাচাদো:
ফেদেরিকো পড়ল মাটিসই,
পেটে সীসে, রক্ত মুখ ভরা
আর এই অপরাধের স্থান দৃশ্য হলো গ্রানাদাতে।
ভাবো, সেই হা-ভাগা গ্রানাদা- তাঁরই আপন গ্রানাদা...।২
লোরকার কথাই আবার সত্য প্রমাণিত হলো, যখন তিনি বলেছেন: ‘পৃথিবীর যে কোনো দেশের মৃতদের চেয়ে স্পেনের মৃতরা অনেক বেশি জীবিত’। লোরকা মৃত হয়েও অনেক জীবিত, অনেক জীবিত মানুষের চেয়েও বেশি জীবিত। লোরকার কবিতার আবৃত্তি হয়, তাঁর নাটক মঞ্চস্থ হয়, তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয়- বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ঋতুতে। লোরকা মরেও অনেক বেশি জীবিত। লোরকা হয়ে আছেন অমর।
Ref:
১. Fábula y rueda de los tres amigos, চক্কর দিয়ে গাওয়ার জন্য তিন বন্ধুর কিসসা,
অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ
২. Antonio Machado, El Crimen fue en Granada, অপরাধ ঘটল গ্রানাদাতে,
অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৯
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আজ ভোরের সূর্য ও আকাশ ঢাকা পড়ে আছে মেঘে- মেঘমেদুর হয়ে আছে আমাদের মনটাও, মন ঠিকই ধরে ফেলেছে- বিদায় জানাতে হবে প্রিয় দুজনকে- গ্রানাদা ও লোরকাকে। তাই যেন বেজে উঠেছে এক বিদায় রাগিনী।
গ্রানাদায় আমাদের শেষ গন্তব্য হলো লোরকার শেষ যাত্রার স্থান।
শহর ছেড়ে পাড়ি দিলাম আবার গ্রামের পথে। দু’পাশের মনোরম দৃশ্য- ছোট ছোট পাহাড়ের গায়ে সারি সারি বাড়ি, তার নিচে জলপাই বাগান, মাঝে মাঝে পপলার ও পাইন গাছ, দূরে সিয়ারা নেভাদা পর্বতমালা- দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম। ৩০ মিনিট পরেট্যাক্সি এসে থামল আলফাকার পাহাড়ের পাদদেশে ভিজনার গ্রামে, একটি পার্কের সামনে- সামনে বড় করে লেখা-‘পার্কে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা’। পার্কের ভেতরে ঢুকতেই পড়ে এক গোল চত্বর, যা সাদা-কালো নুড়ি পাথরে নকশা করে মোড়া। চত্বরের দেয়ালে অনেকগুলি নীল-সাদা টাইলস, তার উপর লোরকার কবিতার পংক্তি। জনপ্রিয় অনেক কবিতা শিরোনাম দেখে চিনতে পারলাম। পার্কটির মাঝখানে সুন্দর এক ফোয়ারা, পাশে বসার বেঞ্চি। আর চারদিকে পাইন ও পপলার গাছের সারি।
পাহাড়ের পাদদেশের চত্বর থেকে বেরিয়ে আমরা ওপরে উঠতে লাগলাম। নুড়ি বিছানো আঁকা-বাঁকা এক সরু রাস্তা পপলার বনের মাঝখান চিরে ওপরে উঠে গেছে। আলফাকার ও ভিজনার-এর মাঝামাঝি এসে রাস্তাটি দ্রুত বাঁক নেয়, এসে পড়ে একটি ঢালু জায়গায়, বারানকো দে ভিজনার এলাকায়, যার সবদিকে পাইন গাছের সারি। রাস্তা হতে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে নিচে তাকাতেই দেখা যায় উপত্যকার ঘর-বাড়ি ও জলপাই গাছ, পাশেই সিয়েরা নেভাদার অপূর্ব নীল-সাদা পর্বতমালা, সে নীল-সাদাই যেন ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে নীল-সাদা হয়ে। ছবির মতো সুন্দর, পবিত্র এ নিসর্গের কোলে কি কাউকে হত্যা করা যায়, তাও স্পেনের শ্রেষ্ঠ কবিকে? অথচ এখানেই গৃহযুদ্ধের সময় হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এখানেই এই নিবিড় পাইনকুঞ্জে লোরকার জীবন ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। সে তারিখ ১৮ আগস্ট বা ১৯ আগস্ট, ১৯৩৬। আমাদের সামনের কোনো এক পাইন গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে আছেন কবি গভীর এক অভিমানে। সাথে ঘুমিয়ে আছেন আরো হাজারো মানুষ, যারা লোরকার সাথে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়েছেন, তাই সবার জন্য একটি স্মৃতি-ফলকই দাঁড়িয়ে আছে এখানে: “খঙজঈঅ ঊজঅঘ ঞঙউঙঝ, সবাই ছিল লোরকা”
আমাদের মন গভীর বিষাদে ভরে গেল লোরকার জন্য, আর নাম না জানা সবার জন্য। নাবিল ও নাতাশা তাদের নিয়ে আসা ফুলগুচ্ছ এ স্মৃতিফলকের বেদিতে আস্তে করে রেখে দিল। আমি ও ফারজানাও হাত দিলাম তাদের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে। এক লোরকাকে দেখতে এসে মিলল হাজার লোরকার সমাধি- সবাই মিশে গেছে লোরকার সাথে তারই প্রিয় গ্রানাদার মাটিতে।
এ এলাকায় অনেক অনুসন্ধান হয়েছে, কিন্তু লোরকার দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি। এর কথাই কি তিনি কল্পনা করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর আগেই:
আমি টের পেলাম তারা আমাকে খুন করেছে।
কাফে, গোরস্থান ও গির্জা তন্ন তন্ন করে তারা খুঁজল আমাকে,
উঁকি দিল পিপায় আর দেরাজে,
তিনটি কঙ্কাল ল-ভ- করে উপড়ে আনল সোনার দাঁত
কিন্তু তারা আমাকে আর কখনো খুঁজে পেল না,
আমাকে তারা খুঁজে পায়নি?
না। আমাকে তারা আর খুঁজে পায়নি।১‘
লোরকার হত্যা গ্রানাদার রক্তপাতের ধারায় আরেকটি অধ্যায় যোগ করল। আটশ’ বছরের শাসন শেষে মুরদের পরাজয় ও গ্রানাদা থেকে বিতাড়ন, মারিয়ানা পিনেদার প্রকাশ্য মৃত্যুদ- কার্যকর, স্পেনীয় ইনকুইসিছিঁওর নিষ্ঠুরতা, আর স্পেনের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ- গ্রানাদার অপরাধের এ ধারার শেষ মর্মান্তিক শিকার স্বয়ং লোরকা। আপন মাটিতে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যা গ্রানাদাকে চির অপরাধী করে রাখল, যার কথা বলেছেন স্পেনের আরেকজন বড় কবি আনতোনিয়ো মাচাদো:
ফেদেরিকো পড়ল মাটিসই,
পেটে সীসে, রক্ত মুখ ভরা
আর এই অপরাধের স্থান দৃশ্য হলো গ্রানাদাতে।
ভাবো, সেই হা-ভাগা গ্রানাদা- তাঁরই আপন গ্রানাদা...।২
লোরকার কথাই আবার সত্য প্রমাণিত হলো, যখন তিনি বলেছেন: ‘পৃথিবীর যে কোনো দেশের মৃতদের চেয়ে স্পেনের মৃতরা অনেক বেশি জীবিত’। লোরকা মৃত হয়েও অনেক জীবিত, অনেক জীবিত মানুষের চেয়েও বেশি জীবিত। লোরকার কবিতার আবৃত্তি হয়, তাঁর নাটক মঞ্চস্থ হয়, তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয়- বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ঋতুতে। লোরকা মরেও অনেক বেশি জীবিত। লোরকা হয়ে আছেন অমর।
Ref:
১. Fábula y rueda de los tres amigos, চক্কর দিয়ে গাওয়ার জন্য তিন বন্ধুর কিসসা,
অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ
২. Antonio Machado, El Crimen fue en Granada, অপরাধ ঘটল গ্রানাদাতে,
অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়