সুমন শাম্স
শিল্পী : সুনীল কুমার
ইলশেগুঁড়ি রোদটুকুও পড়ে গেছে। ক্লান্ত ফুলের গন্ধে বিষণœ সন্ধ্যা। ঢাকের বোলে পুজোর বাদ্য বেজে উঠলো। বনের ভেতর নিসর্গের বনবাংলোয় অশ্বত্থে জড়ানো ফলবান বৈলামের গাছে গোটা পঞ্চাশেক হরিয়াল- মুখে ‘রা’ নেই। শেষতক শ্যাওড়া ডালের প্যাঁচাই গা করে কণ্ঠবাদনে কান তেতো করছে।
দূরে কয়েকটি টিলা পেরিয়ে আসামীলতায় ঢাকা ঝোপড়ানো জঙ্গল। কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছ। কোনো ছাল বাকল নেই। ডালপালাও ছাঁটা। তবু গাছের কমতি নেই এখানটায়। রাতের বেলা জোনাকিরা তারা হয়ে যায়- পাতার ফাঁকে বসে থেকে। আকাশ বেয়ে ওঠা পাহাড়ের সমতল পিঠে উঁচু কাঠের খুঁটিতে পাহাড়ি ঘরগুলো কিঞ্চিৎ ঢালু হয়ে পাশাপাশি জিরাফের মতো দাঁড়িয়ে। ঠিক যেন পাহাড়ের বুকে স্বপ্নআরণ্যক। পায়ের নীলদংশনে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ঘাসেরা মরে গেছে। এই পাহাড়ের বুক চিরেই বয়ে চলেছে বরাক নদী।
মরা গাছটির তলেই জমেছে এ বছরের রাস উৎসব। রাত ১২টা। পাশের ম-পে মহারাস পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই। কেউ একজন ত্রস্তপায়ে ম-পের পুবদিকে নদীর পাড়ে দৌড়ে গেল। দৃষ্টির জবরদস্তি সয়ে নীরবে ফিরেও এলো। ওপাড়ার রোহিমি তান। তারপর অনেকক্ষণ, নির্জন পাহাড়ি নদীপথে থেমে থেমে ধর্ষিতা সেই পাগলিটির অভ্যস্ত গোঙানি শোনা গেল। কখনো কখনো একে ছাপিয়ে যাচ্ছিল ভাটির দিকে ছুটে চলা ক্লান্তিহীন পানির শোঁ শোঁ আওয়াজ।
কখন যেন মেঘমেদুর হয়ে এলো আকাশটা। রাত ধরে আসার সাথে সাথে আবহাওয়ার গুমোট ভাবটা আন্দাজ করা গেল। মেঘ জড়ানো আকাশ যেন ক্রমেই নিচে নামছিল। রোহিমির মনে পড়ল- সেদিনও ছিল রাসপূর্ণিমার রাত!
মনিকাদের উঠোনে ইলিরা তখন নাড়– তৈরিতে ব্যস্ত। এবার যে উৎসব একটি না; দুটো! সাধারণত কার্তিকেই রাসপূর্ণিমার চাঁদ ওঠে। বাতাসে তাই ঠাওর হচ্ছিল- শৈত্য, সৌরভ আর মান্দ্য স্বভাবের খামখেয়ালিপনা। এ সময় নিকটের পাহাড়ে একটা সুয়োতা পাখির রহস্যডাক থেমে গেল।
বউনেওটা রোহিমি রাসলীলায় ইলিরার হেঁশেল-দুয়ার ছাড়তে চায় না। ওর হাতের নাড়–র স্বাদ জিভের ডগায় লেগে থাকে যে! বেশ পয়মন্ত আর সংসারী মেয়ে ইলিরা। তার খলবলে হাসির সবটুকু সৌন্দর্যই লেগে থাকে বাঁ-পাশের গজদাঁতটিতে। দেখনদারিতে রূপবতী সে। হেঁশেলদারিতেও যথারীতি গুণবতীর তকমা চড়িয়েছে নামের পাশে। গুণের পুঁজি গাঁটে থাকার হ্যাপাও কম হলো না তাই। ভালোবেসে তার হাতে গুণের উদ্ধার করিয়ে নিতে মাথা চুলকায় সকলেরই।
সেদিন দুপুরবেলা ছায়া দ্বিগুণ হবার কিছু আগে, মাখামাখা রোদে ভেজাচুল ছড়িয়ে বেতের ফাঁকে আদা বুনছিল ইলিরা। কার্তিকের আগমনে রোদে চাঁপা ফুলের রং ধরেছে। হালকা হলুদ পাতায় আলগোছে পা ফেলে নামছে নরম সূর্য।
বাতাসে ভেসে এলো,
- ইলিরা, বাড়ি আছিস মা?
- কে, মাসী? দাওয়ায় মাদুর রয়েছে। একটু বসো!
ঘাটে জল ছুঁয়ে আসছি।
পঞ্চাশ ফিট অন্তত পাহাড় গলিয়ে নামতে হয় বরাকের ঘাট মাড়াতে হলে। হেমন্তের ঢিমে হাওয়া ভরভরন্ত ফসলের মাঠ যেন দুলিয়ে গেল জলের ষোড়শী বুকে। দুলে উঠল ঘাটে নোঙ্গর করা পাহাড়ি টাগবোট। রাজ-রাজড়াদের মতো রাজকীয় শান বাঁধানো ঘাট নেই এখানে। পাহাড়ের মাটি কেটে গড়া এবড়ো থেবড়ো সিঁড়িগুলোই যেটুকু মন্দের ভালো।
ইলিরা ঘাট হয়ে ফিরে এলে মাসি বললেন, ‘ভুলে যাসনি তো মা? একটু আগে আগে শুরু না করলে বরপক্ষ যে না খেয়ে ফিরবে! ওদিকে মনিকা আবার গোঁ ধরেছে; ইলিরা দিদিকে ছাড়া বিয়ের সাজ গায়েই তুলবে না।’
তারপর, বিকেলটা মরে এলেই মনিকাদের সিঁদুর রঙের উঠোনে ইলিরার নাড়– তৈরির কারুকর্ম এগুতে থাকে। সন্ধ্যা ভারী হবার পরও শেষ হতে চায় না।
হেঁশেল ঘরের সামনে যেতেই সবার চোখ চড়কগাছ। আখেরগুড়, খেজুরগুড়, চিটেগুড়, ঝোলাগুড়, তালগুড়, মাতগুড়, ভেলিগুড়, নলেনগুড়- রীতিমতো আটগুড়ের বাসন উঁচু লাড়–-নাড়–। সাথে শুঁটের লাড়– আর বোলতার ডিমের মনোহরাও যে আছে। অন্যপাশে হাড়ি-কাফগিরে চড়েছে বিয়ের আনুষঙ্গিক অন্যান্য খাবারগুলোও। রসনা বিলাসী এই আয়োজনের পুরো কৃতিত্বই কিন্তু ইলিরার পাওনা। তবু স্বামী হিসেবে খানিকটা সাধুবাদ পাবার লোভে রোহিমি তান তখন থেকেই সবার চোখে চোখে ফিরছে। তাতে কী! সবার চোখ যে ইলিরার গুণমুগ্ধ এই মুহূর্তে। কেউ অন্তত কটাক্ষও করলো না বেচারা রোহিমিকে।
শ্বাসকষ্টের বাড়াবাড়িতে ঘরকন্না আজকাল একটুও গা সওয়া হতে চায় না মনিকার মায়ের। এতটা পথ বুকে হেঁটেই তো বাপমরা মেয়েটাকে তিনি পায়ে হাঁটা পথ চিনিয়েছেন, দেখিয়েছেন অভিযাত্রীর ছুটে চলা দুটি পা। পরিশ্রান্ত সরীসৃপের স্বাদ জিভ থেকে খসে গেছে তার, দুটিমাত্র পায়ের অভাবে।
রাসপূর্ণিমার চাঁদে কেউ যেন হাপর টেনে চলেছে। গনগনে জ্যোৎ¯œা গলে গলে পুরোটা পাহাড়ে রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর শুকনো কুয়াশা চাঁদের সে মহুয়া আলোয় মিশে অবিরাম ধোঁয়া তুলছে লোকতাক হ্রদের ভাসমান কুঁড়েঘরটিতে। মধ্যরাতের কিছু আগে...
মূলফটকে তখন সবার উৎসুক অপেক্ষা। পরিপাটি পোশাকে প্রতিবেশীদের পায়চারি; কখন আসবে বরযাত্রী? খোলা বারান্দায় চেয়ার পেতে জমে উঠেছে গল্পের ধুম। নারীদের মুখে ছুটে চলেছে খিস্তিখেউরের তুবড়ি। সেখান থেকেও একটু পরপর কেউ মাথা উঁচু করে এদিকটায় চোখ রাখছে- ওই বুঝি এলো!
বরের আগমন উপলক্ষে প্রবেশদ্বারে সারি সারি কলাগাছ পুঁতে সুন্দর একটি তোরণ তৈরি করা হয়েছে। গেটটি কাগজ কাটা ফুল-লতা-পাতা দিয়ে সুশোভিত। তোরণদ্বার থেকে রাস্তার উভয়পার্শ্বে অনেকগুলো সপত্র আমশাখা মাটিতে পোঁতা। কলাগাছের নিচে বসানো মঙ্গলঘট ও আমপাতার শোভনসজ্জা। মনিপুরী সাজে বেশ সুসজ্জিত একচালা বিয়েবাড়িটি।
লগ্ন পেরোলে একটি আর্তচিৎকার শোনা গেল। অসংখ্য চোখ ঘুরে যায় কনের ঘরের দিকে। লগ্নভ্রষ্টা মনিকা সংজ্ঞা হারিয়েছে। জ্ঞান ফেরাতে পথ্য আর সেবায় কনেপক্ষ তখন দিশেহারা।
যখন জ্ঞান ফিরল; মানসিক ভারসাম্যের অমানুষিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে গেল মনিকা। পৃথিবীর অসুস্থ ফুসফুসে আর দীর্ঘশ্বাসের খোঁচা দিতে হবে না তাকে। সব দাহকাল অন্তর্দাহের অপরিচিত আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হলো। এই মুহূর্তে মনিকা তাই নির্মম পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
কিছুক্ষণ আগেও স্বপ্নের আকাশ দিগন্তে মিলেমিশে একাকার হয়েছিল মেয়েটির। রমণীয় উপস্থিতিতে ‘বাসরঘরের বধূ’ হওয়াই ছিল মুহূর্ত আগে তার একমাত্র চারিত্রিক ভূমিকা। অথচ, বাঁকে বাঁকেই যেন লুকিয়ে ছিল সুখ কেড়ে নেয়া কোনো মায়াবী ঘাতক।
প্রদোষ-কৈশোরে মনিকার পাইথন চোখের কালোজলে উদয় যে আকণ্ঠ ডুবেছিল। একগাল বঁঈচি ফুলের হাসি ঝরে পড়তো মাড়কন্যা মনিকার চোখেমুখে। এলাংবম লীলকান্তের শ্রেষ্ঠ উপমাটি তার জন্য উৎসর্গ করা খুব বেশি আদিখ্যেতা হবে না। আশৈশব সে যে বাগদত্তা ছিল মাড়য়ারি উদয়ের। তাই তো প্রেমের মোহন আঘাত মনিকার সইলো না।
বেনোজলে ধুয়ে-মুছে নিপাট সমতল সতীত্বের ব-দ্বীপ এখন। যুবতী মনিকাকে তাই আজ ন্যাংটা হতে হয়। হতে হয় রাসলীলার শরীরী দেবী। সে পূজার উপচার ঘামের লোনাগন্ধ এবং বীর্যপূর্ণ শিশ্নমু-। ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেছে তার একান্ত নারীত্বের গোপন কুমারীত্ব; শিশ্নপরায়ণ কয়েকটি পূজারি!
কে দায়ী মনিকার এই পরিণতির জন্য, নিয়তি নাকি উদয়? হয়তো কোনোদিনই পাগল মনিকা খুঁজে পাবে না তার উত্তর। উদয়ের বিশ্বাসঘাতক মুখের পোর্ট্রেট লটকে থাকবে মনিকার খুইয়ে ফেলা একগাদা স্মৃতিময় অতীতে, হতে পারে চিরটাকাল।
কিন্তু উদয়তো ভালোবাসার পবিত্র বিশ্বাসকে হত্যা করতে চায়নি! প্রশ্ন যখন স্বাধীনতার, অস্তিত্ব রক্ষার! তার সদুত্তরও তাই সংগ্রাম! পাওনা ব্রজবাসীর মতো মুক্তিপাগল উদয় নিজেকে এড়াতে পারেনি স্বজাতি, স্বরাজ্য ও স্বাধীনতার প্রশ্নে। আর সে অপরাধেই বরের সাজ গায়ে চড়ানোর কয়েক মুহূর্ত আগে কয়েদির সাজ গায়ে জড়াতে হয়েছিল তাকে।
ইলিরা এসে ডাকলে রোহিমির চমক ভাঙে।
- রাস উৎসব ছেড়ে এখানে বসে কী ভাবছো?
- না, কিছু না!
শান্ত হয়ে আসা বরাকের জলে চিকন একটি ফিকেস্বর গহীন কণ্ঠে হৃদয়ের প্রতিধ্বনি বিছিয়ে দিলো বাতাসের পাথরে গানের সুরে তখন-
চিংগা সাত পা ইংগেনা নাই
চিন্ নাট্না কেম্খি বা পা মু আই;
আই না কেংগী কেন দি দা
মালাং বা না সিত পা গী কেন বা নাই।
মালাং বা আই সুং কাই ত দা
হাই রাং লাই খাক লাই বাগী কেন বা নাই।
অনুবাদ: পর্বতের আড়ালে কী সুন্দর ফুল ফুটে আছে।
হে ফুল, তুমি বৃথাই ঝরে পড়ছো।
তোমার জন্য দুঃখ হয়।
ফুল বলে, আমি বৃথাই ঝরে পড়ি না।
বায়ু এমন নিষ্ঠুর যে সে আমাকে বৃন্তচ্যুত করে।
বাতাস বলে, আমি তো কিছু করি না।
তোমার বোঁটার শক্তি ভারি কম।
কাজেই তুমি ঝড়ে পড়।
এখনো রাসপূর্ণিমার আলোয় প্রসারিত তীব্র অশোভন ছায়াগুলো মনিকার বুকে উদ্যত। রাত্রি ও নক্ষত্রের মাঝখানে শিশির ঝরার শব্দ। সপ্তর্ষি মণ্ডলের ঝিলিক তোলা হাহাকারের নিশ্চুপ সাক্ষী এক টুকরো সন্ধ্যাতারা।
সুমন শাম্স
শিল্পী : সুনীল কুমার
বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
ইলশেগুঁড়ি রোদটুকুও পড়ে গেছে। ক্লান্ত ফুলের গন্ধে বিষণœ সন্ধ্যা। ঢাকের বোলে পুজোর বাদ্য বেজে উঠলো। বনের ভেতর নিসর্গের বনবাংলোয় অশ্বত্থে জড়ানো ফলবান বৈলামের গাছে গোটা পঞ্চাশেক হরিয়াল- মুখে ‘রা’ নেই। শেষতক শ্যাওড়া ডালের প্যাঁচাই গা করে কণ্ঠবাদনে কান তেতো করছে।
দূরে কয়েকটি টিলা পেরিয়ে আসামীলতায় ঢাকা ঝোপড়ানো জঙ্গল। কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছ। কোনো ছাল বাকল নেই। ডালপালাও ছাঁটা। তবু গাছের কমতি নেই এখানটায়। রাতের বেলা জোনাকিরা তারা হয়ে যায়- পাতার ফাঁকে বসে থেকে। আকাশ বেয়ে ওঠা পাহাড়ের সমতল পিঠে উঁচু কাঠের খুঁটিতে পাহাড়ি ঘরগুলো কিঞ্চিৎ ঢালু হয়ে পাশাপাশি জিরাফের মতো দাঁড়িয়ে। ঠিক যেন পাহাড়ের বুকে স্বপ্নআরণ্যক। পায়ের নীলদংশনে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ঘাসেরা মরে গেছে। এই পাহাড়ের বুক চিরেই বয়ে চলেছে বরাক নদী।
মরা গাছটির তলেই জমেছে এ বছরের রাস উৎসব। রাত ১২টা। পাশের ম-পে মহারাস পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই। কেউ একজন ত্রস্তপায়ে ম-পের পুবদিকে নদীর পাড়ে দৌড়ে গেল। দৃষ্টির জবরদস্তি সয়ে নীরবে ফিরেও এলো। ওপাড়ার রোহিমি তান। তারপর অনেকক্ষণ, নির্জন পাহাড়ি নদীপথে থেমে থেমে ধর্ষিতা সেই পাগলিটির অভ্যস্ত গোঙানি শোনা গেল। কখনো কখনো একে ছাপিয়ে যাচ্ছিল ভাটির দিকে ছুটে চলা ক্লান্তিহীন পানির শোঁ শোঁ আওয়াজ।
কখন যেন মেঘমেদুর হয়ে এলো আকাশটা। রাত ধরে আসার সাথে সাথে আবহাওয়ার গুমোট ভাবটা আন্দাজ করা গেল। মেঘ জড়ানো আকাশ যেন ক্রমেই নিচে নামছিল। রোহিমির মনে পড়ল- সেদিনও ছিল রাসপূর্ণিমার রাত!
মনিকাদের উঠোনে ইলিরা তখন নাড়– তৈরিতে ব্যস্ত। এবার যে উৎসব একটি না; দুটো! সাধারণত কার্তিকেই রাসপূর্ণিমার চাঁদ ওঠে। বাতাসে তাই ঠাওর হচ্ছিল- শৈত্য, সৌরভ আর মান্দ্য স্বভাবের খামখেয়ালিপনা। এ সময় নিকটের পাহাড়ে একটা সুয়োতা পাখির রহস্যডাক থেমে গেল।
বউনেওটা রোহিমি রাসলীলায় ইলিরার হেঁশেল-দুয়ার ছাড়তে চায় না। ওর হাতের নাড়–র স্বাদ জিভের ডগায় লেগে থাকে যে! বেশ পয়মন্ত আর সংসারী মেয়ে ইলিরা। তার খলবলে হাসির সবটুকু সৌন্দর্যই লেগে থাকে বাঁ-পাশের গজদাঁতটিতে। দেখনদারিতে রূপবতী সে। হেঁশেলদারিতেও যথারীতি গুণবতীর তকমা চড়িয়েছে নামের পাশে। গুণের পুঁজি গাঁটে থাকার হ্যাপাও কম হলো না তাই। ভালোবেসে তার হাতে গুণের উদ্ধার করিয়ে নিতে মাথা চুলকায় সকলেরই।
সেদিন দুপুরবেলা ছায়া দ্বিগুণ হবার কিছু আগে, মাখামাখা রোদে ভেজাচুল ছড়িয়ে বেতের ফাঁকে আদা বুনছিল ইলিরা। কার্তিকের আগমনে রোদে চাঁপা ফুলের রং ধরেছে। হালকা হলুদ পাতায় আলগোছে পা ফেলে নামছে নরম সূর্য।
বাতাসে ভেসে এলো,
- ইলিরা, বাড়ি আছিস মা?
- কে, মাসী? দাওয়ায় মাদুর রয়েছে। একটু বসো!
ঘাটে জল ছুঁয়ে আসছি।
পঞ্চাশ ফিট অন্তত পাহাড় গলিয়ে নামতে হয় বরাকের ঘাট মাড়াতে হলে। হেমন্তের ঢিমে হাওয়া ভরভরন্ত ফসলের মাঠ যেন দুলিয়ে গেল জলের ষোড়শী বুকে। দুলে উঠল ঘাটে নোঙ্গর করা পাহাড়ি টাগবোট। রাজ-রাজড়াদের মতো রাজকীয় শান বাঁধানো ঘাট নেই এখানে। পাহাড়ের মাটি কেটে গড়া এবড়ো থেবড়ো সিঁড়িগুলোই যেটুকু মন্দের ভালো।
ইলিরা ঘাট হয়ে ফিরে এলে মাসি বললেন, ‘ভুলে যাসনি তো মা? একটু আগে আগে শুরু না করলে বরপক্ষ যে না খেয়ে ফিরবে! ওদিকে মনিকা আবার গোঁ ধরেছে; ইলিরা দিদিকে ছাড়া বিয়ের সাজ গায়েই তুলবে না।’
তারপর, বিকেলটা মরে এলেই মনিকাদের সিঁদুর রঙের উঠোনে ইলিরার নাড়– তৈরির কারুকর্ম এগুতে থাকে। সন্ধ্যা ভারী হবার পরও শেষ হতে চায় না।
হেঁশেল ঘরের সামনে যেতেই সবার চোখ চড়কগাছ। আখেরগুড়, খেজুরগুড়, চিটেগুড়, ঝোলাগুড়, তালগুড়, মাতগুড়, ভেলিগুড়, নলেনগুড়- রীতিমতো আটগুড়ের বাসন উঁচু লাড়–-নাড়–। সাথে শুঁটের লাড়– আর বোলতার ডিমের মনোহরাও যে আছে। অন্যপাশে হাড়ি-কাফগিরে চড়েছে বিয়ের আনুষঙ্গিক অন্যান্য খাবারগুলোও। রসনা বিলাসী এই আয়োজনের পুরো কৃতিত্বই কিন্তু ইলিরার পাওনা। তবু স্বামী হিসেবে খানিকটা সাধুবাদ পাবার লোভে রোহিমি তান তখন থেকেই সবার চোখে চোখে ফিরছে। তাতে কী! সবার চোখ যে ইলিরার গুণমুগ্ধ এই মুহূর্তে। কেউ অন্তত কটাক্ষও করলো না বেচারা রোহিমিকে।
শ্বাসকষ্টের বাড়াবাড়িতে ঘরকন্না আজকাল একটুও গা সওয়া হতে চায় না মনিকার মায়ের। এতটা পথ বুকে হেঁটেই তো বাপমরা মেয়েটাকে তিনি পায়ে হাঁটা পথ চিনিয়েছেন, দেখিয়েছেন অভিযাত্রীর ছুটে চলা দুটি পা। পরিশ্রান্ত সরীসৃপের স্বাদ জিভ থেকে খসে গেছে তার, দুটিমাত্র পায়ের অভাবে।
রাসপূর্ণিমার চাঁদে কেউ যেন হাপর টেনে চলেছে। গনগনে জ্যোৎ¯œা গলে গলে পুরোটা পাহাড়ে রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর শুকনো কুয়াশা চাঁদের সে মহুয়া আলোয় মিশে অবিরাম ধোঁয়া তুলছে লোকতাক হ্রদের ভাসমান কুঁড়েঘরটিতে। মধ্যরাতের কিছু আগে...
মূলফটকে তখন সবার উৎসুক অপেক্ষা। পরিপাটি পোশাকে প্রতিবেশীদের পায়চারি; কখন আসবে বরযাত্রী? খোলা বারান্দায় চেয়ার পেতে জমে উঠেছে গল্পের ধুম। নারীদের মুখে ছুটে চলেছে খিস্তিখেউরের তুবড়ি। সেখান থেকেও একটু পরপর কেউ মাথা উঁচু করে এদিকটায় চোখ রাখছে- ওই বুঝি এলো!
বরের আগমন উপলক্ষে প্রবেশদ্বারে সারি সারি কলাগাছ পুঁতে সুন্দর একটি তোরণ তৈরি করা হয়েছে। গেটটি কাগজ কাটা ফুল-লতা-পাতা দিয়ে সুশোভিত। তোরণদ্বার থেকে রাস্তার উভয়পার্শ্বে অনেকগুলো সপত্র আমশাখা মাটিতে পোঁতা। কলাগাছের নিচে বসানো মঙ্গলঘট ও আমপাতার শোভনসজ্জা। মনিপুরী সাজে বেশ সুসজ্জিত একচালা বিয়েবাড়িটি।
লগ্ন পেরোলে একটি আর্তচিৎকার শোনা গেল। অসংখ্য চোখ ঘুরে যায় কনের ঘরের দিকে। লগ্নভ্রষ্টা মনিকা সংজ্ঞা হারিয়েছে। জ্ঞান ফেরাতে পথ্য আর সেবায় কনেপক্ষ তখন দিশেহারা।
যখন জ্ঞান ফিরল; মানসিক ভারসাম্যের অমানুষিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে গেল মনিকা। পৃথিবীর অসুস্থ ফুসফুসে আর দীর্ঘশ্বাসের খোঁচা দিতে হবে না তাকে। সব দাহকাল অন্তর্দাহের অপরিচিত আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হলো। এই মুহূর্তে মনিকা তাই নির্মম পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
কিছুক্ষণ আগেও স্বপ্নের আকাশ দিগন্তে মিলেমিশে একাকার হয়েছিল মেয়েটির। রমণীয় উপস্থিতিতে ‘বাসরঘরের বধূ’ হওয়াই ছিল মুহূর্ত আগে তার একমাত্র চারিত্রিক ভূমিকা। অথচ, বাঁকে বাঁকেই যেন লুকিয়ে ছিল সুখ কেড়ে নেয়া কোনো মায়াবী ঘাতক।
প্রদোষ-কৈশোরে মনিকার পাইথন চোখের কালোজলে উদয় যে আকণ্ঠ ডুবেছিল। একগাল বঁঈচি ফুলের হাসি ঝরে পড়তো মাড়কন্যা মনিকার চোখেমুখে। এলাংবম লীলকান্তের শ্রেষ্ঠ উপমাটি তার জন্য উৎসর্গ করা খুব বেশি আদিখ্যেতা হবে না। আশৈশব সে যে বাগদত্তা ছিল মাড়য়ারি উদয়ের। তাই তো প্রেমের মোহন আঘাত মনিকার সইলো না।
বেনোজলে ধুয়ে-মুছে নিপাট সমতল সতীত্বের ব-দ্বীপ এখন। যুবতী মনিকাকে তাই আজ ন্যাংটা হতে হয়। হতে হয় রাসলীলার শরীরী দেবী। সে পূজার উপচার ঘামের লোনাগন্ধ এবং বীর্যপূর্ণ শিশ্নমু-। ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেছে তার একান্ত নারীত্বের গোপন কুমারীত্ব; শিশ্নপরায়ণ কয়েকটি পূজারি!
কে দায়ী মনিকার এই পরিণতির জন্য, নিয়তি নাকি উদয়? হয়তো কোনোদিনই পাগল মনিকা খুঁজে পাবে না তার উত্তর। উদয়ের বিশ্বাসঘাতক মুখের পোর্ট্রেট লটকে থাকবে মনিকার খুইয়ে ফেলা একগাদা স্মৃতিময় অতীতে, হতে পারে চিরটাকাল।
কিন্তু উদয়তো ভালোবাসার পবিত্র বিশ্বাসকে হত্যা করতে চায়নি! প্রশ্ন যখন স্বাধীনতার, অস্তিত্ব রক্ষার! তার সদুত্তরও তাই সংগ্রাম! পাওনা ব্রজবাসীর মতো মুক্তিপাগল উদয় নিজেকে এড়াতে পারেনি স্বজাতি, স্বরাজ্য ও স্বাধীনতার প্রশ্নে। আর সে অপরাধেই বরের সাজ গায়ে চড়ানোর কয়েক মুহূর্ত আগে কয়েদির সাজ গায়ে জড়াতে হয়েছিল তাকে।
ইলিরা এসে ডাকলে রোহিমির চমক ভাঙে।
- রাস উৎসব ছেড়ে এখানে বসে কী ভাবছো?
- না, কিছু না!
শান্ত হয়ে আসা বরাকের জলে চিকন একটি ফিকেস্বর গহীন কণ্ঠে হৃদয়ের প্রতিধ্বনি বিছিয়ে দিলো বাতাসের পাথরে গানের সুরে তখন-
চিংগা সাত পা ইংগেনা নাই
চিন্ নাট্না কেম্খি বা পা মু আই;
আই না কেংগী কেন দি দা
মালাং বা না সিত পা গী কেন বা নাই।
মালাং বা আই সুং কাই ত দা
হাই রাং লাই খাক লাই বাগী কেন বা নাই।
অনুবাদ: পর্বতের আড়ালে কী সুন্দর ফুল ফুটে আছে।
হে ফুল, তুমি বৃথাই ঝরে পড়ছো।
তোমার জন্য দুঃখ হয়।
ফুল বলে, আমি বৃথাই ঝরে পড়ি না।
বায়ু এমন নিষ্ঠুর যে সে আমাকে বৃন্তচ্যুত করে।
বাতাস বলে, আমি তো কিছু করি না।
তোমার বোঁটার শক্তি ভারি কম।
কাজেই তুমি ঝড়ে পড়।
এখনো রাসপূর্ণিমার আলোয় প্রসারিত তীব্র অশোভন ছায়াগুলো মনিকার বুকে উদ্যত। রাত্রি ও নক্ষত্রের মাঝখানে শিশির ঝরার শব্দ। সপ্তর্ষি মণ্ডলের ঝিলিক তোলা হাহাকারের নিশ্চুপ সাক্ষী এক টুকরো সন্ধ্যাতারা।