কামরুল ইসলাম
শিল্পী : রাজিব রায়
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বাঙালি সংস্কৃতি বাঙালির জীবন-সংগ্রামেরও চলমান ইতিহাস। নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের সংস্কৃতির স্রোতধারায় যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে সে-কথা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক যে তা আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির মূলধারায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। হাজার বছরেরও বেশি সময়ের বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য সাবলীলভাবে উজ্জীবিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আবহকে আত্তীকরণের মধ্য দিয়েই। সাহিত্যের আদি বাহন কবিতা। কবিতার মধ্যে জীবনের মৌলিক সত্যগুলো সর্বাগ্রেই ঝলসে ওঠে এবং কবিতাই কোনো পরিবর্তনকে, কোনো রাষ্ট্রিক-সামাজিক-বৈশ্বিক মৌলিক আচরণকে শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের আগেই সমসাত্ত্বিক অথবা অসমসাত্ত্বিক যেকোনো ভাবেই ধারণ করার ক্ষমতা রাখে। কবিতাই যে শ্রেষ্ঠ শিল্পমাধ্যম, একথা আজ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলবার কোনো দরকার নেই। কোনো জাতিকে তার সমূহ আচরণে দেখতে হলে সর্বাগ্রে তার কবিতার দিকে তাকাতে হবে। বাঙালির জাতিসত্তার পরিচয় তার কবিতা; কবিতাই বাঙালির চিরকালের গৌরবময় ইতিহাস, তার সংগ্রামী চেতনার শৈল্পিক হাতিয়ার।
এক বিস্ময়কর গভীরের ডাক আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির মন ও মানবিকতার সুযোগ্য পরিবর্তনের, তার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের এক চিরায়ত প্রেরণা। সামনে বাঙালিরা আরও হাজারও বছর এগিয়ে যাবে, ঝড়-ঝঞ্ঝা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়-মহামারী, রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং শত বিপ্লবেও যা তার চিরকালীন উজ্জ্বলতা কখনো হারাবে না, তা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। নানাবিধ নির্মাণের সিঁড়ি এই মুক্তিযুদ্ধ তাই আগামী প্রজন্মের কাছে এক অপরিহার্য পাঠ। আমাদের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের আঙ্গিনায় এই যুদ্ধ বাঙালির অস্তিত্বেরই চিরায়ত সংগীত, জাতিসত্তার পরিচায়ক চির জাগ্রত গৌরবগাথা। এই যুদ্ধকে ঘিরে আমাদের গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটক বাঙালির সংগ্রামী চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমাদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ এবং তার আবহ এত সফলভাবে এসেছে যে, কবিতা ও মুক্তিযুদ্ধ কখনো কখনো একাকার হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সদা জাগ্রত রাখার মধ্যেই রয়েছে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির মুক্তি।
উপনিবেশ কেবল অর্থনৈতিকভাবেই কোনো জাতিকে পঙ্গু করে ফেলে না, রাষ্ট্রীয় কাঠামোকেও দুর্বল করে, তার ভাষা ও সংস্কৃতির ওপরও আঘাত হানে। কখনো কখনো কোনো জাতির ভাষা-সংস্কৃতিকে এমনভাবে পঙ্গু করে ফেলে যে, স্বাধীনতা লাভের পরও অনেককাল সেই পঙ্গুত্ব নিয়ে তাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আফ্রিকার উপনিবেশগুলোর দিকে তাকালে এসব বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কলোনিয়াল শাসকরা সোমালিয়াসহ অনেক দেশের নিজস্ব ভাষাকে দীর্ঘকাল বিকশিত হতে দেয়নি, বরং নানা কৌশলে তা ধ্বংসের পাঁয়তারা করেছে। উপমহাদেশে নজরুলের আবির্ভাব সেই সময়ে, যখন কলোনিয়াল শাসনের পারদ ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামছে। কলোনিয়াল আবহেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকশিত হয়েছে। মাইকেল, বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতাপশালী প্রতিভাধরদের হাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য একটি মর্যাদাপূর্ণ জায়গায় পৌঁছে যায়। এমনকি বিশ্ব-দরবারেও তার স্থান হয় রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির মধ্য দিযে। নজরুলের আবির্ভাবে বাংলা ভাষার শিরায় প্রবাহিত হয় আলাদা রকমের প্রাণদায়ী শক্তি। নানা প্রান্ত থেকে তার শব্দ-চয়নের পারঙ্গমতা তার মৌলিক সৃজন শক্তিরই বহির্প্রকাশ। একটি সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজের কাব্যভাষা তৈরির মধ্য দিযে বাংলা কবিতায় তার স্বতন্ত্র স্বাক্ষর রাখার বিষয়টি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা প্রয়োজন। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনার ভিত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাবেই যে দানা বেঁধে ওঠে, এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ ধীর লয়ে ক্রমাগত বাঙালির চিরায়ত সাংস্কৃতিক প্রত্যয়কে প্রভাবিত করেছেন, আর নজরুল তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে, বজ্রনির্ঘোষ তাড়নায় বাঙালির চেতনায় এনেছেন এক চিরন্তন অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক বোধ। এই প্রত্যয় ও বোধই ক্রমাগত আমাদের দাঁড়াতে শিখিয়েছে অন্যায়-অবিচার, শাসন-শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে।
বাঙালি সংস্কৃতির স্বাধীন চলার পথ এখনো বঙ্কিম, নানাবিধ শত্রুতায় বিশীর্ণ তার সজীব প্রত্যয়। ইংরেজরা আজকে নেই। সাম্রাজ্য বিস্তারের যুগ শেষ হলেও সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-প্রক্রিয়ার তো সমাপ্তি ঘটেনি। নয়া কৌশল, নয়া ইজম, দর্শন এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনার আওতায় আজ তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো নানাভাবেই নানা বঞ্চনার শিকার এবং এও সত্যি যে, তাদের কৌশলী দয়া-দাক্ষিণ্যের উৎপাতে আমরা স্বয়ম্ভরতার সমূহ সম্ভাবনাকে বিসর্জন দিয়ে ক্র্যাচসর্বস্ব পঙ্গু অর্থনীতির উপাসনায় লোটস-ইটার্সদের মতো আলস্যে দিনযাপন করছি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের সর্বৈব ক্লেদ-গানি রপ্তানি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। স্যাটেলাইটের বদৌলতে আকাশ পথে (আধুনিক প্রযুক্তি আমদানির সাথে সাথে) বিদেশি আগ্রাসী সংস্কৃতিরও পণ্য হিসেবে আমদানি আমাদের জাতিসত্তার প্রতিই এক প্রচ- হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে আমাদের এই ভয়াবহ রাজনৈতিক অরাজকতা, স্বৈরাচার, গণতন্ত্রের নামে অনাচার এবং মৌলবাদের অশুভ আচরণ- সবকিছুই সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনা মাফিক দেশীয় দালালদের দ্বারা সৃষ্ট, যা আমাদের অভ্যন্তরীণ জীবনযাত্রাকে ক্রমাগত নিশ্চল ও অকেজো করে দিচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবিলায়, নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সমূহ বিপদের গ-ি থেকে মুক্ত করতে সর্বাগ্রে দরকার স্বয়ম্ভর অর্থনীতি এবং দেশাত্ববোধ। তারও আগে দরকার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাধীন বিকাশ ত্বরাম্বিত করা এবং বিদেশের যা কিছু ভাল সুস্থ জীবনমুখীনতায় উন্মুখর তা গ্রহণ করা এবং পঙ্কিলতা, কদর্য-ঠুনকো, কুরুচিপূর্ণ, ধনতন্ত্রের মাদকতাপূর্ণ সংস্কৃতি নামক পণ্যসামগ্রী প্রত্যাখান করা। গ্রহণ-বর্জনের মধ্যেই কোনো জাতির সংস্কৃতি বেঁচে থাকে, গতি পায় আর তার অভাবেই তা শুকিয়ে যায়, বন্ধ্যা হয়ে যায়- একথা মনে রাখতে হবে। বিদেশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসন ঠেকানোর ব্যাপারটি যে খুব সহজ নয়, সেসব মনে রেখেই আমাদের এগোতে হবে। টেকনোলজির ক্রম-উন্নয়নের সাথে আমরা তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে জাতি হিশেবে পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য। চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং নতুন প্রজন্মকে গুণগত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে রাষ্ট্রের পজিটিভ পদক্ষেপ থাকা দরকার।
বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতি সব সময়ই দ্বন্দ্বে-সংগ্রামে বিকশিত হয়েছে; এই দ্বন্দ্ব বা বিরুদ্ধস্রোতে আমাদের আতঙ্কিত হবার কারণ নেই যদিও, তথাপিও ভাবতে হবে আজকের দ্বন্দ্বটা পুরনো দ্বন্দ্বের পুনরাবৃত্তি নয় বরং অনেক, অনেকখানিই নতুন কৌশলে আকীর্ণ, সর্বপ্লাবী এবং আলাদা বৈশিষ্ট্যের; যদিও অভিন্ন উদ্দেশ্যে লালিত এবং সংক্রমিত। এর-ই মধ্যে, এই সব চিরায়ত দ্বন্দ্ব এবং ভয়াবহ অরাজক ভূমি-বাতাসেই বাঙালি তার হাজার বছরেরও বেশি সময়ের এই সংগ্রামী ঐতিহ্যপ্রবাহকে সমুন্নত রেখেছে তার সাহিত্যে-শিল্পে, জীবনাচরণে, বোধিতে। বহির্বিশ্বের সাথে আমাদের শিল্পগত সাযুজ্যের সূত্রটি নিতান্তই স্থুল এবং অপরিণতহেতু শিল্পসাহিত্যের মতো সৃষ্টিশীল কাজ এখানে উৎস ও মেধা থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে দাঁড়াতে পারছে না এবং চিন্তনের ক্ষেত্রে এখানে ব্যাপক অনুধ্যান নেই, যতটা আছে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের। তবে একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, আমাদের কবিতা, গল্প, উপন্যাস নাটকের আস্থিক উঠোন পঙ্গু অর্থনীতির মতো একেবারে সংকীর্ণ নয়; সেখানে অন্তত দাঁড়ানো যায়, জোছনা রাতে মাদুর পেতে বসে একসঙ্গে গল্প করে অনেক রাত অবধি জোছনার অমৃত পানে কিছুটা পথ ভেসে যাওয়া যায়। পাশ্চাত্যের, আজকে, প্রাচ্যের দিকে মুখ ফেরানোর তাগিদ দেখা দিয়েছে এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক শিল্পসাহিত্য সমালোচনার যে পথে আজকে সারাবিশ্ব আলোড়িত, সেই পথ পরিক্রমণ এবং সৃষ্টিশীল কাজের প্রাবল্যে নতুন করে পরিচিত হবার যে সময় আজ দুয়ারে, তাকে বুঝতে হবে এবং ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে পুরনো ধ্যান-ধারণা, দাসত্বের অভ্যেসগত জীবনচর্চা। শিল্পসাহিত্য চর্চার ঔপনিবেশিক মানদ- ছেড়ে ফিরতে হবে ঘরে।
৩০-এর দশকে বাংলা সাহিত্যের একটি বিপ্লব ঘটে যায়। ৫০ এবং ৬০-এর দশক হয়ে ক্রমবিকাশমান বাংলা সাহিত্য মুক্তিযুদ্ধের ঐশ্বর্য শরীরে মেখে এক নতুনতর প্রাতিস্বিকতায় আর্বিভূত হয়েছে। আধুনিক অস্তিত্ববাদী দর্শন এবং চেতনাপ্রবাহ টেকনিক (সৈয়দ ওয়ালীউলাহর উপন্যাস) আমাদের উপন্যাসে এসেছে। কবিতায় শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী এবং ছোটগল্প-উপন্যাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং হাসান আজিজুল হকসহ আরো অনেকেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গল্প-উপন্যাস-নাটক লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক এবং এক্ষেত্রে এই সব্যসাচী লেখককে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। মাহমুদুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন প্রমুখও মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাস লিখে সফলতা দেখিয়েছেন। স্বাধীনতা-উত্তর নাটকেও একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে এবং সেলিম আল দীন, সাঈদ আহমেদ প্রমুখ আন্তর্জাতিকভাবে নন্দিত, পুরস্কৃত হয়েছেন। আমাদের কবিতা-ছোটগল্প-উপন্যাস-নাটক আজ দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানেই দাঁড়িয়ে আছে স্বতন্ত্র সৌরভে। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য করার তাগিদ দেখা যাচ্ছে তরুণ লেখকদের মধ্যে। মরমি কবি লালন শাহ, হাসন রাজা এবং শাহ আব্দুল করিমের গান সারা পৃথিবীর মানুষকে মুগ্ধ করেছে। আরো অনেক বাউল সাধকের জন্ম হয়েছে এই মাটিতে যারা আমাদেও লোকসংস্কৃতির ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে। বাঙালি তার হাজার বছরেরও বেশি সময়ের দাসত্ব এবং বেঁচে থাকার লড়াই-এ, ৫২-এর ভাষার সংগ্রাম থেকে স্বাধিকার এবং ’৭১-এ স্বাধীনতা সংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্বের দরবারে এক আলাদা স্বাধীন-সার্বভৌমত্বের পরিচয় নিয়ে আজ সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। নানাভাবে নানা জাতির, ভাষার নিগড়ে, অবাঞ্ছিত আচরণে-অত্যাচারেও সে তার স্বাভাবিক স্বপ্নগুলো লালন করেছে সযতেœ। এই সব অনুষঙ্গে, এ জাতির হয়ে ওঠার দীর্ঘ কষ্টক্লিষ্ট পথে নানা ভাষার নানা সংস্কৃতির গন্ধ স্পর্শ তার নিজস্বতাকে সমৃদ্ধও করেছে এবং আজকের এই বাংলা ভাষায় নানা জাতির ভাষা ও শব্দের সংমিশ্রণ সত্ত্বেও তা আমাদের ঐতিহ্যকে স্পর্শ করেছে এবং বলতে গেলে বাংলা ভাষার এই সর্বগ্রাসী, সংগ্রামী প্রতিবাদী চরিত্র পৃথিবীতে বিরল। তাই, এই ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে এই ভাষায় রচিত শিল্প-সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে এক আলাদা প্রতীতী গড়ে তুলতে হবে মননশীলতার ঐশ্বর্যে, বস্তুনিষ্ঠ স্বভাবে ও শৈলীতে।
জনগণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের মধ্য দিয়েই কেবল এই ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও লালন ত্বরান্বিত হতে পারে। বাংলা ভাষা চিরকালই ছিল অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ভাষা এবং বলতে দ্বিধা নেই, ভারতবর্ষে তুর্কি আক্রমণ সংগঠিত না হলে বাংলা ভাষার মুক্তি ও বিকাশ এত সহজে হয়ত সম্ভবপর হতো না। এই অবহেলিত জনগণই রুখে দাঁড়িয়েছে একসাথে ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে এবং যেহেতু জনগণের সর্বাত্মক রাষ্ট্র ছাড়া ভাষার স্বাধীন বিকাশ অসম্ভব, সেহেতু আজকে সেই সর্বাত্মক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের জন্য এদেশের অবহেলিত জনগোষ্ঠীকেই এগিয়ে আসতে হবে প্রস্তুত মানসিকতা নিয়ে এক সাথে।
সংস্কৃতি মূলত বিকাশপ্রয়াসী একটি প্রবাহ, যা কোনো জাতি বা গোত্রের নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন-আবিষ্কার এবং গতিশীল চিন্তার মধ্যে বিকশিত হয়। এই বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গেলে সে জাতিকে বন্ধ্যা জাতি ছাড়া আর কী-ই-বা ভাবা যেতে পারে। মানুষের সৃষ্টিশীলতার বিকাশ কেবল সেরকম সমাজেই সম্ভব যেখানে শোষণ-বঞ্চনার স্থান নেই, নেই কোনো বৈষম্যের প্রচল। আবার এ-ও সত্যি যে প্রতিকূল পরিবেশেও উন্নত শিল্পসাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে। সংস্কৃতিও তার বিকাশের জন্য চায় এরকম অনুকূল পরিবেশ। হাসান আজিজুল হক এ সম্বন্ধে বলেন, ‘সন্দেহ নেই সংস্কৃতি শ্রেণি আর তার অবস্থা নিয়ে নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু মানুষের দুর্জয় প্রাণশক্তি ও সৃজনক্ষমতার রূপায়নের ক্ষেত্রও বটে সংস্কৃতি।... শ্রেণির দিক থেকে দেখার চেষ্টা করলে বলতেই হবে মানুষ সব রকম শ্রেণিশোষণ ও পীড়ন থেকে মুক্তি লাভ করলে একমাত্র তখুনি সম্ভব কোনো দেশের মানবগোষ্ঠীর সৃজনক্ষমতার পরিপূর্ণ মুক্তি। সেটা যদি ঘটে, সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ ও বৃদ্ধি তখন আর ঠেকিয়ে রাখার নয় (সংস্কৃতি নিয়ে)।’
সংস্কৃতির পরিপূর্ণ বিকাশ তখনই সম্ভব যখন তা নিম্নবিত্তের সংস্কৃতি বা লোকসংস্কৃতির ¯্রােতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে সমন্বিতভাবে এগিয়ে যাবে। মধ্যবিত্তের এই সংস্কৃতি-বিচ্ছিন্নতা আমাদের সামগ্রিক শিল্পচর্চায় এনেছে স্থবিরতা। এ প্রসঙ্গে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, ‘যাকে বাঙালি সংস্কৃতি বলে ঢাক পেটানো হয় তা যদি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কর্মপ্রবাহ ও জীবনযাপন থেকে প্রেরণা নিতে না পারে তো তাও অপসংস্কৃতির মতো উটকো ও ভিত্তিহীন হতে বাধ্য।... যার সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চা মানুষের জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারে না, তার রাজনীতির ফলপ্রসূ হবার সম্ভাবনা কম’ (সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু)। আমাদের সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চায় যে প্রাণহীনতা ও বিচ্ছিন্নতা, তার প্রভাব পড়েছে আমাদের রাজনীতিতেও। ফলে যা কিছু হচ্ছে রাজনীতির নামে তা একধরনের ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়; এ ধরনের রাজনীতি থেকে নিম্নবিত্ত মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের সম্ভবনা তো নেই-ই বরং তা তাদের আরো ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকার মৃত্যুগুহায়। তাই সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চায় প্রাণপ্রবাহ পেতে হলে নিম্নবর্গীয় মানুষেরও সাবলীল সম্পৃক্ততা দরকার। এক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা হলো, এদেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব নিতে হবে একটি সুস্থ অখ- সংস্কৃতিচর্চার প্লাটফর্ম তৈরির। কারণ, সংস্কৃতিতে গলদ থাকলে তা রাজনীতিতেও থাকবে। এবং সেই ধরনের রাজনীতি দেশ বা মানুষের কোনো কল্যাণে আসবে না। বরং তা জন্ম দিবে বিকলাঙ্গ, রুচিহীন, শেকড়-বিচ্ছিন্ন নেতা-নেত্রী, কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের রাজনীতিক নয়।
আমাদের অনেক জনপ্রিয় লোকসংগীত রয়েছে সেগুলো কে কবে রচনা করেছে তার কোনো ইতিহাস নেই, সেই গানগুলো আমরা কালপরম্পরায় শুনে আসছি। এইসব চিরায়ত সংগীত কিংবা পদগুলো শ্রেষ্ঠ কবিতার মূল্যে বিবেচিত। এগুলোর রচয়িতাদের পরিচয় কেউ জানে না। তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ, টেক্সটই আসল, এর পিছনের লোকটিতো মৃত। সুফিয়া কাঙালিনীর একটি গান আমার প্রায়শ মনে হয়- ঘুমাইয়া ছিলাম ভালই ছিলাম জেগে দেখি বেলা নাই / কোনবা পথে নিতাইগঞ্জ যাই। আমরা এই নাগরিক কবিদের কজন এরকম একটি কবিতার ছড় নির্মাণ করতে পেরেছি যা আমাদের ভাবুকতার অন্তর্তলে আলোড়ন তোলে? কবি ও কবিতা নিয়ে আমাদের প্রচলিত ভাবনাগুলোর রিশাফ্লিং দরকার। লেখাপড়া না জেনেও ভালো গান কিংবা কবিতা লেখা যায়। আমাদের লোককবিরা তা করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া না থাকলেও এদের অশিক্ষিত বলা যাবে না, কারণ, এদের রয়েছে অন্যরকম শিক্ষা, আলোকিত মননের জগৎ। ভালো কবিতা কিংবা ভালো গান লিখতে হলে জীবনকে পাঠ করতে হয়, পাঠ করতে হয় জীবনের সাথে জড়িত সব স্বপ্ন-কল্পনা-আকাক্সক্ষা কিংবা সেইসব মানুষ যাদের কাছাকাছি বাস করতে হয়, যাদের সাহচর্য আমাদের নিত্য অভিজ্ঞতার মধ্যে ঠেলে দেয়। লালন, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম কিংবা আরো অনেক লোককবির দিকে তাকালে এগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরা জীবনের বিবিধ পরিচর্চা থেকে গান কিংবা কবিতা লিখেছেন। আমাদের লোকসংস্কৃতির আলোকিত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা সত্যি সত্যি শুনতে পাই মহাজীবনের ডাক। (আগামী সংখ্যায় পড়–ন)
কামরুল ইসলাম
শিল্পী : রাজিব রায়
বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বাঙালি সংস্কৃতি বাঙালির জীবন-সংগ্রামেরও চলমান ইতিহাস। নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের সংস্কৃতির স্রোতধারায় যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে সে-কথা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক যে তা আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির মূলধারায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। হাজার বছরেরও বেশি সময়ের বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য সাবলীলভাবে উজ্জীবিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আবহকে আত্তীকরণের মধ্য দিয়েই। সাহিত্যের আদি বাহন কবিতা। কবিতার মধ্যে জীবনের মৌলিক সত্যগুলো সর্বাগ্রেই ঝলসে ওঠে এবং কবিতাই কোনো পরিবর্তনকে, কোনো রাষ্ট্রিক-সামাজিক-বৈশ্বিক মৌলিক আচরণকে শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের আগেই সমসাত্ত্বিক অথবা অসমসাত্ত্বিক যেকোনো ভাবেই ধারণ করার ক্ষমতা রাখে। কবিতাই যে শ্রেষ্ঠ শিল্পমাধ্যম, একথা আজ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলবার কোনো দরকার নেই। কোনো জাতিকে তার সমূহ আচরণে দেখতে হলে সর্বাগ্রে তার কবিতার দিকে তাকাতে হবে। বাঙালির জাতিসত্তার পরিচয় তার কবিতা; কবিতাই বাঙালির চিরকালের গৌরবময় ইতিহাস, তার সংগ্রামী চেতনার শৈল্পিক হাতিয়ার।
এক বিস্ময়কর গভীরের ডাক আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির মন ও মানবিকতার সুযোগ্য পরিবর্তনের, তার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের এক চিরায়ত প্রেরণা। সামনে বাঙালিরা আরও হাজারও বছর এগিয়ে যাবে, ঝড়-ঝঞ্ঝা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়-মহামারী, রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং শত বিপ্লবেও যা তার চিরকালীন উজ্জ্বলতা কখনো হারাবে না, তা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। নানাবিধ নির্মাণের সিঁড়ি এই মুক্তিযুদ্ধ তাই আগামী প্রজন্মের কাছে এক অপরিহার্য পাঠ। আমাদের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের আঙ্গিনায় এই যুদ্ধ বাঙালির অস্তিত্বেরই চিরায়ত সংগীত, জাতিসত্তার পরিচায়ক চির জাগ্রত গৌরবগাথা। এই যুদ্ধকে ঘিরে আমাদের গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটক বাঙালির সংগ্রামী চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমাদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ এবং তার আবহ এত সফলভাবে এসেছে যে, কবিতা ও মুক্তিযুদ্ধ কখনো কখনো একাকার হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সদা জাগ্রত রাখার মধ্যেই রয়েছে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির মুক্তি।
উপনিবেশ কেবল অর্থনৈতিকভাবেই কোনো জাতিকে পঙ্গু করে ফেলে না, রাষ্ট্রীয় কাঠামোকেও দুর্বল করে, তার ভাষা ও সংস্কৃতির ওপরও আঘাত হানে। কখনো কখনো কোনো জাতির ভাষা-সংস্কৃতিকে এমনভাবে পঙ্গু করে ফেলে যে, স্বাধীনতা লাভের পরও অনেককাল সেই পঙ্গুত্ব নিয়ে তাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আফ্রিকার উপনিবেশগুলোর দিকে তাকালে এসব বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কলোনিয়াল শাসকরা সোমালিয়াসহ অনেক দেশের নিজস্ব ভাষাকে দীর্ঘকাল বিকশিত হতে দেয়নি, বরং নানা কৌশলে তা ধ্বংসের পাঁয়তারা করেছে। উপমহাদেশে নজরুলের আবির্ভাব সেই সময়ে, যখন কলোনিয়াল শাসনের পারদ ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামছে। কলোনিয়াল আবহেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকশিত হয়েছে। মাইকেল, বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতাপশালী প্রতিভাধরদের হাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য একটি মর্যাদাপূর্ণ জায়গায় পৌঁছে যায়। এমনকি বিশ্ব-দরবারেও তার স্থান হয় রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির মধ্য দিযে। নজরুলের আবির্ভাবে বাংলা ভাষার শিরায় প্রবাহিত হয় আলাদা রকমের প্রাণদায়ী শক্তি। নানা প্রান্ত থেকে তার শব্দ-চয়নের পারঙ্গমতা তার মৌলিক সৃজন শক্তিরই বহির্প্রকাশ। একটি সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজের কাব্যভাষা তৈরির মধ্য দিযে বাংলা কবিতায় তার স্বতন্ত্র স্বাক্ষর রাখার বিষয়টি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা প্রয়োজন। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনার ভিত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাবেই যে দানা বেঁধে ওঠে, এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ ধীর লয়ে ক্রমাগত বাঙালির চিরায়ত সাংস্কৃতিক প্রত্যয়কে প্রভাবিত করেছেন, আর নজরুল তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে, বজ্রনির্ঘোষ তাড়নায় বাঙালির চেতনায় এনেছেন এক চিরন্তন অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক বোধ। এই প্রত্যয় ও বোধই ক্রমাগত আমাদের দাঁড়াতে শিখিয়েছে অন্যায়-অবিচার, শাসন-শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে।
বাঙালি সংস্কৃতির স্বাধীন চলার পথ এখনো বঙ্কিম, নানাবিধ শত্রুতায় বিশীর্ণ তার সজীব প্রত্যয়। ইংরেজরা আজকে নেই। সাম্রাজ্য বিস্তারের যুগ শেষ হলেও সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-প্রক্রিয়ার তো সমাপ্তি ঘটেনি। নয়া কৌশল, নয়া ইজম, দর্শন এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনার আওতায় আজ তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো নানাভাবেই নানা বঞ্চনার শিকার এবং এও সত্যি যে, তাদের কৌশলী দয়া-দাক্ষিণ্যের উৎপাতে আমরা স্বয়ম্ভরতার সমূহ সম্ভাবনাকে বিসর্জন দিয়ে ক্র্যাচসর্বস্ব পঙ্গু অর্থনীতির উপাসনায় লোটস-ইটার্সদের মতো আলস্যে দিনযাপন করছি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের সর্বৈব ক্লেদ-গানি রপ্তানি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। স্যাটেলাইটের বদৌলতে আকাশ পথে (আধুনিক প্রযুক্তি আমদানির সাথে সাথে) বিদেশি আগ্রাসী সংস্কৃতিরও পণ্য হিসেবে আমদানি আমাদের জাতিসত্তার প্রতিই এক প্রচ- হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে আমাদের এই ভয়াবহ রাজনৈতিক অরাজকতা, স্বৈরাচার, গণতন্ত্রের নামে অনাচার এবং মৌলবাদের অশুভ আচরণ- সবকিছুই সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনা মাফিক দেশীয় দালালদের দ্বারা সৃষ্ট, যা আমাদের অভ্যন্তরীণ জীবনযাত্রাকে ক্রমাগত নিশ্চল ও অকেজো করে দিচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবিলায়, নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সমূহ বিপদের গ-ি থেকে মুক্ত করতে সর্বাগ্রে দরকার স্বয়ম্ভর অর্থনীতি এবং দেশাত্ববোধ। তারও আগে দরকার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাধীন বিকাশ ত্বরাম্বিত করা এবং বিদেশের যা কিছু ভাল সুস্থ জীবনমুখীনতায় উন্মুখর তা গ্রহণ করা এবং পঙ্কিলতা, কদর্য-ঠুনকো, কুরুচিপূর্ণ, ধনতন্ত্রের মাদকতাপূর্ণ সংস্কৃতি নামক পণ্যসামগ্রী প্রত্যাখান করা। গ্রহণ-বর্জনের মধ্যেই কোনো জাতির সংস্কৃতি বেঁচে থাকে, গতি পায় আর তার অভাবেই তা শুকিয়ে যায়, বন্ধ্যা হয়ে যায়- একথা মনে রাখতে হবে। বিদেশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসন ঠেকানোর ব্যাপারটি যে খুব সহজ নয়, সেসব মনে রেখেই আমাদের এগোতে হবে। টেকনোলজির ক্রম-উন্নয়নের সাথে আমরা তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে জাতি হিশেবে পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য। চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং নতুন প্রজন্মকে গুণগত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে রাষ্ট্রের পজিটিভ পদক্ষেপ থাকা দরকার।
বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতি সব সময়ই দ্বন্দ্বে-সংগ্রামে বিকশিত হয়েছে; এই দ্বন্দ্ব বা বিরুদ্ধস্রোতে আমাদের আতঙ্কিত হবার কারণ নেই যদিও, তথাপিও ভাবতে হবে আজকের দ্বন্দ্বটা পুরনো দ্বন্দ্বের পুনরাবৃত্তি নয় বরং অনেক, অনেকখানিই নতুন কৌশলে আকীর্ণ, সর্বপ্লাবী এবং আলাদা বৈশিষ্ট্যের; যদিও অভিন্ন উদ্দেশ্যে লালিত এবং সংক্রমিত। এর-ই মধ্যে, এই সব চিরায়ত দ্বন্দ্ব এবং ভয়াবহ অরাজক ভূমি-বাতাসেই বাঙালি তার হাজার বছরেরও বেশি সময়ের এই সংগ্রামী ঐতিহ্যপ্রবাহকে সমুন্নত রেখেছে তার সাহিত্যে-শিল্পে, জীবনাচরণে, বোধিতে। বহির্বিশ্বের সাথে আমাদের শিল্পগত সাযুজ্যের সূত্রটি নিতান্তই স্থুল এবং অপরিণতহেতু শিল্পসাহিত্যের মতো সৃষ্টিশীল কাজ এখানে উৎস ও মেধা থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে দাঁড়াতে পারছে না এবং চিন্তনের ক্ষেত্রে এখানে ব্যাপক অনুধ্যান নেই, যতটা আছে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের। তবে একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, আমাদের কবিতা, গল্প, উপন্যাস নাটকের আস্থিক উঠোন পঙ্গু অর্থনীতির মতো একেবারে সংকীর্ণ নয়; সেখানে অন্তত দাঁড়ানো যায়, জোছনা রাতে মাদুর পেতে বসে একসঙ্গে গল্প করে অনেক রাত অবধি জোছনার অমৃত পানে কিছুটা পথ ভেসে যাওয়া যায়। পাশ্চাত্যের, আজকে, প্রাচ্যের দিকে মুখ ফেরানোর তাগিদ দেখা দিয়েছে এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক শিল্পসাহিত্য সমালোচনার যে পথে আজকে সারাবিশ্ব আলোড়িত, সেই পথ পরিক্রমণ এবং সৃষ্টিশীল কাজের প্রাবল্যে নতুন করে পরিচিত হবার যে সময় আজ দুয়ারে, তাকে বুঝতে হবে এবং ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে পুরনো ধ্যান-ধারণা, দাসত্বের অভ্যেসগত জীবনচর্চা। শিল্পসাহিত্য চর্চার ঔপনিবেশিক মানদ- ছেড়ে ফিরতে হবে ঘরে।
৩০-এর দশকে বাংলা সাহিত্যের একটি বিপ্লব ঘটে যায়। ৫০ এবং ৬০-এর দশক হয়ে ক্রমবিকাশমান বাংলা সাহিত্য মুক্তিযুদ্ধের ঐশ্বর্য শরীরে মেখে এক নতুনতর প্রাতিস্বিকতায় আর্বিভূত হয়েছে। আধুনিক অস্তিত্ববাদী দর্শন এবং চেতনাপ্রবাহ টেকনিক (সৈয়দ ওয়ালীউলাহর উপন্যাস) আমাদের উপন্যাসে এসেছে। কবিতায় শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী এবং ছোটগল্প-উপন্যাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং হাসান আজিজুল হকসহ আরো অনেকেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গল্প-উপন্যাস-নাটক লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক এবং এক্ষেত্রে এই সব্যসাচী লেখককে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। মাহমুদুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন প্রমুখও মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাস লিখে সফলতা দেখিয়েছেন। স্বাধীনতা-উত্তর নাটকেও একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে এবং সেলিম আল দীন, সাঈদ আহমেদ প্রমুখ আন্তর্জাতিকভাবে নন্দিত, পুরস্কৃত হয়েছেন। আমাদের কবিতা-ছোটগল্প-উপন্যাস-নাটক আজ দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানেই দাঁড়িয়ে আছে স্বতন্ত্র সৌরভে। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য করার তাগিদ দেখা যাচ্ছে তরুণ লেখকদের মধ্যে। মরমি কবি লালন শাহ, হাসন রাজা এবং শাহ আব্দুল করিমের গান সারা পৃথিবীর মানুষকে মুগ্ধ করেছে। আরো অনেক বাউল সাধকের জন্ম হয়েছে এই মাটিতে যারা আমাদেও লোকসংস্কৃতির ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে। বাঙালি তার হাজার বছরেরও বেশি সময়ের দাসত্ব এবং বেঁচে থাকার লড়াই-এ, ৫২-এর ভাষার সংগ্রাম থেকে স্বাধিকার এবং ’৭১-এ স্বাধীনতা সংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্বের দরবারে এক আলাদা স্বাধীন-সার্বভৌমত্বের পরিচয় নিয়ে আজ সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। নানাভাবে নানা জাতির, ভাষার নিগড়ে, অবাঞ্ছিত আচরণে-অত্যাচারেও সে তার স্বাভাবিক স্বপ্নগুলো লালন করেছে সযতেœ। এই সব অনুষঙ্গে, এ জাতির হয়ে ওঠার দীর্ঘ কষ্টক্লিষ্ট পথে নানা ভাষার নানা সংস্কৃতির গন্ধ স্পর্শ তার নিজস্বতাকে সমৃদ্ধও করেছে এবং আজকের এই বাংলা ভাষায় নানা জাতির ভাষা ও শব্দের সংমিশ্রণ সত্ত্বেও তা আমাদের ঐতিহ্যকে স্পর্শ করেছে এবং বলতে গেলে বাংলা ভাষার এই সর্বগ্রাসী, সংগ্রামী প্রতিবাদী চরিত্র পৃথিবীতে বিরল। তাই, এই ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে এই ভাষায় রচিত শিল্প-সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে এক আলাদা প্রতীতী গড়ে তুলতে হবে মননশীলতার ঐশ্বর্যে, বস্তুনিষ্ঠ স্বভাবে ও শৈলীতে।
জনগণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের মধ্য দিয়েই কেবল এই ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও লালন ত্বরান্বিত হতে পারে। বাংলা ভাষা চিরকালই ছিল অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ভাষা এবং বলতে দ্বিধা নেই, ভারতবর্ষে তুর্কি আক্রমণ সংগঠিত না হলে বাংলা ভাষার মুক্তি ও বিকাশ এত সহজে হয়ত সম্ভবপর হতো না। এই অবহেলিত জনগণই রুখে দাঁড়িয়েছে একসাথে ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে এবং যেহেতু জনগণের সর্বাত্মক রাষ্ট্র ছাড়া ভাষার স্বাধীন বিকাশ অসম্ভব, সেহেতু আজকে সেই সর্বাত্মক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের জন্য এদেশের অবহেলিত জনগোষ্ঠীকেই এগিয়ে আসতে হবে প্রস্তুত মানসিকতা নিয়ে এক সাথে।
সংস্কৃতি মূলত বিকাশপ্রয়াসী একটি প্রবাহ, যা কোনো জাতি বা গোত্রের নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন-আবিষ্কার এবং গতিশীল চিন্তার মধ্যে বিকশিত হয়। এই বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গেলে সে জাতিকে বন্ধ্যা জাতি ছাড়া আর কী-ই-বা ভাবা যেতে পারে। মানুষের সৃষ্টিশীলতার বিকাশ কেবল সেরকম সমাজেই সম্ভব যেখানে শোষণ-বঞ্চনার স্থান নেই, নেই কোনো বৈষম্যের প্রচল। আবার এ-ও সত্যি যে প্রতিকূল পরিবেশেও উন্নত শিল্পসাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে। সংস্কৃতিও তার বিকাশের জন্য চায় এরকম অনুকূল পরিবেশ। হাসান আজিজুল হক এ সম্বন্ধে বলেন, ‘সন্দেহ নেই সংস্কৃতি শ্রেণি আর তার অবস্থা নিয়ে নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু মানুষের দুর্জয় প্রাণশক্তি ও সৃজনক্ষমতার রূপায়নের ক্ষেত্রও বটে সংস্কৃতি।... শ্রেণির দিক থেকে দেখার চেষ্টা করলে বলতেই হবে মানুষ সব রকম শ্রেণিশোষণ ও পীড়ন থেকে মুক্তি লাভ করলে একমাত্র তখুনি সম্ভব কোনো দেশের মানবগোষ্ঠীর সৃজনক্ষমতার পরিপূর্ণ মুক্তি। সেটা যদি ঘটে, সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ ও বৃদ্ধি তখন আর ঠেকিয়ে রাখার নয় (সংস্কৃতি নিয়ে)।’
সংস্কৃতির পরিপূর্ণ বিকাশ তখনই সম্ভব যখন তা নিম্নবিত্তের সংস্কৃতি বা লোকসংস্কৃতির ¯্রােতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে সমন্বিতভাবে এগিয়ে যাবে। মধ্যবিত্তের এই সংস্কৃতি-বিচ্ছিন্নতা আমাদের সামগ্রিক শিল্পচর্চায় এনেছে স্থবিরতা। এ প্রসঙ্গে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, ‘যাকে বাঙালি সংস্কৃতি বলে ঢাক পেটানো হয় তা যদি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কর্মপ্রবাহ ও জীবনযাপন থেকে প্রেরণা নিতে না পারে তো তাও অপসংস্কৃতির মতো উটকো ও ভিত্তিহীন হতে বাধ্য।... যার সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চা মানুষের জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারে না, তার রাজনীতির ফলপ্রসূ হবার সম্ভাবনা কম’ (সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু)। আমাদের সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চায় যে প্রাণহীনতা ও বিচ্ছিন্নতা, তার প্রভাব পড়েছে আমাদের রাজনীতিতেও। ফলে যা কিছু হচ্ছে রাজনীতির নামে তা একধরনের ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়; এ ধরনের রাজনীতি থেকে নিম্নবিত্ত মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের সম্ভবনা তো নেই-ই বরং তা তাদের আরো ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকার মৃত্যুগুহায়। তাই সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চায় প্রাণপ্রবাহ পেতে হলে নিম্নবর্গীয় মানুষেরও সাবলীল সম্পৃক্ততা দরকার। এক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা হলো, এদেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব নিতে হবে একটি সুস্থ অখ- সংস্কৃতিচর্চার প্লাটফর্ম তৈরির। কারণ, সংস্কৃতিতে গলদ থাকলে তা রাজনীতিতেও থাকবে। এবং সেই ধরনের রাজনীতি দেশ বা মানুষের কোনো কল্যাণে আসবে না। বরং তা জন্ম দিবে বিকলাঙ্গ, রুচিহীন, শেকড়-বিচ্ছিন্ন নেতা-নেত্রী, কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের রাজনীতিক নয়।
আমাদের অনেক জনপ্রিয় লোকসংগীত রয়েছে সেগুলো কে কবে রচনা করেছে তার কোনো ইতিহাস নেই, সেই গানগুলো আমরা কালপরম্পরায় শুনে আসছি। এইসব চিরায়ত সংগীত কিংবা পদগুলো শ্রেষ্ঠ কবিতার মূল্যে বিবেচিত। এগুলোর রচয়িতাদের পরিচয় কেউ জানে না। তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ, টেক্সটই আসল, এর পিছনের লোকটিতো মৃত। সুফিয়া কাঙালিনীর একটি গান আমার প্রায়শ মনে হয়- ঘুমাইয়া ছিলাম ভালই ছিলাম জেগে দেখি বেলা নাই / কোনবা পথে নিতাইগঞ্জ যাই। আমরা এই নাগরিক কবিদের কজন এরকম একটি কবিতার ছড় নির্মাণ করতে পেরেছি যা আমাদের ভাবুকতার অন্তর্তলে আলোড়ন তোলে? কবি ও কবিতা নিয়ে আমাদের প্রচলিত ভাবনাগুলোর রিশাফ্লিং দরকার। লেখাপড়া না জেনেও ভালো গান কিংবা কবিতা লেখা যায়। আমাদের লোককবিরা তা করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া না থাকলেও এদের অশিক্ষিত বলা যাবে না, কারণ, এদের রয়েছে অন্যরকম শিক্ষা, আলোকিত মননের জগৎ। ভালো কবিতা কিংবা ভালো গান লিখতে হলে জীবনকে পাঠ করতে হয়, পাঠ করতে হয় জীবনের সাথে জড়িত সব স্বপ্ন-কল্পনা-আকাক্সক্ষা কিংবা সেইসব মানুষ যাদের কাছাকাছি বাস করতে হয়, যাদের সাহচর্য আমাদের নিত্য অভিজ্ঞতার মধ্যে ঠেলে দেয়। লালন, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম কিংবা আরো অনেক লোককবির দিকে তাকালে এগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরা জীবনের বিবিধ পরিচর্চা থেকে গান কিংবা কবিতা লিখেছেন। আমাদের লোকসংস্কৃতির আলোকিত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা সত্যি সত্যি শুনতে পাই মহাজীবনের ডাক। (আগামী সংখ্যায় পড়–ন)