শরীফ আতিক-উজ-জামান
Patricia Piccinini, The Long Awaited, 2008
‘মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী’- মানব-কেন্দ্রিক এই প্রথাগত ভাবনা ও বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে উত্তর-মানবতাবাদ শিরোনামের দার্শনিক ও শৈল্পিক প্রতর্কের উদ্ভব। এই মতবাদ মানুষ ছাড়াও অস্তিমান সব সত্তাকে সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। মানুষই যুক্তি, চেতনা ও কর্তৃত্বের একমাত্র অধিকারী এবং তারাই সব কিছুর চূড়ান্ত মানদ- নির্ধারণে সক্ষম- উত্তর-মানবতাবাদ এই ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই তত্ত্ব মানব, প্রাণি ও প্রযুক্তির আন্তঃসংযোগের উপর জোর দেয় এবং যুক্তি দেখায় যে মানুষ পরিবেশ বা অন্যান্য সত্তা থেকে পৃথক নয়। প্রকৃতিতে বিরাজমান অজ¯্র প্রাণিকুল ও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রতি মানুষের দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপনের পাশাপাশি উত্তর-মানবতাবাদ নীতিশাস্ত্র, জ্ঞানতত্ত্ব ও তত্ত্ববিদ্যা বোঝার জন্য একটি নতুন কাঠামো তুলে ধরে, যা প্রথাগত মানব-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলো প্রায়শই মানবতা-উত্তর বিষয়, মানবতার প্রকৃতি, প্রযুক্তি ও অন্যান্য প্রাণির সাথে তার সম্পর্কের ধরন অন্বেষণ করে। উত্তর-মানবতাবাদ গণমাধ্যম, শিল্প ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণেও ব্যবহৃত হয় এবং প্রথাগত মানবতা উপলব্ধির জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবোর্গ প্রযুক্তির প্রভাব বিশ্লেষণ করে। উত্তর-মানবতাবাদ মানুষের স্বার্থের বাইরে ভাবতে এবং অন্যান্য প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করতে উৎসাহ যোগায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অধিকারের সীমানা কী হবে তা নিয়েও এই প্রতর্কের জিজ্ঞাসা রয়েছে। সংক্ষেপে, উত্তর-মানবতাবাদ বিশ্ব-ব্রহ্মা-ের সাথে আমাদের বর্তমান সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা ও প্রথাগত মানব-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে চিন্তা করতে শেখায়।
কৌতূহল, মুক্ত মন, সুস্থ-রুচি, যুক্তি, সহানুভূতি, নৈতিকতা, গণতন্ত্র, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, মানব জাতির প্রতি আস্থা ইত্যাদি মানবতাবাদের যে বৈশিষ্ট্যগুলো একসময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল এখন সেখানে ভিন্ন ভাবনা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করছে। দার্শনিক জেফ্রি কোহেন মনে করেন যে, উত্তর-মানবতাবাদের উদ্দেশ্য হলো, প্রাণি, নদ-নদী, সমুদ্র, পাহাড়, বনজঙ্গল ইত্যাদি সত্তাসমূহকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা। তাঁর মতে, এই সত্তাগুলোর যথাযথ বিকাশ রুদ্ধ করা উচিত নয়। উত্তর-আধুনিক তাত্ত্বিক ইহাব হাসান তাঁর Prometheus as Performer: Toward a Posthumanist Culture শীর্ষক প্রবন্ধে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা নির্মাণ করেছিলেন। Transhuman ও Antihuman শব্দ দুটিও তিনি ব্যবহার করেছিলেন।
‘উত্তর-মানবতাবাদ’ শব্দটি মানবতাবাদের সমালোচনা বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়েছে, যা প্রকৃতি, সমাজ ও শিল্প-সাহিত্যের সাথে আমাদের সম্পর্কের পরিবর্তনের উপরও বিশেষ গুরুত্ব দেয়। একটি শিশু প্রাকৃতিক নিয়মে বড় হয়ে একজন প্রাপ্তবয়স্কের ক্ষমতা অর্জন করে; একদিন নতুন প্রযুক্তিও প্রাপ্তবয়স্কদের বিকাশ অব্যাহত রেখে মানব-পরবর্তী ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণিতে পরিণত হতে সাহায্য করবে। ট্রান্সহিউম্যানিজম আমাদের সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা বদলে ফেলার পক্ষে নয়, বরং আমরা কীভাবে প্রযুক্তি ও অন্যান্য উপায়ে বর্তমান অবস্থার উন্নতি ও মানুষের রোগবালাই এবং মৃত্যুর মতো অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অতিক্রম করতে পারব সেই কথা বলে।
উত্তর-মানবতাবাদ মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায় যে, আমরা কারা। এই তত্ত্ব উপলব্ধি করতে বলে যে, ‘আমরা’ সেই ‘আমরা’ নই, যে ‘আমরা’ একসময় নিজেদের এক ও অদ্বিতীয় বলে বিশ্বাস করতাম। রেনে দেকার্তের Discourse on the Method (১৬৩৭) অনুসারে, মানুষ জগতের কেন্দ্রে একটি চিরন্তন স্থান দখল করে আছে, যেখানে সে যন্ত্র, প্রাণিকুল ও অন্যান্য অ-মানব সত্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং এটাই বিধিবিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিপরীতে, মানবতাবাদ-পরবর্তী প্রতর্ক দাবি করে যে, মানুষ বিশ্বব্রহ্মা-ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণি নয়, সম্ভবত কখনো ছিলও না। মানুষের একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে ফেলার জন্য উত্তর-মানবতাবাদীরা সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
উত্তর-মানবতাবাদ বহুচর্চিত বিষয় নয়, তাই এটা সাম্প্রতিক কোনো প্রতর্ক বলে মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এর শুরু ১৮৮৮ সালে যখন এইচ.পি. ব্লাভাটস্কির The Secret Doctrine-এ বিষয়টি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লিখিত হয়েছিল। তবে তিনি বিস্তারিত কোনো তত্ত্ব তৈরি করেননি। পরবর্তী সময়ে আমেরিকার বিট জেনারেশনের লেখক জ্যাক কেরুয়াক বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিকরা প্রায়শই প্রান্তিক জীবন চিত্রিত করেছেন, রূপকভাবে মানবতাবাদের ভাবনাগুলোকে স্থানান্তরিত করেছেন যাকে ‘উত্তর-মানবীকরণ’ বলা হচ্ছে। ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ, অভিজ্ঞতা, নতুন জৈবিক ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার (বিবর্তনবাদ, জীবাশ্মবিদ্যা ও মনোবিজ্ঞান) এবং শিল্পায়নের উত্থান দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মেরি শেলি, শার্লোট ব্রন্টি এবং জোসেফ কনরাডের মতো বিশিষ্ট লেখকরা ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ ও প্রাণির সীমানা অস্পষ্ট করে দেন।
মেরি শেলির Frankenstein (১৮১৮), শার্লট ব্রন্টির Jane Eyre (১৮৪৭) এবং জোসেফ কনরাডের Heart of Darkness (১৮৯৮) এবং লেখকের নাম ছাড়া প্রকাশিত The Colour of Woman: A Tale (১৮০৮) মানবতাবাদের বৈশিষ্ট্য অতিক্রমী রচনা। Frankenstein কি একটি আধুনিক পৌরাণিক কাহিনী? দীর্ঘকাল মানবসভ্যতা জুড়ে মানুষের জ্ঞানের মহিমা, শ্রেয়োবোধ, সামাজিক সচেতনতা, হিতকর কর্মকা- সম্পর্কে প্রচুর গল্প প্রচার করা হয়েছে। হিব্রু বাইবেলের গল্প, প্রমিথিউস, প্যান্ডোরার বাক্সের গ্রিক গল্প ও গ্যোটের Faust-এর মধ্য দিয়ে মানুষের মনে ঈশ্বরের মতো সৃজনশীল ক্ষমতার আকাক্সক্ষা, জীবন ও মৃত্যুর উপর কর্তৃত্বের প্রলোভন এবং এর ফলে বিপর্যয়কর পরিণতির উপর আলোকপাত করা হয়েছে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কোনো প্রথাগত পৌরাণিক কাহিনী নয়। এটা দেবতা বা মহাকাব্যের নায়কদের গল্পও নয়, বরং এটা আধুনিক প্রেক্ষাপটে মানুষের সৃষ্টিশীল প্রচেষ্টার একটা ফসল, যেখানে রোমান্টিক ও গোথিক ধারার সংমিশ্রণে মানব-প্রযুক্তির প্রতিফলন ঘটেছে। মেরি শেলির এই প্রাণিটিকে তার ¯্রষ্টা কর্তৃক পরিত্যক্ত বা বিতাড়িত হিসেবে পাঠকের সহানুভূতি জাগানো এবং ‘মানব’-কে অমানবিক আচরণ কিংবা ‘প্রকৃতি’কে ‘কৃত্রিম’ থেকে আলাদা করার রীতিনীতিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যই এটা রচিত হয়েছে।
ফ্রেডরিক নিটশের On Truth and Lies in an Non-moral Sense (১৮৭৩) থেকেও উত্তর-মানবতাবাদের প্রাথমিক ধারণা গৃহীত হয়ে থাকতে পারে। তাঁর মতে, মানুষ চতুর ও জটিল এক প্রাণি। আর প্রথাগত সত্যের ধারণাটি সঠিক নয়, কারণ সত্য এক সামাজিক নির্মাণ এবং মিথ্যা ব্যাপকভাবে গৃহীত ও সমাদৃত। সত্য প্রকৃতপক্ষে এক বিভ্রম। খ্রিস্টীয় মূল্যবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত মানবতাবাদের প্রতি নিটশের অবজ্ঞা এবং ঈশ্বরে অনাস্থা ‘অতিমানব’-এর ধারণার নিশ্চয়তা দেয়।
সাহিত্যে প্রতিফলিত উত্তর-মানবতাবাদের মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’কে বিবেচনা করা হয়। কৃত্রিম জীবন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং মানব ও অ-মানব সত্তার মধ্যে অস্পষ্ট সীমানার মতো বিষয়গুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা রয়েছে এই উপন্যাসে। এখানে কে বেশি মানবিক, কে বেশি অমানবিক- ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের স্রষ্টা, নাকি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সে প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে।
আফ্রিকার প্রসঙ্গ এলে ইউরোপীয়রা এর অধিবাসীদের মানবিক বৈশিষ্ট্যকে সন্দেহের চোখে দেখে। আফ্রিকা তাদের কাছে যেন একটি আধিভৌতিক ক্ষেত্র যেখানে তাদের মতে, স্বীকৃত মানবিক দিকগুলো অনুপস্থিত। সেখানে বিচরণকারী ইউরোপীয়রা প্রতি পদে পদে বিপদের গন্ধ পায়। ইউরোপের চোখ দিয়ে আফ্রিকাকে দেখার এই অযৌক্তিক এবং বিকৃত মানসিকতা অন্যরাও ঠিক দেখতে পান বলে মনে হয় না। জোসেফ কনরাডের উপন্যাস Heart of Darkness আফ্রিকার ওপর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার প্রভাব, সভ্যতার অন্তরালে মানুষের বর্বর প্রকৃতি, মানব হৃদয়ের অন্ধকার দিক, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ধ্বংসাত্মক প্রভাব, ভালো-মন্দের পার্থক্য ও নৈতিকতার গুরুত্ব কথক মার্লোর অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরা হয়েছে। সে কঙ্গোর ‘কালো’ ও ‘বর্বর’ আদিবাসীদের মাঝে যে মানবতার খোঁজ পেয়েছিল, তার ঠিক উল্টোটাই দেখেছিল তথাকথিত সভ্যতার আলোকবর্তিকা বহনকারী ইউরোপীয়দের মাঝে। তার এই উপলব্ধিতে জাতিগত বিভাজন অতিক্রম করার কোনো আভাস ছিল কি? উপন্যাসটিতে আধুনিকতাপূর্ব অমানবিকীকরণের যে চিত্র পাওয়া যায় তা কুৎসিত শ্বেতাঙ্গসত্তার উন্মোচন ঘটায়। এই উপন্যাস মানুষের প্রকৃতি, জ্ঞান ও সা¤্রাজ্যবাদী কঠোরতা সম্পর্কে যে প্রশ্ন তোলে তা মানবতাবাদী ধারণার বাইরে। ঔপনিবেশিক বর্বরতা, শোষণ এবং প্রকৃতির ওপর মানুষের নিপিড়নমূলক আচরণ ও আধিপত্য মানবতাবাদী ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
উত্তর-মানবতাবাদী শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করার অর্থ মানবতাবাদকেই সংজ্ঞায়িত করা, যার কোনো একক ও সুসংহত অর্থ দাঁড় করানো মুশকিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সমালোচনামূলক তত্ত্বে উত্তর-মানবতাবাদ মানুষের অস্তিত্বের সংজ্ঞা পুনর্লিখন করতে চায় এবং মানবতা ও মানুষের অবস্থান সম্পর্কিত প্রথাগত ধারণাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে। উত্তর-মানবতাবাদী প্রতর্কে তথ্যের ধরন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ইতিহাসে তা হয়তো অনিবার্য বিবেচনা না করে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। তারা বিশ্বাস করে যে, চৈতন্য একটি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া এবং মানবদেহ একটি কৃত্রিম অঙ্গ যা প্রয়োজনে মেরামত করা বা বদলে ফেলা যায়।
উত্তর-মানবতাবাদী শিল্পকলার শিকড় মানবতাবাদের মাঝেই নিহিত ছিল যার উৎপত্তি ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময় যখন খ্রিস্টধর্ম ছিল শিল্পসৃষ্টির মূল অনুপ্রেরণা। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে, মানবতাবাদ শিল্পসৃষ্টির নিয়মগুলো কেমন হওয়া উচিত শুধু তার সীমানা নির্দেশ করে গেছে। উত্তর-মানবতাবাদ প্রযুক্তির সাথে জন্মগ্রহণ করেছিল এবং পরবর্তীতে মানবতাবাদের একটি বিকশিত ও উন্নত সংস্করণ হিসেবে মানুষের নতুন সংজ্ঞা নির্মাণ করতে চেয়েছে যেমন, রোবট ও মহাশূন্যের রহস্য আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষ একটি প্রজাতি হিসেবে নিজের গুরুত্ব ও খামতি দুই-ই বুঝতে পেরেছে। ফলে সে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের উপর আরও বেশি মনোযোগ দিয়েছে- যা তার অতীতকে আরো স্পষ্ট এবং ভবিষ্যতকে আরও সহজ করে তোলার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই প্রবণতাগুলো শিল্প-সাহিত্যের সবক্ষেত্রেই প্রতিফলিত।
উত্তর-মানবতাবাদী শিল্প অভিমুখে প্রথম পা ফেলেছিল ফিউচারিজম। চিত্রকলা সবসময়ই যেকোনো সাংস্কৃতিক বা সামাজিক আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকে। কখনো অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেয়, আবার কখনো অনুসরণ করে। রেনেসাঁ যুগের চিত্রকলায় মানবতাবাদের সব বৈশিষ্ট্যই দৃশ্যমান ছিল- যা একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার রেখে গেছে।
উত্তর-মানবতাবাদ সব ধরনের মানবিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করে। তার বদলে প্রবহমানতার ভিতর দিয়ে বিভিন্ন সত্তার মাঝে স্বতন্ত্র ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। বিগত শতাব্দীর সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে আজকের শিল্পকলায় সমজাতীয় বৈশিষ্ট্যের অভাব রয়েছে, তার পরিবর্তে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে। এই আদর্শিক এবং নান্দনিক বিভিন্নতা অসংখ্য শৈল্পিক ধারার জন্ম দিয়েছে। উম্বার্তো বোসিওনির ‘Unique forms in Continuity with Space’ (১৯১৩) ভাস্কর্যটিতে মানুষের গড়নকে যন্ত্রের গড়নের সাথে মিশিয়ে দৃশ্যমান শারীরিক কাঠামোর বাইরে যে আকৃতি দেওয়া হয়েছে তা মানবোত্তর বৈশিষ্ট্যের চমৎকার দৃষ্টান্ত। আরেকটি উদাহরণ হতে পারে অ্যালান সনফিস্টের Time Landscape।
রেনেসাঁর শিল্পকলা মানবরূপের আদর্শিক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে মানবতাবাদী চিন্তাভাবনা তুলে ধরেছে। মাইকেল্যাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’ বা ‘পিয়েটা’র মতো ভাস্কর্যগুলোতে মানুষের নিখুঁত শারীরিক সৌন্দর্যের উপস্থাপনা লক্ষ্যণীয়। উত্তর-মানবতাবাদ, যা মূলত উত্তর-আধুনিকতাবাদ ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল, মানবতাবাদের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে গত ৫০০ বছর ধরে মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কিত যে সরল গল্পগুলো বর্ণিত হয়ে আসছে তার সত্যতার শিকড় ধরে টান দিয়েছে।
অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন যে, ক্রমপরিবর্তনশীল প্রযুক্তি মানুষের প্রচলিত সংজ্ঞাই বদলে দেবে এবং ইতিমধ্যে তার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মানুষ কর্তৃক আবিষ্কৃত প্রযুক্তি তার মানবীয় সীমা বদলে দিচ্ছে। আমাদের কাছে রোবট রয়েছে যার মাধ্যমে গ্রহ-উপগ্রহের অভিজ্ঞতাও পেয়ে থাকি। রোবটের সাহায্যে শৈলচিকিৎসাও দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি আধুনিক বিজ্ঞান কৃত্রিম রেটিনা, ককলিয়া, কৃত্রিম কণ্ঠস্বর, পেসমেকার, স্বয়ংক্রিয় ডিফিব্রিলেটর এবং ইনসুলিন পাম্পও তৈরিতে সক্ষম হয়েছে- যা আমাদের মৃত্যুকে এড়াতে সাহায্য করে। এই প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে, মানুষ তার বিবর্তনকে তরান্বিত ও নিয়ন্ত্রণ করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এমনকি নিজেদেরকে একটি নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরের সক্ষমতাও অর্জন করেছে- যা উত্তর-মানবতাবাদী বৈশিষ্ট্য।
উত্তর-মানবতাবাদ হলো মানবতাবাদের বিনির্মাণ। একটি সামাজিক প্রতর্ক হিসেবে উত্তর-মানবতাবাদ বিশ্বায়ন, প্রযুক্তি, প্রাগ্রসর পুঁজিবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিচার্য বিষয়ের মাঝে মানুষের অবস্থান কী হবে তা নির্ণয়ের চেষ্টা করছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ও বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্যগুলো কতখানি স্পষ্ট থাকবে সে ব্যাপারেও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সতত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন কর্মকা- ও অস্তিত্বের সাথে এতটাই দ্রুত সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে যে, সবকিছু সম্পর্কে আমরা পুরোপুরি সচেতনও নই। এটা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। স্মার্ট ফোন, ভার্চুয়াল গেম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্ক ক্রমেই স্বাভাবিক থেকে স্বাভাবিকতর হয়ে উঠছে। এই ডিজিটাল যন্ত্রগুলো আমাদের সমাজের কাঠামো বদলে দিচ্ছে। আমরা চাইলেও এর থেকে বের হতে পারব না। আর অনেকেই এর ইতিবাচক দিক অপেক্ষা নেতিবাচক দিক বেশি দেখতে পাচ্ছেন। তাদের মতে, উত্তর-মানবতাবাদের প্রাধান্য মানুষের জন্য বৈশ্বিক বিয়োগান্ত পরিণতি ডেকে আনবে যেখানে মানুষ ছাড়াই মানুষের ভবিষ্যৎ নির্মিত হবে।
শরীফ আতিক-উজ-জামান
Patricia Piccinini, The Long Awaited, 2008
বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
‘মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী’- মানব-কেন্দ্রিক এই প্রথাগত ভাবনা ও বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে উত্তর-মানবতাবাদ শিরোনামের দার্শনিক ও শৈল্পিক প্রতর্কের উদ্ভব। এই মতবাদ মানুষ ছাড়াও অস্তিমান সব সত্তাকে সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। মানুষই যুক্তি, চেতনা ও কর্তৃত্বের একমাত্র অধিকারী এবং তারাই সব কিছুর চূড়ান্ত মানদ- নির্ধারণে সক্ষম- উত্তর-মানবতাবাদ এই ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই তত্ত্ব মানব, প্রাণি ও প্রযুক্তির আন্তঃসংযোগের উপর জোর দেয় এবং যুক্তি দেখায় যে মানুষ পরিবেশ বা অন্যান্য সত্তা থেকে পৃথক নয়। প্রকৃতিতে বিরাজমান অজ¯্র প্রাণিকুল ও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রতি মানুষের দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপনের পাশাপাশি উত্তর-মানবতাবাদ নীতিশাস্ত্র, জ্ঞানতত্ত্ব ও তত্ত্ববিদ্যা বোঝার জন্য একটি নতুন কাঠামো তুলে ধরে, যা প্রথাগত মানব-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলো প্রায়শই মানবতা-উত্তর বিষয়, মানবতার প্রকৃতি, প্রযুক্তি ও অন্যান্য প্রাণির সাথে তার সম্পর্কের ধরন অন্বেষণ করে। উত্তর-মানবতাবাদ গণমাধ্যম, শিল্প ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণেও ব্যবহৃত হয় এবং প্রথাগত মানবতা উপলব্ধির জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবোর্গ প্রযুক্তির প্রভাব বিশ্লেষণ করে। উত্তর-মানবতাবাদ মানুষের স্বার্থের বাইরে ভাবতে এবং অন্যান্য প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করতে উৎসাহ যোগায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অধিকারের সীমানা কী হবে তা নিয়েও এই প্রতর্কের জিজ্ঞাসা রয়েছে। সংক্ষেপে, উত্তর-মানবতাবাদ বিশ্ব-ব্রহ্মা-ের সাথে আমাদের বর্তমান সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা ও প্রথাগত মানব-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে চিন্তা করতে শেখায়।
কৌতূহল, মুক্ত মন, সুস্থ-রুচি, যুক্তি, সহানুভূতি, নৈতিকতা, গণতন্ত্র, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, মানব জাতির প্রতি আস্থা ইত্যাদি মানবতাবাদের যে বৈশিষ্ট্যগুলো একসময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল এখন সেখানে ভিন্ন ভাবনা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করছে। দার্শনিক জেফ্রি কোহেন মনে করেন যে, উত্তর-মানবতাবাদের উদ্দেশ্য হলো, প্রাণি, নদ-নদী, সমুদ্র, পাহাড়, বনজঙ্গল ইত্যাদি সত্তাসমূহকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা। তাঁর মতে, এই সত্তাগুলোর যথাযথ বিকাশ রুদ্ধ করা উচিত নয়। উত্তর-আধুনিক তাত্ত্বিক ইহাব হাসান তাঁর Prometheus as Performer: Toward a Posthumanist Culture শীর্ষক প্রবন্ধে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা নির্মাণ করেছিলেন। Transhuman ও Antihuman শব্দ দুটিও তিনি ব্যবহার করেছিলেন।
‘উত্তর-মানবতাবাদ’ শব্দটি মানবতাবাদের সমালোচনা বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়েছে, যা প্রকৃতি, সমাজ ও শিল্প-সাহিত্যের সাথে আমাদের সম্পর্কের পরিবর্তনের উপরও বিশেষ গুরুত্ব দেয়। একটি শিশু প্রাকৃতিক নিয়মে বড় হয়ে একজন প্রাপ্তবয়স্কের ক্ষমতা অর্জন করে; একদিন নতুন প্রযুক্তিও প্রাপ্তবয়স্কদের বিকাশ অব্যাহত রেখে মানব-পরবর্তী ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণিতে পরিণত হতে সাহায্য করবে। ট্রান্সহিউম্যানিজম আমাদের সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা বদলে ফেলার পক্ষে নয়, বরং আমরা কীভাবে প্রযুক্তি ও অন্যান্য উপায়ে বর্তমান অবস্থার উন্নতি ও মানুষের রোগবালাই এবং মৃত্যুর মতো অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অতিক্রম করতে পারব সেই কথা বলে।
উত্তর-মানবতাবাদ মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায় যে, আমরা কারা। এই তত্ত্ব উপলব্ধি করতে বলে যে, ‘আমরা’ সেই ‘আমরা’ নই, যে ‘আমরা’ একসময় নিজেদের এক ও অদ্বিতীয় বলে বিশ্বাস করতাম। রেনে দেকার্তের Discourse on the Method (১৬৩৭) অনুসারে, মানুষ জগতের কেন্দ্রে একটি চিরন্তন স্থান দখল করে আছে, যেখানে সে যন্ত্র, প্রাণিকুল ও অন্যান্য অ-মানব সত্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং এটাই বিধিবিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিপরীতে, মানবতাবাদ-পরবর্তী প্রতর্ক দাবি করে যে, মানুষ বিশ্বব্রহ্মা-ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণি নয়, সম্ভবত কখনো ছিলও না। মানুষের একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে ফেলার জন্য উত্তর-মানবতাবাদীরা সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
উত্তর-মানবতাবাদ বহুচর্চিত বিষয় নয়, তাই এটা সাম্প্রতিক কোনো প্রতর্ক বলে মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এর শুরু ১৮৮৮ সালে যখন এইচ.পি. ব্লাভাটস্কির The Secret Doctrine-এ বিষয়টি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লিখিত হয়েছিল। তবে তিনি বিস্তারিত কোনো তত্ত্ব তৈরি করেননি। পরবর্তী সময়ে আমেরিকার বিট জেনারেশনের লেখক জ্যাক কেরুয়াক বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিকরা প্রায়শই প্রান্তিক জীবন চিত্রিত করেছেন, রূপকভাবে মানবতাবাদের ভাবনাগুলোকে স্থানান্তরিত করেছেন যাকে ‘উত্তর-মানবীকরণ’ বলা হচ্ছে। ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ, অভিজ্ঞতা, নতুন জৈবিক ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার (বিবর্তনবাদ, জীবাশ্মবিদ্যা ও মনোবিজ্ঞান) এবং শিল্পায়নের উত্থান দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মেরি শেলি, শার্লোট ব্রন্টি এবং জোসেফ কনরাডের মতো বিশিষ্ট লেখকরা ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ ও প্রাণির সীমানা অস্পষ্ট করে দেন।
মেরি শেলির Frankenstein (১৮১৮), শার্লট ব্রন্টির Jane Eyre (১৮৪৭) এবং জোসেফ কনরাডের Heart of Darkness (১৮৯৮) এবং লেখকের নাম ছাড়া প্রকাশিত The Colour of Woman: A Tale (১৮০৮) মানবতাবাদের বৈশিষ্ট্য অতিক্রমী রচনা। Frankenstein কি একটি আধুনিক পৌরাণিক কাহিনী? দীর্ঘকাল মানবসভ্যতা জুড়ে মানুষের জ্ঞানের মহিমা, শ্রেয়োবোধ, সামাজিক সচেতনতা, হিতকর কর্মকা- সম্পর্কে প্রচুর গল্প প্রচার করা হয়েছে। হিব্রু বাইবেলের গল্প, প্রমিথিউস, প্যান্ডোরার বাক্সের গ্রিক গল্প ও গ্যোটের Faust-এর মধ্য দিয়ে মানুষের মনে ঈশ্বরের মতো সৃজনশীল ক্ষমতার আকাক্সক্ষা, জীবন ও মৃত্যুর উপর কর্তৃত্বের প্রলোভন এবং এর ফলে বিপর্যয়কর পরিণতির উপর আলোকপাত করা হয়েছে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কোনো প্রথাগত পৌরাণিক কাহিনী নয়। এটা দেবতা বা মহাকাব্যের নায়কদের গল্পও নয়, বরং এটা আধুনিক প্রেক্ষাপটে মানুষের সৃষ্টিশীল প্রচেষ্টার একটা ফসল, যেখানে রোমান্টিক ও গোথিক ধারার সংমিশ্রণে মানব-প্রযুক্তির প্রতিফলন ঘটেছে। মেরি শেলির এই প্রাণিটিকে তার ¯্রষ্টা কর্তৃক পরিত্যক্ত বা বিতাড়িত হিসেবে পাঠকের সহানুভূতি জাগানো এবং ‘মানব’-কে অমানবিক আচরণ কিংবা ‘প্রকৃতি’কে ‘কৃত্রিম’ থেকে আলাদা করার রীতিনীতিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যই এটা রচিত হয়েছে।
ফ্রেডরিক নিটশের On Truth and Lies in an Non-moral Sense (১৮৭৩) থেকেও উত্তর-মানবতাবাদের প্রাথমিক ধারণা গৃহীত হয়ে থাকতে পারে। তাঁর মতে, মানুষ চতুর ও জটিল এক প্রাণি। আর প্রথাগত সত্যের ধারণাটি সঠিক নয়, কারণ সত্য এক সামাজিক নির্মাণ এবং মিথ্যা ব্যাপকভাবে গৃহীত ও সমাদৃত। সত্য প্রকৃতপক্ষে এক বিভ্রম। খ্রিস্টীয় মূল্যবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত মানবতাবাদের প্রতি নিটশের অবজ্ঞা এবং ঈশ্বরে অনাস্থা ‘অতিমানব’-এর ধারণার নিশ্চয়তা দেয়।
সাহিত্যে প্রতিফলিত উত্তর-মানবতাবাদের মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’কে বিবেচনা করা হয়। কৃত্রিম জীবন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং মানব ও অ-মানব সত্তার মধ্যে অস্পষ্ট সীমানার মতো বিষয়গুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা রয়েছে এই উপন্যাসে। এখানে কে বেশি মানবিক, কে বেশি অমানবিক- ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের স্রষ্টা, নাকি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সে প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে।
আফ্রিকার প্রসঙ্গ এলে ইউরোপীয়রা এর অধিবাসীদের মানবিক বৈশিষ্ট্যকে সন্দেহের চোখে দেখে। আফ্রিকা তাদের কাছে যেন একটি আধিভৌতিক ক্ষেত্র যেখানে তাদের মতে, স্বীকৃত মানবিক দিকগুলো অনুপস্থিত। সেখানে বিচরণকারী ইউরোপীয়রা প্রতি পদে পদে বিপদের গন্ধ পায়। ইউরোপের চোখ দিয়ে আফ্রিকাকে দেখার এই অযৌক্তিক এবং বিকৃত মানসিকতা অন্যরাও ঠিক দেখতে পান বলে মনে হয় না। জোসেফ কনরাডের উপন্যাস Heart of Darkness আফ্রিকার ওপর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার প্রভাব, সভ্যতার অন্তরালে মানুষের বর্বর প্রকৃতি, মানব হৃদয়ের অন্ধকার দিক, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ধ্বংসাত্মক প্রভাব, ভালো-মন্দের পার্থক্য ও নৈতিকতার গুরুত্ব কথক মার্লোর অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরা হয়েছে। সে কঙ্গোর ‘কালো’ ও ‘বর্বর’ আদিবাসীদের মাঝে যে মানবতার খোঁজ পেয়েছিল, তার ঠিক উল্টোটাই দেখেছিল তথাকথিত সভ্যতার আলোকবর্তিকা বহনকারী ইউরোপীয়দের মাঝে। তার এই উপলব্ধিতে জাতিগত বিভাজন অতিক্রম করার কোনো আভাস ছিল কি? উপন্যাসটিতে আধুনিকতাপূর্ব অমানবিকীকরণের যে চিত্র পাওয়া যায় তা কুৎসিত শ্বেতাঙ্গসত্তার উন্মোচন ঘটায়। এই উপন্যাস মানুষের প্রকৃতি, জ্ঞান ও সা¤্রাজ্যবাদী কঠোরতা সম্পর্কে যে প্রশ্ন তোলে তা মানবতাবাদী ধারণার বাইরে। ঔপনিবেশিক বর্বরতা, শোষণ এবং প্রকৃতির ওপর মানুষের নিপিড়নমূলক আচরণ ও আধিপত্য মানবতাবাদী ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
উত্তর-মানবতাবাদী শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করার অর্থ মানবতাবাদকেই সংজ্ঞায়িত করা, যার কোনো একক ও সুসংহত অর্থ দাঁড় করানো মুশকিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সমালোচনামূলক তত্ত্বে উত্তর-মানবতাবাদ মানুষের অস্তিত্বের সংজ্ঞা পুনর্লিখন করতে চায় এবং মানবতা ও মানুষের অবস্থান সম্পর্কিত প্রথাগত ধারণাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে। উত্তর-মানবতাবাদী প্রতর্কে তথ্যের ধরন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ইতিহাসে তা হয়তো অনিবার্য বিবেচনা না করে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। তারা বিশ্বাস করে যে, চৈতন্য একটি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া এবং মানবদেহ একটি কৃত্রিম অঙ্গ যা প্রয়োজনে মেরামত করা বা বদলে ফেলা যায়।
উত্তর-মানবতাবাদী শিল্পকলার শিকড় মানবতাবাদের মাঝেই নিহিত ছিল যার উৎপত্তি ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময় যখন খ্রিস্টধর্ম ছিল শিল্পসৃষ্টির মূল অনুপ্রেরণা। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে, মানবতাবাদ শিল্পসৃষ্টির নিয়মগুলো কেমন হওয়া উচিত শুধু তার সীমানা নির্দেশ করে গেছে। উত্তর-মানবতাবাদ প্রযুক্তির সাথে জন্মগ্রহণ করেছিল এবং পরবর্তীতে মানবতাবাদের একটি বিকশিত ও উন্নত সংস্করণ হিসেবে মানুষের নতুন সংজ্ঞা নির্মাণ করতে চেয়েছে যেমন, রোবট ও মহাশূন্যের রহস্য আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষ একটি প্রজাতি হিসেবে নিজের গুরুত্ব ও খামতি দুই-ই বুঝতে পেরেছে। ফলে সে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের উপর আরও বেশি মনোযোগ দিয়েছে- যা তার অতীতকে আরো স্পষ্ট এবং ভবিষ্যতকে আরও সহজ করে তোলার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই প্রবণতাগুলো শিল্প-সাহিত্যের সবক্ষেত্রেই প্রতিফলিত।
উত্তর-মানবতাবাদী শিল্প অভিমুখে প্রথম পা ফেলেছিল ফিউচারিজম। চিত্রকলা সবসময়ই যেকোনো সাংস্কৃতিক বা সামাজিক আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকে। কখনো অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেয়, আবার কখনো অনুসরণ করে। রেনেসাঁ যুগের চিত্রকলায় মানবতাবাদের সব বৈশিষ্ট্যই দৃশ্যমান ছিল- যা একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার রেখে গেছে।
উত্তর-মানবতাবাদ সব ধরনের মানবিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করে। তার বদলে প্রবহমানতার ভিতর দিয়ে বিভিন্ন সত্তার মাঝে স্বতন্ত্র ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। বিগত শতাব্দীর সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে আজকের শিল্পকলায় সমজাতীয় বৈশিষ্ট্যের অভাব রয়েছে, তার পরিবর্তে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে। এই আদর্শিক এবং নান্দনিক বিভিন্নতা অসংখ্য শৈল্পিক ধারার জন্ম দিয়েছে। উম্বার্তো বোসিওনির ‘Unique forms in Continuity with Space’ (১৯১৩) ভাস্কর্যটিতে মানুষের গড়নকে যন্ত্রের গড়নের সাথে মিশিয়ে দৃশ্যমান শারীরিক কাঠামোর বাইরে যে আকৃতি দেওয়া হয়েছে তা মানবোত্তর বৈশিষ্ট্যের চমৎকার দৃষ্টান্ত। আরেকটি উদাহরণ হতে পারে অ্যালান সনফিস্টের Time Landscape।
রেনেসাঁর শিল্পকলা মানবরূপের আদর্শিক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে মানবতাবাদী চিন্তাভাবনা তুলে ধরেছে। মাইকেল্যাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’ বা ‘পিয়েটা’র মতো ভাস্কর্যগুলোতে মানুষের নিখুঁত শারীরিক সৌন্দর্যের উপস্থাপনা লক্ষ্যণীয়। উত্তর-মানবতাবাদ, যা মূলত উত্তর-আধুনিকতাবাদ ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল, মানবতাবাদের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে গত ৫০০ বছর ধরে মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কিত যে সরল গল্পগুলো বর্ণিত হয়ে আসছে তার সত্যতার শিকড় ধরে টান দিয়েছে।
অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন যে, ক্রমপরিবর্তনশীল প্রযুক্তি মানুষের প্রচলিত সংজ্ঞাই বদলে দেবে এবং ইতিমধ্যে তার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মানুষ কর্তৃক আবিষ্কৃত প্রযুক্তি তার মানবীয় সীমা বদলে দিচ্ছে। আমাদের কাছে রোবট রয়েছে যার মাধ্যমে গ্রহ-উপগ্রহের অভিজ্ঞতাও পেয়ে থাকি। রোবটের সাহায্যে শৈলচিকিৎসাও দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি আধুনিক বিজ্ঞান কৃত্রিম রেটিনা, ককলিয়া, কৃত্রিম কণ্ঠস্বর, পেসমেকার, স্বয়ংক্রিয় ডিফিব্রিলেটর এবং ইনসুলিন পাম্পও তৈরিতে সক্ষম হয়েছে- যা আমাদের মৃত্যুকে এড়াতে সাহায্য করে। এই প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে, মানুষ তার বিবর্তনকে তরান্বিত ও নিয়ন্ত্রণ করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এমনকি নিজেদেরকে একটি নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরের সক্ষমতাও অর্জন করেছে- যা উত্তর-মানবতাবাদী বৈশিষ্ট্য।
উত্তর-মানবতাবাদ হলো মানবতাবাদের বিনির্মাণ। একটি সামাজিক প্রতর্ক হিসেবে উত্তর-মানবতাবাদ বিশ্বায়ন, প্রযুক্তি, প্রাগ্রসর পুঁজিবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিচার্য বিষয়ের মাঝে মানুষের অবস্থান কী হবে তা নির্ণয়ের চেষ্টা করছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ও বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্যগুলো কতখানি স্পষ্ট থাকবে সে ব্যাপারেও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সতত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন কর্মকা- ও অস্তিত্বের সাথে এতটাই দ্রুত সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে যে, সবকিছু সম্পর্কে আমরা পুরোপুরি সচেতনও নই। এটা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। স্মার্ট ফোন, ভার্চুয়াল গেম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্ক ক্রমেই স্বাভাবিক থেকে স্বাভাবিকতর হয়ে উঠছে। এই ডিজিটাল যন্ত্রগুলো আমাদের সমাজের কাঠামো বদলে দিচ্ছে। আমরা চাইলেও এর থেকে বের হতে পারব না। আর অনেকেই এর ইতিবাচক দিক অপেক্ষা নেতিবাচক দিক বেশি দেখতে পাচ্ছেন। তাদের মতে, উত্তর-মানবতাবাদের প্রাধান্য মানুষের জন্য বৈশ্বিক বিয়োগান্ত পরিণতি ডেকে আনবে যেখানে মানুষ ছাড়াই মানুষের ভবিষ্যৎ নির্মিত হবে।