alt

সাময়িকী

আইপি ও সঙ্গীত

মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন

মনজুরুর রহমান

: বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

শিল্পী : সুনীল কুমার

বাতাসের মধ্যে ডুবে থেকে আমরা যেমন টের পাই না, বাতাসের মধ্যে ডুবে আছি; তেমনি IP (Intellectual Property) বা মেধাসম্পদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের মধ্যে বসবাস করেও এর অস্তিত্ব অনুভব করি না! গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বর্তমান পৃথিবীর সম্ভ্রান্ত শ্রেণি এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা প্রতিটি মানুষই সকাল থেকে রাত অবধি কোনো না কোনোভাবে এক থেকে দেড়শ আইপি ব্যবহার করছেন! যেমন- একজন সভ্য মানুষ ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে হাতে তুলে নেন টুথ ব্রাশ ও পেস্ট। এই দুটো নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীই কারো না কারো আবিষ্কার এবং এদের গায়ে সেঁটে থাকে ট্রেডমার্ক। দাঁত পরিষ্কার করার পর নাশতার টেবিলে এসে মুখোমুখি হন রুটি, পরোটা, প্লেট-কাপ, চা-কফিসহ আনুষঙ্গিক নানাবিধ পণ্য বা সামগ্রীর। প্রতিটি বস্তুই কোনো না কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠাজাত, যার প্রত্যেকটিতে রয়েছে ট্রেডমার্ক, পেটেন্ট বা ডিজাইনের সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ, এর সবগুলোই শিল্পজাত মেধাসম্পদের অন্তর্গত।

নাশতার টেবিলে বসে আমরা অনেকে চোখ বুলাই সংবাদপত্রে, কর্ম উপলক্ষে যানবাহনে চড়ে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে ছুটে চলি, যেতে যেতে শুনি কথা ও সুর সম্বলিত গান, কেঊবা চোখ বুলাই বইয়ের পাতায়, যাত্রায় বিলম্ব হলে ঘন ঘন দৃষ্টি ফেরাই ঘড়ির দিকে, মোবাইলে বাক্যালাপ করি অহরহ, ছুটির দিনে সিনেমা, নাটক দেখতে যাই, টেলিভিশন দেখি। শহরবাসী তো বটেই, গ্রামের স্বল্প আয়ের মহিলাদের হাতেও অলংকারের মতো শোভা পায় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথা বলার যন্ত্র মোবাইল ফোন, যাতে যুক্ত আছে মেধাসম্পদের ন্যূনতম চারটি উপাদান। এই যে, এতো কিছু ঘটে যাচ্ছে মনের অজান্তে তার সবকিছুতেই এককথায় ব্যবহৃত হচ্ছে আইপি বা মেধাসম্পদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ।

বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সংস্থা (World Intellectual Property Organization) যা WIPO নামে মেধাবিশ্বে পরিচিত তাদের ভাষ্য মতে, ‘It involves the products of the human mind– the fruits of human creativity and invention. It is with us every day of our lives, from dawn to dusk, while we are at school, while we are hanging out with our friend, and even as we sleep.’১

WIPO তাদের অন্য একটি প্রকাশনায় মেধাসম্পদের সংজ্ঞা করেছে নিম্নরূপ:

Intellectual Property refers to creation of the mind: inventions, literary and artistic works and symbols, named and images used in commerce.’২

আমরা সকলেই জানি যে মেধাসম্পদ প্রধানত দুটি শাখায় বিভক্ত। এই ভাগ সম্পর্কে WIPO কী বলছে? আসুন জেনে নেই। WIPO বলছে- ‘There are two categories of Intellectual Property. The first, industrial property, includes inventions (patents), trademarks, copyright and related rights, includes a broad range of literary and artistic works, written, performed, and recorded.’৩

[দুই]

পৃথিবীব্যাপী জাতিসঙ্ঘভুক্ত দেশসমূহে আজ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস’ বা আইপি ডে। ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল থেকে WIPO-র উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়, যেদিন WIPO Convention বলবৎ হয়। সকল সৃষ্টিশীল মানুষের মেধাসম্পদ অধিকার সুরক্ষা ও সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে দিবসটি মর্যাদার সাথে পালিত হয়। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, মেধাসম্পদ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে বর্ণিত মানুষের জন্যস্বীকৃত অধিকারসমূহের মধ্যে অন্যতম অধিকার। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা ২৭-এ বলা আছে’৪:

‘ক. প্রত্যেকেরই গোষ্ঠীগত সাংস্কৃতিক জীবনে অবাধে অংশগ্রহণ করা ও শিল্পকলা চর্চা করার অধিকার রয়েছে। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও সুফলগুলোর অংশীদার হওয়ার অধিকার রয়েছে।

খ. বিজ্ঞান, সাহিত্য অথবা শিল্পকলা ভিত্তিক সৃজনশীল কাজের থেকে যে নৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থের উদ্ভব হতে পারে তা রক্ষা করার অধিকার রয়েছে প্রত্যেকের।’৫

বিগত বছরসমূহের মতো এবছরও WIPO বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের প্রতিবাদ্য নির্ধারণ করেছে, এবারের বিষয়- ‘IP and music: Feel the beat of IP.’

আমি বাংলায় শিরোনাম করেছি ‘আইপি ও সঙ্গীত: মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন’। WIPO তাদের IP protal-এ বলেছে ‘World intellectual property day 2025 highlights creativity and innovation backed by IP rights, keep a vibrant diverse, and thriving music scene that benefits everyone, everywhere.’

সঙ্গীত যেহেতু সংস্কৃতিধর্মী মেধাসম্পদের একটি অনিবার্য অংশ, সেজন্য প্রতিপাদ্যে যাওয়ার আগে আমি সাংস্কৃতিক সম্পদ সম্পর্কে জাপানি মেধাসম্পদ বিশেষজ্ঞ তমোতসু হোজুমির- এশিয়ান কপিরাইট হ্যান্ডবুক থেকে কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করছি। হোজুমি বলছেন- ‘মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আহারের দরকার। মানব শরীরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খাদ্য অত্যন্ত জরুরি। আহার আমাদের পুষ্টি জোগায় এবং বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু আমরা স্তন্যপায়ী প্রাণি আমাদের শুধু দেহের পুষ্টি সাধনই যথেষ্ট নয়, আমাদের মন ও হৃদয়ের পুষ্টিরও প্রয়োজন আছে।

যদি আপনি সাংস্কৃতিক কর্মকে আমাদের আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তির জন্য আহারের সঙ্গে তুলনা করেন তবে সহজেই সাংস্কৃতিক কর্মের সংজ্ঞা উপলব্ধি করতে পারবেন। এমন একটি জগতের কথা ভাবুন যেখানে আমাদের আত্মার সাংস্কৃতিক কর্মের অস্তিত্ব নেই! উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত অথবা চিত্রকর্মহীন একটি পৃথিবীর কথা ভাবুন। আমাদের হৃদয়কে সমৃদ্ধ করে যেসব সাংস্কৃতিক কর্ম তা মানব-ইতিহাসে আমাদের জন্য এক মূল্যবান ঐতিহ্য।’৬

[তিন]

আমাদের এবারকার আলোচনা সঙ্গীতকে অবলম্বন করেই বিস্তৃত হবে। আমরা মেধাসম্পদ হিসেবে সঙ্গীত ¯্রস্টার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবো। আসলে সঙ্গীত কী? প্রাচ্যের প্রাজ্ঞজনদের দৃষ্টিতে- ‘সঙ্গীত হচ্ছে নৃত্য, গীত ও বাদ্যের সমন্বয়’। অর্থাৎ সঙ্গীত মানবসৃষ্ট একটি যৌথ বা গুচ্ছ নান্দনিক সাংস্কৃতিক কর্ম। সঙ্গীতের প্রাণ, ছন্দ বা বিট, যা মূলত জীবনেরই ছন্দ।

মেধাসম্পদ বিশ্বে সঙ্গীত সৃষ্টিকে সঙ্গীতকর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। WIPO-র বিভিন্ন প্রকাশনায় MUSICAL WORKS-এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে- ‘from opera to pop songs to symphonies, are covered by copyright. These include both the written score of a work as well as its melody and lyrics, whether recorded on a compact disc, broadcast over the radio, or performed in a concert hall. Performers of a musical work, such as musicians and singers, are covered by related rights in their performances, as are producers of recordings and broadcasters.’৭

বাংলাদেশের কপিরাইট আইন, ২০২৩ অনুযায়ী ‘সঙ্গীতকর্ম অর্থ সুর সংবলিত কর্ম এবং কর্মের স্বরলিপি, কথা, গীতি, গান বা অনুরূপ বিষয় সৃজন, প্রকাশ বা সম্পাদন,’৮

একমাত্র বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া পৃথিবী খুঁজে সঙ্গীত পছন্দ করে না এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে না। মনের অজান্তেই স্থান-কালের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ নিজেকে নিবিষ্ট করে সুর ও ছন্দের মায়াজালে। শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত, জ্ঞানী-অজ্ঞানী সবার মনেই সঙ্গীতের মূর্ছনা ছন্দ ও দ্যোতনা তৈরি করে। একটি মহৎ সঙ্গীত কর্ম দেশের সীমা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্ব পরিসরে, হয়ে উঠতে পারে সার্বজনীন। আজও আমরা বিটোভেন, মোজার্ট শুনে মুগ্ধ হই। হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার কথাবিহীন বাঁশির সুর, জাকির খানের তবলার বোলের মধ্য দিয়ে যে সৌকর্য সৃষ্টি হয়েছে তা তুলনা রহিত। কিংবদন্তি আছে জগৎখ্যাত তানসেন সুরের মোহজাল সৃষ্টি করে বৃষ্টি ঝরাতে পারতেন! সঙ্গীতের ঔষধী গুণের কথাও আমরা অবগত আছি।

শৈশবে মায়ের সুরেলা কণ্ঠের ঘুম পাড়ানিয়া গান, তারুণ্যে যৌবনে উদ্দীপ্ত ও আর শেষ জীবনে স্মৃতি জাগানিয়া কথা ও সুর মানুষকে নস্টালজিক করে। সঙ্গীত ও সঙ্গীতস্রষ্টা বেঁচে থাকেন শ্রোতা দর্শকের মনের মনিকোঠায়। কথা, সুর ও বাদ্য সহযোগে সঙ্গীতের সৃষ্টি তা মেধাসম্পদের অন্তর্গত, কপিরাইট ও রিলেটেড রাইটস-এর বিষয়বস্তু। কথাবিহীন সুরও সঙ্গীতের অন্তর্ভুক্ত। কথা ও সুর সম্বলিত সঙ্গীত সৃষ্টিতে দু’ধরনের অধিকার জন্ম নেয়। একটি কপিরাইট ও অন্যটি রিলেটেড রাইটস। উদাহরণ উপস্থাপন করলে বিষয়টি স্পষ্টতর হবে। একটি গানের ক্ষেত্রে থাকেন-গীতিকার, সুরকার ও কন্ঠশিল্পী। গানের কথা রচয়িতা বা গীতিকার ও যিনি সুর সৃষ্টিকারী তাদের অধিকার কপিরাইট। তারা মূল স্রষ্টা হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু যে কণ্ঠশিল্পী গীত রচনা ও সুর সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখেননি, কেবল কণ্ঠে ধারণ করেছেন, তিনি পারফর্মার-রিলেটেড রাইটস বা আনুষঙ্গিক অধিকারের মালিক। তাদের অধিকারের মেয়াদও ভিন্ন ভিন্ন হতে বাধ্য। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন শাহ্, শাহ আব্দুল করিম প্রমুখের অধিকার কপিরাইট। অন্যদিকে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, ফাতেমা তুজ জোহরা, সুবির নন্দি, সৈয়দ আব্দুল হাদি প্রমুখ কণ্ঠশিল্পীর অধিকার রিলেটেড রাইটস।৭

[চার]

সঙ্গীতের উদ্ভব, বিকাশ ও সম্প্রসারণ মানব সভ্যতার বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে। ভারতীয় পুরাণে ‘ওঙ্কার’ ধ্বনির মধ্যেও পাওয়া যায় সঙ্গীতের রেশ। অরণ্যচারী মানুষ, কৃষিজীবী মানুষ, জীবনকে পরিপূর্ণ যাপন করতে গিয়ে শ্রম বিভাজনের দিকে যেমন দৃষ্টি দিয়েছে, ঠিক তেমনি কর্মহীন দিনযাপনের সময় মনোযোগী হয়েছে মনের আনন্দে আত্মাকে তৃপ্ত করার বাসনায়। সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে নিজেদের নিয়োজিত করতে। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস অবগাহন করলে দেখবো আদিবাসী মানুষ কাল পরিক্রমায় কীভাবে নিজেদের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে স্বাতন্ত্র্যের ছাপ রেখেছে। বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালে এই স্বাতন্ত্র্যের স্পষ্ট ছবি এখনো দেখতে পাবো। নেপালের রাজদরবারে প্রাপ্ত চর্যাপদ, মধ্যযুগের গীতিকবিতা, মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি সাহিত্য কর্মগুলোতে যে সঙ্গীতের অনিবার্য উপাদান বিদ্যমান, আজ তা গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গবেষকগণ লক্ষ্য করেছেন- চর্যাপদ ও অন্যান্য কাব্যধর্মী সাহিত্যের শিরোদেশে তাল, লয় ও রাগিণীর উল্লেখ রয়েছে।

আমরা যত উন্নত হচ্ছি, আধুনিক হচ্ছি, ততই সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে আমাদের বিকাশ অধিকতর বিকশিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইতিবাচকতা যেমন আছে, তেমনি বৈপরীত্য আছে। আছে ভয়ঙ্কর তাস্কর্যধর্মী কার্যকলাপ। প্রায়শই অভিযোগ শুনি- একজনের কর্ম অন্যজন দেশের প্রচলিত আইন ও নৈতিকতার বেড়া ডিঙ্গিয়ে আত্মসাত করতে, প্রকৃত ¯্রষ্টাকে বঞ্চিত করে তার কর্ম অবৈধ উপায়ে ব্যবহার করতে।

আমাদের প্রাত্যহিক জীবন, শিক্ষা জীবন, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, রাস্ট্রীয় জীবনসহ এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে সঙ্গীত অনুপস্থিত। আমাদের সকল দ্রোহ-সংগ্রামে সঙ্গীত ¯্রষ্টাবৃন্দ রেখেছেন অসামান্য অবদান। সকল সৃষ্টিশীল কর্মে সঙ্গীত সংযোজিত হয় অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে। নাটক, চলচ্চিত্র, যাত্রা, বিজ্ঞাপনচিত্র, সম্প্রচার কর্ম, জনপ্রচারণামূলক কর্ম, খেলাধুলাসহ সকল কার্যক্রমই অপূর্ণ থেকে যায় সঙ্গীত ছাড়া।

বর্তমান বিশ্ব IT-র যুগ পেরিয়ে ইতোমধ্যে AI-এর যুগে প্রবেশ করেছে। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ততোই বাড়ছে ভোক্তার সংখ্যা। সুতরাং সুবিপুল অর্থ লগ্নি হচ্ছে সঙ্গীতধর্মী শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। একই সঙ্গে বাড়ছে অসদুপায়ে অন্যের সম্পদ লুণ্ঠনের কর্মকৌশল। আমরা প্রযুক্তি উন্নয়ন প্রবাহে পিছিয়ে থাকার কারণেও উপযুক্ত সংবাদ যথাসময়ে পেতে ব্যর্থ হচ্ছি।

দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমান বাংলাদেশে শতাব্দীকাল পূর্ব থেকে কপিরাইট আইন বলবৎ থাকার পরও অধিকার হরণের কার্যকর সমাধান সঙ্গীতকর্মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর পেছনে স্বত্বাধিকারিগণের চরম উদাসীনতা, অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা, ও কার্যকর ভূমিকা পালনে দক্ষতার অভাব মূলত দায়ী! গত দেড় দশকে মেধা সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সদাশয় সরকার তথা কপিরাইট অফিসের সহযোগী মনোভাব ও ইতিবাচক ভূমিকার ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে BLCPS (Bangladesh Lyricists Composers & Performers Society) নামের প্রথম CMO বা Collective Management Organization. প্রতিষ্ঠানটি সঙ্গীতস্রষ্টাগণের অধিকার সংরক্ষণ, সুরক্ষা, দেশে-বিদেশে রয়ালটি আদায় এবং চুক্তিবদ্ধ দেশসমূহের সঙ্গীত স্রষ্টাগণের স্বার্থে কার্যকর দায়িত্ব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে। আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি যে- যে মহৎ আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীব্যাপী CMOগুলো কাজ করে, ঠিক একই ধরনের ম্যান্ডেট আমাদের CMO-কে দেয়ার পরও বহু স্রষ্টাকে এক ছাতার তলে এখনো আনা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আমাদের এ সংস্থাটি যাতে পরিপূর্ণভাবে স্রষ্টাদের কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সে উদ্দেশ্যে WIPO এবং CISAC (International Confederation of Societies of Authors & Composers) ক্রমাগত প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।

[পাঁচ]

একজন স্রষ্টাকে পরিপূর্ণভাবে সৃষ্টিশীল কর্মে নিয়োজিত করতে হলে তার রুটি রুজির উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও বৈধ অধিকার অর্জনের পদ্ধতি আবিষ্কার অনিবার্য। পাইরেসিসহ নানাবিধ বেআইনি কার্যকলাপের কারণে স্রষ্টাগণ বারংবার প্রতারিত ও বঞ্চিত হচ্ছেন, আইনি ঝামেলায় জড়াচ্ছেন। কখনো কখনো সঙ্গীতকর্মের সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও বঞ্চিত হোন ¯্রষ্টাবৃন্দ। আমরা অনেকেই জানি যে, বেসরকারি এফএম রেডিওগুলো এলিফ্যান্ট রোডের দোকান থেকে স্বল্পমূল্যে সঙ্গীত সংগ্রহ করে সম্প্রচার করছে তাদের মিডিয়ায়! Youtube নামক ভিডিও সম্প্রচার ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে কে কার সঙ্গীতকর্ম আপলোড করছে তা সবসময় ট্র্যাক করা বা নজর রাখাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ডিজিটাল প্রতারণা ও বঞ্চনার পরিমাণ। ছন্দপতন ঘটছে সৃষ্টিশীলতায়!

[ছয়]

সঙ্গীতের দার্শনিক ও বাস্তবিক গুরুত্ব বিবেচনা করেই WIPO-এ বছর সঙ্গীতকে বিষয়বস্তু করেছে। বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের এই দিনে গভীর বিশ্বাস ও দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে সকল স্টেকহোল্ডারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাই। শিল্পীদের আর্থিক ও নৈতিক বঞ্চনার হাত থেকে বাঁচার জন্য ‘শিল্পী রক্ষা সমিতি’-র পরিবর্তে তারা যেন তাদের সৃষ্টির বিনিময়ে মর্যাদাবান জীবন নিয়ে টিকে থাকতে পারেন তা নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা আর এন্ড্রু কিশোর-আলাউদ্দিন আলীদের মতো গুণী ¯্রষ্টাদের হারাতে চাই না। আসুন আমাদের মেধাবী ¯্রষ্টাদের জন্য দৃশ্য অদৃশ্য সকল বাধা দূর করার সমবেত অঙ্গীকার ব্যক্ত করি, তাদের করি নিরুদ্বিগ্ন। সকল ¯্রষ্টাই যাতে নিবিষ্ট চিত্তে, হাসিমুখে দেশ ও দশের জন্য কল্যাণধর্মী কালজয়ী সৃষ্টি উপহার দিয়ে যেতে পারেন।

পরিশেষে আসুন আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করি- “আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে / মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর / টগবগিয়ে খুন হাসে / আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে / আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে / আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে... ”৯

পাদটীকা:

১. YOUR OWN WORLD OF IP, WIPO Publication No. 907[E], Geneva, Switzerland, page: 03.

২. What is Intellectual Property, WIPO, Geneva, Switzerland, page: 02.

৩. YOUR OWN WORLD OF IP, WIPO Publication No. 907[E], Geneva, Switzerland, page: 03.

৪. বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ও বাংলাদেশের কপিরাইট আইন, মনজুরুর রহমান, ধ্রুবপদ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা ২০১১, পৃষ্ঠা: ৪৩।

৫. জাতিসংঘ, তোফাজ্জল হোসেন, আগামী প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৩১০।

৬. এশিয়ান কপিরাইট হ্যান্ডবুক, তমোতসু হোজুমি, এশিয়ান কপিরাইট হ্যান্ডবুক, এশিয়া-প্যাসিফিক কালচারাল সেন্টার ফর ইউনেস্কো

ও কপিরাইট অফিস, ঢাকা, প্রথম বাংলা সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা: ০৯।

৭. AT HOME WITH INVENTION, WIPO Publication No. 865[E], Geneva 20, Switzerland, page: 11.

৮. কপিরাইট আইন, ২০২৩, বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত সংখ্যা, ধারা ২ (৪১), পৃষ্ঠা : ০৯।

৯. আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, দোলনচাঁপা, কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুলের কবিতাসমগ্র, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা ২০১৫, পৃষ্ঠা: ৫১।

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

সূর্যের দেশ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

লড়াই

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রচলিত সাহিত্যধারার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন মধুসূদন

ছবি

উত্তর-মানবতাবাদ ও শিল্প-সাহিত্যে তার প্রভাব

ছবি

আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

দুই ঋতপার কিসসা এবং এক ন্যাকা চৈতন্য

ছবি

অন্যজীবন অন্যআগুন ছোঁয়া

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কবিজীবন, দর্শন ও কাব্যসন্ধান

ছবি

অসামান্য গদ্যশৈলীর রূপকার

ছবি

পিয়াস মজিদের ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’

ছবি

নজরুলের নিবেদিত কবিতা : অর্ঘ্যরে শিল্পরূপ

ছবি

বাঘাডাঙা গাঁও

ছবি

বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বিষয়ভাবনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

পথকবিতা: লোকবাংলার সাধারণ কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

ক্ষমতার ভাষার বিপরীতে মাতৃভাষার সাধনা

ছবি

ফিলিস্তিনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে অণুগল্প

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

শিল্পী সুনীল কুমারের ‘পথের গল্প’-এর স্বরূপ

ছবি

রাত গভীর

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

‘এ নয় আঁখিজল’

জ্যৈষ্ঠের পদাবলি

ছবি

ওসামা অ্যালোমারের একঝুড়ি খুদে গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কাব্যগ্রন্থে নীলদ্রোহের রেখাপাত

ছবি

নার্গিস-নজরুলের স্মৃতিধন্য দৌলতপুরে একদিন

ছবি

যেভাবে ভেঙেছিল এক মৌনতা

tab

সাময়িকী

আইপি ও সঙ্গীত

মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন

মনজুরুর রহমান

শিল্পী : সুনীল কুমার

বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

বাতাসের মধ্যে ডুবে থেকে আমরা যেমন টের পাই না, বাতাসের মধ্যে ডুবে আছি; তেমনি IP (Intellectual Property) বা মেধাসম্পদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের মধ্যে বসবাস করেও এর অস্তিত্ব অনুভব করি না! গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বর্তমান পৃথিবীর সম্ভ্রান্ত শ্রেণি এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা প্রতিটি মানুষই সকাল থেকে রাত অবধি কোনো না কোনোভাবে এক থেকে দেড়শ আইপি ব্যবহার করছেন! যেমন- একজন সভ্য মানুষ ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে হাতে তুলে নেন টুথ ব্রাশ ও পেস্ট। এই দুটো নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীই কারো না কারো আবিষ্কার এবং এদের গায়ে সেঁটে থাকে ট্রেডমার্ক। দাঁত পরিষ্কার করার পর নাশতার টেবিলে এসে মুখোমুখি হন রুটি, পরোটা, প্লেট-কাপ, চা-কফিসহ আনুষঙ্গিক নানাবিধ পণ্য বা সামগ্রীর। প্রতিটি বস্তুই কোনো না কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠাজাত, যার প্রত্যেকটিতে রয়েছে ট্রেডমার্ক, পেটেন্ট বা ডিজাইনের সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ, এর সবগুলোই শিল্পজাত মেধাসম্পদের অন্তর্গত।

নাশতার টেবিলে বসে আমরা অনেকে চোখ বুলাই সংবাদপত্রে, কর্ম উপলক্ষে যানবাহনে চড়ে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে ছুটে চলি, যেতে যেতে শুনি কথা ও সুর সম্বলিত গান, কেঊবা চোখ বুলাই বইয়ের পাতায়, যাত্রায় বিলম্ব হলে ঘন ঘন দৃষ্টি ফেরাই ঘড়ির দিকে, মোবাইলে বাক্যালাপ করি অহরহ, ছুটির দিনে সিনেমা, নাটক দেখতে যাই, টেলিভিশন দেখি। শহরবাসী তো বটেই, গ্রামের স্বল্প আয়ের মহিলাদের হাতেও অলংকারের মতো শোভা পায় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথা বলার যন্ত্র মোবাইল ফোন, যাতে যুক্ত আছে মেধাসম্পদের ন্যূনতম চারটি উপাদান। এই যে, এতো কিছু ঘটে যাচ্ছে মনের অজান্তে তার সবকিছুতেই এককথায় ব্যবহৃত হচ্ছে আইপি বা মেধাসম্পদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ।

বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সংস্থা (World Intellectual Property Organization) যা WIPO নামে মেধাবিশ্বে পরিচিত তাদের ভাষ্য মতে, ‘It involves the products of the human mind– the fruits of human creativity and invention. It is with us every day of our lives, from dawn to dusk, while we are at school, while we are hanging out with our friend, and even as we sleep.’১

WIPO তাদের অন্য একটি প্রকাশনায় মেধাসম্পদের সংজ্ঞা করেছে নিম্নরূপ:

Intellectual Property refers to creation of the mind: inventions, literary and artistic works and symbols, named and images used in commerce.’২

আমরা সকলেই জানি যে মেধাসম্পদ প্রধানত দুটি শাখায় বিভক্ত। এই ভাগ সম্পর্কে WIPO কী বলছে? আসুন জেনে নেই। WIPO বলছে- ‘There are two categories of Intellectual Property. The first, industrial property, includes inventions (patents), trademarks, copyright and related rights, includes a broad range of literary and artistic works, written, performed, and recorded.’৩

[দুই]

পৃথিবীব্যাপী জাতিসঙ্ঘভুক্ত দেশসমূহে আজ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস’ বা আইপি ডে। ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল থেকে WIPO-র উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়, যেদিন WIPO Convention বলবৎ হয়। সকল সৃষ্টিশীল মানুষের মেধাসম্পদ অধিকার সুরক্ষা ও সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে দিবসটি মর্যাদার সাথে পালিত হয়। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, মেধাসম্পদ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে বর্ণিত মানুষের জন্যস্বীকৃত অধিকারসমূহের মধ্যে অন্যতম অধিকার। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা ২৭-এ বলা আছে’৪:

‘ক. প্রত্যেকেরই গোষ্ঠীগত সাংস্কৃতিক জীবনে অবাধে অংশগ্রহণ করা ও শিল্পকলা চর্চা করার অধিকার রয়েছে। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও সুফলগুলোর অংশীদার হওয়ার অধিকার রয়েছে।

খ. বিজ্ঞান, সাহিত্য অথবা শিল্পকলা ভিত্তিক সৃজনশীল কাজের থেকে যে নৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থের উদ্ভব হতে পারে তা রক্ষা করার অধিকার রয়েছে প্রত্যেকের।’৫

বিগত বছরসমূহের মতো এবছরও WIPO বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের প্রতিবাদ্য নির্ধারণ করেছে, এবারের বিষয়- ‘IP and music: Feel the beat of IP.’

আমি বাংলায় শিরোনাম করেছি ‘আইপি ও সঙ্গীত: মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন’। WIPO তাদের IP protal-এ বলেছে ‘World intellectual property day 2025 highlights creativity and innovation backed by IP rights, keep a vibrant diverse, and thriving music scene that benefits everyone, everywhere.’

সঙ্গীত যেহেতু সংস্কৃতিধর্মী মেধাসম্পদের একটি অনিবার্য অংশ, সেজন্য প্রতিপাদ্যে যাওয়ার আগে আমি সাংস্কৃতিক সম্পদ সম্পর্কে জাপানি মেধাসম্পদ বিশেষজ্ঞ তমোতসু হোজুমির- এশিয়ান কপিরাইট হ্যান্ডবুক থেকে কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করছি। হোজুমি বলছেন- ‘মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আহারের দরকার। মানব শরীরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খাদ্য অত্যন্ত জরুরি। আহার আমাদের পুষ্টি জোগায় এবং বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু আমরা স্তন্যপায়ী প্রাণি আমাদের শুধু দেহের পুষ্টি সাধনই যথেষ্ট নয়, আমাদের মন ও হৃদয়ের পুষ্টিরও প্রয়োজন আছে।

যদি আপনি সাংস্কৃতিক কর্মকে আমাদের আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তির জন্য আহারের সঙ্গে তুলনা করেন তবে সহজেই সাংস্কৃতিক কর্মের সংজ্ঞা উপলব্ধি করতে পারবেন। এমন একটি জগতের কথা ভাবুন যেখানে আমাদের আত্মার সাংস্কৃতিক কর্মের অস্তিত্ব নেই! উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত অথবা চিত্রকর্মহীন একটি পৃথিবীর কথা ভাবুন। আমাদের হৃদয়কে সমৃদ্ধ করে যেসব সাংস্কৃতিক কর্ম তা মানব-ইতিহাসে আমাদের জন্য এক মূল্যবান ঐতিহ্য।’৬

[তিন]

আমাদের এবারকার আলোচনা সঙ্গীতকে অবলম্বন করেই বিস্তৃত হবে। আমরা মেধাসম্পদ হিসেবে সঙ্গীত ¯্রস্টার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবো। আসলে সঙ্গীত কী? প্রাচ্যের প্রাজ্ঞজনদের দৃষ্টিতে- ‘সঙ্গীত হচ্ছে নৃত্য, গীত ও বাদ্যের সমন্বয়’। অর্থাৎ সঙ্গীত মানবসৃষ্ট একটি যৌথ বা গুচ্ছ নান্দনিক সাংস্কৃতিক কর্ম। সঙ্গীতের প্রাণ, ছন্দ বা বিট, যা মূলত জীবনেরই ছন্দ।

মেধাসম্পদ বিশ্বে সঙ্গীত সৃষ্টিকে সঙ্গীতকর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। WIPO-র বিভিন্ন প্রকাশনায় MUSICAL WORKS-এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে- ‘from opera to pop songs to symphonies, are covered by copyright. These include both the written score of a work as well as its melody and lyrics, whether recorded on a compact disc, broadcast over the radio, or performed in a concert hall. Performers of a musical work, such as musicians and singers, are covered by related rights in their performances, as are producers of recordings and broadcasters.’৭

বাংলাদেশের কপিরাইট আইন, ২০২৩ অনুযায়ী ‘সঙ্গীতকর্ম অর্থ সুর সংবলিত কর্ম এবং কর্মের স্বরলিপি, কথা, গীতি, গান বা অনুরূপ বিষয় সৃজন, প্রকাশ বা সম্পাদন,’৮

একমাত্র বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া পৃথিবী খুঁজে সঙ্গীত পছন্দ করে না এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে না। মনের অজান্তেই স্থান-কালের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ নিজেকে নিবিষ্ট করে সুর ও ছন্দের মায়াজালে। শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত, জ্ঞানী-অজ্ঞানী সবার মনেই সঙ্গীতের মূর্ছনা ছন্দ ও দ্যোতনা তৈরি করে। একটি মহৎ সঙ্গীত কর্ম দেশের সীমা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্ব পরিসরে, হয়ে উঠতে পারে সার্বজনীন। আজও আমরা বিটোভেন, মোজার্ট শুনে মুগ্ধ হই। হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার কথাবিহীন বাঁশির সুর, জাকির খানের তবলার বোলের মধ্য দিয়ে যে সৌকর্য সৃষ্টি হয়েছে তা তুলনা রহিত। কিংবদন্তি আছে জগৎখ্যাত তানসেন সুরের মোহজাল সৃষ্টি করে বৃষ্টি ঝরাতে পারতেন! সঙ্গীতের ঔষধী গুণের কথাও আমরা অবগত আছি।

শৈশবে মায়ের সুরেলা কণ্ঠের ঘুম পাড়ানিয়া গান, তারুণ্যে যৌবনে উদ্দীপ্ত ও আর শেষ জীবনে স্মৃতি জাগানিয়া কথা ও সুর মানুষকে নস্টালজিক করে। সঙ্গীত ও সঙ্গীতস্রষ্টা বেঁচে থাকেন শ্রোতা দর্শকের মনের মনিকোঠায়। কথা, সুর ও বাদ্য সহযোগে সঙ্গীতের সৃষ্টি তা মেধাসম্পদের অন্তর্গত, কপিরাইট ও রিলেটেড রাইটস-এর বিষয়বস্তু। কথাবিহীন সুরও সঙ্গীতের অন্তর্ভুক্ত। কথা ও সুর সম্বলিত সঙ্গীত সৃষ্টিতে দু’ধরনের অধিকার জন্ম নেয়। একটি কপিরাইট ও অন্যটি রিলেটেড রাইটস। উদাহরণ উপস্থাপন করলে বিষয়টি স্পষ্টতর হবে। একটি গানের ক্ষেত্রে থাকেন-গীতিকার, সুরকার ও কন্ঠশিল্পী। গানের কথা রচয়িতা বা গীতিকার ও যিনি সুর সৃষ্টিকারী তাদের অধিকার কপিরাইট। তারা মূল স্রষ্টা হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু যে কণ্ঠশিল্পী গীত রচনা ও সুর সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখেননি, কেবল কণ্ঠে ধারণ করেছেন, তিনি পারফর্মার-রিলেটেড রাইটস বা আনুষঙ্গিক অধিকারের মালিক। তাদের অধিকারের মেয়াদও ভিন্ন ভিন্ন হতে বাধ্য। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন শাহ্, শাহ আব্দুল করিম প্রমুখের অধিকার কপিরাইট। অন্যদিকে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, ফাতেমা তুজ জোহরা, সুবির নন্দি, সৈয়দ আব্দুল হাদি প্রমুখ কণ্ঠশিল্পীর অধিকার রিলেটেড রাইটস।৭

[চার]

সঙ্গীতের উদ্ভব, বিকাশ ও সম্প্রসারণ মানব সভ্যতার বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে। ভারতীয় পুরাণে ‘ওঙ্কার’ ধ্বনির মধ্যেও পাওয়া যায় সঙ্গীতের রেশ। অরণ্যচারী মানুষ, কৃষিজীবী মানুষ, জীবনকে পরিপূর্ণ যাপন করতে গিয়ে শ্রম বিভাজনের দিকে যেমন দৃষ্টি দিয়েছে, ঠিক তেমনি কর্মহীন দিনযাপনের সময় মনোযোগী হয়েছে মনের আনন্দে আত্মাকে তৃপ্ত করার বাসনায়। সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে নিজেদের নিয়োজিত করতে। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস অবগাহন করলে দেখবো আদিবাসী মানুষ কাল পরিক্রমায় কীভাবে নিজেদের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে স্বাতন্ত্র্যের ছাপ রেখেছে। বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালে এই স্বাতন্ত্র্যের স্পষ্ট ছবি এখনো দেখতে পাবো। নেপালের রাজদরবারে প্রাপ্ত চর্যাপদ, মধ্যযুগের গীতিকবিতা, মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি সাহিত্য কর্মগুলোতে যে সঙ্গীতের অনিবার্য উপাদান বিদ্যমান, আজ তা গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গবেষকগণ লক্ষ্য করেছেন- চর্যাপদ ও অন্যান্য কাব্যধর্মী সাহিত্যের শিরোদেশে তাল, লয় ও রাগিণীর উল্লেখ রয়েছে।

আমরা যত উন্নত হচ্ছি, আধুনিক হচ্ছি, ততই সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে আমাদের বিকাশ অধিকতর বিকশিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইতিবাচকতা যেমন আছে, তেমনি বৈপরীত্য আছে। আছে ভয়ঙ্কর তাস্কর্যধর্মী কার্যকলাপ। প্রায়শই অভিযোগ শুনি- একজনের কর্ম অন্যজন দেশের প্রচলিত আইন ও নৈতিকতার বেড়া ডিঙ্গিয়ে আত্মসাত করতে, প্রকৃত ¯্রষ্টাকে বঞ্চিত করে তার কর্ম অবৈধ উপায়ে ব্যবহার করতে।

আমাদের প্রাত্যহিক জীবন, শিক্ষা জীবন, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, রাস্ট্রীয় জীবনসহ এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে সঙ্গীত অনুপস্থিত। আমাদের সকল দ্রোহ-সংগ্রামে সঙ্গীত ¯্রষ্টাবৃন্দ রেখেছেন অসামান্য অবদান। সকল সৃষ্টিশীল কর্মে সঙ্গীত সংযোজিত হয় অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে। নাটক, চলচ্চিত্র, যাত্রা, বিজ্ঞাপনচিত্র, সম্প্রচার কর্ম, জনপ্রচারণামূলক কর্ম, খেলাধুলাসহ সকল কার্যক্রমই অপূর্ণ থেকে যায় সঙ্গীত ছাড়া।

বর্তমান বিশ্ব IT-র যুগ পেরিয়ে ইতোমধ্যে AI-এর যুগে প্রবেশ করেছে। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ততোই বাড়ছে ভোক্তার সংখ্যা। সুতরাং সুবিপুল অর্থ লগ্নি হচ্ছে সঙ্গীতধর্মী শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। একই সঙ্গে বাড়ছে অসদুপায়ে অন্যের সম্পদ লুণ্ঠনের কর্মকৌশল। আমরা প্রযুক্তি উন্নয়ন প্রবাহে পিছিয়ে থাকার কারণেও উপযুক্ত সংবাদ যথাসময়ে পেতে ব্যর্থ হচ্ছি।

দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমান বাংলাদেশে শতাব্দীকাল পূর্ব থেকে কপিরাইট আইন বলবৎ থাকার পরও অধিকার হরণের কার্যকর সমাধান সঙ্গীতকর্মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর পেছনে স্বত্বাধিকারিগণের চরম উদাসীনতা, অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা, ও কার্যকর ভূমিকা পালনে দক্ষতার অভাব মূলত দায়ী! গত দেড় দশকে মেধা সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সদাশয় সরকার তথা কপিরাইট অফিসের সহযোগী মনোভাব ও ইতিবাচক ভূমিকার ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে BLCPS (Bangladesh Lyricists Composers & Performers Society) নামের প্রথম CMO বা Collective Management Organization. প্রতিষ্ঠানটি সঙ্গীতস্রষ্টাগণের অধিকার সংরক্ষণ, সুরক্ষা, দেশে-বিদেশে রয়ালটি আদায় এবং চুক্তিবদ্ধ দেশসমূহের সঙ্গীত স্রষ্টাগণের স্বার্থে কার্যকর দায়িত্ব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে। আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি যে- যে মহৎ আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীব্যাপী CMOগুলো কাজ করে, ঠিক একই ধরনের ম্যান্ডেট আমাদের CMO-কে দেয়ার পরও বহু স্রষ্টাকে এক ছাতার তলে এখনো আনা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আমাদের এ সংস্থাটি যাতে পরিপূর্ণভাবে স্রষ্টাদের কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সে উদ্দেশ্যে WIPO এবং CISAC (International Confederation of Societies of Authors & Composers) ক্রমাগত প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।

[পাঁচ]

একজন স্রষ্টাকে পরিপূর্ণভাবে সৃষ্টিশীল কর্মে নিয়োজিত করতে হলে তার রুটি রুজির উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও বৈধ অধিকার অর্জনের পদ্ধতি আবিষ্কার অনিবার্য। পাইরেসিসহ নানাবিধ বেআইনি কার্যকলাপের কারণে স্রষ্টাগণ বারংবার প্রতারিত ও বঞ্চিত হচ্ছেন, আইনি ঝামেলায় জড়াচ্ছেন। কখনো কখনো সঙ্গীতকর্মের সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও বঞ্চিত হোন ¯্রষ্টাবৃন্দ। আমরা অনেকেই জানি যে, বেসরকারি এফএম রেডিওগুলো এলিফ্যান্ট রোডের দোকান থেকে স্বল্পমূল্যে সঙ্গীত সংগ্রহ করে সম্প্রচার করছে তাদের মিডিয়ায়! Youtube নামক ভিডিও সম্প্রচার ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে কে কার সঙ্গীতকর্ম আপলোড করছে তা সবসময় ট্র্যাক করা বা নজর রাখাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ডিজিটাল প্রতারণা ও বঞ্চনার পরিমাণ। ছন্দপতন ঘটছে সৃষ্টিশীলতায়!

[ছয়]

সঙ্গীতের দার্শনিক ও বাস্তবিক গুরুত্ব বিবেচনা করেই WIPO-এ বছর সঙ্গীতকে বিষয়বস্তু করেছে। বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের এই দিনে গভীর বিশ্বাস ও দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে সকল স্টেকহোল্ডারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাই। শিল্পীদের আর্থিক ও নৈতিক বঞ্চনার হাত থেকে বাঁচার জন্য ‘শিল্পী রক্ষা সমিতি’-র পরিবর্তে তারা যেন তাদের সৃষ্টির বিনিময়ে মর্যাদাবান জীবন নিয়ে টিকে থাকতে পারেন তা নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা আর এন্ড্রু কিশোর-আলাউদ্দিন আলীদের মতো গুণী ¯্রষ্টাদের হারাতে চাই না। আসুন আমাদের মেধাবী ¯্রষ্টাদের জন্য দৃশ্য অদৃশ্য সকল বাধা দূর করার সমবেত অঙ্গীকার ব্যক্ত করি, তাদের করি নিরুদ্বিগ্ন। সকল ¯্রষ্টাই যাতে নিবিষ্ট চিত্তে, হাসিমুখে দেশ ও দশের জন্য কল্যাণধর্মী কালজয়ী সৃষ্টি উপহার দিয়ে যেতে পারেন।

পরিশেষে আসুন আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করি- “আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে / মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর / টগবগিয়ে খুন হাসে / আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে / আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে / আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে... ”৯

পাদটীকা:

১. YOUR OWN WORLD OF IP, WIPO Publication No. 907[E], Geneva, Switzerland, page: 03.

২. What is Intellectual Property, WIPO, Geneva, Switzerland, page: 02.

৩. YOUR OWN WORLD OF IP, WIPO Publication No. 907[E], Geneva, Switzerland, page: 03.

৪. বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ও বাংলাদেশের কপিরাইট আইন, মনজুরুর রহমান, ধ্রুবপদ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা ২০১১, পৃষ্ঠা: ৪৩।

৫. জাতিসংঘ, তোফাজ্জল হোসেন, আগামী প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৩১০।

৬. এশিয়ান কপিরাইট হ্যান্ডবুক, তমোতসু হোজুমি, এশিয়ান কপিরাইট হ্যান্ডবুক, এশিয়া-প্যাসিফিক কালচারাল সেন্টার ফর ইউনেস্কো

ও কপিরাইট অফিস, ঢাকা, প্রথম বাংলা সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা: ০৯।

৭. AT HOME WITH INVENTION, WIPO Publication No. 865[E], Geneva 20, Switzerland, page: 11.

৮. কপিরাইট আইন, ২০২৩, বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত সংখ্যা, ধারা ২ (৪১), পৃষ্ঠা : ০৯।

৯. আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, দোলনচাঁপা, কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুলের কবিতাসমগ্র, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা ২০১৫, পৃষ্ঠা: ৫১।

back to top