কামাল রাহমান
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
অন্ধকারে জন্ম নেয়া একটা দলের চারজনেরই হঠাৎ করে ভালো লেগে যায় পাড়ার একটা মেয়েকে। নাম ওর শাবানা। বস্তি থেকে উঠে আসা একটা মেয়ের নাম হিসেবে অনেকটা কাব্যিক বা আধুনিক। তবে বিষয়টা একটু ভিন্ন। মেয়েটার জন্মের সময় ঐ নামে এক সুন্দরী নায়িকা ছিল। ওর মায়ের আশা ছিল যে ঐ মেয়েটাও বড় হয়ে ওরকম নামকেনা কেউ হয়ে উঠবে।
শাবানার বিষয়টা একটু ভাবনায় ফেলে ওদের দলনেতা কোপা মাছুমকে। কারণ সব ঝুটঝামেলা কিনা শেষপর্যন্ত ওকেই পোহাতে হয়। প্রথমে ওদেরকে বুঝিয়েসুজিয়ে ঝামেলাটা বাগে আনার চেষ্টা করে। ওটায় ব্যর্থ হলে ওর মাথার উপর ছাদ হয়ে থাকা বড়ভাইয়ের পরামর্শ নিতে যায় সে। বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পেরে বড়ভাই ওর স্বাভাবিক চাতুর্যে সমাধান করতে চায় ওটার। ঠোঁটের আড়ালে বেশ খানিকটা হেসেও নেয় সে। নিষ্পত্তির জন্য বিষয়টা আবার মাছুমের হাতে ফিরে আসায় কিছুটা দ্বিধায় পড়ে সে। ওদের দুজন হলে না হয় ডুয়েল লড়তে বলত। কিন্তু চারজনের ভেতর ওটা কীভাবে সম্ভব? বড়ভাইয়ের পরামর্শ কিছুটা অনুসরণ করে ওদের বুঝিয়ে উটকো ঝামেলাটার একটা সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছে যায় সে। কিন্তু ওদের একজন শাবানার জন্য এত বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে কোনোভাবেই ওকে সামলানো যাচ্ছে না। ওদিকে দলের বাকি তিনজন কোনো অবস্থায়ই ওকে মেনে নেবে না বলে ধনুর্ভাঙা পণ করে বসে আছে।
হতাশ হয়ে বড়ভাইয়ের পরামর্শটাই শেষপর্যন্ত ওদের মাথায় চাপিয়ে দেয় কোপা মাছুম। ওটার ফলাফল কী হতে পারে ভেবে ওরকম কোনো কিছু মোটেও চায়নি সে। চারটে শক্তসবল খুঁটি হয়ে ওকে মাথায় ধরে রেখেছে ওরা চারজন। কাউকেই হারাতে চায় না সে। এমন একটা জটিল পরিস্থিতি দেখা দেয়ায় শাবানার উপর রাগ হয় ওর। অথচ কিছু করার নেই।
অগত্যা ওদের চারজনকেই লড়াই করে সিদ্ধান্ত নিতে বলে সে। ওদের মারামারিটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো অবস্থায় যেতে পারে না ওরা। ওদের কাউকেই এককভাবে জয়ী বলা যায় না। মারামারি করে যদিও ওদের সবার অবস্থা বেশ শোচনীয়।
অবশেষে কোপা মাছুম বলে, ‘ঠিক আছে, এক কাজ কর, নিজেরা তো কোনো সমাধান করতে পারবি না তোরা শাবানাকে আমার হাতে ছেড়ে দে।’
ওর ঐ কথায় আবার যেন নতুন প্রাণ পেয়ে মাটি থেকে লাফিয়ে ওঠে সবাই। চারজনের ঝগড়াটা এবার পাঁচজনে গড়ায়। তারপরও কোনো একজন জয়ী হতে পারে না। কিছুতেই কোনো কিছু করতে না পেরে শেষপর্যন্ত ভোটাভুটি করার সিদ্ধান্তে পৌঁছে ওরা। তাতেও সমাধান হয় না। ফলাফল দাঁড়ায় সমান সমান।
এবার একটা কঠিন সিদ্ধান্ত জানায় মাছুম। চারজনের একজনকে সরে যেতে হবে। যেহেতু ওরা খুব ভালো বন্ধু, হয় চারজনে লড়ে একজনকে বাদ দেবে নয়তো দলনেতার ইচ্ছে মেনে নিতে হবে ওদের।
আবার শুরু হয়ে যায় প্রচ- লড়াই। সবার ভেতরই মৃত্যুভীতি। কে যাবে? ঝড়ে উপড়ে পড়া কলাগাছের মতো একসময় লুটিয়ে পড়ে সবাই। কোনো একজনকেও পরাজিত করা যায় না। শেষপর্যন্ত মাছুমের হাতের নানচাকু ঝলকে ওঠে। সবাই একযোগে প্রতিহত করার চেষ্টা করে ওকে। কিন্তু কোনোভাবেই ধরাশায়ী করা সম্ভব হয় না মহাশক্তিধর কোপা মাছুমকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ওদের চারজনই।
চূড়ান্ত ও কঠিন সিদ্ধান্তটা অবশেষে মাছুমকেই নিতে হয়। সবাইকে মাটিতে শুইয়ে দূর থেকে চাকু ছুঁড়ে একজনকে বাদ দেয়া হবে। দৃশ্য থেকে মুছে যাক ওদের কোনো একজন। কোনো রকম কারচুপি করা হবে না ওটায়।
যে-মুহূর্তে মাছুমের হাতের চাকুটা গতি পেতে যাচ্ছে ঠিক তখনই ওদের একজনের শরীর পাকা বেতের মতো ছিটকে ওটা লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দেয়। তারপর চারজনে আবার পুনর্গঠিত হয়ে মাছুমের সকল শক্তির অবসান ঘটায়। দৈত্যের মতো বিশাল ঐ শরীর অবশেষে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে ওরা। বুঝে উঠতে পারে না যে কী করবে। কিছুক্ষণ পর নিথর ঐ শরীরটা গড়িয়ে চিৎ করে শোয়ায়। বুকে কান পেতে হৃৎপি-ের শব্দ শোনার চেষ্টা করে। নাহ্, সব শেষ...
কাজটা করতে যেয়ে ওদের সবার সব শক্তি নিংড়ে বেরিয়ে গেছে। মৃতদেহটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে ওরা। অনেকক্ষণ ওভাবে পড়ে থাকে কোপা মাছুমের প্রাণহীন শরীর। একদল পিঁপড়ে ও একঝাঁক মাছি ওর চোখের কোনা ও নাকের ফুটো বেয়ে উপরে উঠে আসে। মনে মনে ভাবে ওরা: হায়রে পরাক্রান্ত বীর! শহরের কত যুবক তোমার নামে কাপড় ভিজিয়েছে। কত মেয়ের বুক কাচের বাটির মতো ভেঙ্গে চৌচির হয়েছে। ওদের শরীর গলেছে মোমের মতো। আর এখন একটা পিঁপড়ে অথবা একটা মাছি তাড়ানোর সামর্থ্যও নেই তোমার!
স্নায়ু কিছুটা থিতিয়ে এলে প্রথমে এক অস্বাভাবিক কান্না পায় ওদের। তারপর শরীর হিমকরা এক ধরনের ভীতি জড়িয়ে ধরে সবাইকে। ওদের নেতা কোপা মাছুম ছিল ওদের মাথার উপর একটা ছাদের মতো। আর এখন ওরা ওর হত্যাকারী। খোলা এক আকাশের নিচে পুরোপুরি অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে ওরা। এ অবস্থায় কে বাঁচাবে ওদের! ধরা পড়লে শাস্তি ওদের নির্ঘাৎ মৃত্যুদ-। ভীষণ মুষড়ে পড়ে ওরা। আর শাবানাও তখন হঠাৎ কান্না জুড়ে দেয়। ওটার প্রতিক্রয়ায় সবার সব রাগ যেয়ে পড়ে ওর উপর। তখন সবাই মিলে সবভাবে ওদের প্রতিশোধ তোলে ওর উপর দিয়ে।
রাত গভীর হলে পরামর্শ করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে ওরা। যেভাবেই হোক সবার আগে শবটাকে সরিয়ে ফেলতে হবে ওখান থেকে। তারপর সটকে পড়বে ওরা যে যেদিকে পারে।
রাতের অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলে প্রকৃতির এক মোহমায়ার ভেতর তলিয়ে যেতে থাকে ওরা। দূরের একটা গাছের নিচে জমাট বাঁধা অন্ধকার থেকে এক থোকা ম্লান আলোর ঝরনা নেমে গেছে কাছাকাছি একটা নদীর অন্ধকার গভীর খাতে। দূর থেকে মনে হয় কালো একটা কলস থেকে সাদা জল গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে নদীর ঢাল বেয়ে। রহস্য-নিসর্গের এসব নিপুণ মায়াজাল মিথ্যের এক অলৌকিক ফাঁদ মনে হয় ওদের কাছে। যা কিছু আহরণ করা যায় প্রকৃতি থেকে তার মূল্য আছে। মিনিমাগনায় বিলানো এসবের আর কী মূল্য! এখন বাঁচার চেষ্টা করতে হবে ওদের। হেঁয়ালি প্রকৃতির ঐসব নিবিড় নৈকট্য থেকে বেরিয়ে আসে ওরা।
অনেকক্ষণ চেষ্টা করে একটা এম্বুলেন্স ছিনিয়ে নিয়ে আসে ওরা। চালক ও সহকারীকে বেঁধে পেছনে শুইয়ে রাখে। মেয়েটাকে ঢুকিয়ে দেয় ওদের মাঝখানে। ওদের একজন চালক, একজন সহকারী ও বাকি দুজন রোগীর সঙ্গী হয়ে মৃতকে অসুস্থ রোগী সাজিয়ে গাড়িতে তোলে। নদীর যে বাঁকে রাস্তাটা ছুঁই ছুঁই সেখানে এম্বুলেন্সটা থামায়। তার পর নদীতে ছুঁড়ে ফেলে ওদের দলনেতা, একসময়ের প্রবল প্রতাপশালী ঐ কোপা মাছুমকে।
অবশেষে হাঁফ ছাড়ে ওরা। আর ঠিক তখনি মাটি ফুঁড়ে যেন একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামে ওদের সামনে! তাৎক্ষণিকভাবে যে প্রতিক্রিয়াটি ধ্বনিত হয় ওদের ভেতর: হায়, ধরা পড়ে গেলাম শেষপর্যন্ত! মানে মৃত্যুদ-, অথবা আজীবন কারাদ-। যার অর্থ ঐ মৃত্যুদ-ই!
মুহূর্তের জন্য রাতের প্রকৃতি আবার আচ্ছন্ন করে ফেলে ওদের। শাবানার কোমল করপুটের মতো একটা সুন্দর চাঁদ জেগে রয়েছে এখন রাতের আকাশে। অমলিন ঐ চাঁদের চারপাশে কি বিস্তীর্ণ ঐ কালো শূন্যতা! গাভীর চোখের মতো টলটলে নদীর জলেও আকাশের ছায়া। তারাদের জ্যামিতিক বিন্যাসে কাল্পনিক রাশিগুলো ফুটে রয়েছে। নিজেদের রাশির তারকাগুচ্ছের সন্ধান করে ওরা। আশ্চর্য ঐ রাতটাকে রূপকথার এক রাত বলে মনে হয় ওদের কাছে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর প্রাচীন জ্যোৎস্না নগরীর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় তখন। রাতের ঐ মোহন আবেশ, শিভাজের নেশাকাটা আলস্য, শরীরের রতিতৃপ্ত অবসাদ, কয়েক ঘণ্টা আগে ঘটে যাওয়া ঐসব ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়া, প্রভৃতির এক মিশ্র আবহে ওদের মনে হয়: নাহয় ঘুমোনোই যাক আরেকটু...
হয়তো ঘুমিয়েই পড়ে ওরা।
সবার দৃষ্টি ঝলকে দিয়ে হুঁশ করে মাঝ নদীতে ভেসে ওঠে কিছু একটা! পুলিশের টর্চলাইটের জোরালো আলোর তীর বিদ্ধ করে ওটাকে। কিন্তু কিছুই করার নেই এখন ওদের। ডুবসাঁতারে ওপারে চলে যায় সে।
ঘটনার আকস্মিকতায় অথবা অলৌকিকতায় ওদের সবার ভেতর প্রশান্তির কোমল ছায়া নেমে আসে। আহ্ বন্ধু, বাঁচিয়ে দিলে আমাদের। সব কিছু ভুলে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে ওরা। ওপার থেকে হাত নেড়ে জানায় সে, বেঁচে আছে। একটু পরেই ঐ বিকেলের মৃত্যুভীতিটা আবার জড়িয়ে ধরে ওদের। তার অর্থ যে-কোনো একজনের অবধারিত মৃত্যু!
তাহলে কে সে? সবাই ভাবে কোনো অবস্থায়ই সে নয়। তাহলে? সমস্যাটা রয়েই গেল। যদিও ওটা এখন এ মুহূর্তে ওপারে। ওকে যখন মৃত মনে হয়েছিল, আবার যখন জীবিত হয়ে উঠল, বিষয়টা তো একই রকম রয়ে গেল!
‘লাশ উঠাও।’ পুলিশ অফিসারের কঠিন ঐ নির্দেশ বজ্রের মতো আকাশ থেকে ঘোষিত হয়ে আসে যেন। সিপাইরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ‘লাশ কোথায় স্যার, ও তো জ্যান্ত, সাঁতরে ওপারে যেয়ে হাত নাড়ল।’ আবার গর্জে উঠে অফিসার, ‘আহাম্মক, ওটা আমার এলাকা না। এ পারের লাশটার কথা বলছি আমি।
অন্ধকার ভেঙ্গেচুরে নদীতীরের দৃশ্যটা এখন কালো বাদুড়ের অলৌকিক পাখার মতো ছটফট করে। কোথায় লাশ?
ততক্ষণে চাঁদ লুকিয়েছে আকাশের গোপন আলিঙ্গনের ভেতর। মেঘের বন্ধনী থেকে উপচে পড়া কিছুটা জ্যোৎস্না পরিবেশটাকে আরো ভৌতিক করে তোলে। সত্য-অসত্যের দোলার ভেতর দুলতে থেকে মানুষগুলো বুঝতেই পারেনি মেয়েটা কখন আবার আরেকটা লাশ বানিয়ে ফেলেছে নিজেকে!
কামাল রাহমান
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
অন্ধকারে জন্ম নেয়া একটা দলের চারজনেরই হঠাৎ করে ভালো লেগে যায় পাড়ার একটা মেয়েকে। নাম ওর শাবানা। বস্তি থেকে উঠে আসা একটা মেয়ের নাম হিসেবে অনেকটা কাব্যিক বা আধুনিক। তবে বিষয়টা একটু ভিন্ন। মেয়েটার জন্মের সময় ঐ নামে এক সুন্দরী নায়িকা ছিল। ওর মায়ের আশা ছিল যে ঐ মেয়েটাও বড় হয়ে ওরকম নামকেনা কেউ হয়ে উঠবে।
শাবানার বিষয়টা একটু ভাবনায় ফেলে ওদের দলনেতা কোপা মাছুমকে। কারণ সব ঝুটঝামেলা কিনা শেষপর্যন্ত ওকেই পোহাতে হয়। প্রথমে ওদেরকে বুঝিয়েসুজিয়ে ঝামেলাটা বাগে আনার চেষ্টা করে। ওটায় ব্যর্থ হলে ওর মাথার উপর ছাদ হয়ে থাকা বড়ভাইয়ের পরামর্শ নিতে যায় সে। বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পেরে বড়ভাই ওর স্বাভাবিক চাতুর্যে সমাধান করতে চায় ওটার। ঠোঁটের আড়ালে বেশ খানিকটা হেসেও নেয় সে। নিষ্পত্তির জন্য বিষয়টা আবার মাছুমের হাতে ফিরে আসায় কিছুটা দ্বিধায় পড়ে সে। ওদের দুজন হলে না হয় ডুয়েল লড়তে বলত। কিন্তু চারজনের ভেতর ওটা কীভাবে সম্ভব? বড়ভাইয়ের পরামর্শ কিছুটা অনুসরণ করে ওদের বুঝিয়ে উটকো ঝামেলাটার একটা সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছে যায় সে। কিন্তু ওদের একজন শাবানার জন্য এত বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে কোনোভাবেই ওকে সামলানো যাচ্ছে না। ওদিকে দলের বাকি তিনজন কোনো অবস্থায়ই ওকে মেনে নেবে না বলে ধনুর্ভাঙা পণ করে বসে আছে।
হতাশ হয়ে বড়ভাইয়ের পরামর্শটাই শেষপর্যন্ত ওদের মাথায় চাপিয়ে দেয় কোপা মাছুম। ওটার ফলাফল কী হতে পারে ভেবে ওরকম কোনো কিছু মোটেও চায়নি সে। চারটে শক্তসবল খুঁটি হয়ে ওকে মাথায় ধরে রেখেছে ওরা চারজন। কাউকেই হারাতে চায় না সে। এমন একটা জটিল পরিস্থিতি দেখা দেয়ায় শাবানার উপর রাগ হয় ওর। অথচ কিছু করার নেই।
অগত্যা ওদের চারজনকেই লড়াই করে সিদ্ধান্ত নিতে বলে সে। ওদের মারামারিটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো অবস্থায় যেতে পারে না ওরা। ওদের কাউকেই এককভাবে জয়ী বলা যায় না। মারামারি করে যদিও ওদের সবার অবস্থা বেশ শোচনীয়।
অবশেষে কোপা মাছুম বলে, ‘ঠিক আছে, এক কাজ কর, নিজেরা তো কোনো সমাধান করতে পারবি না তোরা শাবানাকে আমার হাতে ছেড়ে দে।’
ওর ঐ কথায় আবার যেন নতুন প্রাণ পেয়ে মাটি থেকে লাফিয়ে ওঠে সবাই। চারজনের ঝগড়াটা এবার পাঁচজনে গড়ায়। তারপরও কোনো একজন জয়ী হতে পারে না। কিছুতেই কোনো কিছু করতে না পেরে শেষপর্যন্ত ভোটাভুটি করার সিদ্ধান্তে পৌঁছে ওরা। তাতেও সমাধান হয় না। ফলাফল দাঁড়ায় সমান সমান।
এবার একটা কঠিন সিদ্ধান্ত জানায় মাছুম। চারজনের একজনকে সরে যেতে হবে। যেহেতু ওরা খুব ভালো বন্ধু, হয় চারজনে লড়ে একজনকে বাদ দেবে নয়তো দলনেতার ইচ্ছে মেনে নিতে হবে ওদের।
আবার শুরু হয়ে যায় প্রচ- লড়াই। সবার ভেতরই মৃত্যুভীতি। কে যাবে? ঝড়ে উপড়ে পড়া কলাগাছের মতো একসময় লুটিয়ে পড়ে সবাই। কোনো একজনকেও পরাজিত করা যায় না। শেষপর্যন্ত মাছুমের হাতের নানচাকু ঝলকে ওঠে। সবাই একযোগে প্রতিহত করার চেষ্টা করে ওকে। কিন্তু কোনোভাবেই ধরাশায়ী করা সম্ভব হয় না মহাশক্তিধর কোপা মাছুমকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ওদের চারজনই।
চূড়ান্ত ও কঠিন সিদ্ধান্তটা অবশেষে মাছুমকেই নিতে হয়। সবাইকে মাটিতে শুইয়ে দূর থেকে চাকু ছুঁড়ে একজনকে বাদ দেয়া হবে। দৃশ্য থেকে মুছে যাক ওদের কোনো একজন। কোনো রকম কারচুপি করা হবে না ওটায়।
যে-মুহূর্তে মাছুমের হাতের চাকুটা গতি পেতে যাচ্ছে ঠিক তখনই ওদের একজনের শরীর পাকা বেতের মতো ছিটকে ওটা লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দেয়। তারপর চারজনে আবার পুনর্গঠিত হয়ে মাছুমের সকল শক্তির অবসান ঘটায়। দৈত্যের মতো বিশাল ঐ শরীর অবশেষে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে ওরা। বুঝে উঠতে পারে না যে কী করবে। কিছুক্ষণ পর নিথর ঐ শরীরটা গড়িয়ে চিৎ করে শোয়ায়। বুকে কান পেতে হৃৎপি-ের শব্দ শোনার চেষ্টা করে। নাহ্, সব শেষ...
কাজটা করতে যেয়ে ওদের সবার সব শক্তি নিংড়ে বেরিয়ে গেছে। মৃতদেহটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে ওরা। অনেকক্ষণ ওভাবে পড়ে থাকে কোপা মাছুমের প্রাণহীন শরীর। একদল পিঁপড়ে ও একঝাঁক মাছি ওর চোখের কোনা ও নাকের ফুটো বেয়ে উপরে উঠে আসে। মনে মনে ভাবে ওরা: হায়রে পরাক্রান্ত বীর! শহরের কত যুবক তোমার নামে কাপড় ভিজিয়েছে। কত মেয়ের বুক কাচের বাটির মতো ভেঙ্গে চৌচির হয়েছে। ওদের শরীর গলেছে মোমের মতো। আর এখন একটা পিঁপড়ে অথবা একটা মাছি তাড়ানোর সামর্থ্যও নেই তোমার!
স্নায়ু কিছুটা থিতিয়ে এলে প্রথমে এক অস্বাভাবিক কান্না পায় ওদের। তারপর শরীর হিমকরা এক ধরনের ভীতি জড়িয়ে ধরে সবাইকে। ওদের নেতা কোপা মাছুম ছিল ওদের মাথার উপর একটা ছাদের মতো। আর এখন ওরা ওর হত্যাকারী। খোলা এক আকাশের নিচে পুরোপুরি অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে ওরা। এ অবস্থায় কে বাঁচাবে ওদের! ধরা পড়লে শাস্তি ওদের নির্ঘাৎ মৃত্যুদ-। ভীষণ মুষড়ে পড়ে ওরা। আর শাবানাও তখন হঠাৎ কান্না জুড়ে দেয়। ওটার প্রতিক্রয়ায় সবার সব রাগ যেয়ে পড়ে ওর উপর। তখন সবাই মিলে সবভাবে ওদের প্রতিশোধ তোলে ওর উপর দিয়ে।
রাত গভীর হলে পরামর্শ করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে ওরা। যেভাবেই হোক সবার আগে শবটাকে সরিয়ে ফেলতে হবে ওখান থেকে। তারপর সটকে পড়বে ওরা যে যেদিকে পারে।
রাতের অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলে প্রকৃতির এক মোহমায়ার ভেতর তলিয়ে যেতে থাকে ওরা। দূরের একটা গাছের নিচে জমাট বাঁধা অন্ধকার থেকে এক থোকা ম্লান আলোর ঝরনা নেমে গেছে কাছাকাছি একটা নদীর অন্ধকার গভীর খাতে। দূর থেকে মনে হয় কালো একটা কলস থেকে সাদা জল গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে নদীর ঢাল বেয়ে। রহস্য-নিসর্গের এসব নিপুণ মায়াজাল মিথ্যের এক অলৌকিক ফাঁদ মনে হয় ওদের কাছে। যা কিছু আহরণ করা যায় প্রকৃতি থেকে তার মূল্য আছে। মিনিমাগনায় বিলানো এসবের আর কী মূল্য! এখন বাঁচার চেষ্টা করতে হবে ওদের। হেঁয়ালি প্রকৃতির ঐসব নিবিড় নৈকট্য থেকে বেরিয়ে আসে ওরা।
অনেকক্ষণ চেষ্টা করে একটা এম্বুলেন্স ছিনিয়ে নিয়ে আসে ওরা। চালক ও সহকারীকে বেঁধে পেছনে শুইয়ে রাখে। মেয়েটাকে ঢুকিয়ে দেয় ওদের মাঝখানে। ওদের একজন চালক, একজন সহকারী ও বাকি দুজন রোগীর সঙ্গী হয়ে মৃতকে অসুস্থ রোগী সাজিয়ে গাড়িতে তোলে। নদীর যে বাঁকে রাস্তাটা ছুঁই ছুঁই সেখানে এম্বুলেন্সটা থামায়। তার পর নদীতে ছুঁড়ে ফেলে ওদের দলনেতা, একসময়ের প্রবল প্রতাপশালী ঐ কোপা মাছুমকে।
অবশেষে হাঁফ ছাড়ে ওরা। আর ঠিক তখনি মাটি ফুঁড়ে যেন একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামে ওদের সামনে! তাৎক্ষণিকভাবে যে প্রতিক্রিয়াটি ধ্বনিত হয় ওদের ভেতর: হায়, ধরা পড়ে গেলাম শেষপর্যন্ত! মানে মৃত্যুদ-, অথবা আজীবন কারাদ-। যার অর্থ ঐ মৃত্যুদ-ই!
মুহূর্তের জন্য রাতের প্রকৃতি আবার আচ্ছন্ন করে ফেলে ওদের। শাবানার কোমল করপুটের মতো একটা সুন্দর চাঁদ জেগে রয়েছে এখন রাতের আকাশে। অমলিন ঐ চাঁদের চারপাশে কি বিস্তীর্ণ ঐ কালো শূন্যতা! গাভীর চোখের মতো টলটলে নদীর জলেও আকাশের ছায়া। তারাদের জ্যামিতিক বিন্যাসে কাল্পনিক রাশিগুলো ফুটে রয়েছে। নিজেদের রাশির তারকাগুচ্ছের সন্ধান করে ওরা। আশ্চর্য ঐ রাতটাকে রূপকথার এক রাত বলে মনে হয় ওদের কাছে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর প্রাচীন জ্যোৎস্না নগরীর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় তখন। রাতের ঐ মোহন আবেশ, শিভাজের নেশাকাটা আলস্য, শরীরের রতিতৃপ্ত অবসাদ, কয়েক ঘণ্টা আগে ঘটে যাওয়া ঐসব ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়া, প্রভৃতির এক মিশ্র আবহে ওদের মনে হয়: নাহয় ঘুমোনোই যাক আরেকটু...
হয়তো ঘুমিয়েই পড়ে ওরা।
সবার দৃষ্টি ঝলকে দিয়ে হুঁশ করে মাঝ নদীতে ভেসে ওঠে কিছু একটা! পুলিশের টর্চলাইটের জোরালো আলোর তীর বিদ্ধ করে ওটাকে। কিন্তু কিছুই করার নেই এখন ওদের। ডুবসাঁতারে ওপারে চলে যায় সে।
ঘটনার আকস্মিকতায় অথবা অলৌকিকতায় ওদের সবার ভেতর প্রশান্তির কোমল ছায়া নেমে আসে। আহ্ বন্ধু, বাঁচিয়ে দিলে আমাদের। সব কিছু ভুলে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে ওরা। ওপার থেকে হাত নেড়ে জানায় সে, বেঁচে আছে। একটু পরেই ঐ বিকেলের মৃত্যুভীতিটা আবার জড়িয়ে ধরে ওদের। তার অর্থ যে-কোনো একজনের অবধারিত মৃত্যু!
তাহলে কে সে? সবাই ভাবে কোনো অবস্থায়ই সে নয়। তাহলে? সমস্যাটা রয়েই গেল। যদিও ওটা এখন এ মুহূর্তে ওপারে। ওকে যখন মৃত মনে হয়েছিল, আবার যখন জীবিত হয়ে উঠল, বিষয়টা তো একই রকম রয়ে গেল!
‘লাশ উঠাও।’ পুলিশ অফিসারের কঠিন ঐ নির্দেশ বজ্রের মতো আকাশ থেকে ঘোষিত হয়ে আসে যেন। সিপাইরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ‘লাশ কোথায় স্যার, ও তো জ্যান্ত, সাঁতরে ওপারে যেয়ে হাত নাড়ল।’ আবার গর্জে উঠে অফিসার, ‘আহাম্মক, ওটা আমার এলাকা না। এ পারের লাশটার কথা বলছি আমি।
অন্ধকার ভেঙ্গেচুরে নদীতীরের দৃশ্যটা এখন কালো বাদুড়ের অলৌকিক পাখার মতো ছটফট করে। কোথায় লাশ?
ততক্ষণে চাঁদ লুকিয়েছে আকাশের গোপন আলিঙ্গনের ভেতর। মেঘের বন্ধনী থেকে উপচে পড়া কিছুটা জ্যোৎস্না পরিবেশটাকে আরো ভৌতিক করে তোলে। সত্য-অসত্যের দোলার ভেতর দুলতে থেকে মানুষগুলো বুঝতেই পারেনি মেয়েটা কখন আবার আরেকটা লাশ বানিয়ে ফেলেছে নিজেকে!