মূল: হানান আল-শাইখ অনুবাদ: লুনা রাহনুমা
হানান আল-শাইখ
মরুভূমিতে একটা গাড়ি গড়াচ্ছে। গাড়িটা একটা মরা পাখির মতো গড়াতে গড়াতে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার আগে উল্টে গেল। দূর থেকে এটাকে একটা মরীচিকা মনে হতে পারে, যেমন মরীচিকা দেখা যায় মরুভূমিতে সৃষ্ট সবুজের একটুখানি প্রাণবন্ত মাঠের মতোবিস্তীর্ণ ভূমিতে- যে দৃশ্য মানুষের চোখ সহ্য করতে পারে না।
এই সময় তপ্ত বালুর উপর রঙের আরেকটা বড় ছিটা পড়ল। সেই ছিটা থেকে এক যুবক বেরিয়ে এলো। প্রচ- গতিতে যুবক সবুজ জায়গাটার দিকে ছুটে যাচ্ছে। এই নিস্তব্ধ ভূমিতে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেখানে দিনের পর দিন অক্লান্তভাবে বালু পোড়ানো সূর্য, মরীচিকার তীব্র ঝিকিমিকি উজ্জ্বলতা, হঠাৎ দমকা বাতাস আর রাতের হিম ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
যে রঙের ছিটার কথা বলা হলো, সেটা তৈরি হয়েছে মরুভূমির শূন্য ভূদৃশ্যে টাঙানো কয়েকটি তাঁবুর মাধ্যমে। এই তাঁবুগুলোর বাসিন্দা একদল ভাড়াটে শ্রমিক, যারা বিস্বাদ বালিতে ঘুরে বেড়ায় অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণির সন্ধানে; যারা এখানে শান্তিপূর্ণ, নিরুপদ্রব জীবনযাপন করে, কেবল মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে কিছু খারাপ স্বপ্ন এসে যাদের বিরক্ত করে। এসব স্বপ্ন সাধারণত তাদের কাজের হতাশা থেকেই আসে, যখন তাদের অনেক পরিশ্রমে বিছিয়ে রাখা ফাঁদ থেকে সাপ ও টিকটিকিগুলো পালিয়ে যায়।
জসিমই প্রথম সবুজ বিন্দুতে এসে পৌঁছল, যে বিন্দুটা এখনো কাঁপছে আর যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কিছু দূরে একটা উট দাঁড়িয়ে আছে আর ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভয়ঙ্কর গতিতে ওটা বালিতে আঘাত করছে। উটের ঘড়ঘড় শব্দের তলায় ডুবে গেছে গাড়ি থেকে বালুর উপর পড়তে থাকা তরলের টিপটিপ শব্দ, আর গাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা বিভিন্ন ছন্দ ও সুরের ক্ষীণ আর্তনাদ।
জসিম হয়ত অনির্দিষ্টকাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল, যন্ত্রটার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল, যেন ওটা এক প্রজাতির টিকটিকি যা সে আগে কখনো দেখেনি। হঠাৎ গোঙানির শব্দ শুনতে পেল সে আর গাড়ির যাত্রীদের একজনকে জানালা দিয়ে টেনে বের করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু গাড়ির দরজায় লেগে থাকা ভাঙা কাঁচের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সে সংকল্প পরিত্যাগ করল। আসলে কোনো লাভ হতো না, কারণ জানালাটি এত ছোট যে গাড়ির ভিতরের লোকটার বিশাল শরীর ওটা দিয়ে সহজে বের করা সম্ভব হতো না।
এতক্ষণে জসিমের এক সহকর্মী দৌড়ে চলে এসেছে। তারা দুজনে মিলে ধাক্কা দিয়ে গাড়িটাকে মোটামুটি সোজা করতে পারল। দুমড়ানো একটা দরজা খুলতেই পিছনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসা নারীটিকে দেখে তারা একমুহূর্তের জন্য থমকে গেল। গাড়ির ভিতরে নারীটি মৃদু গোঙাচ্ছে, তার পরনের কাপড় এলোমেলো হয়ে বেঁকে যাওয়া দেহের উপরে উঠে গেছে, আর পেটের একটা বড় অংশ উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে, চুলের একটা মোটা বেণী নারীর মুখ আর বাহুর উপরে পড়েছে, কানে সোনার দুল দেখা যাচ্ছে। জসিম তার সঙ্গীর দিকে এক মুহূর্ত তাকাল। তারপর তারা দুজন পারস্পরিক নীরব সম্মতিতে এইমাত্র যা দেখেছে সেটা উপেক্ষা করে গাড়ির ড্রাইভারটাকে টেনে বের করতে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল, যাকে এখন মৃত মনে হচ্ছে। তারা একে অপরের দৃষ্টিকে ধরে ফেলল, যখন তারা পিছনের সিটে কুঁচকে পড়ে থাকা মহিলার খালি পেটের দিকে তাকিয়েছিল। অবশ্য তারা বাচ্চাটাকে বের করে আনতে সক্ষম হলো, বাচ্চাটা সম্ভবত মহিলার পাশে বসেছিল আর গাড়ি এক্সিডেন্টের সময় জোর শক্তিতে দরজার সাথে ধাক্কা খেয়েছিল ফলে বাচ্চার মাথার খুলি আর ঘিলুর কিছু অংশ পাশের জানালায় গিয়ে পড়েছে।
তারা দুজন অবিচলভাবে কাজ করে যেতে থাকল। অল্প সময়ের মধ্যে গাড়ির ভিতর থেকে অবশিষ্ট যাত্রীদের বের করে সূর্যের পূর্ণ আলোয় জ্বলন্ত বালির উপর শুইয়ে দিল, যার ফলে আহতদের শরীর থেকে রক্ত আরও তীব্রভাবে প্রবাহিত হতে পারল আর যা তাদের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করল। চারদিক শান্ত, উটটা এখন পা ছোঁড়াছুড়ি থামিয়ে নিশ্চল পড়ে আছে। গাড়ির ভিতর থেকে নারীর গোঙানির শব্দ এখনও শোনা যাচ্ছে, আগের চেয়ে আরো স্পষ্টভাবে।
দুই যুবক বেশ স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থেকে, একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে, অব্যক্ত কথা বিনিময় করল। কিন্তু তারা অন্য কিছু করল না, শুধু গাড়ির নিচ থেকে আরো জোরে গড়িয়ে নামতে থাকা তরলধারা এড়াতে খানিকটা সরে দাঁড়াল। তরল ¯্রােতের গতি বাড়ার সাথে সাথে তারা আরো দূরে সরে যেতে লাগল, যতক্ষণ না জসিম সঙ্গীকে কোনো সংকেত না দিয়েই আচমকা গাড়িটার দিকে ছুটে গেল। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সে গাড়ির ভিতরে গোঙাতে থাকা মহিলার শরীরের উপরের অর্ধেক অংশে ঝুঁকে পড়ল আর তাকে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু আরো একবার জসিম এই নারীর নগ্ন পেট ও তার বাদামি মাংস ও তার নাভির চারপাশে সূক্ষ্ম চুলের হালকা বিচ্ছুরণ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। এর আগে কখনো সে কোনো নারীর নগ্নতা দেখেনি। মাথা থেকে কালো মেহেদির নকশা আঁকা পা পর্যন্ত ঢেকে রাখা নারী ছাড়া সে কোনো নারী দেখেনি, যাদের শুধু চোখ দুটো মাছ ধরার জালে আটকা পড়া দুটি পোকার মতো বেরিয়ে থাকত। তাই জসিম ছিটকে গাড়ি থেকে একটুখানি পিছিয়ে গেল। তারপর, যেন সে হঠাৎ হৃৎপি-ে এক যন্ত্রণা অনুভব করল, এক হাতের তালু দিয়ে অন্য হাতের তালুতে আঘাত করে, আর পিছিয়ে গিয়েছে বলে অনুতপ্ত হলো। হতাশ হয়ে ও নিরাশায় বিভ্রান্ত হয়ে সে তার সঙ্গীর দিকে তাকাল। নিঃশব্দে জসিম সঙ্গীর কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানায় যাতে সে ফিরে গিয়ে গাড়ি থেকে এখনো জীবিত মহিলাটাকে বের করে আনতে সাহস জোগাড় করতে পারে।
কোনো কথা না বলে, নড়াচড়া না করে, তারা দুজন কিছুক্ষণ একসাথে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু তারপরপরই তীব্র গন্ধযুক্ত তরল তাদের হাত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব কেড়ে নিল, দাহ্য তরল স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্বলে উঠেছে আর এক ঝলকে সেটা দুমড়ানো গাড়িটাকে নিজের শুষ্কতায় এক জ্বলন্ত মরীচিকায় রূপান্তরিত করেছে: যে তরল অনেকদিন পানি পায়নি। বিস্ফোরণের তীব্রতা দুই যুবককে গাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনটি মৃতদেহ আগুনের নাগালের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার কাজে। আর আগুন যখন গাড়ির ভিতরের মহিলাকে গ্রাস করছে তখন তারা সেদিকে তাকাতে বা না শুনতে পাওয়ার চেষ্টা করল। যদিও মহিলার পেটের স্পর্শ জসিমের মনে থাকবে আরো অনেকদিন।
হানান আল-শাইখ
সূর্যের দেশ
মূল: হানান আল-শাইখ অনুবাদ: লুনা রাহনুমা
মরুভূমিতে একটা গাড়ি গড়াচ্ছে। গাড়িটা একটা মরা পাখির মতো গড়াতে গড়াতে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার আগে উল্টে গেল। দূর থেকে এটাকে একটা মরীচিকা মনে হতে পারে, যেমন মরীচিকা দেখা যায় মরুভূমিতে সৃষ্ট সবুজের একটুখানি প্রাণবন্ত মাঠের মতোবিস্তীর্ণ ভূমিতে- যে দৃশ্য মানুষের চোখ সহ্য করতে পারে না।
এই সময় তপ্ত বালুর উপর রঙের আরেকটা বড় ছিটা পড়ল। সেই ছিটা থেকে এক যুবক বেরিয়ে এলো। প্রচ- গতিতে যুবক সবুজ জায়গাটার দিকে ছুটে যাচ্ছে। এই নিস্তব্ধ ভূমিতে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেখানে দিনের পর দিন অক্লান্তভাবে বালু পোড়ানো সূর্য, মরীচিকার তীব্র ঝিকিমিকি উজ্জ্বলতা, হঠাৎ দমকা বাতাস আর রাতের হিম ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
যে রঙের ছিটার কথা বলা হলো, সেটা তৈরি হয়েছে মরুভূমির শূন্য ভূদৃশ্যে টাঙানো কয়েকটি তাঁবুর মাধ্যমে। এই তাঁবুগুলোর বাসিন্দা একদল ভাড়াটে শ্রমিক, যারা বিস্বাদ বালিতে ঘুরে বেড়ায় অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণির সন্ধানে; যারা এখানে শান্তিপূর্ণ, নিরুপদ্রব জীবনযাপন করে, কেবল মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে কিছু খারাপ স্বপ্ন এসে যাদের বিরক্ত করে। এসব স্বপ্ন সাধারণত তাদের কাজের হতাশা থেকেই আসে, যখন তাদের অনেক পরিশ্রমে বিছিয়ে রাখা ফাঁদ থেকে সাপ ও টিকটিকিগুলো পালিয়ে যায়।
জসিমই প্রথম সবুজ বিন্দুতে এসে পৌঁছল, যে বিন্দুটা এখনো কাঁপছে আর যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কিছু দূরে একটা উট দাঁড়িয়ে আছে আর ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভয়ঙ্কর গতিতে ওটা বালিতে আঘাত করছে। উটের ঘড়ঘড় শব্দের তলায় ডুবে গেছে গাড়ি থেকে বালুর উপর পড়তে থাকা তরলের টিপটিপ শব্দ, আর গাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা বিভিন্ন ছন্দ ও সুরের ক্ষীণ আর্তনাদ।
জসিম হয়ত অনির্দিষ্টকাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল, যন্ত্রটার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল, যেন ওটা এক প্রজাতির টিকটিকি যা সে আগে কখনো দেখেনি। হঠাৎ গোঙানির শব্দ শুনতে পেল সে আর গাড়ির যাত্রীদের একজনকে জানালা দিয়ে টেনে বের করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু গাড়ির দরজায় লেগে থাকা ভাঙা কাঁচের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সে সংকল্প পরিত্যাগ করল। আসলে কোনো লাভ হতো না, কারণ জানালাটি এত ছোট যে গাড়ির ভিতরের লোকটার বিশাল শরীর ওটা দিয়ে সহজে বের করা সম্ভব হতো না।
এতক্ষণে জসিমের এক সহকর্মী দৌড়ে চলে এসেছে। তারা দুজনে মিলে ধাক্কা দিয়ে গাড়িটাকে মোটামুটি সোজা করতে পারল। দুমড়ানো একটা দরজা খুলতেই পিছনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসা নারীটিকে দেখে তারা একমুহূর্তের জন্য থমকে গেল। গাড়ির ভিতরে নারীটি মৃদু গোঙাচ্ছে, তার পরনের কাপড় এলোমেলো হয়ে বেঁকে যাওয়া দেহের উপরে উঠে গেছে, আর পেটের একটা বড় অংশ উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে, চুলের একটা মোটা বেণী নারীর মুখ আর বাহুর উপরে পড়েছে, কানে সোনার দুল দেখা যাচ্ছে। জসিম তার সঙ্গীর দিকে এক মুহূর্ত তাকাল। তারপর তারা দুজন পারস্পরিক নীরব সম্মতিতে এইমাত্র যা দেখেছে সেটা উপেক্ষা করে গাড়ির ড্রাইভারটাকে টেনে বের করতে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল, যাকে এখন মৃত মনে হচ্ছে। তারা একে অপরের দৃষ্টিকে ধরে ফেলল, যখন তারা পিছনের সিটে কুঁচকে পড়ে থাকা মহিলার খালি পেটের দিকে তাকিয়েছিল। অবশ্য তারা বাচ্চাটাকে বের করে আনতে সক্ষম হলো, বাচ্চাটা সম্ভবত মহিলার পাশে বসেছিল আর গাড়ি এক্সিডেন্টের সময় জোর শক্তিতে দরজার সাথে ধাক্কা খেয়েছিল ফলে বাচ্চার মাথার খুলি আর ঘিলুর কিছু অংশ পাশের জানালায় গিয়ে পড়েছে।
তারা দুজন অবিচলভাবে কাজ করে যেতে থাকল। অল্প সময়ের মধ্যে গাড়ির ভিতর থেকে অবশিষ্ট যাত্রীদের বের করে সূর্যের পূর্ণ আলোয় জ্বলন্ত বালির উপর শুইয়ে দিল, যার ফলে আহতদের শরীর থেকে রক্ত আরও তীব্রভাবে প্রবাহিত হতে পারল আর যা তাদের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করল। চারদিক শান্ত, উটটা এখন পা ছোঁড়াছুড়ি থামিয়ে নিশ্চল পড়ে আছে। গাড়ির ভিতর থেকে নারীর গোঙানির শব্দ এখনও শোনা যাচ্ছে, আগের চেয়ে আরো স্পষ্টভাবে।
দুই যুবক বেশ স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থেকে, একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে, অব্যক্ত কথা বিনিময় করল। কিন্তু তারা অন্য কিছু করল না, শুধু গাড়ির নিচ থেকে আরো জোরে গড়িয়ে নামতে থাকা তরলধারা এড়াতে খানিকটা সরে দাঁড়াল। তরল ¯্রােতের গতি বাড়ার সাথে সাথে তারা আরো দূরে সরে যেতে লাগল, যতক্ষণ না জসিম সঙ্গীকে কোনো সংকেত না দিয়েই আচমকা গাড়িটার দিকে ছুটে গেল। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সে গাড়ির ভিতরে গোঙাতে থাকা মহিলার শরীরের উপরের অর্ধেক অংশে ঝুঁকে পড়ল আর তাকে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু আরো একবার জসিম এই নারীর নগ্ন পেট ও তার বাদামি মাংস ও তার নাভির চারপাশে সূক্ষ্ম চুলের হালকা বিচ্ছুরণ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। এর আগে কখনো সে কোনো নারীর নগ্নতা দেখেনি। মাথা থেকে কালো মেহেদির নকশা আঁকা পা পর্যন্ত ঢেকে রাখা নারী ছাড়া সে কোনো নারী দেখেনি, যাদের শুধু চোখ দুটো মাছ ধরার জালে আটকা পড়া দুটি পোকার মতো বেরিয়ে থাকত। তাই জসিম ছিটকে গাড়ি থেকে একটুখানি পিছিয়ে গেল। তারপর, যেন সে হঠাৎ হৃৎপি-ে এক যন্ত্রণা অনুভব করল, এক হাতের তালু দিয়ে অন্য হাতের তালুতে আঘাত করে, আর পিছিয়ে গিয়েছে বলে অনুতপ্ত হলো। হতাশ হয়ে ও নিরাশায় বিভ্রান্ত হয়ে সে তার সঙ্গীর দিকে তাকাল। নিঃশব্দে জসিম সঙ্গীর কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানায় যাতে সে ফিরে গিয়ে গাড়ি থেকে এখনো জীবিত মহিলাটাকে বের করে আনতে সাহস জোগাড় করতে পারে।
কোনো কথা না বলে, নড়াচড়া না করে, তারা দুজন কিছুক্ষণ একসাথে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু তারপরপরই তীব্র গন্ধযুক্ত তরল তাদের হাত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব কেড়ে নিল, দাহ্য তরল স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্বলে উঠেছে আর এক ঝলকে সেটা দুমড়ানো গাড়িটাকে নিজের শুষ্কতায় এক জ্বলন্ত মরীচিকায় রূপান্তরিত করেছে: যে তরল অনেকদিন পানি পায়নি। বিস্ফোরণের তীব্রতা দুই যুবককে গাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনটি মৃতদেহ আগুনের নাগালের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার কাজে। আর আগুন যখন গাড়ির ভিতরের মহিলাকে গ্রাস করছে তখন তারা সেদিকে তাকাতে বা না শুনতে পাওয়ার চেষ্টা করল। যদিও মহিলার পেটের স্পর্শ জসিমের মনে থাকবে আরো অনেকদিন।
লেখক পরিচিতি:
হানান আল-শাইখ সমসাময়িক আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রশংসিত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের একজন, যার রচনা ২১টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখন বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি লেবাননের বৈরুতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ১২ নভেম্বর। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ৮ এবং রয়েছে কয়েকটি ছোটগল্পের সংকলন। এই গল্পটি আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন: ক্যাথরিন কোবহাম।
হানান আল-শাইখ সমসাময়িক আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রশংসিত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের একজন, যার রচনা ২১টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখন বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি লেবাননের বৈরুতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ১২ নভেম্বর। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ৮ এবং রয়েছে কয়েকটি ছোটগল্পের সংকলন। এই গল্পটি আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন: ক্যাথরিন কোবহাম।
মূল: হানান আল-শাইখ অনুবাদ: লুনা রাহনুমা
হানান আল-শাইখ
বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
মরুভূমিতে একটা গাড়ি গড়াচ্ছে। গাড়িটা একটা মরা পাখির মতো গড়াতে গড়াতে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার আগে উল্টে গেল। দূর থেকে এটাকে একটা মরীচিকা মনে হতে পারে, যেমন মরীচিকা দেখা যায় মরুভূমিতে সৃষ্ট সবুজের একটুখানি প্রাণবন্ত মাঠের মতোবিস্তীর্ণ ভূমিতে- যে দৃশ্য মানুষের চোখ সহ্য করতে পারে না।
এই সময় তপ্ত বালুর উপর রঙের আরেকটা বড় ছিটা পড়ল। সেই ছিটা থেকে এক যুবক বেরিয়ে এলো। প্রচ- গতিতে যুবক সবুজ জায়গাটার দিকে ছুটে যাচ্ছে। এই নিস্তব্ধ ভূমিতে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেখানে দিনের পর দিন অক্লান্তভাবে বালু পোড়ানো সূর্য, মরীচিকার তীব্র ঝিকিমিকি উজ্জ্বলতা, হঠাৎ দমকা বাতাস আর রাতের হিম ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
যে রঙের ছিটার কথা বলা হলো, সেটা তৈরি হয়েছে মরুভূমির শূন্য ভূদৃশ্যে টাঙানো কয়েকটি তাঁবুর মাধ্যমে। এই তাঁবুগুলোর বাসিন্দা একদল ভাড়াটে শ্রমিক, যারা বিস্বাদ বালিতে ঘুরে বেড়ায় অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণির সন্ধানে; যারা এখানে শান্তিপূর্ণ, নিরুপদ্রব জীবনযাপন করে, কেবল মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে কিছু খারাপ স্বপ্ন এসে যাদের বিরক্ত করে। এসব স্বপ্ন সাধারণত তাদের কাজের হতাশা থেকেই আসে, যখন তাদের অনেক পরিশ্রমে বিছিয়ে রাখা ফাঁদ থেকে সাপ ও টিকটিকিগুলো পালিয়ে যায়।
জসিমই প্রথম সবুজ বিন্দুতে এসে পৌঁছল, যে বিন্দুটা এখনো কাঁপছে আর যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কিছু দূরে একটা উট দাঁড়িয়ে আছে আর ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভয়ঙ্কর গতিতে ওটা বালিতে আঘাত করছে। উটের ঘড়ঘড় শব্দের তলায় ডুবে গেছে গাড়ি থেকে বালুর উপর পড়তে থাকা তরলের টিপটিপ শব্দ, আর গাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা বিভিন্ন ছন্দ ও সুরের ক্ষীণ আর্তনাদ।
জসিম হয়ত অনির্দিষ্টকাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল, যন্ত্রটার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল, যেন ওটা এক প্রজাতির টিকটিকি যা সে আগে কখনো দেখেনি। হঠাৎ গোঙানির শব্দ শুনতে পেল সে আর গাড়ির যাত্রীদের একজনকে জানালা দিয়ে টেনে বের করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু গাড়ির দরজায় লেগে থাকা ভাঙা কাঁচের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সে সংকল্প পরিত্যাগ করল। আসলে কোনো লাভ হতো না, কারণ জানালাটি এত ছোট যে গাড়ির ভিতরের লোকটার বিশাল শরীর ওটা দিয়ে সহজে বের করা সম্ভব হতো না।
এতক্ষণে জসিমের এক সহকর্মী দৌড়ে চলে এসেছে। তারা দুজনে মিলে ধাক্কা দিয়ে গাড়িটাকে মোটামুটি সোজা করতে পারল। দুমড়ানো একটা দরজা খুলতেই পিছনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসা নারীটিকে দেখে তারা একমুহূর্তের জন্য থমকে গেল। গাড়ির ভিতরে নারীটি মৃদু গোঙাচ্ছে, তার পরনের কাপড় এলোমেলো হয়ে বেঁকে যাওয়া দেহের উপরে উঠে গেছে, আর পেটের একটা বড় অংশ উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে, চুলের একটা মোটা বেণী নারীর মুখ আর বাহুর উপরে পড়েছে, কানে সোনার দুল দেখা যাচ্ছে। জসিম তার সঙ্গীর দিকে এক মুহূর্ত তাকাল। তারপর তারা দুজন পারস্পরিক নীরব সম্মতিতে এইমাত্র যা দেখেছে সেটা উপেক্ষা করে গাড়ির ড্রাইভারটাকে টেনে বের করতে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল, যাকে এখন মৃত মনে হচ্ছে। তারা একে অপরের দৃষ্টিকে ধরে ফেলল, যখন তারা পিছনের সিটে কুঁচকে পড়ে থাকা মহিলার খালি পেটের দিকে তাকিয়েছিল। অবশ্য তারা বাচ্চাটাকে বের করে আনতে সক্ষম হলো, বাচ্চাটা সম্ভবত মহিলার পাশে বসেছিল আর গাড়ি এক্সিডেন্টের সময় জোর শক্তিতে দরজার সাথে ধাক্কা খেয়েছিল ফলে বাচ্চার মাথার খুলি আর ঘিলুর কিছু অংশ পাশের জানালায় গিয়ে পড়েছে।
তারা দুজন অবিচলভাবে কাজ করে যেতে থাকল। অল্প সময়ের মধ্যে গাড়ির ভিতর থেকে অবশিষ্ট যাত্রীদের বের করে সূর্যের পূর্ণ আলোয় জ্বলন্ত বালির উপর শুইয়ে দিল, যার ফলে আহতদের শরীর থেকে রক্ত আরও তীব্রভাবে প্রবাহিত হতে পারল আর যা তাদের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করল। চারদিক শান্ত, উটটা এখন পা ছোঁড়াছুড়ি থামিয়ে নিশ্চল পড়ে আছে। গাড়ির ভিতর থেকে নারীর গোঙানির শব্দ এখনও শোনা যাচ্ছে, আগের চেয়ে আরো স্পষ্টভাবে।
দুই যুবক বেশ স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থেকে, একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে, অব্যক্ত কথা বিনিময় করল। কিন্তু তারা অন্য কিছু করল না, শুধু গাড়ির নিচ থেকে আরো জোরে গড়িয়ে নামতে থাকা তরলধারা এড়াতে খানিকটা সরে দাঁড়াল। তরল ¯্রােতের গতি বাড়ার সাথে সাথে তারা আরো দূরে সরে যেতে লাগল, যতক্ষণ না জসিম সঙ্গীকে কোনো সংকেত না দিয়েই আচমকা গাড়িটার দিকে ছুটে গেল। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সে গাড়ির ভিতরে গোঙাতে থাকা মহিলার শরীরের উপরের অর্ধেক অংশে ঝুঁকে পড়ল আর তাকে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু আরো একবার জসিম এই নারীর নগ্ন পেট ও তার বাদামি মাংস ও তার নাভির চারপাশে সূক্ষ্ম চুলের হালকা বিচ্ছুরণ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। এর আগে কখনো সে কোনো নারীর নগ্নতা দেখেনি। মাথা থেকে কালো মেহেদির নকশা আঁকা পা পর্যন্ত ঢেকে রাখা নারী ছাড়া সে কোনো নারী দেখেনি, যাদের শুধু চোখ দুটো মাছ ধরার জালে আটকা পড়া দুটি পোকার মতো বেরিয়ে থাকত। তাই জসিম ছিটকে গাড়ি থেকে একটুখানি পিছিয়ে গেল। তারপর, যেন সে হঠাৎ হৃৎপি-ে এক যন্ত্রণা অনুভব করল, এক হাতের তালু দিয়ে অন্য হাতের তালুতে আঘাত করে, আর পিছিয়ে গিয়েছে বলে অনুতপ্ত হলো। হতাশ হয়ে ও নিরাশায় বিভ্রান্ত হয়ে সে তার সঙ্গীর দিকে তাকাল। নিঃশব্দে জসিম সঙ্গীর কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানায় যাতে সে ফিরে গিয়ে গাড়ি থেকে এখনো জীবিত মহিলাটাকে বের করে আনতে সাহস জোগাড় করতে পারে।
কোনো কথা না বলে, নড়াচড়া না করে, তারা দুজন কিছুক্ষণ একসাথে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু তারপরপরই তীব্র গন্ধযুক্ত তরল তাদের হাত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব কেড়ে নিল, দাহ্য তরল স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্বলে উঠেছে আর এক ঝলকে সেটা দুমড়ানো গাড়িটাকে নিজের শুষ্কতায় এক জ্বলন্ত মরীচিকায় রূপান্তরিত করেছে: যে তরল অনেকদিন পানি পায়নি। বিস্ফোরণের তীব্রতা দুই যুবককে গাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনটি মৃতদেহ আগুনের নাগালের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার কাজে। আর আগুন যখন গাড়ির ভিতরের মহিলাকে গ্রাস করছে তখন তারা সেদিকে তাকাতে বা না শুনতে পাওয়ার চেষ্টা করল। যদিও মহিলার পেটের স্পর্শ জসিমের মনে থাকবে আরো অনেকদিন।
হানান আল-শাইখ
সূর্যের দেশ
মূল: হানান আল-শাইখ অনুবাদ: লুনা রাহনুমা
মরুভূমিতে একটা গাড়ি গড়াচ্ছে। গাড়িটা একটা মরা পাখির মতো গড়াতে গড়াতে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার আগে উল্টে গেল। দূর থেকে এটাকে একটা মরীচিকা মনে হতে পারে, যেমন মরীচিকা দেখা যায় মরুভূমিতে সৃষ্ট সবুজের একটুখানি প্রাণবন্ত মাঠের মতোবিস্তীর্ণ ভূমিতে- যে দৃশ্য মানুষের চোখ সহ্য করতে পারে না।
এই সময় তপ্ত বালুর উপর রঙের আরেকটা বড় ছিটা পড়ল। সেই ছিটা থেকে এক যুবক বেরিয়ে এলো। প্রচ- গতিতে যুবক সবুজ জায়গাটার দিকে ছুটে যাচ্ছে। এই নিস্তব্ধ ভূমিতে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেখানে দিনের পর দিন অক্লান্তভাবে বালু পোড়ানো সূর্য, মরীচিকার তীব্র ঝিকিমিকি উজ্জ্বলতা, হঠাৎ দমকা বাতাস আর রাতের হিম ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
যে রঙের ছিটার কথা বলা হলো, সেটা তৈরি হয়েছে মরুভূমির শূন্য ভূদৃশ্যে টাঙানো কয়েকটি তাঁবুর মাধ্যমে। এই তাঁবুগুলোর বাসিন্দা একদল ভাড়াটে শ্রমিক, যারা বিস্বাদ বালিতে ঘুরে বেড়ায় অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণির সন্ধানে; যারা এখানে শান্তিপূর্ণ, নিরুপদ্রব জীবনযাপন করে, কেবল মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে কিছু খারাপ স্বপ্ন এসে যাদের বিরক্ত করে। এসব স্বপ্ন সাধারণত তাদের কাজের হতাশা থেকেই আসে, যখন তাদের অনেক পরিশ্রমে বিছিয়ে রাখা ফাঁদ থেকে সাপ ও টিকটিকিগুলো পালিয়ে যায়।
জসিমই প্রথম সবুজ বিন্দুতে এসে পৌঁছল, যে বিন্দুটা এখনো কাঁপছে আর যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কিছু দূরে একটা উট দাঁড়িয়ে আছে আর ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভয়ঙ্কর গতিতে ওটা বালিতে আঘাত করছে। উটের ঘড়ঘড় শব্দের তলায় ডুবে গেছে গাড়ি থেকে বালুর উপর পড়তে থাকা তরলের টিপটিপ শব্দ, আর গাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা বিভিন্ন ছন্দ ও সুরের ক্ষীণ আর্তনাদ।
জসিম হয়ত অনির্দিষ্টকাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল, যন্ত্রটার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল, যেন ওটা এক প্রজাতির টিকটিকি যা সে আগে কখনো দেখেনি। হঠাৎ গোঙানির শব্দ শুনতে পেল সে আর গাড়ির যাত্রীদের একজনকে জানালা দিয়ে টেনে বের করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু গাড়ির দরজায় লেগে থাকা ভাঙা কাঁচের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সে সংকল্প পরিত্যাগ করল। আসলে কোনো লাভ হতো না, কারণ জানালাটি এত ছোট যে গাড়ির ভিতরের লোকটার বিশাল শরীর ওটা দিয়ে সহজে বের করা সম্ভব হতো না।
এতক্ষণে জসিমের এক সহকর্মী দৌড়ে চলে এসেছে। তারা দুজনে মিলে ধাক্কা দিয়ে গাড়িটাকে মোটামুটি সোজা করতে পারল। দুমড়ানো একটা দরজা খুলতেই পিছনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসা নারীটিকে দেখে তারা একমুহূর্তের জন্য থমকে গেল। গাড়ির ভিতরে নারীটি মৃদু গোঙাচ্ছে, তার পরনের কাপড় এলোমেলো হয়ে বেঁকে যাওয়া দেহের উপরে উঠে গেছে, আর পেটের একটা বড় অংশ উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে, চুলের একটা মোটা বেণী নারীর মুখ আর বাহুর উপরে পড়েছে, কানে সোনার দুল দেখা যাচ্ছে। জসিম তার সঙ্গীর দিকে এক মুহূর্ত তাকাল। তারপর তারা দুজন পারস্পরিক নীরব সম্মতিতে এইমাত্র যা দেখেছে সেটা উপেক্ষা করে গাড়ির ড্রাইভারটাকে টেনে বের করতে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল, যাকে এখন মৃত মনে হচ্ছে। তারা একে অপরের দৃষ্টিকে ধরে ফেলল, যখন তারা পিছনের সিটে কুঁচকে পড়ে থাকা মহিলার খালি পেটের দিকে তাকিয়েছিল। অবশ্য তারা বাচ্চাটাকে বের করে আনতে সক্ষম হলো, বাচ্চাটা সম্ভবত মহিলার পাশে বসেছিল আর গাড়ি এক্সিডেন্টের সময় জোর শক্তিতে দরজার সাথে ধাক্কা খেয়েছিল ফলে বাচ্চার মাথার খুলি আর ঘিলুর কিছু অংশ পাশের জানালায় গিয়ে পড়েছে।
তারা দুজন অবিচলভাবে কাজ করে যেতে থাকল। অল্প সময়ের মধ্যে গাড়ির ভিতর থেকে অবশিষ্ট যাত্রীদের বের করে সূর্যের পূর্ণ আলোয় জ্বলন্ত বালির উপর শুইয়ে দিল, যার ফলে আহতদের শরীর থেকে রক্ত আরও তীব্রভাবে প্রবাহিত হতে পারল আর যা তাদের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করল। চারদিক শান্ত, উটটা এখন পা ছোঁড়াছুড়ি থামিয়ে নিশ্চল পড়ে আছে। গাড়ির ভিতর থেকে নারীর গোঙানির শব্দ এখনও শোনা যাচ্ছে, আগের চেয়ে আরো স্পষ্টভাবে।
দুই যুবক বেশ স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থেকে, একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে, অব্যক্ত কথা বিনিময় করল। কিন্তু তারা অন্য কিছু করল না, শুধু গাড়ির নিচ থেকে আরো জোরে গড়িয়ে নামতে থাকা তরলধারা এড়াতে খানিকটা সরে দাঁড়াল। তরল ¯্রােতের গতি বাড়ার সাথে সাথে তারা আরো দূরে সরে যেতে লাগল, যতক্ষণ না জসিম সঙ্গীকে কোনো সংকেত না দিয়েই আচমকা গাড়িটার দিকে ছুটে গেল। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সে গাড়ির ভিতরে গোঙাতে থাকা মহিলার শরীরের উপরের অর্ধেক অংশে ঝুঁকে পড়ল আর তাকে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু আরো একবার জসিম এই নারীর নগ্ন পেট ও তার বাদামি মাংস ও তার নাভির চারপাশে সূক্ষ্ম চুলের হালকা বিচ্ছুরণ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। এর আগে কখনো সে কোনো নারীর নগ্নতা দেখেনি। মাথা থেকে কালো মেহেদির নকশা আঁকা পা পর্যন্ত ঢেকে রাখা নারী ছাড়া সে কোনো নারী দেখেনি, যাদের শুধু চোখ দুটো মাছ ধরার জালে আটকা পড়া দুটি পোকার মতো বেরিয়ে থাকত। তাই জসিম ছিটকে গাড়ি থেকে একটুখানি পিছিয়ে গেল। তারপর, যেন সে হঠাৎ হৃৎপি-ে এক যন্ত্রণা অনুভব করল, এক হাতের তালু দিয়ে অন্য হাতের তালুতে আঘাত করে, আর পিছিয়ে গিয়েছে বলে অনুতপ্ত হলো। হতাশ হয়ে ও নিরাশায় বিভ্রান্ত হয়ে সে তার সঙ্গীর দিকে তাকাল। নিঃশব্দে জসিম সঙ্গীর কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানায় যাতে সে ফিরে গিয়ে গাড়ি থেকে এখনো জীবিত মহিলাটাকে বের করে আনতে সাহস জোগাড় করতে পারে।
কোনো কথা না বলে, নড়াচড়া না করে, তারা দুজন কিছুক্ষণ একসাথে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু তারপরপরই তীব্র গন্ধযুক্ত তরল তাদের হাত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব কেড়ে নিল, দাহ্য তরল স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্বলে উঠেছে আর এক ঝলকে সেটা দুমড়ানো গাড়িটাকে নিজের শুষ্কতায় এক জ্বলন্ত মরীচিকায় রূপান্তরিত করেছে: যে তরল অনেকদিন পানি পায়নি। বিস্ফোরণের তীব্রতা দুই যুবককে গাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনটি মৃতদেহ আগুনের নাগালের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার কাজে। আর আগুন যখন গাড়ির ভিতরের মহিলাকে গ্রাস করছে তখন তারা সেদিকে তাকাতে বা না শুনতে পাওয়ার চেষ্টা করল। যদিও মহিলার পেটের স্পর্শ জসিমের মনে থাকবে আরো অনেকদিন।
লেখক পরিচিতি:
হানান আল-শাইখ সমসাময়িক আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রশংসিত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের একজন, যার রচনা ২১টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখন বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি লেবাননের বৈরুতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ১২ নভেম্বর। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ৮ এবং রয়েছে কয়েকটি ছোটগল্পের সংকলন। এই গল্পটি আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন: ক্যাথরিন কোবহাম।
হানান আল-শাইখ সমসাময়িক আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রশংসিত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের একজন, যার রচনা ২১টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখন বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি লেবাননের বৈরুতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ১২ নভেম্বর। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ৮ এবং রয়েছে কয়েকটি ছোটগল্পের সংকলন। এই গল্পটি আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন: ক্যাথরিন কোবহাম।