কামরুল ইসলাম
শিল্পী : রাজীব রায়
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কবিতা ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে। একধরনের চৌম্বকীয় আবেশে কবির মন তা শুষে নেয়। Poetry must sing or speak from authentic experience -এই কথাটির যাথার্থ্য অনুধাবন জরুরি। আমাদের বিশাল অখ- সংস্কৃতির পালে বাতাস লাগিয়ে যে লোকসংস্কৃতির উজ্জ্বল শিখাটি তাকে তরতর করে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে, যার ঔজ্জ্বল্য অনেক দূর থেকেও পরিলক্ষিত হয়, তা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। একজন কবি কিংবা শিল্পী লোকসংস্কৃতির রসায়নে নিজেকে প্রস্তুত করার শক্তি অর্জন করতে পারে। নতুন সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই এনার্জি খুবই জরুরি ও অনিবার্য। নাগরিক সংস্কৃতি কিংবা শিল্প-সাহিত্যের বিষয় নিয়ে আমাদের আলোচনায় লোকসাহিত্য কিংবা লোকসংস্কৃতির কথাটা না আনলে আলোচনার অর্থটাই খাটো হয়ে যাবে। স্মর্তব্য, আমরা সেই সাহিত্যের দিকে হেঁটে চলেছি যা নাগরিক কিংবা শিক্ষিত মানুষের সাহিত্য হিসেবেই পরিচিত। আমাদের বিবেচনাটা হতে হবে সংমিশ্রণের- আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে- সেই রঙ মেশানোর শক্তি ও সামর্থ্য সবার থাকে না। মানবিক ঔদার্যের মধ্যে এই শক্তি নিহিত। সেই রকম উদার মানুষের আজ বড়ো অভাব আমাদের। একটি অখ- সংস্কৃতির শক্তিতে আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে। একটি পুরাদস্তুর সিনথেসিসের মধ্য দিয়ে আমাদের এগোনো দরকার। এই বোধটি আরো শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন।
একসময়ের মাঠের রাখাল শাহ আব্দুল করিম অনেক উঁচু মানের কবি হয়ে ওঠেন নিরন্তর জীবনচর্চার মধ্য দিয়ে। আমরা ভদ্র মানুষেরা তাকে মেনে নিতে অনেক সময় ব্যয় করেছি। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে অনেক কবিয়ালের দেখা পাওয়া সম্ভব যারা অনেক উঁচুমানের পদ রচনা করে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ত আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে, এইসব কবিয়ালদের ছোট করে দেখার কোনো অবকাশই নেই। এরা ভদ্র মানুষদের কাছে মূল্যহীন, রাষ্ট্র এদের নেক নজরে দেখে না, এরা নোংরা পোশাকে থাকে বলে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে এরা অপাংক্তেয়। ক্ষুধা এদের নিত্যসঙ্গী, অসুখের সাথে পাঞ্জা লড়ে এইসব লোককবি একদিন ভাঁড়ার শূন্য করে দিয়ে চলে যান আর আমরা শিক্ষিত নাগরিক কবিরা তাদেরই এইসব মালমসলার মধ্যে হাতড়াতে থাকি সেইসব সোনালি আকর। সংগীত ও কবিতার নানামাত্রিক এই আয়োজন- তা যে প্রান্ত থেকেই আসুক না কেন, তার মধ্যে যদি আলো থাকে, স্রোতের নবীন প্রাবল্য থাকে তাহলে তার দিকে আমাদের তাকাতেই হবে। লোকসংস্কৃতির দিকে তাকিয়েই রবীন্দ্রনাথ পূর্ণতা পেয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে সম্মিলিত রবিবাসরের সদস্যদের প্রতি দেওয়া তার সম্ভাসনের অংশবিশেষ:
“আমার গত জীবনের আনন্দ উৎসাহ সাহিত্য, সবই পল্লিজীবনের আবেষ্টনীর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল। আমার জীবনের অনেকদিন নগরের বাইরে পল্লিগ্রামের সুখদুঃখের ভিতর দিয়ে কেটেছে, তখনই আমি আমাদের দেশের সত্যিকার রূপ কোথায় তা অনুভব করতে পেরেছি। যখন আমি পদ্মানদীর তীরে গিয়ে বাস করেছিলাম, তখন গ্রামের লোকদের অভাব অভিযোগ, এবং কতবড় অভাগা যে তারা, তা নিত্য চোখের সম্মুখে দেখে আমার হৃদয়ে একটা বেদনা জেগেছিল। এই-সব গ্রামবাসী যে কত অসহায় তা আমি বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলাম। তখন পল্লীগ্রামের মানুষের জীবনের যে পরিচয় পেয়েছিলাম তাতে এই অনুভব করেছিলাম যে, আমাদের জীবনের ভিত্তি রয়েছে পল্লীতে। আমাদের দেশের মা, দেশের ধাত্রী, পল্লীজননীর স্তন্যরস শুকিয়ে গিয়েছে। গ্রামের লোকদের খাদ্য নেই, স্বাস্থ্য নেই, তারা শুধু একান্ত অসহায়ভাবে করুণ নয়নে চেয়ে থাকে। তাদের সেই বেদনা, সেই অসহায় ভাব আমার অন্তরকে একান্তভাবে ¯পর্শ করেছিল।” (পল্লীপ্রকৃতি)
গ্রাম-বাংলার সত্যিকার রূপ দেখার দৃষ্টি তৈরি না হলে বাঙালির সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তা রচনা সম্ভব নয়। লোকসংস্কৃতির পূর্ণ অধিকারই বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণশক্তি। সুতরাং আমাদের লোককবিদের শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের সাথে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে বাংলা কবিতার আলোকিত দিগন্তের সন্ধানে। এইসব লোককবিদের ওপর কবিতা কিংবা সংগীত নেমে আসে ওহী আসার মতোই অনেকটা, স্বতঃস্ফূর্তভাবে- এইসব কবিতা-গানও মৌলিক শিল্প, সৃজনশক্তির আলোয় বোঝা যায় এদের কালজয়ী অভিজ্ঞান। বাঙালি সংস্কৃতি শতাব্দীর পর শতাব্দী বিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশের বহু সামাজিক গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছে। আমাদের সংমিশ্রিত সংস্কৃতির ছায়া তলে ইসলাম ধর্ম, সনাতন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিশ্চিয়ান ধর্মের প্রভাব রয়েছে। সুতরাং, এই বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যকে যেন আমরা আন্তরিকভাবে লালন করতে পারি- সেই উদারতা ও মানবিকবোধ থেকে সরে যাবার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের লোককাহিনী ও লোককথার ক্ষেত্রেও সেই কথা বলতে চাই আমরা।
৬.
কোনো জাতির নৃতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সেই জাতির প্রাণশক্তি। এই প্রাণশক্তিকে ধ্বংস করে শাসন-শোষণের পথকে সুগম করার লক্ষ্যে সেই জাতির ইতিহাসকে বিকৃত করতে চায় প্রভুত্বকারী বিদেশী শক্তি। কেনিয়ার ঔপন্যাসিক ন্গুগি ওয়া থিয়োংগো সম্রাজ্যবাদ কর্তৃক আফ্রিকার ইতিহাস বিকৃতি প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, ‘প্রভুত্বকারী জাতি বিজিত জাতির ইতিহাসকে বিকৃত করে লেখার প্রয়াস চালায়।’ আফ্রিকার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি উপমহাদেশেও বৃটিশরা ইতিহাস বিকৃতির প্রয়াস চালিয়েছে, আর এই বিকৃতির উদ্দেশ্যও আমাদের অজানা নয়। এই ইতিহাস বিকৃতি একই জাতির মধ্যে শাসক শ্রেণির হাতেও হয়ে থাকে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিষয়টিও এদেশে ঘটেছে এবং ঘটছে বারবার আর তা করা হচ্ছে মূলত বাঙালি সংস্কৃতির একটি প্রধানতম প্রবাহকে বিকৃত করার প্রয়াসে। ইতিহাস বিকৃতি মানেই সংস্কৃতির বিকৃতি, আর বিকৃত সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মানুষ বিকৃত মানসিকতার হতে বাধ্য। তাই বাঙালি হিসেবে সগৌরবে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের রুখতে হবে ইতিহাস বিকৃতির এই চক্রান্ত, দাঁড়াতে হবে ঘাড় সোজা করে। বিকৃত ইতিহাস যে টেকে না, একসময় সত্যেরই জয় হয়- এই সত্যটা ইতিহাস বিকৃতকারী শাসকশ্রেণি বুঝেও আমল দেয় না ক্ষমতার অন্ধ মোহে।
আমরা জানি যে, ১৯৬০-এর দশকে শাসকশ্রেণির মদদপুষ্ট একদল বাঙালির মধ্যে এই প্রবণতা দেখা দিয়েছিল যে, বাঙালি হিসেবে পরিচয় দান রাষ্ট্র ও ইসলামবিরোধী। পাকিস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্রপ্রধান আইয়ুব খান নিজের লেখা বই Friends, not Masters-এ বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কে বিকৃত করে এবং আপত্তিকর ও রুচিহীন মন্তব্য করে বাঙালিকে ছোট করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। বাঙালি সংস্কৃতি চিরকালই অসাম্প্রদায়িক। ভারতবর্ষে ব্রিটিশরাই সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেছিল শাসন ও শোষণের সুবিধার্থে। সেই সাম্প্রদায়িকতার গর্ভেই জন্ম নিয়েছে মৌলবাদ যা আমাদের অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেতুবন্ধনই শুধু ধ্বংসের চক্রান্তে লিপ্ত নয়, বাঙালি সংস্কৃতির আবহমান ঐতিহ্যকেও ধবংস করতে চায়। মৌলবাদের সর্বাত্মক দৌরাত্ম্য আমাদের স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রকে যেমন রুদ্ধ করে দিচ্ছে, তেমনি প্রগতিশীল শিল্পচর্চার পথকেও সংকীর্ণ করে তুলছে। এই চক্রান্তের শেকড় অনেক গভীরে চলে গেছে ধীরে ধীরে। এই বাস্তবতা কোনো মতেই সুখকর নয়। আমরা নানাভাবেই বিভক্ত; বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নানা মত ও পথ এবং অনৈক্য-অবহেলাই যে এই বাস্তবতা তৈরির পথকে সুগম করেছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরিসীম লুটপাট, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। একটি বড় সম্ভাবনার দেশকে বাঁচাতে হলে নষ্ট করে ফেলা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক সংস্কার দরকার। অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির শেকড় উৎপাটনের মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে চিরতরে উচ্ছেদ করতে হবে।
স্বাধীনতার এতদিন পরেও এখানে, এদেশে, একটি সুস্থ-সাবলীল-স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বরং ’৫২ থেকে আজাবধি যে মহান সংগ্রামী ঐতিহ্যের সড়ক বেয়ে আমরা এতদূর এসেছি, সেই ঐতিহ্য, সহমর্মিতা, বাঙালিত্বের অহংকার ক্রমশ যেন নেতিয়ে পড়ছে, হারাচ্ছে তার উষ্ণ অহংকার। এসবের মূলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অসহিষ্ণু-স্থুল আচরণ এবং ক্ষমতামুখী নৈরাজ্যিক মানসিকতাই মূলত দায়ী। অন্যদিকে, আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য এবং মৌলবাদের রক্ষণশীল- হন্তারক-সাম্প্রদায়িক প্রক্রিয়াসমূহ নানাভাবেই পিছিয়ে দিচ্ছে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় ও সম্ভাবনা। তাই এখন যা জরুরি তা হলো, সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা নয়, গড়ে তুলতে হবে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের সমন্বিত সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম এবং বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে সুদৃঢ় ঐক্য। বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে বুক বেঁধে এদেশের সাধারণ মানুষকেই দাঁড়াতে হবে আবারো, কারণ, নিরন্তর সংগ্রামই আমাদের এবং আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে এতদূর এনেছে এবং নিরন্তর সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বেই এ জাতি এবং এর ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি এগিয়ে যাবে অনন্তকাল, সেই প্রত্যাশা আমাদের রয়েছে।
লেখক-অধ্যাপক পবিত্র সরকার লিখেছেন-
‘বাঙালি তার জাতিসত্তার গৌরবে প্রাণবন্ত। অথচ জাতিদাম্ভিকতা তার মধ্যে বাসা বাঁধেনি বলেই সে দিয়েছে এবং নিয়েছে। বহতা নদীর মতো বাংলা ও বাঙালি বিকশিত হয়েছে। শত শত বৎসর ধরে হাজার হাজার কিংবা লাখে লাখে ভিন্নভাষী মানুষ এদেশে এসছেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির টানে আপ্লুত হয়েছেন, এ দেশেই থেকে গিয়েছেন। তাঁরাও দিয়েছেন ও নিয়েছেন। আমাদের যা কিছু গৌরব তা এই মহামানবের মিলনক্ষেত্র নিয়ে। মিলনের মধ্য দিয়েই একহাজার বৎসর ধরে প্রস্ফুটিত যে জীবন, ভাষা ও সংস্কৃতিবিশে^র শিরোপা পেয়েছে তা নিয়ে আমাদের চর্চা’। (সভাপতির পূর্বলিপি, বঙ্গদর্শন। ১-২০০১)।
তিরিশ লক্ষ মানুষের জীবন উৎসর্গ, ২ লক্ষেরও বেশি মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আজ আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি তার সূতিকাগার ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। তারপর আমাদের আর থেমে থাকার সময় হয়নি। ৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন ও বেসিক ডেমোক্রেসির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-র স্বাধীকার আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুসহ ষড়যন্ত্র মামলার সব আসামীর মুক্তি, ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ পাওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতায় বসতে না দেওয়া এবং পরিশেষে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিশ্চিয়ান সবারই অংশগ্রহণ ছিল- একথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’- এই কথাটির মর্মার্থ অনুধাবন করতে না পারলে মানুষ হিসেবে আমাদের মুক্তির পথ কখনোই প্রশস্থ হবে না।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২২ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত কবি কাজী নজরুল ইসলাম মূলত কবিতাচর্চা করেছেন। ’৩০-এর পরে তিনি কবিতাচর্চা করলেও মূলত ব্যস্ত থেকেছেন সংগীত রচনায় এবং ১৯৪২ সালের ১০ আগস্ট বাকরুদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কবিতা ও বিপুল সংগীতের মধ্য দিয়ে জয় করেছিলেন গণমানুষের মন। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক বলিষ্ঠ ঐক্যের মধ্যে ভারতবর্ষের সর্বৈব মুক্তি ও প্রশান্ত মুখ। এই সংশ্লেষী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁকে নানাবিধ গালিগালাজ শুনতে হয়েছে- মুসলমানরা তাঁকে কাফের আখ্যা দিয়েছে তাঁর কবিতা ও গানে হিন্দু দেব-দেবীর নাম থাকায় এবং হিন্দু রমণীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায়। আবার হিন্দুরাও তাঁকে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের কারণে গালমন্দ করেছে। এসব তিনি সহ্য করেছেন নিবিষ্ঠচিত্তে, সাহসে-সংযমে, সহাস্যে, ভালোবাসার ঐকান্তিক বোধে। তিনি বলেছেন, ‘আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি বা হিন্দু দেবদেবীর নাম নিই।’ শ্যামা সংগীত ও ইসলামি গান রচনার মধ্য দিয়ে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেই সাঁকোটিকে আরো মজবুত করেছিলেন।
দেশটাকে বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে আমাদের এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির দীর্ঘ ¯্রােতধারায়, আমাদের রক্তের লালিমায় আমরা কি সেই সম্প্রীতির সমবেত সংগীতের ধ্বনিমাধুর্য অনুভব করি না? আমরা কি উপলব্ধি করি না ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’?
রবীন্দ্রনাথ ‘হিন্দুমুসলমান’ প্রবন্ধে লিখেছেন-
“যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোনো বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেইটেকেই সহজ প্রীতিরসঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি। যে দেশে ধর্মই সেই বুদ্ধিকে পীড়িত করে রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি কি সে দেশকে বাঁচাতে পারে।
বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যকে যেন আমাদের উজ্জীবনের সারথী, সামনে এগিয়ে যাবার অজেয় শক্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমুজ্জ্বল দীপশিখা হিসেবে গ্রহণ করতে পারি- বিশ^ায়নের এই যুগে এই প্রত্যাশা আমাদের জারি থাকবে সবসময়। কোনো জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ততটা উন্নত, যতটা ওই জাতি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-মনস্ক, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় অন্বিষ্ট, দেশপ্রেমে অবিচল এবং মনেপ্রাণে কসমোপলিটন। (সমাপ্ত)
কামরুল ইসলাম
শিল্পী : রাজীব রায়
বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কবিতা ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে। একধরনের চৌম্বকীয় আবেশে কবির মন তা শুষে নেয়। Poetry must sing or speak from authentic experience -এই কথাটির যাথার্থ্য অনুধাবন জরুরি। আমাদের বিশাল অখ- সংস্কৃতির পালে বাতাস লাগিয়ে যে লোকসংস্কৃতির উজ্জ্বল শিখাটি তাকে তরতর করে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে, যার ঔজ্জ্বল্য অনেক দূর থেকেও পরিলক্ষিত হয়, তা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। একজন কবি কিংবা শিল্পী লোকসংস্কৃতির রসায়নে নিজেকে প্রস্তুত করার শক্তি অর্জন করতে পারে। নতুন সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই এনার্জি খুবই জরুরি ও অনিবার্য। নাগরিক সংস্কৃতি কিংবা শিল্প-সাহিত্যের বিষয় নিয়ে আমাদের আলোচনায় লোকসাহিত্য কিংবা লোকসংস্কৃতির কথাটা না আনলে আলোচনার অর্থটাই খাটো হয়ে যাবে। স্মর্তব্য, আমরা সেই সাহিত্যের দিকে হেঁটে চলেছি যা নাগরিক কিংবা শিক্ষিত মানুষের সাহিত্য হিসেবেই পরিচিত। আমাদের বিবেচনাটা হতে হবে সংমিশ্রণের- আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে- সেই রঙ মেশানোর শক্তি ও সামর্থ্য সবার থাকে না। মানবিক ঔদার্যের মধ্যে এই শক্তি নিহিত। সেই রকম উদার মানুষের আজ বড়ো অভাব আমাদের। একটি অখ- সংস্কৃতির শক্তিতে আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে। একটি পুরাদস্তুর সিনথেসিসের মধ্য দিয়ে আমাদের এগোনো দরকার। এই বোধটি আরো শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন।
একসময়ের মাঠের রাখাল শাহ আব্দুল করিম অনেক উঁচু মানের কবি হয়ে ওঠেন নিরন্তর জীবনচর্চার মধ্য দিয়ে। আমরা ভদ্র মানুষেরা তাকে মেনে নিতে অনেক সময় ব্যয় করেছি। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে অনেক কবিয়ালের দেখা পাওয়া সম্ভব যারা অনেক উঁচুমানের পদ রচনা করে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ত আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে, এইসব কবিয়ালদের ছোট করে দেখার কোনো অবকাশই নেই। এরা ভদ্র মানুষদের কাছে মূল্যহীন, রাষ্ট্র এদের নেক নজরে দেখে না, এরা নোংরা পোশাকে থাকে বলে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে এরা অপাংক্তেয়। ক্ষুধা এদের নিত্যসঙ্গী, অসুখের সাথে পাঞ্জা লড়ে এইসব লোককবি একদিন ভাঁড়ার শূন্য করে দিয়ে চলে যান আর আমরা শিক্ষিত নাগরিক কবিরা তাদেরই এইসব মালমসলার মধ্যে হাতড়াতে থাকি সেইসব সোনালি আকর। সংগীত ও কবিতার নানামাত্রিক এই আয়োজন- তা যে প্রান্ত থেকেই আসুক না কেন, তার মধ্যে যদি আলো থাকে, স্রোতের নবীন প্রাবল্য থাকে তাহলে তার দিকে আমাদের তাকাতেই হবে। লোকসংস্কৃতির দিকে তাকিয়েই রবীন্দ্রনাথ পূর্ণতা পেয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে সম্মিলিত রবিবাসরের সদস্যদের প্রতি দেওয়া তার সম্ভাসনের অংশবিশেষ:
“আমার গত জীবনের আনন্দ উৎসাহ সাহিত্য, সবই পল্লিজীবনের আবেষ্টনীর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল। আমার জীবনের অনেকদিন নগরের বাইরে পল্লিগ্রামের সুখদুঃখের ভিতর দিয়ে কেটেছে, তখনই আমি আমাদের দেশের সত্যিকার রূপ কোথায় তা অনুভব করতে পেরেছি। যখন আমি পদ্মানদীর তীরে গিয়ে বাস করেছিলাম, তখন গ্রামের লোকদের অভাব অভিযোগ, এবং কতবড় অভাগা যে তারা, তা নিত্য চোখের সম্মুখে দেখে আমার হৃদয়ে একটা বেদনা জেগেছিল। এই-সব গ্রামবাসী যে কত অসহায় তা আমি বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলাম। তখন পল্লীগ্রামের মানুষের জীবনের যে পরিচয় পেয়েছিলাম তাতে এই অনুভব করেছিলাম যে, আমাদের জীবনের ভিত্তি রয়েছে পল্লীতে। আমাদের দেশের মা, দেশের ধাত্রী, পল্লীজননীর স্তন্যরস শুকিয়ে গিয়েছে। গ্রামের লোকদের খাদ্য নেই, স্বাস্থ্য নেই, তারা শুধু একান্ত অসহায়ভাবে করুণ নয়নে চেয়ে থাকে। তাদের সেই বেদনা, সেই অসহায় ভাব আমার অন্তরকে একান্তভাবে ¯পর্শ করেছিল।” (পল্লীপ্রকৃতি)
গ্রাম-বাংলার সত্যিকার রূপ দেখার দৃষ্টি তৈরি না হলে বাঙালির সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তা রচনা সম্ভব নয়। লোকসংস্কৃতির পূর্ণ অধিকারই বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণশক্তি। সুতরাং আমাদের লোককবিদের শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের সাথে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে বাংলা কবিতার আলোকিত দিগন্তের সন্ধানে। এইসব লোককবিদের ওপর কবিতা কিংবা সংগীত নেমে আসে ওহী আসার মতোই অনেকটা, স্বতঃস্ফূর্তভাবে- এইসব কবিতা-গানও মৌলিক শিল্প, সৃজনশক্তির আলোয় বোঝা যায় এদের কালজয়ী অভিজ্ঞান। বাঙালি সংস্কৃতি শতাব্দীর পর শতাব্দী বিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশের বহু সামাজিক গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছে। আমাদের সংমিশ্রিত সংস্কৃতির ছায়া তলে ইসলাম ধর্ম, সনাতন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিশ্চিয়ান ধর্মের প্রভাব রয়েছে। সুতরাং, এই বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যকে যেন আমরা আন্তরিকভাবে লালন করতে পারি- সেই উদারতা ও মানবিকবোধ থেকে সরে যাবার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের লোককাহিনী ও লোককথার ক্ষেত্রেও সেই কথা বলতে চাই আমরা।
৬.
কোনো জাতির নৃতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সেই জাতির প্রাণশক্তি। এই প্রাণশক্তিকে ধ্বংস করে শাসন-শোষণের পথকে সুগম করার লক্ষ্যে সেই জাতির ইতিহাসকে বিকৃত করতে চায় প্রভুত্বকারী বিদেশী শক্তি। কেনিয়ার ঔপন্যাসিক ন্গুগি ওয়া থিয়োংগো সম্রাজ্যবাদ কর্তৃক আফ্রিকার ইতিহাস বিকৃতি প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, ‘প্রভুত্বকারী জাতি বিজিত জাতির ইতিহাসকে বিকৃত করে লেখার প্রয়াস চালায়।’ আফ্রিকার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি উপমহাদেশেও বৃটিশরা ইতিহাস বিকৃতির প্রয়াস চালিয়েছে, আর এই বিকৃতির উদ্দেশ্যও আমাদের অজানা নয়। এই ইতিহাস বিকৃতি একই জাতির মধ্যে শাসক শ্রেণির হাতেও হয়ে থাকে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিষয়টিও এদেশে ঘটেছে এবং ঘটছে বারবার আর তা করা হচ্ছে মূলত বাঙালি সংস্কৃতির একটি প্রধানতম প্রবাহকে বিকৃত করার প্রয়াসে। ইতিহাস বিকৃতি মানেই সংস্কৃতির বিকৃতি, আর বিকৃত সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মানুষ বিকৃত মানসিকতার হতে বাধ্য। তাই বাঙালি হিসেবে সগৌরবে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের রুখতে হবে ইতিহাস বিকৃতির এই চক্রান্ত, দাঁড়াতে হবে ঘাড় সোজা করে। বিকৃত ইতিহাস যে টেকে না, একসময় সত্যেরই জয় হয়- এই সত্যটা ইতিহাস বিকৃতকারী শাসকশ্রেণি বুঝেও আমল দেয় না ক্ষমতার অন্ধ মোহে।
আমরা জানি যে, ১৯৬০-এর দশকে শাসকশ্রেণির মদদপুষ্ট একদল বাঙালির মধ্যে এই প্রবণতা দেখা দিয়েছিল যে, বাঙালি হিসেবে পরিচয় দান রাষ্ট্র ও ইসলামবিরোধী। পাকিস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্রপ্রধান আইয়ুব খান নিজের লেখা বই Friends, not Masters-এ বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কে বিকৃত করে এবং আপত্তিকর ও রুচিহীন মন্তব্য করে বাঙালিকে ছোট করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। বাঙালি সংস্কৃতি চিরকালই অসাম্প্রদায়িক। ভারতবর্ষে ব্রিটিশরাই সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেছিল শাসন ও শোষণের সুবিধার্থে। সেই সাম্প্রদায়িকতার গর্ভেই জন্ম নিয়েছে মৌলবাদ যা আমাদের অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেতুবন্ধনই শুধু ধ্বংসের চক্রান্তে লিপ্ত নয়, বাঙালি সংস্কৃতির আবহমান ঐতিহ্যকেও ধবংস করতে চায়। মৌলবাদের সর্বাত্মক দৌরাত্ম্য আমাদের স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রকে যেমন রুদ্ধ করে দিচ্ছে, তেমনি প্রগতিশীল শিল্পচর্চার পথকেও সংকীর্ণ করে তুলছে। এই চক্রান্তের শেকড় অনেক গভীরে চলে গেছে ধীরে ধীরে। এই বাস্তবতা কোনো মতেই সুখকর নয়। আমরা নানাভাবেই বিভক্ত; বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নানা মত ও পথ এবং অনৈক্য-অবহেলাই যে এই বাস্তবতা তৈরির পথকে সুগম করেছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরিসীম লুটপাট, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। একটি বড় সম্ভাবনার দেশকে বাঁচাতে হলে নষ্ট করে ফেলা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক সংস্কার দরকার। অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির শেকড় উৎপাটনের মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে চিরতরে উচ্ছেদ করতে হবে।
স্বাধীনতার এতদিন পরেও এখানে, এদেশে, একটি সুস্থ-সাবলীল-স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বরং ’৫২ থেকে আজাবধি যে মহান সংগ্রামী ঐতিহ্যের সড়ক বেয়ে আমরা এতদূর এসেছি, সেই ঐতিহ্য, সহমর্মিতা, বাঙালিত্বের অহংকার ক্রমশ যেন নেতিয়ে পড়ছে, হারাচ্ছে তার উষ্ণ অহংকার। এসবের মূলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অসহিষ্ণু-স্থুল আচরণ এবং ক্ষমতামুখী নৈরাজ্যিক মানসিকতাই মূলত দায়ী। অন্যদিকে, আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য এবং মৌলবাদের রক্ষণশীল- হন্তারক-সাম্প্রদায়িক প্রক্রিয়াসমূহ নানাভাবেই পিছিয়ে দিচ্ছে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় ও সম্ভাবনা। তাই এখন যা জরুরি তা হলো, সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা নয়, গড়ে তুলতে হবে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের সমন্বিত সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম এবং বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে সুদৃঢ় ঐক্য। বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে বুক বেঁধে এদেশের সাধারণ মানুষকেই দাঁড়াতে হবে আবারো, কারণ, নিরন্তর সংগ্রামই আমাদের এবং আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে এতদূর এনেছে এবং নিরন্তর সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বেই এ জাতি এবং এর ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি এগিয়ে যাবে অনন্তকাল, সেই প্রত্যাশা আমাদের রয়েছে।
লেখক-অধ্যাপক পবিত্র সরকার লিখেছেন-
‘বাঙালি তার জাতিসত্তার গৌরবে প্রাণবন্ত। অথচ জাতিদাম্ভিকতা তার মধ্যে বাসা বাঁধেনি বলেই সে দিয়েছে এবং নিয়েছে। বহতা নদীর মতো বাংলা ও বাঙালি বিকশিত হয়েছে। শত শত বৎসর ধরে হাজার হাজার কিংবা লাখে লাখে ভিন্নভাষী মানুষ এদেশে এসছেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির টানে আপ্লুত হয়েছেন, এ দেশেই থেকে গিয়েছেন। তাঁরাও দিয়েছেন ও নিয়েছেন। আমাদের যা কিছু গৌরব তা এই মহামানবের মিলনক্ষেত্র নিয়ে। মিলনের মধ্য দিয়েই একহাজার বৎসর ধরে প্রস্ফুটিত যে জীবন, ভাষা ও সংস্কৃতিবিশে^র শিরোপা পেয়েছে তা নিয়ে আমাদের চর্চা’। (সভাপতির পূর্বলিপি, বঙ্গদর্শন। ১-২০০১)।
তিরিশ লক্ষ মানুষের জীবন উৎসর্গ, ২ লক্ষেরও বেশি মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আজ আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি তার সূতিকাগার ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। তারপর আমাদের আর থেমে থাকার সময় হয়নি। ৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন ও বেসিক ডেমোক্রেসির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-র স্বাধীকার আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুসহ ষড়যন্ত্র মামলার সব আসামীর মুক্তি, ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ পাওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতায় বসতে না দেওয়া এবং পরিশেষে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিশ্চিয়ান সবারই অংশগ্রহণ ছিল- একথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’- এই কথাটির মর্মার্থ অনুধাবন করতে না পারলে মানুষ হিসেবে আমাদের মুক্তির পথ কখনোই প্রশস্থ হবে না।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২২ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত কবি কাজী নজরুল ইসলাম মূলত কবিতাচর্চা করেছেন। ’৩০-এর পরে তিনি কবিতাচর্চা করলেও মূলত ব্যস্ত থেকেছেন সংগীত রচনায় এবং ১৯৪২ সালের ১০ আগস্ট বাকরুদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কবিতা ও বিপুল সংগীতের মধ্য দিয়ে জয় করেছিলেন গণমানুষের মন। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক বলিষ্ঠ ঐক্যের মধ্যে ভারতবর্ষের সর্বৈব মুক্তি ও প্রশান্ত মুখ। এই সংশ্লেষী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁকে নানাবিধ গালিগালাজ শুনতে হয়েছে- মুসলমানরা তাঁকে কাফের আখ্যা দিয়েছে তাঁর কবিতা ও গানে হিন্দু দেব-দেবীর নাম থাকায় এবং হিন্দু রমণীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায়। আবার হিন্দুরাও তাঁকে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের কারণে গালমন্দ করেছে। এসব তিনি সহ্য করেছেন নিবিষ্ঠচিত্তে, সাহসে-সংযমে, সহাস্যে, ভালোবাসার ঐকান্তিক বোধে। তিনি বলেছেন, ‘আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি বা হিন্দু দেবদেবীর নাম নিই।’ শ্যামা সংগীত ও ইসলামি গান রচনার মধ্য দিয়ে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেই সাঁকোটিকে আরো মজবুত করেছিলেন।
দেশটাকে বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে আমাদের এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির দীর্ঘ ¯্রােতধারায়, আমাদের রক্তের লালিমায় আমরা কি সেই সম্প্রীতির সমবেত সংগীতের ধ্বনিমাধুর্য অনুভব করি না? আমরা কি উপলব্ধি করি না ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’?
রবীন্দ্রনাথ ‘হিন্দুমুসলমান’ প্রবন্ধে লিখেছেন-
“যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোনো বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেইটেকেই সহজ প্রীতিরসঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি। যে দেশে ধর্মই সেই বুদ্ধিকে পীড়িত করে রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি কি সে দেশকে বাঁচাতে পারে।
বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যকে যেন আমাদের উজ্জীবনের সারথী, সামনে এগিয়ে যাবার অজেয় শক্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমুজ্জ্বল দীপশিখা হিসেবে গ্রহণ করতে পারি- বিশ^ায়নের এই যুগে এই প্রত্যাশা আমাদের জারি থাকবে সবসময়। কোনো জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ততটা উন্নত, যতটা ওই জাতি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-মনস্ক, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় অন্বিষ্ট, দেশপ্রেমে অবিচল এবং মনেপ্রাণে কসমোপলিটন। (সমাপ্ত)