alt

সাময়িকী

কাফকার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার

মাহফুজ আল-হোসেন

: বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই জীবনধারণের উপায় ও কৃৎকৌশলের ক্রম-পরিবর্তনের ধারায় ব্যক্তি-মানুষের উৎপাদন সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক দর্শন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কালের পরিক্রমায় মানুষে-মানুষে সম্পর্কের গণিতও হচ্ছে ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর। এসব কারণে আন্তর্ব্যক্তিক আচরণ, পারিবারিক সদস্যদের আন্তঃসম্পর্কের সমীকরণ, দৈনন্দিন অভিব্যক্তি ও চালচলনও পাল্টে গেছে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। কালে কালে মানুষের সৃজনশীল ক্রিয়াকলাপ, চিরন্তন-কাঠামো, শৈলী এবং নন্দন-বিভাবনায়ও ঘটে গেছে অচিন্ত্যনীয় রূপবদল। সাহিত্যিক ও শিল্প¯্রষ্টাগণ নিজ নিজ কালের অগ্রসর ব্যক্তি বলেই বোধকরি তাঁদের শিল্পপ্রয়াস ও রচনায় এসেছে বহুবিচিত্র বিষয়, অপ্রস্তুত নিরেট বিষয়হীনতা, বিষয়াতীত স্বজ্ঞা এবং আঙ্গিক ও উপস্থাপনগত অভিনবত্বসহ নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্ট। তাদের কেউ কেউ অধিবিদ্যক অতীন্দ্রীয় পরিভ্রমণে যেমন অভ্যস্ত, কেউ আবার বাস্তবতার পোড়োজমিনে পা রেখেই পৌঁছুতে চান কাক্সিক্ষত গন্তব্যে কিংবা যে পথে কেউ কখনও পা বাড়ায়নি চান সেই বন্ধুর পথে হাঁটতে।

শিল্পসুকৃতির নিরন্তর কালপ্রবাহে এমনই একজন ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী, লেখক ও দার্শনিক ফ্রানৎস্ কাফকা- যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে অস্ট্রিয়াভুক্ত প্রাগের এক চেক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। কর্তৃত্ববাদী আইন ও আজগুবি নিয়মের নিষ্ঠুর নিগড়ে প্রতিনিয়ত তামাশায় রূপান্তরিত হওয়া ক্রমরূপান্তরণশীল এক পৃথিবীতে (যেটি ‘কাফকায়েস্ক’ হিসেবে চিন্তন-চর্চায় সুপরিচিত) মানবীয় ও ক্ষমতা সম্পর্কের জটিল গোলক ধাঁধার শৈল্পিক উন্মোচন করে তিনি প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। বিশেষ করে আমলাতান্ত্রিক সিস্টেমের প্রতিকূলে জীবনব্যাপী একাকী লড়ে যাওয়া ব্যক্তিমানুষের ক্ষমতাহীনতা, অসহায়ত্ব ও বিচ্ছিন্নতার নির্মোহ চিত্র তাঁর রূপকাশ্রয়ী তিনটি নভেলায় এবং ব্যাঙ্গাত্মক শৈলীর অনন্য ছোটগল্পসমূহে উঠে এসেছে। তাঁর আত্মসংলাপধর্মী রোজনামচাসমূহ এবং একান্ত ব্যক্তিগত পত্রাবলিতে বিধৃত হয়েছে নিজ সম্পর্কিত নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি এবং ভালোবাসার প্রগাঢ় উচ্চারণ। বিংশ শতাব্দীর শেষাবধি ও তৎপরবর্তী সময়ে, এমনকি বর্তমানে তাঁর মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌর্দ-প্রতাপ যখন প্রায় অলঙ্ঘ্যনীয় তখনও কাফকা এবং তাঁর লেখালেখি ও অন্তর্নিহিত দর্শন ভীষণ রকমের প্রাসঙ্গিক। বিশ্বসাহিত্যের স্বনামখ্যাত অনেক লেখক-সাহিত্যিক এবং বিশ্ববিশ্রুত দার্শনিক-শিল্পীর কালোত্তীর্ণ রচনা ও শিল্পপ্রয়াসে কাফকার প্রভাব অস্বীকার করবার জো নেই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিষয়ে সোচ্চার কাফকার রচনাবলিকে আধুনিকতার সূচনা-বিন্দু হিসেবেও অনেকে বিবেচনা করে থাকেন; আবার তত্ত্বতালাশিদের কেউ কেউ কাফকার রচনায় উত্তরাধুনিকতার বৈশিষ্ট্যও খুঁজে পান অবলীলায়। অবাক করার মতো বিষয় হলো দুনিয়াজুড়ে কাফকাকে নিয়ে অসংখ্য অগণন একাডেমিক ও সাধারণ পাঠকের বিস্ময়কর আগ্রহ, গবেষণা ও বিপুল পঠনপাঠন। পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব ভাষাতেই অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে কাফকা বিষয়ক লেখালেখি। সংখ্যার দিক থেকে ইতোমধ্যেই দশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রতিনিয়ত এটি জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে, সম্ভবত শেক্সপিয়ার ছাড়া আর কারো ক্ষেত্রেই এমনটি দেখা যায় না।

কাফকা পাঠে বুঁদ হয়ে থাকা মুগ্ধ পাঠক প্রায়শই বুঝে উঠতে পারেন না কী করে তিনি আমাদের এই জটিল যাপিত জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠলেন। কাফকার পারিবারিক পরিম-ল এবং বেড়ে ওঠার মধ্যে এ প্রশ্নের উত্তর বোধহয় অনেকটা লুকিয়ে আছে। কাফকার কর্তৃত্ববাদী পিতার কড়া শাসন শৈশবে তাঁর মধ্যে হীনম্মন্যতার বোধ তৈরি করে (এটি নিয়ে অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যাও রয়েছে)। তিনি আধুনিক জার্মান স্কুলে মাধ্যমিকের পাঠ সমাপ্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রসায়ন শাস্ত্রে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন, বিষয়টি কঠিন মনে হওয়ায় সেটি তাৎক্ষণিক বদলে নিয়ে তিনি পিতার পছন্দনীয় বিষয় আইন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রাগ্রসর শিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে তিনি আইনে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো আইনবিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত যুক্তিশীলতা থেকে তিনি জীবনের পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। নবিশী প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে আইন বিষয়ক ডকুমেন্টেশনের কাজ তিনি নিষ্ঠার সাথে আয়ত্ত করেন এবং তৎপরবর্তীতে কর্পোরেট বীমা সেক্টরে উচ্চ বেতনে কাজ করার পরিক্রমায় দুর্ঘটনাজনিত ঝুঁকি ও এতদসংক্রান্ত বীমা দাবির প্রতিবেদন তৈরির কাজে তিনি বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। এসব কারণে তাঁর মানুষ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিলো। বাস্তব জগতে বিচরণশীল মানুষের নেতিবাচক মনোভাব ও প্রবণতা, ধূর্তামি, কপটতা-শঠতা এবং অন্তরের গভীরতম প্রদেশের অন্ধকারগুলো তিনি সহজেই অনুধাবন করতে পারতেন বলে সেটিকে তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য করেছিলেন। তবে জটিল মানবমনের গুপ্ত অলিগলি কিংবা চেনা মানুষের নিরুত্তাপ নেতিবাচকতার স্বরূপ প্রকাশের সাহিত্যিক শৈলী হিসেবে তিনি পরাবাস্তবতার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন একারণে যে, এটি পাঠকের মনে গভীর চিন্তার উদ্রেককারী হিসেবে অধিকতর স্থায়ী আবেদন তৈরি করতে সক্ষম এবং তা তিনি সবসময় মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। কাফকার চিন্তার মৌলিকত্ব এবং প্রকাশশৈলীর অভিনবত্ব তাঁকে গড়পড়তা সাধারণ লেখক থেকে গ্রেটনেসের দিকে নিয়ে গেছে। এখনকার পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় শোষণ নিপীড়নের অংশ হিসেবে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক/উপ-আঞ্চলিক রাজনীতির ষড়যন্ত্র ও ঘোর মারপ্যাঁচে রাষ্ট্রীয় পরিম-লে ও সমাজে যে ভ্রষ্টাচার ও অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয়, সে পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির জীবনে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নানামাত্রিক অভিঘাত ও অস্তিত্বের সংকট এবং এটি যে ‘কাফকায়েস্ক’ পরিস্থিতির জলজ্যান্ত উদাহরণ তা সচেতন পাঠকমাত্রই অনুধাবনে সমর্থ হবেন।

কাফকা আমৃত্যু সাহিত্যের জয়গান গেয়েছেন এবং সাহিত্যের মাধ্যমেই একজন মানুষের সত্যিকারের মুক্তি মিলতে পারে সেটি তিনি তাঁর অমূল্য রোজনামচায় লিখে গেছেন। তিনি সাহিত্যিক অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে এ ধোঁয়াশাপূর্ণ বিভ্রমের পৃথিবীতে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত দেখার চোখ নির্মাণ করে দেন। সেই চোখ কোনো সাধারণ চোখ নয়। সেটি মূলত অসংখ্য চোখের সমষ্টি, যেটিকে প্রাণিবিদ্যার ভাষার বলা হয় পুঞ্জাক্ষি। সেই পুঞ্জাক্ষি দিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি কী করে মানুষের পৃথিবীতে অভিব্যক্তিবাদের নিয়মে সকলের অলক্ষ্যে এক অদ্ভুত রূপান্তর ঘটে চলেছে। এক ডিহিউমানাইজড্ পৃথিবীতে পরিস্থিতির পাঁকে পড়ে আমরাও কী তবে গ্রেগর সামসার মতো একদিন সকালে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখছি (রূপকার্থে) একটা বৃহদাকার পতঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে গেছি! এখন না পারছি নড়াচড়া করতে, না পারছি কাউকে কিছু বলতে। ঘরের মধ্যেই নিকট সম্পর্কের মানুষের কাছ থেকে ভিন্ন আচরণের শিকার হচ্ছি প্রতিমুহূর্তে, আর্থিক অক্ষমতার কারণে প্রিয়জনের কাছে বোধহয় আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে বলে হয়তো তারা মৃত্যু কামনা করছে, আর শেষ পরিণতিতে কর্তৃত্ববাদের ছোঁড়া আপেলে আহত হয়ে সহসাই আমাদের ভবলীলা সাঙ্গ হবে। এই যে অ্যাপিয়ারেন্স ও রিয়্যালিটির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সেটি ঘোচাতে কাফকা তাঁর কল্পনাশক্তির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়েছিলেন, যেটিকে তাত্ত্বিকভাবে আমরা বলে থাকি সুররিয়্যালিজম। মানবজীবনের অনিশ্চয়তাময় কৌতুকী অবস্থানকে রূপান্তরের আখ্যানে তুলে এনে সেটির উপস্থাপনায় জীবনশিল্পী কাফকা অ্যাবসার্ডিটির কৌশল অবলম্বন করেছেন। অবশ্য জীবন সম্পর্কে বিশ্বাস আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টা আরো পুরোনো আমলের অনুষঙ্গ। ঊনবিংশ শতাব্দীর দীপায়নের কাল থেকেই এই টলায়মান বিশ্বাসের নানান উপসর্গ সমাজে অনুভূত হচ্ছিল। ফ্রেডরিখ নিৎশে ঐ শতকের আটের দশকে ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা করে বিশ্বাসহীনতাকে আরো উস্কে দিলেন সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা পরিসরে। তৎপরবর্তীতে ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকে সামাজিক প্রগতির অনিবার্যতা নিয়ে যে বিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল সেটা যে মুক্তিকামী একক ব্যক্তির ক্ষেত্রে শুভঙ্করের ফাঁকি বৈ অন্য কিছু নয়, তা সকলের কাছে পরিষ্কার হতে লাগলো। বাস্তব জীবনের অনালোকিত সেইসব রহস্যময় হেঁয়ালিগুলো রূপান্তরের আপাত-উদ্ভট স্টোরিলাইনে তুলে এনে আ্যাবসার্ডিটির মোক্ষম শিল্পকৌশলটি কাফকা অত্যন্ত সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন বলেই পরবর্তীকালে প্রভাবশালী সাহিত্যিক ও শিল্প¯্রষ্টাগণ এ পথে সদর্পে হেঁটেছেন এবং এখনও প্রত্যয়দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন।

বিরোধপূর্ণ বর্তমান সমাজে প্রতিষ্ঠিত ন্যারেটিভগুলো যখন ভেঙ্গেচুরে খান খান হয়ে যাচ্ছে অন্তর্নিহিত বাগাড়ম্বর অথবা প্রশ্নহীন পরিকল্পিত অসত্য কিংবা অর্ধসত্যের সাথে নির্বিরোধ মিথোজীবিতার কারণে, সেই নিষ্করুণ প্রেক্ষাপটে প্রজন্মের দায় রয়েছে কাফকার এই হেঁয়ালিপূর্ণ রূপান্তরের পাঠ থেকে সমৃদ্ধ হয়ে সাহিত্য ও চিন্তনের ভয়ডরহীন নিত্যনতুন ন্যারেটিভ তৈরি করার। সৃষ্টিশীল অদম্য তারুণ্যের কাছে এমন সব সিম্বল ও মেটাফরের প্রত্যাশা আমাদের যেগুলো কাফকার অসমাপ্ত মুক্তপ্রান্ত প্লটগুলোকে অভাবনীয় উপস্থাপনায় সত্যান্বেষী নতুন গল্পের বাকরুদ্ধ সমাপ্তি এনে দেবে কিংবা মৌলিক কাব্য প্রকল্পনার নিত্যনতুন অভিমুখ রচনা করবে, তাহলেই বোধকরি একজন কাফকার কাছে আমাদের যে অপরিশোধ্য ঋণ রয়েছে সেটি শিল্পপ্রয়াসের মাধ্যমে পুনর্ব্যক্ত হবে।

ছবি

রক্তে লেখা প্রেম: রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিপ্লব

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শঙ্খজীবন: যাপিত জীবনের অন্তর্গূঢ় প্রতিকথা

ছবি

ওসামা অ্যালোমার এক ঝুড়ি খুদে গল্প

ছবি

প্রযুক্তির আলোয় বিশ্বব্যাপী বইবাণিজ্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

সূর্যের দেশ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

লড়াই

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রচলিত সাহিত্যধারার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন মধুসূদন

ছবি

মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন

ছবি

উত্তর-মানবতাবাদ ও শিল্প-সাহিত্যে তার প্রভাব

ছবি

আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

দুই ঋতপার কিসসা এবং এক ন্যাকা চৈতন্য

ছবি

অন্যজীবন অন্যআগুন ছোঁয়া

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কবিজীবন, দর্শন ও কাব্যসন্ধান

ছবি

অসামান্য গদ্যশৈলীর রূপকার

ছবি

পিয়াস মজিদের ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’

ছবি

নজরুলের নিবেদিত কবিতা : অর্ঘ্যরে শিল্পরূপ

ছবি

বাঘাডাঙা গাঁও

ছবি

বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বিষয়ভাবনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

পথকবিতা: লোকবাংলার সাধারণ কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

ক্ষমতার ভাষার বিপরীতে মাতৃভাষার সাধনা

ছবি

ফিলিস্তিনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে অণুগল্প

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

শিল্পী সুনীল কুমারের ‘পথের গল্প’-এর স্বরূপ

tab

সাময়িকী

কাফকার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার

মাহফুজ আল-হোসেন

বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই জীবনধারণের উপায় ও কৃৎকৌশলের ক্রম-পরিবর্তনের ধারায় ব্যক্তি-মানুষের উৎপাদন সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক দর্শন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কালের পরিক্রমায় মানুষে-মানুষে সম্পর্কের গণিতও হচ্ছে ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর। এসব কারণে আন্তর্ব্যক্তিক আচরণ, পারিবারিক সদস্যদের আন্তঃসম্পর্কের সমীকরণ, দৈনন্দিন অভিব্যক্তি ও চালচলনও পাল্টে গেছে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। কালে কালে মানুষের সৃজনশীল ক্রিয়াকলাপ, চিরন্তন-কাঠামো, শৈলী এবং নন্দন-বিভাবনায়ও ঘটে গেছে অচিন্ত্যনীয় রূপবদল। সাহিত্যিক ও শিল্প¯্রষ্টাগণ নিজ নিজ কালের অগ্রসর ব্যক্তি বলেই বোধকরি তাঁদের শিল্পপ্রয়াস ও রচনায় এসেছে বহুবিচিত্র বিষয়, অপ্রস্তুত নিরেট বিষয়হীনতা, বিষয়াতীত স্বজ্ঞা এবং আঙ্গিক ও উপস্থাপনগত অভিনবত্বসহ নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্ট। তাদের কেউ কেউ অধিবিদ্যক অতীন্দ্রীয় পরিভ্রমণে যেমন অভ্যস্ত, কেউ আবার বাস্তবতার পোড়োজমিনে পা রেখেই পৌঁছুতে চান কাক্সিক্ষত গন্তব্যে কিংবা যে পথে কেউ কখনও পা বাড়ায়নি চান সেই বন্ধুর পথে হাঁটতে।

শিল্পসুকৃতির নিরন্তর কালপ্রবাহে এমনই একজন ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী, লেখক ও দার্শনিক ফ্রানৎস্ কাফকা- যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে অস্ট্রিয়াভুক্ত প্রাগের এক চেক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। কর্তৃত্ববাদী আইন ও আজগুবি নিয়মের নিষ্ঠুর নিগড়ে প্রতিনিয়ত তামাশায় রূপান্তরিত হওয়া ক্রমরূপান্তরণশীল এক পৃথিবীতে (যেটি ‘কাফকায়েস্ক’ হিসেবে চিন্তন-চর্চায় সুপরিচিত) মানবীয় ও ক্ষমতা সম্পর্কের জটিল গোলক ধাঁধার শৈল্পিক উন্মোচন করে তিনি প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। বিশেষ করে আমলাতান্ত্রিক সিস্টেমের প্রতিকূলে জীবনব্যাপী একাকী লড়ে যাওয়া ব্যক্তিমানুষের ক্ষমতাহীনতা, অসহায়ত্ব ও বিচ্ছিন্নতার নির্মোহ চিত্র তাঁর রূপকাশ্রয়ী তিনটি নভেলায় এবং ব্যাঙ্গাত্মক শৈলীর অনন্য ছোটগল্পসমূহে উঠে এসেছে। তাঁর আত্মসংলাপধর্মী রোজনামচাসমূহ এবং একান্ত ব্যক্তিগত পত্রাবলিতে বিধৃত হয়েছে নিজ সম্পর্কিত নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি এবং ভালোবাসার প্রগাঢ় উচ্চারণ। বিংশ শতাব্দীর শেষাবধি ও তৎপরবর্তী সময়ে, এমনকি বর্তমানে তাঁর মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌর্দ-প্রতাপ যখন প্রায় অলঙ্ঘ্যনীয় তখনও কাফকা এবং তাঁর লেখালেখি ও অন্তর্নিহিত দর্শন ভীষণ রকমের প্রাসঙ্গিক। বিশ্বসাহিত্যের স্বনামখ্যাত অনেক লেখক-সাহিত্যিক এবং বিশ্ববিশ্রুত দার্শনিক-শিল্পীর কালোত্তীর্ণ রচনা ও শিল্পপ্রয়াসে কাফকার প্রভাব অস্বীকার করবার জো নেই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিষয়ে সোচ্চার কাফকার রচনাবলিকে আধুনিকতার সূচনা-বিন্দু হিসেবেও অনেকে বিবেচনা করে থাকেন; আবার তত্ত্বতালাশিদের কেউ কেউ কাফকার রচনায় উত্তরাধুনিকতার বৈশিষ্ট্যও খুঁজে পান অবলীলায়। অবাক করার মতো বিষয় হলো দুনিয়াজুড়ে কাফকাকে নিয়ে অসংখ্য অগণন একাডেমিক ও সাধারণ পাঠকের বিস্ময়কর আগ্রহ, গবেষণা ও বিপুল পঠনপাঠন। পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব ভাষাতেই অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে কাফকা বিষয়ক লেখালেখি। সংখ্যার দিক থেকে ইতোমধ্যেই দশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রতিনিয়ত এটি জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে, সম্ভবত শেক্সপিয়ার ছাড়া আর কারো ক্ষেত্রেই এমনটি দেখা যায় না।

কাফকা পাঠে বুঁদ হয়ে থাকা মুগ্ধ পাঠক প্রায়শই বুঝে উঠতে পারেন না কী করে তিনি আমাদের এই জটিল যাপিত জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠলেন। কাফকার পারিবারিক পরিম-ল এবং বেড়ে ওঠার মধ্যে এ প্রশ্নের উত্তর বোধহয় অনেকটা লুকিয়ে আছে। কাফকার কর্তৃত্ববাদী পিতার কড়া শাসন শৈশবে তাঁর মধ্যে হীনম্মন্যতার বোধ তৈরি করে (এটি নিয়ে অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যাও রয়েছে)। তিনি আধুনিক জার্মান স্কুলে মাধ্যমিকের পাঠ সমাপ্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রসায়ন শাস্ত্রে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন, বিষয়টি কঠিন মনে হওয়ায় সেটি তাৎক্ষণিক বদলে নিয়ে তিনি পিতার পছন্দনীয় বিষয় আইন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রাগ্রসর শিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে তিনি আইনে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো আইনবিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত যুক্তিশীলতা থেকে তিনি জীবনের পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। নবিশী প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে আইন বিষয়ক ডকুমেন্টেশনের কাজ তিনি নিষ্ঠার সাথে আয়ত্ত করেন এবং তৎপরবর্তীতে কর্পোরেট বীমা সেক্টরে উচ্চ বেতনে কাজ করার পরিক্রমায় দুর্ঘটনাজনিত ঝুঁকি ও এতদসংক্রান্ত বীমা দাবির প্রতিবেদন তৈরির কাজে তিনি বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। এসব কারণে তাঁর মানুষ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিলো। বাস্তব জগতে বিচরণশীল মানুষের নেতিবাচক মনোভাব ও প্রবণতা, ধূর্তামি, কপটতা-শঠতা এবং অন্তরের গভীরতম প্রদেশের অন্ধকারগুলো তিনি সহজেই অনুধাবন করতে পারতেন বলে সেটিকে তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য করেছিলেন। তবে জটিল মানবমনের গুপ্ত অলিগলি কিংবা চেনা মানুষের নিরুত্তাপ নেতিবাচকতার স্বরূপ প্রকাশের সাহিত্যিক শৈলী হিসেবে তিনি পরাবাস্তবতার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন একারণে যে, এটি পাঠকের মনে গভীর চিন্তার উদ্রেককারী হিসেবে অধিকতর স্থায়ী আবেদন তৈরি করতে সক্ষম এবং তা তিনি সবসময় মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। কাফকার চিন্তার মৌলিকত্ব এবং প্রকাশশৈলীর অভিনবত্ব তাঁকে গড়পড়তা সাধারণ লেখক থেকে গ্রেটনেসের দিকে নিয়ে গেছে। এখনকার পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় শোষণ নিপীড়নের অংশ হিসেবে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক/উপ-আঞ্চলিক রাজনীতির ষড়যন্ত্র ও ঘোর মারপ্যাঁচে রাষ্ট্রীয় পরিম-লে ও সমাজে যে ভ্রষ্টাচার ও অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয়, সে পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির জীবনে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নানামাত্রিক অভিঘাত ও অস্তিত্বের সংকট এবং এটি যে ‘কাফকায়েস্ক’ পরিস্থিতির জলজ্যান্ত উদাহরণ তা সচেতন পাঠকমাত্রই অনুধাবনে সমর্থ হবেন।

কাফকা আমৃত্যু সাহিত্যের জয়গান গেয়েছেন এবং সাহিত্যের মাধ্যমেই একজন মানুষের সত্যিকারের মুক্তি মিলতে পারে সেটি তিনি তাঁর অমূল্য রোজনামচায় লিখে গেছেন। তিনি সাহিত্যিক অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে এ ধোঁয়াশাপূর্ণ বিভ্রমের পৃথিবীতে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত দেখার চোখ নির্মাণ করে দেন। সেই চোখ কোনো সাধারণ চোখ নয়। সেটি মূলত অসংখ্য চোখের সমষ্টি, যেটিকে প্রাণিবিদ্যার ভাষার বলা হয় পুঞ্জাক্ষি। সেই পুঞ্জাক্ষি দিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি কী করে মানুষের পৃথিবীতে অভিব্যক্তিবাদের নিয়মে সকলের অলক্ষ্যে এক অদ্ভুত রূপান্তর ঘটে চলেছে। এক ডিহিউমানাইজড্ পৃথিবীতে পরিস্থিতির পাঁকে পড়ে আমরাও কী তবে গ্রেগর সামসার মতো একদিন সকালে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখছি (রূপকার্থে) একটা বৃহদাকার পতঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে গেছি! এখন না পারছি নড়াচড়া করতে, না পারছি কাউকে কিছু বলতে। ঘরের মধ্যেই নিকট সম্পর্কের মানুষের কাছ থেকে ভিন্ন আচরণের শিকার হচ্ছি প্রতিমুহূর্তে, আর্থিক অক্ষমতার কারণে প্রিয়জনের কাছে বোধহয় আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে বলে হয়তো তারা মৃত্যু কামনা করছে, আর শেষ পরিণতিতে কর্তৃত্ববাদের ছোঁড়া আপেলে আহত হয়ে সহসাই আমাদের ভবলীলা সাঙ্গ হবে। এই যে অ্যাপিয়ারেন্স ও রিয়্যালিটির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সেটি ঘোচাতে কাফকা তাঁর কল্পনাশক্তির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়েছিলেন, যেটিকে তাত্ত্বিকভাবে আমরা বলে থাকি সুররিয়্যালিজম। মানবজীবনের অনিশ্চয়তাময় কৌতুকী অবস্থানকে রূপান্তরের আখ্যানে তুলে এনে সেটির উপস্থাপনায় জীবনশিল্পী কাফকা অ্যাবসার্ডিটির কৌশল অবলম্বন করেছেন। অবশ্য জীবন সম্পর্কে বিশ্বাস আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টা আরো পুরোনো আমলের অনুষঙ্গ। ঊনবিংশ শতাব্দীর দীপায়নের কাল থেকেই এই টলায়মান বিশ্বাসের নানান উপসর্গ সমাজে অনুভূত হচ্ছিল। ফ্রেডরিখ নিৎশে ঐ শতকের আটের দশকে ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা করে বিশ্বাসহীনতাকে আরো উস্কে দিলেন সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা পরিসরে। তৎপরবর্তীতে ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকে সামাজিক প্রগতির অনিবার্যতা নিয়ে যে বিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল সেটা যে মুক্তিকামী একক ব্যক্তির ক্ষেত্রে শুভঙ্করের ফাঁকি বৈ অন্য কিছু নয়, তা সকলের কাছে পরিষ্কার হতে লাগলো। বাস্তব জীবনের অনালোকিত সেইসব রহস্যময় হেঁয়ালিগুলো রূপান্তরের আপাত-উদ্ভট স্টোরিলাইনে তুলে এনে আ্যাবসার্ডিটির মোক্ষম শিল্পকৌশলটি কাফকা অত্যন্ত সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন বলেই পরবর্তীকালে প্রভাবশালী সাহিত্যিক ও শিল্প¯্রষ্টাগণ এ পথে সদর্পে হেঁটেছেন এবং এখনও প্রত্যয়দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন।

বিরোধপূর্ণ বর্তমান সমাজে প্রতিষ্ঠিত ন্যারেটিভগুলো যখন ভেঙ্গেচুরে খান খান হয়ে যাচ্ছে অন্তর্নিহিত বাগাড়ম্বর অথবা প্রশ্নহীন পরিকল্পিত অসত্য কিংবা অর্ধসত্যের সাথে নির্বিরোধ মিথোজীবিতার কারণে, সেই নিষ্করুণ প্রেক্ষাপটে প্রজন্মের দায় রয়েছে কাফকার এই হেঁয়ালিপূর্ণ রূপান্তরের পাঠ থেকে সমৃদ্ধ হয়ে সাহিত্য ও চিন্তনের ভয়ডরহীন নিত্যনতুন ন্যারেটিভ তৈরি করার। সৃষ্টিশীল অদম্য তারুণ্যের কাছে এমন সব সিম্বল ও মেটাফরের প্রত্যাশা আমাদের যেগুলো কাফকার অসমাপ্ত মুক্তপ্রান্ত প্লটগুলোকে অভাবনীয় উপস্থাপনায় সত্যান্বেষী নতুন গল্পের বাকরুদ্ধ সমাপ্তি এনে দেবে কিংবা মৌলিক কাব্য প্রকল্পনার নিত্যনতুন অভিমুখ রচনা করবে, তাহলেই বোধকরি একজন কাফকার কাছে আমাদের যে অপরিশোধ্য ঋণ রয়েছে সেটি শিল্পপ্রয়াসের মাধ্যমে পুনর্ব্যক্ত হবে।

back to top