ফ্রান্ৎস কাফকা গল্প
অনুবাদ : বিপাশা মন্ডল
ছবি সূত্র ইন্টারনেট
১৯০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর লা সেন্টিনেলা ব্রেশাকানা রিপোর্ট করল এবং রিপোর্টটা করতে পেরে তারা খুব খুশি হল : ‘ব্রেশায় আমরা লোকজনদের এমন একটা সমাবেশ পেয়েছি যেটা আগে কখনো পাইনি, এমনকি সেই বিশাল মোটরগাড়ি রেসের সময়েও পাইনি; দর্শনার্থীরা ভেটেনিয়া, লিগুরিয়া, ইডমন্ট তুসক্যানি, রোম বস্তুত নেপলসের মতো দূর-দূরান্ত থেকেও এসেছিল; ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকা থেকে এসেছিল বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ; সকলে মিলে আমাদের স্কয়ার চত্বরে, আমাদের হোটেলগুলোয়, আমাদের ব্যক্তিগত বাড়িগুলোর প্রত্যেকটা খালি কোণে জায়গা পাবার জন্য ধাক্কাধাক্কি করছিল; সব জিনিসের দাম সন্তোষজনকভাবে বেড়ে গিয়েছিল; লোকজনকে সার্কিটিও এরিওতে আনা-নেওয়ার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা অনিবার্য হয়ে ওঠে; বিমানবন্দর এলাকার রেস্তরাঁগুলো প্রশংসনীয়ভাবে অন্তত দুহাজার লোকের খাবার পরিবেশন করেছে, কিন্তু হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে তারা হার মেনেছে, পরিস্থিতি এমন ছিল যে সৈন্যদেরকে বুফে রেস্তরাঁগুলোকে রক্ষা করার জন্য মাঠে নামতে হয়েছিল; মাঠের সস্তা টিকিটের জায়গাগুলো থেকে ৫০ হাজার উৎসাহী দর্শক সারাদিন ধরে দাঁড়িয়ে ছিল।’
এভাবে খবরটা পড়ে আমি ও আমার দু’বন্ধু যুগপৎ আত্মবিশ্বাসী ও সতর্ক হয়ে উঠেছিলাম। আত্মবিশ্বাসী কারণ : যেখানে এত ভয়াবহরকম চাপ থাকে সেখানে সবকিছু স্বভাবতই গণতান্ত্রিকভাবে এগিয়ে যায়, আর ওখানে যে আদতেই কোনো থাকার জয়গা ছিল না সেটা কারুর প্রমাণের কোনো প্রয়োজন ছিল না। সতর্ক কারণ : এ ধরনের এন্টারপ্রাইজের ইটালিয়ান ধরনে সংগঠিত করা বিষয়ক সতর্কতা, ঐ কমিটি বিষয়ে সতর্কতা, যেটা নিজে থেকে সচেতন ছিল আমাদের ভালোভাবে যতœ করতে হবে, ট্রেন বিষয়ে সতর্কতা, এর মধ্যে আবার সেন্টিনেলার বিষয়ে চার ঘণ্টা দেরি করে ফেলার গল্পও চালু আছে।
সকল প্রত্যাশা মিথ্যে প্রমাণিত হলো; যে কোনোভাবে একজন ব্যক্তি বেড়ানোর শেষে বাড়ি ফিরে গেলে ইতালিতে থাকার সকল স্মৃতি দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায়; স্মৃতিগুলো তাদের স্বচ্ছতা হারায়, সে আর ঐ স্মৃতিনির্ভর থাকতে পারে না।
আমাদের ট্রেন ব্রাসিয়া স্টেশনের অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকে গেলে দেখলাম, লোকজন সেখানে পায়ের নিচে জ্বলন্ত কয়লা পড়লে যেভাবে বিলাপ করে সেভাবে বিলাপ করছে, যাই ঘটুক না কেন, আমরা তখনও একে অন্যকে উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছিলাম, আলাদা করে আমরা তিনজন গায়ে গায়ে লেগে থাকলাম সারাক্ষণ। আমরা কি একধরনের বিরোধিতা নিয়েই পৌঁছুলাম না?
আমরা ট্রেন থেকে নামলাম; একটা ট্যাক্সি ভাড়া করতে গেলাম, গাড়িটা যেন কোনোমতে চার চাকার উপরে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের লুফে নিল; ড্রাইভার রসিক মানুষ, আমরা প্রায় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে কমিটির প্যালেসের দিকে যেতে থাকলাম, যেখানে আমাদের মনের বিদ্বেষ এমনভাবে গায়েব হয়ে গেল যেন আমাদের মনে বিদ্বেষ কখনো ছিলই না; ওখানে আমাদের যা যা দরকার সব বলে দেওয়া হলো। যে সরাইখানায় আমাদের নিয়ে গেল, সেটা দেখে মনে হলো যেন, এমন নোংরা হোটেল আমরা জীবনে প্রথম দেখলাম, কিন্তু শীঘ্রই মনে হলো, ওটা অতটা খারাপও নয়। ওখানে যেন সাধারণভাবেই ধুলা-ময়লা আছে আর তা নিয়ে কথা বলারও দরকার নেই, এগুলো এমন এক ময়লা, যার কোনো বিকল্প নেই, যার শিকড় আছে, যে ময়লা মানুষের জীবনকে আরও খাঁটি এবং মাটি সংলগ্ন করে তোলে, ঐ ধুলা-ময়লার ভিতর থেকেই আমাদের নিমন্ত্রণকর্তা তড়িঘড়ি এগিয়ে এলেন, ভদ্রলোক নিজের অস্তিত্ব ও অবস্থান সম্পর্কে ভালোভাবে সচেতন, আমাদের প্রতি খুবই বিনীত, তার কনুই দুটো অনবরত নড়াচড়া করছে, এবং তার হাত দুটোর (প্রত্যেকটা আঙুলে প্রশংসা ঝরে পড়ছে) ছায়া তার মুখে ক্ষণে ক্ষণে ছায়া ফেলছে একেকবার একেক আকৃতিতে, এটার কারণ ছিল যে সে অনবরত কোমর ভাঁজ করে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল, সে বিষয়টা আমরা পরে বুঝতে পেরেছিলাম, ঠিক যেন বিমানঘাঁটির গ্যাব্রিয়েলে ডি আনুনজিও; যিনি এমন লোক, যাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা যায়, ময়লার বিরুদ্ধে কিছু কি করা যায়, এমন সব কিছু প্রশ্ন।
বিমানঘাঁটিটা মন্টকেয়ারিতে, এক ঘণ্টার কম সময়ে মনতোয়াগামী লোকাল রেলসার্ভিসে চড়ে সেখানে পৌঁছানো যায়। লোকাল রেলটা একটা পাবলিক হাইওয়ে রিজার্ভ করেছে এটার জন্য, সেসঙ্গে এটার ট্রেনগুলোও মার্জিত রুচিসম্পন্ন, বাকি ট্রাফিকগুলোর মতো চরম দ্রুত অথবা অত্যন্ত ধীর নয়, বাইসাইকেল চালকরা ঐ ধুলা-বালির ভিতর দিয়ে চোখ প্রায় বন্ধ করে পায়ে প্যাডেল করে যাচ্ছে, এখানে পুরো প্রদেশের সম্পূর্ণ অকেজো গাড়িগুলো- যেগুলো যতটা সম্ভব যাত্রী নিতে পারে এবং যত দ্রুত সম্ভব যেতে পারে, সেগুলো সব বুঝেশুনেই আমাদের পেরিয়ে গেল- এবং এগুলো ভিতর দিয়ে দৈত্যাকৃতি মোটর-গাড়িগুলো, একবার যদি এগুলোকে সুযোগ দেওয়া হয়, মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে সেগুলো ঘুরে দাঁড়াবে, তাদের বহুমুখী তূর্যনিনাদসহ যা খুব দ্রুতগতিতে একটি সরল ধ্বনিতে মিশে যায়।
কখনো কখনো এই দুর্বিষহ ট্রেন করে সার্কুইটোতে পৌঁছাবার সকল আশা ত্যাগ করতে হয়। বতর্নীর পথে এমনভাবে পৌঁছায় যে এই নারকীয় ট্রেন শুধু একাই নিঃসঙ্গ পিছনে পড়ে থাকে। কিন্তু আমাদের চারধারে ট্রেনের যাত্রীরা হাসছে, এবং ডান ও বাম পাশ থেকে রাস্তার লোকজন ট্রেনের ভিতর হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে। আমি একটা শেষ প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলাম, একজন দৈত্যাকৃতি লোক পা ফাঁকা করে দু’বগিতে দুই পা রেখে দাঁড়িয়ে আমাকে প্রায় ঠেসে ধরেছিল, ধাক্কা সামলানোর গদিগুলোর উপরে সমানে ধুলা এবং কালি-ঝুলির বৃষ্টি হচ্ছে, এসব ধুলা-বালি মৃদুলয়ে ধাক্কা খাওয়া বাগিগুলোর ছাদ থেকে ঝরে পড়ছে। ট্রেনটা উল্টাদিক থেকে আসা ট্রেনের জন্য দুবার থামল, কাজেই দীর্ঘসময় ধরে ধৈর্যের সঙ্গে ট্রেনটা শুধু কোনোমতে বেরিয়ে যাবার পথ খুঁজে পেতে অপেক্ষা করতে থাকল। কিছু গ্রামবাসী ধীরে ধীরে ক্রসিং পার হয়ে গেল, দেয়ালজুড়ে এখানে সেখানে গত মোটরগাড়ি রেসের বিজ্ঞাপনের উত্তেজক পোস্টার সাঁটানো দেখা যাচ্ছে, রাস্তার দু’পাশের সাদা ধুলোয় গাছের পাতাগুলোগুলো জলপাইপাতার রঙ ধারণ করে এমনভাবে ঢেকে গেছে যে কোনো গাছেরই আর আলাদা করে জাত বিচার করা যাচ্ছে না।
আর এগোতে না পেরে ট্রেনটি শেষপর্যন্ত থেমে যায়। একঝাঁক মোটরগাড়ি ঠিক সেই সময়ে ছুটতে শুরু করে, ধুলোর ভিতর দিয়ে ওগুলো চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করল, আমরা দেখতে পেলাম, কাছেই, অনেকগুলো ছোটো ছোটো পতাকা বাতাসে দুলছিল; একদল গবাদিপশু ভীষণ উত্তেজিত হয়ে টিলা-পাহাড়ের ভিতরে চেহারা দেখাচ্ছে এবং হারিয়ে যাচ্ছে, ছুটে এসে ধাম করে মোটরগাড়িতে ধাক্কা মারছে, এগুলোই আমাদের এখনো পথে আটকে রেখেছে।
আমরা পৌঁছুলাম। বিমানবন্দরের সামনে অনেক বড় একটা খোলামেলা জায়গা; সেখানে সন্দেহজনক চেহারার ছোট্ট ছোট্ট কাঠের কুটির, ওর উপরে আমরা অন্যকিছুর নোটিশ লেখা দেখার প্রত্যাশা করলাম, এরপরে : গ্যারেজ, গ্র্যান্ড বাফেট ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি। প্রচুর পরিমাণ ভিখারী ঠেলাগাড়ির ভিতর বসে বসে মোটা হচ্ছে, পথে আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, একজনকে বিরক্ত করে এমন উত্তেজিত করবে যে সে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইবে। প্রচুর লোককে আমরা পেরিয়ে গেলাম, প্রচুর লোক আমাদের পেরিয়ে গেল। আমরা বাতাসের দিকে তাকাই, এখানে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এখনো কেউ উড়তে শুরু করেনি। আমরা কারুর জন্য রাস্তা বের করে দিইনি এবং আমরা চাপাও পড়িনি। হাজার হাজার যানবাহনের মধ্যে থেকে ও হাজারো যানবাহনকে পিছনে ফেলে, তাদের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, সেখানে ইতালীয় অশ্বারোহী বাহিনী হঠাৎ বেগে প্রবেশ করে। শৃঙ্খলা এবং দুর্ঘটনা দুটোকেই সমান রকম অসম্ভব মনে হয়।
ব্রেশায় একবার শেষ সন্ধ্যায় আমরা খুব দ্রুত একটা বিশেষ রাস্তায় যেতে চাইলাম, রাস্তাটা আমাদের হিসাবে যথেষ্ট দীর্ঘ ছিল। এ পথটুকু যাবার জন্য একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার ৩ লিরা দাবি করে বসল, আমরা দুই লিরা বললাম। ট্যাক্সিওয়ালা রাজি হলো না এবং কোনো বিরোধিতা-বিতর্ক না করেই সে আমাদের কাছে খুব সুন্দর করে ইনিয়ে-বিনিয়ে এই রাস্তার ভয়ঙ্কর রকম দূরত্বের কথা বলল। তখন আমরা নিজেদের নির্ধারণ করে দেওয়া ভাড়া এত কম ভেবে ভীষণ লজ্জা পেতে থাকি। এরপর যাত্রার ভাড়া ৩ লিরায়ই ঠিক হলো। আমরা লাফিয়ে ট্যাক্সিটায় উঠলাম। ট্যাক্সিটা ছোটো ছোটো রাস্তা ধরে মাত্র তিনবার মোড় ঘুরল আর আমরা কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। আমাদের অন্য দুজনের চেয়ে অট্টো অনেক বেশি কর্মচঞ্চল ও প্রাণবন্ত, ও ঘোষণা করল, সে এমনিতেই কোনো দুর্বল মুহূর্তেও এক মিনিটের পথযাত্রার জন্য তিন লিরা ভাড়া দেবে না। এটুকু পথের জন্য এক লিরাও অনেক বেশি ভাড়া হয়ে যায়। সে এই একটা লিরাই পেতে পারে। ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে গেছে, ছোটো রাস্তাটা পুরো খালি, ক্ষমতাবান ট্যাক্সি ড্রাইভার মুহূর্তে উত্তেজিত হয়ে পড়ল, মনে হচ্ছিল যেন এই বিতর্ক পুরো একঘণ্টা ধরে চলবে : কী?- এটা তো প্রতারণা,- কোন বিবেচনায় আমরা এমন ভাবতে পারছি। -তিন লিরায়ই তো রাজি হয়েছিল, তিন লিরাই দিতে হবে, তিন লিরা দিয়ে দাও নয়তো সে অন্য ব্যবস্থা নেবে। অট্টো : “কী জন্য দেব, শুল্ক অথবা পুলিশকে দিতে হবে!” শুল্ক? এখানে কোনো শুল্ক নেই- এজন্য কীভাবে শুল্ক আরোপ হতে পারে? -এটা রাত্রিকালীন ভ্রমণের জন্য একটা চুক্তি ছিলো, কিন্তু আমরা যদি এখন তাকে ২ লিরা দিয়ে দেই, সে আমাদের যেতে দেবে। অট্টো ভয় পাবার মতো ভঙ্গী করে বললো : শুল্ক অথবা পুলিশ! আরও কিছুক্ষণ চেঁচামেচি ও খোঁজাখুজির পর একটা ট্যাক্স দেবার কাগজ খুঁজে পাওয়া গেল, ঐ কাগজে ধুলা ছাড়া কিছুই দেখা গেল না। কাজেই আমরা দেড় লিরায় মেনে নিলাম আর ট্যাক্সিটাও সংকীর্ণ রাস্তা ধরে বেরিয়ে গেল, এই রাস্তা দিয়ে সে ঘুরে আসতেও পারে না, শুধু রেগে গিয়ে নয়, দুঃখের সাথেও, আমার কাছে এমনটাই মনে হলো। আমাদের ব্যবহার দুর্ভাগ্যবশত সঠিক ছিল না; ইতালিতে কেউ এমন আচরণ করতে পারে না; অন্য কোথাও হয়তো এমন আচরণ করা চলে, কিন্তু এখানে নয়। আহ্, বেশ, এখন যে উত্তেজনার ভিতর দিয়ে যাচ্ছি, এখন আর কে এসব নিয়ে ভাববে! এখানে অভিযোগের কিছু নেই, একজন ব্যক্তি মাত্র একটা এভিয়েশন সপ্তাহ ইতালিতে সময় কাটাতে এসে ইতালিয়ান হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু অনুশোচনা বিমানঘাঁটিতে আমাদের আনন্দকে শুধু নষ্ট করবে না, এটা শুধু আরেকবার নতুন করে অনুশোচনা আনবে এবং বিমানবন্দরের ভিতরের দিকে আমরা হাঁটার বদলে বরং লাফাতে থাকলাম, আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো উৎসাহে উদ্বেল হয়ে এই সূর্যতাপের নিচে আমাদের ধরে রাখছে।
আমরা বিমানের হ্যাঙ্গার পেরিয়ে এলাম, হ্যাঙ্গারগুলোর পর্দা নামানো ছিল, ভ্রমণরত নাট্যকুশলীদের বন্ধ মঞ্চের মতো পর্দা ফেলে ওগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পেডিমেন্টগুলোতে সেইসব বৈমানিকদের নাম লেখা আছে যাদের মেশিন তারা লুকিয়ে রেখেছে এবং ওগুলোর উপরে পতপত করে উড়ছে তাদের মাতৃভূমির পতাকা। আমরা নামগুলো পড়ি, কোবিয়ানচি, ক্যাঙ্গো, ক্যালডোরা, রুজিয়ের, কার্টিস, মনচার (ট্রেন্টোর একজন তিলোরিয়ান যিনি ইতালীয় ছদ্মবেশে উড়ে বেড়ান, তিনি আমাদের চেয়ে ইতালীয়দের বেশি বিশ্বাস করেন), আনজানি, রোমান এভিয়েটর ক্লাবের নাম এগুলো। এবং ব্লেরিও? আমরা জিজ্ঞাসা করলাম। ব্লেরিও, যার বিষয়ে আমরা সব সময় মনে মনে ভাবছিলাম, ব্লেরিও কোথায়?
হ্যাঙ্গারের ঠিক সামনে বেড়া দেওয়া জায়গাটায় খাটো চেহারা খাড়া নাকের রুজিয়ের হাতাওয়ালা শার্ট পরে দৌড়াদৌড়ি করছিল, ভয়ঙ্কর অঙ্গভঙ্গি করে সে তার হাতদুটো ঝাঁকুনি দিল, যেতে যেতে নিজের গায়ে আলতো করে চাপড় মেরে সে তার সকল যন্ত্রবিদদের হ্যাঙ্গারের পর্দার পিছনে পাঠিয়ে দিল, ফের তাদের ডাকল, নিজের মধ্যে ভাবনায় ডুবে গেল, তার সামনে গাড়ি চলছে, তখন একপাশ থেকে তার স্ত্রী, একটা আঁটসাঁট সাদা পোশাকে, একটা ছোট্ট কালো টুপি শক্তপোক্ত করে মাথার চুলের ভিতরে লাগানো, খাটো স্কার্টের নিচে তার পযুগল আকর্ষণীয়ভাবে ফাঁক হওয়া, তাপমাত্রার শূন্যতার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এমন একজন ব্যবসায়ী নারী তিনি, দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের সব বিষয়-আশয় তার ছোট্ট মাথার ভিতরে ঢুকে বসে আছে।
হ্যাঙ্গারের সামনে বসে আছে কার্টিস, সম্পূর্ণ একা। অল্প করে তোলা পর্দার পিছনে তার মেকানিকদের দেখা যাচ্ছে; লোকজন যে পরিমাণ বলে, তার চেয়েও অনেক বড় এটা। আমরা যখন ওটাকে পেরিয়ে গেলাম কার্টিস তার সামনে নিউইয়র্ক হেরাল্ড পত্রিকাটি খুলে ধরেছিল এবং প্রথম পৃষ্ঠার উপর থেকে একটা লাইন পড়ছিল; আধাঘণ্টা পরে আমরা আবার ওখান থেকে হেঁটে গেলাম, তখন সে পত্রিকাটা পড়তে পড়তে প্রথম পৃষ্ঠার মাঝামাঝি চলে এসেছে; এরপরের আধাঘণ্টায় সে ঐ পৃষ্ঠাটা পড়ে শেষ করে ফেলল এবং নতুন আরেকটা পৃষ্ঠা পড়া শুরু করল। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল, সে আজকে আর উড়োজাহাজ উড়াচ্ছে না।
আমরা ঘুরে দাঁড়িয়ে বিস্তৃত বিমানবন্দরটিকে দেখি। এটা এত বড় যে কেউ ওখানে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে; বিজয়ীদের পোস্ট আমাদের কাছাকাছি ছিল, দূরে সিগন্যাল মাস্তুল, ডানদিকে কোথাও উড়ান দেবার জায়গা, কমিটির মোটর গাড়ি, বাতাসে পত পত করে ওড়া গাড়িগুলোর ছোট্ট হলুদ পতাকাসহ, যেগুলো মাঠ পেরিয়ে ওপারে একটা বাঁককে ফুটিয়ে তুলছে, নিজেদেরই ধুলোর ভারে থেমে যায়, আবার চলতে থাকে।
এখানে প্রায় সম্পূর্ণ গ্রীষ্মম-লীয় এলাকায় একটা কৃত্রিম মরুভূমি তৈরি করা হয়েছে, এবং ইতালির উচ্চ আভিজাত্য, প্যারিস থেকে আসা চকমকে সম্ভ্রান্ত নারীবৃন্দ এবং আরও অন্যান্য জায়গা থেকে আসা অভ্যাগতবৃন্দরা এখানে জড়ো হয়েছেন, কুচকানো চোখে, রৌদ্রঝলসিত আবর্জনার দিকে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তাকিয়ে আছেন। এখানে এমন কিছু নেই যেটা খেলার মাঠটাকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তুলবে। দৌড় প্রতিযোগিতায় সুন্দর সুন্দর লাফের ঘাটতি আছে, একই অবস্থা টেনিস কোর্টের সাদা দাগের ক্ষেত্রেও, আঁকা হয়নি, ফুটবল ম্যাচগুলোর মাঠে তাজা ঘাসের চাবড়ায় কোনো দাগ নেই, মোটরকার-রেস এবং বাইসাইকেল রেসের-ট্র্যাকের পাথুরে উঁচুনীচু পথেও কোনো চিহ্ন নেই। শুধু বিকেলে দু-তিনবার একদল রঙিন পোশাক পরা অশ্বারোহী দুলকি চালে সমতলভূমিটা পেরিয়ে গেল। ধুলোয় ডুবে যাওয়ায় ঘোড়াগুলোর খুর দেখা যাচ্ছিল না, পাঁচটা বাজার আগে সূর্যের তেজও এতটুকু কমলো না। কাজেই আমাদের কোনোকিছুই বিরক্ত করল না, আমরা যখন সমতলভূমিটাকে ভালোভাবে দেখছিলাম, সেখানে কোনো ধরনের কোনো গান বা অন্য কিছু ছিল না, সস্তা টিকিটের দর্শক সারিতে জড়াজড়ি করে থাকা জনতার বাঁশির শব্দ আমাদের ধৈর্য ও শ্রবণের সীমাকে ছুঁতে চাইছিল। আমাদের পিছনে থাকা দামী টিকিটের স্ট্যান্ডগুলো থেকে দেখলে, দেখা যায় যে, জনতার ভিড় ফাঁকা সমতলভূমিতে অস্পষ্টভাবে যেন গলে পড়ছে। (আগামী সংখ্যায় পড়–ন)
ফ্রান্ৎস কাফকা গল্প
অনুবাদ : বিপাশা মন্ডল
ছবি সূত্র ইন্টারনেট
বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
১৯০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর লা সেন্টিনেলা ব্রেশাকানা রিপোর্ট করল এবং রিপোর্টটা করতে পেরে তারা খুব খুশি হল : ‘ব্রেশায় আমরা লোকজনদের এমন একটা সমাবেশ পেয়েছি যেটা আগে কখনো পাইনি, এমনকি সেই বিশাল মোটরগাড়ি রেসের সময়েও পাইনি; দর্শনার্থীরা ভেটেনিয়া, লিগুরিয়া, ইডমন্ট তুসক্যানি, রোম বস্তুত নেপলসের মতো দূর-দূরান্ত থেকেও এসেছিল; ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকা থেকে এসেছিল বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ; সকলে মিলে আমাদের স্কয়ার চত্বরে, আমাদের হোটেলগুলোয়, আমাদের ব্যক্তিগত বাড়িগুলোর প্রত্যেকটা খালি কোণে জায়গা পাবার জন্য ধাক্কাধাক্কি করছিল; সব জিনিসের দাম সন্তোষজনকভাবে বেড়ে গিয়েছিল; লোকজনকে সার্কিটিও এরিওতে আনা-নেওয়ার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা অনিবার্য হয়ে ওঠে; বিমানবন্দর এলাকার রেস্তরাঁগুলো প্রশংসনীয়ভাবে অন্তত দুহাজার লোকের খাবার পরিবেশন করেছে, কিন্তু হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে তারা হার মেনেছে, পরিস্থিতি এমন ছিল যে সৈন্যদেরকে বুফে রেস্তরাঁগুলোকে রক্ষা করার জন্য মাঠে নামতে হয়েছিল; মাঠের সস্তা টিকিটের জায়গাগুলো থেকে ৫০ হাজার উৎসাহী দর্শক সারাদিন ধরে দাঁড়িয়ে ছিল।’
এভাবে খবরটা পড়ে আমি ও আমার দু’বন্ধু যুগপৎ আত্মবিশ্বাসী ও সতর্ক হয়ে উঠেছিলাম। আত্মবিশ্বাসী কারণ : যেখানে এত ভয়াবহরকম চাপ থাকে সেখানে সবকিছু স্বভাবতই গণতান্ত্রিকভাবে এগিয়ে যায়, আর ওখানে যে আদতেই কোনো থাকার জয়গা ছিল না সেটা কারুর প্রমাণের কোনো প্রয়োজন ছিল না। সতর্ক কারণ : এ ধরনের এন্টারপ্রাইজের ইটালিয়ান ধরনে সংগঠিত করা বিষয়ক সতর্কতা, ঐ কমিটি বিষয়ে সতর্কতা, যেটা নিজে থেকে সচেতন ছিল আমাদের ভালোভাবে যতœ করতে হবে, ট্রেন বিষয়ে সতর্কতা, এর মধ্যে আবার সেন্টিনেলার বিষয়ে চার ঘণ্টা দেরি করে ফেলার গল্পও চালু আছে।
সকল প্রত্যাশা মিথ্যে প্রমাণিত হলো; যে কোনোভাবে একজন ব্যক্তি বেড়ানোর শেষে বাড়ি ফিরে গেলে ইতালিতে থাকার সকল স্মৃতি দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায়; স্মৃতিগুলো তাদের স্বচ্ছতা হারায়, সে আর ঐ স্মৃতিনির্ভর থাকতে পারে না।
আমাদের ট্রেন ব্রাসিয়া স্টেশনের অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকে গেলে দেখলাম, লোকজন সেখানে পায়ের নিচে জ্বলন্ত কয়লা পড়লে যেভাবে বিলাপ করে সেভাবে বিলাপ করছে, যাই ঘটুক না কেন, আমরা তখনও একে অন্যকে উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছিলাম, আলাদা করে আমরা তিনজন গায়ে গায়ে লেগে থাকলাম সারাক্ষণ। আমরা কি একধরনের বিরোধিতা নিয়েই পৌঁছুলাম না?
আমরা ট্রেন থেকে নামলাম; একটা ট্যাক্সি ভাড়া করতে গেলাম, গাড়িটা যেন কোনোমতে চার চাকার উপরে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের লুফে নিল; ড্রাইভার রসিক মানুষ, আমরা প্রায় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে কমিটির প্যালেসের দিকে যেতে থাকলাম, যেখানে আমাদের মনের বিদ্বেষ এমনভাবে গায়েব হয়ে গেল যেন আমাদের মনে বিদ্বেষ কখনো ছিলই না; ওখানে আমাদের যা যা দরকার সব বলে দেওয়া হলো। যে সরাইখানায় আমাদের নিয়ে গেল, সেটা দেখে মনে হলো যেন, এমন নোংরা হোটেল আমরা জীবনে প্রথম দেখলাম, কিন্তু শীঘ্রই মনে হলো, ওটা অতটা খারাপও নয়। ওখানে যেন সাধারণভাবেই ধুলা-ময়লা আছে আর তা নিয়ে কথা বলারও দরকার নেই, এগুলো এমন এক ময়লা, যার কোনো বিকল্প নেই, যার শিকড় আছে, যে ময়লা মানুষের জীবনকে আরও খাঁটি এবং মাটি সংলগ্ন করে তোলে, ঐ ধুলা-ময়লার ভিতর থেকেই আমাদের নিমন্ত্রণকর্তা তড়িঘড়ি এগিয়ে এলেন, ভদ্রলোক নিজের অস্তিত্ব ও অবস্থান সম্পর্কে ভালোভাবে সচেতন, আমাদের প্রতি খুবই বিনীত, তার কনুই দুটো অনবরত নড়াচড়া করছে, এবং তার হাত দুটোর (প্রত্যেকটা আঙুলে প্রশংসা ঝরে পড়ছে) ছায়া তার মুখে ক্ষণে ক্ষণে ছায়া ফেলছে একেকবার একেক আকৃতিতে, এটার কারণ ছিল যে সে অনবরত কোমর ভাঁজ করে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল, সে বিষয়টা আমরা পরে বুঝতে পেরেছিলাম, ঠিক যেন বিমানঘাঁটির গ্যাব্রিয়েলে ডি আনুনজিও; যিনি এমন লোক, যাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা যায়, ময়লার বিরুদ্ধে কিছু কি করা যায়, এমন সব কিছু প্রশ্ন।
বিমানঘাঁটিটা মন্টকেয়ারিতে, এক ঘণ্টার কম সময়ে মনতোয়াগামী লোকাল রেলসার্ভিসে চড়ে সেখানে পৌঁছানো যায়। লোকাল রেলটা একটা পাবলিক হাইওয়ে রিজার্ভ করেছে এটার জন্য, সেসঙ্গে এটার ট্রেনগুলোও মার্জিত রুচিসম্পন্ন, বাকি ট্রাফিকগুলোর মতো চরম দ্রুত অথবা অত্যন্ত ধীর নয়, বাইসাইকেল চালকরা ঐ ধুলা-বালির ভিতর দিয়ে চোখ প্রায় বন্ধ করে পায়ে প্যাডেল করে যাচ্ছে, এখানে পুরো প্রদেশের সম্পূর্ণ অকেজো গাড়িগুলো- যেগুলো যতটা সম্ভব যাত্রী নিতে পারে এবং যত দ্রুত সম্ভব যেতে পারে, সেগুলো সব বুঝেশুনেই আমাদের পেরিয়ে গেল- এবং এগুলো ভিতর দিয়ে দৈত্যাকৃতি মোটর-গাড়িগুলো, একবার যদি এগুলোকে সুযোগ দেওয়া হয়, মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে সেগুলো ঘুরে দাঁড়াবে, তাদের বহুমুখী তূর্যনিনাদসহ যা খুব দ্রুতগতিতে একটি সরল ধ্বনিতে মিশে যায়।
কখনো কখনো এই দুর্বিষহ ট্রেন করে সার্কুইটোতে পৌঁছাবার সকল আশা ত্যাগ করতে হয়। বতর্নীর পথে এমনভাবে পৌঁছায় যে এই নারকীয় ট্রেন শুধু একাই নিঃসঙ্গ পিছনে পড়ে থাকে। কিন্তু আমাদের চারধারে ট্রেনের যাত্রীরা হাসছে, এবং ডান ও বাম পাশ থেকে রাস্তার লোকজন ট্রেনের ভিতর হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে। আমি একটা শেষ প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলাম, একজন দৈত্যাকৃতি লোক পা ফাঁকা করে দু’বগিতে দুই পা রেখে দাঁড়িয়ে আমাকে প্রায় ঠেসে ধরেছিল, ধাক্কা সামলানোর গদিগুলোর উপরে সমানে ধুলা এবং কালি-ঝুলির বৃষ্টি হচ্ছে, এসব ধুলা-বালি মৃদুলয়ে ধাক্কা খাওয়া বাগিগুলোর ছাদ থেকে ঝরে পড়ছে। ট্রেনটা উল্টাদিক থেকে আসা ট্রেনের জন্য দুবার থামল, কাজেই দীর্ঘসময় ধরে ধৈর্যের সঙ্গে ট্রেনটা শুধু কোনোমতে বেরিয়ে যাবার পথ খুঁজে পেতে অপেক্ষা করতে থাকল। কিছু গ্রামবাসী ধীরে ধীরে ক্রসিং পার হয়ে গেল, দেয়ালজুড়ে এখানে সেখানে গত মোটরগাড়ি রেসের বিজ্ঞাপনের উত্তেজক পোস্টার সাঁটানো দেখা যাচ্ছে, রাস্তার দু’পাশের সাদা ধুলোয় গাছের পাতাগুলোগুলো জলপাইপাতার রঙ ধারণ করে এমনভাবে ঢেকে গেছে যে কোনো গাছেরই আর আলাদা করে জাত বিচার করা যাচ্ছে না।
আর এগোতে না পেরে ট্রেনটি শেষপর্যন্ত থেমে যায়। একঝাঁক মোটরগাড়ি ঠিক সেই সময়ে ছুটতে শুরু করে, ধুলোর ভিতর দিয়ে ওগুলো চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করল, আমরা দেখতে পেলাম, কাছেই, অনেকগুলো ছোটো ছোটো পতাকা বাতাসে দুলছিল; একদল গবাদিপশু ভীষণ উত্তেজিত হয়ে টিলা-পাহাড়ের ভিতরে চেহারা দেখাচ্ছে এবং হারিয়ে যাচ্ছে, ছুটে এসে ধাম করে মোটরগাড়িতে ধাক্কা মারছে, এগুলোই আমাদের এখনো পথে আটকে রেখেছে।
আমরা পৌঁছুলাম। বিমানবন্দরের সামনে অনেক বড় একটা খোলামেলা জায়গা; সেখানে সন্দেহজনক চেহারার ছোট্ট ছোট্ট কাঠের কুটির, ওর উপরে আমরা অন্যকিছুর নোটিশ লেখা দেখার প্রত্যাশা করলাম, এরপরে : গ্যারেজ, গ্র্যান্ড বাফেট ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি। প্রচুর পরিমাণ ভিখারী ঠেলাগাড়ির ভিতর বসে বসে মোটা হচ্ছে, পথে আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, একজনকে বিরক্ত করে এমন উত্তেজিত করবে যে সে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইবে। প্রচুর লোককে আমরা পেরিয়ে গেলাম, প্রচুর লোক আমাদের পেরিয়ে গেল। আমরা বাতাসের দিকে তাকাই, এখানে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এখনো কেউ উড়তে শুরু করেনি। আমরা কারুর জন্য রাস্তা বের করে দিইনি এবং আমরা চাপাও পড়িনি। হাজার হাজার যানবাহনের মধ্যে থেকে ও হাজারো যানবাহনকে পিছনে ফেলে, তাদের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, সেখানে ইতালীয় অশ্বারোহী বাহিনী হঠাৎ বেগে প্রবেশ করে। শৃঙ্খলা এবং দুর্ঘটনা দুটোকেই সমান রকম অসম্ভব মনে হয়।
ব্রেশায় একবার শেষ সন্ধ্যায় আমরা খুব দ্রুত একটা বিশেষ রাস্তায় যেতে চাইলাম, রাস্তাটা আমাদের হিসাবে যথেষ্ট দীর্ঘ ছিল। এ পথটুকু যাবার জন্য একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার ৩ লিরা দাবি করে বসল, আমরা দুই লিরা বললাম। ট্যাক্সিওয়ালা রাজি হলো না এবং কোনো বিরোধিতা-বিতর্ক না করেই সে আমাদের কাছে খুব সুন্দর করে ইনিয়ে-বিনিয়ে এই রাস্তার ভয়ঙ্কর রকম দূরত্বের কথা বলল। তখন আমরা নিজেদের নির্ধারণ করে দেওয়া ভাড়া এত কম ভেবে ভীষণ লজ্জা পেতে থাকি। এরপর যাত্রার ভাড়া ৩ লিরায়ই ঠিক হলো। আমরা লাফিয়ে ট্যাক্সিটায় উঠলাম। ট্যাক্সিটা ছোটো ছোটো রাস্তা ধরে মাত্র তিনবার মোড় ঘুরল আর আমরা কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। আমাদের অন্য দুজনের চেয়ে অট্টো অনেক বেশি কর্মচঞ্চল ও প্রাণবন্ত, ও ঘোষণা করল, সে এমনিতেই কোনো দুর্বল মুহূর্তেও এক মিনিটের পথযাত্রার জন্য তিন লিরা ভাড়া দেবে না। এটুকু পথের জন্য এক লিরাও অনেক বেশি ভাড়া হয়ে যায়। সে এই একটা লিরাই পেতে পারে। ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে গেছে, ছোটো রাস্তাটা পুরো খালি, ক্ষমতাবান ট্যাক্সি ড্রাইভার মুহূর্তে উত্তেজিত হয়ে পড়ল, মনে হচ্ছিল যেন এই বিতর্ক পুরো একঘণ্টা ধরে চলবে : কী?- এটা তো প্রতারণা,- কোন বিবেচনায় আমরা এমন ভাবতে পারছি। -তিন লিরায়ই তো রাজি হয়েছিল, তিন লিরাই দিতে হবে, তিন লিরা দিয়ে দাও নয়তো সে অন্য ব্যবস্থা নেবে। অট্টো : “কী জন্য দেব, শুল্ক অথবা পুলিশকে দিতে হবে!” শুল্ক? এখানে কোনো শুল্ক নেই- এজন্য কীভাবে শুল্ক আরোপ হতে পারে? -এটা রাত্রিকালীন ভ্রমণের জন্য একটা চুক্তি ছিলো, কিন্তু আমরা যদি এখন তাকে ২ লিরা দিয়ে দেই, সে আমাদের যেতে দেবে। অট্টো ভয় পাবার মতো ভঙ্গী করে বললো : শুল্ক অথবা পুলিশ! আরও কিছুক্ষণ চেঁচামেচি ও খোঁজাখুজির পর একটা ট্যাক্স দেবার কাগজ খুঁজে পাওয়া গেল, ঐ কাগজে ধুলা ছাড়া কিছুই দেখা গেল না। কাজেই আমরা দেড় লিরায় মেনে নিলাম আর ট্যাক্সিটাও সংকীর্ণ রাস্তা ধরে বেরিয়ে গেল, এই রাস্তা দিয়ে সে ঘুরে আসতেও পারে না, শুধু রেগে গিয়ে নয়, দুঃখের সাথেও, আমার কাছে এমনটাই মনে হলো। আমাদের ব্যবহার দুর্ভাগ্যবশত সঠিক ছিল না; ইতালিতে কেউ এমন আচরণ করতে পারে না; অন্য কোথাও হয়তো এমন আচরণ করা চলে, কিন্তু এখানে নয়। আহ্, বেশ, এখন যে উত্তেজনার ভিতর দিয়ে যাচ্ছি, এখন আর কে এসব নিয়ে ভাববে! এখানে অভিযোগের কিছু নেই, একজন ব্যক্তি মাত্র একটা এভিয়েশন সপ্তাহ ইতালিতে সময় কাটাতে এসে ইতালিয়ান হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু অনুশোচনা বিমানঘাঁটিতে আমাদের আনন্দকে শুধু নষ্ট করবে না, এটা শুধু আরেকবার নতুন করে অনুশোচনা আনবে এবং বিমানবন্দরের ভিতরের দিকে আমরা হাঁটার বদলে বরং লাফাতে থাকলাম, আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো উৎসাহে উদ্বেল হয়ে এই সূর্যতাপের নিচে আমাদের ধরে রাখছে।
আমরা বিমানের হ্যাঙ্গার পেরিয়ে এলাম, হ্যাঙ্গারগুলোর পর্দা নামানো ছিল, ভ্রমণরত নাট্যকুশলীদের বন্ধ মঞ্চের মতো পর্দা ফেলে ওগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পেডিমেন্টগুলোতে সেইসব বৈমানিকদের নাম লেখা আছে যাদের মেশিন তারা লুকিয়ে রেখেছে এবং ওগুলোর উপরে পতপত করে উড়ছে তাদের মাতৃভূমির পতাকা। আমরা নামগুলো পড়ি, কোবিয়ানচি, ক্যাঙ্গো, ক্যালডোরা, রুজিয়ের, কার্টিস, মনচার (ট্রেন্টোর একজন তিলোরিয়ান যিনি ইতালীয় ছদ্মবেশে উড়ে বেড়ান, তিনি আমাদের চেয়ে ইতালীয়দের বেশি বিশ্বাস করেন), আনজানি, রোমান এভিয়েটর ক্লাবের নাম এগুলো। এবং ব্লেরিও? আমরা জিজ্ঞাসা করলাম। ব্লেরিও, যার বিষয়ে আমরা সব সময় মনে মনে ভাবছিলাম, ব্লেরিও কোথায়?
হ্যাঙ্গারের ঠিক সামনে বেড়া দেওয়া জায়গাটায় খাটো চেহারা খাড়া নাকের রুজিয়ের হাতাওয়ালা শার্ট পরে দৌড়াদৌড়ি করছিল, ভয়ঙ্কর অঙ্গভঙ্গি করে সে তার হাতদুটো ঝাঁকুনি দিল, যেতে যেতে নিজের গায়ে আলতো করে চাপড় মেরে সে তার সকল যন্ত্রবিদদের হ্যাঙ্গারের পর্দার পিছনে পাঠিয়ে দিল, ফের তাদের ডাকল, নিজের মধ্যে ভাবনায় ডুবে গেল, তার সামনে গাড়ি চলছে, তখন একপাশ থেকে তার স্ত্রী, একটা আঁটসাঁট সাদা পোশাকে, একটা ছোট্ট কালো টুপি শক্তপোক্ত করে মাথার চুলের ভিতরে লাগানো, খাটো স্কার্টের নিচে তার পযুগল আকর্ষণীয়ভাবে ফাঁক হওয়া, তাপমাত্রার শূন্যতার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এমন একজন ব্যবসায়ী নারী তিনি, দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের সব বিষয়-আশয় তার ছোট্ট মাথার ভিতরে ঢুকে বসে আছে।
হ্যাঙ্গারের সামনে বসে আছে কার্টিস, সম্পূর্ণ একা। অল্প করে তোলা পর্দার পিছনে তার মেকানিকদের দেখা যাচ্ছে; লোকজন যে পরিমাণ বলে, তার চেয়েও অনেক বড় এটা। আমরা যখন ওটাকে পেরিয়ে গেলাম কার্টিস তার সামনে নিউইয়র্ক হেরাল্ড পত্রিকাটি খুলে ধরেছিল এবং প্রথম পৃষ্ঠার উপর থেকে একটা লাইন পড়ছিল; আধাঘণ্টা পরে আমরা আবার ওখান থেকে হেঁটে গেলাম, তখন সে পত্রিকাটা পড়তে পড়তে প্রথম পৃষ্ঠার মাঝামাঝি চলে এসেছে; এরপরের আধাঘণ্টায় সে ঐ পৃষ্ঠাটা পড়ে শেষ করে ফেলল এবং নতুন আরেকটা পৃষ্ঠা পড়া শুরু করল। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল, সে আজকে আর উড়োজাহাজ উড়াচ্ছে না।
আমরা ঘুরে দাঁড়িয়ে বিস্তৃত বিমানবন্দরটিকে দেখি। এটা এত বড় যে কেউ ওখানে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে; বিজয়ীদের পোস্ট আমাদের কাছাকাছি ছিল, দূরে সিগন্যাল মাস্তুল, ডানদিকে কোথাও উড়ান দেবার জায়গা, কমিটির মোটর গাড়ি, বাতাসে পত পত করে ওড়া গাড়িগুলোর ছোট্ট হলুদ পতাকাসহ, যেগুলো মাঠ পেরিয়ে ওপারে একটা বাঁককে ফুটিয়ে তুলছে, নিজেদেরই ধুলোর ভারে থেমে যায়, আবার চলতে থাকে।
এখানে প্রায় সম্পূর্ণ গ্রীষ্মম-লীয় এলাকায় একটা কৃত্রিম মরুভূমি তৈরি করা হয়েছে, এবং ইতালির উচ্চ আভিজাত্য, প্যারিস থেকে আসা চকমকে সম্ভ্রান্ত নারীবৃন্দ এবং আরও অন্যান্য জায়গা থেকে আসা অভ্যাগতবৃন্দরা এখানে জড়ো হয়েছেন, কুচকানো চোখে, রৌদ্রঝলসিত আবর্জনার দিকে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তাকিয়ে আছেন। এখানে এমন কিছু নেই যেটা খেলার মাঠটাকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তুলবে। দৌড় প্রতিযোগিতায় সুন্দর সুন্দর লাফের ঘাটতি আছে, একই অবস্থা টেনিস কোর্টের সাদা দাগের ক্ষেত্রেও, আঁকা হয়নি, ফুটবল ম্যাচগুলোর মাঠে তাজা ঘাসের চাবড়ায় কোনো দাগ নেই, মোটরকার-রেস এবং বাইসাইকেল রেসের-ট্র্যাকের পাথুরে উঁচুনীচু পথেও কোনো চিহ্ন নেই। শুধু বিকেলে দু-তিনবার একদল রঙিন পোশাক পরা অশ্বারোহী দুলকি চালে সমতলভূমিটা পেরিয়ে গেল। ধুলোয় ডুবে যাওয়ায় ঘোড়াগুলোর খুর দেখা যাচ্ছিল না, পাঁচটা বাজার আগে সূর্যের তেজও এতটুকু কমলো না। কাজেই আমাদের কোনোকিছুই বিরক্ত করল না, আমরা যখন সমতলভূমিটাকে ভালোভাবে দেখছিলাম, সেখানে কোনো ধরনের কোনো গান বা অন্য কিছু ছিল না, সস্তা টিকিটের দর্শক সারিতে জড়াজড়ি করে থাকা জনতার বাঁশির শব্দ আমাদের ধৈর্য ও শ্রবণের সীমাকে ছুঁতে চাইছিল। আমাদের পিছনে থাকা দামী টিকিটের স্ট্যান্ডগুলো থেকে দেখলে, দেখা যায় যে, জনতার ভিড় ফাঁকা সমতলভূমিতে অস্পষ্টভাবে যেন গলে পড়ছে। (আগামী সংখ্যায় পড়–ন)