বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলা
মালেক মুস্তাকিম
বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশের স্টলের সামনে বিদেশি ডেলিগেশনের সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধিবৃন্দ
গত ১৮-২২ জুন চীনের ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার, বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা “বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলা”। এ বছর ছিল মেলার ৩১ তম আসর। চায়না পাবলিশিং গ্রুপ চায়না সরকারের উদ্যোগে ১৯৮৬ সাল থেকে শুরু করে প্রতিবছর এ মেলা আয়োজন করে আসছে। মেলায় এ বছর বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশ অংশগ্রহণ করেছে এবং আড়াই লক্ষের অধিক বই প্রদর্শিত হয়েছে। বাংলাদেশ, চিলি, কেনিয়া, ওমানসহ ৯টি দেশ প্রথমবারের মতো এ মেলায় অংশগ্রহণ করেছে। মেলায় মালেশিয়াকে কান্ট্রি অব অনার হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আমন্ত্রিত হয়ে মেলায় অংশ নিয়েছে।
আমাদের উপমহাদেশের বইমেলা থেকে এ মেলা বিভিন্ন দিক দিয়ে ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যম-িত বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। বইমেলা মানেই অজ¯্র পাঠকের ভিড় ঠেলে প্রিয় বই কিনে ঘরে ফেরার আনন্দ। বইমেলা মানে পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের এক মহামিলনমেলা। বইমেলা মানেই প্রিয় লেখকের হাত থেকে অটোগ্রাফসহ বই নেয়া।
বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলায় এসে বইমেলার এ চিরাচরিত ধারণাই পাল্টে গিয়েছে আমার। চায়না কনভেনশন সেন্টারের পাঁচটি ফ্লোরজুড়ে এ বইমেলা হচ্ছে। হঠাৎ করে ঢুকলে যে কারোর মনে হতে পারে এখানে হয়তো কোনো বাণিজ্যিক পণ্যের এক্সিবিশন চলছে। অনিন্দ্য সুন্দর আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রদর্শন করা হচ্ছে নানা রকম বই। আলো ঝলমলে প্রতিটি স্টল ও প্যাভিলিয়নে রয়েছে ডিসপ্লে বোর্ড, সাজানো টেবিল চেয়ার আর বাহারি মনিটর। বইয়ের সেলফে সারি সারি বই। স্টলে পাতানো টেবিল চেয়ারে ছোট ছোট গ্রুপ করে মানুষ কথা বলছে, আলোচনা করছে, বই নেড়েচেড়ে দেখছে।
সব কিছুই আছে এ মেলায়, শুধু পাঠক নেই। নেই বইয়ের বেচাকেনা। পাঠক লেখকের ভিড় নেই। নেই কোনো অটোগ্রাফ শিকারী। আমার কাছে কিছুটা খটকা লাগলো। আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। গ্রাউন্ড ফ্লোর, দোতলা, তিনতলা। সব জায়গায় বই আর বই। অথচ পাঠক নেই। ক্রেতা নেই। কী আশ্চর্য!
পরে জানতে পারলাম, এ বইমেলার প্রথম কয়েক দিন মূলত প্রকাশকদের জন্য নির্ধারিত থাকে। শেষ দিকে পাঠকের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রকাশকেরা এই মেলায় এসে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দেশের বই দেখে এবং যে বইগুলো তাদের ভালো লাগে সেই বইয়ের প্রকাশকদের সাথে চুক্তি করেন। সে বইটি ক্রেতা পাবলিশার তাঁর মাতৃভাষায় অনুবাদ করে নিজের দেশে বাজারজাত করবেন। এভাবে এক দেশের বই সীমানা পেরিয়ে চলে যাবে অন্য দেশে, অন্য ভাষায়- পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে। আর বিভিন্ন স্টলে যে জটলাগুলো দেখলাম আলোচনার টেবিলে তারা মূলত বই নিয়েই কথা বলছে- দেনদরবার করছে। যাকে তারা বলে নেগোশিয়েশন। কোন প্রকাশক কোন বইটি নিবেন, কী কী শর্ত থাকবে, কীভাবে কত কপি বই ক্রেতা-পাবলিশার তার দেশে সারা বছর ছাপবেন ও বিপণন করবেন- মূলত এসব বিষয় নিয়েই কথাবার্তা হয়ে থাকে।
বুঝতে অসুবিধে হলো না যে, এ বইমেলার বড় একটি দিক হলো স্বত্ব বা কপিরাইট কেনাবেচা। পেঙ্গুইন থেকে শুরু করে পৃথিবীর বড় বড় পাবলিশার, যেমন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেসসহ সবাই বইয়ের কপিরাইট কেনাবেচায় নেগোশিয়েশন চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বই ছড়িয়ে দেবার এ এক অন্য রকম আয়োজন। শুনেছি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাতেও একইভাবে বইয়ের কপিরাইট বা স্বত্ব বিক্রি হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী বই বাণিজ্যের জন্য সব দেশের প্রকাশকেরা গড়ে তুলেছেন আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক- যারা বইমেলা ছাড়াও সারা বছর পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে বই বিনিময়, মুদ্রণ, বিপণন ও বাণিজ্যের এ কাজটি করে থাকেন। বই প্রকাশনার ক্ষেত্রেও এখন সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত প্রযুক্তির এ সময়েও কাগজের বইয়ের ব্যাপক চাহিদা ও মূল্যায়ন দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। ই-বুকের পাশাপাশি মুদ্রিত বই পুরো পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
আমাদের দেশের প্রকাশনা জগত অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময়। বিশ্বব্যাপী প্রকাশনার সাথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত হয়ে আমাদের বইও আমরা পৌঁছে দিতে পারি নানা দেশের পাঠকের হাতে। আন্তর্জাতিক এসব বইমেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের প্রকাশক, লেখক ও পাঠকের কাছেও আমাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্যের পরিচিতি তুলে ধরতে পারি এবং বিশ্বব্যাপী বইবাণিজ্যে যুক্ত হতে পারি। আগামী দিনে ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে বই-ই এঁকে দেবে মানুষের মানচিত্র- বইকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে নতুন পৃথিবী- যেন সে কথাই মনে করিয়ে দিল বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলা।
বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলা
মালেক মুস্তাকিম
বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশের স্টলের সামনে বিদেশি ডেলিগেশনের সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধিবৃন্দ
বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
গত ১৮-২২ জুন চীনের ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার, বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা “বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলা”। এ বছর ছিল মেলার ৩১ তম আসর। চায়না পাবলিশিং গ্রুপ চায়না সরকারের উদ্যোগে ১৯৮৬ সাল থেকে শুরু করে প্রতিবছর এ মেলা আয়োজন করে আসছে। মেলায় এ বছর বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশ অংশগ্রহণ করেছে এবং আড়াই লক্ষের অধিক বই প্রদর্শিত হয়েছে। বাংলাদেশ, চিলি, কেনিয়া, ওমানসহ ৯টি দেশ প্রথমবারের মতো এ মেলায় অংশগ্রহণ করেছে। মেলায় মালেশিয়াকে কান্ট্রি অব অনার হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আমন্ত্রিত হয়ে মেলায় অংশ নিয়েছে।
আমাদের উপমহাদেশের বইমেলা থেকে এ মেলা বিভিন্ন দিক দিয়ে ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যম-িত বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। বইমেলা মানেই অজ¯্র পাঠকের ভিড় ঠেলে প্রিয় বই কিনে ঘরে ফেরার আনন্দ। বইমেলা মানে পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের এক মহামিলনমেলা। বইমেলা মানেই প্রিয় লেখকের হাত থেকে অটোগ্রাফসহ বই নেয়া।
বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলায় এসে বইমেলার এ চিরাচরিত ধারণাই পাল্টে গিয়েছে আমার। চায়না কনভেনশন সেন্টারের পাঁচটি ফ্লোরজুড়ে এ বইমেলা হচ্ছে। হঠাৎ করে ঢুকলে যে কারোর মনে হতে পারে এখানে হয়তো কোনো বাণিজ্যিক পণ্যের এক্সিবিশন চলছে। অনিন্দ্য সুন্দর আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রদর্শন করা হচ্ছে নানা রকম বই। আলো ঝলমলে প্রতিটি স্টল ও প্যাভিলিয়নে রয়েছে ডিসপ্লে বোর্ড, সাজানো টেবিল চেয়ার আর বাহারি মনিটর। বইয়ের সেলফে সারি সারি বই। স্টলে পাতানো টেবিল চেয়ারে ছোট ছোট গ্রুপ করে মানুষ কথা বলছে, আলোচনা করছে, বই নেড়েচেড়ে দেখছে।
সব কিছুই আছে এ মেলায়, শুধু পাঠক নেই। নেই বইয়ের বেচাকেনা। পাঠক লেখকের ভিড় নেই। নেই কোনো অটোগ্রাফ শিকারী। আমার কাছে কিছুটা খটকা লাগলো। আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। গ্রাউন্ড ফ্লোর, দোতলা, তিনতলা। সব জায়গায় বই আর বই। অথচ পাঠক নেই। ক্রেতা নেই। কী আশ্চর্য!
পরে জানতে পারলাম, এ বইমেলার প্রথম কয়েক দিন মূলত প্রকাশকদের জন্য নির্ধারিত থাকে। শেষ দিকে পাঠকের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রকাশকেরা এই মেলায় এসে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দেশের বই দেখে এবং যে বইগুলো তাদের ভালো লাগে সেই বইয়ের প্রকাশকদের সাথে চুক্তি করেন। সে বইটি ক্রেতা পাবলিশার তাঁর মাতৃভাষায় অনুবাদ করে নিজের দেশে বাজারজাত করবেন। এভাবে এক দেশের বই সীমানা পেরিয়ে চলে যাবে অন্য দেশে, অন্য ভাষায়- পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে। আর বিভিন্ন স্টলে যে জটলাগুলো দেখলাম আলোচনার টেবিলে তারা মূলত বই নিয়েই কথা বলছে- দেনদরবার করছে। যাকে তারা বলে নেগোশিয়েশন। কোন প্রকাশক কোন বইটি নিবেন, কী কী শর্ত থাকবে, কীভাবে কত কপি বই ক্রেতা-পাবলিশার তার দেশে সারা বছর ছাপবেন ও বিপণন করবেন- মূলত এসব বিষয় নিয়েই কথাবার্তা হয়ে থাকে।
বুঝতে অসুবিধে হলো না যে, এ বইমেলার বড় একটি দিক হলো স্বত্ব বা কপিরাইট কেনাবেচা। পেঙ্গুইন থেকে শুরু করে পৃথিবীর বড় বড় পাবলিশার, যেমন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেসসহ সবাই বইয়ের কপিরাইট কেনাবেচায় নেগোশিয়েশন চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বই ছড়িয়ে দেবার এ এক অন্য রকম আয়োজন। শুনেছি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাতেও একইভাবে বইয়ের কপিরাইট বা স্বত্ব বিক্রি হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী বই বাণিজ্যের জন্য সব দেশের প্রকাশকেরা গড়ে তুলেছেন আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক- যারা বইমেলা ছাড়াও সারা বছর পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে বই বিনিময়, মুদ্রণ, বিপণন ও বাণিজ্যের এ কাজটি করে থাকেন। বই প্রকাশনার ক্ষেত্রেও এখন সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত প্রযুক্তির এ সময়েও কাগজের বইয়ের ব্যাপক চাহিদা ও মূল্যায়ন দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। ই-বুকের পাশাপাশি মুদ্রিত বই পুরো পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
আমাদের দেশের প্রকাশনা জগত অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময়। বিশ্বব্যাপী প্রকাশনার সাথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত হয়ে আমাদের বইও আমরা পৌঁছে দিতে পারি নানা দেশের পাঠকের হাতে। আন্তর্জাতিক এসব বইমেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের প্রকাশক, লেখক ও পাঠকের কাছেও আমাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্যের পরিচিতি তুলে ধরতে পারি এবং বিশ্বব্যাপী বইবাণিজ্যে যুক্ত হতে পারি। আগামী দিনে ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে বই-ই এঁকে দেবে মানুষের মানচিত্র- বইকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে নতুন পৃথিবী- যেন সে কথাই মনে করিয়ে দিল বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলা।