সিরীয়-মার্কিন লেখক
অনুবাদ: ফজল হাসান
গন্ধ
এক যুবক বনের ভেতর দীর্ঘ এক মাসের আবিষ্কারের কাজ সম্পন্ন করে ফিরে আসে- সে নতুন এবং উত্তেজনাপূর্ণ জিনিসের সন্ধান করেছে। ঘরে ফিরে সে প্রচ- ক্লান্তিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছুড়ে দেয় বাতাসের মধ্যে। জুতা, মোজা ও জামাকাপড়খুলে সোফায় শুয়ে পড়ে এবং মুহূর্তের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।
যুবকটির পায়ের উৎকট গন্ধ ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রচ- বিব্রত বোধ করে যুবকের দুই পা তার হাতের দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকায় এবং জিজ্ঞেস করে, ‘আমাদের থেকে যেমন বিরক্তিকর গন্ধ বের হয়, তেমন গন্ধ তোমাদের থেকে বের হয় না কেন?’ জবাবে হাত দুটি উঁচু গলায় বলল, ‘কারণ আমরা সবসময় অন্যের জন্য উন্মুক্ত থাকি এবং নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ হতে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করি।’
সমতা
চার ঋতু নির্দিষ্ট একটা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল এবং সেই দেশের জমি অবশেষে মরুভূমিতে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত তারা বেশ কয়েক বছর সেখানে যাওয়া স্থগিত রেখেছিল। প্রতিবেশী কয়েকটি রাজ্য দেশটির প্রতি সহানুভূতি অনুভব করেছিল। প্রথমে তারা ইতস্তত ছিল, কারণ প্রতিশোধের ভয়ে শেষ পর্যন্ত চার ঋতুকে স্বাগত জানানো বন্ধ করে দিয়েছিল। মহামারীর মতো ধীরে ধীরে সহানুভূতি ছড়িয়ে পড়েছিল, যতক্ষণ না পৃথিবীর সমস্ত দেশ চার ঋতুর শক্তি এবং অহংকারের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ দল গঠন করে।
প্রথমে ঋতুরা রাগ দমন করে এবং তাদের আহত অভিমানের প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গে দুর্বলতা ঢুকে পড়ে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে তারা অন্য আর কোনো জায়গা খুঁজে পায় না। তারা কিছু সময়ের জন্য বায়ুম-লে গৃহহীন হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং অবশেষে সেখানেই মারা যায়। তারা পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য আকুল আকাক্সক্ষা করেছিল।
কখনই স্পর্শ করা হয়নি
শেলফে রাখা ছেঁড়া মলাট, পৃষ্ঠার কিনারে মন্তব্য ও টুকে রাখা সংক্ষিপ্ত কথামালা ভর্তি পাতা নিয়ে একটা পুস্তক তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সহকর্মীকে বলেছিল, ‘তোমার সতেজতা এবং অনন্ত যৌবনকে আমি খুব ঈর্ষা করি!’
কিন্তু সহকর্মী হতাশার সুরে জবাব দিয়েছিল, ‘আমাকে কখনই স্পর্শ করা হয়নি!’
কাঁটাতারের বেড়া
সামীর, যার বয়স এখনো সাত বছর হয়নি, তার বিখ্যাত লেখক বাবার আচরণে পুরোপুরি হতবাক হয়ে যায়। বাবা তার ডেস্কে বসে একটি হলুদ খাতায় লিখছিলেন এবং তাঁর মুখম-লে স্পষ্ট বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। তিনি রাগ করে বারবার পাতাগুলো ছিঁড়ে ময়লা কাগজের ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলছিলেন। কাগজ ছোঁড়ার কাজটি তিনি অনেকবার পুনরাবৃত্তি করছিলেন, যতক্ষণ না তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। অবশেষে তিনি খাতাটি দূরে সরিয়ে রাখেন এবং বিড়বিড় করে ঘুমিয়ে পড়েন। সমীর চটজলদি বসার ঘর থেকে পায়ের আঙুলের উপর ভর করে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যেই ঘরে ময়লা কাগজের ঝুড়ি ছিল, সেই ঘরে প্রবেশ করে। সে কাগজের ঝুড়ি থেকে দলা পাকানো এক টুকরো কাগজ বের করে এবং ভাঁজ খোলে। সেখানে সে লাইন টানা কাঁটাতারের বেড়া এবং গণহত্যা লেখা দেখেছে, যা থেকে বহমান নদীর মতো রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। বেঁচে যাওয়া লোকজন যন্ত্রণার ভয়াবহতা ও দুঃস্বপ্নের আর্তনাদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য হাহাকার করছিল। সামীর হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একসময় সে কাগজটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায়। সে কম্বলের নিচে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। তার মুখম-লে ভয়ানক আগ্নেয়গিরির মতো ভয় জেগে ওঠে এবং সে কাঁপতে থাকে।
সেদিন থেকে সামীর শব্দের প্রতি প্রচ- মমতা অনুভব করে এবং সম্পূর্ণ কাঁটাতার মুক্ত কাগজে শুধু সেগুলো লিখে রাখে।
মৃত চোখ
তিনি কাজ শেষ করে গভীর রাতে ফল এবং শাকসব্জি ভর্তি ব্যাগ নিয়ে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে আসেন। যখন তিনি শোবার ঘরের দরজা খুললেন, তখন হতবাক হয়ে দেখেন যে তার স্ত্রী নিজের ছেলের এক বন্ধুর সঙ্গে পাগলের মতো প্রেমলীলায় মত্ত রয়েছে। মহিলা স্বামীর দিকে তাচ্ছিল্য ও উপহাসের দৃষ্টি মেলে তাকায়। লোকটি চোখ দুটি ভালো করে ঘষে এবং তারপর চোখের পাতা খুলে দেখে যে, মহিলা বিনয়ের সঙ্গে প্রার্থনা করছে। লোকটি পুনরায় তার চোখ ঘষে, এবার দ্রুততার সঙ্গে এবং প্রচ- জোরে। চোখের পাতা খুলতেই সে দেখে যে তরুণ এক প্রতিবেশীর বাড়ির মুখোমুখি একটি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে মহিলা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নাচছে। সে ভয় ও আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে এবং টর্নেডোর মতো প্রবল জোরে দু’হাত দিয়ে ঘষতে থাকে। যখন সে চোখ খোলে, তখন তার স্ত্রী সেখানে ছিল। সে তার স্বামীকে বিছানায় প্রাতঃরাশ ভাগ করে নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তখন তার চোখ ভালবাসা এবং কোমলতায় ভরে ওঠে।
সেই সময় লোকটি বুঝতে পেরেছিল যে, তার চোখের নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে গেছে। তাই তার মৃত চোখের বদলে এক জোড়া নতুন এবং সতেজ চোখ বসানোর জন্য সে দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিল। সেদিন থেকে সে তার স্ত্রীকে নিজের ইচ্ছেমতো দেখতে পারে।
পুরুষ
সূর্যের প্রখর রশ্মি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য সাঈদ একটি খবরের কাগজ হাতে নিয়ে জনসাধারণের জন্য নির্ধারিত বাগান থেকে বেরিয়ে যায়। তার মুখজুড়ে ছিল শত শত পরস্পরবিরোধী আবেগ আর বিদ্যুতায়িত প্রশ্ন... যা বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মাঝখানে আটকে আছে। তিনি মাথা এমনভাবে নিচু করে থাকেন, যেন সেসব আবেগ ও প্রশ্নগুলো আড়াল করতে চাচ্ছেন।
বাগানের বাইরের ফুটপাত ধরে একজন গৃহহীন লোক ছেঁগা কাপড় পড়ে তার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। লোকটির কাছ থেকে ভয়ানক দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। হঠাৎ সাঈদ বড় পেটওয়ালা পুঁজিপতি হয়ে ওঠে এবং সিগার ফুঁকতে শুরু করে। সে তার শেষ চুক্তির লাভের কথা ভাবতে থাকে। যে গৃহহীন লোকটি হাত বাড়িয়ে তার সফলতা ও দীর্ঘ জীবন কামনা করছিল, তাকে সে দেখতে পেল না।
কিছুক্ষণ পর সাঈদের সামনে দিয়ে একটি বিলাসবহুল গাড়ি চলে যায়। গাড়ির চালক ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সাঈদ যেন মরু ঝড়ের মাঝে এক অসহায় ভেড়া, যে ঝড় তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। যখন সে শহরের অন্যতম অভিনব হোটেলে পৌঁছে, তখন পা ছাড়াই জন্মগ্রহণকারী একটি পিঁপড়া হয়ে যায়, যা পায়ের নিচে প্রায় চাপা পড়তে যাচ্ছিল।
সাঈদ জরাজীর্ণ বাড়ি থেকে কয়েক মিটার দূরে পৌঁছে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে: একটি সরকারী সংস্থার নিম্ন শ্রেণির কর্মচারী; কিন্তু যখনই সে তার স্ত্রী-সন্তানদের মুখোমুখি হয়, তখনই সে তাদের সবার হয়ে যায়।
শূন্য কিছুই না
বাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শূন্যের দিকে তাকিয়ে সাত সংখ্যা বলল, ‘শূন্য কিছুই না! শূন্য কেউ না। তুমি ভিখারী এবং মানুষের নিতম্বের মতো। তোমার কাছ থেকে কোনো ভালো কিছু কিংবা লাভজনক কিছুই আসবে না!’ কিন্তু শূন্য শান্ত থাকে, যতক্ষণ না সে সাত সংখ্যার ডান পাশে এসে দাঁড়ায়। সাত সংখ্যা রীতিমতো বিস্মিত ও হতবাক। সে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘তুমি কী চিরকাল আমার অতিথি হয়ে থাকবে?’ অতিরঞ্জিত প্রশংসাসুলভ কণ্ঠে সাত সংখ্যা জিজ্ঞেস করে, ‘আর তুমি যদি শূন্যের মধ্যে থেকে তোমার সমকক্ষদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তোমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাও, তাহলে তার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!’
দু’পায়ে দৌঁড়ানো জেব্রা
সমতল ভূমিতে যখন একদল জেব্রা বিচরণ করছিল, তখন তাদের মধ্যে একটা জেব্রা লক্ষ্য করে যে, একজন লোক নিকটবর্তী কারাগার থেকে পালিয়ে আসছে এবং তার পড়নে বন্দীদের বিশেষ পোশাক, যার রঙ সেই প্রাণিদের গায়ের রঙের মতোই।
‘দেখ... দেখ, ওই জেব্রাটা দু’পায়ে দৌঁড়াচ্ছে!’ অবাক হয়ে সে বন্ধুদের বলল। সবাই বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
‘তার শারীরিক গঠন সত্যিই অদ্ভুত’, অন্য এক জেব্রা বলল, ‘আমি ভাবছি তিনি কোন জায়গা থেকে আসছেন?’
অন্য এক বন্ধুর কাছ থেকে জবাব এল, ‘আমি শুনেছি কাছাকাছি কোথাও জমায়েত হওয়ার একটা জায়গা রয়েছে, যেখানে এই ধরনের জেব্রা আছে।’
এখানে বয়স্ক জেব্রা, যাকে সবাই শ্রদ্ধা করে এবং তাদের গুরু বলে মনে করে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় বলল, ‘সে পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য, প্রিয়জনেরা।’
পলাতক কয়েদি যখন তাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়, তখন জেব্রাদের বিস্মিত চোখ বয়স্ক জেব্রার দিকে স্থির হয়ে আটকে থাকে।
ঐতিহ্যবাহী বোমা
আমি ক্ষয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের ভাঁজে একটা পারমাণবিক বোমা পুঁতে রেখেছিলাম। বিস্ফোরণের পর দেখলাম ভাঁজগুলো যেমন ছিল, ঠিক তেমনই আছে, কেবল আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি বিধ্বস্ত হয়েছে।
আঙুলের নখ
আঙুলের কাটা নখ একরাশ দুঃখ নিয়ে বিষণœ চোখে বাঁকা চাঁদের দিকে তাকায়।
‘আমাদের প্রভু কখন আমাদের দুঃখকষ্টের কথা জানবেন?’ নিজেকেই জিজ্ঞেস করে কাটা নখ, ‘কখন তিনি তাঁর হাতির দাঁতের সুউচ্চ মিনার থেকে নেমে আসবেন এবং আমাদের অভিযোগ শুনবেন? তাঁর সঙ্গে আমাদের কত দূরত্ব! তাঁর অবস্থান থেকে পৃথিবীকে দেখতে কেমন দেখায়! নিঃসন্দেহে সুন্দর... ভয়ঙ্কর সুন্দর!’
হায়!
বিশ্বব্রহ্মা- নিজের পরিণতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিল, ‘হায়! এখানে সামান্য জায়গা পাওয়ার কী আমার কোনো অধিকার নেই?’
সুন্দর মুখ
আমি পাহাড়ের চূড়ায় বসে ইতিহাসের অপরূপ সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল যে, ইতিহাসের অপরূপ মুখের মাধুর্য ও লাবণ্য অতি আশ্চর্য মানুষের অনিন্দ্য সুন্দর রূপকেও অতিক্রম করে গিয়েছে। আমি পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে যাই। আমি বিস্মিত হয়ে তার মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছি এবং আমি আমার হৃদয়ে একটি ফুলের তোড়া বহন করেছি, যা ক্রমাগত বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু যখন আমি তার কাছাকাছি পৌঁছেছি, তখন আমি তার বিস্ময়কর চোখের গভীরে ভয়ঙ্কর কিছু লক্ষ্য করেছি: চোখের জোড়া কণিকায় যুগ যুগ ধরে মধ্যবর্তী সময়ের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকারী দুটি দৈত্যাকার কামানের গোলা রয়েছে। তার নিখুঁত অঙ্কিত মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে অপবাদ এবং অশ্লীলতা, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেছে এবং ঘৃণা ও ক্ষোভ, যা সময়ের সীমানা অস্বীকার করে। আমি ঘুরে দাঁড়াই এবং ইতিহাসের জাঁকজমকপূর্ণ সময়কে অভিশাপ দিতে দিতে বাড়িতে ফিরে আসি, যা ভবিষ্যতকে ধ্বংস করতে মুখিয়ে আছে।
বাক-স্বাধীনতা
নাগরিকদের বাক-স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করে সরকার একটি আইন জারি করেছে। আইনটি এক দুর্দান্ত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষ করে যেহেতু অনেক দেশ এধরনের মত প্রকাশকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে। গণতন্ত্রের এই মহান এবং অভূতপূর্ব বিজয়ের সমর্থনে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। মিছিল করার সময় তারা বিজয়ের খুশিতে প্রাণ খুলে হাসতে, তাদের মুখে আনন্দের বীভৎস মুখোশ।
যৌবনের চোর
দেশে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। এক সকালে কয়েকজন যুবক ঘুম থেকে উঠে দেখে যে, তারা আশি ও নব্বই বছর বয়সী বুড়ো হয়ে গেছে। দিনের পর দিন যৌবন হারানো মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং পুরো জনগোষ্ঠী এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কে নিমজ্জিত হয়। মানুষের মনে ভয় ঢুকে যায় যে, অচিরেই দেশটি বৃদ্ধাশ্রমে পরিণত হবে। এই আতঙ্কের মাঝেই গবেষকরা এমন অনন্য ঘটনা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। অনেক চেষ্টা এবং কঠিন পরিশ্রমের পর তারা রহস্যের সমাধান করলেও জনসাধারণের কাছে তা প্রকাশ করার সাহস পাননি। তাদের তদন্তের ফলাফল সংবাদ মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার দিন পর্যন্ত তারা বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে খবর প্রকাশিত হয় যে, বেশ কয়েকজন প্রবীণ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সেই তরুণদের যৌবনকালের সময় চুরি করে নিজেদের আসল বয়সের সঙ্গে যুক্ত করেছেন এবং বাকি যা ছিল, তা পরিবারের সদস্য ও সহযোগীদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তরুণদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাওয়ার জন্য এবং তাদের কাছ থেকে সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণ যৌবনের সময় চুরি করার জন্য প্রবীণ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে।
সবাই ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে... সেই দেশের যুবকদের মধ্যে যারা অবশিষ্ট ছিল, বিষয়টি নিয়ে তারা তখনই সিদ্ধান্ত নেয় যে অন্য দেশে পালিয়ে যাবে, যেখানে তরুণদের যৌবনকাল চুরি করার জন্য কোনো চোর নেই।
সিরীয়-মার্কিন লেখক
অনুবাদ: ফজল হাসান
বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
গন্ধ
এক যুবক বনের ভেতর দীর্ঘ এক মাসের আবিষ্কারের কাজ সম্পন্ন করে ফিরে আসে- সে নতুন এবং উত্তেজনাপূর্ণ জিনিসের সন্ধান করেছে। ঘরে ফিরে সে প্রচ- ক্লান্তিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছুড়ে দেয় বাতাসের মধ্যে। জুতা, মোজা ও জামাকাপড়খুলে সোফায় শুয়ে পড়ে এবং মুহূর্তের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।
যুবকটির পায়ের উৎকট গন্ধ ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রচ- বিব্রত বোধ করে যুবকের দুই পা তার হাতের দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকায় এবং জিজ্ঞেস করে, ‘আমাদের থেকে যেমন বিরক্তিকর গন্ধ বের হয়, তেমন গন্ধ তোমাদের থেকে বের হয় না কেন?’ জবাবে হাত দুটি উঁচু গলায় বলল, ‘কারণ আমরা সবসময় অন্যের জন্য উন্মুক্ত থাকি এবং নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ হতে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করি।’
সমতা
চার ঋতু নির্দিষ্ট একটা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল এবং সেই দেশের জমি অবশেষে মরুভূমিতে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত তারা বেশ কয়েক বছর সেখানে যাওয়া স্থগিত রেখেছিল। প্রতিবেশী কয়েকটি রাজ্য দেশটির প্রতি সহানুভূতি অনুভব করেছিল। প্রথমে তারা ইতস্তত ছিল, কারণ প্রতিশোধের ভয়ে শেষ পর্যন্ত চার ঋতুকে স্বাগত জানানো বন্ধ করে দিয়েছিল। মহামারীর মতো ধীরে ধীরে সহানুভূতি ছড়িয়ে পড়েছিল, যতক্ষণ না পৃথিবীর সমস্ত দেশ চার ঋতুর শক্তি এবং অহংকারের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ দল গঠন করে।
প্রথমে ঋতুরা রাগ দমন করে এবং তাদের আহত অভিমানের প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গে দুর্বলতা ঢুকে পড়ে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে তারা অন্য আর কোনো জায়গা খুঁজে পায় না। তারা কিছু সময়ের জন্য বায়ুম-লে গৃহহীন হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং অবশেষে সেখানেই মারা যায়। তারা পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য আকুল আকাক্সক্ষা করেছিল।
কখনই স্পর্শ করা হয়নি
শেলফে রাখা ছেঁড়া মলাট, পৃষ্ঠার কিনারে মন্তব্য ও টুকে রাখা সংক্ষিপ্ত কথামালা ভর্তি পাতা নিয়ে একটা পুস্তক তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সহকর্মীকে বলেছিল, ‘তোমার সতেজতা এবং অনন্ত যৌবনকে আমি খুব ঈর্ষা করি!’
কিন্তু সহকর্মী হতাশার সুরে জবাব দিয়েছিল, ‘আমাকে কখনই স্পর্শ করা হয়নি!’
কাঁটাতারের বেড়া
সামীর, যার বয়স এখনো সাত বছর হয়নি, তার বিখ্যাত লেখক বাবার আচরণে পুরোপুরি হতবাক হয়ে যায়। বাবা তার ডেস্কে বসে একটি হলুদ খাতায় লিখছিলেন এবং তাঁর মুখম-লে স্পষ্ট বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। তিনি রাগ করে বারবার পাতাগুলো ছিঁড়ে ময়লা কাগজের ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলছিলেন। কাগজ ছোঁড়ার কাজটি তিনি অনেকবার পুনরাবৃত্তি করছিলেন, যতক্ষণ না তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। অবশেষে তিনি খাতাটি দূরে সরিয়ে রাখেন এবং বিড়বিড় করে ঘুমিয়ে পড়েন। সমীর চটজলদি বসার ঘর থেকে পায়ের আঙুলের উপর ভর করে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যেই ঘরে ময়লা কাগজের ঝুড়ি ছিল, সেই ঘরে প্রবেশ করে। সে কাগজের ঝুড়ি থেকে দলা পাকানো এক টুকরো কাগজ বের করে এবং ভাঁজ খোলে। সেখানে সে লাইন টানা কাঁটাতারের বেড়া এবং গণহত্যা লেখা দেখেছে, যা থেকে বহমান নদীর মতো রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। বেঁচে যাওয়া লোকজন যন্ত্রণার ভয়াবহতা ও দুঃস্বপ্নের আর্তনাদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য হাহাকার করছিল। সামীর হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একসময় সে কাগজটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায়। সে কম্বলের নিচে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। তার মুখম-লে ভয়ানক আগ্নেয়গিরির মতো ভয় জেগে ওঠে এবং সে কাঁপতে থাকে।
সেদিন থেকে সামীর শব্দের প্রতি প্রচ- মমতা অনুভব করে এবং সম্পূর্ণ কাঁটাতার মুক্ত কাগজে শুধু সেগুলো লিখে রাখে।
মৃত চোখ
তিনি কাজ শেষ করে গভীর রাতে ফল এবং শাকসব্জি ভর্তি ব্যাগ নিয়ে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে আসেন। যখন তিনি শোবার ঘরের দরজা খুললেন, তখন হতবাক হয়ে দেখেন যে তার স্ত্রী নিজের ছেলের এক বন্ধুর সঙ্গে পাগলের মতো প্রেমলীলায় মত্ত রয়েছে। মহিলা স্বামীর দিকে তাচ্ছিল্য ও উপহাসের দৃষ্টি মেলে তাকায়। লোকটি চোখ দুটি ভালো করে ঘষে এবং তারপর চোখের পাতা খুলে দেখে যে, মহিলা বিনয়ের সঙ্গে প্রার্থনা করছে। লোকটি পুনরায় তার চোখ ঘষে, এবার দ্রুততার সঙ্গে এবং প্রচ- জোরে। চোখের পাতা খুলতেই সে দেখে যে তরুণ এক প্রতিবেশীর বাড়ির মুখোমুখি একটি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে মহিলা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নাচছে। সে ভয় ও আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে এবং টর্নেডোর মতো প্রবল জোরে দু’হাত দিয়ে ঘষতে থাকে। যখন সে চোখ খোলে, তখন তার স্ত্রী সেখানে ছিল। সে তার স্বামীকে বিছানায় প্রাতঃরাশ ভাগ করে নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তখন তার চোখ ভালবাসা এবং কোমলতায় ভরে ওঠে।
সেই সময় লোকটি বুঝতে পেরেছিল যে, তার চোখের নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে গেছে। তাই তার মৃত চোখের বদলে এক জোড়া নতুন এবং সতেজ চোখ বসানোর জন্য সে দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিল। সেদিন থেকে সে তার স্ত্রীকে নিজের ইচ্ছেমতো দেখতে পারে।
পুরুষ
সূর্যের প্রখর রশ্মি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য সাঈদ একটি খবরের কাগজ হাতে নিয়ে জনসাধারণের জন্য নির্ধারিত বাগান থেকে বেরিয়ে যায়। তার মুখজুড়ে ছিল শত শত পরস্পরবিরোধী আবেগ আর বিদ্যুতায়িত প্রশ্ন... যা বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মাঝখানে আটকে আছে। তিনি মাথা এমনভাবে নিচু করে থাকেন, যেন সেসব আবেগ ও প্রশ্নগুলো আড়াল করতে চাচ্ছেন।
বাগানের বাইরের ফুটপাত ধরে একজন গৃহহীন লোক ছেঁগা কাপড় পড়ে তার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। লোকটির কাছ থেকে ভয়ানক দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। হঠাৎ সাঈদ বড় পেটওয়ালা পুঁজিপতি হয়ে ওঠে এবং সিগার ফুঁকতে শুরু করে। সে তার শেষ চুক্তির লাভের কথা ভাবতে থাকে। যে গৃহহীন লোকটি হাত বাড়িয়ে তার সফলতা ও দীর্ঘ জীবন কামনা করছিল, তাকে সে দেখতে পেল না।
কিছুক্ষণ পর সাঈদের সামনে দিয়ে একটি বিলাসবহুল গাড়ি চলে যায়। গাড়ির চালক ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সাঈদ যেন মরু ঝড়ের মাঝে এক অসহায় ভেড়া, যে ঝড় তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। যখন সে শহরের অন্যতম অভিনব হোটেলে পৌঁছে, তখন পা ছাড়াই জন্মগ্রহণকারী একটি পিঁপড়া হয়ে যায়, যা পায়ের নিচে প্রায় চাপা পড়তে যাচ্ছিল।
সাঈদ জরাজীর্ণ বাড়ি থেকে কয়েক মিটার দূরে পৌঁছে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে: একটি সরকারী সংস্থার নিম্ন শ্রেণির কর্মচারী; কিন্তু যখনই সে তার স্ত্রী-সন্তানদের মুখোমুখি হয়, তখনই সে তাদের সবার হয়ে যায়।
শূন্য কিছুই না
বাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শূন্যের দিকে তাকিয়ে সাত সংখ্যা বলল, ‘শূন্য কিছুই না! শূন্য কেউ না। তুমি ভিখারী এবং মানুষের নিতম্বের মতো। তোমার কাছ থেকে কোনো ভালো কিছু কিংবা লাভজনক কিছুই আসবে না!’ কিন্তু শূন্য শান্ত থাকে, যতক্ষণ না সে সাত সংখ্যার ডান পাশে এসে দাঁড়ায়। সাত সংখ্যা রীতিমতো বিস্মিত ও হতবাক। সে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘তুমি কী চিরকাল আমার অতিথি হয়ে থাকবে?’ অতিরঞ্জিত প্রশংসাসুলভ কণ্ঠে সাত সংখ্যা জিজ্ঞেস করে, ‘আর তুমি যদি শূন্যের মধ্যে থেকে তোমার সমকক্ষদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তোমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাও, তাহলে তার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!’
দু’পায়ে দৌঁড়ানো জেব্রা
সমতল ভূমিতে যখন একদল জেব্রা বিচরণ করছিল, তখন তাদের মধ্যে একটা জেব্রা লক্ষ্য করে যে, একজন লোক নিকটবর্তী কারাগার থেকে পালিয়ে আসছে এবং তার পড়নে বন্দীদের বিশেষ পোশাক, যার রঙ সেই প্রাণিদের গায়ের রঙের মতোই।
‘দেখ... দেখ, ওই জেব্রাটা দু’পায়ে দৌঁড়াচ্ছে!’ অবাক হয়ে সে বন্ধুদের বলল। সবাই বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
‘তার শারীরিক গঠন সত্যিই অদ্ভুত’, অন্য এক জেব্রা বলল, ‘আমি ভাবছি তিনি কোন জায়গা থেকে আসছেন?’
অন্য এক বন্ধুর কাছ থেকে জবাব এল, ‘আমি শুনেছি কাছাকাছি কোথাও জমায়েত হওয়ার একটা জায়গা রয়েছে, যেখানে এই ধরনের জেব্রা আছে।’
এখানে বয়স্ক জেব্রা, যাকে সবাই শ্রদ্ধা করে এবং তাদের গুরু বলে মনে করে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় বলল, ‘সে পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য, প্রিয়জনেরা।’
পলাতক কয়েদি যখন তাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়, তখন জেব্রাদের বিস্মিত চোখ বয়স্ক জেব্রার দিকে স্থির হয়ে আটকে থাকে।
ঐতিহ্যবাহী বোমা
আমি ক্ষয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের ভাঁজে একটা পারমাণবিক বোমা পুঁতে রেখেছিলাম। বিস্ফোরণের পর দেখলাম ভাঁজগুলো যেমন ছিল, ঠিক তেমনই আছে, কেবল আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি বিধ্বস্ত হয়েছে।
আঙুলের নখ
আঙুলের কাটা নখ একরাশ দুঃখ নিয়ে বিষণœ চোখে বাঁকা চাঁদের দিকে তাকায়।
‘আমাদের প্রভু কখন আমাদের দুঃখকষ্টের কথা জানবেন?’ নিজেকেই জিজ্ঞেস করে কাটা নখ, ‘কখন তিনি তাঁর হাতির দাঁতের সুউচ্চ মিনার থেকে নেমে আসবেন এবং আমাদের অভিযোগ শুনবেন? তাঁর সঙ্গে আমাদের কত দূরত্ব! তাঁর অবস্থান থেকে পৃথিবীকে দেখতে কেমন দেখায়! নিঃসন্দেহে সুন্দর... ভয়ঙ্কর সুন্দর!’
হায়!
বিশ্বব্রহ্মা- নিজের পরিণতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিল, ‘হায়! এখানে সামান্য জায়গা পাওয়ার কী আমার কোনো অধিকার নেই?’
সুন্দর মুখ
আমি পাহাড়ের চূড়ায় বসে ইতিহাসের অপরূপ সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল যে, ইতিহাসের অপরূপ মুখের মাধুর্য ও লাবণ্য অতি আশ্চর্য মানুষের অনিন্দ্য সুন্দর রূপকেও অতিক্রম করে গিয়েছে। আমি পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে যাই। আমি বিস্মিত হয়ে তার মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছি এবং আমি আমার হৃদয়ে একটি ফুলের তোড়া বহন করেছি, যা ক্রমাগত বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু যখন আমি তার কাছাকাছি পৌঁছেছি, তখন আমি তার বিস্ময়কর চোখের গভীরে ভয়ঙ্কর কিছু লক্ষ্য করেছি: চোখের জোড়া কণিকায় যুগ যুগ ধরে মধ্যবর্তী সময়ের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকারী দুটি দৈত্যাকার কামানের গোলা রয়েছে। তার নিখুঁত অঙ্কিত মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে অপবাদ এবং অশ্লীলতা, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেছে এবং ঘৃণা ও ক্ষোভ, যা সময়ের সীমানা অস্বীকার করে। আমি ঘুরে দাঁড়াই এবং ইতিহাসের জাঁকজমকপূর্ণ সময়কে অভিশাপ দিতে দিতে বাড়িতে ফিরে আসি, যা ভবিষ্যতকে ধ্বংস করতে মুখিয়ে আছে।
বাক-স্বাধীনতা
নাগরিকদের বাক-স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করে সরকার একটি আইন জারি করেছে। আইনটি এক দুর্দান্ত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষ করে যেহেতু অনেক দেশ এধরনের মত প্রকাশকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে। গণতন্ত্রের এই মহান এবং অভূতপূর্ব বিজয়ের সমর্থনে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। মিছিল করার সময় তারা বিজয়ের খুশিতে প্রাণ খুলে হাসতে, তাদের মুখে আনন্দের বীভৎস মুখোশ।
যৌবনের চোর
দেশে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। এক সকালে কয়েকজন যুবক ঘুম থেকে উঠে দেখে যে, তারা আশি ও নব্বই বছর বয়সী বুড়ো হয়ে গেছে। দিনের পর দিন যৌবন হারানো মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং পুরো জনগোষ্ঠী এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কে নিমজ্জিত হয়। মানুষের মনে ভয় ঢুকে যায় যে, অচিরেই দেশটি বৃদ্ধাশ্রমে পরিণত হবে। এই আতঙ্কের মাঝেই গবেষকরা এমন অনন্য ঘটনা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। অনেক চেষ্টা এবং কঠিন পরিশ্রমের পর তারা রহস্যের সমাধান করলেও জনসাধারণের কাছে তা প্রকাশ করার সাহস পাননি। তাদের তদন্তের ফলাফল সংবাদ মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার দিন পর্যন্ত তারা বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে খবর প্রকাশিত হয় যে, বেশ কয়েকজন প্রবীণ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সেই তরুণদের যৌবনকালের সময় চুরি করে নিজেদের আসল বয়সের সঙ্গে যুক্ত করেছেন এবং বাকি যা ছিল, তা পরিবারের সদস্য ও সহযোগীদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তরুণদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাওয়ার জন্য এবং তাদের কাছ থেকে সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণ যৌবনের সময় চুরি করার জন্য প্রবীণ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে।
সবাই ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে... সেই দেশের যুবকদের মধ্যে যারা অবশিষ্ট ছিল, বিষয়টি নিয়ে তারা তখনই সিদ্ধান্ত নেয় যে অন্য দেশে পালিয়ে যাবে, যেখানে তরুণদের যৌবনকাল চুরি করার জন্য কোনো চোর নেই।