alt

সাময়িকী

বড়শি

মোহিত কামাল

: বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

শিল্পী : সুনীল কুমার

সিদ্ধান্তটা নিতান্তই আমার। ‘ভাবিয়া করিও কাজ’?এ প্রবচনটির মর্মার্থ মাথায় নিয়ে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মূল কথা হচ্ছে, একা থাকব। একা থাকার মধ্যে মগ্নতার ব্যাপার থাকে। নিজের মধ্যে তৈরি হয় নিজস্ব চাহিদা, অযৌক্তিক চাহিদা তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। আমার মধ্যে অযৌক্তিক চাহিদা নেই; অন্তত আমার দৃষ্টিতে আমি বিচার করে বলতে পারি সে কথা। আমার স্বচ্ছতার কোনো ঘাটতি নেই।

নিজেকে বিচার করার জন্য এই উপলব্ধিই কি শেষ কথা? না, শেষ কথা নয়। তাহলে শুনুন শেষ কথা। আমাকে বিচার করছি আমি?

হঠাৎ একদিন দেখি, ওয়াশরুমে ঢুকে কারও সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছে আমার স্বামীপ্রবর, তাপস। সাত বছরের দুরন্ত সময় পার করে তাপসের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছি। একদিন এই তাপসই বলেছিল?জানো কাকলি, ফেসবুকে, মোবাইলে অনেক অল্পবয়সী মেয়ে আমাকে নক করে। আমার সঙ্গে... প্রস্তাব দেয়। হাসতে হাসতে তাপসের বলা কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ‘ভালোই তো। টিন টিন স্বাদ পাবে, ঝুলে পড়ো।’

‘আমি ঝুলে পড়লে তো ঝুলন্ত দড়িতে ফাঁস লেগে যাবে তোমার গলায়। তখন কী হবে?’

‘কী আর হবে? ফাঁস লাগলে চলে যাব অচেনা দেশে। তখন তোমার জন্য খুলে যাবে অবারিত মাঠ, খোলা প্রাঙ্গণ, সবুজ গাছগাছালি আর নরম পাতার চাটনি। খেয়েদেয়ে নাদুসনুদুস হতে পারবে। তোমার ইচ্ছায় কেউ তখন বাধা দিতে পারবে না!’

হা হা হা করে বিকট উল্লাসে ফেটে পড়েছিল তাপস। তার সেই উল্লাস দেখে চট করে একবার মনে হয়েছিল, বাঘের জিম্মায় রেখে দিলাম না তো আমার মুক্ত হরিণটাকে! পরক্ষণেই উড়িয়ে দিলাম সেই চিন্তা। প্রকৃতির সবুজ বনে হরিণটাকে বুকের খাঁচা থেকে ছেড়ে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ দিলাম।

তো, তাপসকে এ মুহূর্তে ওয়াশরুমে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে মনে হলো, আমার মুক্ত হরিণটা আর কখনো উড়ন্ত লাফ দিয়ে ঢুকবে না বুকের খাঁচায়, গাইবে না অভিমানী কিংবা মরমি সঙ্গীত। হঠাৎ এমন মনে হলো কেন? মেঘে মেঘে সংঘর্ষে যেমন আচমকা ছড়িয়ে যায় বিদ্যুৎ-তরঙ্গ, তেমন ঝলকে বেরিয়ে এক ধারালো ছুরি আমূল বসে গেল হৃৎপি-ে। পড়ন্ত বিকেলের মায়াবী রহস্য ওয়াশরুমের ভেতর থেকে ডাইনির উড়াল থাবা হয়ে চড় বসিয়ে দিল গালে। সাত বছরের তিলে তিলে গড়ে ওঠা মমতা আর ভালোবাসার ভিত্তিটা বিরাট একটা ঝাঁকি খেল। স্পষ্ট শুনলাম, তাপস বলছে ‘জান, আমার জান, রাগ কোরো না। কালই মিটিয়ে দেব তোমার সব পাওনা, তোমার চাহিদা।’

এ কথার চৌদ্দটা শব্দ চৌদ্দ হাজার টন বারুদের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল আমার মাথার ভেতর। হরিণের গলায় ঝাঁপিয়ে পড়া বাঘের প্রবল শক্তিধর কামড়ের চেয়েও বেশি শক্তিতে শোনা কথার প্রথম শব্দটিই চেপে ধরল নিজের গলা। চিৎকার, চেঁচামেচি কিছুই করার সুযোগ হলো না। ‘আমার জান’ বাক্যটার শব্দ দুটো বিষধর গোখরার ছোবল বসিয়ে দিল বুকে। কী তার চাহিদা, কী তার পাওনা?ওই মুহূর্তে ভাবার সুযোগ হয়নি। দেনা-পাওনার আড়ালে গুপ্ত সম্পদ লুণ্ঠনের ইঙ্গিত রয়েছে, তাও ভাবতে পারিনি। কেবল লুকোনো সিন্দুক থেকে আবেগ লুণ্ঠনের আলামত পেয়েই এপারের জীবন থেকে আছাড় খেড়ে পড়ে গেলাম প্রায় ওপারের জীবনের বিরাণভূমিতে।

এ সময় ওয়াশরুম থেকে বেরোল তাপস। দরজার সামনে আমাকে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে ঝাঁঝাল গলায় প্রশ্ন করল, এখানে কী করছ?

আমার গলা থেকে জবাব বেরোল না। তখনও সবলে গলায় বসেছিল নিরুদ্বিগ্ন বাঘের দাঁতাল কামড়। তখনও নিঃশ্বাস বের করার পথ পাচ্ছিল না আমার শ্বাসযন্ত্র।

আমার শরীরে হালকা ধাক্কা দিয়ে টাওয়েল কাঁধে সে বেরিয়ে গেল লুকিংগ্লাসের দিকে। হাতে ধরা মোবাইল ফোন লুকোনোর ব্যর্থ চেষ্টা করে দাঁড়াল আয়নার সামনে।

নিজেকে কি দেখতে পেল? পায়নি। কাঁধ বাঁকিয়ে প্রতিফলিত আয়নায় তার মুখ দেখে আমার মনে হলো সত্যি সত্যি ক্ষুধার্ত এক হায়েনা এইমাত্র ভোজন শেষে পরম প্রশান্তি নিয়ে হেলেদুলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে।

আকস্মিক পায়ে শক্তি টের পেলাম। দেহ মোচড় দিয়ে তিন কদম বাড়িয়ে তার মুখোমুখি হলাম। বাঘের গর্জন ছেড়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’

‘কারও সঙ্গে কথা বলিনি।’

‘কেন, আমি যে শুনলাম... ’

‘কিচ্ছু শোনোনি কিংবা ভুল শুনেছ। তোমার মাথা বোধ হয় ঠিক নেই এখন, কাকলি।’

‘আমি কানে শুনেছি। কথা বলছিলে তুমি।’ জোরালোভাবে আবারও বললাম।

‘নাহ, কথা বলিনি আমি।’ প্রচ- ক্ষিপ্ত হয়ে বলল তাপস।

আমি আবার তার মুখের দিকে তাকালাম। মুখের ত্বকের ভাঁজ থেকে বেরোতে দেখলাম অন্য এক তাপস। তা আগে কখনো দেখিনি, মানুষের মুখ এত বিকৃত হতে পারে, আগে জানা ছিল না। তার উদ্ধত ফণার সামনে অবনত হয়ে গেল আমার ভেতরের শক্তি। সত্য ঢাকার জন্য জোরালোভাবে সে ক্রমাগত মিথ্যা বলে যেতে লাগল। ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ প্রবচনটি জানা ছিল। তার জীবন-খোঁড়া অর্থ জানা ছিল না। বিষমাখা বাণে আক্রান্ত হয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, প্রবাদটার অর্থবোধক শক্তি। চৈতন্যে তখন হানা দিল কবি চৈতন্য দাশের পঙ্ক্তি:

বর্ষারাতের মায়াবী রহস্য পায়ে জড়িয়ে

শুধু ভাবি?সে প্রেম কি ঐতিহাসিক ভুল ছিল?

এ বারবেলায় আকাশে মেঘ ডাকলে

ভয়ে গায়ে কাঁটা দেয়

যদি আবার লম্বা হয়ে ওঠে, তোমার ফিরতি-পথ পিছল হয়...

মেঘকে বলেছি?ডানা বাড়িয়ে রেখো সূর্য যেন তোমাকে চোখ গরম করতে না পারে ঘাসকে বলেছি পথ আঁকড়ে থেকো, পিছলে না যাও...

এখনো আমি, কাকলি চৌধুরী, ভাবি আর ভাবি, সবই কি ভুল ছিল? নাকি শুদ্ধপথেও আকাশে উড়ে আসতে পারে ভুল মেঘ? সেই মেঘ কি আড়াল করে দিতে পারে শুদ্ধ আলোর ধারা?

হ্যাঁ, পারে। শুদ্ধ আলোর মধ্যে ঢুকে গেছে ঘৃণার মেঘতরঙ্গ। সেই তরঙ্গ মোকাবিলা করার সামর্থ্য থাকে না মানুষের। আমারও ছিল না। ধাপে ধাপে আরও ঘা খেতে খেতে, জীবনের আরও প্রকট দুর্গন্ধে শ^াস নিতে নিতে অবশেষে আমি এখন একা। মুক্ত আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির মতো একা।

আসলে কি তাই? চলার পথে কোনো ঝড়ঝাপটা খাবে না মানুষ?

আসুন, প্রিয় পাঠক, আমার সঙ্গে পথ চলুন। আমি কথা দিচ্ছি বিরক্তি দেব না, জীবন পোড়ানো অভিজ্ঞতা শেয়ার করব আপনার সুন্দর দিনে।

দুই

ওহ! আগে বলে নিই। আমি কিন্তু সুন্দরী। এখন একটা চাকরিও করছি। পদবিটাও মন্দ নয়। তবু কোথায় যেন একটা শূন্যতা কাজ করে। একাকিত্বও একটা শূন্যতা। বিশাল শূন্যটা কেবল বায়বীয় উপাদানে ভরা, তাও বলা যাবে না। সীমাহীন আকাশেও অগোচরে রয়েছে গভীরতম শূন্যতার চোরা খাদ। সে খাদ দেখা যায় না। যেমন দেখা যায়নি আমার একাকী চলার পথে দৃষ্টির অগোচরে থাকা কালো গর্ত।

নিজেকে শূন্য ভাবলেও চারপাশের সবাই ভাবে আমি অরক্ষিত। মনে করে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে আমাকে, ছোঁয়া যাবে। হাত বাড়ালেই... যাবে। অজস্র ‘যাবে’র ভিড়ে আসলে আমি পূর্ণ। এ পূর্ণতাকে গোখরার বিষের চেয়ে বড় বেশি বিষমাখা মনে হচ্ছে এখন। কারণ আমার বাস্তবের গোখরাকে আমি জ্যান্ত চোখে চিনতাম। এখনকার যারা আছে চারপাশে তাদের চেনা যায় না। মুখোশের আড়ালে তারা ঢেকে রাখে আসল মুখ। ওই মুখের বিষের লালা আরও ভয়ংকর।

তো, যে-কথা বলছিলাম এসব ভেবেই একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এ জোরালো ভাবনায় কোনো খাদ ছিল কি না, জানি না। কারণ ইদানীং একটা নতুন শাড়ি পরলে তার ছবি পোস্ট দিতে ইচ্ছা করে ফেসবুকে। দিইও। তারপর প্রশংসা পেতে ইচ্ছা করে। চেনাজানা মানুষরাই প্রশংসার জোয়ার বইয়ে দেয়। প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে! সবার মতো আমারও ভালো লাগে। প্রশংসার মধ্যে জোঁক ঢুকে যায়, জোঁক গোপনে কেবলই রক্ত চুষে খায় না, খেতে চায় দেহের কচি ডালপালাও।

ফেসবুকের ইনবক্সে নানা মন্তব্য আসে। সরাসরি প্রস্তাব আসে। ইনিয়ে-বিনিয়ে কিছু বলার পরই সরাসরি দেহের প্রস্তাবও আসে। এদের আমি পাত্তা দিই না। কারণ, এ জোঁকের জিহ্বা দেখা যায়। একটু চুন মেখে দিলেই জিহ্বা পুড়ে যায়, গুটিয়ে যায়, পালায় ওরা। কিন্তু দৃশ্যের আড়ালে থাকা জোঁক চিনব কীভাবে?

আসুন, কোনো ধুরন্ধর জোঁকের পাল্লায় পড়লাম কি না দেখুন একবার। আসলে পাল্লায় পড়েছি বলব না, আপনিই বলুন, কোন পথে এগোচ্ছি আমি।

এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি শপিংমলে। একটা শাড়ির শোরুমের সামনে। আমার মোবাইল বাজছে।

কল রিসিভ করে বললাম, ‘জি। আমি কাকলি চৌধুরী। কিছু বলবেন?’

‘হাই! কাকলি! কোথায় তুমি?’

‘রাপা প্লাজায়। একটা শোরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ডিসপ্লে করা শাড়ি দেখছি।’

‘গুড। শপিং করা ভালো। তবে তোমার তো রেস্ট হলো না। সকাল থেকেই তো অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলে। রেস্ট না নিলে পরের দিনের কাজের জন্য কি মনোযোগী হতে পারবে?’

‘জি, পারব। রাতভর ঘুমিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেব।’

‘তবু বলছি, নিজের দিকে নজর দিয়ো। পর্যাপ্ত রেস্ট না নিলে এনার্জি প্রিজার্ভ হয় না, কাজে মনোযোগের ঘাটতি তৈরি হয়।’

‘আমার খোঁজখবর রাখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’

‘ওকে, বাই।’ বলেই থেমে গেলেন। লাইন কেটে দিলেন না তিনি।

বললাম, ‘লাইনে আছেন?’

‘আছি।’

‘আর কিছু বলবেন?’

‘না। তেমন কিছু না, তবে একটা উইশ করতে চাই।’

‘কী ধরনের উইশ?’

‘ফেসবুকে বসেছিলাম। দেখলাম দু দিন পর তোমার জন্মদিন। জন্মদিনে একটা কিছু গিফট দিতে চাই। তুমি কি নেবে আমার উপহার?’

‘বাহ! আপনার শুভ ইচ্ছাকে ফেরাব কেন?’

‘থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ, কাকলি!’ বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত হয়ে গেলেন তিনি। তাঁর কথা ও গলার স্বর বদলে গেল আচমকা?‘আসলে তুমি তো অসাধারণ একটা মেয়ে! অথচ তোমার জীবনটা কেমন হয়ে গেল, ভাবলে খারাপ লাগে আমার।’

বললাম, ‘আপনি আমার সুহৃদ। খারাপ লাগা তো দোষের কিছু নয়। তবে আমি বেশ আছি। আপনার খারাপ লাগাটা অসম্মান করছি না, সম্মান করেই বলছি, আমি ভালো আছি।’

‘বেশ! বেশ! ভালো থাকাটা ভালো। তবে তোমার জন্মদিনে... ’

আমি বললাম, ‘জন্মদিনটা মায়ের সঙ্গে কাটাব। আপনি কি বাসায় আসতে চাচ্ছেন?’

‘তোমার জন্মদিনে তোমাদের বাসায় আমার যাওয়াটা কি ঠিক হবে?’

‘কেন নয়? একজন শুভাকাক্সক্ষী উইশ করতে এলে আমার মায়ের তো আপত্তি থাকার কথা নয়।’

‘ভালো। বেশ, তোমার মা নিশ্চয়ই মডার্ন?’

‘না। তা বলব না। মা রক্ষণশীল।’

‘ওহ! তাহলে এক কাজ করো, এখন তুমি শপিংমলেই থাকো, আমি আসছি। একটা ভালো শাড়ি চয়েস করো।’

‘না, না। আপনাকে আসতে হবে না।’

‘প্লিজ, আমি আসছি। তুমি চয়েস করতে থাকো। মনে রেখো, মানি ইজ নট আ প্রবলেম!’

লাইন কেটে দিলেন তিনি।

আমার অস্বস্তি হচ্ছে। থাকব, না চলে যাব?

প্রিয় পাঠক, শুরুতে বলেছিলাম আমি ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারি। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হয় না। এমন অহংবোধ বাসা বেঁধে আছে আমার মননে। কিন্তু দ্বিধায় পড়ে গেছি এখন। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। এখনো দাঁড়িয়ে আছি নির্দিষ্ট শোরুমের সামনে।

আকস্মিক চমকে উঠলাম ‘হাই’ সম্বোধন শুনে। ঘুরেই দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পাশে।

ভূত নাকি! এক ঝটকায় ভয়ের আঁচড় খেয়ে গুটিয়ে গেলাম নিজের মধ্যে।

‘ভয় পেলে? ভয়ের কিছু নেই, কাছেই ছিলাম তো। তাই তোমার সামনে আসতে এক মিনিটের বেশি লাগল না।’

‘কাছে ছিলেন মানে? শপিং মলেই ছিলেন?’

কিছুটা থতমত খেয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ।’

‘ওহ। হঠাৎ আপনাকে দেখে আমি তো ঘাবড়ে গেছি।’

‘আসলে দূর থেকে তোমাকে দেখছিলাম। তাই কল করেছি।’

‘আপনি যে বললেন ফেসবুকে ছিলেন?’

‘ও হো। হ্যাঁ। ফোনসেটেই ফেসবুক অন করেছিলাম।’

পাঠক, আছেন আমার সঙ্গে? দেখতে পাচ্ছেন? আমার মুখ দেখে কি কিছু বুঝতে পাচ্ছেন? নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন পোড়খাওয়া মনে আকস্মিক সন্দেহ ঘনীভূত হয়ে গেছে।

তিনি কি আমাকে অনুসরণ করছিলেন? ফলো করে এসেছেন এখানে? কেন? সত্যি কথা কি, তাঁর মধ্যে নারীদেহের প্রতি যে লোভ থাকার কথা, তা আগে দেখতে পাইনি। তাই কথাবার্তায় নিজের অজান্তেই প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছি তাঁকে। একটু কি বাজিয়ে দেখব? তিনি কেমন, তাঁর দৃঢ়তা কেমন, মানবপ্রবৃত্তির সঙ্গে শকুনপ্রবৃত্তি লুকিয়ে আছে কি না, দেখব? প্লিজ ক্ষমা করুন আমাকে। না বাজালে কীভাবে বুঝব তাঁর আসল চাহিদাটা কী? জন্মদিনে শাড়ি উপহার দেওয়ার পেছনে কী ইচ্ছা লুকিয়ে আছে, পরখ করে দেখব না একবার? জীবনের টান উপড়ে আমি একটু কাছে ভিড়ছি। বললাম, ‘বাহ! আপনাকে তো দারুণ লাগছে! টি-শার্টে কখনো দেখিনি, সবসময় ফরমাল ড্রেসে দেখেছি, আজ তো বেশ লাগছে!’

লজ্জায় অবনত হয়ে গেল তাঁর মাথা। কথা বলতে পারছেন না আর।

এবার মূল প্রসঙ্গে ঢুকলাম, ‘কী শাড়ি উপহার দেবেন?’

‘তুমি যা চাও।’

‘বলেছিলেন মানি ইজ নট আ প্রবলেম। পর্যাপ্ত টাকা কি আছে ব্যাগে?’

‘ব্যাগে ক্রেডিট কার্ড আছে, নো প্রবলেম।’

‘ওকে, চলুন। শোরুমের ভেতরে যাই। বাইরে ঝোলানো ওই যে ওই জামদানিটা পছন্দ হয়েছে। কিনে দেবেন?’

‘শিওর।’

দাম নিশ্চিত করুন। কিনে দিন। বলেই একটু দূরে সরে এলাম আমি। বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। শাড়িটার দাম ২৫ হাজার টাকা। ভেবেছিলাম, নিশ্চিত তিনি ভড়কে যাবেন দাম শুনে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না তাঁর। শাড়ির প্যাকেটটা আমার হাতে তুলে দিচ্ছেন তিনি, দেখছেন তো, প্রিয় পাঠক? তাঁর মুখে স্বর্গজয় করার হাসি! আঁধারের যাত্রাপথে পা রাখলাম না তো! বুকের মধ্যে দ্বিধার কাঁটা বিঁধে গেল। কাঁটাটা উপড়ে ফেলতে হবে। কারণ আমি সিদ্ধান্ত নিতে জানি। যৌক্তিক সিদ্ধান্তে ভুল হয় না আমার। এ বিশ্বাস অবশ্যই লালন করি। নিজের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দধারা দ্বিধার কাঁটায় আটকে গেলেও সহজ ভঙ্গিতে বললাম, ‘এত দামি গিফট পেলাম, আমি কী দেব আপনাকে?’

‘বাহ! গিফটের কি বিনিময় নিতে হয়? এত ছোট ভাবছ আমাকে?’

পালটা প্রশ্নে ধাক্কা খেলাম। আমার ধারণায় কি ভুল আছে? তিনি কি নারীদেহ জয়ে পথে নামেননি?

আরেকটু কি বাজিয়ে দেখব, প্রিয় পাঠক? দেখি। তবে বলে রাখছি এ মুহূর্তে গোপনে গোয়েন্দাগিরি করার জন্য দোষ দেবেন না আমাকে। যাচাই-বাছাই করে দেখছি তাঁর সঙ্গে মেশা যাবে কি না ভবিষ্যতে। বললাম, ‘বিনিময় তো কেবল অর্থের বিনিময়ে দিতে হয় না। কিছুটা সময় কি কাটানো যায় না একসঙ্গে? সঙ্গ-আনন্দের বিনিময়ও তো এক ধরনের বিনিময়। কী বলেন?’

‘তা ঠিক। তবে তোমাকে নিয়ে কোথাও বসা কি ঠিক হবে? তোমার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করা ঠিক হবে?’

‘ঠিক হবে না কেন? আড্ডা দিতে দোষ কী?’

‘না, দোষ নয়। ব্যাপারটা শোভন হবে না।’

‘শোভন-অশোভন তো নিজেদের ব্যাপার। কে কী বলল, মেপে মেপে কি চলা যায়? চলুন আপনার বাসায় যাই।’

‘না, বাসা খালি। খালি বাসায় একা তোমার মতো একজন তরুণীকে নেওয়া ঠিক হবে না।’

আবার একটা ধাক্কা খেলাম। লোকটা কী চায়? কেবল একটু ছোঁয়া, একটু সঙ্গ? একটু কথা বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায়? আর কিছু নয়? নতুন বোধের আগুন জ্বলে উঠল। ঘৃণার আগুনে খাক হয়ে থাকা বুকের ভেতর থেকে আচমকা বেরোতে শুরু করেছে চাঁপাফুলের ঘ্রাণ। কৃষ্ণচূড়ার লাল আভা ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার চোখ। কপালের লাল টিপটা খুলে তাঁর পদতলে বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। এমন ইচ্ছা করছে কেন? তবে কি আমার ভালো লাগা শুরু হয়ে গেছে? অতিমানবকে কি ভালোবাসা যায়? নাকি যায় না? সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। তবু হাসতে হাসতে বললাম, ‘আমার কাছে আপনি কী চান, বলবেন?’

মুখ টেনে হাসি ছড়িয়ে তিনি জবাব দিলেন, ‘কাকলি চৌধুরী, সত্যি বলছি, কী চাই জানি না। তবে তোমাকে শাড়িটা উপহার দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি, আনন্দ পাচ্ছি। আমার উপহারের বিনিময়ে এ ‘আনন্দটুকুই’ তোমার দেওয়া মমতা হিসেবে ধরে নাও। পেয়ে গেছি আমি।’

এ কি! লোকটিকে অশ্রদ্ধা করতে পারছি না কেন? তিনি কি জয় করে ফেলেছেন আমাকে? জানি না। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। প্রশ্নের তীব্র শিখা চোখের আলো কেড়ে নিয়েছে। আমি কি যাত্রা শুরু করেছি নতুন কোনো পথে? ভালো মানুষের সন্ধান পেয়ে গেছি? তাঁর হাত ধরে ফেলেছি?

তিন

মধ্যরাতে আমাকে কখনো কেউ কল করেনি। হঠাৎ একটা কল এল। ভুলে মোবাইল ফোন অফ করে রাখিনি আজ। প্রতিদিন শোবার আগে অফ করে রাখি। আজ ব্যতিক্রম। আর আজই আক্রমণ করল ঘুমভাঙা কল!

কে? কে রিং করতে পারে এত রাতে? ভাবতে ভাবতে ইয়েস বাটন ছুঁয়ে কলটা রিসিভ করলাম।

‘আপনি কি কাকলি চৌধুরী?’ মেয়েলি কণ্ঠে নরম স্বরে সহজ প্রশ্ন করে উত্তরের আশা না করে তিনি শীতল গলায় আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘এটাই আপনার নম্বর?’

জবাব দিলাম, ‘জি। আমি কাকলি। এটা আমারই সেল নম্বর। ঠিক মানুষটির সঙ্গে কথা বলছেন আপনি।’

‘চৌধুরী টাইটেলটা কি... ’

প্রশ্ন শেষ করতে পারলেন না তিনি। লুফে নিয়ে অসমাপ্ত প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে বললাম, ‘চৌধুরী আমার বংশের টাইটেল।’

‘ওহ। আপনি কি আনম্যারেড?’ পালটা প্রশ্ন বুলেটের মতো সাঁই করে আঘাত হানল মাথায়। বিরুদ্ধপক্ষের যুদ্ধবিমানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের মতো অপরাধ করে ফেললেন তিনি। অন্তত তাই ভাবলাম। ক্রোধ জেগে উঠল?যুদ্ধের ময়দানে ক্রোধ থাকা ভালো। শত্রুহননে ক্রোধ না থাকলে এগোনো যায় না সামনে, পিছু হটলে নিশ্চিত উড়ে যাবে খুলি কিংবা পাঁজর। হঠাৎ সৃষ্ট উত্তাপে খুলে গেল দেহের বাঁকল। তবে নিয়ন্ত্রণ হারালাম না। ‘রাগলেন তো হারলেন’ কথাটাও ঝট করে উড়ে এল মাথায়। নিয়ন্ত্রিত গলায় বললাম, ‘আমি সিংগেল।’

এবার শীতল গলার ভেতর থেকে উড়ে এল ওপাশের চিবানো স্বর, ‘এ তকমা মেখেই তো শত পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে পারেন, বহুভোগ্যা হয়েও নিজেকে সিংগেল ভাবেন, তাই না?’

তাপস ছাড়া কেউ শয্যাসঙ্গী করতে পারেনি আমাকে। এ অহংবোধে টলে উঠল পুরো দেহ, নাড়া খেল পুরো বাড়ি। এ ধরনের বিষমাখানো প্রশ্নের জবাবে কী বলতে হবে, জানা ছিল না। দিশেহারা লাগছে। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। ক্ষুধার্ত বাঘিনী যেন দাঁতাল কামড় বসিয়ে দিয়েছে গলায়, যেমন কামড় খেয়েছিলাম তাপসের ফিসফিসানি শুনে?‘জান, আমার জান, রাগ কোরো না। কালই মিটিয়ে দেব তোমার সব পাওনা, সব চাহিদা।’ এসব কথা তখন ধ্বংসাত্মক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো আঘাত হেনেছিল মাথায়, তছনছ করে দিয়েছিল আমার সংসার। এখনকার অচেনা এই নারীকণ্ঠীর কথাকে বিষাক্ত জীবাণুবোমা মনে হচ্ছে। বোমায় উড়ে আসা জীবাণুগুলো কিলবিল করে ছড়িয়ে যাচ্ছে, দেহের অণু-পরমাণুর ভেতর ঢুকে কোষের শক্তির আধার ইলেকট্রন-প্রোটন আর নিউট্রনের ক্রিয়ায় ঘটিয়ে দিয়েছে বিশৃঙ্খলা, তাল হারিয়ে ফেলছি আমি। চিৎকার করে বললাম, ‘এই, আমি কিতোর স্বামীর সঙ্গে একান্ত সময় কাটিয়েছি?’

‘নিজে যে-রকম, সে অন্যকে সে-রকম ভাবে।’

মধ্যরাতে আকস্মিক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মস্তিষ্কের বিদ্যুৎসংযোগ। আঁধারের ভেতরই জেগে উঠল অন্যরকম আরেক আঁধার। সেই আঁধারের কোনো সীমা নেই, পরিসীমা নেই। তল নেই। তলহীন তলানিতে আচমকা সেঁটে গেলাম আমি। ভাষা হারিয়ে গেল। স্বরযন্ত্র স্বরধ্বনি উগরে দিতে পারল না। নিঃসাড় হয়ে পড়ে রইলাম তলানিতে। কিছুক্ষণ পর শব্দের তরঙ্গ-ঢেউয়ে ভর করে আবার উড়ে এল উড়ন্ত কেউটের বিষাক্ত পঙ্ক্তি?‘এই, এখন কথা বলছিস না কেন? কতজনের মাথা খেলে শান্তি পাবি? কত চাস? দেহের অজগরের স্বাদ মেটাতে আর কতজনকে শিকার করবি তুই?’

বাপ রে! কী কথা রে! কী ভয়ংকর বাক্যবাণ! এই প্রশ্নবোমার কী জবাব হতে পারে?

নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেললাম। মুহূর্তেই দেখতে পেলাম নিজের অন্য দিকটা। নিজেকে যতই ভালো ভাবি না কেন, যতই ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারি বলে অহংবোধে ভুগি না কেন, তলে তলে আসলে ভুল করতে পারে যে-কেউ, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অপরাধের জালে আটকে যেতে পারি আমরা। আমিও আটকে গেলাম সমাজের বিষচোখে। একদিন যে দ্বিতীয় নারীর কারণে আমার সংসার তছনছ হয়েছিল, আজ আমিও অন্য আরেক নারীর কাছে সেই দ্বিতীয় নারীর জায়গায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছি নিজেকে। এ মুহূর্তে আপনাদের বলতে বাধ্য হচ্ছি, প্রিয় পাঠক, ভুল করেছি, যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। ভুল থেকে ভুলপথে যাত্রা করেছি। ভুলের বড়শি গেঁথে গেছে গলায়। এ বড়শি কি খুলতে পারব? এ পথ থেকে কি ফেরার উপায় আছে আমার? কী বলেন আপনারা?

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

মননশস্যের অমৃত মন্থন

ছবি

অনুবাদ ও ভূমিকা : আলী সিদ্দিকী

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

এ মুখর বরষায়

ছবি

রক্তে লেখা প্রেম: রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিপ্লব

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শঙ্খজীবন: যাপিত জীবনের অন্তর্গূঢ় প্রতিকথা

ছবি

ওসামা অ্যালোমার এক ঝুড়ি খুদে গল্প

ছবি

প্রযুক্তির আলোয় বিশ্বব্যাপী বইবাণিজ্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

কাফকার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

সূর্যের দেশ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

লড়াই

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রচলিত সাহিত্যধারার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন মধুসূদন

ছবি

মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন

ছবি

উত্তর-মানবতাবাদ ও শিল্প-সাহিত্যে তার প্রভাব

ছবি

আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

দুই ঋতপার কিসসা এবং এক ন্যাকা চৈতন্য

ছবি

অন্যজীবন অন্যআগুন ছোঁয়া

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কবিজীবন, দর্শন ও কাব্যসন্ধান

ছবি

অসামান্য গদ্যশৈলীর রূপকার

ছবি

পিয়াস মজিদের ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’

ছবি

নজরুলের নিবেদিত কবিতা : অর্ঘ্যরে শিল্পরূপ

ছবি

বাঘাডাঙা গাঁও

ছবি

বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বিষয়ভাবনা

সাময়িকী কবিতা

tab

সাময়িকী

বড়শি

মোহিত কামাল

শিল্পী : সুনীল কুমার

বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

সিদ্ধান্তটা নিতান্তই আমার। ‘ভাবিয়া করিও কাজ’?এ প্রবচনটির মর্মার্থ মাথায় নিয়ে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মূল কথা হচ্ছে, একা থাকব। একা থাকার মধ্যে মগ্নতার ব্যাপার থাকে। নিজের মধ্যে তৈরি হয় নিজস্ব চাহিদা, অযৌক্তিক চাহিদা তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। আমার মধ্যে অযৌক্তিক চাহিদা নেই; অন্তত আমার দৃষ্টিতে আমি বিচার করে বলতে পারি সে কথা। আমার স্বচ্ছতার কোনো ঘাটতি নেই।

নিজেকে বিচার করার জন্য এই উপলব্ধিই কি শেষ কথা? না, শেষ কথা নয়। তাহলে শুনুন শেষ কথা। আমাকে বিচার করছি আমি?

হঠাৎ একদিন দেখি, ওয়াশরুমে ঢুকে কারও সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছে আমার স্বামীপ্রবর, তাপস। সাত বছরের দুরন্ত সময় পার করে তাপসের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছি। একদিন এই তাপসই বলেছিল?জানো কাকলি, ফেসবুকে, মোবাইলে অনেক অল্পবয়সী মেয়ে আমাকে নক করে। আমার সঙ্গে... প্রস্তাব দেয়। হাসতে হাসতে তাপসের বলা কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ‘ভালোই তো। টিন টিন স্বাদ পাবে, ঝুলে পড়ো।’

‘আমি ঝুলে পড়লে তো ঝুলন্ত দড়িতে ফাঁস লেগে যাবে তোমার গলায়। তখন কী হবে?’

‘কী আর হবে? ফাঁস লাগলে চলে যাব অচেনা দেশে। তখন তোমার জন্য খুলে যাবে অবারিত মাঠ, খোলা প্রাঙ্গণ, সবুজ গাছগাছালি আর নরম পাতার চাটনি। খেয়েদেয়ে নাদুসনুদুস হতে পারবে। তোমার ইচ্ছায় কেউ তখন বাধা দিতে পারবে না!’

হা হা হা করে বিকট উল্লাসে ফেটে পড়েছিল তাপস। তার সেই উল্লাস দেখে চট করে একবার মনে হয়েছিল, বাঘের জিম্মায় রেখে দিলাম না তো আমার মুক্ত হরিণটাকে! পরক্ষণেই উড়িয়ে দিলাম সেই চিন্তা। প্রকৃতির সবুজ বনে হরিণটাকে বুকের খাঁচা থেকে ছেড়ে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ দিলাম।

তো, তাপসকে এ মুহূর্তে ওয়াশরুমে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে মনে হলো, আমার মুক্ত হরিণটা আর কখনো উড়ন্ত লাফ দিয়ে ঢুকবে না বুকের খাঁচায়, গাইবে না অভিমানী কিংবা মরমি সঙ্গীত। হঠাৎ এমন মনে হলো কেন? মেঘে মেঘে সংঘর্ষে যেমন আচমকা ছড়িয়ে যায় বিদ্যুৎ-তরঙ্গ, তেমন ঝলকে বেরিয়ে এক ধারালো ছুরি আমূল বসে গেল হৃৎপি-ে। পড়ন্ত বিকেলের মায়াবী রহস্য ওয়াশরুমের ভেতর থেকে ডাইনির উড়াল থাবা হয়ে চড় বসিয়ে দিল গালে। সাত বছরের তিলে তিলে গড়ে ওঠা মমতা আর ভালোবাসার ভিত্তিটা বিরাট একটা ঝাঁকি খেল। স্পষ্ট শুনলাম, তাপস বলছে ‘জান, আমার জান, রাগ কোরো না। কালই মিটিয়ে দেব তোমার সব পাওনা, তোমার চাহিদা।’

এ কথার চৌদ্দটা শব্দ চৌদ্দ হাজার টন বারুদের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল আমার মাথার ভেতর। হরিণের গলায় ঝাঁপিয়ে পড়া বাঘের প্রবল শক্তিধর কামড়ের চেয়েও বেশি শক্তিতে শোনা কথার প্রথম শব্দটিই চেপে ধরল নিজের গলা। চিৎকার, চেঁচামেচি কিছুই করার সুযোগ হলো না। ‘আমার জান’ বাক্যটার শব্দ দুটো বিষধর গোখরার ছোবল বসিয়ে দিল বুকে। কী তার চাহিদা, কী তার পাওনা?ওই মুহূর্তে ভাবার সুযোগ হয়নি। দেনা-পাওনার আড়ালে গুপ্ত সম্পদ লুণ্ঠনের ইঙ্গিত রয়েছে, তাও ভাবতে পারিনি। কেবল লুকোনো সিন্দুক থেকে আবেগ লুণ্ঠনের আলামত পেয়েই এপারের জীবন থেকে আছাড় খেড়ে পড়ে গেলাম প্রায় ওপারের জীবনের বিরাণভূমিতে।

এ সময় ওয়াশরুম থেকে বেরোল তাপস। দরজার সামনে আমাকে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে ঝাঁঝাল গলায় প্রশ্ন করল, এখানে কী করছ?

আমার গলা থেকে জবাব বেরোল না। তখনও সবলে গলায় বসেছিল নিরুদ্বিগ্ন বাঘের দাঁতাল কামড়। তখনও নিঃশ্বাস বের করার পথ পাচ্ছিল না আমার শ্বাসযন্ত্র।

আমার শরীরে হালকা ধাক্কা দিয়ে টাওয়েল কাঁধে সে বেরিয়ে গেল লুকিংগ্লাসের দিকে। হাতে ধরা মোবাইল ফোন লুকোনোর ব্যর্থ চেষ্টা করে দাঁড়াল আয়নার সামনে।

নিজেকে কি দেখতে পেল? পায়নি। কাঁধ বাঁকিয়ে প্রতিফলিত আয়নায় তার মুখ দেখে আমার মনে হলো সত্যি সত্যি ক্ষুধার্ত এক হায়েনা এইমাত্র ভোজন শেষে পরম প্রশান্তি নিয়ে হেলেদুলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে।

আকস্মিক পায়ে শক্তি টের পেলাম। দেহ মোচড় দিয়ে তিন কদম বাড়িয়ে তার মুখোমুখি হলাম। বাঘের গর্জন ছেড়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’

‘কারও সঙ্গে কথা বলিনি।’

‘কেন, আমি যে শুনলাম... ’

‘কিচ্ছু শোনোনি কিংবা ভুল শুনেছ। তোমার মাথা বোধ হয় ঠিক নেই এখন, কাকলি।’

‘আমি কানে শুনেছি। কথা বলছিলে তুমি।’ জোরালোভাবে আবারও বললাম।

‘নাহ, কথা বলিনি আমি।’ প্রচ- ক্ষিপ্ত হয়ে বলল তাপস।

আমি আবার তার মুখের দিকে তাকালাম। মুখের ত্বকের ভাঁজ থেকে বেরোতে দেখলাম অন্য এক তাপস। তা আগে কখনো দেখিনি, মানুষের মুখ এত বিকৃত হতে পারে, আগে জানা ছিল না। তার উদ্ধত ফণার সামনে অবনত হয়ে গেল আমার ভেতরের শক্তি। সত্য ঢাকার জন্য জোরালোভাবে সে ক্রমাগত মিথ্যা বলে যেতে লাগল। ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ প্রবচনটি জানা ছিল। তার জীবন-খোঁড়া অর্থ জানা ছিল না। বিষমাখা বাণে আক্রান্ত হয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, প্রবাদটার অর্থবোধক শক্তি। চৈতন্যে তখন হানা দিল কবি চৈতন্য দাশের পঙ্ক্তি:

বর্ষারাতের মায়াবী রহস্য পায়ে জড়িয়ে

শুধু ভাবি?সে প্রেম কি ঐতিহাসিক ভুল ছিল?

এ বারবেলায় আকাশে মেঘ ডাকলে

ভয়ে গায়ে কাঁটা দেয়

যদি আবার লম্বা হয়ে ওঠে, তোমার ফিরতি-পথ পিছল হয়...

মেঘকে বলেছি?ডানা বাড়িয়ে রেখো সূর্য যেন তোমাকে চোখ গরম করতে না পারে ঘাসকে বলেছি পথ আঁকড়ে থেকো, পিছলে না যাও...

এখনো আমি, কাকলি চৌধুরী, ভাবি আর ভাবি, সবই কি ভুল ছিল? নাকি শুদ্ধপথেও আকাশে উড়ে আসতে পারে ভুল মেঘ? সেই মেঘ কি আড়াল করে দিতে পারে শুদ্ধ আলোর ধারা?

হ্যাঁ, পারে। শুদ্ধ আলোর মধ্যে ঢুকে গেছে ঘৃণার মেঘতরঙ্গ। সেই তরঙ্গ মোকাবিলা করার সামর্থ্য থাকে না মানুষের। আমারও ছিল না। ধাপে ধাপে আরও ঘা খেতে খেতে, জীবনের আরও প্রকট দুর্গন্ধে শ^াস নিতে নিতে অবশেষে আমি এখন একা। মুক্ত আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির মতো একা।

আসলে কি তাই? চলার পথে কোনো ঝড়ঝাপটা খাবে না মানুষ?

আসুন, প্রিয় পাঠক, আমার সঙ্গে পথ চলুন। আমি কথা দিচ্ছি বিরক্তি দেব না, জীবন পোড়ানো অভিজ্ঞতা শেয়ার করব আপনার সুন্দর দিনে।

দুই

ওহ! আগে বলে নিই। আমি কিন্তু সুন্দরী। এখন একটা চাকরিও করছি। পদবিটাও মন্দ নয়। তবু কোথায় যেন একটা শূন্যতা কাজ করে। একাকিত্বও একটা শূন্যতা। বিশাল শূন্যটা কেবল বায়বীয় উপাদানে ভরা, তাও বলা যাবে না। সীমাহীন আকাশেও অগোচরে রয়েছে গভীরতম শূন্যতার চোরা খাদ। সে খাদ দেখা যায় না। যেমন দেখা যায়নি আমার একাকী চলার পথে দৃষ্টির অগোচরে থাকা কালো গর্ত।

নিজেকে শূন্য ভাবলেও চারপাশের সবাই ভাবে আমি অরক্ষিত। মনে করে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে আমাকে, ছোঁয়া যাবে। হাত বাড়ালেই... যাবে। অজস্র ‘যাবে’র ভিড়ে আসলে আমি পূর্ণ। এ পূর্ণতাকে গোখরার বিষের চেয়ে বড় বেশি বিষমাখা মনে হচ্ছে এখন। কারণ আমার বাস্তবের গোখরাকে আমি জ্যান্ত চোখে চিনতাম। এখনকার যারা আছে চারপাশে তাদের চেনা যায় না। মুখোশের আড়ালে তারা ঢেকে রাখে আসল মুখ। ওই মুখের বিষের লালা আরও ভয়ংকর।

তো, যে-কথা বলছিলাম এসব ভেবেই একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এ জোরালো ভাবনায় কোনো খাদ ছিল কি না, জানি না। কারণ ইদানীং একটা নতুন শাড়ি পরলে তার ছবি পোস্ট দিতে ইচ্ছা করে ফেসবুকে। দিইও। তারপর প্রশংসা পেতে ইচ্ছা করে। চেনাজানা মানুষরাই প্রশংসার জোয়ার বইয়ে দেয়। প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে! সবার মতো আমারও ভালো লাগে। প্রশংসার মধ্যে জোঁক ঢুকে যায়, জোঁক গোপনে কেবলই রক্ত চুষে খায় না, খেতে চায় দেহের কচি ডালপালাও।

ফেসবুকের ইনবক্সে নানা মন্তব্য আসে। সরাসরি প্রস্তাব আসে। ইনিয়ে-বিনিয়ে কিছু বলার পরই সরাসরি দেহের প্রস্তাবও আসে। এদের আমি পাত্তা দিই না। কারণ, এ জোঁকের জিহ্বা দেখা যায়। একটু চুন মেখে দিলেই জিহ্বা পুড়ে যায়, গুটিয়ে যায়, পালায় ওরা। কিন্তু দৃশ্যের আড়ালে থাকা জোঁক চিনব কীভাবে?

আসুন, কোনো ধুরন্ধর জোঁকের পাল্লায় পড়লাম কি না দেখুন একবার। আসলে পাল্লায় পড়েছি বলব না, আপনিই বলুন, কোন পথে এগোচ্ছি আমি।

এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি শপিংমলে। একটা শাড়ির শোরুমের সামনে। আমার মোবাইল বাজছে।

কল রিসিভ করে বললাম, ‘জি। আমি কাকলি চৌধুরী। কিছু বলবেন?’

‘হাই! কাকলি! কোথায় তুমি?’

‘রাপা প্লাজায়। একটা শোরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ডিসপ্লে করা শাড়ি দেখছি।’

‘গুড। শপিং করা ভালো। তবে তোমার তো রেস্ট হলো না। সকাল থেকেই তো অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলে। রেস্ট না নিলে পরের দিনের কাজের জন্য কি মনোযোগী হতে পারবে?’

‘জি, পারব। রাতভর ঘুমিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেব।’

‘তবু বলছি, নিজের দিকে নজর দিয়ো। পর্যাপ্ত রেস্ট না নিলে এনার্জি প্রিজার্ভ হয় না, কাজে মনোযোগের ঘাটতি তৈরি হয়।’

‘আমার খোঁজখবর রাখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’

‘ওকে, বাই।’ বলেই থেমে গেলেন। লাইন কেটে দিলেন না তিনি।

বললাম, ‘লাইনে আছেন?’

‘আছি।’

‘আর কিছু বলবেন?’

‘না। তেমন কিছু না, তবে একটা উইশ করতে চাই।’

‘কী ধরনের উইশ?’

‘ফেসবুকে বসেছিলাম। দেখলাম দু দিন পর তোমার জন্মদিন। জন্মদিনে একটা কিছু গিফট দিতে চাই। তুমি কি নেবে আমার উপহার?’

‘বাহ! আপনার শুভ ইচ্ছাকে ফেরাব কেন?’

‘থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ, কাকলি!’ বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত হয়ে গেলেন তিনি। তাঁর কথা ও গলার স্বর বদলে গেল আচমকা?‘আসলে তুমি তো অসাধারণ একটা মেয়ে! অথচ তোমার জীবনটা কেমন হয়ে গেল, ভাবলে খারাপ লাগে আমার।’

বললাম, ‘আপনি আমার সুহৃদ। খারাপ লাগা তো দোষের কিছু নয়। তবে আমি বেশ আছি। আপনার খারাপ লাগাটা অসম্মান করছি না, সম্মান করেই বলছি, আমি ভালো আছি।’

‘বেশ! বেশ! ভালো থাকাটা ভালো। তবে তোমার জন্মদিনে... ’

আমি বললাম, ‘জন্মদিনটা মায়ের সঙ্গে কাটাব। আপনি কি বাসায় আসতে চাচ্ছেন?’

‘তোমার জন্মদিনে তোমাদের বাসায় আমার যাওয়াটা কি ঠিক হবে?’

‘কেন নয়? একজন শুভাকাক্সক্ষী উইশ করতে এলে আমার মায়ের তো আপত্তি থাকার কথা নয়।’

‘ভালো। বেশ, তোমার মা নিশ্চয়ই মডার্ন?’

‘না। তা বলব না। মা রক্ষণশীল।’

‘ওহ! তাহলে এক কাজ করো, এখন তুমি শপিংমলেই থাকো, আমি আসছি। একটা ভালো শাড়ি চয়েস করো।’

‘না, না। আপনাকে আসতে হবে না।’

‘প্লিজ, আমি আসছি। তুমি চয়েস করতে থাকো। মনে রেখো, মানি ইজ নট আ প্রবলেম!’

লাইন কেটে দিলেন তিনি।

আমার অস্বস্তি হচ্ছে। থাকব, না চলে যাব?

প্রিয় পাঠক, শুরুতে বলেছিলাম আমি ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারি। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হয় না। এমন অহংবোধ বাসা বেঁধে আছে আমার মননে। কিন্তু দ্বিধায় পড়ে গেছি এখন। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। এখনো দাঁড়িয়ে আছি নির্দিষ্ট শোরুমের সামনে।

আকস্মিক চমকে উঠলাম ‘হাই’ সম্বোধন শুনে। ঘুরেই দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পাশে।

ভূত নাকি! এক ঝটকায় ভয়ের আঁচড় খেয়ে গুটিয়ে গেলাম নিজের মধ্যে।

‘ভয় পেলে? ভয়ের কিছু নেই, কাছেই ছিলাম তো। তাই তোমার সামনে আসতে এক মিনিটের বেশি লাগল না।’

‘কাছে ছিলেন মানে? শপিং মলেই ছিলেন?’

কিছুটা থতমত খেয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ।’

‘ওহ। হঠাৎ আপনাকে দেখে আমি তো ঘাবড়ে গেছি।’

‘আসলে দূর থেকে তোমাকে দেখছিলাম। তাই কল করেছি।’

‘আপনি যে বললেন ফেসবুকে ছিলেন?’

‘ও হো। হ্যাঁ। ফোনসেটেই ফেসবুক অন করেছিলাম।’

পাঠক, আছেন আমার সঙ্গে? দেখতে পাচ্ছেন? আমার মুখ দেখে কি কিছু বুঝতে পাচ্ছেন? নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন পোড়খাওয়া মনে আকস্মিক সন্দেহ ঘনীভূত হয়ে গেছে।

তিনি কি আমাকে অনুসরণ করছিলেন? ফলো করে এসেছেন এখানে? কেন? সত্যি কথা কি, তাঁর মধ্যে নারীদেহের প্রতি যে লোভ থাকার কথা, তা আগে দেখতে পাইনি। তাই কথাবার্তায় নিজের অজান্তেই প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছি তাঁকে। একটু কি বাজিয়ে দেখব? তিনি কেমন, তাঁর দৃঢ়তা কেমন, মানবপ্রবৃত্তির সঙ্গে শকুনপ্রবৃত্তি লুকিয়ে আছে কি না, দেখব? প্লিজ ক্ষমা করুন আমাকে। না বাজালে কীভাবে বুঝব তাঁর আসল চাহিদাটা কী? জন্মদিনে শাড়ি উপহার দেওয়ার পেছনে কী ইচ্ছা লুকিয়ে আছে, পরখ করে দেখব না একবার? জীবনের টান উপড়ে আমি একটু কাছে ভিড়ছি। বললাম, ‘বাহ! আপনাকে তো দারুণ লাগছে! টি-শার্টে কখনো দেখিনি, সবসময় ফরমাল ড্রেসে দেখেছি, আজ তো বেশ লাগছে!’

লজ্জায় অবনত হয়ে গেল তাঁর মাথা। কথা বলতে পারছেন না আর।

এবার মূল প্রসঙ্গে ঢুকলাম, ‘কী শাড়ি উপহার দেবেন?’

‘তুমি যা চাও।’

‘বলেছিলেন মানি ইজ নট আ প্রবলেম। পর্যাপ্ত টাকা কি আছে ব্যাগে?’

‘ব্যাগে ক্রেডিট কার্ড আছে, নো প্রবলেম।’

‘ওকে, চলুন। শোরুমের ভেতরে যাই। বাইরে ঝোলানো ওই যে ওই জামদানিটা পছন্দ হয়েছে। কিনে দেবেন?’

‘শিওর।’

দাম নিশ্চিত করুন। কিনে দিন। বলেই একটু দূরে সরে এলাম আমি। বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। শাড়িটার দাম ২৫ হাজার টাকা। ভেবেছিলাম, নিশ্চিত তিনি ভড়কে যাবেন দাম শুনে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না তাঁর। শাড়ির প্যাকেটটা আমার হাতে তুলে দিচ্ছেন তিনি, দেখছেন তো, প্রিয় পাঠক? তাঁর মুখে স্বর্গজয় করার হাসি! আঁধারের যাত্রাপথে পা রাখলাম না তো! বুকের মধ্যে দ্বিধার কাঁটা বিঁধে গেল। কাঁটাটা উপড়ে ফেলতে হবে। কারণ আমি সিদ্ধান্ত নিতে জানি। যৌক্তিক সিদ্ধান্তে ভুল হয় না আমার। এ বিশ্বাস অবশ্যই লালন করি। নিজের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দধারা দ্বিধার কাঁটায় আটকে গেলেও সহজ ভঙ্গিতে বললাম, ‘এত দামি গিফট পেলাম, আমি কী দেব আপনাকে?’

‘বাহ! গিফটের কি বিনিময় নিতে হয়? এত ছোট ভাবছ আমাকে?’

পালটা প্রশ্নে ধাক্কা খেলাম। আমার ধারণায় কি ভুল আছে? তিনি কি নারীদেহ জয়ে পথে নামেননি?

আরেকটু কি বাজিয়ে দেখব, প্রিয় পাঠক? দেখি। তবে বলে রাখছি এ মুহূর্তে গোপনে গোয়েন্দাগিরি করার জন্য দোষ দেবেন না আমাকে। যাচাই-বাছাই করে দেখছি তাঁর সঙ্গে মেশা যাবে কি না ভবিষ্যতে। বললাম, ‘বিনিময় তো কেবল অর্থের বিনিময়ে দিতে হয় না। কিছুটা সময় কি কাটানো যায় না একসঙ্গে? সঙ্গ-আনন্দের বিনিময়ও তো এক ধরনের বিনিময়। কী বলেন?’

‘তা ঠিক। তবে তোমাকে নিয়ে কোথাও বসা কি ঠিক হবে? তোমার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করা ঠিক হবে?’

‘ঠিক হবে না কেন? আড্ডা দিতে দোষ কী?’

‘না, দোষ নয়। ব্যাপারটা শোভন হবে না।’

‘শোভন-অশোভন তো নিজেদের ব্যাপার। কে কী বলল, মেপে মেপে কি চলা যায়? চলুন আপনার বাসায় যাই।’

‘না, বাসা খালি। খালি বাসায় একা তোমার মতো একজন তরুণীকে নেওয়া ঠিক হবে না।’

আবার একটা ধাক্কা খেলাম। লোকটা কী চায়? কেবল একটু ছোঁয়া, একটু সঙ্গ? একটু কথা বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায়? আর কিছু নয়? নতুন বোধের আগুন জ্বলে উঠল। ঘৃণার আগুনে খাক হয়ে থাকা বুকের ভেতর থেকে আচমকা বেরোতে শুরু করেছে চাঁপাফুলের ঘ্রাণ। কৃষ্ণচূড়ার লাল আভা ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার চোখ। কপালের লাল টিপটা খুলে তাঁর পদতলে বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। এমন ইচ্ছা করছে কেন? তবে কি আমার ভালো লাগা শুরু হয়ে গেছে? অতিমানবকে কি ভালোবাসা যায়? নাকি যায় না? সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। তবু হাসতে হাসতে বললাম, ‘আমার কাছে আপনি কী চান, বলবেন?’

মুখ টেনে হাসি ছড়িয়ে তিনি জবাব দিলেন, ‘কাকলি চৌধুরী, সত্যি বলছি, কী চাই জানি না। তবে তোমাকে শাড়িটা উপহার দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি, আনন্দ পাচ্ছি। আমার উপহারের বিনিময়ে এ ‘আনন্দটুকুই’ তোমার দেওয়া মমতা হিসেবে ধরে নাও। পেয়ে গেছি আমি।’

এ কি! লোকটিকে অশ্রদ্ধা করতে পারছি না কেন? তিনি কি জয় করে ফেলেছেন আমাকে? জানি না। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। প্রশ্নের তীব্র শিখা চোখের আলো কেড়ে নিয়েছে। আমি কি যাত্রা শুরু করেছি নতুন কোনো পথে? ভালো মানুষের সন্ধান পেয়ে গেছি? তাঁর হাত ধরে ফেলেছি?

তিন

মধ্যরাতে আমাকে কখনো কেউ কল করেনি। হঠাৎ একটা কল এল। ভুলে মোবাইল ফোন অফ করে রাখিনি আজ। প্রতিদিন শোবার আগে অফ করে রাখি। আজ ব্যতিক্রম। আর আজই আক্রমণ করল ঘুমভাঙা কল!

কে? কে রিং করতে পারে এত রাতে? ভাবতে ভাবতে ইয়েস বাটন ছুঁয়ে কলটা রিসিভ করলাম।

‘আপনি কি কাকলি চৌধুরী?’ মেয়েলি কণ্ঠে নরম স্বরে সহজ প্রশ্ন করে উত্তরের আশা না করে তিনি শীতল গলায় আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘এটাই আপনার নম্বর?’

জবাব দিলাম, ‘জি। আমি কাকলি। এটা আমারই সেল নম্বর। ঠিক মানুষটির সঙ্গে কথা বলছেন আপনি।’

‘চৌধুরী টাইটেলটা কি... ’

প্রশ্ন শেষ করতে পারলেন না তিনি। লুফে নিয়ে অসমাপ্ত প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে বললাম, ‘চৌধুরী আমার বংশের টাইটেল।’

‘ওহ। আপনি কি আনম্যারেড?’ পালটা প্রশ্ন বুলেটের মতো সাঁই করে আঘাত হানল মাথায়। বিরুদ্ধপক্ষের যুদ্ধবিমানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের মতো অপরাধ করে ফেললেন তিনি। অন্তত তাই ভাবলাম। ক্রোধ জেগে উঠল?যুদ্ধের ময়দানে ক্রোধ থাকা ভালো। শত্রুহননে ক্রোধ না থাকলে এগোনো যায় না সামনে, পিছু হটলে নিশ্চিত উড়ে যাবে খুলি কিংবা পাঁজর। হঠাৎ সৃষ্ট উত্তাপে খুলে গেল দেহের বাঁকল। তবে নিয়ন্ত্রণ হারালাম না। ‘রাগলেন তো হারলেন’ কথাটাও ঝট করে উড়ে এল মাথায়। নিয়ন্ত্রিত গলায় বললাম, ‘আমি সিংগেল।’

এবার শীতল গলার ভেতর থেকে উড়ে এল ওপাশের চিবানো স্বর, ‘এ তকমা মেখেই তো শত পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে পারেন, বহুভোগ্যা হয়েও নিজেকে সিংগেল ভাবেন, তাই না?’

তাপস ছাড়া কেউ শয্যাসঙ্গী করতে পারেনি আমাকে। এ অহংবোধে টলে উঠল পুরো দেহ, নাড়া খেল পুরো বাড়ি। এ ধরনের বিষমাখানো প্রশ্নের জবাবে কী বলতে হবে, জানা ছিল না। দিশেহারা লাগছে। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। ক্ষুধার্ত বাঘিনী যেন দাঁতাল কামড় বসিয়ে দিয়েছে গলায়, যেমন কামড় খেয়েছিলাম তাপসের ফিসফিসানি শুনে?‘জান, আমার জান, রাগ কোরো না। কালই মিটিয়ে দেব তোমার সব পাওনা, সব চাহিদা।’ এসব কথা তখন ধ্বংসাত্মক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো আঘাত হেনেছিল মাথায়, তছনছ করে দিয়েছিল আমার সংসার। এখনকার অচেনা এই নারীকণ্ঠীর কথাকে বিষাক্ত জীবাণুবোমা মনে হচ্ছে। বোমায় উড়ে আসা জীবাণুগুলো কিলবিল করে ছড়িয়ে যাচ্ছে, দেহের অণু-পরমাণুর ভেতর ঢুকে কোষের শক্তির আধার ইলেকট্রন-প্রোটন আর নিউট্রনের ক্রিয়ায় ঘটিয়ে দিয়েছে বিশৃঙ্খলা, তাল হারিয়ে ফেলছি আমি। চিৎকার করে বললাম, ‘এই, আমি কিতোর স্বামীর সঙ্গে একান্ত সময় কাটিয়েছি?’

‘নিজে যে-রকম, সে অন্যকে সে-রকম ভাবে।’

মধ্যরাতে আকস্মিক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মস্তিষ্কের বিদ্যুৎসংযোগ। আঁধারের ভেতরই জেগে উঠল অন্যরকম আরেক আঁধার। সেই আঁধারের কোনো সীমা নেই, পরিসীমা নেই। তল নেই। তলহীন তলানিতে আচমকা সেঁটে গেলাম আমি। ভাষা হারিয়ে গেল। স্বরযন্ত্র স্বরধ্বনি উগরে দিতে পারল না। নিঃসাড় হয়ে পড়ে রইলাম তলানিতে। কিছুক্ষণ পর শব্দের তরঙ্গ-ঢেউয়ে ভর করে আবার উড়ে এল উড়ন্ত কেউটের বিষাক্ত পঙ্ক্তি?‘এই, এখন কথা বলছিস না কেন? কতজনের মাথা খেলে শান্তি পাবি? কত চাস? দেহের অজগরের স্বাদ মেটাতে আর কতজনকে শিকার করবি তুই?’

বাপ রে! কী কথা রে! কী ভয়ংকর বাক্যবাণ! এই প্রশ্নবোমার কী জবাব হতে পারে?

নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেললাম। মুহূর্তেই দেখতে পেলাম নিজের অন্য দিকটা। নিজেকে যতই ভালো ভাবি না কেন, যতই ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারি বলে অহংবোধে ভুগি না কেন, তলে তলে আসলে ভুল করতে পারে যে-কেউ, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অপরাধের জালে আটকে যেতে পারি আমরা। আমিও আটকে গেলাম সমাজের বিষচোখে। একদিন যে দ্বিতীয় নারীর কারণে আমার সংসার তছনছ হয়েছিল, আজ আমিও অন্য আরেক নারীর কাছে সেই দ্বিতীয় নারীর জায়গায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছি নিজেকে। এ মুহূর্তে আপনাদের বলতে বাধ্য হচ্ছি, প্রিয় পাঠক, ভুল করেছি, যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। ভুল থেকে ভুলপথে যাত্রা করেছি। ভুলের বড়শি গেঁথে গেছে গলায়। এ বড়শি কি খুলতে পারব? এ পথ থেকে কি ফেরার উপায় আছে আমার? কী বলেন আপনারা?

back to top