চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-১৩
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আকাশে উড়ে বেড়ানো গাঙচিল বুঝিয়ে দিল তার সাথে আছি আমরাও- সাগর পাড়ে। একটা গাঙচিল দূর থেকে উড়ে এলো কাছে, আবার উড়ে মিলিয়ে গেল দিগন্তে। আবার ফিরে এল, একা নয়, সাথে আরো অনেকে। ধীরে ধীরে দেখি আরো বহু গাঙচিল- ওপরে উঠছে- প্রায়ই ছুঁয়ে যাচ্ছে আকাশ, নিচে নামছে- প্রায়ই ছুঁয়ে যাচ্ছে সমুদ্র-তরঙ্গ। যখন যা খুশি করছে- কী মুক্ত, কী উচ্ছ্বসিত! ওরা কি জীবনানন্দের সিন্ধুসারস:
দু-এক মুহূর্ত শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি
হে সিন্ধুসারস,
মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি
কী চমৎকার মিল! ‘পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি’- এখানেও পাহাড়, সাথে তরঙ্গ, সেখানে নামছে সিন্ধুসারস- তবে ‘মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে’ নয়, মালাগা-র পাহাড়ের কোল ছেড়ে।
মালাগা-র পাহাড়ের কোল দেখতে আমরা ভোরে এলাম ‘কাস্তিয়ো দে জিব্রালফারো’, মানে জিব্রালফারো দুর্গে, এটি নিজেও দাঁড়িয়ে আছে এক পাহাড়ে। সামনে দেখা যাচ্ছে ‘মনতেছ দে মালাগা’ পর্বতমালা, ওপরে তাকে ছুঁয়ে আছে নীল-সাদা আকাশ, নিচে তার সাথে খেলা করছে ভূমধ্যসাগরের তরঙ্গমালা, যা আছড়ে পড়ছে বিস্তৃত এক সোনালি সৈকতে। পাশে দেখা যাচ্ছে মালাগা বন্দরের কর্মব্যস্ততা, জাহাজের আনাগোনা, আর পোতাশ্রয়ে বিশ্রাম নেয়া জাহাজের সারি। জিব্রালফারো থেকে উল্টোদিকে তাকিয়ে দেখলাম মালাগা শহরকে- দেখা যাচ্ছে আল কাছাবা, ক্যাথেড্রাল, রোমান থিয়েটার, সাথে বুল রিং ‘লা মালাগুয়েতা’, আর পাম গাছের সারি। আকাশ-পাহাড়-সমুদ্র সৈকত-বন্দর-শহর-বৃক্ষ মিলে সৃষ্টি করেছে এক ঐকতান, অসাধারণ সুন্দর এক দৃশ্যের!
অতন্দ্র প্রহরীর মতো মালাগা শহরের ওপর মাথা উঁচু করে আছে কাস্তিয়ো দে জিব্রালফারো। প্রথমে ফিনিশীয়রা এখানে নির্মাণ করেন এক বাতিঘর, যাতে দূর সাগরের পথে জাহাজরা পথ দেখতে পায়। আরবি শব্দ ‘জেবেল’ মানে পাহাড়, আর গ্রিক শব্দ ‘ফারো’ মানে বাতি- দুয়ে মিলে বাতিঘর- জিব্রালফারো নামটি হয়তো এখান থেকেই এসেছে। ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের কারণে কাস্তিয়ো দে জিব্রালফারো জায়গা করে নিয়েছে মালাগার পতাকায়।
৯২৯ সালে মুর শাসক ৩য় আবদ-আল-রহমান বাতিঘরটিকে দুর্গ হিসেবে সম্প্রসারিত করেন। আরো পরে ১৪শ’ শতাব্দীতে ১ম সুলতান ইউসুফ জিব্রালফারোকে আরো প্রসারিত করেন- দুদিকে দেয়াল ঘেরা চলার সরু রাস্তা তৈরি করে দুর্গটিকে যুক্ত করে দেন নিচের আলকাছাবা প্রাসাদের সাথে।
আমরা সে সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে জিব্রালফারো থেকে গেলাম আলকাছাবা প্রাসাদে। তা দেখে মনে পড়ল গ্রানাদার আলহাম্বরাকে। ১১ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুসলিম শাসকরা আলকাছাবার নির্মাণ কাজ শুরু করেন। প্রাসাদটি সুরক্ষার জন্য নির্মিত দুটি দেয়ালের বেষ্টনী, যার প্রতিটিতে রয়েছে অনেক টাওয়ার। ভেতরের বেষ্টনীর মাঝখানে রয়েছে পাহাড়ের চূড়া, যার ওপর প্রাসাদগুলি নির্মিত। মোট ৫টি গেট পেরিয়ে আমরা মূল প্রাসাদে প্রবেশ করলাম। প্রথমে তাইফা প্রাসাদ। বহু খিলান-সমৃদ্ধ এ প্রাসাদে কর্ডোভার মসজিদের স্থাপত্য ও অলঙ্করণের ছাপ দেখা যায়। পেতিও দে লস সুরতিদোরেছ- বাগান, ফোয়ারা ও জলাধার ঘেরা এক সুন্দর আঙ্গিনা এ প্রাসাদকে শোভিত করেছে। এরপর দেখলাম নাসিরীয় প্রাসাদ। খিলান-সমৃদ্ধ দুটি আয়তাকার আঙ্গিনার চারপাশে রয়েছে অনেক কক্ষ ও বারান্দা।
আলকাছাবা দেখে ক’মিনিট হেঁটে আমরা গেলাম কাছের এক সমুদ্র সৈকতে, নাম-‘প্লেয়া দে লা মালাগুয়েতা’। সাগরপাড়ে দাঁড়াতেই নীল জলরাশি পায়ে লুটিয়ে পড়ে আমাদের স্বাগত জানাল। সাগরের কল্লোল একটানা গান হয়ে বাজছে কানে। সৈকতের সোনা রঙের বালির ওপর পড়েছে ঝলমলে রোদ। এ রোদের জন্যই খ্যাত হয়ে আছে এ অঞ্চল। এখানে এসে বুঝলাম- কেন এ অঞ্চলটিকে বলা হয় ‘কস্টা ডি সল’- কস্টা মানে সৈকত, সল মানে সূর্য- সূর্য-চুম্বিত সৈকত। যথার্থই!
সৈকতে রয়েছে সুন্দর এক প্রমেনেদ- হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর এক বাঁধানো চত্বর, প্রায় এক মাইলের মতো লম্বা, দেড়শো ফিট চওড়া, একে ঘিরে রেখেছে তার দুপাশের সারি সারি পাম গাছ। পর্যটকদের জন্য রয়েছে ছাতা ও সানবেড, জলক্রীড়ার স্থান, ডিঙি নৌকা, জেট স্কী, বীচ বাইক, বীচ ভলিবল, শিশু পার্ক এবং আরো অনেক কিছু। সবদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, বুটিক শপ ও ফলমূলের দোকান। একটু হাঁটতেই নাকে ভেসে এল খাবারের ঘ্রাণ- কেমন পোড়া পোড়া মসলামাখা- যেন ঢাকার দারুল কাবাবের গন্ধ। এগোতেই দেখলাম বিশাল গ্রিলে কয়লার আগুনে সেঁকা হচ্ছে মাছ। দেখে মনে হলো পদ্মার ইলিশ, তা অবশ্য এখানে পাওয়ার কথা নয়। জিজ্ঞেস করতেই বলল সার্ডিন মাছ, দেখতে আমাদের প্রিয় ইলিশের মতোই। এসময় এখানে সার্ডিন মাছ ধরা হচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে। দুপুর গড়িয়ে গেছে অনেক। আমাদের এমনিতেই খিদে পেয়েছে, তার উপর কয়লার আগুনে সেঁকা মাছের ঘ্রাণে খিদে বেড়ে গেছে বহুগুণ। দেরি না করে অর্ডার দিলাম সার্ডিন, ব্রাউন রাইচ ও সালাদ। মাছের স্বাদই আলাদা, আর তা যদি হয় সদ্য ধরা মাছের গ্রিল। অনেকদিন পর খেলাম ভাত ও মাছ খুব তৃপ্তিভরে। তাই তো বলা হয় মাছে ভাতে বাঙালি।
এরপর আমরা বীচ ভলিবল খেলায় যোগ দিলাম। আগে অনেকবার এ খেলা খেলেছি শহরের মাঝখানে বালি দিয়ে ঢাকা মাঠে। তবে বীচ ভলিবল তো বীচেই খেলতে হবে, যদি সুযোগ থাকে। আজ এল সে দুর্লভ সুযোগ, তাই হাতছাড়া করলাম না। ছেলে বুড়ো মিলে একটি দল আরো কয়েকজনের অপেক্ষায় ছিল। কাছে যেতেই অনুরোধ করল তাদের সাথে খেলতে- আমরা সানন্দে যোগ দিলাম। বয়স, খেলার নিয়মকানুন, বা হারা জেতা- কোনোটিই এখানে বড় নয়। বড় হচ্ছে আনন্দ দেয়া ও আনন্দ পাওয়া। আজ বীচ ভলিবল খেলে এ দুটি লক্ষ্য অনেকটা পূরণ করল নাবিল ও নাতাশা।
এভাবে বহু সময় কেটে গেল সাগর পারের আনন্দে। এরপর বাকি থাকল আরো বড় সৌন্দর্য- সূর্যাস্ত। পড়ন্ত বিকেলের আভা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, সূর্যাস্তের আর বেশি দেরি নেই। তা দেখার ইচ্ছেয় কয়েকটি সানবেডে বসে আমরা পশ্চিমে সাগরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শেষ কবে এতো সময় ধরে সাগর দেখেছি তা মনে নেই। হয়তো তা ত্রিশ বছরেরও আগে, দেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গিয়েছিলাম। তখন জানতাম না এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সৈকত। কক্সবাজার সৈকতে যেয়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম সাগরের শক্তি ও সৌন্দর্য দেখে।
যে সূর্য দিনভর চকচকে রোদ ঢেলে দিয়েছে, সে এখন রঙ বদলাতে শুরু করল। হলুদ-কমলা-লাল- নানা রঙের মেলা শুরু হলো দিগন্তে, আর সে রঙ ছড়িয়ে পড়তে লাগল সাগরের জলরাশিতে, পাহাড়ে, মেঘমালায়, বন্দরে, পাম-বৃক্ষে এবং আমাদের মনেও। অবশেষে কোস্টা দে সল এর ‘সল’ বা সূর্য বিদায় নিল, থাকল ‘কস্টা’ বা সৈকত- তার সাথে আমরাও।
এক স্বপ্নিল সূর্যাস্ত শেষে আর নড়তে ইচ্ছে হয় না, যেন এক ঘোর ভর করে আছে মনে। তবুও উঠতে হলো, কারণ আজ আমাদের যাওয়ার কথা সাগর পাড়ের এক হোটেলে, মালাগার আরেক প্রান্তে, জায়গাটির নাম থররেমোলিনোছ। শহরকেন্দ্রের হোটেল ছেড়ে সাগর পাড়ের হোটেলে পৌঁছতে প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেল।
সাগর পাড়ের হোটেলে এসে নাবিল ও নাতাশা খুবই খুশি। রুমের জানালা খুলতেই সাগর, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। ঢেউয়ের একটানা গর্জন কানে বাজছে, তাতে যোগ হচ্ছে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। রাতের সাগরের জলরাশি ফ্লাডলাইটের আলোতে চিকচিক করছে, তার সাথে মিশেছে চাঁদ ও তারাদের আলো। সবকিছু মনে হচ্ছে সুন্দর ও মায়াবী!
আমরা সবাই ব্যালকনিতে বসে সাগর দেখতে লাগলাম। ওপরে আকাশে মেঘের ভেলা। মেঘ এসে মাঝে মাঝে চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে, তার ছায়া এসে পড়ছে সাগরের জলে। মেঘ ও চাঁদের লুকোচুরি খেলা আমরা উপভোগ করতে লাগলাম। আকাশ, চাঁদ, মেঘ, সাগর, সৈকত- সব মিলে সৃষ্টি করেছে এক অপরূপ দৃশ্যের। সে দৃশ্যে সবাই যেন হারিয়ে গেল। আমার মনে হলো ভোরে সূর্যোদয় দেখতে হলে আমাদের এখনই ঘুমানো দরকার। সতর্কতা হিসেবে ফারজানা ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রাখল- যাতে সূর্যোদয় মিস না হয়।
ভোরে সময়মতো উঠেই ছুটলাম ‘প্লেয়া দে লা কারিওয়েলা’ সৈকতের দিকে। এ সৈকতটি পূর্বমুখী, তাই সূর্যোদয় ভালোভাবে দেখা যাবে। ভাগ্য আরো ভাল যে, আজ আকাশও ঝকঝকে পরিষ্কার। এর মধ্যে সৈকতে অনেকে চলে এসেছে, উদ্দেশ্য একই- সূর্যোদয় দেখা। পথের এক ক্যাফে থেকে কফি ও স্যান্ডউইচ নিয়ে বসলাম কাছের সানবেডে।
প্লেয়া দে লা কারিওয়েলা, সংক্ষেপে লা কারিওয়েলা, অনেক আগে ছিল এক জেলে পাড়া। মেডিটেরিয়ান আবহাওয়া ও শান্ত পরিবেশের কারণে তা হয়ে উঠে অভিজাতদের এক মিলন কেন্দ্র। এখানকার পেজ এসপাদা হোটেলটি ছিল রাজ পরিবারের সদস্য, হলিউডের তারকাবৃন্দ ও ধনকুবেরদের প্রাণকেন্দ্র। এখানে অবস্থান করেছেন চার্লটন হেস্টন, অরসন ওয়েলস, এলিজাবেথ টেলর ও আরো অনেক তারকা। এ সৈকতের শহর থররেমোলিনোছ ষাটের দশকে হয়ে উঠে স্পেনের আধুনিকতা ও গ্ল্যামারের বড় প্রতীক। ঝকঝকে রোদ ও সোনালি সৈকত কস্টা দে সলকে ২০০০ সালের মধ্যে করে তোলে স্পেনে পর্যটনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। দলে দলে পর্যটক আসতে থাকে, তাদের জায়গা দেয়ার জন্য নির্মিত হয় বহু সুউচ্চ হোটেল ও অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। এক কালের শান্ত, নিরিবিলি সৈকত ও শহর হয়ে উঠে জনাকীর্ণ। ফলে এলাকাটি তার আভিজাত্য ও আবেদন হারাতে থাকে।
লা কারিওয়েলা সৈকতে এ ভোর বেলা বসে সূর্যোদয় দেখছেন আমাদের মতো হাজারো সাধারণ মানুষ, যারা অতীতের অভিজাতদের জায়গা পূরণ করে দিয়েছে।
এর মধ্যে পুরো সাগর ও সৈকতকে সোনার আলোয় ভরিয়ে দিয়ে উদিত হলো সূর্য। সে আলো যেন প্রবেশ করল আমাদের হৃদয়-মনে, গভীর এক আনন্দে আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম। ভোরের হাসিমাখা রোদ গায়ে মেখে আমরাও হেসে উঠলাম সূর্য-সাগর-সৈকতের হাসিতে যোগ দিয়ে।
নাতাশা বলল, ঝিনুক কুড়াতে যাব। নাবিল বলল, আমি সমুদ্রে সাঁতার কাটব। তারা ভাল করে সাঁতার কাটতে পারে না, তারপরও দেখা যাক। সমুদ্র এখন বেশ শান্ত, তাই পানিতে নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম, একটু সাঁতার কাটলাম। সৈকতের বালি সোনা রঙের ও বেশ মসৃণ- তার মাঝে ঝিনুক কুড়ানোতে মেতে উঠেছে নাবিল ও নাতাশা। তারা খুঁজে পেল অনেক ঝিনুক- বেগুনী, সাদা, নীল, ধূসর। এরপর পাশের একটি পানির কলে ঝিনুকগুলিকে পরিষ্কার করল, আমরাও হাত-পা ধুয়ে নিলাম। পরে হোটেলে ফিরে সবাই পোশাক পাল্টিয়ে নিলাম।
অনেকগুলি ঝিনুকের মধ্যে নাতাশার নীল রঙের একটি ঝিনুক বেশ বড় ও সুন্দর। সে ওটাকে নিয়ে আদর করছে, তার সাথে কথা বলছে। কারণ, ঝিনুকটি উঠে এসেছে সাগর থেকে, সাগরের প্রতিনিধি হয়ে। লোরকা যেন এ ঝিনুকটির কথাই বলেছেন তাঁর কবিতায়:
কে যেন আমাকে একটা ঝিনুক এনে দিল
তার মধ্যে থেকে ভেসে আসে
মানচিত্র থেকে উঠে আসা এক সমুদ্রের গান
আমার হৃদয়
ভরে যায় সাগরের জলে
আর ছোট ছোট রুপালি
ছায়ামাখা মাছের দলে।১
আবারও লোরকা! কোস্টা দে সল-এর ঝিনুক কি মনে করিয়ে দিল লোরকাকে, না লোরকাই তুলে ধরল এ ঝিনুককে?
Ref:
১. Caracola : A Natalita Jimenez,
ঝিনুক: অনুবাদ: গৌতম দত্ত
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-১৩
বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আকাশে উড়ে বেড়ানো গাঙচিল বুঝিয়ে দিল তার সাথে আছি আমরাও- সাগর পাড়ে। একটা গাঙচিল দূর থেকে উড়ে এলো কাছে, আবার উড়ে মিলিয়ে গেল দিগন্তে। আবার ফিরে এল, একা নয়, সাথে আরো অনেকে। ধীরে ধীরে দেখি আরো বহু গাঙচিল- ওপরে উঠছে- প্রায়ই ছুঁয়ে যাচ্ছে আকাশ, নিচে নামছে- প্রায়ই ছুঁয়ে যাচ্ছে সমুদ্র-তরঙ্গ। যখন যা খুশি করছে- কী মুক্ত, কী উচ্ছ্বসিত! ওরা কি জীবনানন্দের সিন্ধুসারস:
দু-এক মুহূর্ত শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি
হে সিন্ধুসারস,
মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি
কী চমৎকার মিল! ‘পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি’- এখানেও পাহাড়, সাথে তরঙ্গ, সেখানে নামছে সিন্ধুসারস- তবে ‘মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে’ নয়, মালাগা-র পাহাড়ের কোল ছেড়ে।
মালাগা-র পাহাড়ের কোল দেখতে আমরা ভোরে এলাম ‘কাস্তিয়ো দে জিব্রালফারো’, মানে জিব্রালফারো দুর্গে, এটি নিজেও দাঁড়িয়ে আছে এক পাহাড়ে। সামনে দেখা যাচ্ছে ‘মনতেছ দে মালাগা’ পর্বতমালা, ওপরে তাকে ছুঁয়ে আছে নীল-সাদা আকাশ, নিচে তার সাথে খেলা করছে ভূমধ্যসাগরের তরঙ্গমালা, যা আছড়ে পড়ছে বিস্তৃত এক সোনালি সৈকতে। পাশে দেখা যাচ্ছে মালাগা বন্দরের কর্মব্যস্ততা, জাহাজের আনাগোনা, আর পোতাশ্রয়ে বিশ্রাম নেয়া জাহাজের সারি। জিব্রালফারো থেকে উল্টোদিকে তাকিয়ে দেখলাম মালাগা শহরকে- দেখা যাচ্ছে আল কাছাবা, ক্যাথেড্রাল, রোমান থিয়েটার, সাথে বুল রিং ‘লা মালাগুয়েতা’, আর পাম গাছের সারি। আকাশ-পাহাড়-সমুদ্র সৈকত-বন্দর-শহর-বৃক্ষ মিলে সৃষ্টি করেছে এক ঐকতান, অসাধারণ সুন্দর এক দৃশ্যের!
অতন্দ্র প্রহরীর মতো মালাগা শহরের ওপর মাথা উঁচু করে আছে কাস্তিয়ো দে জিব্রালফারো। প্রথমে ফিনিশীয়রা এখানে নির্মাণ করেন এক বাতিঘর, যাতে দূর সাগরের পথে জাহাজরা পথ দেখতে পায়। আরবি শব্দ ‘জেবেল’ মানে পাহাড়, আর গ্রিক শব্দ ‘ফারো’ মানে বাতি- দুয়ে মিলে বাতিঘর- জিব্রালফারো নামটি হয়তো এখান থেকেই এসেছে। ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের কারণে কাস্তিয়ো দে জিব্রালফারো জায়গা করে নিয়েছে মালাগার পতাকায়।
৯২৯ সালে মুর শাসক ৩য় আবদ-আল-রহমান বাতিঘরটিকে দুর্গ হিসেবে সম্প্রসারিত করেন। আরো পরে ১৪শ’ শতাব্দীতে ১ম সুলতান ইউসুফ জিব্রালফারোকে আরো প্রসারিত করেন- দুদিকে দেয়াল ঘেরা চলার সরু রাস্তা তৈরি করে দুর্গটিকে যুক্ত করে দেন নিচের আলকাছাবা প্রাসাদের সাথে।
আমরা সে সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে জিব্রালফারো থেকে গেলাম আলকাছাবা প্রাসাদে। তা দেখে মনে পড়ল গ্রানাদার আলহাম্বরাকে। ১১ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুসলিম শাসকরা আলকাছাবার নির্মাণ কাজ শুরু করেন। প্রাসাদটি সুরক্ষার জন্য নির্মিত দুটি দেয়ালের বেষ্টনী, যার প্রতিটিতে রয়েছে অনেক টাওয়ার। ভেতরের বেষ্টনীর মাঝখানে রয়েছে পাহাড়ের চূড়া, যার ওপর প্রাসাদগুলি নির্মিত। মোট ৫টি গেট পেরিয়ে আমরা মূল প্রাসাদে প্রবেশ করলাম। প্রথমে তাইফা প্রাসাদ। বহু খিলান-সমৃদ্ধ এ প্রাসাদে কর্ডোভার মসজিদের স্থাপত্য ও অলঙ্করণের ছাপ দেখা যায়। পেতিও দে লস সুরতিদোরেছ- বাগান, ফোয়ারা ও জলাধার ঘেরা এক সুন্দর আঙ্গিনা এ প্রাসাদকে শোভিত করেছে। এরপর দেখলাম নাসিরীয় প্রাসাদ। খিলান-সমৃদ্ধ দুটি আয়তাকার আঙ্গিনার চারপাশে রয়েছে অনেক কক্ষ ও বারান্দা।
আলকাছাবা দেখে ক’মিনিট হেঁটে আমরা গেলাম কাছের এক সমুদ্র সৈকতে, নাম-‘প্লেয়া দে লা মালাগুয়েতা’। সাগরপাড়ে দাঁড়াতেই নীল জলরাশি পায়ে লুটিয়ে পড়ে আমাদের স্বাগত জানাল। সাগরের কল্লোল একটানা গান হয়ে বাজছে কানে। সৈকতের সোনা রঙের বালির ওপর পড়েছে ঝলমলে রোদ। এ রোদের জন্যই খ্যাত হয়ে আছে এ অঞ্চল। এখানে এসে বুঝলাম- কেন এ অঞ্চলটিকে বলা হয় ‘কস্টা ডি সল’- কস্টা মানে সৈকত, সল মানে সূর্য- সূর্য-চুম্বিত সৈকত। যথার্থই!
সৈকতে রয়েছে সুন্দর এক প্রমেনেদ- হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর এক বাঁধানো চত্বর, প্রায় এক মাইলের মতো লম্বা, দেড়শো ফিট চওড়া, একে ঘিরে রেখেছে তার দুপাশের সারি সারি পাম গাছ। পর্যটকদের জন্য রয়েছে ছাতা ও সানবেড, জলক্রীড়ার স্থান, ডিঙি নৌকা, জেট স্কী, বীচ বাইক, বীচ ভলিবল, শিশু পার্ক এবং আরো অনেক কিছু। সবদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, বুটিক শপ ও ফলমূলের দোকান। একটু হাঁটতেই নাকে ভেসে এল খাবারের ঘ্রাণ- কেমন পোড়া পোড়া মসলামাখা- যেন ঢাকার দারুল কাবাবের গন্ধ। এগোতেই দেখলাম বিশাল গ্রিলে কয়লার আগুনে সেঁকা হচ্ছে মাছ। দেখে মনে হলো পদ্মার ইলিশ, তা অবশ্য এখানে পাওয়ার কথা নয়। জিজ্ঞেস করতেই বলল সার্ডিন মাছ, দেখতে আমাদের প্রিয় ইলিশের মতোই। এসময় এখানে সার্ডিন মাছ ধরা হচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে। দুপুর গড়িয়ে গেছে অনেক। আমাদের এমনিতেই খিদে পেয়েছে, তার উপর কয়লার আগুনে সেঁকা মাছের ঘ্রাণে খিদে বেড়ে গেছে বহুগুণ। দেরি না করে অর্ডার দিলাম সার্ডিন, ব্রাউন রাইচ ও সালাদ। মাছের স্বাদই আলাদা, আর তা যদি হয় সদ্য ধরা মাছের গ্রিল। অনেকদিন পর খেলাম ভাত ও মাছ খুব তৃপ্তিভরে। তাই তো বলা হয় মাছে ভাতে বাঙালি।
এরপর আমরা বীচ ভলিবল খেলায় যোগ দিলাম। আগে অনেকবার এ খেলা খেলেছি শহরের মাঝখানে বালি দিয়ে ঢাকা মাঠে। তবে বীচ ভলিবল তো বীচেই খেলতে হবে, যদি সুযোগ থাকে। আজ এল সে দুর্লভ সুযোগ, তাই হাতছাড়া করলাম না। ছেলে বুড়ো মিলে একটি দল আরো কয়েকজনের অপেক্ষায় ছিল। কাছে যেতেই অনুরোধ করল তাদের সাথে খেলতে- আমরা সানন্দে যোগ দিলাম। বয়স, খেলার নিয়মকানুন, বা হারা জেতা- কোনোটিই এখানে বড় নয়। বড় হচ্ছে আনন্দ দেয়া ও আনন্দ পাওয়া। আজ বীচ ভলিবল খেলে এ দুটি লক্ষ্য অনেকটা পূরণ করল নাবিল ও নাতাশা।
এভাবে বহু সময় কেটে গেল সাগর পারের আনন্দে। এরপর বাকি থাকল আরো বড় সৌন্দর্য- সূর্যাস্ত। পড়ন্ত বিকেলের আভা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, সূর্যাস্তের আর বেশি দেরি নেই। তা দেখার ইচ্ছেয় কয়েকটি সানবেডে বসে আমরা পশ্চিমে সাগরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শেষ কবে এতো সময় ধরে সাগর দেখেছি তা মনে নেই। হয়তো তা ত্রিশ বছরেরও আগে, দেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গিয়েছিলাম। তখন জানতাম না এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সৈকত। কক্সবাজার সৈকতে যেয়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম সাগরের শক্তি ও সৌন্দর্য দেখে।
যে সূর্য দিনভর চকচকে রোদ ঢেলে দিয়েছে, সে এখন রঙ বদলাতে শুরু করল। হলুদ-কমলা-লাল- নানা রঙের মেলা শুরু হলো দিগন্তে, আর সে রঙ ছড়িয়ে পড়তে লাগল সাগরের জলরাশিতে, পাহাড়ে, মেঘমালায়, বন্দরে, পাম-বৃক্ষে এবং আমাদের মনেও। অবশেষে কোস্টা দে সল এর ‘সল’ বা সূর্য বিদায় নিল, থাকল ‘কস্টা’ বা সৈকত- তার সাথে আমরাও।
এক স্বপ্নিল সূর্যাস্ত শেষে আর নড়তে ইচ্ছে হয় না, যেন এক ঘোর ভর করে আছে মনে। তবুও উঠতে হলো, কারণ আজ আমাদের যাওয়ার কথা সাগর পাড়ের এক হোটেলে, মালাগার আরেক প্রান্তে, জায়গাটির নাম থররেমোলিনোছ। শহরকেন্দ্রের হোটেল ছেড়ে সাগর পাড়ের হোটেলে পৌঁছতে প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেল।
সাগর পাড়ের হোটেলে এসে নাবিল ও নাতাশা খুবই খুশি। রুমের জানালা খুলতেই সাগর, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। ঢেউয়ের একটানা গর্জন কানে বাজছে, তাতে যোগ হচ্ছে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। রাতের সাগরের জলরাশি ফ্লাডলাইটের আলোতে চিকচিক করছে, তার সাথে মিশেছে চাঁদ ও তারাদের আলো। সবকিছু মনে হচ্ছে সুন্দর ও মায়াবী!
আমরা সবাই ব্যালকনিতে বসে সাগর দেখতে লাগলাম। ওপরে আকাশে মেঘের ভেলা। মেঘ এসে মাঝে মাঝে চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে, তার ছায়া এসে পড়ছে সাগরের জলে। মেঘ ও চাঁদের লুকোচুরি খেলা আমরা উপভোগ করতে লাগলাম। আকাশ, চাঁদ, মেঘ, সাগর, সৈকত- সব মিলে সৃষ্টি করেছে এক অপরূপ দৃশ্যের। সে দৃশ্যে সবাই যেন হারিয়ে গেল। আমার মনে হলো ভোরে সূর্যোদয় দেখতে হলে আমাদের এখনই ঘুমানো দরকার। সতর্কতা হিসেবে ফারজানা ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রাখল- যাতে সূর্যোদয় মিস না হয়।
ভোরে সময়মতো উঠেই ছুটলাম ‘প্লেয়া দে লা কারিওয়েলা’ সৈকতের দিকে। এ সৈকতটি পূর্বমুখী, তাই সূর্যোদয় ভালোভাবে দেখা যাবে। ভাগ্য আরো ভাল যে, আজ আকাশও ঝকঝকে পরিষ্কার। এর মধ্যে সৈকতে অনেকে চলে এসেছে, উদ্দেশ্য একই- সূর্যোদয় দেখা। পথের এক ক্যাফে থেকে কফি ও স্যান্ডউইচ নিয়ে বসলাম কাছের সানবেডে।
প্লেয়া দে লা কারিওয়েলা, সংক্ষেপে লা কারিওয়েলা, অনেক আগে ছিল এক জেলে পাড়া। মেডিটেরিয়ান আবহাওয়া ও শান্ত পরিবেশের কারণে তা হয়ে উঠে অভিজাতদের এক মিলন কেন্দ্র। এখানকার পেজ এসপাদা হোটেলটি ছিল রাজ পরিবারের সদস্য, হলিউডের তারকাবৃন্দ ও ধনকুবেরদের প্রাণকেন্দ্র। এখানে অবস্থান করেছেন চার্লটন হেস্টন, অরসন ওয়েলস, এলিজাবেথ টেলর ও আরো অনেক তারকা। এ সৈকতের শহর থররেমোলিনোছ ষাটের দশকে হয়ে উঠে স্পেনের আধুনিকতা ও গ্ল্যামারের বড় প্রতীক। ঝকঝকে রোদ ও সোনালি সৈকত কস্টা দে সলকে ২০০০ সালের মধ্যে করে তোলে স্পেনে পর্যটনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। দলে দলে পর্যটক আসতে থাকে, তাদের জায়গা দেয়ার জন্য নির্মিত হয় বহু সুউচ্চ হোটেল ও অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। এক কালের শান্ত, নিরিবিলি সৈকত ও শহর হয়ে উঠে জনাকীর্ণ। ফলে এলাকাটি তার আভিজাত্য ও আবেদন হারাতে থাকে।
লা কারিওয়েলা সৈকতে এ ভোর বেলা বসে সূর্যোদয় দেখছেন আমাদের মতো হাজারো সাধারণ মানুষ, যারা অতীতের অভিজাতদের জায়গা পূরণ করে দিয়েছে।
এর মধ্যে পুরো সাগর ও সৈকতকে সোনার আলোয় ভরিয়ে দিয়ে উদিত হলো সূর্য। সে আলো যেন প্রবেশ করল আমাদের হৃদয়-মনে, গভীর এক আনন্দে আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম। ভোরের হাসিমাখা রোদ গায়ে মেখে আমরাও হেসে উঠলাম সূর্য-সাগর-সৈকতের হাসিতে যোগ দিয়ে।
নাতাশা বলল, ঝিনুক কুড়াতে যাব। নাবিল বলল, আমি সমুদ্রে সাঁতার কাটব। তারা ভাল করে সাঁতার কাটতে পারে না, তারপরও দেখা যাক। সমুদ্র এখন বেশ শান্ত, তাই পানিতে নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম, একটু সাঁতার কাটলাম। সৈকতের বালি সোনা রঙের ও বেশ মসৃণ- তার মাঝে ঝিনুক কুড়ানোতে মেতে উঠেছে নাবিল ও নাতাশা। তারা খুঁজে পেল অনেক ঝিনুক- বেগুনী, সাদা, নীল, ধূসর। এরপর পাশের একটি পানির কলে ঝিনুকগুলিকে পরিষ্কার করল, আমরাও হাত-পা ধুয়ে নিলাম। পরে হোটেলে ফিরে সবাই পোশাক পাল্টিয়ে নিলাম।
অনেকগুলি ঝিনুকের মধ্যে নাতাশার নীল রঙের একটি ঝিনুক বেশ বড় ও সুন্দর। সে ওটাকে নিয়ে আদর করছে, তার সাথে কথা বলছে। কারণ, ঝিনুকটি উঠে এসেছে সাগর থেকে, সাগরের প্রতিনিধি হয়ে। লোরকা যেন এ ঝিনুকটির কথাই বলেছেন তাঁর কবিতায়:
কে যেন আমাকে একটা ঝিনুক এনে দিল
তার মধ্যে থেকে ভেসে আসে
মানচিত্র থেকে উঠে আসা এক সমুদ্রের গান
আমার হৃদয়
ভরে যায় সাগরের জলে
আর ছোট ছোট রুপালি
ছায়ামাখা মাছের দলে।১
আবারও লোরকা! কোস্টা দে সল-এর ঝিনুক কি মনে করিয়ে দিল লোরকাকে, না লোরকাই তুলে ধরল এ ঝিনুককে?
Ref:
১. Caracola : A Natalita Jimenez,
ঝিনুক: অনুবাদ: গৌতম দত্ত