ফ্রান্ৎস কাফকা গল্প
অনুবাদ : বিপাশা মন্ডল
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কাঠের রেলিংয়ের একটা জায়গায় প্রচুর লোকজন জড়ো হয়েছে। ‘কী ছোটো!’ একদল ফরাসি চিৎকার করে উঠল, মনে হলো যেন তারা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে। কী হতে পারে? আমরা এগিয়ে গেলাম। এবং সেখানে মাঠের বেশ কাছে, অভিনবভাবে, একটা ছোটো উড়োজাহাজ দাঁড়িয়ে ছিল, সত্যিকারের হলুদ রঙ করা, ওটা ওড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এখন আমরা ব্লেরিওর হ্যাঙ্গার দেখতে পেলাম, হ্যাঙ্গারের পাশে তার শিক্ষানবিশ লেবেল্যাঙ্ক; উড়োজাহাজগুলো মাঠের মধ্যেই সেট করা হয়েছে। দুইটা পাখার একটায় ভর দিয়ে মেশিনটা দাঁড় করানো, সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায়, ব্লেরিও একচোখ বন্ধ করে মাথাটাকে দৃঢ়ভাবে ঘাড়ের উপর রেখে তার বিমানের কর্মরত ইঞ্জিনের মেরামতকারীদের উপরে নজর রাখছে।
সে কী এই তুচ্ছ জিনিসটা নিয়ে হাওয়ায় উড়তে চাইছে? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মানুষের জন্য একাজটাই জলের উপরে করা কতো সহজ। প্রথমে তারা হাঁটুজল ছোটো ডোবায় প্র্যাকটিস করে, এরপর পুকুরে, এরপর নদীতে, এবং এর অনেক পরে, তারা সমুদ্রে নেমে সাহসিকতা দেখায়; এই লোকগুলোর জন্য এই হাওয়ায় উড়োজাহাজ উড়ানোর প্রতিযোগিতা তো সমুদ্রের সমান।
ব্লেরিও এর মধ্যে তার সিটে বসে পড়েছে; হাত দিয়ে কোনো লিভার অথবা সে জাতীয় কিছু ধরে আছে, কিন্তু এখনো সে মেকানিকদের কাজ করে যেতে দিল, যেন তারা অতি উৎসাহী বাচ্চা-কাচ্চা। সে ধীর গতিতে আমাদের দিকে তাকাল, আমাদের থেকে চোখ সরিয়ে আবার অন্যদিকে চোখ ঘোরাল, কিন্তু সে সবসময় আসলে নিজের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। এখন সে উড়ান দিতে যাচ্ছে, পৃথিবীর অন্য কোনো কিছু এতো স্বাভাবিক হতে পারে না। এটার সঙ্গে স্বাভাবিকত্বের এই যে অনুভূতি, যুগপৎ চারপাশের অনন্যতার সাধারণ অনুভূতি, যেটা থেকে সে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারে না, এটা তাকে একই সঙ্গে সাধারণ ও অসাধারণত্বের অনুভূতি দেয়।
একজন সহকারী একটা প্রপেলারের ব্লেড নিয়ে সেটাকে ঠিকভাবে জুড়ে দিতে যায়, সে ওটাকে ধরে টান দেয় এবং একটা ঝাঁকুনি দেয়, যে কেউ শুনলে মনে করবে কোনো শক্তিশালী লোক তার ঘুমের মধ্যে হাঁপাচ্ছে; কিন্তু প্রপেলারটির মধ্যে জীবনের কোনো চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় না। সে আবার চেষ্টা করে, সে আরো দশবার চেষ্টা করে, কখনো প্রপেলারটি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়, কখনো কয়েকবার ঘোরার কষ্ট স্বীকার করে। সমস্যা আছে এঞ্জিনে। আবার গোড়া থেকে কাজ শুরু করা হয়, এইমাত্র যারা কাজ করল তাদের চেয়ে বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে দর্শকরা। ইঞ্জিনটাকে প্রতি কোণ থেকে তেলমাখানো হলো; লুকানো স্ক্রুগুলো ঢিলা করা হলো এবং টাইটও দেয়া হলো; একটা লোক হ্যাঙ্গারের মধ্যে ঢুকে পড়ল, অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ নিয়ে এল; এরপর ওটা আর ফিট হলো না; সে আবার দৌড়ে ফিরে যায়, এবং হ্যাঙ্গারের মেঝেতে বসে সে তার হাঁটুর মাঝখানে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। ব্লেরিও একজন মেরামতকারীর সঙ্গে নিজের সিট বদলে দেয়, মেরামতকারী সিট বদলে নেয় লেব্ল্যাঙ্কের সঙ্গে। এখন একটা লোক প্রপেলার ধরে টান দেয়, এরপর আরো একজন। কিন্তু ইঞ্জিন নির্দয়; একজন স্কুল ছাত্রের মতো যাকে সবসময় সাহায্য করতে হয়, পুরো ক্লাস তাকে পিছন থেকে বলে দিয়ে সাহায্য করে, না, সে পারবে না, বার বার সে আটকে যায়, বার বার সে একই স্থানে আটকে যায় এরপর হাল ছেড়ে দেয়। এক মুহূর্তের জন্য ব্লেরিও নিজের সিটে শান্ত স্থির হয়ে বসেছিল; তার ছয়জন সহকারী একটুও নড়াচড়া না করে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল; এসব দৃশ্য স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।
এবার দর্শকরা এক মুহূর্তের জন্য সহজভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারল এবং তাদের চারদিকে তাকাল। মায়ের মমতামাখা তরুণী স্ত্রী ব্লেরিওর, পাশ থেকে এগিয়ে আসে, দুটো বাচ্চা তার পিছনে। যদি তার স্বামী উড়তে না পারে, সেটা তার জন্য ভালো হবে না, আবার যদি তার স্বামী উড়ান দিতে পারে, সে ভয় পাবে; এছাড়া তার সুন্দর পোশাকটা এই আবহাওয়ার তুলনায় কিছুটা ভারিও বটে।
আরও একবার প্রপেলারটা ঘুরে গেল, হতে পারে আগের চেয়ে ভালোভাবে অথবা খারাপভাবে; ইঞ্জিনটা একটা গর্জন করে চলতে শুরু করল, যেন এটা অন্য কোনো ইঞ্জিন; চারজন মানুষ পিছন থেকে যন্ত্রটাকে ধরে আছে, এবং চারদিকের নীরবতার ভিতর ঘুরতে থাকা প্রপেলারের তৈরি ঝোড়ো হাওয়া যেন এই লোকগুলোর পোশাকের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কোনো লোকই এখানে কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছে না, মনে হয় যেন প্রপেলারের শব্দই এখানে নির্দেশনা দিচ্ছে; আটটি হাত যন্ত্রটাকে ছেড়ে দিচ্ছে, যন্ত্রটা দীর্ঘ সময় ধরে একজন বেখাপ্পা নৃত্যশিল্পীর মতো নাচের ফ্লোরে ঢেউয়ের ভঙ্গিতে দৌড়াচ্ছে।
এরকম বহু উদ্যোগ তৈরি হয়েছে এবং এর সবগুলোই উদ্দেশ্যহীনভাবে শেষ হয়েছে। এদের প্রত্যেকের প্রদর্শনী উত্তেজনায় জনসাধারণকে তাদের বসা থেকে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য করেছে, খড়ের ঢাকনার আসনে, যে আসনে একজন লোক হাত-পা ছড়িয়ে ভারসাম্য রাখতে পারে এবং একই সঙ্গে এই অভিব্যক্তি এগুলোকে একজন ব্যক্তির আশা, উদ্বিগ্নতা এবং আনন্দের প্রকাশ হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু এধরনের অঙ্গভঙ্গী প্রকাশের সময়ে ইতালিয়ান সম্ভ্রান্তদের অভিজাত সমাজ ঐ স্ট্যান্ডের সঙ্গেই হাঁটাচলা করতে থাকে, অভিবাদন এবং কুশল বিনিময় চলতেই থাকে, তারা একে অপরের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করে এবং আলিঙ্গন করে, এতে স্ট্যান্ডে ওঠার সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিচে নড়াচড়া হচ্ছে। লোকজন একে অন্যকে দেখায়, রাজকুমারী ল্যাতেসিয়া স্যাভেইয়া বোনাপার্ট, বোর্গেসের রাজকন্যা, একজন বয়স্ক নারী যার মুখের চামড়া গাঢ় হলুদ আঙুরের মতো; কাউন্টেস মোরোসিনি। মারচেলো বোর্গেস সকল নারীদের সমান তালে সেবা করে চলেছেন, কোনো বিশেষ কাউকে নয়, দূর থেকে তিনি সহজ-সরল চেহারায় সামনে এলেন, কিন্তু কাছ থেকে দেখা গেল, যেভাবে তিনি তার মুখের দুই কোন গালের দিকে চেপে আছেন তা যথেষ্ট অদ্ভুত। গ্যাব্রিয়েলে ডি আনুনজিও, খোটোখাটো পলকা চেহারার কাউন্ট অলদোফ্রেদির সামনে যে ভঙ্গিতে নাচানাচি করলেন তা লজ্জাজনক, কমিটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন কাউন্ট অলদোফ্রেদি।
স্ট্যান্ডের উপর দিয়ে তাকালে পুচিনির শক্তিশালী মুখটা দেখা যায়, এমন একটা নাক, যে নাক একজন মদ্যপের।
কিন্তু এই লোকগুলোকে যদি কেউ দেখতে চায় তাহলেই দেখে চিনে বের করতে পারবে, নয়তো ওখানে একজন ব্যক্তি শুধু এই চাকচিক্যই দেখতে পায়, সমকালীন ফ্যাশনদুরস্ত নারীদের চাকচিক্যের দীর্ঘায়িত ছায়ায় সব গুণী মুখ ঢেকে যায়।
এসকল নারীরা বসে থাকার চেয়ে হাঁটতে বেশি পছন্দ করে, তাদের পোশাক-আশাক বসার পক্ষে অসুবিধাজনক। সব মুখগুলো এশিয়ানদের মতো আচ্ছাদিত, একটি ম্লান গোধূলি বহন করছে। তাদের পোশাকগুলো উপরের অংশ ঢিলেঢালা, পিছন থেকে দেখলে মনে হবে অস্বস্তিকর, দ্বিধাগ্রস্ত; এই ধরনের নারীরা যখন দ্বিধাগ্রস্ত হন, তখন যে কী পরিমাণ মিশ্র ও বিরক্তিকর ধারণা তৈরি হয়! ব্লাউজগুলো লো কাট, কোনো মানুষ সহজে এটা ধরতে পারবে না; কোমর সাধারণের চেয়ে চওড়া মনে হচ্ছে কারণ অন্য সব কিছু এতো বেশি সরু, এসকল নারীরা ভালোবাসা-সহানুভূতি কামনা করেন।
এটা হলো লেব্ল্যাঙ্কের একমাত্র যন্ত্র যেটাকে এখন পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। কিন্তু এখন সেই যন্ত্রটি আসছে, যেটায় করে ব্লেরিও চ্যানেলটি অতিক্রম করেছে; কেউ এরকম বলেনি, প্রত্যেকেই এটা জানে বেশ লম্বা একটা বিরতি এবং ব্লেরিও আকাশের মধ্যে উড়তে উড়তে উঠে গেছে, কেউই তার শরীরের উর্ধ্বাংশ দেখতে পাচ্ছে না, শরীরটা পাখাগুলোর আড়ালে একেবারে সোজা হয়ে আছে, তার পাগুলো যন্ত্রাংশের মাঝে আড়াল হয়ে আছে। সূর্য ডুবে গেছে, স্ট্যান্ডের উপরে টানানো সামিয়ানার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে দুলতে থাকা ডানার উপর অস্তগামী কিরণ চমক দিচ্ছে। সকলে বিস্ময়াভিভূত আহ্লাদি চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল, কারুর মনের মধ্যেই অন্য কারোর জন্য অভিযোগ নেই। সে একটা ছোটো চক্কর কেটে ঘুরে এল এবং এরপর প্রায় খাড়াভাবে আমাদের মাথার অনেক উপরে দেখা দিল। এবং গলা বাড়িয়ে আমরা সকলে দেখতে পেলাম, কী করে একপাখার উড়োজাহাজটি উল্লাস করছে, কী করে এটার নিয়ন্ত্রণ ব্লেরিও ধরে আছে এবং লাফাচ্ছে এবং উপরে উঠে যাচ্ছে। এখানে কী ঘটছে? আমাদের মাথার উপরে, পৃথিবীর মাটি থেকে বিশ মিটার উপরে একটা মানুষ একটা কাঠের ফ্রেমের মধ্যে নিজেকে আটকে রেখে অদৃশ্য বিপদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে, যে বিপদকে সে নিজে স্বাধীনভাবে বরণ করেছে। কিন্তু আমরা নিচে দাঁড়িয়ে, অনেকটা পিছনে তুচ্ছ মানুষ এবং আমরা ঐ মানুষটাকে দেখছি।
এটার সবকিছু ভালোভাবেই কাটল। একই সময়ে সংকেত মাস্তুল দেখাল যে বাতাস এখন অনেক অনুকূলে এবং সেকারণে কার্টিস ব্রেশার গ্রান্ড প্রাইজের জন্য উড়ান দেবে। তো! সেও যাবে, শেষ পর্যন্ত? যখন কার্টিসের ইঞ্জিন গরগর করে শব্দ করছিল তখন আমরা এটা বুঝতেই পারিনি। তার সামনে যে প্লেনটা বিস্তৃত সমভূমির উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সেটার উপর দিয়ে উড়াল দিল, দূর থেকে জঙ্গলের দিকে, যে জঙ্গলকে দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র জঙ্গলটা বেড়ে উঠছে প্রথমবারের মতো। জঙ্গলের উপরে তার উড়ান যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে, সে জঙ্গলের মাথার উপর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, কার্টিসের দিকে নয়, আমরা গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ঘরগুলোর পিছন দিয়ে, খোদা জানেন কোথা থেকে আমাদের লক্ষ্যকে আহত করে, সে আগের মতো একই উচ্চতায় ফের আর্বিভূত হল; যখন সে উপরে উঠতে থাকল, যে কেউ দেখতে পাবে যে দুই পাখার বিমানটির নিচের অংশটির বর্হিভাগ অন্ধকারে ঢালু হয়ে আছে, যখন সে বিমানটার উপরের অংশ নীচে নামায়, বাইরের ভাগ সূর্যালোকে চমকায়। সে সংকেত মাস্তুলের চারপাশে ঘুরে আসে, এবং ফিরে যায়, তাকে শুভেচ্ছা জানাতে যে চিৎকার করা হলো তা কেউ লক্ষ্যই করল না। সোজা সেই জায়গায় যাওয়া হলো। সোজাসুজি সেই দিকে নিয়ে যাওয়া হলো যেখান থেকে সে এসেছিল, শুধু যে কারণে সে শিগগিরই দ্রুত, খুব দ্রুত ছোটো হয়ে এবং আবারও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। সে এরকম ৫ বার চক্কর দিয়ে এল, ৪৯ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে ৫০ কি.মি. উড়ে এল এবং এ দক্ষতা দেখাতে পারার কারণে কার্টিজ ব্রেশার গ্রান্ড প্রাইজ ৩০,০০০ লিরা জিতে নিল। এটা শেষ পর্যন্ত একটা পরিপূর্ণ অর্জন, কিন্তু পরিপূর্ণ অর্জনও প্রশংসা পায় না, প্রত্যেকেই শেষ পর্যন্ত নিজেকে নিখুঁত অর্জনের যোগ্য মনে করে, ভাবটা এমন যেন শ্রেষ্ঠ হবার জন্য কোনো সাহসের দরকারই নেই। যখন কার্টিস একাকী জঙ্গলের উপর উড়ে চলেছে, যখন তার স্ত্রী, এখন যাকে সকলে ভালোভাবে চিনেছে, তাঁর জন্য চিন্তিত ছিল, তখন জনতা কার্টিসকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। চারপাশ থেকে লোকজন এই অভিযোগ শুনতে থাকল যে ক্যালডেরারা আকাশে বিমান ওড়াচ্ছে না (তার যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে)। রুজিয়ের তার ভয়েসন উড়োজাহাজটি নিয়ে দু’দিন ধরে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেছে, কিন্তু তা উড়ছে না, ইতালির বায়ু বেলুন সেই জ্যোডিয়ারও এখন পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। ক্যালেডারার দুর্ঘটনার কারণে এখন সে মানুষের কাছে বেশি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, এবং তাকেই নিয়েই যত কাহিনি মানুষের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে, লোকজন এটা বিশ্বাস করে ফেলছে যে দেশের প্রতি ক্যালেডারার অনুরাগ হয়তো তাকে রাইটভাইদের যন্ত্রগুলোর চেয়েও বেশিরকম নিরাপদভাবে হাওয়ায় ওড়াবে।
কার্টিজ তার উড়ান শেষ করার আগেই, অন্য তিনটা হ্যাঙ্গারের মধ্যে থেকে বিমানগুলো আকাশের দিকে উড়ে গেছে, যেন এরা উৎসাহে টইটুম্বুর। বিপরীত দিক থেকে বাতাসে ধুলার ঘূর্ণি একসঙ্গে বয়ে এল। এতগুলো বিমানকে একসঙ্গে দেখার জন্য একজোড়া চোখ যথেষ্ট নয়। তুমি বুঝতে পেরেছো এবং তোমার সিটের উপর উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছো, টলমল করে পড়তে পড়তে অন্য কাউকে ধরে থাক, তুমি বল যে তুমি দুঃখিত, অন্য কেউ টলমল করে পড়ে যেতে চায়, তোমায় টেনে তোলে, তুমি ধন্যবাদ গ্রহণ কর। ইতালীয় শরৎকালের শুরুতে সন্ধ্যার সময়, এটা সম্ভব নয় যে মাঠের অনেক উপরে সবকিছু সুস্পষ্ট দেখা যাবে।
ঠিক যেমন কার্টিস তার বিজয়ী ফ্লাইটের পরে চলে যায় এবং আমাদের দিকে না তাকিয়েই একটা ম্লান হাসি দিয়ে তার টুপি তুলে ধরে, ব্লেরিও এরমধ্যেই একটা সংক্ষিপ্ত বৃত্তাকার উড়ান শুরু করেছে, সবাই আগে থেকেই জানে যে সে উড়োজাহাজ উড়াতে পারে! কোনো লোক একথা কমই জানবে যে যদি কেউ কার্টিস অথবা ব্লেরিওকে সাধুবাদ জানায়, অথবা যদি রজিয়েরকে জানায় ঐ সময়ে যার নিরেট ভারী মেশিন এখন নিজেই আকাশে চলছে। রজিয়ের তার চালকের সিটে এমনভাবে বসে আসে যেন সে তার লেখার টেবিলে বসে আছে, পিছন থেকে ছোট্ট একটা মই দিয়ে তার কাছে অনায়াসে পৌঁছানো যায়। সে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে আরও উপরে উঠতে থাকল, ব্লেরিওর ও অনেক উপরে, ব্লেরিওকে বিস্ময়ে হতবাক দর্শক বানিয়ে দিল এবং উপরে উঠতেই থাকল।
আমাদের যদি ফেরার জন্য একটা ট্যাক্সি পেতে হয় আমাদের এখনই এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে; আমাদের সামনেই বহু মানুষ হট্টগোল করছে। সবাই জানে এটা শুধুমাত্র একটা পরীক্ষামূলক বিমান চালনা। যেহেতু এর মধ্যে ৭টা বেজে গেছে এখন এটা আর প্রতিযোগিতার হিসেব হবে না। বিমান ঘাঁটির মোটর-গাড়ি পার্কিং এলাকার প্রবেশ পথে গাড়ির শোফার এবং খিদমতগাররা সিটের উপর দাঁড়িয়ে রজিয়েরের দিকে দেখাচ্ছিল; বিমান ঘাঁটির বাইরে ঘোড়ার গাড়ির চালকরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাড়া গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে রজিয়েরের গাড়ির দিকে ইশারা করছে।
আমাদের ভাগ্য ভালো যে একটা ট্যাক্সি ক্যাব পেয়েছি, ক্যাব চালক আমাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে, গাড়িতে কোনো কোচ-বক্স নেই, এবং শেষ পর্যন্ত আরো একবার স্বাধীন মানুষ হয়ে উঠি, আমরা গাড়ি চালিয়ে চলে যাই। ম্যাক্স খুব যুক্তিসঙ্গত মন্তব্য করেছে যে প্রাগেও এরকম কিছু আয়োজন করা যেতে পারে এবং আয়োজন করাও উচিত। ও বলল, প্রতিযোগিতাটা যে বিমান উড়ানের প্রতিযোগিতা হতে হবে এমন নয়, যদিও এটাও সফল হবে, কিন্তু একজন বৈমানিককে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে, এ কাজটা যথেষ্ট সহজ হবে এবং কেউ এতে টেনশন করে অনুশোচনা করবে না, পুরো বিষয়টাই সাধারণভাবে হবে; রাইট এখন বার্লিনে প্লেন ওড়াচ্ছে, শীঘ্রই ব্লেরিও ভিয়েনায় প্লেন ওড়াবে, ল্যাথাম বার্লিনে। তাই এই পাইলটদের একটু প্লেন নিয়ে চক্কর দিয়ে যেতে রাজি করাতে হবে। ম্যাক্সের কথার জবাবে আমরা বাকি দু’বন্ধু কোনো জবাব দিলাম না, প্রথমত, আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত এবং দ্বিতীয়ত আমাদের কোনো অভিযোগ নেই এ বিষয়ে। আমাদের রাস্তা ঘুরল এবং রজিয়েরকে আকাশের উঁচুতে দেখা গেল, এতো উঁচুতে, মনে হয় যেন তার স্থান শুধু নক্ষত্রদের পাশেই হতে পারে, রজিয়েরের বিমান অন্ধকারের মধ্যেও এখনো দেখা যাচ্ছে। আমরা রাস্তার বাঁক ঘুরতেই থাকলাম; রজিয়ের এখনো উঁচুতে চড়ছে, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে, আমরা চূড়ান্ত আত্মপ্রচারের অভিযানের আরও গভীরে ঝাঁপিয়ে পড়ছি। (সমাপ্ত)
ফ্রান্ৎস কাফকা গল্প
অনুবাদ : বিপাশা মন্ডল
বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কাঠের রেলিংয়ের একটা জায়গায় প্রচুর লোকজন জড়ো হয়েছে। ‘কী ছোটো!’ একদল ফরাসি চিৎকার করে উঠল, মনে হলো যেন তারা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে। কী হতে পারে? আমরা এগিয়ে গেলাম। এবং সেখানে মাঠের বেশ কাছে, অভিনবভাবে, একটা ছোটো উড়োজাহাজ দাঁড়িয়ে ছিল, সত্যিকারের হলুদ রঙ করা, ওটা ওড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এখন আমরা ব্লেরিওর হ্যাঙ্গার দেখতে পেলাম, হ্যাঙ্গারের পাশে তার শিক্ষানবিশ লেবেল্যাঙ্ক; উড়োজাহাজগুলো মাঠের মধ্যেই সেট করা হয়েছে। দুইটা পাখার একটায় ভর দিয়ে মেশিনটা দাঁড় করানো, সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায়, ব্লেরিও একচোখ বন্ধ করে মাথাটাকে দৃঢ়ভাবে ঘাড়ের উপর রেখে তার বিমানের কর্মরত ইঞ্জিনের মেরামতকারীদের উপরে নজর রাখছে।
সে কী এই তুচ্ছ জিনিসটা নিয়ে হাওয়ায় উড়তে চাইছে? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মানুষের জন্য একাজটাই জলের উপরে করা কতো সহজ। প্রথমে তারা হাঁটুজল ছোটো ডোবায় প্র্যাকটিস করে, এরপর পুকুরে, এরপর নদীতে, এবং এর অনেক পরে, তারা সমুদ্রে নেমে সাহসিকতা দেখায়; এই লোকগুলোর জন্য এই হাওয়ায় উড়োজাহাজ উড়ানোর প্রতিযোগিতা তো সমুদ্রের সমান।
ব্লেরিও এর মধ্যে তার সিটে বসে পড়েছে; হাত দিয়ে কোনো লিভার অথবা সে জাতীয় কিছু ধরে আছে, কিন্তু এখনো সে মেকানিকদের কাজ করে যেতে দিল, যেন তারা অতি উৎসাহী বাচ্চা-কাচ্চা। সে ধীর গতিতে আমাদের দিকে তাকাল, আমাদের থেকে চোখ সরিয়ে আবার অন্যদিকে চোখ ঘোরাল, কিন্তু সে সবসময় আসলে নিজের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। এখন সে উড়ান দিতে যাচ্ছে, পৃথিবীর অন্য কোনো কিছু এতো স্বাভাবিক হতে পারে না। এটার সঙ্গে স্বাভাবিকত্বের এই যে অনুভূতি, যুগপৎ চারপাশের অনন্যতার সাধারণ অনুভূতি, যেটা থেকে সে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারে না, এটা তাকে একই সঙ্গে সাধারণ ও অসাধারণত্বের অনুভূতি দেয়।
একজন সহকারী একটা প্রপেলারের ব্লেড নিয়ে সেটাকে ঠিকভাবে জুড়ে দিতে যায়, সে ওটাকে ধরে টান দেয় এবং একটা ঝাঁকুনি দেয়, যে কেউ শুনলে মনে করবে কোনো শক্তিশালী লোক তার ঘুমের মধ্যে হাঁপাচ্ছে; কিন্তু প্রপেলারটির মধ্যে জীবনের কোনো চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় না। সে আবার চেষ্টা করে, সে আরো দশবার চেষ্টা করে, কখনো প্রপেলারটি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়, কখনো কয়েকবার ঘোরার কষ্ট স্বীকার করে। সমস্যা আছে এঞ্জিনে। আবার গোড়া থেকে কাজ শুরু করা হয়, এইমাত্র যারা কাজ করল তাদের চেয়ে বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে দর্শকরা। ইঞ্জিনটাকে প্রতি কোণ থেকে তেলমাখানো হলো; লুকানো স্ক্রুগুলো ঢিলা করা হলো এবং টাইটও দেয়া হলো; একটা লোক হ্যাঙ্গারের মধ্যে ঢুকে পড়ল, অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ নিয়ে এল; এরপর ওটা আর ফিট হলো না; সে আবার দৌড়ে ফিরে যায়, এবং হ্যাঙ্গারের মেঝেতে বসে সে তার হাঁটুর মাঝখানে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। ব্লেরিও একজন মেরামতকারীর সঙ্গে নিজের সিট বদলে দেয়, মেরামতকারী সিট বদলে নেয় লেব্ল্যাঙ্কের সঙ্গে। এখন একটা লোক প্রপেলার ধরে টান দেয়, এরপর আরো একজন। কিন্তু ইঞ্জিন নির্দয়; একজন স্কুল ছাত্রের মতো যাকে সবসময় সাহায্য করতে হয়, পুরো ক্লাস তাকে পিছন থেকে বলে দিয়ে সাহায্য করে, না, সে পারবে না, বার বার সে আটকে যায়, বার বার সে একই স্থানে আটকে যায় এরপর হাল ছেড়ে দেয়। এক মুহূর্তের জন্য ব্লেরিও নিজের সিটে শান্ত স্থির হয়ে বসেছিল; তার ছয়জন সহকারী একটুও নড়াচড়া না করে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল; এসব দৃশ্য স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।
এবার দর্শকরা এক মুহূর্তের জন্য সহজভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারল এবং তাদের চারদিকে তাকাল। মায়ের মমতামাখা তরুণী স্ত্রী ব্লেরিওর, পাশ থেকে এগিয়ে আসে, দুটো বাচ্চা তার পিছনে। যদি তার স্বামী উড়তে না পারে, সেটা তার জন্য ভালো হবে না, আবার যদি তার স্বামী উড়ান দিতে পারে, সে ভয় পাবে; এছাড়া তার সুন্দর পোশাকটা এই আবহাওয়ার তুলনায় কিছুটা ভারিও বটে।
আরও একবার প্রপেলারটা ঘুরে গেল, হতে পারে আগের চেয়ে ভালোভাবে অথবা খারাপভাবে; ইঞ্জিনটা একটা গর্জন করে চলতে শুরু করল, যেন এটা অন্য কোনো ইঞ্জিন; চারজন মানুষ পিছন থেকে যন্ত্রটাকে ধরে আছে, এবং চারদিকের নীরবতার ভিতর ঘুরতে থাকা প্রপেলারের তৈরি ঝোড়ো হাওয়া যেন এই লোকগুলোর পোশাকের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কোনো লোকই এখানে কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছে না, মনে হয় যেন প্রপেলারের শব্দই এখানে নির্দেশনা দিচ্ছে; আটটি হাত যন্ত্রটাকে ছেড়ে দিচ্ছে, যন্ত্রটা দীর্ঘ সময় ধরে একজন বেখাপ্পা নৃত্যশিল্পীর মতো নাচের ফ্লোরে ঢেউয়ের ভঙ্গিতে দৌড়াচ্ছে।
এরকম বহু উদ্যোগ তৈরি হয়েছে এবং এর সবগুলোই উদ্দেশ্যহীনভাবে শেষ হয়েছে। এদের প্রত্যেকের প্রদর্শনী উত্তেজনায় জনসাধারণকে তাদের বসা থেকে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য করেছে, খড়ের ঢাকনার আসনে, যে আসনে একজন লোক হাত-পা ছড়িয়ে ভারসাম্য রাখতে পারে এবং একই সঙ্গে এই অভিব্যক্তি এগুলোকে একজন ব্যক্তির আশা, উদ্বিগ্নতা এবং আনন্দের প্রকাশ হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু এধরনের অঙ্গভঙ্গী প্রকাশের সময়ে ইতালিয়ান সম্ভ্রান্তদের অভিজাত সমাজ ঐ স্ট্যান্ডের সঙ্গেই হাঁটাচলা করতে থাকে, অভিবাদন এবং কুশল বিনিময় চলতেই থাকে, তারা একে অপরের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করে এবং আলিঙ্গন করে, এতে স্ট্যান্ডে ওঠার সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিচে নড়াচড়া হচ্ছে। লোকজন একে অন্যকে দেখায়, রাজকুমারী ল্যাতেসিয়া স্যাভেইয়া বোনাপার্ট, বোর্গেসের রাজকন্যা, একজন বয়স্ক নারী যার মুখের চামড়া গাঢ় হলুদ আঙুরের মতো; কাউন্টেস মোরোসিনি। মারচেলো বোর্গেস সকল নারীদের সমান তালে সেবা করে চলেছেন, কোনো বিশেষ কাউকে নয়, দূর থেকে তিনি সহজ-সরল চেহারায় সামনে এলেন, কিন্তু কাছ থেকে দেখা গেল, যেভাবে তিনি তার মুখের দুই কোন গালের দিকে চেপে আছেন তা যথেষ্ট অদ্ভুত। গ্যাব্রিয়েলে ডি আনুনজিও, খোটোখাটো পলকা চেহারার কাউন্ট অলদোফ্রেদির সামনে যে ভঙ্গিতে নাচানাচি করলেন তা লজ্জাজনক, কমিটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন কাউন্ট অলদোফ্রেদি।
স্ট্যান্ডের উপর দিয়ে তাকালে পুচিনির শক্তিশালী মুখটা দেখা যায়, এমন একটা নাক, যে নাক একজন মদ্যপের।
কিন্তু এই লোকগুলোকে যদি কেউ দেখতে চায় তাহলেই দেখে চিনে বের করতে পারবে, নয়তো ওখানে একজন ব্যক্তি শুধু এই চাকচিক্যই দেখতে পায়, সমকালীন ফ্যাশনদুরস্ত নারীদের চাকচিক্যের দীর্ঘায়িত ছায়ায় সব গুণী মুখ ঢেকে যায়।
এসকল নারীরা বসে থাকার চেয়ে হাঁটতে বেশি পছন্দ করে, তাদের পোশাক-আশাক বসার পক্ষে অসুবিধাজনক। সব মুখগুলো এশিয়ানদের মতো আচ্ছাদিত, একটি ম্লান গোধূলি বহন করছে। তাদের পোশাকগুলো উপরের অংশ ঢিলেঢালা, পিছন থেকে দেখলে মনে হবে অস্বস্তিকর, দ্বিধাগ্রস্ত; এই ধরনের নারীরা যখন দ্বিধাগ্রস্ত হন, তখন যে কী পরিমাণ মিশ্র ও বিরক্তিকর ধারণা তৈরি হয়! ব্লাউজগুলো লো কাট, কোনো মানুষ সহজে এটা ধরতে পারবে না; কোমর সাধারণের চেয়ে চওড়া মনে হচ্ছে কারণ অন্য সব কিছু এতো বেশি সরু, এসকল নারীরা ভালোবাসা-সহানুভূতি কামনা করেন।
এটা হলো লেব্ল্যাঙ্কের একমাত্র যন্ত্র যেটাকে এখন পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। কিন্তু এখন সেই যন্ত্রটি আসছে, যেটায় করে ব্লেরিও চ্যানেলটি অতিক্রম করেছে; কেউ এরকম বলেনি, প্রত্যেকেই এটা জানে বেশ লম্বা একটা বিরতি এবং ব্লেরিও আকাশের মধ্যে উড়তে উড়তে উঠে গেছে, কেউই তার শরীরের উর্ধ্বাংশ দেখতে পাচ্ছে না, শরীরটা পাখাগুলোর আড়ালে একেবারে সোজা হয়ে আছে, তার পাগুলো যন্ত্রাংশের মাঝে আড়াল হয়ে আছে। সূর্য ডুবে গেছে, স্ট্যান্ডের উপরে টানানো সামিয়ানার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে দুলতে থাকা ডানার উপর অস্তগামী কিরণ চমক দিচ্ছে। সকলে বিস্ময়াভিভূত আহ্লাদি চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল, কারুর মনের মধ্যেই অন্য কারোর জন্য অভিযোগ নেই। সে একটা ছোটো চক্কর কেটে ঘুরে এল এবং এরপর প্রায় খাড়াভাবে আমাদের মাথার অনেক উপরে দেখা দিল। এবং গলা বাড়িয়ে আমরা সকলে দেখতে পেলাম, কী করে একপাখার উড়োজাহাজটি উল্লাস করছে, কী করে এটার নিয়ন্ত্রণ ব্লেরিও ধরে আছে এবং লাফাচ্ছে এবং উপরে উঠে যাচ্ছে। এখানে কী ঘটছে? আমাদের মাথার উপরে, পৃথিবীর মাটি থেকে বিশ মিটার উপরে একটা মানুষ একটা কাঠের ফ্রেমের মধ্যে নিজেকে আটকে রেখে অদৃশ্য বিপদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে, যে বিপদকে সে নিজে স্বাধীনভাবে বরণ করেছে। কিন্তু আমরা নিচে দাঁড়িয়ে, অনেকটা পিছনে তুচ্ছ মানুষ এবং আমরা ঐ মানুষটাকে দেখছি।
এটার সবকিছু ভালোভাবেই কাটল। একই সময়ে সংকেত মাস্তুল দেখাল যে বাতাস এখন অনেক অনুকূলে এবং সেকারণে কার্টিস ব্রেশার গ্রান্ড প্রাইজের জন্য উড়ান দেবে। তো! সেও যাবে, শেষ পর্যন্ত? যখন কার্টিসের ইঞ্জিন গরগর করে শব্দ করছিল তখন আমরা এটা বুঝতেই পারিনি। তার সামনে যে প্লেনটা বিস্তৃত সমভূমির উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সেটার উপর দিয়ে উড়াল দিল, দূর থেকে জঙ্গলের দিকে, যে জঙ্গলকে দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র জঙ্গলটা বেড়ে উঠছে প্রথমবারের মতো। জঙ্গলের উপরে তার উড়ান যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে, সে জঙ্গলের মাথার উপর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, কার্টিসের দিকে নয়, আমরা গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ঘরগুলোর পিছন দিয়ে, খোদা জানেন কোথা থেকে আমাদের লক্ষ্যকে আহত করে, সে আগের মতো একই উচ্চতায় ফের আর্বিভূত হল; যখন সে উপরে উঠতে থাকল, যে কেউ দেখতে পাবে যে দুই পাখার বিমানটির নিচের অংশটির বর্হিভাগ অন্ধকারে ঢালু হয়ে আছে, যখন সে বিমানটার উপরের অংশ নীচে নামায়, বাইরের ভাগ সূর্যালোকে চমকায়। সে সংকেত মাস্তুলের চারপাশে ঘুরে আসে, এবং ফিরে যায়, তাকে শুভেচ্ছা জানাতে যে চিৎকার করা হলো তা কেউ লক্ষ্যই করল না। সোজা সেই জায়গায় যাওয়া হলো। সোজাসুজি সেই দিকে নিয়ে যাওয়া হলো যেখান থেকে সে এসেছিল, শুধু যে কারণে সে শিগগিরই দ্রুত, খুব দ্রুত ছোটো হয়ে এবং আবারও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। সে এরকম ৫ বার চক্কর দিয়ে এল, ৪৯ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে ৫০ কি.মি. উড়ে এল এবং এ দক্ষতা দেখাতে পারার কারণে কার্টিজ ব্রেশার গ্রান্ড প্রাইজ ৩০,০০০ লিরা জিতে নিল। এটা শেষ পর্যন্ত একটা পরিপূর্ণ অর্জন, কিন্তু পরিপূর্ণ অর্জনও প্রশংসা পায় না, প্রত্যেকেই শেষ পর্যন্ত নিজেকে নিখুঁত অর্জনের যোগ্য মনে করে, ভাবটা এমন যেন শ্রেষ্ঠ হবার জন্য কোনো সাহসের দরকারই নেই। যখন কার্টিস একাকী জঙ্গলের উপর উড়ে চলেছে, যখন তার স্ত্রী, এখন যাকে সকলে ভালোভাবে চিনেছে, তাঁর জন্য চিন্তিত ছিল, তখন জনতা কার্টিসকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। চারপাশ থেকে লোকজন এই অভিযোগ শুনতে থাকল যে ক্যালডেরারা আকাশে বিমান ওড়াচ্ছে না (তার যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে)। রুজিয়ের তার ভয়েসন উড়োজাহাজটি নিয়ে দু’দিন ধরে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেছে, কিন্তু তা উড়ছে না, ইতালির বায়ু বেলুন সেই জ্যোডিয়ারও এখন পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। ক্যালেডারার দুর্ঘটনার কারণে এখন সে মানুষের কাছে বেশি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, এবং তাকেই নিয়েই যত কাহিনি মানুষের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে, লোকজন এটা বিশ্বাস করে ফেলছে যে দেশের প্রতি ক্যালেডারার অনুরাগ হয়তো তাকে রাইটভাইদের যন্ত্রগুলোর চেয়েও বেশিরকম নিরাপদভাবে হাওয়ায় ওড়াবে।
কার্টিজ তার উড়ান শেষ করার আগেই, অন্য তিনটা হ্যাঙ্গারের মধ্যে থেকে বিমানগুলো আকাশের দিকে উড়ে গেছে, যেন এরা উৎসাহে টইটুম্বুর। বিপরীত দিক থেকে বাতাসে ধুলার ঘূর্ণি একসঙ্গে বয়ে এল। এতগুলো বিমানকে একসঙ্গে দেখার জন্য একজোড়া চোখ যথেষ্ট নয়। তুমি বুঝতে পেরেছো এবং তোমার সিটের উপর উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছো, টলমল করে পড়তে পড়তে অন্য কাউকে ধরে থাক, তুমি বল যে তুমি দুঃখিত, অন্য কেউ টলমল করে পড়ে যেতে চায়, তোমায় টেনে তোলে, তুমি ধন্যবাদ গ্রহণ কর। ইতালীয় শরৎকালের শুরুতে সন্ধ্যার সময়, এটা সম্ভব নয় যে মাঠের অনেক উপরে সবকিছু সুস্পষ্ট দেখা যাবে।
ঠিক যেমন কার্টিস তার বিজয়ী ফ্লাইটের পরে চলে যায় এবং আমাদের দিকে না তাকিয়েই একটা ম্লান হাসি দিয়ে তার টুপি তুলে ধরে, ব্লেরিও এরমধ্যেই একটা সংক্ষিপ্ত বৃত্তাকার উড়ান শুরু করেছে, সবাই আগে থেকেই জানে যে সে উড়োজাহাজ উড়াতে পারে! কোনো লোক একথা কমই জানবে যে যদি কেউ কার্টিস অথবা ব্লেরিওকে সাধুবাদ জানায়, অথবা যদি রজিয়েরকে জানায় ঐ সময়ে যার নিরেট ভারী মেশিন এখন নিজেই আকাশে চলছে। রজিয়ের তার চালকের সিটে এমনভাবে বসে আসে যেন সে তার লেখার টেবিলে বসে আছে, পিছন থেকে ছোট্ট একটা মই দিয়ে তার কাছে অনায়াসে পৌঁছানো যায়। সে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে আরও উপরে উঠতে থাকল, ব্লেরিওর ও অনেক উপরে, ব্লেরিওকে বিস্ময়ে হতবাক দর্শক বানিয়ে দিল এবং উপরে উঠতেই থাকল।
আমাদের যদি ফেরার জন্য একটা ট্যাক্সি পেতে হয় আমাদের এখনই এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে; আমাদের সামনেই বহু মানুষ হট্টগোল করছে। সবাই জানে এটা শুধুমাত্র একটা পরীক্ষামূলক বিমান চালনা। যেহেতু এর মধ্যে ৭টা বেজে গেছে এখন এটা আর প্রতিযোগিতার হিসেব হবে না। বিমান ঘাঁটির মোটর-গাড়ি পার্কিং এলাকার প্রবেশ পথে গাড়ির শোফার এবং খিদমতগাররা সিটের উপর দাঁড়িয়ে রজিয়েরের দিকে দেখাচ্ছিল; বিমান ঘাঁটির বাইরে ঘোড়ার গাড়ির চালকরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাড়া গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে রজিয়েরের গাড়ির দিকে ইশারা করছে।
আমাদের ভাগ্য ভালো যে একটা ট্যাক্সি ক্যাব পেয়েছি, ক্যাব চালক আমাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে, গাড়িতে কোনো কোচ-বক্স নেই, এবং শেষ পর্যন্ত আরো একবার স্বাধীন মানুষ হয়ে উঠি, আমরা গাড়ি চালিয়ে চলে যাই। ম্যাক্স খুব যুক্তিসঙ্গত মন্তব্য করেছে যে প্রাগেও এরকম কিছু আয়োজন করা যেতে পারে এবং আয়োজন করাও উচিত। ও বলল, প্রতিযোগিতাটা যে বিমান উড়ানের প্রতিযোগিতা হতে হবে এমন নয়, যদিও এটাও সফল হবে, কিন্তু একজন বৈমানিককে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে, এ কাজটা যথেষ্ট সহজ হবে এবং কেউ এতে টেনশন করে অনুশোচনা করবে না, পুরো বিষয়টাই সাধারণভাবে হবে; রাইট এখন বার্লিনে প্লেন ওড়াচ্ছে, শীঘ্রই ব্লেরিও ভিয়েনায় প্লেন ওড়াবে, ল্যাথাম বার্লিনে। তাই এই পাইলটদের একটু প্লেন নিয়ে চক্কর দিয়ে যেতে রাজি করাতে হবে। ম্যাক্সের কথার জবাবে আমরা বাকি দু’বন্ধু কোনো জবাব দিলাম না, প্রথমত, আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত এবং দ্বিতীয়ত আমাদের কোনো অভিযোগ নেই এ বিষয়ে। আমাদের রাস্তা ঘুরল এবং রজিয়েরকে আকাশের উঁচুতে দেখা গেল, এতো উঁচুতে, মনে হয় যেন তার স্থান শুধু নক্ষত্রদের পাশেই হতে পারে, রজিয়েরের বিমান অন্ধকারের মধ্যেও এখনো দেখা যাচ্ছে। আমরা রাস্তার বাঁক ঘুরতেই থাকলাম; রজিয়ের এখনো উঁচুতে চড়ছে, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে, আমরা চূড়ান্ত আত্মপ্রচারের অভিযানের আরও গভীরে ঝাঁপিয়ে পড়ছি। (সমাপ্ত)