alt

সাময়িকী

নিরন্তর প্রতিবাদী ও আত্মপ্রতিশ্রুত কবি শঙ্খ ঘোষ

গৌতম গুহ রায়

: বৃহস্পতিবার, ০৩ জুন ২০২১

“তুমি দিয়েছিলে ভার, আমি তাই নির্জন রাখাল।

তুমি দিয়েছিলে ভার, আমি তাই এমন সকালসন্ধ্যা

আজানু বসেছি এই উদাসীন মর্যাদায়

চেয়ে আছি নিঃস্ব চোখে চোখে। ...”

যখন বহু খণ্ডিত বাঙলা ও বঙ্গ সংস্কৃতি, সামাজিক বুননের উপর বহুমুখী আঘাত নেমে আসছে সেই সময়কে আরো দুঃসময় করে দিয়ে চলে গেলেন শঙ্খ ঘোষ। বাংলার বিবেকী স্বর স্তব্ধ হয়ে গেলো। মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখানো কবি যখন অন্তিম শ্বাস নিলেন তখন তাঁর বয়সের হিসাবে প্রায় নব্বই। ২১শে এপ্রিল সকালে দুঃসংবাদটা একটা হিমশীতল শূন্যতা নিয়ে এলো সাহিত্যপ্রেমী ও সংবেদনশীল বাঙালির কাছে। আমাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমাজ আজ চূড়ান্ত বিপর্যয়ের সামনে। মানবতার দৈনন্দিন মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নিয়ে আরো অন্ধকারের দিকে এই মৃত্যু যাত্রা আমাদের। এই সময় আমাদের অন্যতম প্রধান ছায়াবৃক্ষটিও অন্তর্হিত হলো। ধ্বংসের প্রান্তরে বসে যার উচ্চারণে ছিল জীবন মন্ত্র, “কিছুই কোথাও যদি নেই / তবু তো কজন আছি বাকি / আয় আরো হাতে হাত রেখে / আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি”।

কবিতায়, প্রবন্ধে, রবীন্দ্রনাথকে পুনঃপুন আবিষ্কারে, প্রত্যক্ষ সামাজিক সক্রিয়তায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রায় নয় দশকের যাপিত জীবনের গোটাটাই তাঁর আমাদের সামনে উদাহরণ, স্থিতধী এক ‘চির প্রণম্য অগ্নি’। ১৩৫৯-এর ১৫ ফাল্গুন শান্তিনেকেতনে আয়োজিত এক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “গত পাঁচ বছরের বাংলা কবিতার আঙ্গিকের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য যদি কিছু হয়ে থাকে, তা হলো লৌকিকতার স্পর্শ”। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। পুরাণকে, আদি আখ্যানকে বারংবার পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে সঞ্জীবনী জিজ্ঞাসা রেখে গেছেন অনুকরণীয় শিক্ষক শঙ্খ ঘোষ। ‘জাবাল-সত্যকাম’-এর নির্জন রাখাল সত্যকামের মুখ দিয়ে আমাদের, সমসময়ের পাঠকের সামনে তিনি রাখেন সেই অমোঘ প্রশ্নটি, ‘কী আমার পরিচয় মা?” এই মা তাঁর ধরিত্রী, এই নির্জনতা তাঁর অভীষ্ট সাধনধাম যার কেন্দ্রে রয়েছে একটি ধ্রুব শব্দ ‘সত্য’। এই সত্য বারেবারে তাঁর লেখায়, কথায় এসেছে, যেমন নীরব অনুভবের সাধনার কথা এসেছে, ‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো শব্দহীন হও’। এই সত্যের একান্ত নীরবতার কাছে বিসর্জিত শঙ্খ ঘোষ তাই ঊননব্বই বছরের যাপিত জীবনে রয়ে গেছেন শিরদাঁড়া সোজা রাখা এক আপসহীন প্রতীক মানুষ, ‘আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে লিপ্ত হওয়ার সন্যাস যাঁর’ তিনিই তো লিখতে পারেন ‘মজ্জার ভিতরে গর্ব কই, উপেক্ষা কই? মুখ ঘুরিয়ে উদাসীন সরে দাঁড়ানো কই? এখন আমরা দাম্ভিক কিন্তু গর্বিত নই, নির্জীব কিন্তু উদাসীন নই, লুপ্ত কিন্তু লিপ্ত নই।”

পরম সুহৃদ অশ্রুকুমার সিকদার বন্ধু শঙ্খকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন যে- একজন কবির নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায় একেবারে গোড়া থেকেই। আমাদের অস্তিত্বের একটা দিক আত্তীকতার কেন্দ্রে থাকে, অন্য একটা দিক থাকে বাইরে মুখ-ফেরানো। বিশ্বগত আর ব্যক্তিগত সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়, সমন্বিত হয়। সমগ্র সত্তার স্বরূপে তিনি দেখেন বিশ্বকে, সমগ্র সত্তার মধ্য দিয়েই জীবনকে পেতে চান শঙ্খ ঘোষ, তাই স্বার্থের স্থানীয় সমীকরণের গণ্ডি তাঁকে আক্রান্ত করে, ন্যুব্জ করতে পারে না। তিনি আত্মমন্থন জাত উচ্চারণে লিখতে পারেন- “ঘর যায় পথ যায় প্রিয় যায় পরিচিত যায় / সমস্ত মিলায় / এমন মুহূর্ত আসে যেন তুমি একা / দাঁড়িয়েছ মুহূর্তের টিলার উপরে, আর জল / সব ধারে ধাবমান জল / প্লাবন করেছে সত্তা ঘরহীন পথহীন প্রিয়হীন পরিচিতিহীন / আর, তুমি একা / এত ছোটো দুটি হাত স্তব্ধ করে ধরেছ করোটি / মহা সময়ের শূন্যতলে... ”। এই মহাসময়ে তাঁর প্রয়াণ তাই এক অসীম শূন্যতা এনে দিলো।

“ঘুমের মধ্যে হাত বাড়িয়ে রাখে কেবল দূরের

মাটি, আমার বিলীয়মান মাটি”

পূর্ববঙ্গের বরিশালের বানিয়াপাড়া থেকে দেশভাগের ক্ষত নিয়ে আরো অনেকের সঙ্গে তাঁর পূর্বপুরুষও চলে আসেন এই পশ্চিম বাংলায়। বাবা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, মা অমলা ঘোষ। ১৯৩২-এর ৫ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গের চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃত নাম ছিলো চিত্তপ্রিয় ঘোষ, ক্রমশ পরিচিত হয়ে ওঠেন শঙ্খ ঘোষ নামে। বাবার কর্মস্থল পাবনায় শৈশব ও কৈশর কাটে তাঁর। পাবনার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশান পাস করেন। পরবর্তীতে শিক্ষার জন্য, পেশার জন্য নগর কলকাতা তাঁর আবাস হলেও পূর্ববঙ্গ বা অবিভক্ত বাংলাদেশ তাঁর স্মৃতি ও সত্তায় জাগরিত ছিলো আজীবন। আত্মপ্রসঙ্গে তিনি তাই লিখেছেন যে, ‘এমন কবিতা কমই লিখেছি যার মধ্যে- শব্দে বা প্রতিমায়- বাংলাদেশ প্রচ্ছন্ন হয়ে নেই।... এ তো সত্যি যে মুহুর্মুহু আমি বেঁচে থাকি বাংলাদেশের মধ্যেই।’ ১৯৫১তে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কলা বিভাগে বাংলায় স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বাবার মতো তিনিও গোটা জীবন শিক্ষকতা করে যান। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। এই সময়কালে তাঁর রবীন্দ্র বিষয়ক চর্চা বিদগ্ধজনের চর্চায় আসে, তিনি একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পান। বাংলার আপামর সাহিত্যপ্রেমীর কাছে যদিও কবি পরিচয়েই শঙ্খ ঘোষ ক্রমশ মুখ্য হয়ে ওঠেন। কিন্তু ব্যক্তি মানুষ নয় তাঁর অন্বিষ্ট ছিলো মানবতার সমগ্রতায়, পরিপার্শ্বের প্রতি সংবেদনময় অবস্থান ছিলো তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও মুখ্য। এই কারণেই সমাজিক মানুষের উপর যখন কোনো আঘাত এসেছে তিনি সক্রিয় থেকেছেন প্রতিবাদে। সেই প্রতিবাদের উচ্চারণ পঞ্চাশের খাদ্য আন্দোলনের প্রতিবাদীদের উপর গুলি চালনার প্রতিবাদ থেকে সত্তরের আধা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিবাদ থেকে নন্দীগ্রাম বা কামদনি কা-, নীরব থাকেনি শঙ্খনাদ। তাঁর সংবেদনী ও যন্ত্রণাকাতর অন্তর থেকে উচ্চারিত হয় তিরস্কার, “... চুপ করো / শব্দহীন হও / শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর / লেখো আয়ু লেখো আয়ু” (আয়ু /মূর্খ বড় সামাজিক নয়)।

শঙ্খ ঘোষের অকৃত্রিম সাথী ছিলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। বন্ধুর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অলোকরঞ্জন লিখেছেন যে “সমীপসময়ের বিশ্বসাহিত্য ও দেশজ কবিতার কষ্টি পাথরে পরীক্ষিত যে সমস্ত শিল্পকৃতির উদাহরণ তিনি জুগিয়েছেন এবং সেই সূত্রে এই শতাব্দীর কাছে আমাদের ঋদ্দি-ঋণের যে অঙ্গীকার জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন, তা থেকে প্রতিপন্ন হয়, জীবন ও সাহিত্যের সমীকরণের ঐ দুই কিংবা অনুরূপ আরো জনকয়েক পুরোহিতের ব্যাসার্ধ থেকে অনেক দুরূহসাধ্য ক্ষণসাম্প্রতে তাঁর জাগর ঔৎসুক্যের ঠিকানা। এক হিসেবে তিনি ভারতীয় ও ইউরোপীয় সাহিত্য দর্পণে শীলিত মনষ্কতা দস্তুরমতো নেপথ্যে রেখে এভাবেই বেরিয়ে পড়েন কালান্তরের অমীমাংসিত আবর্তগুলির দিকে।” এখানেই সূচিত হয় কবির দ্বিতীয় প্রস্বর, এরই প্রথম স্বননে ‘প্রতিবাদ ও ভালোবাসা’ যেন এক বিন্দুতে মিলে যায় তাঁর কবিতায়।

শিল্পীর স্ববিবেক বাঁচিয়ে রাখার সংকল্পের বীজ তাঁর অন্তরে অঙ্কুরিত হয়েছিলো একেবারে গোড়ার দিকেই। সত্তরের ইন্দিরা জমানার জরুরি অবস্থা, নকশাল দমনের নামে রাষ্ট্র কতৃক নামিয়ে আনা দমনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদের উচ্চারণে দ্বিধা করেননি মৃদুভাষী শঙ্খ ঘোষ। শ্রেণীহীন শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন নিয়ে যখন এই বাংলার তারুণ্য নিজেদের বুকের হৃৎপি-টাকে উৎসর্গ করছে সেই সময় তাঁদের শিক্ষকের কলম নিশ্চুপ থাকতে পারে না, লেখেন- ‘তোমারই সেন্ট্রাল জেলে, / তোমারই কার্জন পার্কে।’

এভাবেই লিখে যান, ‘চিতা যখন জ্বলছে, আমার হৃৎকমলে / ধুম লেগেছে, ঘুম লেগেছে চরাচরে, পাপড়ি জ্বলে/ এই তো আমার / এই তো আমার জন্মভূমির আলোর কথা।’

শঙ্খ ঘোষের প্রিয় ছাত্রদের একজন তিমিরবরণ সিংহ। ‘কবিতার মুহূর্তে’তে লিখেছেন, ‘অনার্স ক্লাসে এসে ভর্তি হলো যখন, তরুণ লাবণ্যময় মুখ, উজ্জ্বল চোখ, নম্র আর লাজুক।... তারপর এক বছর বিদেশে কাটাবার পর যখন ফিরে এসেছি আবার আটষট্টিতে, তিমিরের মুখের রেখায় অনেক বদল হয়ে গেছে ততদিনে। কেবল তিমিরের নয়, অনেক যুবকেরই তখন পালটে গেছে আদল, অনেকেরই মনে হচ্ছে নকশালবাড়ির পথ দেশের মুক্তির পথ, সে-পথে মেতে উঠেছে অনেকের মতো তিমিরও।” এরপর একদিন বইয়ের একটি তালিকা নিয়ে ছাত্র আসে শিক্ষকের কাছে। ‘ফেরত পেতে দেরি হবে অনেক। এখন তো দেখা হবে না অনেকদিন।’ ‘অনেকদিন আর কোথায়? তোমাদের এম. এ. ক্লাস শুরু হতে খুব তো বেশি দেরি নেই আর।’ অল্প খানিকক্ষণ নিচু-মুখে বসে রইল তিমির, বলল তারপর- ‘কিন্তু এম. এ. পড়ছি না আমি। পড়ে কোনো লাভ নেই। কোনো লাভ নেই এইসব পড়াশোনায়। আপনি কি মনে করেন, না-পড়লে কোনো ক্ষতি আছে?... গ্রামে চলে যাচ্ছি আমি। কোথায় থাকব, কবে ফিরব, কিছুই ঠিক নেই। বইগুলো সঙ্গে থাকলে একটু সুবিধা হবে আমার।’ এই তিমির “কিন্তু ধরাও পড়ে একদিন। আর তারপর, আবার একদিন, কয়েকজন সহবন্দির সঙ্গে মিলিয়ে তাকে পিটিয়ে মারে পুলিশ। সে খবরও কানে এসে পৌঁছয়।” তিমিরের মতো আত্মবলিপ্রদত্ত ছাত্রদের ভুলতে পারেননি শিক্ষক শঙ্খ ঘোষ। লিখছেন, “কুয়াশাভরা সন্ধ্যায় ময়দানের কাছে গাড়ি বাঁক নিতেই দ্রুত ফুটে উঠলো কয়েকটা ছবি। এই সেই ময়দান, যেখানে ভোররাতে পুলিশের হাতে কত হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে অনায়াসে, পড়ে থেকেছে কত রক্তাক্ত শরীর। মনে পড়লো তিমিরকে। মনে পড়লো তাঁর মাকে, যাকে আমি দেখিইনি কখনো”। কবিতা লিখলেন তিনি-

“ময়দান ভারি হয়ে নামে কুয়াশায় / দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ / তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া? / নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই / তোমার ছিন্ন শির, তিমির।”

এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাননি বা মুক্তি চাননি কবি। এর অনেক দিন পরেও নিজের বাসার বারান্দা থেকে দেখতে থাকা বৃষ্টি ও বিদ্যুতের মধ্যেও ফিরে আসে তিমিরেরা।

“ইন্দ্র ধরেছে কুলিশ / চুরমার ফেটে যায় মেঘ, দশভাগে দশটানে বিদ্যুৎ / তারপর সব চুপ / এই তোমার মুখ, তিমির / কিন্তু তারপর সব চুপ”

দেশ ও রাজ্যের রাজনৈতিক চেহারাটা অনেক পালটে যাওয়ার পরেও শঙ্খ ঘোষ তাঁর চিন্তা চেতনা থেকে বিচ্যুত হন নি। ‘কলকাতা’ সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্তকে লেখা একটি চিঠির অবতারণা এই প্রসঙ্গে খুব প্রাসঙ্গিক। নব কলেবরে প্রকাশিত ‘কলকাতা দু-হাজার’ এর লেখক পরিচিতিতে দুঁদে পুলিশ অফিসার রঞ্জিত গুপ্ত-র পরিচিতিতে ব্যবহৃত বাক্যবন্ধের প্রতিবাদে সম্পাদক ‘প্রিয় জ্যোতি’কে চিঠি লেখেন তিনি। লেখক পরিচিতির পাতায় লেখা ছিল : ‘হ্যাঁ, এই সনেট-অনুবাদক রঞ্জিত গুপ্ত’ই হচ্ছেন সেই নকশাল-দমনকারী পুলিশ কমিশনার, পোলো ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, নৃতাত্ত্বিক, চাষী এবং ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট রঞ্জিত গুপ্ত আই পি।” শঙ্খ ঘোষ লিখলেন, “...ভাবনাটা আলোড়িত হলো পরিচয় জানাবার বিশেষ এই পদ্ধতিতে, বিশেষণের এই মর্মান্তিক নির্বাচনে, এই সগৌরব ঘোষণায় যে ইনিই সেই নকশাল-দমনকারী পুলিশ অফিসার।... অনুমান করি যে, এ-উল্লেখ আপনি বোঝাতে চেয়েছেন শুধু লেখকের বৈচিত্র্যটুকুই, এমন কী হয়তো আত্মবিরোধটাই, পোলো খেলা এবং নকশাল-দমনের এই চমকপদ সহাবস্থ্না, বিবরণে সম্পূর্ণতার গরজ ছাড়া ওখানে নিশ্চই আর কোনো রকম আতিরিক্ত অভিপ্রায় কাজ করেনি। অথচ এই কয়েকটি শব্দের প্রয়োগ যে মুহূর্তমধ্যে আমার মতো অনেক পাঠকের সামনে ঝাঁপ দিয়ে ওঠে এক বিষাক্ত ছোবল নিয়ে, সেকথাও সত্যি।... ওই ‘দমন’ শব্দটি শুনবার সঙ্গে সঙ্গে পনেরো বছরের পুরোনো ছবিগুলি আবার জেগে উঠতে থাকে আমাদের চোখের সামনে, জেগে ওঠে কত-না স্বজন বন্ধু ছাত্রছাত্রী অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের মুখ, আমার আপনার সকলেরই বেশ চেনাজানা, কিছু-বা সংকল্পে উজ্জ্বল, কিছু –বা নির্যাতনে বধির, যারা অনেকেই হয়তো বিভ্রান্ত ছিল সেদিন, কিন্তু যাঁদের আর্ত কল্পনার সামনে ছিল মস্ত এক সুস্থ দিনের স্বপ্ন।... সভ্যতা আর মানবতার এই শব্দদুটি যখন আজ পড়ি, তখন মনে পড়ে বেলেঘাটার কথা, বরানগরের কথা, দমদম আর বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলের অন্তর্গত নৃশংস আর অবাধ হত্যাকাণ্ডের কথা, মানবতাকেই যার প্রধান ভিত্তি বলে বিবেচনা করা শক্তই ছিল সেদিন। দমনের এই বিভীষিকাময় দিনগুলি কি আজও কিছু কিছু মনে পড়ে আপনার?” এটি নিছক এক বন্ধু সম্পাদকের কাছে এক কবির চেতনার অন্তর্গত যন্ত্রণার ভাষ্য নয়, সময়ের গভীর তত্ত্বতালাশ। “কী হয়েছিলো সেই দমন প্রক্রিয়া, সেটা ভাববার আগে লক্ষ করা দরকার এই বিশৃঙ্খলার চরিত্রটা। নকশালপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে, যে কোনো কৌশলেই হোক, মিশে গেল লুম্পেন প্রোলিটারিয়েটরা। আবার লুম্পেন প্রোলিটায়েটদেরই প্রয়োগ করা হলো এদের ধ্বংস করবারও কাজে, এর বিবরণ রঞ্জিত গুপ্ত নিজেই দিয়েছেন। কিন্তু তার বিবরণে তিনি স্পষ্টত বলেননি জেল বা জেলের বাইরে সেই রাজনৈতিক ছেলেমেয়েদের কথা, যারা লুম্পেন নয়, ওই ফাঁদে জড়িয়ে নিয়ে যাদের ওপর পুলিশি মত্ততা চলেছিল উৎকট হিংস্রতায়। উনিশশো সত্তর-এর জুলাই থেকে পুলিশ কমিশনার হন রঞ্জিত গুপ্ত, আর আমাদের মনে পড়ে সে-বছরেরই নভেম্বরের এক ভোররাতে, যখন বেলেঘাটার পাঁচশো বাড়িতে হানা দিয়ে চুয়াল্লিশটি পুলিশভ্যান টেনে বার করে কিছু স্কুলকলেজের ছাত্রকে, আর প্রমাণহীন বিচারহীনভাবে চারজনকে গুলি করে মেরে ফেলে সেখানেই, প্রকাশ্য অঞ্চলে। শ্যামপুকুর পার্কের কাছে চৌদ্দ বছর বয়সের টাইফয়েড আক্রান্ত একটি ছেলেকে পথে নিয়ে এসে দিনের আলোয় খুন করে পুলিশ, শ্যামপুকুর রোডে ডেপুটি কমিশনার নিজেরই হাতে গুলি করেন দুজনকে, বেলঘরিয়াতেও ঘটে একইরকম ঘটনা।... প্রতিটি মধ্যরাতে পুলিশ শ্মশানঘাটে নিয়ে আসে চৌদ্দ থেকে তিরিশ বছরের অন্তর্গত অসংখ্য যুবাকিশোরের দগ্ধ শরীর, ... অথবা ভাবুন একাত্তর সালের চব্বিশ ফেব্রুয়ারিতে বহরমপুর জেলের কথা। বেয়নেট আর লাঠি দিয়ে চারজনকে পিটিয়ে মারা হয় সেলের অভ্যন্তরে, তিনজনের মৃত্যু হয় হাসপাতালে পৌঁছে আরো একজন পরে। দমদম সেন্ট্রাল জেলে একইভাবে হত্যা করা হলো একদিন ষোলোটি ছেলেকে, আহত আরো অগণ্য। কিংবা ভাবুন বরানগরের-কাশীপুরের সেই হিংস্র আরণ্যক দিন দুটির কথা, বারো আর তেরই আগস্ট, যখন তালিকা চিহ্নিত করে দেড়শো ছাত্রকে খুন করা হলো বাড়ি বাড়ি ঘুরে, পথের মোড়ে লটকে দেওয়া হলো নাম, সকলের অভিজ্ঞতার সামনে, যেন প্রশাসনহীন জগতে।” ১৯৮৫তে লেখা এই চিঠিতে আমরা যে মানুষটিকে পাই সে গরল পানের স্মৃতিদগ্ধ ক্ষুব্ধ এক কবি, সামাজিক অবদমনের বিরুদ্ধে সমকালের প্রধান সংবেদনশীল ‘এক্টিভিস্ট’।

জরুরি অবস্থার সময় নিজের অবস্থানে অটুট থাকার জন্য খেসারত দিতে হয়েছিলো তাঁকে। ১৯৭৫-এ ১৮ মাস ব্যাপী জরুরি অবস্থার অন্ধকার সময়ে শুধু বিরোধী মত ও দলের মানুষদের অবরুদ্ধই করা হয় নি, বহু সংবাদপত্র, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করা হয়েছিলো। ব্যতিক্রম ঘটেনি শঙ্খ ঘোষের ক্ষেত্রেও। ‘দেশ’ সম্পাদক সাগরময় ঘোষ নিজে চেয়ে নিয়েছিলেন তাঁর কবিতা, কিন্তু ‘সরকারি নিষেধাজ্ঞায়’ ছাপতে পারেন নি! সাগরময় ঘোষ সসংকোচে তাঁকে অন্য লেখা দিতে বললেন। উত্তরে শঙ্খ ঘোষ বলেন, “অন্য কোনো কবিতা তো পারব না পাঠাতে। কেননা যা কিছু লিখছি এখন, তার সবটাই তো ও-রকম সরকারি হুকুম নিয়ে ফিরে আসতে পারে।” সেবার আর লেখা দেননি। ইন্দিরা শাহীর দাপট আক্রান্ত সেই সময়ে শঙ্খ বাবুর শর্ত ছিল অবিকৃতভাবেই তাঁর লেখা ছাপানোর সাহস দেখালেই সম্পাদককে লেখা দেবেন। এই শর্তে অনেক সম্পাদক পিছিয়ে এলেও বার্ণিক রায়, অরুণ সেনেরা এই শর্তেই লেখা ছাপেন। ‘লা পয়েজি’ ও ‘সাহিত্যপত্র’-এ ছাপা হয় ‘রাধাচূড়া’ ও ‘আপাত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে’।

জরুরি অবস্থার সময় রাষ্ট্র শাসকের রক্তচক্ষুকে কুর্নিশ না জানানো কবি শঙ্খ ঘোষেকে জড়িয়ে আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। একবার সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন দুরদর্শনে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের দিন আর অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে সেখানে ‘জন্মদিন-মৃত্যুদিন’ নামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। হঠাৎ অনুষ্ঠান পরিচলক শঙ্খ ঘোষকে জানান যে স্টেশান ডিরেক্টারের আপত্তিতে তাঁকে একটি লাইন পাল্টাতে হবে। লাইনটি হলো, ‘তখন ইন্দ্রের ভয়ে ঘরে কুলুপ দিয়েছেন ব্রহ্মা’। দর্শকের কানে যদি ‘ইন্দ্র’ শব্দটি ‘ইন্দিরা’ হয়ে প্রবেশ করে এই ভয়ে সেই শব্দটি পাল্টাতে বলা হয়। এমনই আরও অভিজ্ঞতা ছিলো তাঁর, একবার ‘আকাশবাণী’তে অনুষ্ঠান করছেন তিনি ও কবিতা সিংহ। সরকারি বেতার কর্তৃপক্ষ কবিতা সিংহর লেখা স্ক্রিপ্ট থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্প থেকে নেওয়া অংশ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। কিন্তু দৃঢ়ভাবে শঙ্খ ঘোষ এই অংশটি বাদ দেওয়ার বিরোধিতা করেন, বলেন যে বাদ দিলে গোটাটাই বাদ দিতে হবে। এই দৃঢ়তা সবাই সেই সময় দেখাতে পারেননি, যেটা শঙ্খ ঘোষ পেরেছিলেন। ‘কবিতার মুহূর্ত’তে লিখেছেন, “অপমান বোধ হয়। অপমান বোধ হয়, ভয় দেখিয়ে শাসন করবার এই লজ্জাহীন ফ্যাসিস্ট আয়োজন দেখে। স্ট্রেটেজি হিসাবে অনেকে চুপ থাকতে চান সত্যি, কিন্তু প্রতিবাদে এগিয়ে এসে পুলিশের কাছে তাড়িতও হন অনেকে গোটা দেশ জুড়ে। দিল্লির মসনদ কি জানে না যে প্রতিবাদীর এই সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলবে? অনিচ্ছুকের উপর চাপ দিয়ে খুব বেশিদিন যে বাঁচে না ক্ষমতা, ইতিহাস কি তাকে শেখায়নি এটা?” এই কথাগুলো চিরকালীন সত্য উচ্চারণ হয়ে থাকবে। (অসমাপ্ত)

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

নিরন্তর প্রতিবাদী ও আত্মপ্রতিশ্রুত কবি শঙ্খ ঘোষ

গৌতম গুহ রায়

বৃহস্পতিবার, ০৩ জুন ২০২১

“তুমি দিয়েছিলে ভার, আমি তাই নির্জন রাখাল।

তুমি দিয়েছিলে ভার, আমি তাই এমন সকালসন্ধ্যা

আজানু বসেছি এই উদাসীন মর্যাদায়

চেয়ে আছি নিঃস্ব চোখে চোখে। ...”

যখন বহু খণ্ডিত বাঙলা ও বঙ্গ সংস্কৃতি, সামাজিক বুননের উপর বহুমুখী আঘাত নেমে আসছে সেই সময়কে আরো দুঃসময় করে দিয়ে চলে গেলেন শঙ্খ ঘোষ। বাংলার বিবেকী স্বর স্তব্ধ হয়ে গেলো। মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখানো কবি যখন অন্তিম শ্বাস নিলেন তখন তাঁর বয়সের হিসাবে প্রায় নব্বই। ২১শে এপ্রিল সকালে দুঃসংবাদটা একটা হিমশীতল শূন্যতা নিয়ে এলো সাহিত্যপ্রেমী ও সংবেদনশীল বাঙালির কাছে। আমাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমাজ আজ চূড়ান্ত বিপর্যয়ের সামনে। মানবতার দৈনন্দিন মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নিয়ে আরো অন্ধকারের দিকে এই মৃত্যু যাত্রা আমাদের। এই সময় আমাদের অন্যতম প্রধান ছায়াবৃক্ষটিও অন্তর্হিত হলো। ধ্বংসের প্রান্তরে বসে যার উচ্চারণে ছিল জীবন মন্ত্র, “কিছুই কোথাও যদি নেই / তবু তো কজন আছি বাকি / আয় আরো হাতে হাত রেখে / আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি”।

কবিতায়, প্রবন্ধে, রবীন্দ্রনাথকে পুনঃপুন আবিষ্কারে, প্রত্যক্ষ সামাজিক সক্রিয়তায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রায় নয় দশকের যাপিত জীবনের গোটাটাই তাঁর আমাদের সামনে উদাহরণ, স্থিতধী এক ‘চির প্রণম্য অগ্নি’। ১৩৫৯-এর ১৫ ফাল্গুন শান্তিনেকেতনে আয়োজিত এক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “গত পাঁচ বছরের বাংলা কবিতার আঙ্গিকের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য যদি কিছু হয়ে থাকে, তা হলো লৌকিকতার স্পর্শ”। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। পুরাণকে, আদি আখ্যানকে বারংবার পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে সঞ্জীবনী জিজ্ঞাসা রেখে গেছেন অনুকরণীয় শিক্ষক শঙ্খ ঘোষ। ‘জাবাল-সত্যকাম’-এর নির্জন রাখাল সত্যকামের মুখ দিয়ে আমাদের, সমসময়ের পাঠকের সামনে তিনি রাখেন সেই অমোঘ প্রশ্নটি, ‘কী আমার পরিচয় মা?” এই মা তাঁর ধরিত্রী, এই নির্জনতা তাঁর অভীষ্ট সাধনধাম যার কেন্দ্রে রয়েছে একটি ধ্রুব শব্দ ‘সত্য’। এই সত্য বারেবারে তাঁর লেখায়, কথায় এসেছে, যেমন নীরব অনুভবের সাধনার কথা এসেছে, ‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো শব্দহীন হও’। এই সত্যের একান্ত নীরবতার কাছে বিসর্জিত শঙ্খ ঘোষ তাই ঊননব্বই বছরের যাপিত জীবনে রয়ে গেছেন শিরদাঁড়া সোজা রাখা এক আপসহীন প্রতীক মানুষ, ‘আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে লিপ্ত হওয়ার সন্যাস যাঁর’ তিনিই তো লিখতে পারেন ‘মজ্জার ভিতরে গর্ব কই, উপেক্ষা কই? মুখ ঘুরিয়ে উদাসীন সরে দাঁড়ানো কই? এখন আমরা দাম্ভিক কিন্তু গর্বিত নই, নির্জীব কিন্তু উদাসীন নই, লুপ্ত কিন্তু লিপ্ত নই।”

পরম সুহৃদ অশ্রুকুমার সিকদার বন্ধু শঙ্খকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন যে- একজন কবির নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায় একেবারে গোড়া থেকেই। আমাদের অস্তিত্বের একটা দিক আত্তীকতার কেন্দ্রে থাকে, অন্য একটা দিক থাকে বাইরে মুখ-ফেরানো। বিশ্বগত আর ব্যক্তিগত সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়, সমন্বিত হয়। সমগ্র সত্তার স্বরূপে তিনি দেখেন বিশ্বকে, সমগ্র সত্তার মধ্য দিয়েই জীবনকে পেতে চান শঙ্খ ঘোষ, তাই স্বার্থের স্থানীয় সমীকরণের গণ্ডি তাঁকে আক্রান্ত করে, ন্যুব্জ করতে পারে না। তিনি আত্মমন্থন জাত উচ্চারণে লিখতে পারেন- “ঘর যায় পথ যায় প্রিয় যায় পরিচিত যায় / সমস্ত মিলায় / এমন মুহূর্ত আসে যেন তুমি একা / দাঁড়িয়েছ মুহূর্তের টিলার উপরে, আর জল / সব ধারে ধাবমান জল / প্লাবন করেছে সত্তা ঘরহীন পথহীন প্রিয়হীন পরিচিতিহীন / আর, তুমি একা / এত ছোটো দুটি হাত স্তব্ধ করে ধরেছ করোটি / মহা সময়ের শূন্যতলে... ”। এই মহাসময়ে তাঁর প্রয়াণ তাই এক অসীম শূন্যতা এনে দিলো।

“ঘুমের মধ্যে হাত বাড়িয়ে রাখে কেবল দূরের

মাটি, আমার বিলীয়মান মাটি”

পূর্ববঙ্গের বরিশালের বানিয়াপাড়া থেকে দেশভাগের ক্ষত নিয়ে আরো অনেকের সঙ্গে তাঁর পূর্বপুরুষও চলে আসেন এই পশ্চিম বাংলায়। বাবা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, মা অমলা ঘোষ। ১৯৩২-এর ৫ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গের চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃত নাম ছিলো চিত্তপ্রিয় ঘোষ, ক্রমশ পরিচিত হয়ে ওঠেন শঙ্খ ঘোষ নামে। বাবার কর্মস্থল পাবনায় শৈশব ও কৈশর কাটে তাঁর। পাবনার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশান পাস করেন। পরবর্তীতে শিক্ষার জন্য, পেশার জন্য নগর কলকাতা তাঁর আবাস হলেও পূর্ববঙ্গ বা অবিভক্ত বাংলাদেশ তাঁর স্মৃতি ও সত্তায় জাগরিত ছিলো আজীবন। আত্মপ্রসঙ্গে তিনি তাই লিখেছেন যে, ‘এমন কবিতা কমই লিখেছি যার মধ্যে- শব্দে বা প্রতিমায়- বাংলাদেশ প্রচ্ছন্ন হয়ে নেই।... এ তো সত্যি যে মুহুর্মুহু আমি বেঁচে থাকি বাংলাদেশের মধ্যেই।’ ১৯৫১তে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কলা বিভাগে বাংলায় স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বাবার মতো তিনিও গোটা জীবন শিক্ষকতা করে যান। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। এই সময়কালে তাঁর রবীন্দ্র বিষয়ক চর্চা বিদগ্ধজনের চর্চায় আসে, তিনি একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পান। বাংলার আপামর সাহিত্যপ্রেমীর কাছে যদিও কবি পরিচয়েই শঙ্খ ঘোষ ক্রমশ মুখ্য হয়ে ওঠেন। কিন্তু ব্যক্তি মানুষ নয় তাঁর অন্বিষ্ট ছিলো মানবতার সমগ্রতায়, পরিপার্শ্বের প্রতি সংবেদনময় অবস্থান ছিলো তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও মুখ্য। এই কারণেই সমাজিক মানুষের উপর যখন কোনো আঘাত এসেছে তিনি সক্রিয় থেকেছেন প্রতিবাদে। সেই প্রতিবাদের উচ্চারণ পঞ্চাশের খাদ্য আন্দোলনের প্রতিবাদীদের উপর গুলি চালনার প্রতিবাদ থেকে সত্তরের আধা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিবাদ থেকে নন্দীগ্রাম বা কামদনি কা-, নীরব থাকেনি শঙ্খনাদ। তাঁর সংবেদনী ও যন্ত্রণাকাতর অন্তর থেকে উচ্চারিত হয় তিরস্কার, “... চুপ করো / শব্দহীন হও / শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর / লেখো আয়ু লেখো আয়ু” (আয়ু /মূর্খ বড় সামাজিক নয়)।

শঙ্খ ঘোষের অকৃত্রিম সাথী ছিলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। বন্ধুর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অলোকরঞ্জন লিখেছেন যে “সমীপসময়ের বিশ্বসাহিত্য ও দেশজ কবিতার কষ্টি পাথরে পরীক্ষিত যে সমস্ত শিল্পকৃতির উদাহরণ তিনি জুগিয়েছেন এবং সেই সূত্রে এই শতাব্দীর কাছে আমাদের ঋদ্দি-ঋণের যে অঙ্গীকার জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন, তা থেকে প্রতিপন্ন হয়, জীবন ও সাহিত্যের সমীকরণের ঐ দুই কিংবা অনুরূপ আরো জনকয়েক পুরোহিতের ব্যাসার্ধ থেকে অনেক দুরূহসাধ্য ক্ষণসাম্প্রতে তাঁর জাগর ঔৎসুক্যের ঠিকানা। এক হিসেবে তিনি ভারতীয় ও ইউরোপীয় সাহিত্য দর্পণে শীলিত মনষ্কতা দস্তুরমতো নেপথ্যে রেখে এভাবেই বেরিয়ে পড়েন কালান্তরের অমীমাংসিত আবর্তগুলির দিকে।” এখানেই সূচিত হয় কবির দ্বিতীয় প্রস্বর, এরই প্রথম স্বননে ‘প্রতিবাদ ও ভালোবাসা’ যেন এক বিন্দুতে মিলে যায় তাঁর কবিতায়।

শিল্পীর স্ববিবেক বাঁচিয়ে রাখার সংকল্পের বীজ তাঁর অন্তরে অঙ্কুরিত হয়েছিলো একেবারে গোড়ার দিকেই। সত্তরের ইন্দিরা জমানার জরুরি অবস্থা, নকশাল দমনের নামে রাষ্ট্র কতৃক নামিয়ে আনা দমনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদের উচ্চারণে দ্বিধা করেননি মৃদুভাষী শঙ্খ ঘোষ। শ্রেণীহীন শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন নিয়ে যখন এই বাংলার তারুণ্য নিজেদের বুকের হৃৎপি-টাকে উৎসর্গ করছে সেই সময় তাঁদের শিক্ষকের কলম নিশ্চুপ থাকতে পারে না, লেখেন- ‘তোমারই সেন্ট্রাল জেলে, / তোমারই কার্জন পার্কে।’

এভাবেই লিখে যান, ‘চিতা যখন জ্বলছে, আমার হৃৎকমলে / ধুম লেগেছে, ঘুম লেগেছে চরাচরে, পাপড়ি জ্বলে/ এই তো আমার / এই তো আমার জন্মভূমির আলোর কথা।’

শঙ্খ ঘোষের প্রিয় ছাত্রদের একজন তিমিরবরণ সিংহ। ‘কবিতার মুহূর্তে’তে লিখেছেন, ‘অনার্স ক্লাসে এসে ভর্তি হলো যখন, তরুণ লাবণ্যময় মুখ, উজ্জ্বল চোখ, নম্র আর লাজুক।... তারপর এক বছর বিদেশে কাটাবার পর যখন ফিরে এসেছি আবার আটষট্টিতে, তিমিরের মুখের রেখায় অনেক বদল হয়ে গেছে ততদিনে। কেবল তিমিরের নয়, অনেক যুবকেরই তখন পালটে গেছে আদল, অনেকেরই মনে হচ্ছে নকশালবাড়ির পথ দেশের মুক্তির পথ, সে-পথে মেতে উঠেছে অনেকের মতো তিমিরও।” এরপর একদিন বইয়ের একটি তালিকা নিয়ে ছাত্র আসে শিক্ষকের কাছে। ‘ফেরত পেতে দেরি হবে অনেক। এখন তো দেখা হবে না অনেকদিন।’ ‘অনেকদিন আর কোথায়? তোমাদের এম. এ. ক্লাস শুরু হতে খুব তো বেশি দেরি নেই আর।’ অল্প খানিকক্ষণ নিচু-মুখে বসে রইল তিমির, বলল তারপর- ‘কিন্তু এম. এ. পড়ছি না আমি। পড়ে কোনো লাভ নেই। কোনো লাভ নেই এইসব পড়াশোনায়। আপনি কি মনে করেন, না-পড়লে কোনো ক্ষতি আছে?... গ্রামে চলে যাচ্ছি আমি। কোথায় থাকব, কবে ফিরব, কিছুই ঠিক নেই। বইগুলো সঙ্গে থাকলে একটু সুবিধা হবে আমার।’ এই তিমির “কিন্তু ধরাও পড়ে একদিন। আর তারপর, আবার একদিন, কয়েকজন সহবন্দির সঙ্গে মিলিয়ে তাকে পিটিয়ে মারে পুলিশ। সে খবরও কানে এসে পৌঁছয়।” তিমিরের মতো আত্মবলিপ্রদত্ত ছাত্রদের ভুলতে পারেননি শিক্ষক শঙ্খ ঘোষ। লিখছেন, “কুয়াশাভরা সন্ধ্যায় ময়দানের কাছে গাড়ি বাঁক নিতেই দ্রুত ফুটে উঠলো কয়েকটা ছবি। এই সেই ময়দান, যেখানে ভোররাতে পুলিশের হাতে কত হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে অনায়াসে, পড়ে থেকেছে কত রক্তাক্ত শরীর। মনে পড়লো তিমিরকে। মনে পড়লো তাঁর মাকে, যাকে আমি দেখিইনি কখনো”। কবিতা লিখলেন তিনি-

“ময়দান ভারি হয়ে নামে কুয়াশায় / দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ / তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া? / নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই / তোমার ছিন্ন শির, তিমির।”

এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাননি বা মুক্তি চাননি কবি। এর অনেক দিন পরেও নিজের বাসার বারান্দা থেকে দেখতে থাকা বৃষ্টি ও বিদ্যুতের মধ্যেও ফিরে আসে তিমিরেরা।

“ইন্দ্র ধরেছে কুলিশ / চুরমার ফেটে যায় মেঘ, দশভাগে দশটানে বিদ্যুৎ / তারপর সব চুপ / এই তোমার মুখ, তিমির / কিন্তু তারপর সব চুপ”

দেশ ও রাজ্যের রাজনৈতিক চেহারাটা অনেক পালটে যাওয়ার পরেও শঙ্খ ঘোষ তাঁর চিন্তা চেতনা থেকে বিচ্যুত হন নি। ‘কলকাতা’ সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্তকে লেখা একটি চিঠির অবতারণা এই প্রসঙ্গে খুব প্রাসঙ্গিক। নব কলেবরে প্রকাশিত ‘কলকাতা দু-হাজার’ এর লেখক পরিচিতিতে দুঁদে পুলিশ অফিসার রঞ্জিত গুপ্ত-র পরিচিতিতে ব্যবহৃত বাক্যবন্ধের প্রতিবাদে সম্পাদক ‘প্রিয় জ্যোতি’কে চিঠি লেখেন তিনি। লেখক পরিচিতির পাতায় লেখা ছিল : ‘হ্যাঁ, এই সনেট-অনুবাদক রঞ্জিত গুপ্ত’ই হচ্ছেন সেই নকশাল-দমনকারী পুলিশ কমিশনার, পোলো ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, নৃতাত্ত্বিক, চাষী এবং ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট রঞ্জিত গুপ্ত আই পি।” শঙ্খ ঘোষ লিখলেন, “...ভাবনাটা আলোড়িত হলো পরিচয় জানাবার বিশেষ এই পদ্ধতিতে, বিশেষণের এই মর্মান্তিক নির্বাচনে, এই সগৌরব ঘোষণায় যে ইনিই সেই নকশাল-দমনকারী পুলিশ অফিসার।... অনুমান করি যে, এ-উল্লেখ আপনি বোঝাতে চেয়েছেন শুধু লেখকের বৈচিত্র্যটুকুই, এমন কী হয়তো আত্মবিরোধটাই, পোলো খেলা এবং নকশাল-দমনের এই চমকপদ সহাবস্থ্না, বিবরণে সম্পূর্ণতার গরজ ছাড়া ওখানে নিশ্চই আর কোনো রকম আতিরিক্ত অভিপ্রায় কাজ করেনি। অথচ এই কয়েকটি শব্দের প্রয়োগ যে মুহূর্তমধ্যে আমার মতো অনেক পাঠকের সামনে ঝাঁপ দিয়ে ওঠে এক বিষাক্ত ছোবল নিয়ে, সেকথাও সত্যি।... ওই ‘দমন’ শব্দটি শুনবার সঙ্গে সঙ্গে পনেরো বছরের পুরোনো ছবিগুলি আবার জেগে উঠতে থাকে আমাদের চোখের সামনে, জেগে ওঠে কত-না স্বজন বন্ধু ছাত্রছাত্রী অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের মুখ, আমার আপনার সকলেরই বেশ চেনাজানা, কিছু-বা সংকল্পে উজ্জ্বল, কিছু –বা নির্যাতনে বধির, যারা অনেকেই হয়তো বিভ্রান্ত ছিল সেদিন, কিন্তু যাঁদের আর্ত কল্পনার সামনে ছিল মস্ত এক সুস্থ দিনের স্বপ্ন।... সভ্যতা আর মানবতার এই শব্দদুটি যখন আজ পড়ি, তখন মনে পড়ে বেলেঘাটার কথা, বরানগরের কথা, দমদম আর বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলের অন্তর্গত নৃশংস আর অবাধ হত্যাকাণ্ডের কথা, মানবতাকেই যার প্রধান ভিত্তি বলে বিবেচনা করা শক্তই ছিল সেদিন। দমনের এই বিভীষিকাময় দিনগুলি কি আজও কিছু কিছু মনে পড়ে আপনার?” এটি নিছক এক বন্ধু সম্পাদকের কাছে এক কবির চেতনার অন্তর্গত যন্ত্রণার ভাষ্য নয়, সময়ের গভীর তত্ত্বতালাশ। “কী হয়েছিলো সেই দমন প্রক্রিয়া, সেটা ভাববার আগে লক্ষ করা দরকার এই বিশৃঙ্খলার চরিত্রটা। নকশালপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে, যে কোনো কৌশলেই হোক, মিশে গেল লুম্পেন প্রোলিটারিয়েটরা। আবার লুম্পেন প্রোলিটায়েটদেরই প্রয়োগ করা হলো এদের ধ্বংস করবারও কাজে, এর বিবরণ রঞ্জিত গুপ্ত নিজেই দিয়েছেন। কিন্তু তার বিবরণে তিনি স্পষ্টত বলেননি জেল বা জেলের বাইরে সেই রাজনৈতিক ছেলেমেয়েদের কথা, যারা লুম্পেন নয়, ওই ফাঁদে জড়িয়ে নিয়ে যাদের ওপর পুলিশি মত্ততা চলেছিল উৎকট হিংস্রতায়। উনিশশো সত্তর-এর জুলাই থেকে পুলিশ কমিশনার হন রঞ্জিত গুপ্ত, আর আমাদের মনে পড়ে সে-বছরেরই নভেম্বরের এক ভোররাতে, যখন বেলেঘাটার পাঁচশো বাড়িতে হানা দিয়ে চুয়াল্লিশটি পুলিশভ্যান টেনে বার করে কিছু স্কুলকলেজের ছাত্রকে, আর প্রমাণহীন বিচারহীনভাবে চারজনকে গুলি করে মেরে ফেলে সেখানেই, প্রকাশ্য অঞ্চলে। শ্যামপুকুর পার্কের কাছে চৌদ্দ বছর বয়সের টাইফয়েড আক্রান্ত একটি ছেলেকে পথে নিয়ে এসে দিনের আলোয় খুন করে পুলিশ, শ্যামপুকুর রোডে ডেপুটি কমিশনার নিজেরই হাতে গুলি করেন দুজনকে, বেলঘরিয়াতেও ঘটে একইরকম ঘটনা।... প্রতিটি মধ্যরাতে পুলিশ শ্মশানঘাটে নিয়ে আসে চৌদ্দ থেকে তিরিশ বছরের অন্তর্গত অসংখ্য যুবাকিশোরের দগ্ধ শরীর, ... অথবা ভাবুন একাত্তর সালের চব্বিশ ফেব্রুয়ারিতে বহরমপুর জেলের কথা। বেয়নেট আর লাঠি দিয়ে চারজনকে পিটিয়ে মারা হয় সেলের অভ্যন্তরে, তিনজনের মৃত্যু হয় হাসপাতালে পৌঁছে আরো একজন পরে। দমদম সেন্ট্রাল জেলে একইভাবে হত্যা করা হলো একদিন ষোলোটি ছেলেকে, আহত আরো অগণ্য। কিংবা ভাবুন বরানগরের-কাশীপুরের সেই হিংস্র আরণ্যক দিন দুটির কথা, বারো আর তেরই আগস্ট, যখন তালিকা চিহ্নিত করে দেড়শো ছাত্রকে খুন করা হলো বাড়ি বাড়ি ঘুরে, পথের মোড়ে লটকে দেওয়া হলো নাম, সকলের অভিজ্ঞতার সামনে, যেন প্রশাসনহীন জগতে।” ১৯৮৫তে লেখা এই চিঠিতে আমরা যে মানুষটিকে পাই সে গরল পানের স্মৃতিদগ্ধ ক্ষুব্ধ এক কবি, সামাজিক অবদমনের বিরুদ্ধে সমকালের প্রধান সংবেদনশীল ‘এক্টিভিস্ট’।

জরুরি অবস্থার সময় নিজের অবস্থানে অটুট থাকার জন্য খেসারত দিতে হয়েছিলো তাঁকে। ১৯৭৫-এ ১৮ মাস ব্যাপী জরুরি অবস্থার অন্ধকার সময়ে শুধু বিরোধী মত ও দলের মানুষদের অবরুদ্ধই করা হয় নি, বহু সংবাদপত্র, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করা হয়েছিলো। ব্যতিক্রম ঘটেনি শঙ্খ ঘোষের ক্ষেত্রেও। ‘দেশ’ সম্পাদক সাগরময় ঘোষ নিজে চেয়ে নিয়েছিলেন তাঁর কবিতা, কিন্তু ‘সরকারি নিষেধাজ্ঞায়’ ছাপতে পারেন নি! সাগরময় ঘোষ সসংকোচে তাঁকে অন্য লেখা দিতে বললেন। উত্তরে শঙ্খ ঘোষ বলেন, “অন্য কোনো কবিতা তো পারব না পাঠাতে। কেননা যা কিছু লিখছি এখন, তার সবটাই তো ও-রকম সরকারি হুকুম নিয়ে ফিরে আসতে পারে।” সেবার আর লেখা দেননি। ইন্দিরা শাহীর দাপট আক্রান্ত সেই সময়ে শঙ্খ বাবুর শর্ত ছিল অবিকৃতভাবেই তাঁর লেখা ছাপানোর সাহস দেখালেই সম্পাদককে লেখা দেবেন। এই শর্তে অনেক সম্পাদক পিছিয়ে এলেও বার্ণিক রায়, অরুণ সেনেরা এই শর্তেই লেখা ছাপেন। ‘লা পয়েজি’ ও ‘সাহিত্যপত্র’-এ ছাপা হয় ‘রাধাচূড়া’ ও ‘আপাত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে’।

জরুরি অবস্থার সময় রাষ্ট্র শাসকের রক্তচক্ষুকে কুর্নিশ না জানানো কবি শঙ্খ ঘোষেকে জড়িয়ে আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। একবার সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন দুরদর্শনে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের দিন আর অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে সেখানে ‘জন্মদিন-মৃত্যুদিন’ নামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। হঠাৎ অনুষ্ঠান পরিচলক শঙ্খ ঘোষকে জানান যে স্টেশান ডিরেক্টারের আপত্তিতে তাঁকে একটি লাইন পাল্টাতে হবে। লাইনটি হলো, ‘তখন ইন্দ্রের ভয়ে ঘরে কুলুপ দিয়েছেন ব্রহ্মা’। দর্শকের কানে যদি ‘ইন্দ্র’ শব্দটি ‘ইন্দিরা’ হয়ে প্রবেশ করে এই ভয়ে সেই শব্দটি পাল্টাতে বলা হয়। এমনই আরও অভিজ্ঞতা ছিলো তাঁর, একবার ‘আকাশবাণী’তে অনুষ্ঠান করছেন তিনি ও কবিতা সিংহ। সরকারি বেতার কর্তৃপক্ষ কবিতা সিংহর লেখা স্ক্রিপ্ট থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্প থেকে নেওয়া অংশ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। কিন্তু দৃঢ়ভাবে শঙ্খ ঘোষ এই অংশটি বাদ দেওয়ার বিরোধিতা করেন, বলেন যে বাদ দিলে গোটাটাই বাদ দিতে হবে। এই দৃঢ়তা সবাই সেই সময় দেখাতে পারেননি, যেটা শঙ্খ ঘোষ পেরেছিলেন। ‘কবিতার মুহূর্ত’তে লিখেছেন, “অপমান বোধ হয়। অপমান বোধ হয়, ভয় দেখিয়ে শাসন করবার এই লজ্জাহীন ফ্যাসিস্ট আয়োজন দেখে। স্ট্রেটেজি হিসাবে অনেকে চুপ থাকতে চান সত্যি, কিন্তু প্রতিবাদে এগিয়ে এসে পুলিশের কাছে তাড়িতও হন অনেকে গোটা দেশ জুড়ে। দিল্লির মসনদ কি জানে না যে প্রতিবাদীর এই সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলবে? অনিচ্ছুকের উপর চাপ দিয়ে খুব বেশিদিন যে বাঁচে না ক্ষমতা, ইতিহাস কি তাকে শেখায়নি এটা?” এই কথাগুলো চিরকালীন সত্য উচ্চারণ হয়ে থাকবে। (অসমাপ্ত)

back to top