alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক উপন্যাস : এগারো

শিকিবু

আবুল কাসেম

: বৃহস্পতিবার, ০৮ জুলাই ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আঠারো

বর্ষব্যাপী কলেরা মহামারীর প্রাদুর্ভাবে হেইয়ানকিউ-এর জীবনযাত্রা অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে। ইঝোমি শিকিবুরা এর মধ্যেও জীবনকে উপভোগ করে চলেছেন। প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই-এর প্রাসাদে তার মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। সম্রাট তনয় তামেতাকা প্রেয়সী ইঝোমিকে সম্মানের সঙ্গে সঙ্গ দিচ্ছেন। সবমিলিয়ে ভালোই আছেন ইঝোমি। অবশ্য তাকে সম্রাট রেইঝেই-এর দেয়া দায়িত্ব পালন করতে হয়নি। কলেরা মহামারী শিল্প-সাহিত্যের ওপরও থাবা বিস্তার করেছে। এসবের চর্চা, উৎসব অনুষ্ঠান- সবই বন্ধ আছে।

ইমনকে শোশির দরবারে যেতে হয়। ইমন সেই শোনাগনের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চান না, কারণ সেই শোনাগন জ্যেষ্ঠ কবি হিসেবে তাকে সম্মান করেন। এছাড়া তিনি জানেন, কবিপ্রতিভা পরিমাপের মানদ- না থাকলেও লেখার জন্য সেই শোনাগন যথেষ্ট জনপ্রিয়। সম্মানবোধ থেকে ইমন যেকোনো দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলেন।

সম্রাজ্ঞী শোশির অবশ্য এসব বুঝবার বালাই নেই। তেইশিকে জব্দ করতেই (মারি অরি পারি যে কৌশলে) সর্বক্ষণ ব্যস্ত আছেন। মহামারীরও এখানে কোনো বাধা নয়।

ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান

মিচিনাগা তার দরবারে খোঁজখবর নিতে এসেছেন। বাবাকে পেয়ে বললেন, ইঝোমি তো আসছে না।

এই মহামারীতে না আসাই ভালো। সবাই তো জানেই যে তোমার দরবারে আছে।

তা জানে। তাই বলে কি একবারও আসবে না?

তুমি উতলা হয়ো না। বাইরে পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তাই বলে তো তেইশির সেই শোনাগন বসে নেই। নিশ্চয়ই কিছু না কিছু লিখছে। আমাদের কে কি করছে বুঝতে পারছি না।

কে কি করছে এটা বড় কথা নয়, সম্রাট জানছেন তুমি সাহিত্যানুরাগী সম্রাজ্ঞী, একজন নয়, একাধিক কবি-সাহিত্যিক তোমার দরবারে আছে, সেটাই বড় কথা। তাতে তোমার প্রতি সম্রাটের মনোভাব উচ্চতর হচ্ছে।

কিন্তু ইঝোমি সম্পর্কে যে কীসব বললেন।

এটা মনে রাখবেন না।

মনে করিয়ে দেয়ার জন্য তেইশি আছে।

সম্রাট ইঝোমির কবিতা পছন্দ করেন। তেইশি সুবিধা করতে পারবে না।

তেইশি একটা ভয়ের মধ্যে আছেন। বাবা নেই, দুই সমর্থক চাচা মারা গেছেন। ভাইকে প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন কলেরা মহামারী চারদিকে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সম্রাটের প্রাসাদের কয়েকজনের মৃত্যু সংবাদ কানে এসেছে।

তিনি সেই শোনাগনকে ডাকলেন। তার মানসিক অবস্থার কথা গোপন করে বললেন, চারদিকের খবর ভালো নয়, তুমি নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত কর। আর মানসিকভাবে শক্ত থাকো। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগটা কম রাখবে। আমার দরবারের সবাইকে সচেতন করে দেবে। আমি বলে দিয়েছি দাস-দাসীদের কি কি নিয়ম মানতে হবে। তুমি এই নিরিবিলি সময়ে এমন কিছু লেখ, যা সম্রাট পছন্দ করবেন। আমাকে দেখাতে ভুলবে না যেন।

লেডি সেই শোনাগনের ভেতরও ভয় আছে। কলেরায় আক্রান্ত হলে কেউ আর রক্ষা পায় না। সতর্কতা তারও আছে।

সম্রাজ্ঞী আবার বললেন, সে দিককার খবর কি? বড় চুপচাপ মনে হচ্ছে।

ইঝোমির দিন শেষ, আপনি নিশ্চিত থাকুন।

তাই যেন হয়। বড় জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল।

আপনি সম্রাটকে বলে কাজের কাজ করেছেন।

কিন্তু তার প্রতিভা আছে। তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা লেখা সহজ কাজ নয়।

এ কথাটা সেই শোনাগনের ভালো লাগেনি। তবে কিছু বললেন না ইঝোমি সম্পর্কে, বললেন, ইমন আমার সকল চিন্তার কেন্দ্রে।

সম্রাজ্ঞী আবার বললেন, মহামারীর পর বুঝা যাবে অবস্থা কী দাঁড়ায়। ইমনের কথা কেন বললে?

ইমন আগে ছিলেন সম্রাজ্ঞীর মায়ের সঙ্গে। তার বুনিয়াদ শক্ত। মিচিনাগা তার কথা শুনবেন।

ইমন কূটরাজনীতি করার মেয়ে নয় বলে জানি। তারপরও খেয়াল রেখো। সে দিন যে মেয়েটা কবিতা পড়েছিল তার স্বামী নাকি মারা গেছে। লোকটি কে?

উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগের নোবুতাকা।

তার জন্য কষ্ট হয়। কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্যও।

তার স্বামী প্রচুর ধন-সম্পদ রেখে গেছে। একটি মাত্র মেয়ে কোনো সমস্যা হবে না।

তুমি তো দেখছি সব খবরই রাখো।

সম্রাজ্ঞীর কথা শুনে সেই শোনাগন হাসলেন।

আকাঝোমি ইমন মহামারীর মধ্যেও ছুটে গেছেন মুরাসাকিদের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন মুরাসাকিরা বিওয়া হৃদের তীরে ইশিয়ামা ডেরায় চলে গেছেন। কয়েক দিন পর সেখানে গেলেন।

বিরাট প্রাসাদপ্রতীম বাড়ি বানিয়েছেন নোবুতাকা। সর্বত্র আভিজাত্য আর রুচির পরিচয়। প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী। শিল্পের ছাপ রেখে গেছেন এ বাড়িতে। অকালে তার মৃত্যু হলো।

মুরাসাকিকে সান্ত¡না দিতে গিয়ে নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। বললেন, শুধু নৃত্যশিল্পে নয় সাজসজ্জা, পোশাক-আশাকে হেইয়ানকিউতে তিনি ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন তিনি। অনেকের মনও জয় করতে পেরেছিলেন। হেইয়ানকিউ তার কথা মনে রাখবে। এই মানুষটির অকাল মৃত্যুতে যে ক্ষতি হয়েছে, তার জন্য তোমাকে সান্ত¡না দেয়ার শক্তি বা ভাষা কোনোটাই আমার নেই। শুধু বলতে পারি, আমি তোমার সঙ্গে আছি তাকাকু। যখন ডাকবে ছুটে আসব। তুমি এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে।

ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। খুব ভেঙে পড়েছিলাম। মনে হলো বুঝি আমার বেঁচে থাকার অর্থই হয় না। শুধু মেয়েটার কথা ভেবে আবার আশায় বুক বেঁধেছি। সাহিত্যও যেন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কষ্ট হয় কি জানেন, উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগের মানুষ, কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই তাঁকে সমাধিস্থ হতে হলো।

তার জন্য তো তোমরা কেউ দায়ী নও, মহামারীই সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। সাহিত্যের সঙ্গে মনোসংযোগ করতে পেরেছ শুনে ভালো লাগল। তোমার লেখা অনেকের দৃষ্টি আকর্র্র্ষণ করেছে। সেদিন মিচিনাগা তোমার কথা বলছিলেন।

তেমন লিখতে পারছি না। তবে পড়ছি, প্রচুর পড়ছি। বাবা অনেক বই দিয়ে গেছেন।

কিছুই লিখোনি?

একটা মাত্র ওয়াকা লিখতে পেরেছি। শুনবেন :

‘তাঁকে, আমি দেখেছি

ধোঁয়ায় রূপান্তরিত হতে এবং

সেই সন্ধ্যাকাল থেকে

সে নাম আমার চেতনায় ভাবাসক্তি এনে দিয়ে গেছে

শিয়োগামায় সমুদ্র যেন।’

সুন্দর হয়েছে। তবে কি জানো? তাকে ভুলে থাকতে পারলে ভালো হয়।

কিভাবে সম্ভব বলুন?

তা খুব কঠিন জানি।

কবরে নামানোর অসহায় দৃশ্যটা আমি ভুলতে পারি না। শুধু একটা কালো কিমোনো গায়ে। আর সবকিছু রেখে গেছে। সে দৃশ্যটা ভুলে থাকার জন্যই বিওয়া হ্রদের দিকে সন্ধ্যায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন মনে হলো সে সফেদ পোশাকে জেগে উঠে ধোঁয়ায় মিলিয়ে গেল। আমার ভেতর রেখে গেল চিন্তার সাগর।

তুমি যত ভাববে কষ্ট পাবে, তাকাকু। প্রকৃতি নিয়ে ভাবো, সন্তানকে নিয়ে ভাবো। বিওয়া হ্রদের সৌন্দর্যকে কবিতায় নিয়ে এসো। ধোঁয়া বা কুয়াশাচ্ছন্ন বিওয়ার বুক নয়, চাঁদের আলোপড়া উজ্জ্বল জলরাশিতে পদ্যের মতো শোভমান ঝিরিঝিরি ঢেউ। তা তোমাকে কুয়াশার ধূম্রজাল সৃষ্টির অতীত স্মৃতি ও ভাবকল্প থেকে উদ্ধার করে বাস্তবতার জগতে নিয়ে আসবে।

আপনি বলছেন?

হ্যাঁ, এটাই এখন ইস্পিত। এখন মহামারীর সময় না হয় তোমাকে নিয়ে যেতাম। বাইরে ঘুরলে মনটা হালকা হবে। তবে আমি আসব, মাঝে মধ্যেই আসব। তুমি না চাইলেও আসব।

এটা কী বলছেন আপনি, আমি চাইব না কেন?

জবাবে শুধু মুরাসাকির গায়ে হাত বুলিয়ে ইমন বিদায় নিলেন।

ইমন চলে গেলে মুরাসাকি ভাবতে বসে গেলেন। কীভাবে তিনি নোবুতাকাকে ভুলবেন। আর কেনই বা ভুলবেন। তাহলে ইমন তা কেন বলে গেলেন। ইমন তার ভালোটাই চান, অতীতে তা বহুবার দেখেছেন এবং বহুভাবে পরীক্ষিতও। তাঁর কথা অমান্য করবেন কীভাবে। কিন্তু কেন ইমন এমন কথা বলবেন, তার কি কোনো কারণ তিনি দেখেছেন? কাকে জিজ্ঞেস করবেন?

তিন বছরের মেয়ে কেনশি। তাকে জিজ্ঞেস করে কিছু জানা যাবে না। ঠিক করলেন টেরামাচি লেনে যাবেন। নোবুনোরি আছে সেখানে।

নোবুনোরি তাকে দেখে বলল, একি আপনার হাল হয়েছে?

কী হয়েছে আমার?

আপনাকে উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে।

তুই সরাসরি বললি? এভাবে কেউ বলে?

মুরাসাকি রাগ করে চলে যাচ্ছিলেন, নোবুনোরি তাকে আটকালো, বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে। সেও ভুলে গিয়েছিল তার বোনের বড় কষ্টের সময় যাচ্ছে। এখন সে বড় হয়েছে। তার বুঝা উচিত ছিল। বুঝেই সে ক্ষমা চাইল। তবে সে বুঝতে পারলো তার বোন কিছুদিন আগের মতোই অস্বাভাবিক আচরণ করছে। শুধু উদ্ভ্রান্ত বলায় কেউ রাগ করে চলে যেতে পারে না। তার সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হবে।

কেনশি সঙ্গে এসেছে। সে তার মামাকে পেয়ে আনন্দে আছে। ইদানীং মেয়েটা মানসিকভাবে বেশ চাপে থাকে। মায়ের কাছ থেকে কাজের লোকদের সঙ্গে থাকতে বেশি পছন্দ করে। মাঝে মধ্যে বেশ জেদ করে। এখানে মনে হয় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।

মুরাসাকি ভাবছেন ভাইকে তার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবেন কিনা। তিনি তার জবাব প্রথমেই পেয়ে গেছেন। বাড়ির জলাশয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, বাবা ঠিক যেখানটায় দাঁড়িয়ে ক্ষুদে হাঁসদের জলকেলি দেখেন। তাদের আনন্দ দেখে তার ভালো লাগল। অনেক সময় দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। এক সময় মনে হলো তার পাশে নোবুতাকা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তার উপস্থিতি অনুভব করছেন।

এদিক সেদিক দাঁড়িয়ে দেখলেন পাশে কেউ নেই। তখনই নিজে সতর্ক হলেন। এখন ইমনের পরামর্শটা যেন অনুধাবন করতে পারছেন তিনি। হ্যাঁ সমস্যা তৈরি হয়েছে। তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

বাড়ি ফিরে এলেন। এসে শুনলেন ইঝোমি এসেছিলেন। বলে গেছেন, আবার আসবেন। আগে ইঝোমিকে গুরুত্বহীন একটা হালকা প্রকৃতির মেয়ে মনে হতো। আজ মনে হলো তিনি দায়িত্বশীলা নারী। তবে ঐ টুকুই। এর বেশি কোনো টান অনুভব করলেন না। মনে হলো সাক্ষাৎ পেলে কিছুক্ষণ ব্যস্ত থাকা যেত।

ইঝোমি আবার ঠিকই এলেন। নোবুতাকার মৃত্যুর জন্য শোক জানালেন। কেমন যেন ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেন। মুরাসাকির একটা হাত টেনে নিয়ে নিজের কোলের ওপর ধরে রেখে বললেন, তাকাকু, জীবনটা বড় বিচিত্র। নিজেকে হারিয়ে খুঁজে পাওয়া দ্বীপের মতো। তোমার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার মতো না হলেও কিছু কিছু হারানোর কষ্ট আমারও আছে। আমি ধরে নিয়েছি, এ আমার নিয়তি। তুমি শোক ভুলে যাবে। আবার জীবনের কঠিন বাস্তব পথে পা বাড়াবে এইই তো নিয়ম।

একথা বলার জন্য প্রিন্সকে ফেলে ছুটে এসেছ?

না, আমাকে ক্ষমা করো, আমি জানি না তোমার এ দুঃসময়ে আমার কি বলা বা করা উচিত।

তুমি এ সময়ে এসেছ, এটাই আমার জন্য বড় কথা।

জীবনকে বাজি রেখে চলা একজন সর্বজন অপ্রিয় মানুষকে আর কী বলবে তুমি। তোমার মেয়েকে আগে দেখিনি, তার জন্য সামান্য উপহার।

উনিশ

ইঝোমির পরিবর্তনে অবাক হলেন মুরাসাকি। কিন্তু ইঝোমি ঝড়ের বেগে চলে যাওয়ায় তাকে পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। আরো কিছুক্ষণ আশা করেছিলেন।

কিছুদিন যেতে না যেতেই একটা দুঃসংবাদ এলো। ইঝোমির প্রেমিক প্রিন্স তামেতাকা মারা গেছেন। না, মহামারী কলেরায় আক্রান্ত হয়ে নয়, অদ্ভুত এক মৃত্যু হয়েছে তার। স্বপ্ন সঞ্চরণ রোগ ছিল তার, সে কথা আগেই জানা গেছে। এই মহামারীর মধ্যেও ঘুমন্ত অবস্থায় চোখ বন্ধ রেখে গভীর রাতে অন্ধকারের মধ্যে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে যান। স্বপ্ন সঞ্চরণে সাধারণত দিক-দিশে ঠিক থাকে, চৈতন্য বিলোপ হয় না। তাই ঘুমন্ত মানুষটি ঠিক ঠিক ফিরে আসতে পারেন। কারো কারো প্রদীপ নিয়েও বের হতে এবং ফিরে আসতে দেখা যায়। প্রিন্স তামেতাকা এমনিতেই বের হয়ে পড়েন। বাতি নিয়ে বের হন না। সবাই ঘুমিয়ে গেলে বের হয়ে পড়েন তিনি।

কখনো কোনো সমস্যা হয় না। সেদিনই দুর্ঘটনা ঘটে গেল। পা জলে পড়ে গেলেন তিনি আর উঠতে পারলেন না। সকাল বেলায় তার মৃতদেহ জলাশয়ে ভাসতে দেখা গেল।

তামেতাকার বাবা প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেইকে প্রথম সংবাদটা পেলেন। ছুটে গেলেন তিনি। তার এই ছেলেকে তিনি অন্য ছেলে-মেয়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। তার কাছে এই ছেলের কোনো চাহিদা ছিল না। সাম্রাজ্যের সিংহাসন চাননি। নিজের মধ্যেই অবস্থান করতেন। তবে তার জ্ঞানস্পৃহা ছিল। জীবনকে নানাভাবে দেখতেন। অন্তরে প্রেম ছিল। কবিতা ভালোবাসতেন। তাই কবি ইঝোমিকে ভালোবেসে ফেলেন। তার ভালোবাসার প্রচ-তায় ইঝোমি স্বামী থাকা সত্ত্বেও তার প্রেমে পাগল হয়ে যান।

তামেতাকার মৃত্যু সংবাদে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন ইঝোমি। তার জীবনে অনেকবার ভালোবাসা এসেছে, কিন্তু এরকমভাবে কেউ তাকে নিঃস্ব করে ভালোবাসেনি। তাই তিনি স্বামী-সন্তান, বাবা-মা সবাইকে ছেড়েছেন এই ভালোবাসার জন্য। তাকে হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলেন।

তামেতাকার বাবা চিৎকার করে কাঁদলেন না, কিন্তু পর্বতপ্রতীম মানুষটির অন্তর পর্বত শৃঙ্গের মতই যেন ভূমিকম্পের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। হাত-হুতাশে যেন খ- খ- পাথর ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। বললেন, পৃথিবীর নিয়ম পিতাপুত্রের কাঁদে চড়ে সমাধির দিকে যায় শেষ ঠিকানায়। কী দুর্ভাগ্য আমার তোমার লাশ বয়ে নিয়ে আমি সমাধিস্থলে যাব। তুমি জানো সন্তানের লাশ পিতার কাঁধে কত দুর্বহ, বিদীর্ণ অন্তরে এ শোক কত দুঃসহ। পুত্রশোকে সম্রাজ্ঞী চোশি (তোকো) বিলাপে আরো বিষাদঘন করে তুললেন পরিবেশ। হায় পুত্র। হায় তামেতাকা। মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন। কত যতেœ তোকে লালন করেছি, ভুলে গেছি রাতের ঘুম, স্বপ্ন দেখার সুখ। সম্রাটের মাতা হব আমি, সম্রাজ্ঞীর শাশুড়ি, এই ছিল আশা। তুই সম্রাট হতে গেলি না, না চাইলি সাম্রাজ্য। তাতেও সুখ ছিল আমার। কী কারণে স্বপ্ন সঞ্চরণে বের হলি অন্ধকার রাত দুপুরে। কালমৃত্যু সেখানেই অপেক্ষা করছিল?

চতুর্থ স্ত্রী ফুশি টেনে নিয়ে গেলেন তাকে পদ-পদবির কথা ভেবে। বললেন, পুত্র আপনার সকলের প্রিয় ছিল, আমরাও স্নেহের চোখে দেখতাম। ত্যাগের দৃষ্টিতে দেকুন বোন, যে শিক্ষা বৌদ্ধ ধর্ম দিয়ে থাকে। হ্যাঁ ত্যাগেই মুক্তি। ত্যাগেই শান্তি।

সম্রাট রেইঝেই বললেন, আমার এই সম্রাটতনয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং সমাধি হবে রাজকীয় রীতি মেনে। সম্রাটনন্দন অতসুমিচি যাবতীয় ব্যবস্থা করো।

প্রিন্স তামেতাকার মৃত্যু কলেরায় নয়। অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তার। তাই রাজকীয় রীতি মেনে তাকে সমাধিস্ত করা হবে।

বৌদ্ধরীতিতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হবে। তাই প্রথমেই মৃতের ঠোঁট পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া হলো। বাইরের অপবিত্র অপশক্তির চোখের আড়াল করার জন্য গৃহ শ্রাইন বন্ধ ও সাদাবস্ত্র দ্বারা ঘিরে রাখা হলো। তাকে বলা হয় কামিদানা ফুজি। একটি সাজানো টেবিলে ফুল, ধূপ এবং একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে মৃত্যুর বিছানায় রাখা হলো। অপশক্তির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য মৃতের বুকে রাখা হলো একটি ধারালো ছুরি।

রাজকীয় প্যাগোডায় সংবাদ পাঠানো হয়েছে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এখানেই সম্পন্ন হবে। শরীর ধুয়ে তুলো দিয়ে নাক ও কান বন্ধ করা হয়েছে। কালো কিমোনো পরাবার পর মুখম-লে সামান্য মেকআপ করা হলো। একটি শবাধারে রেখে শবদেহের পাশে একটি সাদা কিমোনো, সেন্ডেল, ছয়টি মুদ্রা এবং তার পছন্দের জিনিসপত্র রাখা হলো। ছয়টি মুদ্রা রাখার কারণ হলো লোক বিশ্বাস তিনটা নদী তাকে পাড়ি দিতে হবে এই পয়সায়।

লাশের মাথা রাখা হয়েছে উত্তর দিকে। প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই ব্যক্তিগতভাবে সবকিছু দেখভাল করছেন। বৌদ্ধভিক্ষু সূত্র পাঠ করছেন। সমস্যা দেখা দিল মরদেহ পোড়ানো হবে নাকি করব দেয়া হবে এ নিয়ে। হেইয়ান জাপানে, বিশেষ করে হেইয়ানকিউতে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। শবদেহ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পুড়িয়ে ফেলার পক্ষে। শিন্টু ধর্মের লোকেরা প্রাচীনপন্থি, তারা কবর দিতে চায়। মধ্যপন্থিরা মরদেহে সামান্য অগ্নিসংযোগ করেই পূর্ণদেহ সমাধিস্থ করছে। তারা উভয়ধর্ম ও প্রচলিত ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে বিশ্বাসী। প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই এই দলে (তবে বতর্মানে জীবিত সম্রাট আকিহিতো এবং সম্রাজ্ঞী তাদের শবদেহ সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলার নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। কারণ সম্রাটদের সমাধিতে স্থানাভাব দেখা দিয়েছে)।

যথাযোগ্য মর্যাদায় ধর্মীয় এবং প্রচলিত সংস্কার ও ঐতিহ্য অনুসরণ করে ৪৯ দিনের নানা নিয়ম মেনে তামেতাকার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়ে গেল।

কবি ইঝোমি শিকিবু কালো কিমোনো পরিধান করে মরদেহে ফুল দেয়া থেকে সকল অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এখানে তিনি বড় একা। শুধু সম্রাট রেইঝেইয়ের মধ্যে তার জন্য কিছুটা জায়গা আছে। তিনিই তাকে অনুষ্ঠানগুলোয় থাকার জায়গা করে দিয়েছেন।

প্রাক্তন সম্রাজ্ঞী চোশি তাকে সহ্য করতে পারছেন না। তার ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ, ইঝোমি প্রাসাদে একসঙ্গে থাকাকালে কী করে প্রিন্স প্রাসাদ থেকে বের হয়ে যান।

রেইঝেই বললেন, ঘুম আর মৃত্যু সমান। তাকে কেন দোষ দিচ্ছ তোকো? গভীর রাতে তার জেগে থাকার কথা নয়।

তাই বলে একটুও টের পাবে না। সে তো জানে প্রিন্সের এই সমস্যা রয়েছে।

তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যেভাবে প্রিন্সের মৃত্যু লেখা ছিল তাই হয়েছে।

ইঝোমি তার কন্যাকে নিয়ে প্রাসাদ ছাড়তে উদ্যোগী হলেন। মনকে শক্ত করলেন।

রেইঝেইকে বলতেই তিনি বললেন, তোমরা কোথায় যাবে?

আপাতত কবি আকাঝোমি ইমনের বাড়ি, সেখান থেকে অন্য কোথাও।

মা-বাবার বাড়ির দরজা আগে থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। একথা সম্রাট নিজেও জানেন। বললেন, না, তোমার কোথাও যাওয়া হবে না। তোমরা এখানেই থাকবে।

পিতৃস্থানীয় এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি রেইঝেইয়ের কথা তিনি ফেলতে পারলেন না। প্রাসাদেই রয়ে গেলেন।

ইমন মুরাসাকিকে নিয়ে ইঝোমিকে দেখতে এলেন। ইঝোমি শোকের কালো পোশাক কালো কিমোনো পরে আছেন। সুন্দর মুখ, ফ্যাকাসে এবং চোখের নিজে কালি পড়ে গেছে। চপল ও ফুটফুটে মেয়েটি একেবারে গম্ভীর হয়ে গেছে। চুল এলোমেলো, পোশাক পরিধানের ঠিক-ঠিকানা নেই। উদাসীনতা পুরোপুরি ভর করেছে। দুজনই তার পাশে এসে বসলেন। ইমন তার হাতটা টেনে নিয়ে বললেন, তোমাকে সান্ত¡না জানাবার ভাষা আমার নেই। তুমি এত ভেঙে পড়ো না, তোমার মেয়ের জন্য হলেও সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে হবে, বাঁচতে হবে।

মুরাসাকি বললেন, যত কঠিন আঘাতই আসুক তবু আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, এই হচ্ছে নিয়তি। আমি তো সেভাবেই বেঁচে আছি। একদিন তোমারও হয়ত জীবন স্বাভাবিক হয়ে আসবে তখনও পিছুটানটা, প্রিয়জনকে হারাবার বেদনাটা, যাবে না। তুমি সবকিছু সহ্য করার শক্তি লাভ কর, এটাই আমি চাই।

ইমন বললেন, আমি তোমাদের মত এতবড় আঘাত পাইনি, কিন্তু দুঃখ পেয়েছি। তোমরা জানো সে দুঃখের কথা। দুঃখ শুধু ধ্বংসই করে না সৃষ্টিও করতে সাহায্য করে। হয়ত দুঃখটা ভালোর জন্যই আসে। আমরা আগে তা বুঝি না। ইঝোমি একজন জীবনবাদী মানুষ। এরকম মানুষের জীবন এক জায়গায় আবদ্ধ হয়ে থাকে না, গতিশীল ও চলমান এবং তার বিস্তার নক্ষত্রের মতো, আলোয় আলোয়।

মুরাসাকি বললেন, ঠিক বলেছেন। ইঝোমি থেমে থাকার মানুষ না। এ আঘাতের পর সে আরো বেগবান হবে।

ইঝোমি আস্তে আস্তে বললেন, আপনারা এসেছেন আমার মন অনেক হালকা হয়ে গেছে। তাকাকুর বাড়িতে সেদিন গিয়ে বুঝতে পারিনি মৃত্যু কতটা ভয়াবহ শোক বয়ে আনে। প্রিয়জনদের মৃত্যু হলে আর বাঁচবার ইচ্ছেই হয় না। মরে যেতে ইচ্ছে হয়। তামেতাকা এমন এক মানুষ ছিলেন যার গুণ বলে শেষ করা যাবে না। আমাকে তিনি এতটা ঘনিষ্ঠ করে নেবেন ভাবতেও পারিনি। তিনি সত্যিকার অর্থেই ভালো বাসতে জানতেন, সম্মান করতেন এবং মর্যাদা দিতেন। একজন আত্মসচেতন নারীর জন্য আর কি চাই।

ইমন বললেন, ঠিকই বলেছ। এই হেইয়ান কিউতে নারীর জন্য এটাই বেশি দরকার।

একজন তামেতাকা আমাদের জন্য আদর্শ। এই আদর্শের অনুসারী হতে হেইয়ান কিউর এখনো অনেক বাকি। তার আরো বহু বছর বেঁচে থাকা উচিত ছিল। বললেন মুরাসাকি।

সম্রাট রেইঝেই তার এই পুত্রকে বেশি ভালোবাসতেন। তার খুব ইচ্ছে ছিল রাজকীয় ফুল ক্রাইসানথ্যমম প্রিন্সের শবাধারে শোভা পাবে। তিনি সংগ্রহ করতে পারেননি, সময়টা এ ফুল ফোটার সময় নয়; কিন্তু আমি পেলাম। সৌভাগ্যই বলতে হয়, আমি বোধহয় তার ইচ্ছা পূরণ করে প্রতিদানই দিতে পেরেছি। আর প্রিয় মানুষটিকে বিদায় বেলায় উপযুক্ত উপহারে ভূষিত করার দুর্লভ এক সুযোগ লাভ করেছি।

ইমন বললেন, সম্রাটকে কী প্রতিদান?

তিনি আমাকে এবং আমার মেয়েকে প্রাসাদে স্থান দিয়েছেন। প্রিন্স নেই, তবুও এখানে থাকতে স্নেহের হাত বাড়িয়েছেন। আমি আপনার বাড়িতে চলে যেতে চেয়েছিলাম, তিনি দিলেন না।

শ্রদ্ধা পাবার মতো ব্যক্তিত্ব তার। বললেন মুরাসাকি। ক্রমশ...

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক উপন্যাস : এগারো

শিকিবু

আবুল কাসেম

বৃহস্পতিবার, ০৮ জুলাই ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আঠারো

বর্ষব্যাপী কলেরা মহামারীর প্রাদুর্ভাবে হেইয়ানকিউ-এর জীবনযাত্রা অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে। ইঝোমি শিকিবুরা এর মধ্যেও জীবনকে উপভোগ করে চলেছেন। প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই-এর প্রাসাদে তার মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। সম্রাট তনয় তামেতাকা প্রেয়সী ইঝোমিকে সম্মানের সঙ্গে সঙ্গ দিচ্ছেন। সবমিলিয়ে ভালোই আছেন ইঝোমি। অবশ্য তাকে সম্রাট রেইঝেই-এর দেয়া দায়িত্ব পালন করতে হয়নি। কলেরা মহামারী শিল্প-সাহিত্যের ওপরও থাবা বিস্তার করেছে। এসবের চর্চা, উৎসব অনুষ্ঠান- সবই বন্ধ আছে।

ইমনকে শোশির দরবারে যেতে হয়। ইমন সেই শোনাগনের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চান না, কারণ সেই শোনাগন জ্যেষ্ঠ কবি হিসেবে তাকে সম্মান করেন। এছাড়া তিনি জানেন, কবিপ্রতিভা পরিমাপের মানদ- না থাকলেও লেখার জন্য সেই শোনাগন যথেষ্ট জনপ্রিয়। সম্মানবোধ থেকে ইমন যেকোনো দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলেন।

সম্রাজ্ঞী শোশির অবশ্য এসব বুঝবার বালাই নেই। তেইশিকে জব্দ করতেই (মারি অরি পারি যে কৌশলে) সর্বক্ষণ ব্যস্ত আছেন। মহামারীরও এখানে কোনো বাধা নয়।

ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান

মিচিনাগা তার দরবারে খোঁজখবর নিতে এসেছেন। বাবাকে পেয়ে বললেন, ইঝোমি তো আসছে না।

এই মহামারীতে না আসাই ভালো। সবাই তো জানেই যে তোমার দরবারে আছে।

তা জানে। তাই বলে কি একবারও আসবে না?

তুমি উতলা হয়ো না। বাইরে পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তাই বলে তো তেইশির সেই শোনাগন বসে নেই। নিশ্চয়ই কিছু না কিছু লিখছে। আমাদের কে কি করছে বুঝতে পারছি না।

কে কি করছে এটা বড় কথা নয়, সম্রাট জানছেন তুমি সাহিত্যানুরাগী সম্রাজ্ঞী, একজন নয়, একাধিক কবি-সাহিত্যিক তোমার দরবারে আছে, সেটাই বড় কথা। তাতে তোমার প্রতি সম্রাটের মনোভাব উচ্চতর হচ্ছে।

কিন্তু ইঝোমি সম্পর্কে যে কীসব বললেন।

এটা মনে রাখবেন না।

মনে করিয়ে দেয়ার জন্য তেইশি আছে।

সম্রাট ইঝোমির কবিতা পছন্দ করেন। তেইশি সুবিধা করতে পারবে না।

তেইশি একটা ভয়ের মধ্যে আছেন। বাবা নেই, দুই সমর্থক চাচা মারা গেছেন। ভাইকে প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন কলেরা মহামারী চারদিকে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সম্রাটের প্রাসাদের কয়েকজনের মৃত্যু সংবাদ কানে এসেছে।

তিনি সেই শোনাগনকে ডাকলেন। তার মানসিক অবস্থার কথা গোপন করে বললেন, চারদিকের খবর ভালো নয়, তুমি নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত কর। আর মানসিকভাবে শক্ত থাকো। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগটা কম রাখবে। আমার দরবারের সবাইকে সচেতন করে দেবে। আমি বলে দিয়েছি দাস-দাসীদের কি কি নিয়ম মানতে হবে। তুমি এই নিরিবিলি সময়ে এমন কিছু লেখ, যা সম্রাট পছন্দ করবেন। আমাকে দেখাতে ভুলবে না যেন।

লেডি সেই শোনাগনের ভেতরও ভয় আছে। কলেরায় আক্রান্ত হলে কেউ আর রক্ষা পায় না। সতর্কতা তারও আছে।

সম্রাজ্ঞী আবার বললেন, সে দিককার খবর কি? বড় চুপচাপ মনে হচ্ছে।

ইঝোমির দিন শেষ, আপনি নিশ্চিত থাকুন।

তাই যেন হয়। বড় জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল।

আপনি সম্রাটকে বলে কাজের কাজ করেছেন।

কিন্তু তার প্রতিভা আছে। তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা লেখা সহজ কাজ নয়।

এ কথাটা সেই শোনাগনের ভালো লাগেনি। তবে কিছু বললেন না ইঝোমি সম্পর্কে, বললেন, ইমন আমার সকল চিন্তার কেন্দ্রে।

সম্রাজ্ঞী আবার বললেন, মহামারীর পর বুঝা যাবে অবস্থা কী দাঁড়ায়। ইমনের কথা কেন বললে?

ইমন আগে ছিলেন সম্রাজ্ঞীর মায়ের সঙ্গে। তার বুনিয়াদ শক্ত। মিচিনাগা তার কথা শুনবেন।

ইমন কূটরাজনীতি করার মেয়ে নয় বলে জানি। তারপরও খেয়াল রেখো। সে দিন যে মেয়েটা কবিতা পড়েছিল তার স্বামী নাকি মারা গেছে। লোকটি কে?

উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগের নোবুতাকা।

তার জন্য কষ্ট হয়। কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্যও।

তার স্বামী প্রচুর ধন-সম্পদ রেখে গেছে। একটি মাত্র মেয়ে কোনো সমস্যা হবে না।

তুমি তো দেখছি সব খবরই রাখো।

সম্রাজ্ঞীর কথা শুনে সেই শোনাগন হাসলেন।

আকাঝোমি ইমন মহামারীর মধ্যেও ছুটে গেছেন মুরাসাকিদের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন মুরাসাকিরা বিওয়া হৃদের তীরে ইশিয়ামা ডেরায় চলে গেছেন। কয়েক দিন পর সেখানে গেলেন।

বিরাট প্রাসাদপ্রতীম বাড়ি বানিয়েছেন নোবুতাকা। সর্বত্র আভিজাত্য আর রুচির পরিচয়। প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী। শিল্পের ছাপ রেখে গেছেন এ বাড়িতে। অকালে তার মৃত্যু হলো।

মুরাসাকিকে সান্ত¡না দিতে গিয়ে নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। বললেন, শুধু নৃত্যশিল্পে নয় সাজসজ্জা, পোশাক-আশাকে হেইয়ানকিউতে তিনি ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন তিনি। অনেকের মনও জয় করতে পেরেছিলেন। হেইয়ানকিউ তার কথা মনে রাখবে। এই মানুষটির অকাল মৃত্যুতে যে ক্ষতি হয়েছে, তার জন্য তোমাকে সান্ত¡না দেয়ার শক্তি বা ভাষা কোনোটাই আমার নেই। শুধু বলতে পারি, আমি তোমার সঙ্গে আছি তাকাকু। যখন ডাকবে ছুটে আসব। তুমি এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে।

ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। খুব ভেঙে পড়েছিলাম। মনে হলো বুঝি আমার বেঁচে থাকার অর্থই হয় না। শুধু মেয়েটার কথা ভেবে আবার আশায় বুক বেঁধেছি। সাহিত্যও যেন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কষ্ট হয় কি জানেন, উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগের মানুষ, কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই তাঁকে সমাধিস্থ হতে হলো।

তার জন্য তো তোমরা কেউ দায়ী নও, মহামারীই সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। সাহিত্যের সঙ্গে মনোসংযোগ করতে পেরেছ শুনে ভালো লাগল। তোমার লেখা অনেকের দৃষ্টি আকর্র্র্ষণ করেছে। সেদিন মিচিনাগা তোমার কথা বলছিলেন।

তেমন লিখতে পারছি না। তবে পড়ছি, প্রচুর পড়ছি। বাবা অনেক বই দিয়ে গেছেন।

কিছুই লিখোনি?

একটা মাত্র ওয়াকা লিখতে পেরেছি। শুনবেন :

‘তাঁকে, আমি দেখেছি

ধোঁয়ায় রূপান্তরিত হতে এবং

সেই সন্ধ্যাকাল থেকে

সে নাম আমার চেতনায় ভাবাসক্তি এনে দিয়ে গেছে

শিয়োগামায় সমুদ্র যেন।’

সুন্দর হয়েছে। তবে কি জানো? তাকে ভুলে থাকতে পারলে ভালো হয়।

কিভাবে সম্ভব বলুন?

তা খুব কঠিন জানি।

কবরে নামানোর অসহায় দৃশ্যটা আমি ভুলতে পারি না। শুধু একটা কালো কিমোনো গায়ে। আর সবকিছু রেখে গেছে। সে দৃশ্যটা ভুলে থাকার জন্যই বিওয়া হ্রদের দিকে সন্ধ্যায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন মনে হলো সে সফেদ পোশাকে জেগে উঠে ধোঁয়ায় মিলিয়ে গেল। আমার ভেতর রেখে গেল চিন্তার সাগর।

তুমি যত ভাববে কষ্ট পাবে, তাকাকু। প্রকৃতি নিয়ে ভাবো, সন্তানকে নিয়ে ভাবো। বিওয়া হ্রদের সৌন্দর্যকে কবিতায় নিয়ে এসো। ধোঁয়া বা কুয়াশাচ্ছন্ন বিওয়ার বুক নয়, চাঁদের আলোপড়া উজ্জ্বল জলরাশিতে পদ্যের মতো শোভমান ঝিরিঝিরি ঢেউ। তা তোমাকে কুয়াশার ধূম্রজাল সৃষ্টির অতীত স্মৃতি ও ভাবকল্প থেকে উদ্ধার করে বাস্তবতার জগতে নিয়ে আসবে।

আপনি বলছেন?

হ্যাঁ, এটাই এখন ইস্পিত। এখন মহামারীর সময় না হয় তোমাকে নিয়ে যেতাম। বাইরে ঘুরলে মনটা হালকা হবে। তবে আমি আসব, মাঝে মধ্যেই আসব। তুমি না চাইলেও আসব।

এটা কী বলছেন আপনি, আমি চাইব না কেন?

জবাবে শুধু মুরাসাকির গায়ে হাত বুলিয়ে ইমন বিদায় নিলেন।

ইমন চলে গেলে মুরাসাকি ভাবতে বসে গেলেন। কীভাবে তিনি নোবুতাকাকে ভুলবেন। আর কেনই বা ভুলবেন। তাহলে ইমন তা কেন বলে গেলেন। ইমন তার ভালোটাই চান, অতীতে তা বহুবার দেখেছেন এবং বহুভাবে পরীক্ষিতও। তাঁর কথা অমান্য করবেন কীভাবে। কিন্তু কেন ইমন এমন কথা বলবেন, তার কি কোনো কারণ তিনি দেখেছেন? কাকে জিজ্ঞেস করবেন?

তিন বছরের মেয়ে কেনশি। তাকে জিজ্ঞেস করে কিছু জানা যাবে না। ঠিক করলেন টেরামাচি লেনে যাবেন। নোবুনোরি আছে সেখানে।

নোবুনোরি তাকে দেখে বলল, একি আপনার হাল হয়েছে?

কী হয়েছে আমার?

আপনাকে উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে।

তুই সরাসরি বললি? এভাবে কেউ বলে?

মুরাসাকি রাগ করে চলে যাচ্ছিলেন, নোবুনোরি তাকে আটকালো, বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে। সেও ভুলে গিয়েছিল তার বোনের বড় কষ্টের সময় যাচ্ছে। এখন সে বড় হয়েছে। তার বুঝা উচিত ছিল। বুঝেই সে ক্ষমা চাইল। তবে সে বুঝতে পারলো তার বোন কিছুদিন আগের মতোই অস্বাভাবিক আচরণ করছে। শুধু উদ্ভ্রান্ত বলায় কেউ রাগ করে চলে যেতে পারে না। তার সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হবে।

কেনশি সঙ্গে এসেছে। সে তার মামাকে পেয়ে আনন্দে আছে। ইদানীং মেয়েটা মানসিকভাবে বেশ চাপে থাকে। মায়ের কাছ থেকে কাজের লোকদের সঙ্গে থাকতে বেশি পছন্দ করে। মাঝে মধ্যে বেশ জেদ করে। এখানে মনে হয় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।

মুরাসাকি ভাবছেন ভাইকে তার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবেন কিনা। তিনি তার জবাব প্রথমেই পেয়ে গেছেন। বাড়ির জলাশয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, বাবা ঠিক যেখানটায় দাঁড়িয়ে ক্ষুদে হাঁসদের জলকেলি দেখেন। তাদের আনন্দ দেখে তার ভালো লাগল। অনেক সময় দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। এক সময় মনে হলো তার পাশে নোবুতাকা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তার উপস্থিতি অনুভব করছেন।

এদিক সেদিক দাঁড়িয়ে দেখলেন পাশে কেউ নেই। তখনই নিজে সতর্ক হলেন। এখন ইমনের পরামর্শটা যেন অনুধাবন করতে পারছেন তিনি। হ্যাঁ সমস্যা তৈরি হয়েছে। তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

বাড়ি ফিরে এলেন। এসে শুনলেন ইঝোমি এসেছিলেন। বলে গেছেন, আবার আসবেন। আগে ইঝোমিকে গুরুত্বহীন একটা হালকা প্রকৃতির মেয়ে মনে হতো। আজ মনে হলো তিনি দায়িত্বশীলা নারী। তবে ঐ টুকুই। এর বেশি কোনো টান অনুভব করলেন না। মনে হলো সাক্ষাৎ পেলে কিছুক্ষণ ব্যস্ত থাকা যেত।

ইঝোমি আবার ঠিকই এলেন। নোবুতাকার মৃত্যুর জন্য শোক জানালেন। কেমন যেন ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেন। মুরাসাকির একটা হাত টেনে নিয়ে নিজের কোলের ওপর ধরে রেখে বললেন, তাকাকু, জীবনটা বড় বিচিত্র। নিজেকে হারিয়ে খুঁজে পাওয়া দ্বীপের মতো। তোমার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার মতো না হলেও কিছু কিছু হারানোর কষ্ট আমারও আছে। আমি ধরে নিয়েছি, এ আমার নিয়তি। তুমি শোক ভুলে যাবে। আবার জীবনের কঠিন বাস্তব পথে পা বাড়াবে এইই তো নিয়ম।

একথা বলার জন্য প্রিন্সকে ফেলে ছুটে এসেছ?

না, আমাকে ক্ষমা করো, আমি জানি না তোমার এ দুঃসময়ে আমার কি বলা বা করা উচিত।

তুমি এ সময়ে এসেছ, এটাই আমার জন্য বড় কথা।

জীবনকে বাজি রেখে চলা একজন সর্বজন অপ্রিয় মানুষকে আর কী বলবে তুমি। তোমার মেয়েকে আগে দেখিনি, তার জন্য সামান্য উপহার।

উনিশ

ইঝোমির পরিবর্তনে অবাক হলেন মুরাসাকি। কিন্তু ইঝোমি ঝড়ের বেগে চলে যাওয়ায় তাকে পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। আরো কিছুক্ষণ আশা করেছিলেন।

কিছুদিন যেতে না যেতেই একটা দুঃসংবাদ এলো। ইঝোমির প্রেমিক প্রিন্স তামেতাকা মারা গেছেন। না, মহামারী কলেরায় আক্রান্ত হয়ে নয়, অদ্ভুত এক মৃত্যু হয়েছে তার। স্বপ্ন সঞ্চরণ রোগ ছিল তার, সে কথা আগেই জানা গেছে। এই মহামারীর মধ্যেও ঘুমন্ত অবস্থায় চোখ বন্ধ রেখে গভীর রাতে অন্ধকারের মধ্যে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে যান। স্বপ্ন সঞ্চরণে সাধারণত দিক-দিশে ঠিক থাকে, চৈতন্য বিলোপ হয় না। তাই ঘুমন্ত মানুষটি ঠিক ঠিক ফিরে আসতে পারেন। কারো কারো প্রদীপ নিয়েও বের হতে এবং ফিরে আসতে দেখা যায়। প্রিন্স তামেতাকা এমনিতেই বের হয়ে পড়েন। বাতি নিয়ে বের হন না। সবাই ঘুমিয়ে গেলে বের হয়ে পড়েন তিনি।

কখনো কোনো সমস্যা হয় না। সেদিনই দুর্ঘটনা ঘটে গেল। পা জলে পড়ে গেলেন তিনি আর উঠতে পারলেন না। সকাল বেলায় তার মৃতদেহ জলাশয়ে ভাসতে দেখা গেল।

তামেতাকার বাবা প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেইকে প্রথম সংবাদটা পেলেন। ছুটে গেলেন তিনি। তার এই ছেলেকে তিনি অন্য ছেলে-মেয়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। তার কাছে এই ছেলের কোনো চাহিদা ছিল না। সাম্রাজ্যের সিংহাসন চাননি। নিজের মধ্যেই অবস্থান করতেন। তবে তার জ্ঞানস্পৃহা ছিল। জীবনকে নানাভাবে দেখতেন। অন্তরে প্রেম ছিল। কবিতা ভালোবাসতেন। তাই কবি ইঝোমিকে ভালোবেসে ফেলেন। তার ভালোবাসার প্রচ-তায় ইঝোমি স্বামী থাকা সত্ত্বেও তার প্রেমে পাগল হয়ে যান।

তামেতাকার মৃত্যু সংবাদে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন ইঝোমি। তার জীবনে অনেকবার ভালোবাসা এসেছে, কিন্তু এরকমভাবে কেউ তাকে নিঃস্ব করে ভালোবাসেনি। তাই তিনি স্বামী-সন্তান, বাবা-মা সবাইকে ছেড়েছেন এই ভালোবাসার জন্য। তাকে হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলেন।

তামেতাকার বাবা চিৎকার করে কাঁদলেন না, কিন্তু পর্বতপ্রতীম মানুষটির অন্তর পর্বত শৃঙ্গের মতই যেন ভূমিকম্পের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। হাত-হুতাশে যেন খ- খ- পাথর ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। বললেন, পৃথিবীর নিয়ম পিতাপুত্রের কাঁদে চড়ে সমাধির দিকে যায় শেষ ঠিকানায়। কী দুর্ভাগ্য আমার তোমার লাশ বয়ে নিয়ে আমি সমাধিস্থলে যাব। তুমি জানো সন্তানের লাশ পিতার কাঁধে কত দুর্বহ, বিদীর্ণ অন্তরে এ শোক কত দুঃসহ। পুত্রশোকে সম্রাজ্ঞী চোশি (তোকো) বিলাপে আরো বিষাদঘন করে তুললেন পরিবেশ। হায় পুত্র। হায় তামেতাকা। মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন। কত যতেœ তোকে লালন করেছি, ভুলে গেছি রাতের ঘুম, স্বপ্ন দেখার সুখ। সম্রাটের মাতা হব আমি, সম্রাজ্ঞীর শাশুড়ি, এই ছিল আশা। তুই সম্রাট হতে গেলি না, না চাইলি সাম্রাজ্য। তাতেও সুখ ছিল আমার। কী কারণে স্বপ্ন সঞ্চরণে বের হলি অন্ধকার রাত দুপুরে। কালমৃত্যু সেখানেই অপেক্ষা করছিল?

চতুর্থ স্ত্রী ফুশি টেনে নিয়ে গেলেন তাকে পদ-পদবির কথা ভেবে। বললেন, পুত্র আপনার সকলের প্রিয় ছিল, আমরাও স্নেহের চোখে দেখতাম। ত্যাগের দৃষ্টিতে দেকুন বোন, যে শিক্ষা বৌদ্ধ ধর্ম দিয়ে থাকে। হ্যাঁ ত্যাগেই মুক্তি। ত্যাগেই শান্তি।

সম্রাট রেইঝেই বললেন, আমার এই সম্রাটতনয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং সমাধি হবে রাজকীয় রীতি মেনে। সম্রাটনন্দন অতসুমিচি যাবতীয় ব্যবস্থা করো।

প্রিন্স তামেতাকার মৃত্যু কলেরায় নয়। অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তার। তাই রাজকীয় রীতি মেনে তাকে সমাধিস্ত করা হবে।

বৌদ্ধরীতিতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হবে। তাই প্রথমেই মৃতের ঠোঁট পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া হলো। বাইরের অপবিত্র অপশক্তির চোখের আড়াল করার জন্য গৃহ শ্রাইন বন্ধ ও সাদাবস্ত্র দ্বারা ঘিরে রাখা হলো। তাকে বলা হয় কামিদানা ফুজি। একটি সাজানো টেবিলে ফুল, ধূপ এবং একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে মৃত্যুর বিছানায় রাখা হলো। অপশক্তির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য মৃতের বুকে রাখা হলো একটি ধারালো ছুরি।

রাজকীয় প্যাগোডায় সংবাদ পাঠানো হয়েছে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এখানেই সম্পন্ন হবে। শরীর ধুয়ে তুলো দিয়ে নাক ও কান বন্ধ করা হয়েছে। কালো কিমোনো পরাবার পর মুখম-লে সামান্য মেকআপ করা হলো। একটি শবাধারে রেখে শবদেহের পাশে একটি সাদা কিমোনো, সেন্ডেল, ছয়টি মুদ্রা এবং তার পছন্দের জিনিসপত্র রাখা হলো। ছয়টি মুদ্রা রাখার কারণ হলো লোক বিশ্বাস তিনটা নদী তাকে পাড়ি দিতে হবে এই পয়সায়।

লাশের মাথা রাখা হয়েছে উত্তর দিকে। প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই ব্যক্তিগতভাবে সবকিছু দেখভাল করছেন। বৌদ্ধভিক্ষু সূত্র পাঠ করছেন। সমস্যা দেখা দিল মরদেহ পোড়ানো হবে নাকি করব দেয়া হবে এ নিয়ে। হেইয়ান জাপানে, বিশেষ করে হেইয়ানকিউতে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। শবদেহ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পুড়িয়ে ফেলার পক্ষে। শিন্টু ধর্মের লোকেরা প্রাচীনপন্থি, তারা কবর দিতে চায়। মধ্যপন্থিরা মরদেহে সামান্য অগ্নিসংযোগ করেই পূর্ণদেহ সমাধিস্থ করছে। তারা উভয়ধর্ম ও প্রচলিত ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে বিশ্বাসী। প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই এই দলে (তবে বতর্মানে জীবিত সম্রাট আকিহিতো এবং সম্রাজ্ঞী তাদের শবদেহ সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলার নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। কারণ সম্রাটদের সমাধিতে স্থানাভাব দেখা দিয়েছে)।

যথাযোগ্য মর্যাদায় ধর্মীয় এবং প্রচলিত সংস্কার ও ঐতিহ্য অনুসরণ করে ৪৯ দিনের নানা নিয়ম মেনে তামেতাকার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়ে গেল।

কবি ইঝোমি শিকিবু কালো কিমোনো পরিধান করে মরদেহে ফুল দেয়া থেকে সকল অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এখানে তিনি বড় একা। শুধু সম্রাট রেইঝেইয়ের মধ্যে তার জন্য কিছুটা জায়গা আছে। তিনিই তাকে অনুষ্ঠানগুলোয় থাকার জায়গা করে দিয়েছেন।

প্রাক্তন সম্রাজ্ঞী চোশি তাকে সহ্য করতে পারছেন না। তার ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ, ইঝোমি প্রাসাদে একসঙ্গে থাকাকালে কী করে প্রিন্স প্রাসাদ থেকে বের হয়ে যান।

রেইঝেই বললেন, ঘুম আর মৃত্যু সমান। তাকে কেন দোষ দিচ্ছ তোকো? গভীর রাতে তার জেগে থাকার কথা নয়।

তাই বলে একটুও টের পাবে না। সে তো জানে প্রিন্সের এই সমস্যা রয়েছে।

তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যেভাবে প্রিন্সের মৃত্যু লেখা ছিল তাই হয়েছে।

ইঝোমি তার কন্যাকে নিয়ে প্রাসাদ ছাড়তে উদ্যোগী হলেন। মনকে শক্ত করলেন।

রেইঝেইকে বলতেই তিনি বললেন, তোমরা কোথায় যাবে?

আপাতত কবি আকাঝোমি ইমনের বাড়ি, সেখান থেকে অন্য কোথাও।

মা-বাবার বাড়ির দরজা আগে থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। একথা সম্রাট নিজেও জানেন। বললেন, না, তোমার কোথাও যাওয়া হবে না। তোমরা এখানেই থাকবে।

পিতৃস্থানীয় এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি রেইঝেইয়ের কথা তিনি ফেলতে পারলেন না। প্রাসাদেই রয়ে গেলেন।

ইমন মুরাসাকিকে নিয়ে ইঝোমিকে দেখতে এলেন। ইঝোমি শোকের কালো পোশাক কালো কিমোনো পরে আছেন। সুন্দর মুখ, ফ্যাকাসে এবং চোখের নিজে কালি পড়ে গেছে। চপল ও ফুটফুটে মেয়েটি একেবারে গম্ভীর হয়ে গেছে। চুল এলোমেলো, পোশাক পরিধানের ঠিক-ঠিকানা নেই। উদাসীনতা পুরোপুরি ভর করেছে। দুজনই তার পাশে এসে বসলেন। ইমন তার হাতটা টেনে নিয়ে বললেন, তোমাকে সান্ত¡না জানাবার ভাষা আমার নেই। তুমি এত ভেঙে পড়ো না, তোমার মেয়ের জন্য হলেও সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে হবে, বাঁচতে হবে।

মুরাসাকি বললেন, যত কঠিন আঘাতই আসুক তবু আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, এই হচ্ছে নিয়তি। আমি তো সেভাবেই বেঁচে আছি। একদিন তোমারও হয়ত জীবন স্বাভাবিক হয়ে আসবে তখনও পিছুটানটা, প্রিয়জনকে হারাবার বেদনাটা, যাবে না। তুমি সবকিছু সহ্য করার শক্তি লাভ কর, এটাই আমি চাই।

ইমন বললেন, আমি তোমাদের মত এতবড় আঘাত পাইনি, কিন্তু দুঃখ পেয়েছি। তোমরা জানো সে দুঃখের কথা। দুঃখ শুধু ধ্বংসই করে না সৃষ্টিও করতে সাহায্য করে। হয়ত দুঃখটা ভালোর জন্যই আসে। আমরা আগে তা বুঝি না। ইঝোমি একজন জীবনবাদী মানুষ। এরকম মানুষের জীবন এক জায়গায় আবদ্ধ হয়ে থাকে না, গতিশীল ও চলমান এবং তার বিস্তার নক্ষত্রের মতো, আলোয় আলোয়।

মুরাসাকি বললেন, ঠিক বলেছেন। ইঝোমি থেমে থাকার মানুষ না। এ আঘাতের পর সে আরো বেগবান হবে।

ইঝোমি আস্তে আস্তে বললেন, আপনারা এসেছেন আমার মন অনেক হালকা হয়ে গেছে। তাকাকুর বাড়িতে সেদিন গিয়ে বুঝতে পারিনি মৃত্যু কতটা ভয়াবহ শোক বয়ে আনে। প্রিয়জনদের মৃত্যু হলে আর বাঁচবার ইচ্ছেই হয় না। মরে যেতে ইচ্ছে হয়। তামেতাকা এমন এক মানুষ ছিলেন যার গুণ বলে শেষ করা যাবে না। আমাকে তিনি এতটা ঘনিষ্ঠ করে নেবেন ভাবতেও পারিনি। তিনি সত্যিকার অর্থেই ভালো বাসতে জানতেন, সম্মান করতেন এবং মর্যাদা দিতেন। একজন আত্মসচেতন নারীর জন্য আর কি চাই।

ইমন বললেন, ঠিকই বলেছ। এই হেইয়ান কিউতে নারীর জন্য এটাই বেশি দরকার।

একজন তামেতাকা আমাদের জন্য আদর্শ। এই আদর্শের অনুসারী হতে হেইয়ান কিউর এখনো অনেক বাকি। তার আরো বহু বছর বেঁচে থাকা উচিত ছিল। বললেন মুরাসাকি।

সম্রাট রেইঝেই তার এই পুত্রকে বেশি ভালোবাসতেন। তার খুব ইচ্ছে ছিল রাজকীয় ফুল ক্রাইসানথ্যমম প্রিন্সের শবাধারে শোভা পাবে। তিনি সংগ্রহ করতে পারেননি, সময়টা এ ফুল ফোটার সময় নয়; কিন্তু আমি পেলাম। সৌভাগ্যই বলতে হয়, আমি বোধহয় তার ইচ্ছা পূরণ করে প্রতিদানই দিতে পেরেছি। আর প্রিয় মানুষটিকে বিদায় বেলায় উপযুক্ত উপহারে ভূষিত করার দুর্লভ এক সুযোগ লাভ করেছি।

ইমন বললেন, সম্রাটকে কী প্রতিদান?

তিনি আমাকে এবং আমার মেয়েকে প্রাসাদে স্থান দিয়েছেন। প্রিন্স নেই, তবুও এখানে থাকতে স্নেহের হাত বাড়িয়েছেন। আমি আপনার বাড়িতে চলে যেতে চেয়েছিলাম, তিনি দিলেন না।

শ্রদ্ধা পাবার মতো ব্যক্তিত্ব তার। বললেন মুরাসাকি। ক্রমশ...

back to top