সানজিদা সিদ্দিকা
শহরের শেষাংশে যেখানে বলা চলে সহসা কোনো ভদ্রলোকেরা কিংবা যাদের একটু টাকাপয়সা বেশি আছে তারা সাধারণত এখানে বাস করে না। আমার নতুন চাকরি, বেতন বেশি না, তার উপর নতুন বিয়ে করেছি। বিয়ে অবশ্য যতোবারই করা হোক না কেন, প্রতিবার সেটা নতুনই হয়। তবে এটা আমার প্রথম বিয়ে। আপাতত রিমিকে নিয়ে পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের একেবারে পাঁচতলায় দুই রুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি। দিন ভালোই কাটছে এখানে। হঠাৎ একদিন রিমি বললো-
- শোভন, আমাদের ঘর হতে বের হবার সময় যে সিঁড়ি তার সামনে ছাদের সাথে ছোট্ট একটা রুমের মতো আছে। ঠিক রুম বলা যায় না ওটাকে। তুমি কি সেটা দেখেছো?
- হ্যাঁ, দেখেছি। অন্ধকার একটা জায়গা। বাড়িওয়ালা মনে হয় ওখানে পুত্তিকা পালেন। দেখো না, মাসের পাঁচ তারিখের পর ভাড়া দিতে দেরি হলে উনি এসে ওই রুম নাড়াচাড়া করেন আর সব পোষা পুত্তিকারা আমাদের ঘরে এসে গুন গুন করে কানের কাছে পুঁথি পাঠ করে জানান দেয়, ভাড়া দেয়ার সময় হয়েছে আর কতো দেরি করবে?
- ধুর! তোমার সবসময় সবকিছু নিয়েই ফাজলামি।
- আরে না! সিরিয়াসলি বলছি। শোনো, সবাই কিছু না কিছু পালে কিংবা পোষে। সেই সব পালিত জিনিসগুলো ঠিক সময়ে সুযোগ বুঝে কাজে লাগায়।
- আমি তোমাকে কী বলতে চাইলাম আর তুমি কোনদিকে চলে যাচ্ছো কথার এবড়েখেবড়ো রাস্তা ধরে।
- নাহ! আর যাচ্ছি না। এই যাও ব্রেক কষলাম। বলো, কী বলবে?
- সিঁড়ির কাছে যে রুমটার কথা বলছিলাম ওখানে বাড়িওয়ালা কিছু আজেবাজে ফেলনা জিনিস রেখে দিয়েছেন। ওনাকে বলে আমরা যদি রুমটা কাজে লাগাই তবে কেমন হয় বলো?
- মাথা খারাপ! তুমি কি আমাকে ওই রুম ভাড়া নিতে বলছো?
- আরে না না! ভাড়া নয়। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। বাড়িওয়ালাকে ভালো মতো বুঝিয়ে রাজি করাতে পারলে ওখানে আমরা কিছু দেশি মুরগি পালবো।
- তা মুরগি পালার জন্য বাড়িওয়ালা তোমাকে কেন খালি খালি ওটা দিবেন ওনার লাভ ছাড়া?
- আহা! লাভ যে ওনার হবে না তা কে বললো? লাভ তো হবেই। উনি প্রতি মাসে একটা দেশি মুরগি পাবেন আর মাঝে মাঝে ডিম। এখন এ বাজারে দেশি মুরগি আর তার ডিম পাওয়া বেশ টাকার বিষয়। আর আমি যদি এভাবে মুরগিগুলো পালতে পারি তবে আমার সময়ও ভালো কাটবে পাশাপাশি মুরগিগুলোও একটা খোলা ছাদে ঘোরার সুযোগ পাবে।
- হা হা হা, বন্দিকে ঘোরার সুযোগ দেয়াটা বেশ মজার, তাই না রিমি? আচ্ছা দেখি কাল কথা বলবো বাড়িওয়ালার সাথে।
এমন সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলো আর সেই সাথে ভাবনায় ছেদ পড়লো। আজকাল খুব ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। শহরে মেয়র নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ফেরার সময় দেখলাম প্রার্থী দোকানগুলোতে ভোট চাইছেন। এই এলাকার সকল সমস্যার সমাধান করবেন তার অঙ্গীকার করছেন ভোটারদের কাছে। আর ভোটাররাও তাকে সমর্থন জানাচ্ছেন। ভোট চাওয়ার কথা শুনেই রিমি গটগট করে বলে উঠলো, “আসুক এখানে, আমার বাড়ির দরজায়, শুনিয়ে দিবো কিছু কথা। ঠিক মতো পানি থাকে না, বিদ্যুৎ থাকে না, একটু বৃষ্টিতেই রাস্তায় পানি জমে যায়। তখন কাপড় উঠিয়ে চলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আশেপাশের দোকানে বসে থাকা লোকগুলো তখন মেয়েদের পাগুলোকে আখ মনে করে। কাছে পেলেই যেনো পাগুলো চিবিয়ে রস বের করে খেতো। আসুক আমিও ছেড়ে দিবো না, বলবো সব কথা।”
পরদিন বাড়ি ভাড়া দেয়ার সময় বাড়িওয়ালাকে বুঝিয়ে বললাম মুরগি পালনের বিষয়টি এবং এতে যে তারও কিছু লাভ হবে সেটাও বোঝালাম। বাড়িওয়ালাও খুশি মনে রাজি হয়ে গেলো।
এরপর বাড়িতে মুরগি এলো। রিমি দিনের বেলা অনেকটা সময় মুরগির দেখভাল নিয়ে থাকে। সেদিন মুরগিগুলোর সাথে তাগড়া দেখে একটা মোরগ এনে যোগ করলাম। দু’দিন পার হলো কিন্তু মোরগের একটা ডাকও শুনলাম না। সকাল হলেই মোরগের ডাকেই ঘুম ভাঙার কথা, কিন্তু কোথায়? তার বদলে কাকের ডাকে ঘুম ভাঙে। এমনিতে সবই ঠিক আছে মোরগটা খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুরছে-ফিরছে কিন্তু কোনো হাক-ডাক নেই। এতো ভদ্র হলে তো সমস্যা। কোনো কিছু তার স্বভাবের বাইরে আচরণ করলে মনে হয় অস্বাভাবিক কিছু, তা না হলে প্রতিবন্ধী। কোনটা যে ভাববো তাও বুঝতে পারছি না। মানুষ হলে না হয় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে ওর পেটের কথা বের করে ফেলা যেতো, বেশ চিন্তায় পড়লাম। এই সমস্যা নিয়ে দিন পার হয়ে যাচ্ছে আমরাও মোরগটাকে বোবা ভেবে নিজেদের সান্ত¦না দিয়ে বেশ কাটিয়ে দিচ্ছি দিনগুলো।
সেদিন শুক্রবার সন্ধ্যাবেলায় আমি আর রিমি চা খাচ্ছি। এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে রিমি দরজা খুলে দিলো। মোজাম্মেল হক তার কিছু সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। ভোট চাইতে এসেছেন। আমার তখনই মনে পড়লো রিমির সেদিনের কথা। এই যাহ! সর্বনাশ, রিমিটা আবার কী না কী বলে বসে?
নাহ, ও বেশ শান্তই ছিলো। হক সাহেব বললেন, “ভাবি সবসময় আসা হয়ে ওঠে না আপনাদের খোঁজখবর নেয়ার জন্য। বুঝতেই পারেন জনগণের সেবায় ব্যস্ত থাকতে হয় সারাদিন। ভাবি, আপনাদের কষ্ট বুঝি। আপনারা মহিলারা বেশিরভাগ সময় রান্না ঘরে থাকেন। রান্নাঘরে ঘেমে নেয়ে যখন বাতাস খেতে আসেন আর তখনই যদি বিদ্যুৎ না থাকে রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। সত্যি কথা হলো, আমরা পুরুষ মানুষেরা বাইরে বাইরে থাকি আপনাদের কষ্ট তেমন বুঝি না। তবে ক্ষমা করবেন, ভাবি। এবার যদি একটা সুযোগ এই অধমকে দেন কথা দিচ্ছি ঘর সবসময় উজালা থাকবে। সবসময় শীতল বাতাসে জুড়াবে পরাণ। গতবার এলাকায় যে সব উন্নয়মূলক কাজ শেষ করতে পারিনি এবার আপনারা সুযোগ দিলে সেই কাজগুলো শেষ করবো, কথা দিলাম।”
এসব কথা বলার সময় হক সাহেবের সাথে থাকা একটি ছেলে চিৎকার করে উঠলো কে যেন পায়ে আঁচড় দিয়েছে। ছেলেটি বললো, “ভাই, এইখানে কী জ্বীন পালে, কিসে আঁচড় দিলো।” রিমি মুচকি মুচকি হেসে জবাব দিলো, “আসলে আমি এখানে কিছু দেশি মুরগি পালছি।”
হক সাহেব শুনে বললেন, “বাহ! খুবই ভালো কথা। ভাবি একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। আপনার মতো সবাই যদি এভাবে ফেলনা জায়গাগুলো কাজে লাগাতো তবে আমাদের আমাদের সমাজ ও দেশ বদলে যেতে।”
হক সাহেবের কথাগুলো শুনে রিমির যে বেশ ভালোই লাগছিলো। আমি ঘরে বসেই দরজায় দাঁড়ানো রিমির প্রফুল্ল মুখ দেখে তা বুঝতে পারছিলাম।
হঠাৎ হক সাহেব তার এক সাগরেদকে বললো, “এই মিজান, যা তো নিচের দোকান থেকে ২০ ওয়াটের ভালো মানের একটি এলইডি বাল্ব নিয়ে আয়। ভাবির মুরগির অন্ধকার ঘরে লাগিয়ে দেই। হক সাহেব রিমিকে বোঝাতে লাগলেন, “ভাবি, অন্ধকারে কেন এই অবলা জীবগুলোরে রেখেছেন। ওদেরও তো আলো দরকার। দেখবেন আলোর মুখ দেখলে ওরা আরো ভালো থাকবে তার উপর ডিম ফুটে বের হওয়া ছানাগুলোর জন্য পর্যাপ্ত আলো দরকার।”
রিমি এবার একটু লজ্জাই পেলো হক সাহেবের কথা শুনে। এরই মধ্যে মিজান বাল্ব নিয়ে হাজির। হক সাহেব মিজানকে বাল্বটা লাগিয়ে দিতে বললেন। বাল্বটা লাগানো হলো। আলোয় ভরে ওঠে চারপাশ। আর তখনই মোরগটি কক কক করে ডেকে উঠলো উচ্চৈঃস্বরে। ঠিক ভোর বেলা মোরগ যেমন ডাকে। রিমি বেশ উচ্ছ্বসিত আর আমি আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি রীতিমত অবাক হয়েছি। যাকে বোবা ভেবেছি সে কিনা আজ কৃত্রিম আলোয় নীরবতা ভাঙলো অথচ প্রতিদিন র্সূযের আলো ওই ঘরে পড়তো।
আলোতে মুরগিগুলো দেখে হক সাহেবও অনেক অবাক। তিনি বলেই বসলেন, “আরে ভাবি দেখছি একেবারে ফার্ম করে ফেলেছেন!”
হক সাহেবের কথা শুনে আর সেই সাথে এতদিন পর মোরগের ডাক শুনতে পেয়ে রিমি দুটি মুরগি বের করে মিজানের হাতে দিয়ে হক সাহেবকে বললো, “ভাই, এই মুরগি দুটো আপনাকে গিফট করলাম। কিছু মনে না করলে প্লিজ এ উপহার গ্রহণ করুন।”
হক সাহেবের মুখে পরিতুষ্টির হাসি। একজন ভোটারের মন গলাতে পেরেছেন। একটি ভোট অন্তত নিশ্চিত হলো। হাসিমাখা মুখ নিয়ে দলবল সাথে নিয়ে মোজাম্মেল হক চলে গেলেন।
রাস্তা হতে স্লোগান ভেসে আসছে... “যে এলাকায় মোজাম্মেল হক, উন্নয়ন ঠেকাতে পারবে না কোনো ঠক। আমরা আছি তোমার সাথে। এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো”
- রিমি দরজা লাগিয়ে ফিরে এলো। চা এতক্ষণে ঠা-া হয়ে গেছে। রিমির দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, কী হলো? তুমি না বলেছিলে, এবার ওরা আসলে অনেক কিছু বলবে, বলার বদলে উল্টো উপহার দিয়ে বিদায় দিলে!
- রিমি আমতা আমতা করে বললো, “হ্যাঁ, ভেবেছিলাম বলবো কিন্তু দেখলে তো ওনার কারণেই মোরগটা ডেকে উঠলো।”
- রিমির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম, দেখেছো রিমি আমাদের অবস্থা? ঠিক ওই নির্বোধ মোরগটির মতো। মিথ্যা আলোকে জেগে উঠি, সরব হই। হক সাহেবেরা খুশি হয় এরপর জিতে যায়।
সানজিদা সিদ্দিকা
বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১
শহরের শেষাংশে যেখানে বলা চলে সহসা কোনো ভদ্রলোকেরা কিংবা যাদের একটু টাকাপয়সা বেশি আছে তারা সাধারণত এখানে বাস করে না। আমার নতুন চাকরি, বেতন বেশি না, তার উপর নতুন বিয়ে করেছি। বিয়ে অবশ্য যতোবারই করা হোক না কেন, প্রতিবার সেটা নতুনই হয়। তবে এটা আমার প্রথম বিয়ে। আপাতত রিমিকে নিয়ে পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের একেবারে পাঁচতলায় দুই রুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি। দিন ভালোই কাটছে এখানে। হঠাৎ একদিন রিমি বললো-
- শোভন, আমাদের ঘর হতে বের হবার সময় যে সিঁড়ি তার সামনে ছাদের সাথে ছোট্ট একটা রুমের মতো আছে। ঠিক রুম বলা যায় না ওটাকে। তুমি কি সেটা দেখেছো?
- হ্যাঁ, দেখেছি। অন্ধকার একটা জায়গা। বাড়িওয়ালা মনে হয় ওখানে পুত্তিকা পালেন। দেখো না, মাসের পাঁচ তারিখের পর ভাড়া দিতে দেরি হলে উনি এসে ওই রুম নাড়াচাড়া করেন আর সব পোষা পুত্তিকারা আমাদের ঘরে এসে গুন গুন করে কানের কাছে পুঁথি পাঠ করে জানান দেয়, ভাড়া দেয়ার সময় হয়েছে আর কতো দেরি করবে?
- ধুর! তোমার সবসময় সবকিছু নিয়েই ফাজলামি।
- আরে না! সিরিয়াসলি বলছি। শোনো, সবাই কিছু না কিছু পালে কিংবা পোষে। সেই সব পালিত জিনিসগুলো ঠিক সময়ে সুযোগ বুঝে কাজে লাগায়।
- আমি তোমাকে কী বলতে চাইলাম আর তুমি কোনদিকে চলে যাচ্ছো কথার এবড়েখেবড়ো রাস্তা ধরে।
- নাহ! আর যাচ্ছি না। এই যাও ব্রেক কষলাম। বলো, কী বলবে?
- সিঁড়ির কাছে যে রুমটার কথা বলছিলাম ওখানে বাড়িওয়ালা কিছু আজেবাজে ফেলনা জিনিস রেখে দিয়েছেন। ওনাকে বলে আমরা যদি রুমটা কাজে লাগাই তবে কেমন হয় বলো?
- মাথা খারাপ! তুমি কি আমাকে ওই রুম ভাড়া নিতে বলছো?
- আরে না না! ভাড়া নয়। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। বাড়িওয়ালাকে ভালো মতো বুঝিয়ে রাজি করাতে পারলে ওখানে আমরা কিছু দেশি মুরগি পালবো।
- তা মুরগি পালার জন্য বাড়িওয়ালা তোমাকে কেন খালি খালি ওটা দিবেন ওনার লাভ ছাড়া?
- আহা! লাভ যে ওনার হবে না তা কে বললো? লাভ তো হবেই। উনি প্রতি মাসে একটা দেশি মুরগি পাবেন আর মাঝে মাঝে ডিম। এখন এ বাজারে দেশি মুরগি আর তার ডিম পাওয়া বেশ টাকার বিষয়। আর আমি যদি এভাবে মুরগিগুলো পালতে পারি তবে আমার সময়ও ভালো কাটবে পাশাপাশি মুরগিগুলোও একটা খোলা ছাদে ঘোরার সুযোগ পাবে।
- হা হা হা, বন্দিকে ঘোরার সুযোগ দেয়াটা বেশ মজার, তাই না রিমি? আচ্ছা দেখি কাল কথা বলবো বাড়িওয়ালার সাথে।
এমন সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলো আর সেই সাথে ভাবনায় ছেদ পড়লো। আজকাল খুব ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। শহরে মেয়র নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ফেরার সময় দেখলাম প্রার্থী দোকানগুলোতে ভোট চাইছেন। এই এলাকার সকল সমস্যার সমাধান করবেন তার অঙ্গীকার করছেন ভোটারদের কাছে। আর ভোটাররাও তাকে সমর্থন জানাচ্ছেন। ভোট চাওয়ার কথা শুনেই রিমি গটগট করে বলে উঠলো, “আসুক এখানে, আমার বাড়ির দরজায়, শুনিয়ে দিবো কিছু কথা। ঠিক মতো পানি থাকে না, বিদ্যুৎ থাকে না, একটু বৃষ্টিতেই রাস্তায় পানি জমে যায়। তখন কাপড় উঠিয়ে চলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আশেপাশের দোকানে বসে থাকা লোকগুলো তখন মেয়েদের পাগুলোকে আখ মনে করে। কাছে পেলেই যেনো পাগুলো চিবিয়ে রস বের করে খেতো। আসুক আমিও ছেড়ে দিবো না, বলবো সব কথা।”
পরদিন বাড়ি ভাড়া দেয়ার সময় বাড়িওয়ালাকে বুঝিয়ে বললাম মুরগি পালনের বিষয়টি এবং এতে যে তারও কিছু লাভ হবে সেটাও বোঝালাম। বাড়িওয়ালাও খুশি মনে রাজি হয়ে গেলো।
এরপর বাড়িতে মুরগি এলো। রিমি দিনের বেলা অনেকটা সময় মুরগির দেখভাল নিয়ে থাকে। সেদিন মুরগিগুলোর সাথে তাগড়া দেখে একটা মোরগ এনে যোগ করলাম। দু’দিন পার হলো কিন্তু মোরগের একটা ডাকও শুনলাম না। সকাল হলেই মোরগের ডাকেই ঘুম ভাঙার কথা, কিন্তু কোথায়? তার বদলে কাকের ডাকে ঘুম ভাঙে। এমনিতে সবই ঠিক আছে মোরগটা খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুরছে-ফিরছে কিন্তু কোনো হাক-ডাক নেই। এতো ভদ্র হলে তো সমস্যা। কোনো কিছু তার স্বভাবের বাইরে আচরণ করলে মনে হয় অস্বাভাবিক কিছু, তা না হলে প্রতিবন্ধী। কোনটা যে ভাববো তাও বুঝতে পারছি না। মানুষ হলে না হয় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে ওর পেটের কথা বের করে ফেলা যেতো, বেশ চিন্তায় পড়লাম। এই সমস্যা নিয়ে দিন পার হয়ে যাচ্ছে আমরাও মোরগটাকে বোবা ভেবে নিজেদের সান্ত¦না দিয়ে বেশ কাটিয়ে দিচ্ছি দিনগুলো।
সেদিন শুক্রবার সন্ধ্যাবেলায় আমি আর রিমি চা খাচ্ছি। এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে রিমি দরজা খুলে দিলো। মোজাম্মেল হক তার কিছু সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। ভোট চাইতে এসেছেন। আমার তখনই মনে পড়লো রিমির সেদিনের কথা। এই যাহ! সর্বনাশ, রিমিটা আবার কী না কী বলে বসে?
নাহ, ও বেশ শান্তই ছিলো। হক সাহেব বললেন, “ভাবি সবসময় আসা হয়ে ওঠে না আপনাদের খোঁজখবর নেয়ার জন্য। বুঝতেই পারেন জনগণের সেবায় ব্যস্ত থাকতে হয় সারাদিন। ভাবি, আপনাদের কষ্ট বুঝি। আপনারা মহিলারা বেশিরভাগ সময় রান্না ঘরে থাকেন। রান্নাঘরে ঘেমে নেয়ে যখন বাতাস খেতে আসেন আর তখনই যদি বিদ্যুৎ না থাকে রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। সত্যি কথা হলো, আমরা পুরুষ মানুষেরা বাইরে বাইরে থাকি আপনাদের কষ্ট তেমন বুঝি না। তবে ক্ষমা করবেন, ভাবি। এবার যদি একটা সুযোগ এই অধমকে দেন কথা দিচ্ছি ঘর সবসময় উজালা থাকবে। সবসময় শীতল বাতাসে জুড়াবে পরাণ। গতবার এলাকায় যে সব উন্নয়মূলক কাজ শেষ করতে পারিনি এবার আপনারা সুযোগ দিলে সেই কাজগুলো শেষ করবো, কথা দিলাম।”
এসব কথা বলার সময় হক সাহেবের সাথে থাকা একটি ছেলে চিৎকার করে উঠলো কে যেন পায়ে আঁচড় দিয়েছে। ছেলেটি বললো, “ভাই, এইখানে কী জ্বীন পালে, কিসে আঁচড় দিলো।” রিমি মুচকি মুচকি হেসে জবাব দিলো, “আসলে আমি এখানে কিছু দেশি মুরগি পালছি।”
হক সাহেব শুনে বললেন, “বাহ! খুবই ভালো কথা। ভাবি একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। আপনার মতো সবাই যদি এভাবে ফেলনা জায়গাগুলো কাজে লাগাতো তবে আমাদের আমাদের সমাজ ও দেশ বদলে যেতে।”
হক সাহেবের কথাগুলো শুনে রিমির যে বেশ ভালোই লাগছিলো। আমি ঘরে বসেই দরজায় দাঁড়ানো রিমির প্রফুল্ল মুখ দেখে তা বুঝতে পারছিলাম।
হঠাৎ হক সাহেব তার এক সাগরেদকে বললো, “এই মিজান, যা তো নিচের দোকান থেকে ২০ ওয়াটের ভালো মানের একটি এলইডি বাল্ব নিয়ে আয়। ভাবির মুরগির অন্ধকার ঘরে লাগিয়ে দেই। হক সাহেব রিমিকে বোঝাতে লাগলেন, “ভাবি, অন্ধকারে কেন এই অবলা জীবগুলোরে রেখেছেন। ওদেরও তো আলো দরকার। দেখবেন আলোর মুখ দেখলে ওরা আরো ভালো থাকবে তার উপর ডিম ফুটে বের হওয়া ছানাগুলোর জন্য পর্যাপ্ত আলো দরকার।”
রিমি এবার একটু লজ্জাই পেলো হক সাহেবের কথা শুনে। এরই মধ্যে মিজান বাল্ব নিয়ে হাজির। হক সাহেব মিজানকে বাল্বটা লাগিয়ে দিতে বললেন। বাল্বটা লাগানো হলো। আলোয় ভরে ওঠে চারপাশ। আর তখনই মোরগটি কক কক করে ডেকে উঠলো উচ্চৈঃস্বরে। ঠিক ভোর বেলা মোরগ যেমন ডাকে। রিমি বেশ উচ্ছ্বসিত আর আমি আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি রীতিমত অবাক হয়েছি। যাকে বোবা ভেবেছি সে কিনা আজ কৃত্রিম আলোয় নীরবতা ভাঙলো অথচ প্রতিদিন র্সূযের আলো ওই ঘরে পড়তো।
আলোতে মুরগিগুলো দেখে হক সাহেবও অনেক অবাক। তিনি বলেই বসলেন, “আরে ভাবি দেখছি একেবারে ফার্ম করে ফেলেছেন!”
হক সাহেবের কথা শুনে আর সেই সাথে এতদিন পর মোরগের ডাক শুনতে পেয়ে রিমি দুটি মুরগি বের করে মিজানের হাতে দিয়ে হক সাহেবকে বললো, “ভাই, এই মুরগি দুটো আপনাকে গিফট করলাম। কিছু মনে না করলে প্লিজ এ উপহার গ্রহণ করুন।”
হক সাহেবের মুখে পরিতুষ্টির হাসি। একজন ভোটারের মন গলাতে পেরেছেন। একটি ভোট অন্তত নিশ্চিত হলো। হাসিমাখা মুখ নিয়ে দলবল সাথে নিয়ে মোজাম্মেল হক চলে গেলেন।
রাস্তা হতে স্লোগান ভেসে আসছে... “যে এলাকায় মোজাম্মেল হক, উন্নয়ন ঠেকাতে পারবে না কোনো ঠক। আমরা আছি তোমার সাথে। এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো”
- রিমি দরজা লাগিয়ে ফিরে এলো। চা এতক্ষণে ঠা-া হয়ে গেছে। রিমির দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, কী হলো? তুমি না বলেছিলে, এবার ওরা আসলে অনেক কিছু বলবে, বলার বদলে উল্টো উপহার দিয়ে বিদায় দিলে!
- রিমি আমতা আমতা করে বললো, “হ্যাঁ, ভেবেছিলাম বলবো কিন্তু দেখলে তো ওনার কারণেই মোরগটা ডেকে উঠলো।”
- রিমির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম, দেখেছো রিমি আমাদের অবস্থা? ঠিক ওই নির্বোধ মোরগটির মতো। মিথ্যা আলোকে জেগে উঠি, সরব হই। হক সাহেবেরা খুশি হয় এরপর জিতে যায়।