ধারাবাহিক উপন্যাস : উনিশ
আবুল কাসেম
পঁয়ত্রিশ.
প্রিন্স অতসুমিচি যে কবিতা পাঠিয়েছেন, তা যেন কাটাঘাঁয়ে নুনের ছিটা। কবিতাটি এ রকম :
এটা হতে দাও
আমি সৈকতের দিকে তাকাব না-
নাবিকের ছোট নৌকা দাঁড় বেয়ে চলে গেছে।
কবিতাটি পাঠ করে ইঝোমির অন্তর জ্বলে গেল। এত দীর্ঘ প্রতীক্ষার এই প্রতিফল। ইঝোমি রেগে মেগে লিখলেন, আপনি আমার সম্পর্কে অনুচ্চার্য কিছু শুনেছেন। আমি লাঞ্ছিত বোধ করছি। আর লিখতে পারা আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর। সম্ভবত এটিই আমার শেষ চিঠি।
সঙ্গে একটি কবিতা :
লক্ষ্যহীনতার ঠেস সরিয়ে ফেলুন
জ্বলন্ত হৃদয় এবং ঝলসানো হাতা নিয়ে
আমিই সে, যে ভেসে চলেছি নাবিকের নৌকায়।
সাতদিন পার হয়ে গেছে। এরই মধ্যে অনেকে তাঁর প্রেম প্রার্থনা করে পত্র লিখেছেন। এরা সবাই সম্ভ্রান্ত, ভদ্র ও মার্জিত ব্যক্তি। কিন্তু কেউ তাঁর অন্তর স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি ভেবেছিলেন প্রিন্স তাঁকে ভুলে গেছেন। অথচ তাঁর সুযোগ ছিল তাকে লেখার। তবে তাকে চমকে দিয়ে প্রিন্সের পত্র এলো। লিখেছেন :
হায়! আমি সেই হার্ডারগডের মত হয়ে উঠব
যিনি শুধু তাঁত বোনার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন
স্বর্গীয় নদীর ওপার থেকে।
ইঝোমি দেখলেন প্রিন্স যা-ই লিখুন না কেন, তাকে ভুলতে পারেননি, তাতেই তাঁর আনন্দ।
আমি সেই তীরের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারি না।
যেখানে হার্ডারগড অপেক্ষা করছেন।
প্রেমিক তারাকারাও আমাকে এড়িয়ে যেতে পারেন।
মহামান্য প্রিন্স তা পড়লেন এবং উপলব্ধি করলেন তিনি তাঁকে ত্যাগ করবেন না। অমাবস্যার কালে লিখলেন :
আমি খুব নিঃসঙ্গ। ইঝোমি লিখলেন :
আপনি জাগ্রত না তাই শুনতে পান না।
বাতাস দীর্ঘশ্বাস ফেলছে বাদ্যযন্ত্রে
কোনো রাত, কোনো এক শরতের রাতে।
যে পত্রবাহক কবিতাটি নিয়ে গিয়েছিল, সে-ই আসার সময় প্রিন্সের কাছ থেকে একটি পত্র নিয়ে এলো। তিনি লিখেছেন :
হে আমার প্রিয়তমা,
তুমি কেমন করে ভাবলে আমার ঘুম নির্বিঘ্ন?
দুশ্চিন্তায় আমি, শান্তিমতো ঘুমোতে পারি না।
বাতাস বাদ্যযন্ত্রের ওপর করছে আঘাত
আমি ঘুমোব না, কিন্তু শোনো
দীর্ঘশ্বাস আসলেই কি আমার হৃদয়কে শিহরিত করে?
প্রিন্স সিদ্ধান্তহীনতায় আছেন। দু’তিন দিন পর সন্ধ্যার দিকে অপ্রত্যাশিতভাবে ইঝোমির বাড়িতে এলেন। দিনের আলোয়ও তিনি প্রিন্সকে দেখেননি। তাই প্রিন্স বিব্রত। বললেনও তা। কিন্তু কেউ তাকে সহায়তা করতে এগিয়ে এলো না। তিনি তাড়াতাড়ি ফিরে গেলেন এবং মনের অবস্থা এমন হল যে দীর্ঘ সময় আর পত্র লিখলেন না।
প্রিন্স পারিবারিকভাবে চাপে আছেন। বাবা প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই তার স্ত্রীর কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে তাকে ডেকে পাঠিয়ে কঠোরভাবে সাবধান করে দিয়েছেন। মিচিনাগাও ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখছেন না। শুধু সম্রাটের সমসাময়িক এবং দরবারে আসা যাওয়া আছে বলে কিছু বলছেন না। এছাড়া ইঝোমিকেও বশে আনা সম্ভব হচ্ছে না। চোখে ঘুম নেই। তারপরও লুকিয়ে লুকিয়ে এখন যাওয়া আসা করেন পালকিতে। শকটে চড়া ছেড়ে দিয়েছেন। ফলাফল শূন্য। তাই তার ক্ষিপ্ত হবার সঙ্গত কারণ রয়েছে। মনে হয় একবার ছেড়ে চলে যাবেন আবার মনে হয় হৃদয় তা মানছে না। ছুটে আসেন কখনো, বলে কয়ে সংবাদ দিয়ে কখনো বা অপ্রত্যাশিতভাবে। ধৈর্য ধারণ করে অপেক্ষা না করে আবার ফিরে যান। ইঝোমির ওপর দোষারোপ করেন।
ইঝোমি যেন কিছু ভুলের জন্য ভাগ্যের হাতের পুতুল। অশেষ যন্ত্রণাবিদ্ধ। শুধু ছটপট করছেন। প্রিন্স চলে যাবার সংবাদে আবারো দারুণভাবে যন্ত্রণাবিদ্ধ। ভেবে ভেবে কষ্ট পেয়ে শেষতক প্রিন্সকে লিখলেন :
ক্লান্তিকর শরতের দিন, ইচ্ছের বাইরে টানছে
আপনার কাছ থেকে কোনো বার্তা নেই
মৃত্যুর নীরবতা।
পুরুষের প্রতিশ্রুতি মিষ্টি, কিন্তু কত পৃথক তার হৃদয়।
পত্র পেয়ে প্রিন্স লিখলেন,
যদিও দিন চলে যায়
অন্যেরা ভুলে যেতে পারে
আমি কখনো হারাতে পারি না সে স্মৃতি
সেই দেখা হওয়ার সন্ধ্যা
শরতের একটি দিন।
ইঝোমি এসবের অর্থ বোঝেন। নির্ভর করার মতো কেউ নেই। বাবা মা ত্যাজ্য করে দিয়েছেন। স্বামী তালাক দিয়েছেন। মেয়েটাকেও নিয়ে গেছেন। ভালোবাসা তাকে ভিখারি করেছে। তিনি নারী হয়েও একের পর একজনকে ভালোবেসে গেছেন। প্রেমতৃষ্ণ ভোগচিন্তা যেন তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও বাধা পেয়ে চেষ্টা করছেন নিজেকে অনিশ্চিত হিসাব নিকাশের মধ্যে জীবনের ভাবানুভূতির একটা বন্দর খুঁজে দিতে।
ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান
প্রেম এবং ভোগ তার কাছে অপরাধ নয়। আর একজনের কাছে তা বন্দি থাকবে কেন। পুরুষদের বেলায় তো নেই। মূল্যবোধের এ বৈষম্য বিচ্যুতি তিনি কেন মানবেন। তবুও ভাগ্যের কাছে যেন অসহায়, দুর্ভাগ্যপীড়িত। তাই ছুটে যান বুদ্ধের কাছে, প্যাগোডায়। সেখানে প্রায়ই যান। এক সপ্তাহ পর্যন্ত থেকে যান। আরাধনা করেন। হয়ত কিছু চান। ইহলৌকিক কী পারলৌকিক। যে ধর্ম ত্যাগের শিক্ষা দেয় তার কাছে কি চাওয়া। যে ধর্ম দুঃখকষ্টের কারণ লোভ লালসা এবং ভোগ-সম্ভোগ বলে জানে তার কাছে কী দীক্ষা। হয়ত আছে। প্রকাশ নেই। ইঝোমি আরাধনায়ও চোখবুজে বুদ্ধ নয় প্রিন্স অতসুমিচির কথাই ভাবেন। সূত্র পড়তে পড়তে তার স্মৃতিতে চলে যান।
মুরাসাকি-ইশিয়ামা টেম্পলে গেছেন। ইশিয়ামা ডেরায় গেলেই সেখানে যান। সেখানে ইঝোমির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তার। তার জানা ছিল না ইঝোমি টেম্পলে যেতে পারেন। তাই অবাকই হলেন। সূত্র পাঠান্তে কথা বললেন দুজন। চলে গেলেন বিওয়া লেকের ধারে।
ইঝোমির মানসিক পরিবর্তনের জন্য কোনো প্রশ্ন করলেন না। তবে প্রিন্স অতসুমিচির কথা জানতে চাইলেন।
ইঝোমি বললেন, আছেন তিনি তার মতো করে। দিতে পারেন না সকল শূন্য করে। দোটানায় আছেন। ভাগ্যও যেন খেলছে। তিনি আসেন তো আমি জানি না, ফিরে যান- এনিয়ে নানা অভিযোগ অনুযোগ, বলতে পার জীবনের শান্তিটা কোথায়?
তুমি যে পথ বেছে নিয়েছ, সে পথেই তোমাকে শান্তির ঠিকানা খুঁজতে হবে।
আমার পথটা কী ভুল?
তা আমি বলতে পারব না।
আমি বলতে পারব কেন তুমি বলতে পারবে না।
কেন? মুরাসাকি ভাবলেন বলবে, তিনি তার কোনো কাজকেই শৈশব থেকে সমর্থন করেননি। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ইঝোমি বললেন, তুমি তোমার উপন্যাসের নায়ক গেঞ্জিকেই তো সামলাতে পারছ না, আমাকে সংযমী হওয়ার কথা বলবে কী করে?
তুমি আমার লেখা পড়?
না পড়লে বললাম কী করে? প্রতিটা পর্বই পড়ছি, সকল স্ক্রলই আমার কাছে আছে। চমৎকার লাগছে।
আমি ভেবেছিলাম তুমি প্রিন্সকে নিয়েই মত্ত আছো। আমার ধারণা তুমি ভুল প্রমাণ করে দিলে। তোমার লেখালেখি চলছে তো? নাকি প্রেম করে করে একে বিদায় জানিয়েছ?
চলছে প্রিন্সের সঙ্গে মান-অভিমান, আর বিরহ বেদনার পত্র-কবিতা লেখালেখি করে। বলতে পার কবিতার ডায়েরি লিখে।
নিশ্চয়ই এ লেখারও মূল্য আছে। আজকে তোমাদের কাছে একদিন সকলের কাছে।
ইঝোমি বললেন, তুমি আবার বিয়ে করছ না কেন?
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, এমনিতেই ভালো আছি ইঝোমি। তুমিও ভালো থেকো।
শুনেছি তুমি ইশিয়ামা ডেরার স্বামীর বাড়িতেই থাকতে। টেরামাচি লেনে যাও না?
যাই। সেখানে নোবুনোরি আছে। তবে খুব কম যাওয়া হয়। সম্রাজ্ঞীকে বেশি সময় দিতে হয় বলে প্রাসাদেই থাকতে হয়। তোমার কি বাবার বাড়িটির কথা মনে হয়? ইঝোমি যেন তা ভুলে থাকতে চান তাই প্রসঙ্গান্তরে বললেন, সম্রাজ্ঞীকে কেমন লাগে? ইচড়ে পাকা না?
এখন কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছেন।
তুমি আছো, ইমন আছেন, ভালোই তো হলো।
তুমিও তো ছিলে, চলে এলে আর গেলে না।
প্রাসাদে বড় রাজকীয় চাপ, কেমন যেন একটা স্তব্ধ ভীতিকর অবস্থা, সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়।
মুরাসাকি বললেন, আমার কাছেও তাই মনে হয়।
ইঝোমি হঠাৎ করেই বলরেন, শোনাগনের অবস্থা কি?
তুমি জানো না? বিয়ে করেছে আবার। ফুজিওয়ারা আমলা স্বামী।
সে উচ্চাভিলাষী।
ঠিক ধরেছ। তবে তার স্বামীকে প্রদেশে বদলী করে দিয়েছেন সম্রাট।
নাম মুনেয়ো, ঠিক?
তুমি জানো কি করে?
প্রিন্স অতসুমিচির মুখে এনামটা শুনেছি। সে নাকি তদ্বিরে এসেছিল।
আচ্ছা। চেষ্টা কম করেনি না যাওয়ার জন্য।
সে অহংকারী, উচ্চাভিলাষী, সুবিধাভোগী সন্দেহ নেই, তবে লেখে ভালো। দেখবে তার লেখাও কালোত্তীর্ণ হবে।
মুরাসাকি বললেন, আমারও তাই মনে হয়। সে যদি ব্যবহার ভালো করতো, অহংকার না দেখাতো, অন্যের ছিদ্রান্বেষণ না করতো, তাহলে নিঃসন্দেহে সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠতো, শ্রদ্ধার পাতও বনে যেতো।
আমার সঙ্গেও ঈর্ষামূলক আচরণ করেছে। সম্রাজ্ঞী তেইশিকে দিয়ে সম্রাটের কানভারী করিয়েছে। ভেবে দেখো ব্যাপারটা কত জঘন্য।
কিছুটা শুনেছি ইমনের কাছে। তোমাকে ভয় পেয়ে গিয়েছিল শুনে হাসি পাচ্ছে। শোশির দরবারে আর না যাওয়ার এটাও একটা কারণ। শোনাগনের আশঙ্কা ছিল আমি শোশির দরবারে থাকলে তার এবং তেইশির দরবার ভাবমূর্তি হারাবে।
এখন আমাকে নিয়ে সে শঙ্কা। বলতে গিয়েও একথা বললেন না মুরাসাকি। বললেন, আশঙ্কাটা ছিল অমূলক। যে যার মত থাকবে। আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি থাকলেই এমনটা হয়।
ঠিক বলেছ।
প্রসঙ্গান্তরে মুরাসাকি বললেন, তুমি কি প্রায়ই প্যাগোডায় আসো? কেমন লাগে ধর্ম-কর্ম।
মাঝে মধ্যে আসি। ভালোই লাগে।
শিন্টু শ্রাইনে যাও?
যাই, তবে খুব কম। এখানে সূত্র পড়তে ভালো লাগে তোমার?
বিওয়া লেকটার দিকে দেখো। মৎস্যজীবী মানুষগুলো কত কষ্ট করে মাছ ধরছে। এদের জীবন অনেক কঠিন তাই না?
ভালোই তো আছে। মৎস্য শিকারে আনন্দ আছে, নিজেরা খেতে পাওে, বিক্রয় করে অর্থ পায়।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। সাদামাটা জীবনই ভালো। তাদের বউ অভিজাত মানুষদের মতো বাবার বাড়িতে থাকে না, তাদের সঙ্গেই থাকে। আমাদের মতো দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় না যে স্বামী কার সঙ্গে রাতযাপন করছে। এ প্রথাটার অবসান হওয়া দরকার।
তুমি বলছ? বলে হাসলেন মুরাসাকি।
কেন তোমার মনে হয়নি? তাতে বহুগামিতার পথ উন্মুক্ত থাকে। কবিতায় অনেকের অনেক দীর্ঘশ্বাস আছে। কাগেরো নিক্কির কথা তো তুমিই বলেছিলে। কবিতা আর ডায়েরিতে হবে না, জায়গা কম, তুমি তোমার বিশাল মনোগাতারিতে সে দীর্ঘশ্বাসকে বড় করে জায়গা করে দাও, ইতিমধ্যে কিছু এসেছেও, আরো দাও। সমাজটাকে পাল্টো দাও। তাকাকু, সে শক্তি তোমার আছে বন্ধু।
এবারেও মুরাসাকি হাসলেন। প্যাগোডায় আহার্য গ্রহণের সময় হয়েছে। ঠিক সময় মতো ভান্তেদের (পুরোহিত) সঙ্গে আহার্য গ্রহণ করতে হয়। সূর্যের দিকে তাকিয়ে এরা উঠে গেলেন। লেকের কাছেই প্যাগোডাটা। যেতে বেশি সময় লাগবে না। ক্রমশ...
ধারাবাহিক উপন্যাস : উনিশ
আবুল কাসেম
বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১
পঁয়ত্রিশ.
প্রিন্স অতসুমিচি যে কবিতা পাঠিয়েছেন, তা যেন কাটাঘাঁয়ে নুনের ছিটা। কবিতাটি এ রকম :
এটা হতে দাও
আমি সৈকতের দিকে তাকাব না-
নাবিকের ছোট নৌকা দাঁড় বেয়ে চলে গেছে।
কবিতাটি পাঠ করে ইঝোমির অন্তর জ্বলে গেল। এত দীর্ঘ প্রতীক্ষার এই প্রতিফল। ইঝোমি রেগে মেগে লিখলেন, আপনি আমার সম্পর্কে অনুচ্চার্য কিছু শুনেছেন। আমি লাঞ্ছিত বোধ করছি। আর লিখতে পারা আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর। সম্ভবত এটিই আমার শেষ চিঠি।
সঙ্গে একটি কবিতা :
লক্ষ্যহীনতার ঠেস সরিয়ে ফেলুন
জ্বলন্ত হৃদয় এবং ঝলসানো হাতা নিয়ে
আমিই সে, যে ভেসে চলেছি নাবিকের নৌকায়।
সাতদিন পার হয়ে গেছে। এরই মধ্যে অনেকে তাঁর প্রেম প্রার্থনা করে পত্র লিখেছেন। এরা সবাই সম্ভ্রান্ত, ভদ্র ও মার্জিত ব্যক্তি। কিন্তু কেউ তাঁর অন্তর স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি ভেবেছিলেন প্রিন্স তাঁকে ভুলে গেছেন। অথচ তাঁর সুযোগ ছিল তাকে লেখার। তবে তাকে চমকে দিয়ে প্রিন্সের পত্র এলো। লিখেছেন :
হায়! আমি সেই হার্ডারগডের মত হয়ে উঠব
যিনি শুধু তাঁত বোনার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন
স্বর্গীয় নদীর ওপার থেকে।
ইঝোমি দেখলেন প্রিন্স যা-ই লিখুন না কেন, তাকে ভুলতে পারেননি, তাতেই তাঁর আনন্দ।
আমি সেই তীরের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারি না।
যেখানে হার্ডারগড অপেক্ষা করছেন।
প্রেমিক তারাকারাও আমাকে এড়িয়ে যেতে পারেন।
মহামান্য প্রিন্স তা পড়লেন এবং উপলব্ধি করলেন তিনি তাঁকে ত্যাগ করবেন না। অমাবস্যার কালে লিখলেন :
আমি খুব নিঃসঙ্গ। ইঝোমি লিখলেন :
আপনি জাগ্রত না তাই শুনতে পান না।
বাতাস দীর্ঘশ্বাস ফেলছে বাদ্যযন্ত্রে
কোনো রাত, কোনো এক শরতের রাতে।
যে পত্রবাহক কবিতাটি নিয়ে গিয়েছিল, সে-ই আসার সময় প্রিন্সের কাছ থেকে একটি পত্র নিয়ে এলো। তিনি লিখেছেন :
হে আমার প্রিয়তমা,
তুমি কেমন করে ভাবলে আমার ঘুম নির্বিঘ্ন?
দুশ্চিন্তায় আমি, শান্তিমতো ঘুমোতে পারি না।
বাতাস বাদ্যযন্ত্রের ওপর করছে আঘাত
আমি ঘুমোব না, কিন্তু শোনো
দীর্ঘশ্বাস আসলেই কি আমার হৃদয়কে শিহরিত করে?
প্রিন্স সিদ্ধান্তহীনতায় আছেন। দু’তিন দিন পর সন্ধ্যার দিকে অপ্রত্যাশিতভাবে ইঝোমির বাড়িতে এলেন। দিনের আলোয়ও তিনি প্রিন্সকে দেখেননি। তাই প্রিন্স বিব্রত। বললেনও তা। কিন্তু কেউ তাকে সহায়তা করতে এগিয়ে এলো না। তিনি তাড়াতাড়ি ফিরে গেলেন এবং মনের অবস্থা এমন হল যে দীর্ঘ সময় আর পত্র লিখলেন না।
প্রিন্স পারিবারিকভাবে চাপে আছেন। বাবা প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই তার স্ত্রীর কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে তাকে ডেকে পাঠিয়ে কঠোরভাবে সাবধান করে দিয়েছেন। মিচিনাগাও ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখছেন না। শুধু সম্রাটের সমসাময়িক এবং দরবারে আসা যাওয়া আছে বলে কিছু বলছেন না। এছাড়া ইঝোমিকেও বশে আনা সম্ভব হচ্ছে না। চোখে ঘুম নেই। তারপরও লুকিয়ে লুকিয়ে এখন যাওয়া আসা করেন পালকিতে। শকটে চড়া ছেড়ে দিয়েছেন। ফলাফল শূন্য। তাই তার ক্ষিপ্ত হবার সঙ্গত কারণ রয়েছে। মনে হয় একবার ছেড়ে চলে যাবেন আবার মনে হয় হৃদয় তা মানছে না। ছুটে আসেন কখনো, বলে কয়ে সংবাদ দিয়ে কখনো বা অপ্রত্যাশিতভাবে। ধৈর্য ধারণ করে অপেক্ষা না করে আবার ফিরে যান। ইঝোমির ওপর দোষারোপ করেন।
ইঝোমি যেন কিছু ভুলের জন্য ভাগ্যের হাতের পুতুল। অশেষ যন্ত্রণাবিদ্ধ। শুধু ছটপট করছেন। প্রিন্স চলে যাবার সংবাদে আবারো দারুণভাবে যন্ত্রণাবিদ্ধ। ভেবে ভেবে কষ্ট পেয়ে শেষতক প্রিন্সকে লিখলেন :
ক্লান্তিকর শরতের দিন, ইচ্ছের বাইরে টানছে
আপনার কাছ থেকে কোনো বার্তা নেই
মৃত্যুর নীরবতা।
পুরুষের প্রতিশ্রুতি মিষ্টি, কিন্তু কত পৃথক তার হৃদয়।
পত্র পেয়ে প্রিন্স লিখলেন,
যদিও দিন চলে যায়
অন্যেরা ভুলে যেতে পারে
আমি কখনো হারাতে পারি না সে স্মৃতি
সেই দেখা হওয়ার সন্ধ্যা
শরতের একটি দিন।
ইঝোমি এসবের অর্থ বোঝেন। নির্ভর করার মতো কেউ নেই। বাবা মা ত্যাজ্য করে দিয়েছেন। স্বামী তালাক দিয়েছেন। মেয়েটাকেও নিয়ে গেছেন। ভালোবাসা তাকে ভিখারি করেছে। তিনি নারী হয়েও একের পর একজনকে ভালোবেসে গেছেন। প্রেমতৃষ্ণ ভোগচিন্তা যেন তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও বাধা পেয়ে চেষ্টা করছেন নিজেকে অনিশ্চিত হিসাব নিকাশের মধ্যে জীবনের ভাবানুভূতির একটা বন্দর খুঁজে দিতে।
ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান
প্রেম এবং ভোগ তার কাছে অপরাধ নয়। আর একজনের কাছে তা বন্দি থাকবে কেন। পুরুষদের বেলায় তো নেই। মূল্যবোধের এ বৈষম্য বিচ্যুতি তিনি কেন মানবেন। তবুও ভাগ্যের কাছে যেন অসহায়, দুর্ভাগ্যপীড়িত। তাই ছুটে যান বুদ্ধের কাছে, প্যাগোডায়। সেখানে প্রায়ই যান। এক সপ্তাহ পর্যন্ত থেকে যান। আরাধনা করেন। হয়ত কিছু চান। ইহলৌকিক কী পারলৌকিক। যে ধর্ম ত্যাগের শিক্ষা দেয় তার কাছে কি চাওয়া। যে ধর্ম দুঃখকষ্টের কারণ লোভ লালসা এবং ভোগ-সম্ভোগ বলে জানে তার কাছে কী দীক্ষা। হয়ত আছে। প্রকাশ নেই। ইঝোমি আরাধনায়ও চোখবুজে বুদ্ধ নয় প্রিন্স অতসুমিচির কথাই ভাবেন। সূত্র পড়তে পড়তে তার স্মৃতিতে চলে যান।
মুরাসাকি-ইশিয়ামা টেম্পলে গেছেন। ইশিয়ামা ডেরায় গেলেই সেখানে যান। সেখানে ইঝোমির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তার। তার জানা ছিল না ইঝোমি টেম্পলে যেতে পারেন। তাই অবাকই হলেন। সূত্র পাঠান্তে কথা বললেন দুজন। চলে গেলেন বিওয়া লেকের ধারে।
ইঝোমির মানসিক পরিবর্তনের জন্য কোনো প্রশ্ন করলেন না। তবে প্রিন্স অতসুমিচির কথা জানতে চাইলেন।
ইঝোমি বললেন, আছেন তিনি তার মতো করে। দিতে পারেন না সকল শূন্য করে। দোটানায় আছেন। ভাগ্যও যেন খেলছে। তিনি আসেন তো আমি জানি না, ফিরে যান- এনিয়ে নানা অভিযোগ অনুযোগ, বলতে পার জীবনের শান্তিটা কোথায়?
তুমি যে পথ বেছে নিয়েছ, সে পথেই তোমাকে শান্তির ঠিকানা খুঁজতে হবে।
আমার পথটা কী ভুল?
তা আমি বলতে পারব না।
আমি বলতে পারব কেন তুমি বলতে পারবে না।
কেন? মুরাসাকি ভাবলেন বলবে, তিনি তার কোনো কাজকেই শৈশব থেকে সমর্থন করেননি। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ইঝোমি বললেন, তুমি তোমার উপন্যাসের নায়ক গেঞ্জিকেই তো সামলাতে পারছ না, আমাকে সংযমী হওয়ার কথা বলবে কী করে?
তুমি আমার লেখা পড়?
না পড়লে বললাম কী করে? প্রতিটা পর্বই পড়ছি, সকল স্ক্রলই আমার কাছে আছে। চমৎকার লাগছে।
আমি ভেবেছিলাম তুমি প্রিন্সকে নিয়েই মত্ত আছো। আমার ধারণা তুমি ভুল প্রমাণ করে দিলে। তোমার লেখালেখি চলছে তো? নাকি প্রেম করে করে একে বিদায় জানিয়েছ?
চলছে প্রিন্সের সঙ্গে মান-অভিমান, আর বিরহ বেদনার পত্র-কবিতা লেখালেখি করে। বলতে পার কবিতার ডায়েরি লিখে।
নিশ্চয়ই এ লেখারও মূল্য আছে। আজকে তোমাদের কাছে একদিন সকলের কাছে।
ইঝোমি বললেন, তুমি আবার বিয়ে করছ না কেন?
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, এমনিতেই ভালো আছি ইঝোমি। তুমিও ভালো থেকো।
শুনেছি তুমি ইশিয়ামা ডেরার স্বামীর বাড়িতেই থাকতে। টেরামাচি লেনে যাও না?
যাই। সেখানে নোবুনোরি আছে। তবে খুব কম যাওয়া হয়। সম্রাজ্ঞীকে বেশি সময় দিতে হয় বলে প্রাসাদেই থাকতে হয়। তোমার কি বাবার বাড়িটির কথা মনে হয়? ইঝোমি যেন তা ভুলে থাকতে চান তাই প্রসঙ্গান্তরে বললেন, সম্রাজ্ঞীকে কেমন লাগে? ইচড়ে পাকা না?
এখন কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছেন।
তুমি আছো, ইমন আছেন, ভালোই তো হলো।
তুমিও তো ছিলে, চলে এলে আর গেলে না।
প্রাসাদে বড় রাজকীয় চাপ, কেমন যেন একটা স্তব্ধ ভীতিকর অবস্থা, সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়।
মুরাসাকি বললেন, আমার কাছেও তাই মনে হয়।
ইঝোমি হঠাৎ করেই বলরেন, শোনাগনের অবস্থা কি?
তুমি জানো না? বিয়ে করেছে আবার। ফুজিওয়ারা আমলা স্বামী।
সে উচ্চাভিলাষী।
ঠিক ধরেছ। তবে তার স্বামীকে প্রদেশে বদলী করে দিয়েছেন সম্রাট।
নাম মুনেয়ো, ঠিক?
তুমি জানো কি করে?
প্রিন্স অতসুমিচির মুখে এনামটা শুনেছি। সে নাকি তদ্বিরে এসেছিল।
আচ্ছা। চেষ্টা কম করেনি না যাওয়ার জন্য।
সে অহংকারী, উচ্চাভিলাষী, সুবিধাভোগী সন্দেহ নেই, তবে লেখে ভালো। দেখবে তার লেখাও কালোত্তীর্ণ হবে।
মুরাসাকি বললেন, আমারও তাই মনে হয়। সে যদি ব্যবহার ভালো করতো, অহংকার না দেখাতো, অন্যের ছিদ্রান্বেষণ না করতো, তাহলে নিঃসন্দেহে সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠতো, শ্রদ্ধার পাতও বনে যেতো।
আমার সঙ্গেও ঈর্ষামূলক আচরণ করেছে। সম্রাজ্ঞী তেইশিকে দিয়ে সম্রাটের কানভারী করিয়েছে। ভেবে দেখো ব্যাপারটা কত জঘন্য।
কিছুটা শুনেছি ইমনের কাছে। তোমাকে ভয় পেয়ে গিয়েছিল শুনে হাসি পাচ্ছে। শোশির দরবারে আর না যাওয়ার এটাও একটা কারণ। শোনাগনের আশঙ্কা ছিল আমি শোশির দরবারে থাকলে তার এবং তেইশির দরবার ভাবমূর্তি হারাবে।
এখন আমাকে নিয়ে সে শঙ্কা। বলতে গিয়েও একথা বললেন না মুরাসাকি। বললেন, আশঙ্কাটা ছিল অমূলক। যে যার মত থাকবে। আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি থাকলেই এমনটা হয়।
ঠিক বলেছ।
প্রসঙ্গান্তরে মুরাসাকি বললেন, তুমি কি প্রায়ই প্যাগোডায় আসো? কেমন লাগে ধর্ম-কর্ম।
মাঝে মধ্যে আসি। ভালোই লাগে।
শিন্টু শ্রাইনে যাও?
যাই, তবে খুব কম। এখানে সূত্র পড়তে ভালো লাগে তোমার?
বিওয়া লেকটার দিকে দেখো। মৎস্যজীবী মানুষগুলো কত কষ্ট করে মাছ ধরছে। এদের জীবন অনেক কঠিন তাই না?
ভালোই তো আছে। মৎস্য শিকারে আনন্দ আছে, নিজেরা খেতে পাওে, বিক্রয় করে অর্থ পায়।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। সাদামাটা জীবনই ভালো। তাদের বউ অভিজাত মানুষদের মতো বাবার বাড়িতে থাকে না, তাদের সঙ্গেই থাকে। আমাদের মতো দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় না যে স্বামী কার সঙ্গে রাতযাপন করছে। এ প্রথাটার অবসান হওয়া দরকার।
তুমি বলছ? বলে হাসলেন মুরাসাকি।
কেন তোমার মনে হয়নি? তাতে বহুগামিতার পথ উন্মুক্ত থাকে। কবিতায় অনেকের অনেক দীর্ঘশ্বাস আছে। কাগেরো নিক্কির কথা তো তুমিই বলেছিলে। কবিতা আর ডায়েরিতে হবে না, জায়গা কম, তুমি তোমার বিশাল মনোগাতারিতে সে দীর্ঘশ্বাসকে বড় করে জায়গা করে দাও, ইতিমধ্যে কিছু এসেছেও, আরো দাও। সমাজটাকে পাল্টো দাও। তাকাকু, সে শক্তি তোমার আছে বন্ধু।
এবারেও মুরাসাকি হাসলেন। প্যাগোডায় আহার্য গ্রহণের সময় হয়েছে। ঠিক সময় মতো ভান্তেদের (পুরোহিত) সঙ্গে আহার্য গ্রহণ করতে হয়। সূর্যের দিকে তাকিয়ে এরা উঠে গেলেন। লেকের কাছেই প্যাগোডাটা। যেতে বেশি সময় লাগবে না। ক্রমশ...