alt

সাময়িকী

কথোপকথন

আব্দুলরাজাক গুরনাহ

অনুবাদ: সাগর সরকার

: সোমবার, ১৮ অক্টোবর ২০২১

এবছর সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ১১৮তম লেখক হিসেবে আবদুলরাজাক গুরনাহর নাম ঘোষণা করা হয়। ৭৩ বছর বয়সী গুরনাহ এখন পর্যন্ত মোট ১০টি উপন্যাস লিখেছেন। প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক বেন ইস্ট ২০১৭ সালে গুরনাহর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারে গুরনাহ তাঁর সেসময়ে প্রকাশিত উপন্যাস গ্রেভেল হার্ট নিয়ে কথা বলেছিলেন। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য ন্যাশনাল’ পত্রিকায়

এটা কিছুটা অবিশ্বাস্যই। সারাবিশ্ব যেখানে সার্বক্ষণিকভাবে যোগাযোগের মধ্যে রয়েছে, আবদুলরাজাক গুরনাহর মা মারা যাওয়ার চার দিন পর্যন্ত তিনি এই সংবাদ জানতে পারেননি। যখন তিনি জানতে পারেন, ততক্ষণে তার মায়ের ইসলামিক সংস্কৃতি অনুযায়ী শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল।

“এটি একদমই অনুচিত মনে হয়েছে আমার কাছে”। তিনি বলেন, “আমার জাঞ্জিবারে ফেরত যাওয়া উচিত ছিল। সেখানে গিয়ে শেষৃত্যানুষ্ঠান পালন করা কর্তব্য ছিল। কিন্তু তখন মোবাইল ফোন ছিল না। তাই বাড়িতে না যাওয়া পর্যন্ত জানতে পারিনি কিছুই।”

এই কঠিন অনুভূতিগুলোই ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে তার নতুন উপন্যাস ‘গ্রেভেল হার্ট’-এ। এটি তার নবম উপন্যাস। আগের আটটি উপন্যাসের মতোই এখানেও শরণার্থীদের অভিজ্ঞতা, সাংস্কৃতিক পরিচয় ও বিভিন্ন পরিবারের গল্প উঠে এসেছে।

গুরনাহর জীবনের বেদনাদয়ক এই অধ্যায়ের কথা উপন্যাসের পাতায় উঠে আসতে অনেক বছর সময় লেগেছে। মায়ের মৃত্যুর তারিখ বর্ননা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “অনেক বছর আগের কথা”। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র সেলিম ঠিক একইভাবে অনেক পরে তার মায়ের মুত্যুর কথা জানতে পারেন। তবে এই মৃত্যুটি উপন্যাসের খুবই ছোট একটি ঘটনা মাত্র, আসল কাহিনী গড়ে উঠেছে তার পরিবারের ভয়ংকর একটি রহস্যকে কেন্দ্র করে।

এতদিন পর কেন এ বিষয়ে লেখা, জানতে চাইলে গুরনাহ হেসে বলেন, “এভাবেই উপন্যাস লেখা হয়। কখনো কখনো চিন্তাগুলো পরিপূর্ণতা পেতে অনেক সময় লেগে যায়। আমি তখন আরেকটি উপন্যাস প্যারাডাইজ লেখা শুরু করি, এটি বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। ১০ বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে আমি আরো তিনটি বই বের করেছিলাম। ‘গ্রেভেল হার্ট’ শুরুতে ছোটগল্প ছিল যার বিষয়বস্তু ছিল একজন মায়ের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তারপর মনে হলো, এই গল্পের অনেকটাই এখনো লেখা বাকি। তখন এটিকে উপন্যাসে পরিণত করার চিন্তা আসলো। আসল কথা হলো আমি কিন্তু নিজেকে নিয়ে লিখছি না।”

অবশ্য লেখকের জীবনের সাথে উপন্যাসের সেলিমের কিছু মিল রয়েছে। সেলিমও গুরনাহর মতো কৈশোরে জাঞ্জিবার থেকে লন্ডনে এসেছিল। সেলিমও একইভাবে বিচ্ছিন্নতা, প্রতিকূলতা ও একাকীত্বের সম্মুখীন হয়েছিল।

গুনরাহর জীবনের এসকল অভিজ্ঞতা নির্দিষ্ট প্লট লাইন তৈরি না করে বরঞ্চ সেলিমের প্রতি কিছুটা সহানুভূতির সঞ্চার ঘটিয়েছে। উপন্যাসে দেখা যায়, সেলিমের বাবা জীবন থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে, সেলিমের মা অধিকাংশ সময়ই ঘরের বাইরে কাটায় একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে। সেলিমের চাচা তাকে প্রস্তাব দেয় জাঞ্জিবারের দূর্বিসহ জীবন থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার। কিন্তু সেলিম নিজের দেশ বা লন্ডনে কোথাও গিয়ে নিজের লজ্জা, অপরাধবোধ ও বিভ্রান্তির তীব্র অনুভূতি থেকে মুক্ত হতে পারে না।

“বড় হওয়ায় সময় সেলিমের মনে হতো এমন কিছু আছে যার জন্য তার লজ্জা পাওয়া উচিত। কিন্তু সেটি কি সে জানতো না।” বলছিলেন কেন্টারবিউরিতে নিজ বাসায় বসে ৬৮ বছর বয়সী লেখক গুনরাহ। “আমার মনে হয় অনেক পরিবারই এটা জানে কীভাবে অব্যক্ত সমস্যাগুলি জীবনে সংশয় নিয়ে আসে। এগুলো নিয়ে অনেকেই কথা বলার সাহস পায় না।”

“সে জানে যে কোনো খারাপ কিছু ঘটেছে। এটিই তার অস্থিরতার মূল কারণ। কিন্তু সে চেষ্টা করে জীবনে সঠিকভাবে চলার জন্য।”

গল্পের শেষে এসে সেলিম সেই ভয়ানক রহস্য উন্মোচন করে। কিন্তু রহস্য উন্মোচন ‘গ্রেভেল হার্ট’-এর সমাপ্তির মূল বিষয়বস্তু নয়। এর পর সেলিমের কী করা উচিত, এটাই মুখ্য বিষয়। তার কি জাঞ্জিবারে থেকে যাওয়া উচিত নাকি লন্ডনে যে জীবনের সূচনা করেছিল সেখানে ফিরে যাওয়া উচিত?

“যারা নিজের শেকড় ছেড়ে যায় তারাই বুঝতে পারে এই দ্বিধার কারণ” বলছিলেন গুনরাহ। “নিজের অভিজ্ঞতার কারণেই আমি জানি যে ‘আমার কোথায় থাকা উচিত’- এই প্রশ্নটি সঙ্কটের মুহূর্তে বারবার ফিরে আসে।”

গ্রেভেল হার্ট-এর চরিত্রেরা শেষমেশ কুয়ালালাপুর, ব্রাইটন ও দুবাইয়ের মতো ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় গিয়ে থিতু হয়। গুরনাহ ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ এবং গাল্ফ অঞ্চলের মধ্যকার ঐতিহাসিক সংযোগের উপর জোর দিতে আগ্রহী।

এটি মূলত সাহিত্য রচনা ও গল্প বলার সর্বজনীন ক্ষমতার পক্ষে তার যুক্তির অংশ, যেমনটা সবাই একজন ইংরেজির অধ্যাপকের কাছ থেকে আশা করে থাকে। যদিও অনেক পাঠক এই লেখাকে প্রাথমিকভাবে আবেগহীন সরল মনে করতে পারে। কিন্তু এটি একটি ইচ্ছাকৃত কৌশল, এই কৌশলের মাধ্যেমে লেখক সেলিমের ভেতরের অনুভূতিগুলোকে আরও বাস্তবিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সেলিম তার মাকে চিঠি পাঠানো নিয়ে যে দ্বিধায় থাকে, এর মাধ্যমে তার ভেতরের দুঃখ-কষ্ট আরো তীব্রভাবে প্রকাশ পায়।

“একদম তাই” বলেন গুনরাহ। “আপনি যখন ক্যাফেতে কারও সাথে কথা বলবেন, তখন তারা আপনাকে এমন কিছু সম্পর্কে বলবে না যা কিছুটা লজ্জাজনক।”

“এমনকি যেসব বন্ধুদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তাদের সাথেও সবসময় নিজের উদ্বেগের কথা মন খুলে বলা যায় না।”

“ব্যপারটা অনেকটা এরকম, আপনি কোথাও থাকেন কিন্তু সেটি আপনার নিজের বাড়ি নয়। আপনি নিজের গল্পগুলো, নিজের জীবনের দুঃখগুলো নিজের মনের ভেতরে লুকিয়ে রাখেন। আর চিঠিগুলি সেই কল্পনাপ্রসূত কথোপকথনের সুযোগ দেয় যা আপনি কখনো বলে উঠতে পারেননি।”

আবদুলরাজাক গুরনাহর সাথে উপন্যাসের, বই পড়ার ও পাঠকের সম্পর্কের যে সুন্দর ছবিটি দেখা যায়- জীবন নিয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত চলা কথোপকথন, একই রকম বাস্তব এবং কল্পনাপ্রসূত।

“একে অপরের কাছ থেকে শেখার একটা স্বাভাবিক উপায় রয়েছে যেটি আপনি উপন্যাসের মাধ্যমেও করতে পারবেন” তিনি বলেন।

“আমি পাঠকদের আনন্দ দিতে চাই, তার সাথে সাথে আমরা সবাই যেভাবে কোনোকিছু বুঝে থাকি সেই প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করতে চাই- প্রতিটি বইয়ের সাথে এক কদম করে সামনে এগিয়ে।”

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

কথোপকথন

আব্দুলরাজাক গুরনাহ

অনুবাদ: সাগর সরকার

সোমবার, ১৮ অক্টোবর ২০২১

এবছর সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ১১৮তম লেখক হিসেবে আবদুলরাজাক গুরনাহর নাম ঘোষণা করা হয়। ৭৩ বছর বয়সী গুরনাহ এখন পর্যন্ত মোট ১০টি উপন্যাস লিখেছেন। প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক বেন ইস্ট ২০১৭ সালে গুরনাহর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারে গুরনাহ তাঁর সেসময়ে প্রকাশিত উপন্যাস গ্রেভেল হার্ট নিয়ে কথা বলেছিলেন। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য ন্যাশনাল’ পত্রিকায়

এটা কিছুটা অবিশ্বাস্যই। সারাবিশ্ব যেখানে সার্বক্ষণিকভাবে যোগাযোগের মধ্যে রয়েছে, আবদুলরাজাক গুরনাহর মা মারা যাওয়ার চার দিন পর্যন্ত তিনি এই সংবাদ জানতে পারেননি। যখন তিনি জানতে পারেন, ততক্ষণে তার মায়ের ইসলামিক সংস্কৃতি অনুযায়ী শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল।

“এটি একদমই অনুচিত মনে হয়েছে আমার কাছে”। তিনি বলেন, “আমার জাঞ্জিবারে ফেরত যাওয়া উচিত ছিল। সেখানে গিয়ে শেষৃত্যানুষ্ঠান পালন করা কর্তব্য ছিল। কিন্তু তখন মোবাইল ফোন ছিল না। তাই বাড়িতে না যাওয়া পর্যন্ত জানতে পারিনি কিছুই।”

এই কঠিন অনুভূতিগুলোই ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে তার নতুন উপন্যাস ‘গ্রেভেল হার্ট’-এ। এটি তার নবম উপন্যাস। আগের আটটি উপন্যাসের মতোই এখানেও শরণার্থীদের অভিজ্ঞতা, সাংস্কৃতিক পরিচয় ও বিভিন্ন পরিবারের গল্প উঠে এসেছে।

গুরনাহর জীবনের বেদনাদয়ক এই অধ্যায়ের কথা উপন্যাসের পাতায় উঠে আসতে অনেক বছর সময় লেগেছে। মায়ের মৃত্যুর তারিখ বর্ননা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “অনেক বছর আগের কথা”। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র সেলিম ঠিক একইভাবে অনেক পরে তার মায়ের মুত্যুর কথা জানতে পারেন। তবে এই মৃত্যুটি উপন্যাসের খুবই ছোট একটি ঘটনা মাত্র, আসল কাহিনী গড়ে উঠেছে তার পরিবারের ভয়ংকর একটি রহস্যকে কেন্দ্র করে।

এতদিন পর কেন এ বিষয়ে লেখা, জানতে চাইলে গুরনাহ হেসে বলেন, “এভাবেই উপন্যাস লেখা হয়। কখনো কখনো চিন্তাগুলো পরিপূর্ণতা পেতে অনেক সময় লেগে যায়। আমি তখন আরেকটি উপন্যাস প্যারাডাইজ লেখা শুরু করি, এটি বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। ১০ বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে আমি আরো তিনটি বই বের করেছিলাম। ‘গ্রেভেল হার্ট’ শুরুতে ছোটগল্প ছিল যার বিষয়বস্তু ছিল একজন মায়ের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তারপর মনে হলো, এই গল্পের অনেকটাই এখনো লেখা বাকি। তখন এটিকে উপন্যাসে পরিণত করার চিন্তা আসলো। আসল কথা হলো আমি কিন্তু নিজেকে নিয়ে লিখছি না।”

অবশ্য লেখকের জীবনের সাথে উপন্যাসের সেলিমের কিছু মিল রয়েছে। সেলিমও গুরনাহর মতো কৈশোরে জাঞ্জিবার থেকে লন্ডনে এসেছিল। সেলিমও একইভাবে বিচ্ছিন্নতা, প্রতিকূলতা ও একাকীত্বের সম্মুখীন হয়েছিল।

গুনরাহর জীবনের এসকল অভিজ্ঞতা নির্দিষ্ট প্লট লাইন তৈরি না করে বরঞ্চ সেলিমের প্রতি কিছুটা সহানুভূতির সঞ্চার ঘটিয়েছে। উপন্যাসে দেখা যায়, সেলিমের বাবা জীবন থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে, সেলিমের মা অধিকাংশ সময়ই ঘরের বাইরে কাটায় একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে। সেলিমের চাচা তাকে প্রস্তাব দেয় জাঞ্জিবারের দূর্বিসহ জীবন থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার। কিন্তু সেলিম নিজের দেশ বা লন্ডনে কোথাও গিয়ে নিজের লজ্জা, অপরাধবোধ ও বিভ্রান্তির তীব্র অনুভূতি থেকে মুক্ত হতে পারে না।

“বড় হওয়ায় সময় সেলিমের মনে হতো এমন কিছু আছে যার জন্য তার লজ্জা পাওয়া উচিত। কিন্তু সেটি কি সে জানতো না।” বলছিলেন কেন্টারবিউরিতে নিজ বাসায় বসে ৬৮ বছর বয়সী লেখক গুনরাহ। “আমার মনে হয় অনেক পরিবারই এটা জানে কীভাবে অব্যক্ত সমস্যাগুলি জীবনে সংশয় নিয়ে আসে। এগুলো নিয়ে অনেকেই কথা বলার সাহস পায় না।”

“সে জানে যে কোনো খারাপ কিছু ঘটেছে। এটিই তার অস্থিরতার মূল কারণ। কিন্তু সে চেষ্টা করে জীবনে সঠিকভাবে চলার জন্য।”

গল্পের শেষে এসে সেলিম সেই ভয়ানক রহস্য উন্মোচন করে। কিন্তু রহস্য উন্মোচন ‘গ্রেভেল হার্ট’-এর সমাপ্তির মূল বিষয়বস্তু নয়। এর পর সেলিমের কী করা উচিত, এটাই মুখ্য বিষয়। তার কি জাঞ্জিবারে থেকে যাওয়া উচিত নাকি লন্ডনে যে জীবনের সূচনা করেছিল সেখানে ফিরে যাওয়া উচিত?

“যারা নিজের শেকড় ছেড়ে যায় তারাই বুঝতে পারে এই দ্বিধার কারণ” বলছিলেন গুনরাহ। “নিজের অভিজ্ঞতার কারণেই আমি জানি যে ‘আমার কোথায় থাকা উচিত’- এই প্রশ্নটি সঙ্কটের মুহূর্তে বারবার ফিরে আসে।”

গ্রেভেল হার্ট-এর চরিত্রেরা শেষমেশ কুয়ালালাপুর, ব্রাইটন ও দুবাইয়ের মতো ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় গিয়ে থিতু হয়। গুরনাহ ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ এবং গাল্ফ অঞ্চলের মধ্যকার ঐতিহাসিক সংযোগের উপর জোর দিতে আগ্রহী।

এটি মূলত সাহিত্য রচনা ও গল্প বলার সর্বজনীন ক্ষমতার পক্ষে তার যুক্তির অংশ, যেমনটা সবাই একজন ইংরেজির অধ্যাপকের কাছ থেকে আশা করে থাকে। যদিও অনেক পাঠক এই লেখাকে প্রাথমিকভাবে আবেগহীন সরল মনে করতে পারে। কিন্তু এটি একটি ইচ্ছাকৃত কৌশল, এই কৌশলের মাধ্যেমে লেখক সেলিমের ভেতরের অনুভূতিগুলোকে আরও বাস্তবিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সেলিম তার মাকে চিঠি পাঠানো নিয়ে যে দ্বিধায় থাকে, এর মাধ্যমে তার ভেতরের দুঃখ-কষ্ট আরো তীব্রভাবে প্রকাশ পায়।

“একদম তাই” বলেন গুনরাহ। “আপনি যখন ক্যাফেতে কারও সাথে কথা বলবেন, তখন তারা আপনাকে এমন কিছু সম্পর্কে বলবে না যা কিছুটা লজ্জাজনক।”

“এমনকি যেসব বন্ধুদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তাদের সাথেও সবসময় নিজের উদ্বেগের কথা মন খুলে বলা যায় না।”

“ব্যপারটা অনেকটা এরকম, আপনি কোথাও থাকেন কিন্তু সেটি আপনার নিজের বাড়ি নয়। আপনি নিজের গল্পগুলো, নিজের জীবনের দুঃখগুলো নিজের মনের ভেতরে লুকিয়ে রাখেন। আর চিঠিগুলি সেই কল্পনাপ্রসূত কথোপকথনের সুযোগ দেয় যা আপনি কখনো বলে উঠতে পারেননি।”

আবদুলরাজাক গুরনাহর সাথে উপন্যাসের, বই পড়ার ও পাঠকের সম্পর্কের যে সুন্দর ছবিটি দেখা যায়- জীবন নিয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত চলা কথোপকথন, একই রকম বাস্তব এবং কল্পনাপ্রসূত।

“একে অপরের কাছ থেকে শেখার একটা স্বাভাবিক উপায় রয়েছে যেটি আপনি উপন্যাসের মাধ্যমেও করতে পারবেন” তিনি বলেন।

“আমি পাঠকদের আনন্দ দিতে চাই, তার সাথে সাথে আমরা সবাই যেভাবে কোনোকিছু বুঝে থাকি সেই প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করতে চাই- প্রতিটি বইয়ের সাথে এক কদম করে সামনে এগিয়ে।”

back to top