alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক রচনা : এগারো

এক অখ্যাত কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ

আহমেদ ফরিদ

: শনিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

উতারো শব্দটার মানে লোটির জানা আছে। উতারো শব্দটি শুনে লোকটির বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। উতারো আর মৃত্যু তার কাছে সমার্থক। কারণ তার ঐ জিনিসের অগ্রভাগ কর্তিত নয়। সে মুসলমানের সন্তান নয়। কী ভয়াবহ বিপদ। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে চেনার একটি উত্তম উপায় হলো তার বিশেষ অঙ্গটার চামড়া কর্তিত কী কর্তিত নয়! লোকটা কী করবে এখন? দৌড়ে পালানোর মতো হিম্মত নেই বুকে। যে কলমা কয়টা শিখেছিল সে তাও ভুলে গিয়েছে এখন। তার হাঁটু জোড়া কাঁপছে থর থর করে। সৈনিক তাকে আবারো ধমক লাগায়, উতারো। লোকটা তার লুঙ্গিটি দুহাতে ধরে কোমরের উপরে তুলে ধরতে বাধ্য হয়। সৈনিকটির মুখে পৈশাচিক ক্রূর একটা হাসি ফুটে ওঠে।

সাচ্চা মুসলমান ইধার আও- বলে চান মিয়া চাচাকে ডাকে সৈনিকটি। চান মিয়া চাচা যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো সৈনিকটির দিকে এগিয়ে যায়। শীতের মধ্য দুপুরের নেতানো রোদেও রাইফেলের আগায় লাগানো বেয়নেটটি চকচক করছিল রক্ত পান করার জন্যই বোধ হয়। সৈনিকটি শীতল চোখে ধীরে সুস্থে বেয়নেটটি চান মিয়া চাচার বুকে চার্জ করে। চান মিয়া চাচা যেনো মনে হয় এর জন্য প্রস্তুতই ছিলেন। তিনি বুক পেতে দেন। সৈনিকটি প্রচণ্ড আক্রোশে একাধিক বার সংগীন চালিয়ে দেয় চান মিয়া চাচার বুকে। সবুজ দুর্বাঘাসের উপর লাল টকটকে রক্ত একটি বৃত্ত একে জমা হতে থাকে। সবুজের বুকে লাল। আমাদের পতাকার সমার্থক একটা কিছু!

চান মিয়া চাচাকে আমরা একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ হিসেবেই জানতাম। তিনি নামাজ কাজা করতেন না, রোজা ভঙ্গ করতেন না। তিনি কখনো মিথ্যা বলেছেন এমন নজির কেউ দিতে পারবে না। তার সততা আর ধার্মিকতার জন্য ছেলে বুড়ো সবাই তাকে সম্মানের চোখে দেখতো। তিনি মিথ্যা বলার লোক নন। এটাই বোধ হয় তার জীবনে প্রথম আর শেষ মিথ্যা ছিল।

তিনি কেনো এ মিথ্যার আশ্রয় নিলেন? তাও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কয়জনের বুকের পাটা এমন যে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন মানুষকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলতে পারেন।

চান মিয়া চাচা জানতেন লোকটা হিন্দু। কারণ লোকটার বাড়ি ছিল একই পাড়ার। তার একটা মিথ্যা যদি একজন মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে তাহলে কী সেই মিথ্যাটা বলাই তার কাছে জরুরী মনে হয়েছিল? এই মিথ্যায় কি কোনো পাপ ছিল? কে বড়, সত্য না কি মানবতা, মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা?

দক্ষিণ পাড়ার শওকত ভাই। বয়সে যুবা হলেও মুখে ছাপ দাড়ি, কয়েক দিন মাদ্রাসায়ও পড়েছে। তাকেসহ আরো নয়দশ জনকে রাজাকার আর পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে এসেছে সাহায্য করার জন্য। সাহায্যের মানে হলো হিন্দুদের বাড়ি চিনিয়ে দিতে হবে এবং সে সকল বাড়িতে পেট্রোল আর গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে হবে। তার আগে এদের মুসলমানিত্ব পরীক্ষা করা দরকার। রাজাকারগুলি শওকত ভাইকে মুসলমানিত্বের পরীক্ষা দিতে অর্থাৎ কাপড় খুলে বিশেষ অঙ্গটি দেখাতে বলল। শওকত ভাই বেঁকে বসল। জান যাবে তবু মান দেবে না। শওকত ভাই কিছুতেই কাপড় খুলবে না। সূর্যের চেয়ে বালি গরম। পাকিস্তানি সৈন্যদের চেয়েও বেশি ক্ষেপে গেল রাজাকাররা। বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে রাজাকারদের একজন গুলি করে বসল শওকত ভাইকে। পালাতে পারে সে আশংকায় বাকি নয়জনকেও গুলি করা হলো। শওকত ভাইসহ নয়জন তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই মারা গেল।

খবর আসল ফুলপুর গ্রাম হতে। আমার খুব কাছের বন্ধু আজিজ। তার বাবা তোরাব আলি চৌধুরীকেও সৈন্যরা গুলি করে মেরে ফেলেছে।

১৫. আমাদের মালতি দিদি

আমাদের স্কুলে বয়সে বেশ বড় বড় কয়েকজন মেয়ে পড়ত। তারা অবশ্য গায়ে গতরেও বেশ বড় ছিল। তখনকার দিনের গ্রামের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েদেরকে কলেজের নিদেন পক্ষে উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী বলে মনে হতো। এরা এতো বড়ো ছিল যে এদের একজনের সাথে আমাদের এক প্রিয় শিক্ষকের কিছু একটা হয়েছে বলে কানাঘুষা চলতে থাকে। কী হয়েছে আমরা তা ধরতে পারি না। নিশ্চয়ই খারাপ কিছু একটা হবে। না হলে আলতাফ স্যারের বিরুদ্ধে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া কয়েকজন ছাত্র ঘুট পাকাচ্ছে কেনো? এমন কী তাঁকে মারধরের মতলবও আঁটতে থাকে এরা। আমরা এতোকিছু বুঝি না তবে মনে হয়েছিল একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে আর আমরা আমাদের একজন প্রিয় শিক্ষককে হারাতে যাচ্ছি। আমাদের সাথে অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাখি, খুকী সাহারা, জেসমিনরা পড়ত। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত নুর নিশা, জয়তুন্নেছা আপারা, মালতী মাধবী দিদিরা। এরা আবার গান করত। গান করা মানে কোনো রকম বাদ্যযন্ত্র ছাড়া খালি গলায় গান। আর গান করাতেন স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক অনু মিয়া স্যার। স্যারের অন্য একটা নামও ছিল। মোজাহার আলি বা এরকম একটা কিছু। আমরা তাঁর সে নামটা ভালোভাবে জানতাম না। স্যার ছিলেন বিশালদেহী একজন মানুষ। স্যারের ভয়ে আমরা সবসময় কম্পমান থাকতাম। স্যার হাঁটতেন থপথপিয়ে। স্যার কী খুব রাগী ছিলেন? মনে হয়। নতুবা আমরা স্যারকে এতো ভয় পেতাম কেনো? স্যার ছিলেন খুব ধার্মিক। সবাইকে নিয়ে নামাজ পড়তে তিনি খুব পছন্দ করতেন। আর এই স্যারই ছাত্রীদেরকে দিয়ে আবার গানও গাওয়াতেন। কয়েকজন ছাত্রী বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে গান করতেন। স্যার থাকতেন সেই বৃত্তের মাঝে। আমার যতটুকু মনে পড়ে স্কুলে দুটি গানই গাওয়া হতো। একটা হলো পাস্তিানের জাতীয় সংগীত-পাক সার জমিন সাদ বাদ। এটি গাইতে হতো প্রতিদিনই। জাতীয় সংগীত শেষে ওয়াদা পাঠ। সেই ওয়াদা পাঠে ভালো হয়ে চলার কী একটা বিষয় যেনো থাকত। একটা হাত সামনের দিকে টান টান করে ওয়াদ পাঠ করতে হতো।

দ্বিতীয় গানটি ছিল অনু মিয়া স্যারের গান। গানের কিছু কথা আমার এখনো মনে আছে। কথাগুলো এরকম-

‘তিনি মোদের সবার প্রিয়

সকলের বরণীয়

সকল গুণের গুনণীয়

তিনি মোদের সবার প্রিয়’।

আজ বহু দিন হয়ে গেলো। গানের কথাগুলি হুবহু আমার মনে নেই কিন্তু কানের কাছে সেই সুরটি এখনো গুনগুন করে কে যেনো মাঝে মাঝেই গেয়ে উঠে। গানটির মূল গায়িকা মালতী দিদি। তার সাথে থাকত আরো চার পাঁচ জন মেয়ে। মালতী দিদির হাতে থাকত একটা ফুলের মালা। অনু মিয়ে স্যারকে কেন্দ্র করে মেয়েরা বৃত্তাকারে গান গাইত। আমরা থাকতাম দর্শক হিসেবে। গান শেষে ফুলের মালাটি অনু মিয়া স্যারের গলায় পড়িয়ে দেয়া হতো। আগেই বলেছি মালতি দি দেখতে অনেক বড় ছিল। তার গায়ের রঙ ছিল শ্যামলা আর চোখ ছিল বেশ বড় বড়। এতো দিন পরে আজ যখন এ লেখা লিখছি তখন মনে হচ্ছে মালতি দি তার বড় বড় চোখ দিয়ে আমার ঘাড়ের পিছন দিক থেকে উঁকি মেরে দেখছে- তাকে নিয়ে আমি কী লিখছি।

সেই মালতী দিদি হারিয়ে যায় চৌদ্দ নভেম্বরে। বড়দেরকে বলতে শুনি ডাক্তারের মেয়েটাকে পাকিস্তানী সৈন্যরা মেরে ফেলেছে। কীভাবে মেরে ফেলেছে সে কথাটি বড়রা আমাদের সামনে বলছে না। বললেও নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে বলছে যেনো আমরা কিছু বুঝতে না পারি। তাদের মুখ থেকে এতোটুকু আমরা জানতে পারি যে মালতী দিদিকে অত্যাচার করেই পাকিস্তানি সৈনারা মেরে ফেলেছে। আমার কান্না আসে। আহা! মালতী দিদি তার বড় বড় চোখ মেলে আর কোনো গান গাইবে না। আমরা আর শুনব না ‘তিনি মোদের সবার প্রিয়’ গানটি। আমাদের সবার প্রিয় মালতী দিদিকে এভাবে মেরে ফেললো হায়েনারা! মালতী দিদিকে তাদের ধর্মমতে পোড়ানো হয়নি মানে পোড়ানোর সুযোগ হয়নি। কে পোড়াবে? সবাই তো তখন দু’পায়ের উপর দৌঁড়াচ্ছে বিশেষ করে হিন্দুরা। মালতী দিদিকে কবর দেয়া হয়েছিল তাদের বাড়ির উত্তর দিকের আম-জাম গাছের বাগানে। সেই কবরটি ছিল লালচে মাটির। মাছের পিঠের মতো উঁচু কবরটি অনেক দিন অক্ষত ছিল কিংবা যত্ন করে অক্ষত রাখা হয়েছিল পরিবারের পক্ষ থেকে। গ্রামের ভিতর দিয়ে আমরা আড়াই মাইল দূরের হাই স্কুলে পড়তে যেতাম। আমাদের পথের ধারেই ছিল সেই কবরটি। একাকী সেই কবরের পাশ দিয়ে যেতে ভয় পেতাম। অন্যদের সাথে গেলেও আমার গা ছম ছম করতো। আমি আড় চোখে সেই কবরের দিকে তাকাতাম। কিসের জন্য? মালতী দিদি কি কবর থেকে বলবে- এই তোরা আমাকে একাকী রেখে কোথায় যাচ্ছিস? আমার কিশোর মনে কি এরকম একটা অনুভূতি কাজ করতো? হয়তো বা। মালতী দিদিদের বাড়ি গ্রামের মাঝামাঝি ভিতরের দিকে। পাকিস্তানি সেনাদের মালতি দিদিদের বাড়ি চেনার কথা নয়। তা হলে কে তাদের বাড়ি চিনিয়ে দিল? নিশ্চয় কেউ না কেউ। রাজাকার আলবদরদের কেউ। কিন্তু আমাদের গ্রামে কোনো রাজাকার তো ছিল না। তাহলে ভিন্ন গ্রামের কেউ? হতে পারে। যেই হোক ইতিহাস কি তাদেরকে কোনো দিন ক্ষমা করবে, করতে পারে?

১৬. ভীতিকর রাতের পর সোনালি ভোর

সময় যত কঠিনই হোক থেমে থাকে না। শীতের দিন এমনিতেই ছোট। ধীরে ধীরে সুর্য অস্ত যেতে থাকে। ঘিরে আসতে থাকে আঁধার। আঁধারের সাথে সাথে নেমে আসে জানা অজানা সব ভয়। আরো অশুভ কিছু ঘটবে? সবার মনেই আতঙ্ক কাজ করে। আতঙ্কে আমিও নীল হয়ে থাকি। রাতের বেলায় কি পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের বাড়ি-ঘরে আগুন দিবে? গ্রামের সব বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিবে। মহিলাদেরকে ধরে নিয়ে যাবে? মালতিদি’র মতো সব মহিলাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে? মহিলাদের প্রতি এদের এতো রাগ কেনো আমার তা মাথায় আসে না। মহিলারা তো আর তাদের বিরুদ্ধে বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করছে না।

বাবা গালে হাত দিয়ে ঠাঁয় বসে ছিলেন বারান্দায়। মাগরিবের আজান কী সেদিন হয়েছিল কিনা আমার মনে নেই। হলেও মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর আমাদের কানতক পৌঁছে নাই। আমাদের কোনো ঘড়ি নেই। অনুমান করে আমরা ইফতার করে নেই। সাদা পানি আর আদার সুগন্ধযুক্ত পাটিসাপ্টা। এটি আমার খুবই প্রিয় একটা খাবার। কিন্তু আজ খেতে তেমন মজা লাগছে না। মানুষের জিবের স্বাদ কোত্থেকে আসে? মন, মস্তিষ্ক নাকি মুখ থেকে?

বাবা মাগরিবের নামাজের জন্য উঠে দাঁড়ায়। অন্যদিনের চেয়েও আজ মনে হলো জোরে কেরাত পড়ছে। ‘ফাবি আইয়ি আলা রাব্বি তুকাজ্জিবান’ তোমরা আমার কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?

বাবার নামাজ পড়া শেষ হলে আমরা দু’মুঠো খেয়ে নেই। আগের দিন নাসিরনগর বাজার থেকে ফোডা মাছ আনা হয়েছিল। মাছটা বেশ মজাদার, তেল চকচকে। কিন্তু খেতে বসে তেমন কোনো মজা পেলাম না। কারও মুখে কোনো কথা নেই। খাওয়া শেষে বাবা মাকে বললেন আমাদের ধানের গোলায় লুকিয়ে থাকতে। ধানের গোলাটি আমাদের মূল ঘরের সাথেই। পাহাড়ি বাশের তরজা দিয়ে তৈরি। খুব শক্ত আর বেশ বড়ো। চোর আর ইঁদুরের হাত থেকে ধান চাল রক্ষা করার জন্য গোলাটি শক্ত করে বানানো হয়েছিল। গোলাটি তখন প্রায় খালি। এর ভিতরে কয়েকজন মানুষ শুয়ে থাকলে বাহির থেকে টের পাওয়ার জো নেই। বাবা চলে গেলেন বাহিরে। সব বয়স্ক পুরুষই আজ রাতে বাহিরে থাকবে। তাদেরকে পাহারা দিতে হবে। কী পাহারা দিবেন? পাহারা দিবেন পাকিস্তানী সেনাদেরকে। এরা যাতে গ্রামে কোনো বাড়িতে না ঢুকে।

কয়েকটি দলে বিভক্ত হয় গ্রামের লোকজন। তারপর সারা রাত তারা গ্রাম পাহারা দিতে থাকে। প্রধান সড়ক ধরে যেখানে সৈন্যদের ক্যাম্প ছিল তার আশেপাশেই পাহারা জোরদার করা হয়। পাহারা দানের এ প্রক্রিয়াকে পাকিস্তানি বাহিনীও মনে মনে পছন্দ করে। তারা এতে কোনো বাঁধ সাধেনি। তাদের মনেও নিশ্চয়ই একটা ভয় ঢুকে ছিল। মুক্তি বাহিনী দ্বারা তারা যে কোনো সময আক্রান্ত হতে পারে। অন্তত এইটুকু তাদের আশংকা ছিল যে তারা গ্রাম দুটিতে প্রবেশের সময় একটা বাধার সম্মুখীন হবে। সেরকম কিছু না ঘটলেও আক্রমণের আশংকা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বাঙালিগুলো যদি পাহারায় থাকে তাহলে মন্দ হয় না। গ্রামের লোকগুলোকে তো পাকিস্তানপন্থী বলেই মনে হয়েছে তাদের।

লোকজন স্লোগান স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছে রাতের বাতাস। তাদের স্লোগান ছিল-

পাকিস্তান জিন্দাবাদ,

পাক সেনা জিন্দাবাদ,

ভুট্টু জিন্দাবাদ,

ইয়াহিয়া জিন্দাবাদ,

কায়েদে আযম জিন্দাবাদ। (ক্রমশ...)

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক রচনা : এগারো

এক অখ্যাত কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ

আহমেদ ফরিদ

শনিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

উতারো শব্দটার মানে লোটির জানা আছে। উতারো শব্দটি শুনে লোকটির বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। উতারো আর মৃত্যু তার কাছে সমার্থক। কারণ তার ঐ জিনিসের অগ্রভাগ কর্তিত নয়। সে মুসলমানের সন্তান নয়। কী ভয়াবহ বিপদ। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে চেনার একটি উত্তম উপায় হলো তার বিশেষ অঙ্গটার চামড়া কর্তিত কী কর্তিত নয়! লোকটা কী করবে এখন? দৌড়ে পালানোর মতো হিম্মত নেই বুকে। যে কলমা কয়টা শিখেছিল সে তাও ভুলে গিয়েছে এখন। তার হাঁটু জোড়া কাঁপছে থর থর করে। সৈনিক তাকে আবারো ধমক লাগায়, উতারো। লোকটা তার লুঙ্গিটি দুহাতে ধরে কোমরের উপরে তুলে ধরতে বাধ্য হয়। সৈনিকটির মুখে পৈশাচিক ক্রূর একটা হাসি ফুটে ওঠে।

সাচ্চা মুসলমান ইধার আও- বলে চান মিয়া চাচাকে ডাকে সৈনিকটি। চান মিয়া চাচা যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো সৈনিকটির দিকে এগিয়ে যায়। শীতের মধ্য দুপুরের নেতানো রোদেও রাইফেলের আগায় লাগানো বেয়নেটটি চকচক করছিল রক্ত পান করার জন্যই বোধ হয়। সৈনিকটি শীতল চোখে ধীরে সুস্থে বেয়নেটটি চান মিয়া চাচার বুকে চার্জ করে। চান মিয়া চাচা যেনো মনে হয় এর জন্য প্রস্তুতই ছিলেন। তিনি বুক পেতে দেন। সৈনিকটি প্রচণ্ড আক্রোশে একাধিক বার সংগীন চালিয়ে দেয় চান মিয়া চাচার বুকে। সবুজ দুর্বাঘাসের উপর লাল টকটকে রক্ত একটি বৃত্ত একে জমা হতে থাকে। সবুজের বুকে লাল। আমাদের পতাকার সমার্থক একটা কিছু!

চান মিয়া চাচাকে আমরা একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ হিসেবেই জানতাম। তিনি নামাজ কাজা করতেন না, রোজা ভঙ্গ করতেন না। তিনি কখনো মিথ্যা বলেছেন এমন নজির কেউ দিতে পারবে না। তার সততা আর ধার্মিকতার জন্য ছেলে বুড়ো সবাই তাকে সম্মানের চোখে দেখতো। তিনি মিথ্যা বলার লোক নন। এটাই বোধ হয় তার জীবনে প্রথম আর শেষ মিথ্যা ছিল।

তিনি কেনো এ মিথ্যার আশ্রয় নিলেন? তাও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কয়জনের বুকের পাটা এমন যে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন মানুষকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলতে পারেন।

চান মিয়া চাচা জানতেন লোকটা হিন্দু। কারণ লোকটার বাড়ি ছিল একই পাড়ার। তার একটা মিথ্যা যদি একজন মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে তাহলে কী সেই মিথ্যাটা বলাই তার কাছে জরুরী মনে হয়েছিল? এই মিথ্যায় কি কোনো পাপ ছিল? কে বড়, সত্য না কি মানবতা, মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা?

দক্ষিণ পাড়ার শওকত ভাই। বয়সে যুবা হলেও মুখে ছাপ দাড়ি, কয়েক দিন মাদ্রাসায়ও পড়েছে। তাকেসহ আরো নয়দশ জনকে রাজাকার আর পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে এসেছে সাহায্য করার জন্য। সাহায্যের মানে হলো হিন্দুদের বাড়ি চিনিয়ে দিতে হবে এবং সে সকল বাড়িতে পেট্রোল আর গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে হবে। তার আগে এদের মুসলমানিত্ব পরীক্ষা করা দরকার। রাজাকারগুলি শওকত ভাইকে মুসলমানিত্বের পরীক্ষা দিতে অর্থাৎ কাপড় খুলে বিশেষ অঙ্গটি দেখাতে বলল। শওকত ভাই বেঁকে বসল। জান যাবে তবু মান দেবে না। শওকত ভাই কিছুতেই কাপড় খুলবে না। সূর্যের চেয়ে বালি গরম। পাকিস্তানি সৈন্যদের চেয়েও বেশি ক্ষেপে গেল রাজাকাররা। বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে রাজাকারদের একজন গুলি করে বসল শওকত ভাইকে। পালাতে পারে সে আশংকায় বাকি নয়জনকেও গুলি করা হলো। শওকত ভাইসহ নয়জন তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই মারা গেল।

খবর আসল ফুলপুর গ্রাম হতে। আমার খুব কাছের বন্ধু আজিজ। তার বাবা তোরাব আলি চৌধুরীকেও সৈন্যরা গুলি করে মেরে ফেলেছে।

১৫. আমাদের মালতি দিদি

আমাদের স্কুলে বয়সে বেশ বড় বড় কয়েকজন মেয়ে পড়ত। তারা অবশ্য গায়ে গতরেও বেশ বড় ছিল। তখনকার দিনের গ্রামের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েদেরকে কলেজের নিদেন পক্ষে উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী বলে মনে হতো। এরা এতো বড়ো ছিল যে এদের একজনের সাথে আমাদের এক প্রিয় শিক্ষকের কিছু একটা হয়েছে বলে কানাঘুষা চলতে থাকে। কী হয়েছে আমরা তা ধরতে পারি না। নিশ্চয়ই খারাপ কিছু একটা হবে। না হলে আলতাফ স্যারের বিরুদ্ধে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া কয়েকজন ছাত্র ঘুট পাকাচ্ছে কেনো? এমন কী তাঁকে মারধরের মতলবও আঁটতে থাকে এরা। আমরা এতোকিছু বুঝি না তবে মনে হয়েছিল একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে আর আমরা আমাদের একজন প্রিয় শিক্ষককে হারাতে যাচ্ছি। আমাদের সাথে অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাখি, খুকী সাহারা, জেসমিনরা পড়ত। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত নুর নিশা, জয়তুন্নেছা আপারা, মালতী মাধবী দিদিরা। এরা আবার গান করত। গান করা মানে কোনো রকম বাদ্যযন্ত্র ছাড়া খালি গলায় গান। আর গান করাতেন স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক অনু মিয়া স্যার। স্যারের অন্য একটা নামও ছিল। মোজাহার আলি বা এরকম একটা কিছু। আমরা তাঁর সে নামটা ভালোভাবে জানতাম না। স্যার ছিলেন বিশালদেহী একজন মানুষ। স্যারের ভয়ে আমরা সবসময় কম্পমান থাকতাম। স্যার হাঁটতেন থপথপিয়ে। স্যার কী খুব রাগী ছিলেন? মনে হয়। নতুবা আমরা স্যারকে এতো ভয় পেতাম কেনো? স্যার ছিলেন খুব ধার্মিক। সবাইকে নিয়ে নামাজ পড়তে তিনি খুব পছন্দ করতেন। আর এই স্যারই ছাত্রীদেরকে দিয়ে আবার গানও গাওয়াতেন। কয়েকজন ছাত্রী বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে গান করতেন। স্যার থাকতেন সেই বৃত্তের মাঝে। আমার যতটুকু মনে পড়ে স্কুলে দুটি গানই গাওয়া হতো। একটা হলো পাস্তিানের জাতীয় সংগীত-পাক সার জমিন সাদ বাদ। এটি গাইতে হতো প্রতিদিনই। জাতীয় সংগীত শেষে ওয়াদা পাঠ। সেই ওয়াদা পাঠে ভালো হয়ে চলার কী একটা বিষয় যেনো থাকত। একটা হাত সামনের দিকে টান টান করে ওয়াদ পাঠ করতে হতো।

দ্বিতীয় গানটি ছিল অনু মিয়া স্যারের গান। গানের কিছু কথা আমার এখনো মনে আছে। কথাগুলো এরকম-

‘তিনি মোদের সবার প্রিয়

সকলের বরণীয়

সকল গুণের গুনণীয়

তিনি মোদের সবার প্রিয়’।

আজ বহু দিন হয়ে গেলো। গানের কথাগুলি হুবহু আমার মনে নেই কিন্তু কানের কাছে সেই সুরটি এখনো গুনগুন করে কে যেনো মাঝে মাঝেই গেয়ে উঠে। গানটির মূল গায়িকা মালতী দিদি। তার সাথে থাকত আরো চার পাঁচ জন মেয়ে। মালতী দিদির হাতে থাকত একটা ফুলের মালা। অনু মিয়ে স্যারকে কেন্দ্র করে মেয়েরা বৃত্তাকারে গান গাইত। আমরা থাকতাম দর্শক হিসেবে। গান শেষে ফুলের মালাটি অনু মিয়া স্যারের গলায় পড়িয়ে দেয়া হতো। আগেই বলেছি মালতি দি দেখতে অনেক বড় ছিল। তার গায়ের রঙ ছিল শ্যামলা আর চোখ ছিল বেশ বড় বড়। এতো দিন পরে আজ যখন এ লেখা লিখছি তখন মনে হচ্ছে মালতি দি তার বড় বড় চোখ দিয়ে আমার ঘাড়ের পিছন দিক থেকে উঁকি মেরে দেখছে- তাকে নিয়ে আমি কী লিখছি।

সেই মালতী দিদি হারিয়ে যায় চৌদ্দ নভেম্বরে। বড়দেরকে বলতে শুনি ডাক্তারের মেয়েটাকে পাকিস্তানী সৈন্যরা মেরে ফেলেছে। কীভাবে মেরে ফেলেছে সে কথাটি বড়রা আমাদের সামনে বলছে না। বললেও নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে বলছে যেনো আমরা কিছু বুঝতে না পারি। তাদের মুখ থেকে এতোটুকু আমরা জানতে পারি যে মালতী দিদিকে অত্যাচার করেই পাকিস্তানি সৈনারা মেরে ফেলেছে। আমার কান্না আসে। আহা! মালতী দিদি তার বড় বড় চোখ মেলে আর কোনো গান গাইবে না। আমরা আর শুনব না ‘তিনি মোদের সবার প্রিয়’ গানটি। আমাদের সবার প্রিয় মালতী দিদিকে এভাবে মেরে ফেললো হায়েনারা! মালতী দিদিকে তাদের ধর্মমতে পোড়ানো হয়নি মানে পোড়ানোর সুযোগ হয়নি। কে পোড়াবে? সবাই তো তখন দু’পায়ের উপর দৌঁড়াচ্ছে বিশেষ করে হিন্দুরা। মালতী দিদিকে কবর দেয়া হয়েছিল তাদের বাড়ির উত্তর দিকের আম-জাম গাছের বাগানে। সেই কবরটি ছিল লালচে মাটির। মাছের পিঠের মতো উঁচু কবরটি অনেক দিন অক্ষত ছিল কিংবা যত্ন করে অক্ষত রাখা হয়েছিল পরিবারের পক্ষ থেকে। গ্রামের ভিতর দিয়ে আমরা আড়াই মাইল দূরের হাই স্কুলে পড়তে যেতাম। আমাদের পথের ধারেই ছিল সেই কবরটি। একাকী সেই কবরের পাশ দিয়ে যেতে ভয় পেতাম। অন্যদের সাথে গেলেও আমার গা ছম ছম করতো। আমি আড় চোখে সেই কবরের দিকে তাকাতাম। কিসের জন্য? মালতী দিদি কি কবর থেকে বলবে- এই তোরা আমাকে একাকী রেখে কোথায় যাচ্ছিস? আমার কিশোর মনে কি এরকম একটা অনুভূতি কাজ করতো? হয়তো বা। মালতী দিদিদের বাড়ি গ্রামের মাঝামাঝি ভিতরের দিকে। পাকিস্তানি সেনাদের মালতি দিদিদের বাড়ি চেনার কথা নয়। তা হলে কে তাদের বাড়ি চিনিয়ে দিল? নিশ্চয় কেউ না কেউ। রাজাকার আলবদরদের কেউ। কিন্তু আমাদের গ্রামে কোনো রাজাকার তো ছিল না। তাহলে ভিন্ন গ্রামের কেউ? হতে পারে। যেই হোক ইতিহাস কি তাদেরকে কোনো দিন ক্ষমা করবে, করতে পারে?

১৬. ভীতিকর রাতের পর সোনালি ভোর

সময় যত কঠিনই হোক থেমে থাকে না। শীতের দিন এমনিতেই ছোট। ধীরে ধীরে সুর্য অস্ত যেতে থাকে। ঘিরে আসতে থাকে আঁধার। আঁধারের সাথে সাথে নেমে আসে জানা অজানা সব ভয়। আরো অশুভ কিছু ঘটবে? সবার মনেই আতঙ্ক কাজ করে। আতঙ্কে আমিও নীল হয়ে থাকি। রাতের বেলায় কি পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের বাড়ি-ঘরে আগুন দিবে? গ্রামের সব বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিবে। মহিলাদেরকে ধরে নিয়ে যাবে? মালতিদি’র মতো সব মহিলাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে? মহিলাদের প্রতি এদের এতো রাগ কেনো আমার তা মাথায় আসে না। মহিলারা তো আর তাদের বিরুদ্ধে বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করছে না।

বাবা গালে হাত দিয়ে ঠাঁয় বসে ছিলেন বারান্দায়। মাগরিবের আজান কী সেদিন হয়েছিল কিনা আমার মনে নেই। হলেও মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর আমাদের কানতক পৌঁছে নাই। আমাদের কোনো ঘড়ি নেই। অনুমান করে আমরা ইফতার করে নেই। সাদা পানি আর আদার সুগন্ধযুক্ত পাটিসাপ্টা। এটি আমার খুবই প্রিয় একটা খাবার। কিন্তু আজ খেতে তেমন মজা লাগছে না। মানুষের জিবের স্বাদ কোত্থেকে আসে? মন, মস্তিষ্ক নাকি মুখ থেকে?

বাবা মাগরিবের নামাজের জন্য উঠে দাঁড়ায়। অন্যদিনের চেয়েও আজ মনে হলো জোরে কেরাত পড়ছে। ‘ফাবি আইয়ি আলা রাব্বি তুকাজ্জিবান’ তোমরা আমার কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?

বাবার নামাজ পড়া শেষ হলে আমরা দু’মুঠো খেয়ে নেই। আগের দিন নাসিরনগর বাজার থেকে ফোডা মাছ আনা হয়েছিল। মাছটা বেশ মজাদার, তেল চকচকে। কিন্তু খেতে বসে তেমন কোনো মজা পেলাম না। কারও মুখে কোনো কথা নেই। খাওয়া শেষে বাবা মাকে বললেন আমাদের ধানের গোলায় লুকিয়ে থাকতে। ধানের গোলাটি আমাদের মূল ঘরের সাথেই। পাহাড়ি বাশের তরজা দিয়ে তৈরি। খুব শক্ত আর বেশ বড়ো। চোর আর ইঁদুরের হাত থেকে ধান চাল রক্ষা করার জন্য গোলাটি শক্ত করে বানানো হয়েছিল। গোলাটি তখন প্রায় খালি। এর ভিতরে কয়েকজন মানুষ শুয়ে থাকলে বাহির থেকে টের পাওয়ার জো নেই। বাবা চলে গেলেন বাহিরে। সব বয়স্ক পুরুষই আজ রাতে বাহিরে থাকবে। তাদেরকে পাহারা দিতে হবে। কী পাহারা দিবেন? পাহারা দিবেন পাকিস্তানী সেনাদেরকে। এরা যাতে গ্রামে কোনো বাড়িতে না ঢুকে।

কয়েকটি দলে বিভক্ত হয় গ্রামের লোকজন। তারপর সারা রাত তারা গ্রাম পাহারা দিতে থাকে। প্রধান সড়ক ধরে যেখানে সৈন্যদের ক্যাম্প ছিল তার আশেপাশেই পাহারা জোরদার করা হয়। পাহারা দানের এ প্রক্রিয়াকে পাকিস্তানি বাহিনীও মনে মনে পছন্দ করে। তারা এতে কোনো বাঁধ সাধেনি। তাদের মনেও নিশ্চয়ই একটা ভয় ঢুকে ছিল। মুক্তি বাহিনী দ্বারা তারা যে কোনো সময আক্রান্ত হতে পারে। অন্তত এইটুকু তাদের আশংকা ছিল যে তারা গ্রাম দুটিতে প্রবেশের সময় একটা বাধার সম্মুখীন হবে। সেরকম কিছু না ঘটলেও আক্রমণের আশংকা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বাঙালিগুলো যদি পাহারায় থাকে তাহলে মন্দ হয় না। গ্রামের লোকগুলোকে তো পাকিস্তানপন্থী বলেই মনে হয়েছে তাদের।

লোকজন স্লোগান স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছে রাতের বাতাস। তাদের স্লোগান ছিল-

পাকিস্তান জিন্দাবাদ,

পাক সেনা জিন্দাবাদ,

ভুট্টু জিন্দাবাদ,

ইয়াহিয়া জিন্দাবাদ,

কায়েদে আযম জিন্দাবাদ। (ক্রমশ...)

back to top