alt

সাময়িকী

কালের প্রেক্ষাপটে চিরসখা অন্নদাশঙ্কর রায়

বাদল বিহারী চক্রবর্তী

: রোববার, ১৪ নভেম্বর ২০২১

অন্নদাশঙ্কর রায় / জন্ম : ১৫ মার্চ ১৯০৪; মৃত্যু ২৮ অক্টোবর ২০০২

প্রায় শতবর্ষ আয়ুষ্মান ছিলেন যিনি, প্রবাদ প্রতিম যে ব্যক্তিত্ব, উনিশ শতকের শেষ প্রতিনিধি হিসেবে যাঁকে দুই বাংলার বিদ্বজ্জন এক কথায় চিহ্নিত করা যায়, উন্নত শিড়দাঁড়ায় কখনো কোন অবস্থায়ই ঘুষ আর ঘুষির কাছে মাথা নোয়াননি যিনি, তিনি যে অন্নদাশঙ্কর রায়- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সমকালে যেমন একটি বিস্ময়, আজ তাঁর নশ^র জীবন ত্যাগের প্রায় দুই দশক পরেও তেমনি বাংলাদেশ ও ভারতের আকাশে এক বিস্ময়কর উজ্জ্বল জুপিটারে মহিমান্বিত হয়ে আছেন তিনি।

অন্নদাশঙ্কর রায়ের (১৯০৪-২০০২) পূর্বপুরুষের বাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় ভাগীরথীর তীরে কোতরং গ্রামে। তাঁর পরিবার বংশপরম্পরায় বহুকাল ধরে উড়িষ্যার প্রবাসী বাঙালি। তিনি সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম ১৯০৪ সালের ১৫ই মার্চ, ছদ্মনাম-লীলাময় রায়; পিতা নিমাইচরণ ও মাতা হেমনলিনী। যদিও তাঁর প্রথম জীবনে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তাঁদের কোনকালেই যোগাযোগ ছিল না, সেটা সম্ভব হলো তাঁর চাকরির সুবাদে। মহকুমা শাসক পদে পদোন্নতি পেয়ে প্রথম বাঁকুড়া থেকে পূর্ববঙ্গের (বর্তমানে বাংলাদেশ) নওগাঁয় আসেন অন্নদাশঙ্কর রায়-সেটা ছিল ১৯৩১ সাল। তারপর চট্টগ্রাম ও ঢাকায় কর্মরত থেকে পুনরায় তিনি বাঁকুড়ায় বদলি হন ১৯৩৪ সালে, একই পদে। ১৯৩৫-এ কুষ্টিয়ায় এবং বছর দুই পর রাজশাহীর জেলা-প্রশাসনের দায়িত্ব বর্তায় তাঁর ওপর। কখনো বাংলা সরকারের অনুরাগ, কখনো বা বিরাগভাজন হতে হয় মিঃ রায়কে তাঁর কর্মজীবনে। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অন্নদাশঙ্করের ছিল অন্তরের গভীর টান।

উৎকলে জাত সেই সুবাদে প্রথম জীবনে উড়িয়া ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন অন্নদাশঙ্কর। উড়িয়া সাহিত্যে প্রসিদ্ধ ‘সবুজ’ গোষ্ঠীর অন্যতম কবি ছিলেন মিঃ রায়। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি বাংলাতেই লেখালেখির সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষের সুখ-আনন্দে যেমন আপ্লুত হতেন, তেমনি দুঃসংবাদেও বিচলিত হতেন। আর তাই সাধ্যমতো লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, একাত্ম হয়েছেন এদেশের বিপন্ন মানুষের সাথে। আর হবেন-ই বা না কেন, তিনি তো শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, নওগাঁই নয়, ১৯৪০ সালে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা জজের দায়িত্ব পালনশেষে ১৯৪৬-এ একই পদে দায়িত্ব নিয়ে ময়মনসিংহে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ পর্যন্ত মিঃ রায়ের আঠারো বছরের চাকরিজীবনে প্রায় দশ বছরই কেটেছে পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে। তাই কর্মজীবনাভিজ্ঞতায় নানা স্মৃতির সূত্রে বাঁধা শ্রীরায় এই বঙ্গের সাথে। এখানকার মানুষ ও প্রকৃতি তাঁকে চিরকালই আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করেছে। বরাবরই সংহতি প্রকাশ করে এসেছেন তিনি এ-বঙ্গভূমির মানুষের সাথে। প্রসঙ্গত মিঃ রায় সম্পর্কে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীর ‘বঙ্গবন্ধু : অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্মৃতি-অনুধ্যান’-শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ- সেই সঙ্গে বাংলা-ভাগ, অন্তর থেকে কখনোই তিনি মেনে নেননি। দেশভাগ-দাঙ্গা-দেশান্তর তাঁর অন্তরে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, হন মর্মাহত।’ আর সেই উষ্মাতেই তিনি লিখলেন- “তেলের শিশি ভাঙল বলে / খুকুর ’পরে রাগ করো / তোমরা যে সব বুড়ো খোকা / ভারত ভেঙে ভাগ করো, / তার বেলা, তার বেলা, তার বেলা?’

রাজনীতি ও সংসার-সমাজনীতির প্রেক্ষিতে কালজয়ী এ-লেখার অবশ্য একটি পটভূমি রয়েছে অন্নদাশঙ্করের ব্যক্তিগত জীবনে। উল্লেখ্য যে, পূর্ববঙ্গের সাতটি জেলায় ধারাবাহিকভাবে চাকরি করাকালীন তাঁর পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনজনের জন্মই এই বঙ্গে। তাঁর বিদেশিনী স্ত্রী অ্যালিস ভার্জিনিয়া অর্নডর্ফ- পরে যিনি লীলা রায় নামে পরিচিত- স্বামীর সান্নিধ্যেই যাঁর বাংলা শেখার সূচনা। যা হোক, ছড়াটির পটভূমিতে ফিরে আসি। তখন তিনি ময়মনসিংহের জজ। ব্রহ্মপুত্রের তীরে একটি সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন। সেই সময়কার স্মৃতিচারণ থেকেই পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক গৌতম রায় তাঁর একটি নিবন্ধে লিখলেন- ‘যুদ্ধের বাজার। খুব কষ্টে জিনিসপত্র জোগাড়-যন্ত্র করতে হয়। অন্নদাশঙ্করের একমাত্র বিলাসিতা- জবাকুসুম তেল মাখা মাথায়। ...সেদিন অফিস যাওয়ার আগে লিখতে একটু বেশি সময় খরচ হয়েছে তাঁর। তাড়াতাড়ি উঠে তেল মেখে স্নান করতে যাবেন; দেখেন ছোট মেয়ে তৃপ্তি জবাকুসুমের কাঁচের বোতলটি ভেঙে ফেলেছে। প্রথমটাতে একটু রেগে গেলেন অন্নদাশঙ্কর। যুদ্ধের বাজারে আবার এই তেল জোগাড় করা যে বেশ কঠিন একথা মনে করেই তাঁর রাগ হলো একটু বুঝি। রাগটা গিয়ে পড়ল ছোট্ট মেয়ে তৃপ্তির উপরেও। পরক্ষণেই ভাবলেন; একি! কার উপর আমি রাগ করছি? আমরা কী করছি? একটা ছোট শিশু তেলের শিশি ভেঙেছে, তার জন্য তার উপর রেগে যাচ্ছি, আর আমরা বুড়ো-ধাড়িরা, আমরা তো গোটা দেশটাকে ভেঙে টুক্রো টুক্রো করে দেওয়ার নেশায় মেতে উঠেছি।... মাথায় উঠল কোর্টে যাওয়া। ওই অবস্থার বশে লিখলেন তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি: অর্থাৎ ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে...’ ছড়াটি।

পূর্বদেশে বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন-নিগ্রহ-বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের আগ্রাসন- বাঙালির জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র- এসব প্রসঙ্গে আবুল আহসান চৌধুরীর মতে “ভিনদেশি” বিশুদ্ধ বাঙালি অন্নদাশঙ্কর বিবেকের নির্দেশে-শিল্পীর দায়বদ্ধতা নিয়ে-মানবিক ভূমিকা পালনের প্রেরণায় প্রতিবাদে মুখর হন। তিনি ১৯৫২ সালেই ভাষা-আন্দোলনের সময় লিখেছিলেন- ‘প্রাণ দিল যারা ভাষার জন্য/ জয় কি হবে না তাদের? / জয় তো তাদের হয়েই রয়েছে / জনতা পক্ষে যাদের।” -পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে মিঃ রায়ের পরিকল্পনা ও উদ্যোগে শান্তিনিকেতনে আয়োজিত হয় একুশের এই ঘটনাকে স্মরণ ও নতুন মাত্রায় তাৎপর্য দেওয়ার জন্যে এক ‘সাহিত্যমেলা’ -যা ছিল দুই বাংলার সাহিত্যিক মিলনমেলার নামান্তর।

পূর্ববঙ্গের মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র-রচনায় ব্রতী হয়, অন্নদাশঙ্কর তখন সক্রিয় সমর্থন, সহায়তা ও সাহস জুগিয়েছেন। সেই ক্রান্তিলগ্নে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সহায়তার জন্যে অর্থসংগ্রহ ও মানবিক সাহায্য প্রদানে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের প্রতিবাদে, বাঙালি জনগণের বিপন্নতায় সহানুভূতি জানিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে কলম ধরেন এই বিবেকি মানুষটি। অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধরীর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মারক লেখায় জানা যায়- ‘মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালির এই মহাজাগরণের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) সঙ্গত কারণেই অন্নদাশঙ্কর রায়ের মনোযোগের কেন্দ্রে অবস্থান করেন। তাঁর এই মুজিব-বীক্ষণ তিন পর্বে বিন্যস্ত: এক. মুক্তিযুদ্ধের কালপর্ব, দুই. স্বাধীন দেশের সময়কাল এবং তিন. লোকান্তরের পরপর্ব।’

স্বাধীন বাংলাদেশের অবরুদ্ধ সময়কালের যে উচ্চারণটির কথা শেষবার বাংলাদেশে এসে অন্নদাশঙ্করকে প্রায় প্রতিটি মানুষের কাছে একবার শুনতে হয়েছিল, যে অনবদ্য ছড়াটি- তা লেখারও কিন্তু একটা মজার ইতিহাস আছে। কলকাতার ময়দানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে একটি সভায় যাওয়ার জন্যে তাঁকে অনুরোধ করলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। নির্ধারিত দিনে অন্নদাশঙ্করকে ময়দানের সভায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বর্তায় চলচ্চিত্র-অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্বামী অভিনেতা নির্মলকুমারের ওপর। অভিনেত্রী এলেন অন্নদাশঙ্করকে ময়দানে নিয়ে যেতে। কিন্তু তাঁদের গাড়ি ময়দানে পৌঁছতেই বিপত্তি বাধে- প্রিয় শিল্পীকে একেবারে কাছটিতে পেয়ে উন্মত্ত ভক্তের দল গাড়ির দিকে ছুটে আসতে থাকে। তখন স্বাভাবিকভাবেই সন্ত্রস্ত মাধবী। এ ব্যাপারে প্রাবন্ধিক গৌতম রায় লিখেন- ‘তিনি ময়দানে তাঁকে নিয়ে গিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে অন্নদাশঙ্করের ভাষায় চম্পট দিলেন।’ অন্নদাশঙ্কর দেখেন সভায় তারাশঙ্কর ‘তারস্বরে’ বক্তৃতা করছেন। নিজের উদ্যোগে কোনভাবে বাড়িতে ফিরে গিয়ে লিখতে বসলেন তিনি-

যতকাল রবে পদ্মা যমুনা

গৌরী মেঘনা বহমান,

ততকাল রবে কীর্তি তোমার

শেখ মুজিবুর রহমান। ’

বলাই বাহুল্য এই কালজয়ী লেখাটি মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তি ও স্বাধীনতাকামী জনগণকে যতটা প্রেরণা দিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর লোকান্তরে, জাতির পিতাহারা বাংলায় দুঃখভারাক্রান্ত বাঙালির মনেও তা নিরন্তর প্রেরণার আধার হয়ে আছে এবং থাকবেও চিরকাল।

গৌতম রায়ের লেখায়- ‘এই অন্নদাশঙ্কর তাঁর বোন-সম্পর্কিত কবি সুফিয়া কামালের কাছ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের কীর্তিকলাপ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে ১৯৭৫-এ তাদের পুনরাভিষেকের সমস্ত কিছু খবরাখবর পাওয়ার পর বসে থাকতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সম্মিলিত করবার উদ্দেশ্যে কলম ধরেছেন।’ হ্যাঁ, একথা স্মর্তব্য যে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যখন ঘাতক-দালাল গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দি ময়দানে গণআদালত অনুষ্ঠিত হয়, তার পক্ষে কলম ধরতে দ্বিধা করেননি অন্নদাশঙ্কর। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্বপালন শেষে বাকি জীবন সেখানেই কাটান তিনি। কিন্তু তাঁর মনটা এপার বাংলার নানামুখী কর্মজীবনাভিজ্ঞতার স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকতো এদেশে।

বাংলাদেশের যশস্বী সাহিত্যিক ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদের সাথে অন্নদাশঙ্করের প্রাণের সংযোগ ছিল, তাঁদের মধ্যে কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একজন। স্বাধীনতার অনেককাল পর মিঃ ইলিয়াসের প্রবল ইচ্ছে-কলকাতায় গিয়ে অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে দেখা করা। ইলিয়াস ওঠলেন যাদবপুরে দূরদর্শনের মন্দিরা পাল, দিলীপ পালদের বাড়ি। মরণব্যাধি ক্যান্সারের একটা পর্যায়ে আক্রান্ত ইলিয়াস। গৌতম রায় মিঃ ইলিয়াসের এ-ইচ্ছের কথা অন্নদাশঙ্করকে জানাতেই অন্নদাশঙ্কর দৃঢ়তার সঙ্গেই বললেন- ‘নিশ্চয়ই তুমি ওঁকে নিয়ে আসবে। কিন্তু তার আগে দরকার ওঁর কিছু লেখা পড়া। তুমি ওঁর দুই-একটা বই আমাকে দিয়ে যাও। আমি রাত জেগে সেই লেখাগুলো পড়ে নিই ; গৌতম বাবু বললেন, “পৌঁছে দিলাম ‘দুধভাতে উৎপাত’, ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ আর ‘খেয়ারি’।”- উল্লেখ্য যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পিতা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ছিলেন পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৪৭-১৯৫৩) এবং মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি। হলেও তিনি ছিলেন প্রগতিশীল ধারার সঙ্গে যুক্ত। অবশ্যই অন্নদাশঙ্করের লেখার প্রতি ছিল তাঁর পাঠমুগ্ধতা। তাই গৌতম রায়ের লেখা থেকেই জানতে পারি- “আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যখন সস্ত্রীক অন্নদাশঙ্করের বাড়ি গেলেন, তখন আপ্লুত ইলিয়াস প্রথমেই বললেন- ‘আমার বাবা যদি আজ বেঁচে থাকতেন, সব থেকে খুশি হতেন তিনি। আপনার বই আমি প্রথম পড়ি বাবার সংগ্রহ থেকে নিয়ে।’ -আখতারুজ্জামানের কাছে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে তাঁর পিতা বদিউজ্জামানের কথা জানতে চাইলেন অন্নদাশঙ্কর।”

পরবর্তীকালে শারীরিক অসুস্থতার বাড়-বাড়ন্তে যখন মিঃ ইলিয়াস ওঠলেন কংগ্রেসের একজিবিশন রোডে নাজেস আফরোজের খালার বাড়িতে, তখন নিজের শরীর, বয়স সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে ট্যাক্সি চড়ে অন্নদাশঙ্কর ছুটে গেলেন অসুস্থ ইলিয়াসকে দেখতে। ইলিয়াস এবং পত্নী সুরাইয়া পরম সমাদরে আপ্যায়ন করলেন অন্নদাশঙ্করকে। পরে আখতারুজ্জামান ঢাকায় ফিরে এসে একটি চিঠিতে তাঁর বিস্ময় প্রকাশ করে জানিয়েছেন এই বলে যে- প্রবাদপ্রতিম অন্নদাশঙ্করের মতো সাহিত্য ও সমাজ- চিন্তানায়ক তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন বলে। এ-বিস্ময় আখতারুজ্জামানের জীবনের শেষাবধি জাগরূক ছিল।

অন্নদাশঙ্কর প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রতি বিশেষ রকমের গুণগ্রাহী ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের সময়নিষ্ঠতার প্রশ্নে। তিনি বলতেন- ‘মানিক (সত্যজিতের ডাকনাম) একটি মুহূর্ত সময় নষ্ট করে না। হয় সে লিখছে, নয়তো আঁকছে, নয়তো চিত্রনাট্য করছে। নয়তো গানের সুর করছে কিংবা গান শুনছে বা ছবি দেখছে। সত্যজিৎ রায় অন্নদাশঙ্করের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল হলেও তাঁর বুঝি একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব ছিল অন্নদাশঙ্করপত্নী লীলা রায়ের প্রতি। মাসিমার প্রতি সত্যজিতের এই সশ্রদ্ধ নমনীয়তার কারণটা হয়তো অনেকের জানা নেই যে- সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অশনি সংকেত’ থেকে ‘ঘরে বাইরে’ ছবিগুলোর সাবটাইটেল কিন্তু করেছিলেন মাসিমা লীলা রায়।

অন্নদাশঙ্কর সম্পর্কিত নিবন্ধে গৌতম রায় বাংলাদেশের দুই প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীর অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে দেখা করা নিয়ে লিখলেন- “আহমদ শরিফ এসেছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর ঘরে বসে আলাপ-আলোচনা চলছে। এমন অবস্থাতেই কবীর চৌধুরী এলেন। কবীর চৌধুরী, আহমদ শরিফ থাকার কারণে অন্নদাশঙ্করের ঘরে যেতে চাইলেন না। আমার ঘরে বসলেন। ঘটনাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে অন্নদাশঙ্কর আমাকে বললেন; ‘এখনই গিয়ে ওঁকে ডেকে নিয়ে এসো আমার ঘরে।’- পরস্পর বিবদমান মুক্তবুদ্ধির দুই স্তম্ভকে নিজেদের ভেতরের যাবতীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাত সরিয়ে মিলিয়ে দিলেন এ-যুগের ভলতেয়ার অন্নদাশঙ্কর।”

’৭৫-এর বিয়োগান্তক নৃশংস হত্যাকা- নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অন্নদাশঙ্কর মন্তব্য করেছিলেন, ‘ধর্ম বনাম ভাষা, এইখানেই যে বাংলাদেশের ট্রাজেডী।’ এ ব্যাপারে অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীর প্রবন্ধ-সমীক্ষায় বলা হয়েছে- ‘কথাটি হয়তো সাময়িক সত্য, তবে শাশ^ত সত্য নয়।’ -বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অন্নদাশঙ্করের বিস্তর আলোচনা ও রচনা রয়েছে। এতটা বিস্তৃত আলোচনা একদিনে সম্ভব নয়। শুধু এটুকুই বলতে পারি, অন্নদাশঙ্কর কালের প্রেক্ষাপটে ও আপন অভিজ্ঞতার আলোকে বঙ্গবন্ধুকে বিচার করেছেন- ‘সেই মুজিব ইতিহাসের মুজিব, কিংবদন্তির মুজিব, মানুষের মুজিব।

পূর্ববঙ্গের মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র-রচনায় ব্রতী হয়, অন্নদাশঙ্কর তখন সক্রিয় সমর্থন, সহায়তা ও সাহস জুগিয়েছেন। সেই ক্রান্তিলগ্নে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সহায়তার জন্যে অর্থসংগ্রহ ও মানবিক সাহায্য প্রদানে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন

অন্নদাশঙ্কর ছিলেন বাংলাদেশের একান্ত সুহৃদ ও শুভাকাক্সক্ষী। এদেশের জন্যে নিত্য কল্যাণ কামনা করেছেন তিনি; এদেশের উন্নয়ন নিয়ে আশাবাদীও ছিলেন। ১৯৯৬-এর ডিসেম্বরে শেষবারের মতো তিনি তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে এসেছিলেন, প্রিয় দেশের বিজয়-উৎসবের রজত জয়ন্তীতে। এসেছিলেন তাঁর প্রিয় মানুষ ও ‘জননায়ক ’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি শোকাঞ্জলি নিবেদন করতে।

২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর মহাপ্রয়াণ ঘটে অন্নদাশঙ্করের। শতাব্দীছোঁয়া চিরবান্ধব চিন্তানায়ক সাহিত্যব্রতী এই মনীষীর প্রাণহীন নশ^র দেহের বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ছবি

অস্থির পৃথিবীর মায়াবী কবি

ছবি

সম্প্রীতির সাধক মরমী বাউল উকিল মুন্সী

ছবি

‘দিবারাত্রির কাব্য’ এবং ‘দ্য আউটসাইডার’ এক নিবিড় সাযুজ্য

ছবি

চুক্তি লিখন

ছবি

লিওপল্ড সেদর সেঙ্ঘর-এর কবিতা

ছবি

হিমু ও হুমায়ূন আহমেদ

শরতের পদাবলি

সাময়িকী কবিতা

মার্কিন চলচ্চিত্র জগতের প্রাণকেন্দ্র লস এঞ্জেলেস

ছবি

যুদ্ধের জানালায় দাঁড়িয়ে

ছবি

শব্দঘর : বিপ্লব, দ্রোহ ও গুচ্ছ কবিতা সংখ্যা

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

সালভাতর কোয়াসিমোদোর কবিতা

ছবি

টুটু

ছবি

অর্ধেক জীবন

ছবি

ক্যান্ডি, শ্রীলঙ্কায় বেড়ানোর আদর্শ জায়গা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘দূরের কার্নিশ’

ছবি

কবিতায় উড়ন্ত সারস

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

রবীন্দ্রসংগীত চর্চা, বাংলাদেশে-

শক্তিমান কবির কলমে গল্প

ছবি

শহীদুল হকের জীবন ও আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা

ছবি

জলবন্দী স্বপ্ন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কমল চক্রবর্তী, আদি ও অকৃত্রিম রিংমাস্টার

ছবি

নূরুল হক : আধুনিক মরমি কবি

ছবি

ও. হেনরি : ছোটগল্পের কালজয়ী অগ্রদূত

ছবি

নজরুল : বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী মানব-বিজয়-কেতন

ছবি

নিছক সাজুর গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কবিতায় বিশ্বস্ত স্বর

ছবি

স্মৃতির আয়নাজুড়ে শহীদ ভাই

ছবি

ব্যক্তিগত শহীদ

ছবি

দূরের তারাটিকে

ছবি

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

tab

সাময়িকী

কালের প্রেক্ষাপটে চিরসখা অন্নদাশঙ্কর রায়

বাদল বিহারী চক্রবর্তী

অন্নদাশঙ্কর রায় / জন্ম : ১৫ মার্চ ১৯০৪; মৃত্যু ২৮ অক্টোবর ২০০২

রোববার, ১৪ নভেম্বর ২০২১

প্রায় শতবর্ষ আয়ুষ্মান ছিলেন যিনি, প্রবাদ প্রতিম যে ব্যক্তিত্ব, উনিশ শতকের শেষ প্রতিনিধি হিসেবে যাঁকে দুই বাংলার বিদ্বজ্জন এক কথায় চিহ্নিত করা যায়, উন্নত শিড়দাঁড়ায় কখনো কোন অবস্থায়ই ঘুষ আর ঘুষির কাছে মাথা নোয়াননি যিনি, তিনি যে অন্নদাশঙ্কর রায়- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সমকালে যেমন একটি বিস্ময়, আজ তাঁর নশ^র জীবন ত্যাগের প্রায় দুই দশক পরেও তেমনি বাংলাদেশ ও ভারতের আকাশে এক বিস্ময়কর উজ্জ্বল জুপিটারে মহিমান্বিত হয়ে আছেন তিনি।

অন্নদাশঙ্কর রায়ের (১৯০৪-২০০২) পূর্বপুরুষের বাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় ভাগীরথীর তীরে কোতরং গ্রামে। তাঁর পরিবার বংশপরম্পরায় বহুকাল ধরে উড়িষ্যার প্রবাসী বাঙালি। তিনি সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম ১৯০৪ সালের ১৫ই মার্চ, ছদ্মনাম-লীলাময় রায়; পিতা নিমাইচরণ ও মাতা হেমনলিনী। যদিও তাঁর প্রথম জীবনে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তাঁদের কোনকালেই যোগাযোগ ছিল না, সেটা সম্ভব হলো তাঁর চাকরির সুবাদে। মহকুমা শাসক পদে পদোন্নতি পেয়ে প্রথম বাঁকুড়া থেকে পূর্ববঙ্গের (বর্তমানে বাংলাদেশ) নওগাঁয় আসেন অন্নদাশঙ্কর রায়-সেটা ছিল ১৯৩১ সাল। তারপর চট্টগ্রাম ও ঢাকায় কর্মরত থেকে পুনরায় তিনি বাঁকুড়ায় বদলি হন ১৯৩৪ সালে, একই পদে। ১৯৩৫-এ কুষ্টিয়ায় এবং বছর দুই পর রাজশাহীর জেলা-প্রশাসনের দায়িত্ব বর্তায় তাঁর ওপর। কখনো বাংলা সরকারের অনুরাগ, কখনো বা বিরাগভাজন হতে হয় মিঃ রায়কে তাঁর কর্মজীবনে। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অন্নদাশঙ্করের ছিল অন্তরের গভীর টান।

উৎকলে জাত সেই সুবাদে প্রথম জীবনে উড়িয়া ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন অন্নদাশঙ্কর। উড়িয়া সাহিত্যে প্রসিদ্ধ ‘সবুজ’ গোষ্ঠীর অন্যতম কবি ছিলেন মিঃ রায়। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি বাংলাতেই লেখালেখির সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষের সুখ-আনন্দে যেমন আপ্লুত হতেন, তেমনি দুঃসংবাদেও বিচলিত হতেন। আর তাই সাধ্যমতো লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, একাত্ম হয়েছেন এদেশের বিপন্ন মানুষের সাথে। আর হবেন-ই বা না কেন, তিনি তো শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, নওগাঁই নয়, ১৯৪০ সালে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা জজের দায়িত্ব পালনশেষে ১৯৪৬-এ একই পদে দায়িত্ব নিয়ে ময়মনসিংহে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ পর্যন্ত মিঃ রায়ের আঠারো বছরের চাকরিজীবনে প্রায় দশ বছরই কেটেছে পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে। তাই কর্মজীবনাভিজ্ঞতায় নানা স্মৃতির সূত্রে বাঁধা শ্রীরায় এই বঙ্গের সাথে। এখানকার মানুষ ও প্রকৃতি তাঁকে চিরকালই আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করেছে। বরাবরই সংহতি প্রকাশ করে এসেছেন তিনি এ-বঙ্গভূমির মানুষের সাথে। প্রসঙ্গত মিঃ রায় সম্পর্কে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীর ‘বঙ্গবন্ধু : অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্মৃতি-অনুধ্যান’-শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ- সেই সঙ্গে বাংলা-ভাগ, অন্তর থেকে কখনোই তিনি মেনে নেননি। দেশভাগ-দাঙ্গা-দেশান্তর তাঁর অন্তরে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, হন মর্মাহত।’ আর সেই উষ্মাতেই তিনি লিখলেন- “তেলের শিশি ভাঙল বলে / খুকুর ’পরে রাগ করো / তোমরা যে সব বুড়ো খোকা / ভারত ভেঙে ভাগ করো, / তার বেলা, তার বেলা, তার বেলা?’

রাজনীতি ও সংসার-সমাজনীতির প্রেক্ষিতে কালজয়ী এ-লেখার অবশ্য একটি পটভূমি রয়েছে অন্নদাশঙ্করের ব্যক্তিগত জীবনে। উল্লেখ্য যে, পূর্ববঙ্গের সাতটি জেলায় ধারাবাহিকভাবে চাকরি করাকালীন তাঁর পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনজনের জন্মই এই বঙ্গে। তাঁর বিদেশিনী স্ত্রী অ্যালিস ভার্জিনিয়া অর্নডর্ফ- পরে যিনি লীলা রায় নামে পরিচিত- স্বামীর সান্নিধ্যেই যাঁর বাংলা শেখার সূচনা। যা হোক, ছড়াটির পটভূমিতে ফিরে আসি। তখন তিনি ময়মনসিংহের জজ। ব্রহ্মপুত্রের তীরে একটি সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন। সেই সময়কার স্মৃতিচারণ থেকেই পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক গৌতম রায় তাঁর একটি নিবন্ধে লিখলেন- ‘যুদ্ধের বাজার। খুব কষ্টে জিনিসপত্র জোগাড়-যন্ত্র করতে হয়। অন্নদাশঙ্করের একমাত্র বিলাসিতা- জবাকুসুম তেল মাখা মাথায়। ...সেদিন অফিস যাওয়ার আগে লিখতে একটু বেশি সময় খরচ হয়েছে তাঁর। তাড়াতাড়ি উঠে তেল মেখে স্নান করতে যাবেন; দেখেন ছোট মেয়ে তৃপ্তি জবাকুসুমের কাঁচের বোতলটি ভেঙে ফেলেছে। প্রথমটাতে একটু রেগে গেলেন অন্নদাশঙ্কর। যুদ্ধের বাজারে আবার এই তেল জোগাড় করা যে বেশ কঠিন একথা মনে করেই তাঁর রাগ হলো একটু বুঝি। রাগটা গিয়ে পড়ল ছোট্ট মেয়ে তৃপ্তির উপরেও। পরক্ষণেই ভাবলেন; একি! কার উপর আমি রাগ করছি? আমরা কী করছি? একটা ছোট শিশু তেলের শিশি ভেঙেছে, তার জন্য তার উপর রেগে যাচ্ছি, আর আমরা বুড়ো-ধাড়িরা, আমরা তো গোটা দেশটাকে ভেঙে টুক্রো টুক্রো করে দেওয়ার নেশায় মেতে উঠেছি।... মাথায় উঠল কোর্টে যাওয়া। ওই অবস্থার বশে লিখলেন তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি: অর্থাৎ ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে...’ ছড়াটি।

পূর্বদেশে বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন-নিগ্রহ-বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের আগ্রাসন- বাঙালির জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র- এসব প্রসঙ্গে আবুল আহসান চৌধুরীর মতে “ভিনদেশি” বিশুদ্ধ বাঙালি অন্নদাশঙ্কর বিবেকের নির্দেশে-শিল্পীর দায়বদ্ধতা নিয়ে-মানবিক ভূমিকা পালনের প্রেরণায় প্রতিবাদে মুখর হন। তিনি ১৯৫২ সালেই ভাষা-আন্দোলনের সময় লিখেছিলেন- ‘প্রাণ দিল যারা ভাষার জন্য/ জয় কি হবে না তাদের? / জয় তো তাদের হয়েই রয়েছে / জনতা পক্ষে যাদের।” -পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে মিঃ রায়ের পরিকল্পনা ও উদ্যোগে শান্তিনিকেতনে আয়োজিত হয় একুশের এই ঘটনাকে স্মরণ ও নতুন মাত্রায় তাৎপর্য দেওয়ার জন্যে এক ‘সাহিত্যমেলা’ -যা ছিল দুই বাংলার সাহিত্যিক মিলনমেলার নামান্তর।

পূর্ববঙ্গের মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র-রচনায় ব্রতী হয়, অন্নদাশঙ্কর তখন সক্রিয় সমর্থন, সহায়তা ও সাহস জুগিয়েছেন। সেই ক্রান্তিলগ্নে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সহায়তার জন্যে অর্থসংগ্রহ ও মানবিক সাহায্য প্রদানে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের প্রতিবাদে, বাঙালি জনগণের বিপন্নতায় সহানুভূতি জানিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে কলম ধরেন এই বিবেকি মানুষটি। অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধরীর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মারক লেখায় জানা যায়- ‘মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালির এই মহাজাগরণের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) সঙ্গত কারণেই অন্নদাশঙ্কর রায়ের মনোযোগের কেন্দ্রে অবস্থান করেন। তাঁর এই মুজিব-বীক্ষণ তিন পর্বে বিন্যস্ত: এক. মুক্তিযুদ্ধের কালপর্ব, দুই. স্বাধীন দেশের সময়কাল এবং তিন. লোকান্তরের পরপর্ব।’

স্বাধীন বাংলাদেশের অবরুদ্ধ সময়কালের যে উচ্চারণটির কথা শেষবার বাংলাদেশে এসে অন্নদাশঙ্করকে প্রায় প্রতিটি মানুষের কাছে একবার শুনতে হয়েছিল, যে অনবদ্য ছড়াটি- তা লেখারও কিন্তু একটা মজার ইতিহাস আছে। কলকাতার ময়দানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে একটি সভায় যাওয়ার জন্যে তাঁকে অনুরোধ করলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। নির্ধারিত দিনে অন্নদাশঙ্করকে ময়দানের সভায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বর্তায় চলচ্চিত্র-অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্বামী অভিনেতা নির্মলকুমারের ওপর। অভিনেত্রী এলেন অন্নদাশঙ্করকে ময়দানে নিয়ে যেতে। কিন্তু তাঁদের গাড়ি ময়দানে পৌঁছতেই বিপত্তি বাধে- প্রিয় শিল্পীকে একেবারে কাছটিতে পেয়ে উন্মত্ত ভক্তের দল গাড়ির দিকে ছুটে আসতে থাকে। তখন স্বাভাবিকভাবেই সন্ত্রস্ত মাধবী। এ ব্যাপারে প্রাবন্ধিক গৌতম রায় লিখেন- ‘তিনি ময়দানে তাঁকে নিয়ে গিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে অন্নদাশঙ্করের ভাষায় চম্পট দিলেন।’ অন্নদাশঙ্কর দেখেন সভায় তারাশঙ্কর ‘তারস্বরে’ বক্তৃতা করছেন। নিজের উদ্যোগে কোনভাবে বাড়িতে ফিরে গিয়ে লিখতে বসলেন তিনি-

যতকাল রবে পদ্মা যমুনা

গৌরী মেঘনা বহমান,

ততকাল রবে কীর্তি তোমার

শেখ মুজিবুর রহমান। ’

বলাই বাহুল্য এই কালজয়ী লেখাটি মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তি ও স্বাধীনতাকামী জনগণকে যতটা প্রেরণা দিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর লোকান্তরে, জাতির পিতাহারা বাংলায় দুঃখভারাক্রান্ত বাঙালির মনেও তা নিরন্তর প্রেরণার আধার হয়ে আছে এবং থাকবেও চিরকাল।

গৌতম রায়ের লেখায়- ‘এই অন্নদাশঙ্কর তাঁর বোন-সম্পর্কিত কবি সুফিয়া কামালের কাছ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের কীর্তিকলাপ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে ১৯৭৫-এ তাদের পুনরাভিষেকের সমস্ত কিছু খবরাখবর পাওয়ার পর বসে থাকতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সম্মিলিত করবার উদ্দেশ্যে কলম ধরেছেন।’ হ্যাঁ, একথা স্মর্তব্য যে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যখন ঘাতক-দালাল গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দি ময়দানে গণআদালত অনুষ্ঠিত হয়, তার পক্ষে কলম ধরতে দ্বিধা করেননি অন্নদাশঙ্কর। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্বপালন শেষে বাকি জীবন সেখানেই কাটান তিনি। কিন্তু তাঁর মনটা এপার বাংলার নানামুখী কর্মজীবনাভিজ্ঞতার স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকতো এদেশে।

বাংলাদেশের যশস্বী সাহিত্যিক ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদের সাথে অন্নদাশঙ্করের প্রাণের সংযোগ ছিল, তাঁদের মধ্যে কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একজন। স্বাধীনতার অনেককাল পর মিঃ ইলিয়াসের প্রবল ইচ্ছে-কলকাতায় গিয়ে অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে দেখা করা। ইলিয়াস ওঠলেন যাদবপুরে দূরদর্শনের মন্দিরা পাল, দিলীপ পালদের বাড়ি। মরণব্যাধি ক্যান্সারের একটা পর্যায়ে আক্রান্ত ইলিয়াস। গৌতম রায় মিঃ ইলিয়াসের এ-ইচ্ছের কথা অন্নদাশঙ্করকে জানাতেই অন্নদাশঙ্কর দৃঢ়তার সঙ্গেই বললেন- ‘নিশ্চয়ই তুমি ওঁকে নিয়ে আসবে। কিন্তু তার আগে দরকার ওঁর কিছু লেখা পড়া। তুমি ওঁর দুই-একটা বই আমাকে দিয়ে যাও। আমি রাত জেগে সেই লেখাগুলো পড়ে নিই ; গৌতম বাবু বললেন, “পৌঁছে দিলাম ‘দুধভাতে উৎপাত’, ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ আর ‘খেয়ারি’।”- উল্লেখ্য যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পিতা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ছিলেন পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৪৭-১৯৫৩) এবং মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি। হলেও তিনি ছিলেন প্রগতিশীল ধারার সঙ্গে যুক্ত। অবশ্যই অন্নদাশঙ্করের লেখার প্রতি ছিল তাঁর পাঠমুগ্ধতা। তাই গৌতম রায়ের লেখা থেকেই জানতে পারি- “আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যখন সস্ত্রীক অন্নদাশঙ্করের বাড়ি গেলেন, তখন আপ্লুত ইলিয়াস প্রথমেই বললেন- ‘আমার বাবা যদি আজ বেঁচে থাকতেন, সব থেকে খুশি হতেন তিনি। আপনার বই আমি প্রথম পড়ি বাবার সংগ্রহ থেকে নিয়ে।’ -আখতারুজ্জামানের কাছে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে তাঁর পিতা বদিউজ্জামানের কথা জানতে চাইলেন অন্নদাশঙ্কর।”

পরবর্তীকালে শারীরিক অসুস্থতার বাড়-বাড়ন্তে যখন মিঃ ইলিয়াস ওঠলেন কংগ্রেসের একজিবিশন রোডে নাজেস আফরোজের খালার বাড়িতে, তখন নিজের শরীর, বয়স সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে ট্যাক্সি চড়ে অন্নদাশঙ্কর ছুটে গেলেন অসুস্থ ইলিয়াসকে দেখতে। ইলিয়াস এবং পত্নী সুরাইয়া পরম সমাদরে আপ্যায়ন করলেন অন্নদাশঙ্করকে। পরে আখতারুজ্জামান ঢাকায় ফিরে এসে একটি চিঠিতে তাঁর বিস্ময় প্রকাশ করে জানিয়েছেন এই বলে যে- প্রবাদপ্রতিম অন্নদাশঙ্করের মতো সাহিত্য ও সমাজ- চিন্তানায়ক তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন বলে। এ-বিস্ময় আখতারুজ্জামানের জীবনের শেষাবধি জাগরূক ছিল।

অন্নদাশঙ্কর প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রতি বিশেষ রকমের গুণগ্রাহী ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের সময়নিষ্ঠতার প্রশ্নে। তিনি বলতেন- ‘মানিক (সত্যজিতের ডাকনাম) একটি মুহূর্ত সময় নষ্ট করে না। হয় সে লিখছে, নয়তো আঁকছে, নয়তো চিত্রনাট্য করছে। নয়তো গানের সুর করছে কিংবা গান শুনছে বা ছবি দেখছে। সত্যজিৎ রায় অন্নদাশঙ্করের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল হলেও তাঁর বুঝি একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব ছিল অন্নদাশঙ্করপত্নী লীলা রায়ের প্রতি। মাসিমার প্রতি সত্যজিতের এই সশ্রদ্ধ নমনীয়তার কারণটা হয়তো অনেকের জানা নেই যে- সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অশনি সংকেত’ থেকে ‘ঘরে বাইরে’ ছবিগুলোর সাবটাইটেল কিন্তু করেছিলেন মাসিমা লীলা রায়।

অন্নদাশঙ্কর সম্পর্কিত নিবন্ধে গৌতম রায় বাংলাদেশের দুই প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীর অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে দেখা করা নিয়ে লিখলেন- “আহমদ শরিফ এসেছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর ঘরে বসে আলাপ-আলোচনা চলছে। এমন অবস্থাতেই কবীর চৌধুরী এলেন। কবীর চৌধুরী, আহমদ শরিফ থাকার কারণে অন্নদাশঙ্করের ঘরে যেতে চাইলেন না। আমার ঘরে বসলেন। ঘটনাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে অন্নদাশঙ্কর আমাকে বললেন; ‘এখনই গিয়ে ওঁকে ডেকে নিয়ে এসো আমার ঘরে।’- পরস্পর বিবদমান মুক্তবুদ্ধির দুই স্তম্ভকে নিজেদের ভেতরের যাবতীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাত সরিয়ে মিলিয়ে দিলেন এ-যুগের ভলতেয়ার অন্নদাশঙ্কর।”

’৭৫-এর বিয়োগান্তক নৃশংস হত্যাকা- নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অন্নদাশঙ্কর মন্তব্য করেছিলেন, ‘ধর্ম বনাম ভাষা, এইখানেই যে বাংলাদেশের ট্রাজেডী।’ এ ব্যাপারে অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীর প্রবন্ধ-সমীক্ষায় বলা হয়েছে- ‘কথাটি হয়তো সাময়িক সত্য, তবে শাশ^ত সত্য নয়।’ -বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অন্নদাশঙ্করের বিস্তর আলোচনা ও রচনা রয়েছে। এতটা বিস্তৃত আলোচনা একদিনে সম্ভব নয়। শুধু এটুকুই বলতে পারি, অন্নদাশঙ্কর কালের প্রেক্ষাপটে ও আপন অভিজ্ঞতার আলোকে বঙ্গবন্ধুকে বিচার করেছেন- ‘সেই মুজিব ইতিহাসের মুজিব, কিংবদন্তির মুজিব, মানুষের মুজিব।

পূর্ববঙ্গের মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র-রচনায় ব্রতী হয়, অন্নদাশঙ্কর তখন সক্রিয় সমর্থন, সহায়তা ও সাহস জুগিয়েছেন। সেই ক্রান্তিলগ্নে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সহায়তার জন্যে অর্থসংগ্রহ ও মানবিক সাহায্য প্রদানে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন

অন্নদাশঙ্কর ছিলেন বাংলাদেশের একান্ত সুহৃদ ও শুভাকাক্সক্ষী। এদেশের জন্যে নিত্য কল্যাণ কামনা করেছেন তিনি; এদেশের উন্নয়ন নিয়ে আশাবাদীও ছিলেন। ১৯৯৬-এর ডিসেম্বরে শেষবারের মতো তিনি তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে এসেছিলেন, প্রিয় দেশের বিজয়-উৎসবের রজত জয়ন্তীতে। এসেছিলেন তাঁর প্রিয় মানুষ ও ‘জননায়ক ’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি শোকাঞ্জলি নিবেদন করতে।

২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর মহাপ্রয়াণ ঘটে অন্নদাশঙ্করের। শতাব্দীছোঁয়া চিরবান্ধব চিন্তানায়ক সাহিত্যব্রতী এই মনীষীর প্রাণহীন নশ^র দেহের বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।

back to top