নজরুল হায়াত
এক.
মনজুরুল আহসান বুলবুল বাংলাদেশের অন্যতম রাজনীতি ও গণসচেতন ছড়াকার। লিখছেন সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে। সম্প্রতি তার প্রথম ছড়াকাব্য ‘দুইশ’ ছড়ার ঝিলিক’ প্রকাশিত হয়েছে। মাঝখানে ক্যারিয়ার গঠনে সাংবাদিকতা, সাংবাদিক নেতৃত্ব ও টিভি উপদেশক হিসেবে অনেকটা সময় ব্যয় করলেও তিনি যে ছড়ার জগৎ থেকে মোটেও বিচ্ছিন্ন হননি এ গ্রন্থ তার প্রমাণ। কালানুক্রমিক সাজানো না হলেও গ্রন্থটিতে সাতাত্তর থেকে হালের লেখা ছড়াটিও জায়গা করে নিয়েছে। ক্যারিয়ার গঠন বুলবুলকে কতটা বদলেছে জানি না, কিন্তু ওর ছড়ার চরিত্র যে মোটেও বদলায়নি সেটা হলফ করে বলা যায়। আবার এটাও হলফ করে বলা যায় যে ক্যারিয়ার গঠন ছড়াকার হিসেবে ওর বিপুল সম্ভাবনা ও জনপ্রিয়তাকেও প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।
এই যে বুলবুল গণমানুষের ছড়াকার হয়ে উঠলো এর সিংহভাগ কৃতিত্বের প্রায় সবটাই প্রাপ্য ওর রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতার। ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়ন দিয়ে শুরু, পরে কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্রব, ওর লেখার উপর আলোচনায় এ প্রসঙ্গটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম জীবনে কোনো দর্শন, চিন্তা, মতবাদ কিম্বা রাজনীতির সাথে সংযোগ একজন লেখকের মনোজগতের একটা ভিত ও প্যাটার্ন, রচনা-বিষয়ের বিশিষ্ট চরিত্র ও প্রবণতা এবং চিন্তার আলাদা প্রকরণ গড়ে দেয়। বুলবুলের বেলায় এটাই ঘটেছে এবং একই কারণে ময়মনসিংহের ওর সমসাময়িক অন্য কবিদের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি।
সত্তরের দশকে বুলবুল যখন লিখতে শুরু করেন তখন দেশ পশ্চাৎমুখি প্রতিক্রিয়াশীল দ্বিজাতিতত্ত্ববাদীর কবলে। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শসমূহ, সংবিধানের চারটি মূলনীতিই ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত আর তার জায়গায় পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূতাদর্শ প্রতিস্থাপিত। এসব ঘটনা সেসময়কার স্বাধীনতার স্বপক্ষ প্রগতিবাদী মুক্তচেতন লেখক, চিন্তকদের প্রবলভাবে হতাশ, ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী করে তুলেছে। বুলবুলও এ ঘটনায় আহত হয়েছেন এবং ছড়ার শাণিত অস্ত্রের মধ্য দিয়ে তার বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
দুই.
ছড়ার সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে অর্থহীন হোক কি অর্থযুক্ত শিশুমনে কল্পলোকের রোমাঞ্চ তৈরি করা। সেই আদিম বন্য জীবনে জন্ম নেয়া প্রথম ছড়াকার থেকে আজকের ছড়া রচয়িতা পর্যন্ত এটাই চলে আসছে। ইতোমধ্যে আঠারো-উনিশ শতকে ইউরোপে সংঘটিত রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে সাহিত্যের বিবিধ শাখায় বিপুল বস্তুবাদী পরিবর্তন ঘটলেও ছড়ার ক্ষেত্রে তার প্রভাব ব্যাপকতা পায়নি। ছড়াকাররা শিশু তোষণ প্রাধান্য রেখেই ছড়া লিখছেন। আশ্চর্যজনকভাবে বুলবুলের ছড়ায় এ প্রবণতার উপস্থিতি খুবই সামান্য। বুলবুলের ছড়ায় সিংহভাগেরই বহিরঙ্গ ও অন্তঃস্থল জুড়ে শিশু-কিশোরের মনোলোকে কল্পগল্প তৈরির চেয়ে চৈতন্যে নাড়া দিতেই জোরালো ভূমিকা রেখেছে। যেমন ৩২ সংখ্যক ছড়ায়-
খোকন সোনার সাগরপাড়ির নেইতো নিশ্চয়তা
এমন কিগো সত্যি আছে বলতে পারি জোরে;
ভাতের হাঁড়ি যাবেই যাবে খুকুমণির ঘরে।
ভাতের হাঁড়ি, ঠুলি পাতিল, ঘরকন্নার খেলা প্রত্যেক শিশুর জীবনেই একটি অন্যতম আনন্দের উৎস। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস কোনো বক্তব্যধর্মী লেখা এর আগে আমার চোখে পড়েনি। বেগম সুফিয়া কামালের একটি ছড়া-কবিতায় ছেলেবেলার বান্ধবীদের নিয়ে রান্নাবান্না খেলার একটি দৃশ্যের বর্ণনা আছে। কিন্তু সেটি কতিপয় কিশোরীর আনন্দ-উৎসবেই সীমাবদ্ধ। বুলবুলই প্রথম বিষয়টাকে গুরুতর ও প্রশ্নবোধক করে তুলেছেন। তিনি এর মধ্য দিয়ে দরিদ্র শিশুর নিরন্ন জীবনের মর্মান্তিক হাহাকারকেই উন্মোচন করেছেন এবং বলতে চেয়েছেন অনাহারী শিশুর কাছে ঠুলিপাতিলের আনন্দের চেয়ে গুরুতর বিষয় তার অন্নহীন জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা। এ খেলা তাকে কোনো আনন্দের নিশ্চয়তা দেয় না। এ বোধ ও দায় সে এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই পরের দুটো লাইনে শিশুকে বুলবুল তাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন-
খুকুমণি খোকন সোনা তোমরা সবে শোনো
বর্তমানের বাস্তবতায় ভবিষ্যৎটা বোনো।
বস্তুত এ রিয়ালিস্টিক চেতনার নতুন ধরনের আধুনিকতার ভিত্তির উপরই দাঁড়িয়ে আছে বুলবুলের ছড়ার রাজনীতি ও গতচেতনার স্বরূপ। তার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে একালের শিশুজীবন সমাজের নানামাত্রিক সমস্যা ও সংকটের শিকার। এর বাইরে যাবার ক্ষমতা তার কোথায়? যেহেতু সমাজ শ্রেণিবিভক্ত। অর্থনীতির বিন্যাস বিপুল সংখ্যক মানুষকে সর্বহারা করেছে। ৯৩ সংখ্যক ছড়ায় এইসব শিশুদের চোখ খুলে দিতে তাই বুলবুল লেখেন-
কংস নদের পানি আজ, ভীষণ দোলায় দুলছে
তারই শব্দে খোকন সোনার ঘুমন্ত চোখ খুলছে
খোকন সোনার নৌকাখানা অই দোলাতেই নাচবে
ঘরহারা সব মানুষগুলো, অই নায়েতেই বাঁচবে।
নিস্তরঙ্গ কংস নদের প্রতীকে চেতনার ঢেউয়ে উদ্দীপ্ত শিশু-কিশোর অন্নবস্ত্র বাসস্থানহীন মানুষদের সব প্রাপ্তির নৌকায় তুলে দেবে এই স্বপ্ন ও কল্পনার আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত এ ছড়া। এতে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির গল্পের বদলে জায়গা করে নিয়েছে শিশুর নয়া জমানার কর্তব্যবোধ।
এতোদিন শিশু জেনে এসেছে- একটি কন্যাকে তার মা শিখিয়েছেন-
ভালো করে সাজতে
বাসন-কোসন মাজতে
বাবা শিখিয়েছেন-
লাঙল কষে ধরতে
পেটটা শুধু ভরতে
নেতা শিখিয়েছেন-
অস্ত্র হাতে লড়তে
শত্রুকে শেষ করতে (ছড়া-৯৭)
আার এখন কবি শীতার্তদের জন্য শিশুর কী দায় তা শিক্ষা দিতে বলছেন-
তুমি পারো তাকে মুক্তি দিতে
কনকনে ভোরে, দারুণ শীতে
তুমি পারো তাকে জড়িয়ে নিতে
বুকের মাঝে, সকাল সাঁঝে। (ছড়া-৯৯)
কিন্তু একালের শিশুর দায় এখানেই শেষ হয় না। তার কর্তব্য আরো বহুদূর বিস্তৃত। কবি তাই উচ্চারণ করেন-
তুমি পারো তাকে শিখিয়ে দিতে
জ্বালতে আগুন, আনতে ফাগুন (ঐ)
সে আগুন কোথায় জ্বালাবে শিশু? উত্তর কবি দিয়েছেন,
অই যে কিশোর তোমার মতো
কাঁপছে শীতে হি হি করে
লেপ দিয়ে নয়,
তাকেই তুমি গড়তে পারো
আগুনের এক পিণ্ড করে। (ঐ)
শিশু-কিশোরকে আগুনের পিণ্ড করে গড়ে তোলা একালের শিশুদের দায়।, কবির দায়। ঠিক এ জায়গায়ই একালের ছড়া শুধু শিশুদের নয়, শিশুতোষ নয়; বড়দের, বুড়োদের, বড়োতোষও। সেটা প্রমাণ করতেই ১৩৪, সংখ্যক ছড়ায় বুলবুল একটি পুরোনো ছড়ার খোলসে নতুন কথা জুড়ে দেন-
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে
বর্গীগুলো ভিনদেশী নয় তফাৎ শুধু বেশে।
হাত রাঙালো রক্ত দিয়ে মুখে নিঠুর হাসি
কী তফাৎ? এরা বর্গী, ডাকাত, লুটেরা, ধনবান জোঁক। জগৎ শোষণময়, শ্রেণিতে বিভক্ত। একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী শোষণের এ যন্ত্রটি করায়ত্ত করে রেখেছে। এরা ‘স্বঘোষিত রাজা।’ (ছড়া ১৩৫)। এরা বাকি সব মানুষের রক্তে হাত রাঙায়, দাঁত রাঙায়। বুলবুল মনে করেন কবির দায়, শিশুর দায়, বড়োর দায়, বুড়োর দায় মূলসুদ্ধ এদের উপড়ে ফেলা।
তিন.
বুলবুলের ছড়ার প্রধানতম অনুষঙ্গ বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের বিচিত্রমাত্রিক ঘটনাপ্রবাহ, পঁচাত্তরের রক্তাক্ত অধ্যায় এবং এসবের প্রতিক্রিয়া। কয়েক সহস্রব্যাপী সামন্তবাদী রাজতান্ত্রিক শাসন, বৃটিশ ঔপনিবেশিক আধিপত্য এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের দ্বিজাতিতাত্ত্বিক রক্ষণশীল আদর্শ প্রত্যাখ্যান করে রক্ত ও ভাষাভিত্তিক একটি জাতীয়তাবাদী, জনগণতান্ত্রিক, শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে এ দেশের জনগণ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু পাকিস্তানি রাষ্ট্রাদর্শের অন্ধ ও গোঁয়াড় অনুসারীরা এ স্বাধীনতা মেনে নেয়নি। ক্ষমতার ভেতরে ও বাইরে থেকে তারা গভীর ষড়যন্ত্র ও সামরিক ক্যু এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার, বহুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণের স্বপ্নকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এর পরের ইতিহাস স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে মুছে ফেলা এবং জনগণকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করার ইতিহাস। এতে তারা অনেকটাই সফল হয়। তরুণ যুবা ও শিশু-কিশোদের তারা ইতিহাস বিচ্ছিন্ন করে অজ্ঞতায় ঠেলে দিতে সক্ষম হয়। বুলবুল তার ছড়ার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের সে ভেজানো দরজাটিকে পুনরুন্মুক্ত করে বিস্মৃত শিশু-কিশোরদের পাঠদান এবং ইতিহাসের সত্যের প্রতি নিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত রাখার প্রয়াস চালিয়েছেন। গ্রন্থটির ৩২ ছড়ায় বুলবুল লিখেছেন-
আমরা ছিলাম যোদ্ধা ছেলে
ভুল করে নয়, সত্যি শোন,
সবার বুকেই শহীদী খুন
নতুন করে উঠছে দোলে।
কিন্তু কে বা কারা এ কাজ করেছে? জনগণকে ইতিহাস বিস্মৃত করতে চেয়েছে? বুলবুল তার একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন ৮ সংখ্যক ছড়ায়-
যুদ্ধে তিনি মাঠে ছিলেন মানি,
কিন্তু তাহার সকল কীর্তি
কত্তটুকুন জানি?
এটা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যুদ্ধ শুরুর আগে এরা জনগণের কাছে কতটুকুই বা পরিচিত ছিলেন? জনগণ তাদের কতটুকুই বা জানতো? এদের অনেকেই রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তাদের কোনো জনসম্পৃক্ততাও ছিলো না। তাদের সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি, সন্দেহ, রহস্যময়তা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে যেতেই পারে। বিশেষ করে পঁচাত্তরের রক্তাক্ত ঘটনার পটভূমিতে। বুলবুল তার/তাদের চেহারা একই ছড়ায় আরেকটু পরিষ্কার করতে চেয়েছেন-
কালো চশমায় সব দেখেছেন
কালোর হাতে হাত রেখেছেন
হাত ভরা তার রক্ত;
কার হাত ভরা রক্ত? এটা এ ছড়ায় স্বচ্ছ কাঁচে প্রতিফলিত প্রতিবিম্বের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে জনগণের সামনে। আর এ রক্ত কার সেটাও জনগণ পঁচাত্তরে চোখের সামনে প্রবাহিত হতে দেখেছে। এ রক্ত বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের লোহুরাঙা স্বপ্নের। বুলেট-ঝাঁঝড়া সেই জাতির জনক এখন শুয়ে আছেন টুঙ্গিপাড়ায় ঘাসের বিছানায়। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ঝরে পড়েছে ১৩২ সংখ্যক ছড়ায়-
তোমরা যদি কেউ কোনোদিন টুঙ্গিপাড়ায় এসো
এইখানের এই মাটিগুলোয় একটু ভালোবেসো
যেহেতু-
মুকুটবিহীন রাজা মোদের ঘুমিয়ে আছে হেথা
চিরঘুমে আচ্ছন্ন ইতিহাসের এই মহানায়কের প্রতি সবাইকে সশ্রদ্ধ থাকার জন্য কবির তাই আকুল আহ্বান-
হেঁটো নাকো শব্দ করে নূপুর পরে পায়,
নায়ের মাঝি আছেন শুয়ে ঘুম ভেঙে না যায়
কিন্তু কেন এই হত্যাকা-? কেন বিপুল রক্তক্ষরণের বিনিময়ে এ নতুন রাষ্ট্রের ভিতের ইট খুলে ফেলার চেষ্টা? এ তো শুধু নিছক হিংসা ও ঈর্ষাজর্জর প্রতিশোধ নয়। এর পেছনে আছে গভীরতর আদর্শিক দ্বন্দ্ব। সু এবং কু এর যুদ্ধ। সে অশুভ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই এ হত্যাকা-। কবির ভাষায়-
লাশের পরে লাশ সাজিয়ে তার ক্ষমতায় যাত্রা,
বাংলা নামের দেশটা যে পায় পাকিস্তানের মাত্রা। (ছড়া-৮)
এসব পঙ্ক্তি খুবই পরিষ্কার করে তুলেছে প্রকৃত সত্য। এর মধ্য দিয়ে ঘটেছে পরাজিত শক্তির পুনরুত্থান, পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্বের পুনস্থাপন এবং স্বাধীনতার শত্রুদের পুনর্বাসন। স্বাধীনতার আদর্শ প্রত্যাখ্যান ও জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে এর মধ্য দিয়ে। সামরিক ক্যু এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতারোহণের কারণে সংবিধান বাতিল, গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে। এ ঘটনায় জাতি আর কী কী হারিয়েছে তার একটা ফিরিস্তি আছে ৫১ সংখ্যক ছড়ায়-
নাই নাই নাই
স্বাধীনতার দেড় দশকে সবটুকু ছিনতাই;
দেড় দশক মানে পঁচাত্তর থেকে নব্বই। মুশতাক জিয়া হয়ে এরশাদ। এরাই এই ছিনতাইয়ের নায়ক। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এরা। কী ছিনতাই করেছে এরা দেড় দশকে? সমাজতন্ত্রের জায়গায় সামাজিক ন্যায় বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ্বাস। বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নতুন করে যুক্ত করেছে সংবিধানে। কবির বচনে-
পঁচাত্তরে জনক গেলো নিকষ কালো রাতে;
সাতাত্তরে সব হারালাম ‘বাংলাদশী’-র হাতে।
স্বাধীনতা সাম্যবাদের মালা গেল ছিঁড়ে ;
ভূতপ্রেতের নৃত্য চলে সারাটা দেশ ঘিরে।
বাহাত্তর আর অষ্টআশি খুব বেশি নয় দূর
দেশের হাওয়ায় বাজে দেখি
পাকিস্তানের সুর।
এ ঘটনার পরিণতি দেশটা প্রো-পাকিস্তানে পরিণত হওয়া। সংবিধানে গৃহীত মূলনীতিগুলো বদলে নতুন নীতি যুক্ত করা। স্বাধীনতার মানে, দেশপ্রেমিকের সংজ্ঞা পালটে যাওয়া। ৪৪ সংখ্যক এর ব্যাঙ্গাত্মক চিত্র দেখতে পাওয়া যায়-
তারাই নাকি দেশপ্রেমিক
যারা ছিলো রাজাকার!
সঠিক কথা সঠিক কথা
তাদের প্রেম যে মানায় হার!
এর ফল এই ঘটনার বেনিফিসিয়ারি হিসেবে স্বাধীনতাবিরোধীদের সদম্ভে ক্ষমতার মসনদে আরোহণই শুধু নয়, দেশের মালিক বনে যাওয়া, আর যারা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন তাদের দেশদ্রোহী ও দেশের শত্রুতে পরিণত হওয়া।
এর অর্থনৈতিক পরিণতি আরো ব্যাপক ও ভয়াবহ। এর নৈতিক অবক্ষয়ের দিকটি বিপুলায়তনিক। সংবিধান থেকে গণতন্ত্র বিসর্জিত হওয়ায় যেমন সামরিক/বেসামরিক আমলারা ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে, তেমনি সমাজতন্ত্র নির্বাসিত হওয়ায় লুটেরা ও মুৎসুদ্দি শ্রেণির পোয়াবারো অবস্থা তৈরি হয়। চারদিকে টাকার খেলা শুরু হয়। সে টাকার ঝনঝন শব্দ বেজে উঠেছে বুলবুলের ১৩ সংখ্যক ছড়ায়-
হঠাৎ টাকার পাখা গজায়
এদিক ওদিক চলার মজায়
নানা ভাবে নানা দেশে
টাকার নহর বইতে থাকে।
শুরু হয় অবাধ লুণ্ঠন, সবকিছু গিলে খাওয়ার প্রতিযোগিতা। এতে শরিক হয় সবাই। পুরোনো ও নব্য রাজাকার, সুবিধাবাদী রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ী। এ অবস্থা চলছে আজও। ইতোমধ্যে, আজতক যারাই ক্ষমতাসীন হয়েছেন সবাই এ লুণ্ঠনে অংশ নিয়েছেন। যেন এরা সবাই মৌমাছি। ক্ষমতার ফুল থেকে মধু আহরণ করাই এদের কাজ। এতে ফুলেফেঁপে উঠেছে সুবিধাবাদী লুটেরা, ফোঁপরা হয়েছে জনগণ। এদের বিশাল হা ও গোগ্রাস গেলার দৃশ্য আর জনগণের কৃষতনুর বর্ণনা আছে ১৬ সংখ্যক ছড়ায়-
আহারে সোনার দেশ! তোমার একি বেশ?
কেউ খাইলো দৈর্ঘ্যে প্রস্থে আকাশ খাইলো কেউ
পাহাড় খাইলো, বনও খাইলো, খাইলো নদীর ঢেউ
ব্যাংক খাইলো, শিল্প খাইলো, নিজের ইচ্ছে মতো
আইন খাইলো, বিচার খাইলো, নাক ডুবিয়ে যতো
এ খাওয়াখাওয়ির নেতা কে? কবি তার পরিচয় দিয়েছেন ‘তিনি এবং তাহারা’ বলে। বোধহয় তিনি মোল্লা শকুন, বাকিরা সাধারণ শকুন। সবাই মিলে চলছে এই উৎসব, হরিলুট।
এ হরি লুটের শরিক যেমন জনগণের জন্য বক্তৃতায় জান কবুল করা রাজনীতিকরা তেমনি প্রজাতন্ত্র তথা জনগণেরর সেবায় নিয়োজিত আমলারাও। জনগণ যুদ্ধ করে স্বাধীন গণতান্ত্রিক শাসনোপযোগী জনগণমনোহারী একটা আমলাতন্ত্র চেয়ে পেয়েছে জনগণমনহরণকারী আমলাতন্ত্র। বৃটিশ এ বিষয়ে চরম সাফল্যের দাবি করতেই পারে। তারা ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের খাঁটি উত্তরাধিকার আমাদের উপহার দিতে পেরেছে। কাগজে এরা সেবক হলেও বাস্তবে প্রভু। নিজেদের এরা রাজা আর জনগণকে দাসানুদাস মনে করে। লুটপাটেও এরা সেরা। দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন, শাসন সবই এদের দ্বারা পরিচালিত। এসবের সুবিধার ফসল পুরোটাই এরা ঘরে তোলে। বুলবুল ২ সংখ্যক সে ছবি খুব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন
সংবিধান বলে, তাহারা হচ্ছেন
প্রজাতন্ত্রের কামলা
কিন্তু তাহারা আসলেই রাজা
গাছেরটা খান তলারও কুড়ান
তাহারা কতিপয় আমলা।
চার.
মনজুরুল আহসান বুলবুলের স্বপ্ন ছিলো একটি সোনার দেশ, সম্পদের সমবন্টনভিত্তিক একটি শোষণহীন সমাজের। যেখানে বিভেদ, বিভাজন, অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না। সব মানুষ সবক্ষেত্রে সমান অধিকার, বিকাশের সম সুযোগ পাবে। অন্নবস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা শিক্ষাসহ সব চাহিদা পূরিত হবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। এ উদ্দেশ্য নিয়েই বুলবুল ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয়নি। দেশ হয়ে উঠেছে বৈষম্যপোষক। ইতোমধ্যে মানুষে মানুষে অসমতা, সম্পদ বণ্টনে অনৈতিকতা ও বৈষম্য বেড়েছে। কিছু মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় জমেছে, আগের চেয়ে আনুপাতিক হারে আরো অধিকসংখ্যক মানুষ কপর্দকহীন হয়েছে। কিছু মানুষ দশতলা অট্টালিকায়; অনেক মানুষ রাস্তায়, রেলের পরিত্যক্ত বগি, গাছতলায় বসবাস করছে। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত একটি রাষ্ট্রের এ পরিণতি অগ্রহণীয়। বুলবুল এর চিত্র ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছেন ২৫ সংখ্যক ছড়ায়-
খায় কে রে ভাই কার খানা;
হাজার লোকের মালিক সেজে
একটা মানুষ নিত্যি;
বুলবুল এটা মানতে পারেন না। তাই ঘৃণা বেরোয় ওর কলম থেকে-
ইচ্ছেমাফিক হুকুম দেবে
দেখলে জ্বলে পিত্তি।
রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দিকে আঙুল তোলেন তিনি তাই। জনগণের হতাশার কথাও ব্যক্ত করেন-
লক্ষ বুকের রক্ত দিয়ে তাহলে কি পেলাম গো
তারপর এ ধরনের রাষ্ট্রকে সেলাম জানিয়ে কী করে তা বদলাতে হয় তার ঘোষণা দেন-
আমরা জানি রক্ত দিয়ে; কেমনে বিজয় কিনতে হয়,
কিন্তু ব্যাপারটা সোজা নয়। তিনি জানেন এ অবস্থা বদলানোর একটাই পথ, বিপ্লব। সেজন্য শোষকের উদ্দেশ্যে হুঙ্কার ছুঁড়ে দেন তিনি-
আর কতকাল ছলচাতুরি
পাওনাটুকু বুঝিয়ে দিতে;
হাত পেতে নয় আসছি দেখো
পাওনাটুকুর আদায় নিতে। (ছড়া-৪১)
কিন্তু এটা তো এমনি এমনি হবে না। তার জন্য চাই নিপীড়িত মানুষের ঐক্য, সচেতনতা, সংঘবদ্ধ প্রয়াস, প্রস্তুতি আর সংগ্রামে দৃঢ়চিত্ত ঝাঁপিয়ে পড়া। কিন্তু কাজটা শক্ত। নরম কোমল ঘাসে হাঁটার নয়। এ পথ রক্ত ঝরানোর। মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার।
সে স্বপ্ন নতুন ভোরের, নতুন আলোর লালচে ভোরের। কবির ভাষায়-
সূর্যের সাথে গড়তে মিতালী
ছড়ার ছন্দে নতুন সুর;
ছন্দে ছন্দে একতা গড়ুক
আনতে একটা নতুন ভোর। (ছড়া-৪৬)
সে ভোর এখনো আসেনি। আসবে নিশ্চয়ই একদিন। সেদিন পায়ের তলায় পিষ্ট মানুষগুলো জেগে উঠবে। মাথা উঁচু করে ঘোষণা করবে তাদের অস্তিত্ব। জানিয়ে দেবে তারাও মানুষ, তাদের মাথাও হিমালয়ের চাইতে উঁচু। সবকিছু পাওয়ার তাদের সমান অধিকার তাদের আছে। হয়তো কালই আসবে সে ভোর। হয়তো আসবে আরো অনেকদিন পর।
দুইশ’ ছড়ার ঝিলিক। মনজুরুল আহসান বুলবুল। প্রকাশক অনন্যা। প্রকাশকাল : বইমেলা ২০২১। মূল্য: ৩৫০ টাকা।
নজরুল হায়াত
বুধবার, ১৭ নভেম্বর ২০২১
এক.
মনজুরুল আহসান বুলবুল বাংলাদেশের অন্যতম রাজনীতি ও গণসচেতন ছড়াকার। লিখছেন সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে। সম্প্রতি তার প্রথম ছড়াকাব্য ‘দুইশ’ ছড়ার ঝিলিক’ প্রকাশিত হয়েছে। মাঝখানে ক্যারিয়ার গঠনে সাংবাদিকতা, সাংবাদিক নেতৃত্ব ও টিভি উপদেশক হিসেবে অনেকটা সময় ব্যয় করলেও তিনি যে ছড়ার জগৎ থেকে মোটেও বিচ্ছিন্ন হননি এ গ্রন্থ তার প্রমাণ। কালানুক্রমিক সাজানো না হলেও গ্রন্থটিতে সাতাত্তর থেকে হালের লেখা ছড়াটিও জায়গা করে নিয়েছে। ক্যারিয়ার গঠন বুলবুলকে কতটা বদলেছে জানি না, কিন্তু ওর ছড়ার চরিত্র যে মোটেও বদলায়নি সেটা হলফ করে বলা যায়। আবার এটাও হলফ করে বলা যায় যে ক্যারিয়ার গঠন ছড়াকার হিসেবে ওর বিপুল সম্ভাবনা ও জনপ্রিয়তাকেও প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।
এই যে বুলবুল গণমানুষের ছড়াকার হয়ে উঠলো এর সিংহভাগ কৃতিত্বের প্রায় সবটাই প্রাপ্য ওর রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতার। ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়ন দিয়ে শুরু, পরে কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্রব, ওর লেখার উপর আলোচনায় এ প্রসঙ্গটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম জীবনে কোনো দর্শন, চিন্তা, মতবাদ কিম্বা রাজনীতির সাথে সংযোগ একজন লেখকের মনোজগতের একটা ভিত ও প্যাটার্ন, রচনা-বিষয়ের বিশিষ্ট চরিত্র ও প্রবণতা এবং চিন্তার আলাদা প্রকরণ গড়ে দেয়। বুলবুলের বেলায় এটাই ঘটেছে এবং একই কারণে ময়মনসিংহের ওর সমসাময়িক অন্য কবিদের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি।
সত্তরের দশকে বুলবুল যখন লিখতে শুরু করেন তখন দেশ পশ্চাৎমুখি প্রতিক্রিয়াশীল দ্বিজাতিতত্ত্ববাদীর কবলে। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শসমূহ, সংবিধানের চারটি মূলনীতিই ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত আর তার জায়গায় পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূতাদর্শ প্রতিস্থাপিত। এসব ঘটনা সেসময়কার স্বাধীনতার স্বপক্ষ প্রগতিবাদী মুক্তচেতন লেখক, চিন্তকদের প্রবলভাবে হতাশ, ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী করে তুলেছে। বুলবুলও এ ঘটনায় আহত হয়েছেন এবং ছড়ার শাণিত অস্ত্রের মধ্য দিয়ে তার বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
দুই.
ছড়ার সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে অর্থহীন হোক কি অর্থযুক্ত শিশুমনে কল্পলোকের রোমাঞ্চ তৈরি করা। সেই আদিম বন্য জীবনে জন্ম নেয়া প্রথম ছড়াকার থেকে আজকের ছড়া রচয়িতা পর্যন্ত এটাই চলে আসছে। ইতোমধ্যে আঠারো-উনিশ শতকে ইউরোপে সংঘটিত রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে সাহিত্যের বিবিধ শাখায় বিপুল বস্তুবাদী পরিবর্তন ঘটলেও ছড়ার ক্ষেত্রে তার প্রভাব ব্যাপকতা পায়নি। ছড়াকাররা শিশু তোষণ প্রাধান্য রেখেই ছড়া লিখছেন। আশ্চর্যজনকভাবে বুলবুলের ছড়ায় এ প্রবণতার উপস্থিতি খুবই সামান্য। বুলবুলের ছড়ায় সিংহভাগেরই বহিরঙ্গ ও অন্তঃস্থল জুড়ে শিশু-কিশোরের মনোলোকে কল্পগল্প তৈরির চেয়ে চৈতন্যে নাড়া দিতেই জোরালো ভূমিকা রেখেছে। যেমন ৩২ সংখ্যক ছড়ায়-
খোকন সোনার সাগরপাড়ির নেইতো নিশ্চয়তা
এমন কিগো সত্যি আছে বলতে পারি জোরে;
ভাতের হাঁড়ি যাবেই যাবে খুকুমণির ঘরে।
ভাতের হাঁড়ি, ঠুলি পাতিল, ঘরকন্নার খেলা প্রত্যেক শিশুর জীবনেই একটি অন্যতম আনন্দের উৎস। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস কোনো বক্তব্যধর্মী লেখা এর আগে আমার চোখে পড়েনি। বেগম সুফিয়া কামালের একটি ছড়া-কবিতায় ছেলেবেলার বান্ধবীদের নিয়ে রান্নাবান্না খেলার একটি দৃশ্যের বর্ণনা আছে। কিন্তু সেটি কতিপয় কিশোরীর আনন্দ-উৎসবেই সীমাবদ্ধ। বুলবুলই প্রথম বিষয়টাকে গুরুতর ও প্রশ্নবোধক করে তুলেছেন। তিনি এর মধ্য দিয়ে দরিদ্র শিশুর নিরন্ন জীবনের মর্মান্তিক হাহাকারকেই উন্মোচন করেছেন এবং বলতে চেয়েছেন অনাহারী শিশুর কাছে ঠুলিপাতিলের আনন্দের চেয়ে গুরুতর বিষয় তার অন্নহীন জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা। এ খেলা তাকে কোনো আনন্দের নিশ্চয়তা দেয় না। এ বোধ ও দায় সে এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই পরের দুটো লাইনে শিশুকে বুলবুল তাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন-
খুকুমণি খোকন সোনা তোমরা সবে শোনো
বর্তমানের বাস্তবতায় ভবিষ্যৎটা বোনো।
বস্তুত এ রিয়ালিস্টিক চেতনার নতুন ধরনের আধুনিকতার ভিত্তির উপরই দাঁড়িয়ে আছে বুলবুলের ছড়ার রাজনীতি ও গতচেতনার স্বরূপ। তার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে একালের শিশুজীবন সমাজের নানামাত্রিক সমস্যা ও সংকটের শিকার। এর বাইরে যাবার ক্ষমতা তার কোথায়? যেহেতু সমাজ শ্রেণিবিভক্ত। অর্থনীতির বিন্যাস বিপুল সংখ্যক মানুষকে সর্বহারা করেছে। ৯৩ সংখ্যক ছড়ায় এইসব শিশুদের চোখ খুলে দিতে তাই বুলবুল লেখেন-
কংস নদের পানি আজ, ভীষণ দোলায় দুলছে
তারই শব্দে খোকন সোনার ঘুমন্ত চোখ খুলছে
খোকন সোনার নৌকাখানা অই দোলাতেই নাচবে
ঘরহারা সব মানুষগুলো, অই নায়েতেই বাঁচবে।
নিস্তরঙ্গ কংস নদের প্রতীকে চেতনার ঢেউয়ে উদ্দীপ্ত শিশু-কিশোর অন্নবস্ত্র বাসস্থানহীন মানুষদের সব প্রাপ্তির নৌকায় তুলে দেবে এই স্বপ্ন ও কল্পনার আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত এ ছড়া। এতে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির গল্পের বদলে জায়গা করে নিয়েছে শিশুর নয়া জমানার কর্তব্যবোধ।
এতোদিন শিশু জেনে এসেছে- একটি কন্যাকে তার মা শিখিয়েছেন-
ভালো করে সাজতে
বাসন-কোসন মাজতে
বাবা শিখিয়েছেন-
লাঙল কষে ধরতে
পেটটা শুধু ভরতে
নেতা শিখিয়েছেন-
অস্ত্র হাতে লড়তে
শত্রুকে শেষ করতে (ছড়া-৯৭)
আার এখন কবি শীতার্তদের জন্য শিশুর কী দায় তা শিক্ষা দিতে বলছেন-
তুমি পারো তাকে মুক্তি দিতে
কনকনে ভোরে, দারুণ শীতে
তুমি পারো তাকে জড়িয়ে নিতে
বুকের মাঝে, সকাল সাঁঝে। (ছড়া-৯৯)
কিন্তু একালের শিশুর দায় এখানেই শেষ হয় না। তার কর্তব্য আরো বহুদূর বিস্তৃত। কবি তাই উচ্চারণ করেন-
তুমি পারো তাকে শিখিয়ে দিতে
জ্বালতে আগুন, আনতে ফাগুন (ঐ)
সে আগুন কোথায় জ্বালাবে শিশু? উত্তর কবি দিয়েছেন,
অই যে কিশোর তোমার মতো
কাঁপছে শীতে হি হি করে
লেপ দিয়ে নয়,
তাকেই তুমি গড়তে পারো
আগুনের এক পিণ্ড করে। (ঐ)
শিশু-কিশোরকে আগুনের পিণ্ড করে গড়ে তোলা একালের শিশুদের দায়।, কবির দায়। ঠিক এ জায়গায়ই একালের ছড়া শুধু শিশুদের নয়, শিশুতোষ নয়; বড়দের, বুড়োদের, বড়োতোষও। সেটা প্রমাণ করতেই ১৩৪, সংখ্যক ছড়ায় বুলবুল একটি পুরোনো ছড়ার খোলসে নতুন কথা জুড়ে দেন-
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে
বর্গীগুলো ভিনদেশী নয় তফাৎ শুধু বেশে।
হাত রাঙালো রক্ত দিয়ে মুখে নিঠুর হাসি
কী তফাৎ? এরা বর্গী, ডাকাত, লুটেরা, ধনবান জোঁক। জগৎ শোষণময়, শ্রেণিতে বিভক্ত। একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী শোষণের এ যন্ত্রটি করায়ত্ত করে রেখেছে। এরা ‘স্বঘোষিত রাজা।’ (ছড়া ১৩৫)। এরা বাকি সব মানুষের রক্তে হাত রাঙায়, দাঁত রাঙায়। বুলবুল মনে করেন কবির দায়, শিশুর দায়, বড়োর দায়, বুড়োর দায় মূলসুদ্ধ এদের উপড়ে ফেলা।
তিন.
বুলবুলের ছড়ার প্রধানতম অনুষঙ্গ বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের বিচিত্রমাত্রিক ঘটনাপ্রবাহ, পঁচাত্তরের রক্তাক্ত অধ্যায় এবং এসবের প্রতিক্রিয়া। কয়েক সহস্রব্যাপী সামন্তবাদী রাজতান্ত্রিক শাসন, বৃটিশ ঔপনিবেশিক আধিপত্য এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের দ্বিজাতিতাত্ত্বিক রক্ষণশীল আদর্শ প্রত্যাখ্যান করে রক্ত ও ভাষাভিত্তিক একটি জাতীয়তাবাদী, জনগণতান্ত্রিক, শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে এ দেশের জনগণ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু পাকিস্তানি রাষ্ট্রাদর্শের অন্ধ ও গোঁয়াড় অনুসারীরা এ স্বাধীনতা মেনে নেয়নি। ক্ষমতার ভেতরে ও বাইরে থেকে তারা গভীর ষড়যন্ত্র ও সামরিক ক্যু এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার, বহুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণের স্বপ্নকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এর পরের ইতিহাস স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে মুছে ফেলা এবং জনগণকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করার ইতিহাস। এতে তারা অনেকটাই সফল হয়। তরুণ যুবা ও শিশু-কিশোদের তারা ইতিহাস বিচ্ছিন্ন করে অজ্ঞতায় ঠেলে দিতে সক্ষম হয়। বুলবুল তার ছড়ার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের সে ভেজানো দরজাটিকে পুনরুন্মুক্ত করে বিস্মৃত শিশু-কিশোরদের পাঠদান এবং ইতিহাসের সত্যের প্রতি নিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত রাখার প্রয়াস চালিয়েছেন। গ্রন্থটির ৩২ ছড়ায় বুলবুল লিখেছেন-
আমরা ছিলাম যোদ্ধা ছেলে
ভুল করে নয়, সত্যি শোন,
সবার বুকেই শহীদী খুন
নতুন করে উঠছে দোলে।
কিন্তু কে বা কারা এ কাজ করেছে? জনগণকে ইতিহাস বিস্মৃত করতে চেয়েছে? বুলবুল তার একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন ৮ সংখ্যক ছড়ায়-
যুদ্ধে তিনি মাঠে ছিলেন মানি,
কিন্তু তাহার সকল কীর্তি
কত্তটুকুন জানি?
এটা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যুদ্ধ শুরুর আগে এরা জনগণের কাছে কতটুকুই বা পরিচিত ছিলেন? জনগণ তাদের কতটুকুই বা জানতো? এদের অনেকেই রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তাদের কোনো জনসম্পৃক্ততাও ছিলো না। তাদের সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি, সন্দেহ, রহস্যময়তা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে যেতেই পারে। বিশেষ করে পঁচাত্তরের রক্তাক্ত ঘটনার পটভূমিতে। বুলবুল তার/তাদের চেহারা একই ছড়ায় আরেকটু পরিষ্কার করতে চেয়েছেন-
কালো চশমায় সব দেখেছেন
কালোর হাতে হাত রেখেছেন
হাত ভরা তার রক্ত;
কার হাত ভরা রক্ত? এটা এ ছড়ায় স্বচ্ছ কাঁচে প্রতিফলিত প্রতিবিম্বের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে জনগণের সামনে। আর এ রক্ত কার সেটাও জনগণ পঁচাত্তরে চোখের সামনে প্রবাহিত হতে দেখেছে। এ রক্ত বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের লোহুরাঙা স্বপ্নের। বুলেট-ঝাঁঝড়া সেই জাতির জনক এখন শুয়ে আছেন টুঙ্গিপাড়ায় ঘাসের বিছানায়। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ঝরে পড়েছে ১৩২ সংখ্যক ছড়ায়-
তোমরা যদি কেউ কোনোদিন টুঙ্গিপাড়ায় এসো
এইখানের এই মাটিগুলোয় একটু ভালোবেসো
যেহেতু-
মুকুটবিহীন রাজা মোদের ঘুমিয়ে আছে হেথা
চিরঘুমে আচ্ছন্ন ইতিহাসের এই মহানায়কের প্রতি সবাইকে সশ্রদ্ধ থাকার জন্য কবির তাই আকুল আহ্বান-
হেঁটো নাকো শব্দ করে নূপুর পরে পায়,
নায়ের মাঝি আছেন শুয়ে ঘুম ভেঙে না যায়
কিন্তু কেন এই হত্যাকা-? কেন বিপুল রক্তক্ষরণের বিনিময়ে এ নতুন রাষ্ট্রের ভিতের ইট খুলে ফেলার চেষ্টা? এ তো শুধু নিছক হিংসা ও ঈর্ষাজর্জর প্রতিশোধ নয়। এর পেছনে আছে গভীরতর আদর্শিক দ্বন্দ্ব। সু এবং কু এর যুদ্ধ। সে অশুভ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই এ হত্যাকা-। কবির ভাষায়-
লাশের পরে লাশ সাজিয়ে তার ক্ষমতায় যাত্রা,
বাংলা নামের দেশটা যে পায় পাকিস্তানের মাত্রা। (ছড়া-৮)
এসব পঙ্ক্তি খুবই পরিষ্কার করে তুলেছে প্রকৃত সত্য। এর মধ্য দিয়ে ঘটেছে পরাজিত শক্তির পুনরুত্থান, পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্বের পুনস্থাপন এবং স্বাধীনতার শত্রুদের পুনর্বাসন। স্বাধীনতার আদর্শ প্রত্যাখ্যান ও জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে এর মধ্য দিয়ে। সামরিক ক্যু এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতারোহণের কারণে সংবিধান বাতিল, গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে। এ ঘটনায় জাতি আর কী কী হারিয়েছে তার একটা ফিরিস্তি আছে ৫১ সংখ্যক ছড়ায়-
নাই নাই নাই
স্বাধীনতার দেড় দশকে সবটুকু ছিনতাই;
দেড় দশক মানে পঁচাত্তর থেকে নব্বই। মুশতাক জিয়া হয়ে এরশাদ। এরাই এই ছিনতাইয়ের নায়ক। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এরা। কী ছিনতাই করেছে এরা দেড় দশকে? সমাজতন্ত্রের জায়গায় সামাজিক ন্যায় বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ্বাস। বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নতুন করে যুক্ত করেছে সংবিধানে। কবির বচনে-
পঁচাত্তরে জনক গেলো নিকষ কালো রাতে;
সাতাত্তরে সব হারালাম ‘বাংলাদশী’-র হাতে।
স্বাধীনতা সাম্যবাদের মালা গেল ছিঁড়ে ;
ভূতপ্রেতের নৃত্য চলে সারাটা দেশ ঘিরে।
বাহাত্তর আর অষ্টআশি খুব বেশি নয় দূর
দেশের হাওয়ায় বাজে দেখি
পাকিস্তানের সুর।
এ ঘটনার পরিণতি দেশটা প্রো-পাকিস্তানে পরিণত হওয়া। সংবিধানে গৃহীত মূলনীতিগুলো বদলে নতুন নীতি যুক্ত করা। স্বাধীনতার মানে, দেশপ্রেমিকের সংজ্ঞা পালটে যাওয়া। ৪৪ সংখ্যক এর ব্যাঙ্গাত্মক চিত্র দেখতে পাওয়া যায়-
তারাই নাকি দেশপ্রেমিক
যারা ছিলো রাজাকার!
সঠিক কথা সঠিক কথা
তাদের প্রেম যে মানায় হার!
এর ফল এই ঘটনার বেনিফিসিয়ারি হিসেবে স্বাধীনতাবিরোধীদের সদম্ভে ক্ষমতার মসনদে আরোহণই শুধু নয়, দেশের মালিক বনে যাওয়া, আর যারা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন তাদের দেশদ্রোহী ও দেশের শত্রুতে পরিণত হওয়া।
এর অর্থনৈতিক পরিণতি আরো ব্যাপক ও ভয়াবহ। এর নৈতিক অবক্ষয়ের দিকটি বিপুলায়তনিক। সংবিধান থেকে গণতন্ত্র বিসর্জিত হওয়ায় যেমন সামরিক/বেসামরিক আমলারা ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে, তেমনি সমাজতন্ত্র নির্বাসিত হওয়ায় লুটেরা ও মুৎসুদ্দি শ্রেণির পোয়াবারো অবস্থা তৈরি হয়। চারদিকে টাকার খেলা শুরু হয়। সে টাকার ঝনঝন শব্দ বেজে উঠেছে বুলবুলের ১৩ সংখ্যক ছড়ায়-
হঠাৎ টাকার পাখা গজায়
এদিক ওদিক চলার মজায়
নানা ভাবে নানা দেশে
টাকার নহর বইতে থাকে।
শুরু হয় অবাধ লুণ্ঠন, সবকিছু গিলে খাওয়ার প্রতিযোগিতা। এতে শরিক হয় সবাই। পুরোনো ও নব্য রাজাকার, সুবিধাবাদী রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ী। এ অবস্থা চলছে আজও। ইতোমধ্যে, আজতক যারাই ক্ষমতাসীন হয়েছেন সবাই এ লুণ্ঠনে অংশ নিয়েছেন। যেন এরা সবাই মৌমাছি। ক্ষমতার ফুল থেকে মধু আহরণ করাই এদের কাজ। এতে ফুলেফেঁপে উঠেছে সুবিধাবাদী লুটেরা, ফোঁপরা হয়েছে জনগণ। এদের বিশাল হা ও গোগ্রাস গেলার দৃশ্য আর জনগণের কৃষতনুর বর্ণনা আছে ১৬ সংখ্যক ছড়ায়-
আহারে সোনার দেশ! তোমার একি বেশ?
কেউ খাইলো দৈর্ঘ্যে প্রস্থে আকাশ খাইলো কেউ
পাহাড় খাইলো, বনও খাইলো, খাইলো নদীর ঢেউ
ব্যাংক খাইলো, শিল্প খাইলো, নিজের ইচ্ছে মতো
আইন খাইলো, বিচার খাইলো, নাক ডুবিয়ে যতো
এ খাওয়াখাওয়ির নেতা কে? কবি তার পরিচয় দিয়েছেন ‘তিনি এবং তাহারা’ বলে। বোধহয় তিনি মোল্লা শকুন, বাকিরা সাধারণ শকুন। সবাই মিলে চলছে এই উৎসব, হরিলুট।
এ হরি লুটের শরিক যেমন জনগণের জন্য বক্তৃতায় জান কবুল করা রাজনীতিকরা তেমনি প্রজাতন্ত্র তথা জনগণেরর সেবায় নিয়োজিত আমলারাও। জনগণ যুদ্ধ করে স্বাধীন গণতান্ত্রিক শাসনোপযোগী জনগণমনোহারী একটা আমলাতন্ত্র চেয়ে পেয়েছে জনগণমনহরণকারী আমলাতন্ত্র। বৃটিশ এ বিষয়ে চরম সাফল্যের দাবি করতেই পারে। তারা ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের খাঁটি উত্তরাধিকার আমাদের উপহার দিতে পেরেছে। কাগজে এরা সেবক হলেও বাস্তবে প্রভু। নিজেদের এরা রাজা আর জনগণকে দাসানুদাস মনে করে। লুটপাটেও এরা সেরা। দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন, শাসন সবই এদের দ্বারা পরিচালিত। এসবের সুবিধার ফসল পুরোটাই এরা ঘরে তোলে। বুলবুল ২ সংখ্যক সে ছবি খুব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন
সংবিধান বলে, তাহারা হচ্ছেন
প্রজাতন্ত্রের কামলা
কিন্তু তাহারা আসলেই রাজা
গাছেরটা খান তলারও কুড়ান
তাহারা কতিপয় আমলা।
চার.
মনজুরুল আহসান বুলবুলের স্বপ্ন ছিলো একটি সোনার দেশ, সম্পদের সমবন্টনভিত্তিক একটি শোষণহীন সমাজের। যেখানে বিভেদ, বিভাজন, অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না। সব মানুষ সবক্ষেত্রে সমান অধিকার, বিকাশের সম সুযোগ পাবে। অন্নবস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা শিক্ষাসহ সব চাহিদা পূরিত হবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। এ উদ্দেশ্য নিয়েই বুলবুল ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয়নি। দেশ হয়ে উঠেছে বৈষম্যপোষক। ইতোমধ্যে মানুষে মানুষে অসমতা, সম্পদ বণ্টনে অনৈতিকতা ও বৈষম্য বেড়েছে। কিছু মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় জমেছে, আগের চেয়ে আনুপাতিক হারে আরো অধিকসংখ্যক মানুষ কপর্দকহীন হয়েছে। কিছু মানুষ দশতলা অট্টালিকায়; অনেক মানুষ রাস্তায়, রেলের পরিত্যক্ত বগি, গাছতলায় বসবাস করছে। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত একটি রাষ্ট্রের এ পরিণতি অগ্রহণীয়। বুলবুল এর চিত্র ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছেন ২৫ সংখ্যক ছড়ায়-
খায় কে রে ভাই কার খানা;
হাজার লোকের মালিক সেজে
একটা মানুষ নিত্যি;
বুলবুল এটা মানতে পারেন না। তাই ঘৃণা বেরোয় ওর কলম থেকে-
ইচ্ছেমাফিক হুকুম দেবে
দেখলে জ্বলে পিত্তি।
রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দিকে আঙুল তোলেন তিনি তাই। জনগণের হতাশার কথাও ব্যক্ত করেন-
লক্ষ বুকের রক্ত দিয়ে তাহলে কি পেলাম গো
তারপর এ ধরনের রাষ্ট্রকে সেলাম জানিয়ে কী করে তা বদলাতে হয় তার ঘোষণা দেন-
আমরা জানি রক্ত দিয়ে; কেমনে বিজয় কিনতে হয়,
কিন্তু ব্যাপারটা সোজা নয়। তিনি জানেন এ অবস্থা বদলানোর একটাই পথ, বিপ্লব। সেজন্য শোষকের উদ্দেশ্যে হুঙ্কার ছুঁড়ে দেন তিনি-
আর কতকাল ছলচাতুরি
পাওনাটুকু বুঝিয়ে দিতে;
হাত পেতে নয় আসছি দেখো
পাওনাটুকুর আদায় নিতে। (ছড়া-৪১)
কিন্তু এটা তো এমনি এমনি হবে না। তার জন্য চাই নিপীড়িত মানুষের ঐক্য, সচেতনতা, সংঘবদ্ধ প্রয়াস, প্রস্তুতি আর সংগ্রামে দৃঢ়চিত্ত ঝাঁপিয়ে পড়া। কিন্তু কাজটা শক্ত। নরম কোমল ঘাসে হাঁটার নয়। এ পথ রক্ত ঝরানোর। মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার।
সে স্বপ্ন নতুন ভোরের, নতুন আলোর লালচে ভোরের। কবির ভাষায়-
সূর্যের সাথে গড়তে মিতালী
ছড়ার ছন্দে নতুন সুর;
ছন্দে ছন্দে একতা গড়ুক
আনতে একটা নতুন ভোর। (ছড়া-৪৬)
সে ভোর এখনো আসেনি। আসবে নিশ্চয়ই একদিন। সেদিন পায়ের তলায় পিষ্ট মানুষগুলো জেগে উঠবে। মাথা উঁচু করে ঘোষণা করবে তাদের অস্তিত্ব। জানিয়ে দেবে তারাও মানুষ, তাদের মাথাও হিমালয়ের চাইতে উঁচু। সবকিছু পাওয়ার তাদের সমান অধিকার তাদের আছে। হয়তো কালই আসবে সে ভোর। হয়তো আসবে আরো অনেকদিন পর।
দুইশ’ ছড়ার ঝিলিক। মনজুরুল আহসান বুলবুল। প্রকাশক অনন্যা। প্রকাশকাল : বইমেলা ২০২১। মূল্য: ৩৫০ টাকা।