alt

সাময়িকী

‘আমার স্বপ্ন ছিল আমি ছবি আঁকব’-তাহেরা খানম

: শনিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২১

https://sangbad.net.bd/images/2021/December/04Dec21/news/Tahera-Khanom-1.jpg

তাহেরা খানম / জন্ম: ১৯৩৫; মৃত্যু : ১ নভেম্বর ২০২১

অনেকটা নীরবে-নিভৃতে চলে গেলেন প্রবল মেধাবী চিত্রকর তাহেরা খানম। হয়তো তাঁকে কেউ মনেই রাখেননি। ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরীর সহধর্মিণী, প্রেরণা। জীবনে ছবি এঁকেছেন খুবই কম। তবে তাঁর শিল্প যে কত গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ- ছবিগুলোতে তা বিধৃত। ১৯৫৪ সালে যে পাঁচজন ছাত্রী ঢাকার আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিলেন তাহেরা খানম তাঁদের অন্যতম। কাছাকাছি সময়ে সেখানকারই ছাত্র কাইয়ুম চৌধুরী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে। পরবর্তীতে তাঁরা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তাহেরা খানমের এ পর্যন্ত একক প্রদর্শনী হয়েছে দুটি। একটি ২০০৩ সালে ও অপরটি ২০১৫ সালে। জীবনসঙ্গী কাইয়ুম চৌধুরীর অন্তর্ধানের পর একা ও নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন দীর্ঘদিন। স্মৃতিগুলো ভারাতুর করে রাখত সব সময়। বছর তিনেক আগে গৃহীত এই সাক্ষাৎকারে ব্যক্তিগত শিল্পী জীবন, কাইয়ুম চৌধুরী ও আরো নানা প্রসঙ্গে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কথা বলেন সংবাদ-এর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সদ্যপ্রয়াত খন্দকার মুনীরুজ্জামানওবায়েদ আকাশ। শ্রুতিলিখন করেন খোন্দকার মুনতাসীর মামুন

ওবায়েদ আকাশ : আপনি কেন চারুকলায় ভর্তি হয়েছিলেন?

তাহেরা খানম : চারুকলায় ভর্তি হওয়ার জন্যই আমি তৈরি ছিলাম। আঁকাআঁকির দিকেই সবসময় আমার নজরটা ছিল। আর পরিবার থেকেও চেয়েছিল যে, আমি চারুকলাতেই ভর্তি হই।

১৯৫৪ সাল। আমরা, মোট পাঁচজন ছাত্রী ভর্তি হয়েছিলাম এক সঙ্গে। সবার নাম মনে নেই। কয়েকজনের নাম মনে আছে- রওশন আমিন, হাসিনা আলী এবং আরেকজন হল জোবেদা। শিল্পী আমিনুল ইসলামের স্ত্রী রুবি ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, যদিও ও আমার এক ব্যাচ জুনিয়র ছিল।

ওবায়েদ আকাশ : শিক্ষক হিসেবে আপনি কাদের পেয়েছিলেন?

তাহেরা খানম : শিক্ষক হিসেবে অনেককেই পেয়েছি। জয়নুল আবেদিন, আলী আহসান, আব্দুর রহমান, কামরুল হাসান, মোহাম্মদ কিবরিয়া। না না, ভুল বলছি। কিবরিয়া স্যার তখনও আসেননি। উনি পরে এসেছেন।

ওবায়েদ আকাশ : শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কী করে হলো?

তাহেরা খানম : যোগাযোগটা কাকতালীয়ভাবেই। আমরা যখন ভর্তি হই তখন সব স্যারই তো ব্যাচেলর। কাইয়ুম চৌধুরী তখন সবেমাত্র টিচার হিসেবে জয়েন করেছেন। আবেদিন স্যার ওনাকে পাঠালেন সব ডিপার্টমেন্ট ঘুরে দেখার জন্য। উনি ভীষণ ভীতু এবং লাজুক ছিলেন। আমাদের ক্লাস দেখতে এলেন। ওনাকে দেখে এক মেয়ে (হাসিনা আলী) পেইন্টিং-এর ব্রাশ মুখে নিয়ে আড়চোখে একটু তাকাল আর সঙ্গে সঙ্গে উনি লজ্জায় বেরিয়ে গেলেন।

ওবায়েদ আকাশ : কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা কখন, কীভাবে হলো?

তাহেরা খানম : ওটাই তো বলছি। রুবি হলো মধ্যস্থতাকারী। কাইয়ুমের সঙ্গে রুবির পরিচয় ছিল। আমিনুল তো তখন আছেই। আমিনুল তখন স্টুডিও করেছিলেন। আবেদিন স্যার তাকে একটা স্টুডিও দিয়েছিলেন, ঐ যে সামনের খোলা রুমটা, গ্লাসঅলা। ওটা তাকে দেয়া হয়েছিল। তিনি ছবি আঁকতেন। বিদেশ থেকে ফেরার পর থেকেই রুবির সঙ্গে আমিনুলের যোগাযোগ। আমিনুল তখন আমাদের ক্লাস নিতেন। আমিনুলের রুমেই আমার সঙ্গে কাইয়ুমের মধ্যস্থতা হয়। আমাকে না কাইয়ুমকেই সব বলে রুবি। আমি তখনও কিছুই জানি না। শুধু কাইয়ুমকেই বলেছে আমার কথা। এর মধ্যে সৈয়দ হককেও কাইয়ুম ডেকেছে। সৈয়দ শামসুল হকও কিন্তু তখন আমাকে পছন্দ করতেন। আমরা যখন ছুটির পর বেরিয়ে যাই, আমি টের পেয়েছি, একটা লোক (সৈয়দ হক) আমাকে দেখছে। যাই হোক, যখন কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা হয়ে গেল তখন সৈয়দ হক বলেছিলেন, ‘চলবে’। সৈয়দ হকও তাঁর এক লেখায় এই গল্প করেছেন।

যা বলছিলাম, ক্লাস সেরে আমি বের হয়েছি, কাইয়ুম আর হক তখন গেটে, হঠাৎ আমি তাকিয়েছি, দেখি দুজন আমাকে দেখছে। ঐ তাকানোটায় আমার সন্দেহ হয়েছে। তখনই হক আমাকে দেখে বলেছিলেন, ‘চলবে’।

তারপর পারিবারিকভাবেই প্রস্তাবটা এলো। এই প্রস্তাব নিয়ে একটু এদিক-ওদিক হয়েছিল। কিন্তু আমার ছোট বোনটা কাইয়ুমকে আমার জন্য পছন্দ করে ফেলেছে। আমার সঙ্গে কাইয়ুমের আলাপ শুরু হলো।

https://sangbad.net.bd/images/2021/December/04Dec21/news/Tahera-Khanom-2.jpg

শিল্পী : তাহেরা খানম

ওবায়েদ আকাশ : এত তাড়াতাড়িই কি বিয়ের কথা বলা হলো? পরিচয় হওয়ার আগেই?

তাহেরা খানম : না না। এর মধ্যে কয়েক মাস গেল তো! আমি তো তখন ফাইনাল ইয়ারে। কিছুদিন পরেই পাস করলাম। পাস করার পরেও কয়েক মাস কাজ করেছি। অনেকদিন গেছে। এর মধ্যে তো কথা হয়ই।

আমার সঙ্গে আলাপ হলো। আমার ছোট বোনটা খুব খুশি। কাইয়ুম বাসায় আসতো। অবশ্য বাসায় ঢোকার সাহস হয়নি তখনও। বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হতো। আমার মা দেখত দূর থেকে। ও আমার দাদাকে (বড় ভাই) খুব ভয় পেত। দাদা জানতেন না ও যে আসে।

কী করে কী করে যেন রুবি জানিয়েছে সবাইকে। বিয়ের আগে আগে কাইয়ুমের চিকেন পক্স হয়েছিল, বাসার বাইরে খুব একটা বের হতো না। আমাদের কাছেই ছিল আমিনুল স্যারের বাড়ি। সেখানে আসত। সেসময় আমার সঙ্গে দেখা হতো। আমি একবার ওকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমাকে মাঝে মাঝে বই-টই দিত। অবশ্য সে সময় আমাদের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। ১৯৬০-এর পয়লা জুনে বিয়ে হলো আর এনগেজমেন্ট হয়েছে মার্চে।

ওবায়েদ আকাশ : আজিমপুরের বাড়িটা কি আপনাদের?

তাহেরা খানম : আজিমপুরেরটা অর্থাৎ যেটায় আমি এখন থাকি সেটা আমাদের। কাইয়ুমদের বাড়ি ছিল সিদ্ধেশ্বরীতে, সেখানে এখন এপার্টমেন্ট হয়েছে।

একটা মজার ঘটনা বলি। কাইয়ুমের এক মামাতো ভাই ছিল, সে থাকত পলাশির ব্যাচেলর কোয়ার্টারে। কাইয়ুমের সঙ্গে একদিনই রিক্সায় চড়েছিলাম, বই-পত্র আমাকে দিয়েছে। রিক্সাওয়ালা কম বয়সী, একটু মিচকে শয়তান টাইপের। আমাদের কথা শুনেই ও সন্দেহ করেছে। কাইয়ুম বাসায় না নেমে গ্রীন রোডে নেমেছে। ওখান থেকে হেঁটে আমরা চলে আসব। ঐ ছেলেটা কী যেন বলল, আর সঙ্গে সঙ্গে কাইয়ুম ভীষণ চটে গিয়ে দিল ওকে দুঘা কষিয়ে। ভিড় হয়ে গেল। মামাতো ভাইটা ভিড়ের মধ্যে এসব দেখে ফেলল। তবে আমাদের তো তখন এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। মনোবলটা তো আছে। যা হোক, পরিবারের অন্যরাও সব কিছু জেনে গেল সেই থেকে।

ওবায়েদ আকাশ : বিয়ের পর আপনারা যে নয়া পল্টনে একটা বাড়িতে উঠেছিলেন, সেখানে কারা কারা ছিলেন, কারা আসতেন?

তাহেরা খানম : হ্যাঁ, ছবি আঁকার সুবিধার জন্য বিয়ের পর আমরা নয়া পল্টনে একটা বাড়ি ভাড়া করেছিলাম। আমার শ্বশুরবাড়িতে একটা ঘর ছিল কাইয়ুমের। বিয়ের পর লোকজন বেড়ে গেল। বোনরা এসেছিল থাকার জন্য। সেজন্য সবার সঙ্গে কথা বলেই আমরা নয়া পল্টনের বাড়িতে উঠলাম। বাড়িটা এখন দেখা যাবে না। আগে ওখানে অনেকগুলো পুকুর ছিল। বিশাল ঝিল ছিল। কাছাকাছি থাকতেন পরিচিত অনেকে। অনেক আড্ডা-টাড্ডা হতো। মুক্তিযোদ্ধা নজরুল, তাঁর বউ হাজেরা নজরুল (লেখালেখি করতেন) ওদের বাড়ি ছিল। গাজী শাহাবুদ্দিন ছিলেন, জয়নুল আবেদিন ছিলেন, জাহিদ ভাই ছিলেন (পরে করাচি চলে গেলেন)। কবি জসীম উদ্দীন সাহেব থাকতেন একটু দূরে। সকালে কোন গান গুনগুন করতে করতে বেরোতেন, সবার বাড়িতে আসতেন। শওকত ভাই (শওকত ওসমান) থাকতেন রাজারবাগ, পুলিশ লাইনের দক্ষিণে। তিনি সকালে ফোন নিয়ে বসতেন, সবাইকে ফোন করতেন। রাস্তা খুব ফাঁকা ছিল সেসময়। বাড়িঘর কম ছিল, ঝিল ছিল, ফাঁকা ছিল, খুবই সুন্দর ছিল পরিবেশটা। পুরানা পল্টনে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল, হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাল ভাল ফ্যামিলি থাকত সেখানে।

ওবায়েদ আকাশ : আপনাদের বাড়িতে যে আড্ডা হতো সেখানে কারা কারা থাকতেন?

তাহেরা খানম : হেন লোক নেই যারা থাকতেন না। জহির রায়হান, সৈয়দ শামসুল হক থেকে শুরু করে যাদের নাম বললাম সবাই আসতেন। সারারাত কাজ করত ওরা। আমাকে সরিয়ে দিত। হক কাট কাট কথা বলত, ‘যান আপনি ঘুমান গিয়া’। গাজীর কথাপল্লীতে ছিল বিশাল আড্ডা। মাওলা ব্রাদার্সের মাওলা সাহেব ছিলেন।

ওবায়েদ আকাশ : আপনার শিল্প চর্চার বিষয়ে কিছু জানতে চাই। আপনার এক্সিবিশন হয়েছিল কি?

তাহেরা খানম : হ্যাঁ হয়েছে। পাস করার আগে-পরে চারুকলায় বাৎসরিকভাবে যেটা হতো সেটায় আমার ছবি গেছে কয়েকবার। তবে কেউ আমাদের ছবি-টবি ফেরত দিত না। বিক্রি-টিক্রিও হতো না এখনকার মতো। ছবি দিতে বলা হতো, ছবি দিয়ে দিতাম। কিছু বুঝতামও না সে সময়। আমরা তখন অনেক অজ্ঞ ছিলাম ভয়ে, আবেদিন স্যারের ভয়ে। আবেদিন স্যার আমাদেরকে তখন এমনভাবে মানুষ করেছেন না! কড়া বাবা যেমন করে শাসন করে তেমন ছিলেন তিনি। ছেলেদের সাথে মিশতেই দিতেন না। থার্ড ইয়ারের পর মিশলাম। টিফিন পিরিয়ডে আড্ডা দিচ্ছি, হয়ত কাজের আড্ডাই দিচ্ছি, আবেদিন স্যার এসেই বললেন, ‘বেরোও’। কোন কথাবার্তা নেই, আমাদের বের করে দিলেন, এই ছিল তাঁর শাসন।

ওবায়েদ আকাশ : আপনারা এর কোনো প্রতিবাদ করেননি?

তাহেরা খানম : না। সাহসই হয়নি। আবেদিন স্যারকে জমের মতো ভয় পেতাম।

ওবায়েদ আকাশ : আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায় ছিল?

তাহেরা খানম : আমরা বরিশালের। আমার আব্বা পুলিশে চাকরি করতেন। আব্বা প্রথম জীবনে ছিলেন ফরিদপুর, তারপরে কলকাতা। ঢাকায় কদাচিৎ আসতেন, তবে ফ্যামিলি নিয়ে না। একাই আসতেন অফিসের কাজে।

মুনীরুজ্জামান : আপনি তো একক প্রদর্শনী করেননি, তাই না?

তাহেরা খানম : সলো করেছি, দুই হাজার তিন সালে। না না, মনে পড়েছে, আরও একবার করেছি। ২০১৫-তে। জল রঙের ওপর দুর্বলতাটা ছিল। অয়েল পেইন্টিং-এ আমি ভাল ছিলাম না। কাজেই সব কাজ জল রঙেই ছিল। ২০০৮ থেকে আরম্ভ করলাম ক্যানভাসে। জলরঙে করতাম বোর্ডে। এর আগে করতাম আরেকটা পেপারে, সেটার নাম ভুলে গেছি। পেপারটা ভিজিয়ে নিতাম আঁকার আগে।

ওবায়েদ আকাশ : অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং সম্পর্কে আপনার কোনো আগ্রহ হয় নি কখনও?

তাহেরা খানম : অ্যাবস্ট্রাক্ট আমি বুঝি না। সত্যি কথা বলতে, সে ব্যাপারে আমি একেবারেই অজ্ঞ। কিন্তু চোখে ভাল লাগা, সেটা তো আছে, যেমন কিবরিয়া স্যারের কাজ। কী যেন আছে, খুব ভাল লাগে, এটুকুই, এর বেশি না। এসব বুঝতাম, যদি এ সম্বন্ধে পড়াশোনা করতাম। এ নিয়ে অনেক পড়তে হয়। আমি সে রকম পড়াশোনা করি নি। পড়াশোনাটা ভীষণ দরকার। কাইয়ুম প্রতিদিন পড়াশোনা করত। সে যে চলে গেছে, সকাল বেলায় বাড়ি থেকে বের হয়েছে, আগের দিনের পাতা ভাঁজ করা বইটা তখনও বিছানায়। কাইয়ুম বাসায় থাকলে প্রতিদিন বই পড়ত, দুপুর বেলায় একটু ঘুমের অভ্যাস ছিল, আর সারা দিন শুধুই বই। আমাদের আগে পড়াশোনার খুব ঝোঁক ছিল। বাংলা সাহিত্যের যত বই পড়েছি, এখনকার ছেলেমেয়েরা তা পড়ছে না।

মুনীরুজ্জামান : আপনি এখন কিছু আঁকছেন না?

তাহেরা খানম : আঁকছিলাম। কাইয়ুম চলে যাওয়ার পরেও আঁকছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই আমি কাজ করছিলাম ২০১৫-তে, ১৬-তেও করেছি, ১৭-তে সামান্য করে ১৮-তে সম্পূর্ণই বাদ দিয়ে দিয়েছি। এখন শুধুই ডাক্তারের পেছনে দৌড়াচ্ছি।

ওবায়েদ আকাশ : আপনার কি কোনো স্বপ্ন ছিল না যে পেইন্টিং নিয়ে বা ড্রয়িং নিয়ে বড় কিছু করবেন?

তাহেরা খানম : আমার স্বপ্ন ছিল আমি ছবি আঁকব। শুধু এটাই ছিল আমার স্বপ্ন।

ওবায়েদ আকাশ : সেটা কি পূরণ হয়েছে?

তাহেরা খানম : সেটা তো পূরণ হতো স্যারদের দিয়ে। স্যাররা যদি এক্সিবিশনের সময় আমাদের ছবিগুলো নিত, আমাদের খবর নিত, তবে তো অনেক কিছুই হতো। আমরা পাস করে বেরিয়ে গেলাম। আমাদের কোনো খবর নেই। কেউ কোনো খবর নেয়নি। ডাকেনি। আক্ষেপটা তো আমাদের আছেই। এসব কথা কাইয়ুমকে অনেক বলেছি, কিন্তু বললেও ও বলত, ‘আমি কী করবো, আমার নিজের তো কোনো ক্ষমতা নাই, তেমন নাম নাই’। একসময় কাইয়ুমকেও অনেক অপমান করা হতো। খুব করা হতো। সব সময় করা হয়েছে। আমি সবসময় ওকে বলেছি, তুমি মন দিয়ে কাজ কর। এগুলোতে কান দিও না। তোমার কাজ তুমি করে যাও।

ওবায়েদ আকাশ : আপনি কী কাইয়ুম ভাইকে সময় দিতে গিয়েই শিল্পচর্চা করলেন না?

তাহেরা খানম : না, তাঁর দোষ না। এটা ঠিক যে, তাঁকে আমি অনেক সহযোগিতা করেছি, আনন্দের সঙ্গেই করেছি এবং সেও আমাকে বিশ্বাস করেছে। আমি একদম খারাপ ছিলাম না, যার জন্য আমার আশ্বাসটা সে গ্রহণ করেছে, সে তো বলেছে যে, ‘আমিই ছবি আঁকতে পারি না, আমার বদনাম করে, আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’ আমার বলা উচিৎ ছিল আবেদিন স্যারকে, যে স্যার আমরা যেসব মেয়ে পাস করে বেরিয়েছি, আমরা যে কাজ করি তাঁর কী কোনো মূল্য নাই? আমরা তো আসলেই সেটা পারি নি। আমরা তাদেরকে জমের মতো ভয় পেয়েছি, ভয় পেয়েই রয়েছি। আমরা মেয়েরা কলেজে পড়েছি কয়েকজনই, এদের বিয়ে হয়ে গেলেই সব শেষ। এটাই ছিল অনেকের ধারণা। ধারণাটা যখন পাল্টালো, অর্থাৎ যখন ভাবা শুরু হলো যে, পারা যায়, মেয়েরাও বড় আঁকিয়ে হতে পারে, তখন বয়স হয়ে গেছে, দেরি হয়ে গেছে।

ওবায়েদ আকাশ : শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে নারীদের এখনো কি প্রতিবন্ধকতা আছে বলে মনে করেন?

তাহেরা খানম : না না। তা আমি বলবো না। মেয়েরা অনেকে হয়ত নিজেরাই করে না। সবাইকে তো দেখি, কেউ কেউ ঘর-সংসার করে, কেউ আবার ছবি আঁকে, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবে। ঘর-সংসার যারা করে স্বাভাবিকভাবেই তাদের জীবনে বাধা আসে, ঘর-সংসার ঠিকভাবে চালানো, ছেলেমেয়ে বড় করা আবার ওদের বিয়ে দেওয়া নানা ব্যাপারে কোথায় যেন হারিয়ে যায় মেয়েরা।

মুনীরুজ্জামান : আপনি এখনকার কারো কাজ দেখছেন?

তাহেরা খানম : না, আমি এখন কাজ-টাজ দেখি না, যাইও না। কাজ দেখা উচিৎ, যাওয়া উচিৎ। কিন্তু যাওয়া হয় না।

মুনীরুজ্জামান : ভাল কোনো এক্সিবিশন হলে যেতে ইচ্ছে করে না?

তাহেরা খানম : ইচ্ছে করে। কিন্তু বেরোতে ইচ্ছে করে না। আমি ঘর থেকেই বেরোই না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমি কেমন যেন মৃত্যুর দিকটাই ভাবতে শুরু করেছি। এটা আমার এসে গেছে। আমার মধ্যে হতাশাটা এসে গেছে।

মুনীরুজ্জামান : আপনার জীবনে অনেক ঝড়-ঝাপটা গেছে, কিন্তু আপনি যদি আবার শিল্প জগতের সঙ্গে যুক্ত হন, তাহলে তো হতাশাটা কেটে যেতে পারে।

তাহেরা খানম : না। সে সময়ও নাই আর সে বয়সও নাই। হয়ত কাইয়ুম থাকলে হতো। আমার অভ্যাস ছিল সব কাজে একজনকে জিজ্ঞাসা করা, সেটা এখন আর হয় না। শেষের দিকে কাইয়ুম আমাকে একটা কথা বলে গেছে, তুমি কল্পনায় চল। আমি হয়ত সেই কল্পনার ভেতরেই থাকার চেষ্টা করি।

ছবি

দূরের তারাটিকে

ছবি

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

ছবি

যেদিন সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন

ছবি

ফিরবে না তা জানি

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

‘আমার স্বপ্ন ছিল আমি ছবি আঁকব’-তাহেরা খানম

শনিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২১

https://sangbad.net.bd/images/2021/December/04Dec21/news/Tahera-Khanom-1.jpg

তাহেরা খানম / জন্ম: ১৯৩৫; মৃত্যু : ১ নভেম্বর ২০২১

অনেকটা নীরবে-নিভৃতে চলে গেলেন প্রবল মেধাবী চিত্রকর তাহেরা খানম। হয়তো তাঁকে কেউ মনেই রাখেননি। ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরীর সহধর্মিণী, প্রেরণা। জীবনে ছবি এঁকেছেন খুবই কম। তবে তাঁর শিল্প যে কত গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ- ছবিগুলোতে তা বিধৃত। ১৯৫৪ সালে যে পাঁচজন ছাত্রী ঢাকার আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিলেন তাহেরা খানম তাঁদের অন্যতম। কাছাকাছি সময়ে সেখানকারই ছাত্র কাইয়ুম চৌধুরী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে। পরবর্তীতে তাঁরা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তাহেরা খানমের এ পর্যন্ত একক প্রদর্শনী হয়েছে দুটি। একটি ২০০৩ সালে ও অপরটি ২০১৫ সালে। জীবনসঙ্গী কাইয়ুম চৌধুরীর অন্তর্ধানের পর একা ও নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন দীর্ঘদিন। স্মৃতিগুলো ভারাতুর করে রাখত সব সময়। বছর তিনেক আগে গৃহীত এই সাক্ষাৎকারে ব্যক্তিগত শিল্পী জীবন, কাইয়ুম চৌধুরী ও আরো নানা প্রসঙ্গে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কথা বলেন সংবাদ-এর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সদ্যপ্রয়াত খন্দকার মুনীরুজ্জামানওবায়েদ আকাশ। শ্রুতিলিখন করেন খোন্দকার মুনতাসীর মামুন

ওবায়েদ আকাশ : আপনি কেন চারুকলায় ভর্তি হয়েছিলেন?

তাহেরা খানম : চারুকলায় ভর্তি হওয়ার জন্যই আমি তৈরি ছিলাম। আঁকাআঁকির দিকেই সবসময় আমার নজরটা ছিল। আর পরিবার থেকেও চেয়েছিল যে, আমি চারুকলাতেই ভর্তি হই।

১৯৫৪ সাল। আমরা, মোট পাঁচজন ছাত্রী ভর্তি হয়েছিলাম এক সঙ্গে। সবার নাম মনে নেই। কয়েকজনের নাম মনে আছে- রওশন আমিন, হাসিনা আলী এবং আরেকজন হল জোবেদা। শিল্পী আমিনুল ইসলামের স্ত্রী রুবি ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, যদিও ও আমার এক ব্যাচ জুনিয়র ছিল।

ওবায়েদ আকাশ : শিক্ষক হিসেবে আপনি কাদের পেয়েছিলেন?

তাহেরা খানম : শিক্ষক হিসেবে অনেককেই পেয়েছি। জয়নুল আবেদিন, আলী আহসান, আব্দুর রহমান, কামরুল হাসান, মোহাম্মদ কিবরিয়া। না না, ভুল বলছি। কিবরিয়া স্যার তখনও আসেননি। উনি পরে এসেছেন।

ওবায়েদ আকাশ : শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কী করে হলো?

তাহেরা খানম : যোগাযোগটা কাকতালীয়ভাবেই। আমরা যখন ভর্তি হই তখন সব স্যারই তো ব্যাচেলর। কাইয়ুম চৌধুরী তখন সবেমাত্র টিচার হিসেবে জয়েন করেছেন। আবেদিন স্যার ওনাকে পাঠালেন সব ডিপার্টমেন্ট ঘুরে দেখার জন্য। উনি ভীষণ ভীতু এবং লাজুক ছিলেন। আমাদের ক্লাস দেখতে এলেন। ওনাকে দেখে এক মেয়ে (হাসিনা আলী) পেইন্টিং-এর ব্রাশ মুখে নিয়ে আড়চোখে একটু তাকাল আর সঙ্গে সঙ্গে উনি লজ্জায় বেরিয়ে গেলেন।

ওবায়েদ আকাশ : কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা কখন, কীভাবে হলো?

তাহেরা খানম : ওটাই তো বলছি। রুবি হলো মধ্যস্থতাকারী। কাইয়ুমের সঙ্গে রুবির পরিচয় ছিল। আমিনুল তো তখন আছেই। আমিনুল তখন স্টুডিও করেছিলেন। আবেদিন স্যার তাকে একটা স্টুডিও দিয়েছিলেন, ঐ যে সামনের খোলা রুমটা, গ্লাসঅলা। ওটা তাকে দেয়া হয়েছিল। তিনি ছবি আঁকতেন। বিদেশ থেকে ফেরার পর থেকেই রুবির সঙ্গে আমিনুলের যোগাযোগ। আমিনুল তখন আমাদের ক্লাস নিতেন। আমিনুলের রুমেই আমার সঙ্গে কাইয়ুমের মধ্যস্থতা হয়। আমাকে না কাইয়ুমকেই সব বলে রুবি। আমি তখনও কিছুই জানি না। শুধু কাইয়ুমকেই বলেছে আমার কথা। এর মধ্যে সৈয়দ হককেও কাইয়ুম ডেকেছে। সৈয়দ শামসুল হকও কিন্তু তখন আমাকে পছন্দ করতেন। আমরা যখন ছুটির পর বেরিয়ে যাই, আমি টের পেয়েছি, একটা লোক (সৈয়দ হক) আমাকে দেখছে। যাই হোক, যখন কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা হয়ে গেল তখন সৈয়দ হক বলেছিলেন, ‘চলবে’। সৈয়দ হকও তাঁর এক লেখায় এই গল্প করেছেন।

যা বলছিলাম, ক্লাস সেরে আমি বের হয়েছি, কাইয়ুম আর হক তখন গেটে, হঠাৎ আমি তাকিয়েছি, দেখি দুজন আমাকে দেখছে। ঐ তাকানোটায় আমার সন্দেহ হয়েছে। তখনই হক আমাকে দেখে বলেছিলেন, ‘চলবে’।

তারপর পারিবারিকভাবেই প্রস্তাবটা এলো। এই প্রস্তাব নিয়ে একটু এদিক-ওদিক হয়েছিল। কিন্তু আমার ছোট বোনটা কাইয়ুমকে আমার জন্য পছন্দ করে ফেলেছে। আমার সঙ্গে কাইয়ুমের আলাপ শুরু হলো।

https://sangbad.net.bd/images/2021/December/04Dec21/news/Tahera-Khanom-2.jpg

শিল্পী : তাহেরা খানম

ওবায়েদ আকাশ : এত তাড়াতাড়িই কি বিয়ের কথা বলা হলো? পরিচয় হওয়ার আগেই?

তাহেরা খানম : না না। এর মধ্যে কয়েক মাস গেল তো! আমি তো তখন ফাইনাল ইয়ারে। কিছুদিন পরেই পাস করলাম। পাস করার পরেও কয়েক মাস কাজ করেছি। অনেকদিন গেছে। এর মধ্যে তো কথা হয়ই।

আমার সঙ্গে আলাপ হলো। আমার ছোট বোনটা খুব খুশি। কাইয়ুম বাসায় আসতো। অবশ্য বাসায় ঢোকার সাহস হয়নি তখনও। বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হতো। আমার মা দেখত দূর থেকে। ও আমার দাদাকে (বড় ভাই) খুব ভয় পেত। দাদা জানতেন না ও যে আসে।

কী করে কী করে যেন রুবি জানিয়েছে সবাইকে। বিয়ের আগে আগে কাইয়ুমের চিকেন পক্স হয়েছিল, বাসার বাইরে খুব একটা বের হতো না। আমাদের কাছেই ছিল আমিনুল স্যারের বাড়ি। সেখানে আসত। সেসময় আমার সঙ্গে দেখা হতো। আমি একবার ওকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমাকে মাঝে মাঝে বই-টই দিত। অবশ্য সে সময় আমাদের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। ১৯৬০-এর পয়লা জুনে বিয়ে হলো আর এনগেজমেন্ট হয়েছে মার্চে।

ওবায়েদ আকাশ : আজিমপুরের বাড়িটা কি আপনাদের?

তাহেরা খানম : আজিমপুরেরটা অর্থাৎ যেটায় আমি এখন থাকি সেটা আমাদের। কাইয়ুমদের বাড়ি ছিল সিদ্ধেশ্বরীতে, সেখানে এখন এপার্টমেন্ট হয়েছে।

একটা মজার ঘটনা বলি। কাইয়ুমের এক মামাতো ভাই ছিল, সে থাকত পলাশির ব্যাচেলর কোয়ার্টারে। কাইয়ুমের সঙ্গে একদিনই রিক্সায় চড়েছিলাম, বই-পত্র আমাকে দিয়েছে। রিক্সাওয়ালা কম বয়সী, একটু মিচকে শয়তান টাইপের। আমাদের কথা শুনেই ও সন্দেহ করেছে। কাইয়ুম বাসায় না নেমে গ্রীন রোডে নেমেছে। ওখান থেকে হেঁটে আমরা চলে আসব। ঐ ছেলেটা কী যেন বলল, আর সঙ্গে সঙ্গে কাইয়ুম ভীষণ চটে গিয়ে দিল ওকে দুঘা কষিয়ে। ভিড় হয়ে গেল। মামাতো ভাইটা ভিড়ের মধ্যে এসব দেখে ফেলল। তবে আমাদের তো তখন এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। মনোবলটা তো আছে। যা হোক, পরিবারের অন্যরাও সব কিছু জেনে গেল সেই থেকে।

ওবায়েদ আকাশ : বিয়ের পর আপনারা যে নয়া পল্টনে একটা বাড়িতে উঠেছিলেন, সেখানে কারা কারা ছিলেন, কারা আসতেন?

তাহেরা খানম : হ্যাঁ, ছবি আঁকার সুবিধার জন্য বিয়ের পর আমরা নয়া পল্টনে একটা বাড়ি ভাড়া করেছিলাম। আমার শ্বশুরবাড়িতে একটা ঘর ছিল কাইয়ুমের। বিয়ের পর লোকজন বেড়ে গেল। বোনরা এসেছিল থাকার জন্য। সেজন্য সবার সঙ্গে কথা বলেই আমরা নয়া পল্টনের বাড়িতে উঠলাম। বাড়িটা এখন দেখা যাবে না। আগে ওখানে অনেকগুলো পুকুর ছিল। বিশাল ঝিল ছিল। কাছাকাছি থাকতেন পরিচিত অনেকে। অনেক আড্ডা-টাড্ডা হতো। মুক্তিযোদ্ধা নজরুল, তাঁর বউ হাজেরা নজরুল (লেখালেখি করতেন) ওদের বাড়ি ছিল। গাজী শাহাবুদ্দিন ছিলেন, জয়নুল আবেদিন ছিলেন, জাহিদ ভাই ছিলেন (পরে করাচি চলে গেলেন)। কবি জসীম উদ্দীন সাহেব থাকতেন একটু দূরে। সকালে কোন গান গুনগুন করতে করতে বেরোতেন, সবার বাড়িতে আসতেন। শওকত ভাই (শওকত ওসমান) থাকতেন রাজারবাগ, পুলিশ লাইনের দক্ষিণে। তিনি সকালে ফোন নিয়ে বসতেন, সবাইকে ফোন করতেন। রাস্তা খুব ফাঁকা ছিল সেসময়। বাড়িঘর কম ছিল, ঝিল ছিল, ফাঁকা ছিল, খুবই সুন্দর ছিল পরিবেশটা। পুরানা পল্টনে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল, হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাল ভাল ফ্যামিলি থাকত সেখানে।

ওবায়েদ আকাশ : আপনাদের বাড়িতে যে আড্ডা হতো সেখানে কারা কারা থাকতেন?

তাহেরা খানম : হেন লোক নেই যারা থাকতেন না। জহির রায়হান, সৈয়দ শামসুল হক থেকে শুরু করে যাদের নাম বললাম সবাই আসতেন। সারারাত কাজ করত ওরা। আমাকে সরিয়ে দিত। হক কাট কাট কথা বলত, ‘যান আপনি ঘুমান গিয়া’। গাজীর কথাপল্লীতে ছিল বিশাল আড্ডা। মাওলা ব্রাদার্সের মাওলা সাহেব ছিলেন।

ওবায়েদ আকাশ : আপনার শিল্প চর্চার বিষয়ে কিছু জানতে চাই। আপনার এক্সিবিশন হয়েছিল কি?

তাহেরা খানম : হ্যাঁ হয়েছে। পাস করার আগে-পরে চারুকলায় বাৎসরিকভাবে যেটা হতো সেটায় আমার ছবি গেছে কয়েকবার। তবে কেউ আমাদের ছবি-টবি ফেরত দিত না। বিক্রি-টিক্রিও হতো না এখনকার মতো। ছবি দিতে বলা হতো, ছবি দিয়ে দিতাম। কিছু বুঝতামও না সে সময়। আমরা তখন অনেক অজ্ঞ ছিলাম ভয়ে, আবেদিন স্যারের ভয়ে। আবেদিন স্যার আমাদেরকে তখন এমনভাবে মানুষ করেছেন না! কড়া বাবা যেমন করে শাসন করে তেমন ছিলেন তিনি। ছেলেদের সাথে মিশতেই দিতেন না। থার্ড ইয়ারের পর মিশলাম। টিফিন পিরিয়ডে আড্ডা দিচ্ছি, হয়ত কাজের আড্ডাই দিচ্ছি, আবেদিন স্যার এসেই বললেন, ‘বেরোও’। কোন কথাবার্তা নেই, আমাদের বের করে দিলেন, এই ছিল তাঁর শাসন।

ওবায়েদ আকাশ : আপনারা এর কোনো প্রতিবাদ করেননি?

তাহেরা খানম : না। সাহসই হয়নি। আবেদিন স্যারকে জমের মতো ভয় পেতাম।

ওবায়েদ আকাশ : আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায় ছিল?

তাহেরা খানম : আমরা বরিশালের। আমার আব্বা পুলিশে চাকরি করতেন। আব্বা প্রথম জীবনে ছিলেন ফরিদপুর, তারপরে কলকাতা। ঢাকায় কদাচিৎ আসতেন, তবে ফ্যামিলি নিয়ে না। একাই আসতেন অফিসের কাজে।

মুনীরুজ্জামান : আপনি তো একক প্রদর্শনী করেননি, তাই না?

তাহেরা খানম : সলো করেছি, দুই হাজার তিন সালে। না না, মনে পড়েছে, আরও একবার করেছি। ২০১৫-তে। জল রঙের ওপর দুর্বলতাটা ছিল। অয়েল পেইন্টিং-এ আমি ভাল ছিলাম না। কাজেই সব কাজ জল রঙেই ছিল। ২০০৮ থেকে আরম্ভ করলাম ক্যানভাসে। জলরঙে করতাম বোর্ডে। এর আগে করতাম আরেকটা পেপারে, সেটার নাম ভুলে গেছি। পেপারটা ভিজিয়ে নিতাম আঁকার আগে।

ওবায়েদ আকাশ : অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং সম্পর্কে আপনার কোনো আগ্রহ হয় নি কখনও?

তাহেরা খানম : অ্যাবস্ট্রাক্ট আমি বুঝি না। সত্যি কথা বলতে, সে ব্যাপারে আমি একেবারেই অজ্ঞ। কিন্তু চোখে ভাল লাগা, সেটা তো আছে, যেমন কিবরিয়া স্যারের কাজ। কী যেন আছে, খুব ভাল লাগে, এটুকুই, এর বেশি না। এসব বুঝতাম, যদি এ সম্বন্ধে পড়াশোনা করতাম। এ নিয়ে অনেক পড়তে হয়। আমি সে রকম পড়াশোনা করি নি। পড়াশোনাটা ভীষণ দরকার। কাইয়ুম প্রতিদিন পড়াশোনা করত। সে যে চলে গেছে, সকাল বেলায় বাড়ি থেকে বের হয়েছে, আগের দিনের পাতা ভাঁজ করা বইটা তখনও বিছানায়। কাইয়ুম বাসায় থাকলে প্রতিদিন বই পড়ত, দুপুর বেলায় একটু ঘুমের অভ্যাস ছিল, আর সারা দিন শুধুই বই। আমাদের আগে পড়াশোনার খুব ঝোঁক ছিল। বাংলা সাহিত্যের যত বই পড়েছি, এখনকার ছেলেমেয়েরা তা পড়ছে না।

মুনীরুজ্জামান : আপনি এখন কিছু আঁকছেন না?

তাহেরা খানম : আঁকছিলাম। কাইয়ুম চলে যাওয়ার পরেও আঁকছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই আমি কাজ করছিলাম ২০১৫-তে, ১৬-তেও করেছি, ১৭-তে সামান্য করে ১৮-তে সম্পূর্ণই বাদ দিয়ে দিয়েছি। এখন শুধুই ডাক্তারের পেছনে দৌড়াচ্ছি।

ওবায়েদ আকাশ : আপনার কি কোনো স্বপ্ন ছিল না যে পেইন্টিং নিয়ে বা ড্রয়িং নিয়ে বড় কিছু করবেন?

তাহেরা খানম : আমার স্বপ্ন ছিল আমি ছবি আঁকব। শুধু এটাই ছিল আমার স্বপ্ন।

ওবায়েদ আকাশ : সেটা কি পূরণ হয়েছে?

তাহেরা খানম : সেটা তো পূরণ হতো স্যারদের দিয়ে। স্যাররা যদি এক্সিবিশনের সময় আমাদের ছবিগুলো নিত, আমাদের খবর নিত, তবে তো অনেক কিছুই হতো। আমরা পাস করে বেরিয়ে গেলাম। আমাদের কোনো খবর নেই। কেউ কোনো খবর নেয়নি। ডাকেনি। আক্ষেপটা তো আমাদের আছেই। এসব কথা কাইয়ুমকে অনেক বলেছি, কিন্তু বললেও ও বলত, ‘আমি কী করবো, আমার নিজের তো কোনো ক্ষমতা নাই, তেমন নাম নাই’। একসময় কাইয়ুমকেও অনেক অপমান করা হতো। খুব করা হতো। সব সময় করা হয়েছে। আমি সবসময় ওকে বলেছি, তুমি মন দিয়ে কাজ কর। এগুলোতে কান দিও না। তোমার কাজ তুমি করে যাও।

ওবায়েদ আকাশ : আপনি কী কাইয়ুম ভাইকে সময় দিতে গিয়েই শিল্পচর্চা করলেন না?

তাহেরা খানম : না, তাঁর দোষ না। এটা ঠিক যে, তাঁকে আমি অনেক সহযোগিতা করেছি, আনন্দের সঙ্গেই করেছি এবং সেও আমাকে বিশ্বাস করেছে। আমি একদম খারাপ ছিলাম না, যার জন্য আমার আশ্বাসটা সে গ্রহণ করেছে, সে তো বলেছে যে, ‘আমিই ছবি আঁকতে পারি না, আমার বদনাম করে, আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’ আমার বলা উচিৎ ছিল আবেদিন স্যারকে, যে স্যার আমরা যেসব মেয়ে পাস করে বেরিয়েছি, আমরা যে কাজ করি তাঁর কী কোনো মূল্য নাই? আমরা তো আসলেই সেটা পারি নি। আমরা তাদেরকে জমের মতো ভয় পেয়েছি, ভয় পেয়েই রয়েছি। আমরা মেয়েরা কলেজে পড়েছি কয়েকজনই, এদের বিয়ে হয়ে গেলেই সব শেষ। এটাই ছিল অনেকের ধারণা। ধারণাটা যখন পাল্টালো, অর্থাৎ যখন ভাবা শুরু হলো যে, পারা যায়, মেয়েরাও বড় আঁকিয়ে হতে পারে, তখন বয়স হয়ে গেছে, দেরি হয়ে গেছে।

ওবায়েদ আকাশ : শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে নারীদের এখনো কি প্রতিবন্ধকতা আছে বলে মনে করেন?

তাহেরা খানম : না না। তা আমি বলবো না। মেয়েরা অনেকে হয়ত নিজেরাই করে না। সবাইকে তো দেখি, কেউ কেউ ঘর-সংসার করে, কেউ আবার ছবি আঁকে, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবে। ঘর-সংসার যারা করে স্বাভাবিকভাবেই তাদের জীবনে বাধা আসে, ঘর-সংসার ঠিকভাবে চালানো, ছেলেমেয়ে বড় করা আবার ওদের বিয়ে দেওয়া নানা ব্যাপারে কোথায় যেন হারিয়ে যায় মেয়েরা।

মুনীরুজ্জামান : আপনি এখনকার কারো কাজ দেখছেন?

তাহেরা খানম : না, আমি এখন কাজ-টাজ দেখি না, যাইও না। কাজ দেখা উচিৎ, যাওয়া উচিৎ। কিন্তু যাওয়া হয় না।

মুনীরুজ্জামান : ভাল কোনো এক্সিবিশন হলে যেতে ইচ্ছে করে না?

তাহেরা খানম : ইচ্ছে করে। কিন্তু বেরোতে ইচ্ছে করে না। আমি ঘর থেকেই বেরোই না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমি কেমন যেন মৃত্যুর দিকটাই ভাবতে শুরু করেছি। এটা আমার এসে গেছে। আমার মধ্যে হতাশাটা এসে গেছে।

মুনীরুজ্জামান : আপনার জীবনে অনেক ঝড়-ঝাপটা গেছে, কিন্তু আপনি যদি আবার শিল্প জগতের সঙ্গে যুক্ত হন, তাহলে তো হতাশাটা কেটে যেতে পারে।

তাহেরা খানম : না। সে সময়ও নাই আর সে বয়সও নাই। হয়ত কাইয়ুম থাকলে হতো। আমার অভ্যাস ছিল সব কাজে একজনকে জিজ্ঞাসা করা, সেটা এখন আর হয় না। শেষের দিকে কাইয়ুম আমাকে একটা কথা বলে গেছে, তুমি কল্পনায় চল। আমি হয়ত সেই কল্পনার ভেতরেই থাকার চেষ্টা করি।

back to top