ধারাবাহিক উপন্যাস : ছাব্বিশ
আবুল কাসেম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
অতসুমিচি ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠলেন তাকে দেখে। কাঁপা কণ্ঠে বললেন, তুমি এখানে?
হ্যাঁ আমি। খুব জরুরি কথা আছে।
বল।
ব্যাপারটা গোপনীয়।
দরবার থেকে খাস কামরায় গেলেন এরা।
সব শুনে প্রিন্স অসুমিচি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বললেন, তোমাকে এ সংবাদ কে দিল?
যে-ই দিক, আপনি নিজে খোঁজখবর নিন।
আচ্ছা। তুমি তাহলে এসো। আর এভাবে হুটহাট করে এসো না। প্রিন্সেস ঝামেলা করছে। এখান পর্যন্ত এসেছ শুনলে খুবই সমস্যা হবে।
আপনি বউকে ভয় করছেন?
বউকে সবাই ভয় করে, তোমাদের শক্তিমান সম্রাটও।
আপনি তো আমাকে ভয় পান না।
প্রিন্স বলতে যাচ্ছিলেন, তুমি তো আমার স্ত্রী না, বললেন না। বললেন, তোমাকে আমি ভালোবাসি ভয় পাব কেন?
ইঝোমি মনে মনে বললেন, জানি কত ভালো বাসেন। মুখে বললেন, যদি সম্রাট বানিয়ে দিই বউ করবেন তো, মানে সম্রাজ্ঞী?
তুমি?
কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?
তোমার ক্ষমতা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
কথা দিন, তারপর দেখুন। তবে আপনাকে বর্তমান সম্রাটের মৃত্যু বা সাম্রাজ্য পরিচালনায় অক্ষম না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
কেন? তুমি কি এই সম্রাটকেও ভালোবাসো?
আপনার বাবার সঙ্গে মিচিনাগার এরকমই কথা হয়েছে।
আচ্ছা, খোঁজখবর নিয়ে দেখি।
আপনি কিন্তু কথা দেননি।
সেটা তো সম্রাটের মৃত্যুর পর। তিনি এখনো যথেষ্ট তরুণ। আমি প্রায়ই তার দরবারে যাই মজা করতে।
তা আমি জানি। একজন সম্রাটের মৃত্যু যে কোনো সময় হতে পারে। এমনকি আজও।
আজও? এতে অবাক হবার কিছু নেই। প্রত্যেক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ঘাঁটিও। যে কোন সময় গণেশ উল্টাতে পারে।
আমি যতদূর জানি এখনো সে সম্ভাবনা নেই।
আপনি উচ্চাভিলাষী নন। যথেষ্ট উদাসীন।
কথাটা সত্য। তিনি ভোগপ্রবণ মানুষ। ভোগচিন্তা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা তার মাথায় নেই। সম্রাট হওয়ার উচ্চাভিলাষ নির্ঝঞ্ঝাট নয়। এ জন্য তার নিস্পৃহতা। এক সময় স্বপ্ন ছিল। এখন সব ছেড়ে ভোগে মত্ত। যার জন্য স্ত্রীকেও ভয়।
প্রিন্স বললেন, অনেক সময় হয়ে গেছে, তুমি এখন এসো।
এসেই যখন পড়েছি, প্রিন্সেস তা জানবেন। শাস্তি যা দেয়ার দেবেন। এখন আসুন। অন্তরবাসিনী, অঙ্কশাহিনী তো প্রদেশে পার হয়ে চলে গেছে। আসুন।
এখানে? এর জন্য নির্ধারিত স্থান আছে নাকি?
অতসুমিচি ইঝোমিকে যাই বলুন না কেন, বাবা রেইঝেইকে কথাটা সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন।
বাবা তাকে চারিত্রিকস্খলতার কারণে খুব একটা পছন্দ করেন না। তবুও তাকে আজ খাটো করে দেখলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি একথা কোথায় শুনলে?
বাবা, কোথায় শুনেছি তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কী শুনেছি তাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যা শুনেছ সত্য। ও তোমার বড় ভাই। তার অধিকার আগে।
তা মানলাম। কিন্তু তার অবর্তমানে আমি নই কেন?
কারণ সম্রাট ইচিজোর এক পুত্র রয়েছে।
এ ব্যাপারটা যদি এমনই হয়, তাহলে বড় ভাই নয়, আমিই সিংহাসন চাই।
সানজুর অধিকার মেনে নেয়ার পর তোমার মুখে একথা মানায়? মানায় না। সানজু বেঁচে থাকলে সেই সম্রাট হবে।
এটা আপনার শেষ কথা হতে পারে না।
তুমি এখন এসো। আমাকে কাজ করতে দাও।
রেইঝেই অত্যন্ত ধৈর্যশীল এবং বিচক্ষণ প্রকৃতির মানুষ। তার ব্যক্তিত্বের কাছে সবাই নতজানু। তার এই পুত্র এভাবে কথা বলবে ভাবতে পারেননি। ব্যাপারটাকে তিনি হালকাভাবে নিচ্ছেন না। ভাবলেন, ব্যাপারটা বেশ দূর গড়িয়েছে। তা নিয়ে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। না হয় যে কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে।
চুয়াল্লিশ.
লেখার দেবতা যেন হঠাৎ করেই মুরাসাকিকে সাক্ষাৎ দিলেন। তিনি আবার লিখতে শুরুকরলেন। বিয়াল্লিশতম অধ্যায়।
হিকারুগেঞ্জির মৃত্যু হয়েছে। এই আবেগাচ্ছন্ন করিৎকর্মা মানুষটি অনেক অকর্ম করে বিদায় নিয়েছে। তার বিদায়ে সাম্রাজ্যজুড়ে শোক। কারণ সম্রাট তার পুত্র। তবে অনেকেই যেমন শোকগ্রস্থ নয়, তেমনি গুনবান ব্যক্তিদের যারা প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের মধ্যে কেউই গেঞ্জির উৎকৃষ্টগুণের অনেকগুলোর সঙ্গেই একমত না বা মানিয়ে নিতে পারছেন না। তাদের মধ্যে রয়েছে নাইয়ো, কাওরো এবং তৃতীয় রাজকুমারী। যদিও সারা দুনিয়া বিশ্বাস করে কাওরো গেঞ্জির পুত্র, কাওরোর তাতে সন্দেহ রয়েছে। এ নিয়ে সে সমস্যায়ই আছে। সে এ জীবন ত্যাগ করে বৌদ্ধ ভিক্ষু হতে চায় (সংক্ষেপিত)।
লেখার এই অগ্রগতিতে উৎফুল্ল মুরাসাকি। আবার যেন জীবন ফিরে পেয়েছেন। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে কাওরোর জন্ম সন্দেহ তার জীবনযাপনে এক মনস্তাত্ত্বিক সংকটের সৃষ্টি করে। সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। গেঞ্জিকে মনে করা হয় বিশ্বের আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসেরও প্রতিভূ। গেঞ্জির ভোগাকাক্সক্ষা এবং দুর্ভোগের মধ্যে তা যেমন স্পষ্ট, তেমনি স্পষ্ট ভুল জন্মের কাওরোর মধ্যেও। কাওরো যেন তার অবৈধ জন্মকে মেনে নিতে পারছে না। মনস্তাত্ত্বিকভাবে সে নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। বাস্তব জীবনে ইচ্ছার নানা ব্যত্যয় সেই সমস্যায় ঘৃতাহুতি দিয়েছে। তবে মুরাসাকির শক্তিশালী লেখনিতে তা এতটা শিল্পায়িত যে, গ্রিক মিথের সে বংশ পরম্পরা পাপের শাস্তির অনিবার্যতা, এখানে তা মুখ্য নয়। প্রাচ্যে একথা তো প্রচলিত যে, পিতার অপরাধে পুত্র কেন শাস্তি ভোগ করবে। তাই উঁচুদরের একটা ট্র্যাজেডি রচনার সুযোগ পেয়েও মুরাসাকি তা হাতছাড়া করছেন।
কাওরোর মধ্যে যে সন্দেহ এবং তা থেকে সংকট, তা কিন্তু একই অবস্থায় সম্রাট সুজোকোর মধ্যে নেই, সম্রাট ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, পিতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে গেঞ্জিকে সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করেছেন। অবৈধ সন্তান বলে তার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি হয়নি।
ব্যাপারটা নিয়ে একদিন ঋদ্ধরমণী খ্যাত সেনশি মুরাসাকিকে প্রশ্ন করলেন। মুরাসাকি বললেন, মনোগাতারিতে চারশ’র বেশি চরিত্র রয়েছে। মানব চরিত্রের বহুরকম প্রবৃত্তি ধরার চেষ্টা করেছি চরিত্রগুলোয়। বহুমাত্রিকতা আমার উদ্দিষ্ট লক্ষ্য।
সবগুলোই কি তুমি বাস্তবে দেখেছ?
অনেকগুলোর সঙ্গে এই সম্রাটের প্রাসাদ এবং সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীদের দরবারে পরিচয় হয়েছে। কিছু কিছু বাস্তব এবং কল্পনায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে, কিছু কিছু এসেছে আমার পঠিত মনোগাতারিগুলোর আদলে। চীনা সাহিত্যের গীতিকাগুলোর কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লেখার সময় মনে ছিল, বিশেষ করে বায়বীয় গীতিকাগুলো।
আমরা তো পড়েই যাচ্ছি তাকাকু, তোমার দৃষ্টি কত গভীরে তোমার সঙ্গে কথা না বললে বুঝবার উপায় ছিল না।
শুনে মুরাসাকি হাসলেন।
সেনশি আবার বললেন, যুগের শ্রেষ্ঠ রচনা। লিখে যাও। উপভোগ্য করে তোলো। তার পরের পরিকল্পনা কি?
পঁয়তাল্লিশ অধ্যায় থেকে উজির পটভূমিতে যাবে কাহিনী।
উজি?
হ্যাঁ, তাই।
আমার মনে হয় বৈচিত্র্যপূর্ণ হবে ব্যাপারটা। লেখায় ইচিঝেন আসাতে অসাধারণ লেগেছে মানব প্রবৃত্তির সঙ্গে প্রকৃতির মেলবন্ধন।
ইচিঝেন আসলেই সুন্দর।
উজিও প্রাকৃতিকভাবে খুবই সুন্দর। সেখানকার জীবনমানে আভিজাত্য আছে।
চেষ্টা করবো তা ফুটিয়ে তোলার জন্য।
সে প্রত্যাশায় রইলাম আমরা। আমার এখানে হেইয়ানকিয়োর যেসব ভদ্রলোকেরা আসেন, তারাও তোমার লেখা নিয়ে মত বিনিময় করেন। সবাই জ্ঞানী ব্যক্তি তারা। সবচেয়ে ভালো দিক হলো তাদের ভেতর তোমার একটা ভালো অবস্থান তৈরি হয়েছে।
এবারও শুনে হাসলেন মুরাসাকি। সমগ্র প্রাসাদের মধ্যে এখানে তাঁর জন্য রাজকীয় পাথরচাপা ভাবটা নেই। তাই সেনশির সান্নিধ্য এবং আলোচনাগুলো বেশ উপভোগ করেন। অন্য লেডিরা তার কাছে যেতে সাহসই পান না।
মুরাসাকি আসার সময় সেনশি বললেন, এই কিমোনোটা তোমার জন্য। পছন্দ হয়েছে? তুমি লেখক, অভিজাত পোষকেই হবে তোমার ভূষণ।
বাবা তামেতোকি প্রাসাদে গিয়েছিলেন। সেখানে গেঞ্জি মনোগাতারির প্রশংসা শুনে এসেছেন। নিজের চাইতে সন্তানেরও প্রশাংসা যেন আরো বেশি সুখবর। টেরামাচি লেনের বাড়িতে এসে গর্ব করে বলছিলেন ছেলে নোবুতারিকে।
নোবুনোরি প্রাসাদে একটা ছোট চাকরি করে। বাবা তার ওপর সন্তুষ্ট নন। অনেক প্রত্যাশা ছিল। হলো না। আগে বলতেন এখন আর বলেন না। নোবুনোরি মুরাসাকির স্বামীর থেকে পাওয়া বিশাল সম্পত্তির দেখভালোও করে। অন্যদের সঙ্গে মুরাসাকির প্রশংসা শুনে শুনে নিজের মধ্যে হীনমন্যতা সৃষ্টি হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। আজ অবশ্য কিছু বলল না।
লেখক পরিবারে তার জন্ম। বইপুস্তকও তেমন পড়ে না। কবিতা লেখা তার বংশের ধারবাহিক ঐতিহ্য হলেও এসবে তার উৎসাহ নেই। আসলে তার জীবনে ব্যর্থতার সুতিকাগার হচ্ছে চীনা ধ্রুপদী ভাষা শিক্ষার কসরত থেকে সবকিছুতে নিরুৎসাহী হয়ে ওঠা। প্রায় সময়ই তাকে চুপচাপ দমমেরে বসে থাকতে দেখা যায়। বন্ধুবান্ধবও তেমন একটা নেই। নারী বন্ধু তো নয়ই। বিয়ে করতেও চায় না। বাবা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন আর বলেন না।
মুরাসাকি এ ব্যাপারে বাবাকে বুঝিয়েছেন। বড় বোনটা মারা গেছে। বাবার মন তাতেও খারাপ হয়েছে, বেশি মন খারাপ হয়েছে মুরাসাকির বৈধব্যে। স্বামী মারা যাবার পর অন্যেরা বিয়ে করে। মুরাসাকি আর বিয়ে করলেন না। তার সারাটা জীবন পড়ে আছে। বাবার জন্য তা যে কত ব্যথার কেউ তা বুঝল না। নিজের স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ কবছর আগে। নিজেও আর দ্বারপরিগ্রহ করেননি। তার জীবনটা আর দশ জনের মত না। চার বছরের জন্য ইচিঝেন গিয়েছিলেন, সাত বছর হয়ে গেছে আসেন না। কোথায় আসবেন? সেখানেই ভালো আছেন, একা আছেন, কাজে মশগুল হয়ে ডুবে থাকেন, বাকি সময় কাটে সাহিত্য নিয়ে। জীবনের শেষ সময়টা যেন ভাগ্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন, করেছেন আত্মসমর্পণও। তাকে কী সাফল্য বলা যায়? তার মনে এরকম অনেক প্রশ্ন জাগে।
এদিকে রাজধানী কিয়োটোতে রাজপ্রাসাদের ভেতরে বাইরে অভিজাত মানুষদের ব্যস্ততা, প্রতিযোগিতা, পোষাকের বাহাদুরী, চাকচিক্যপূর্ণ জীবনযাপন চারদিকে উজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে। সম্রাটের অমাত্য আর যারা প্রাসাদের বাসিন্দা এরা নিজেরা আভিজাত্য এবং চিন্তাভাবনায় উচ্চতর অবস্থান ধরে রাখার জন্য অথবা ওপরে ওঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এসবের পরিচয় পাওয়া যায় তাদের দামি পোশাক, পোশাকের রঙ, পোশাকের কারুকার্য, পোশাকে অঙ্কন শিল্পের অলংকরণ, দরবারের আবহ ও ঋতুবৈচিত্র্যের দিকে লক্ষ্য রেখে পোশাক নির্বাচন, সুগন্ধি ব্যবহার, সাজসজ্জাকরণ, কবিত্ব কিংবা সাহিত্যিক মনোভাবে। এসব রুচি ও আভিজাত্যবোধের পরিচায়ক। অভিজাত ও রুচিশীল নারীদের সৌন্দর্য নির্ণয়ের মাপকাঠি হচ্ছে মাটি স্পর্শ করা লম্বাচুল, গায়ের চামড়া কতটা সাদাটে ও উজ্জ্বল, মুখে কতটা ফর্সা দেখায়, তিনি লাস্যময়ী কিনা, ভালোবাসতে পারেন কিনা, তার প্রেমিক কোন অভিজাত অমাত্য, প্রিন্স হলে তো কথাই নেই, তিনি কবিতা এবং ডায়েরি লেখেন কিনা- এসব।
এসব ক্ষেত্রে কোনো অবস্থায়ই পিছিয়ে পড়া চলবেনা। নিত্য-নতুনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। না হয় গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে, ছিটকে পড়তে হবে প্রতিদিনকার অভিজাত জীবন থেকে। তখন কেউ তাকে মর্যাদা তো দেবেই না, কেমন আছো জিজ্ঞেসও করবে না।
আভিজাত্যের এই দৌড়ে তামেতোকির ছেলে মেয়ে কেউই নেই, এই কষ্ট তার মনে। অথচ তাদের সম্পদের অভাব নেই। তাকাকু লিখে নাম করছে, সম্রাজ্ঞীর লেডি-ইন-ওয়েটিং, কিন্তু অন্যদের মত আভিজাত্যের দৌড়ে নেই। অতিসাধারণ জীবন যাপন।
বাবা অবশ্য জানেন না তাকাকু (মুরাসাকি) এই সাধারণ থেকেই কারো কারো মন জয় করেছেন। মিচিনাগা তাদের মধ্যে অন্যতম। বিজ্ঞজনদের ধারণা মুরাসাকি শোনাগনের মত লোক দেখানো জাঁকজমকপূর্ণ কিংবা প্রণয় বিলাসী, এমনকি মুখরাও নন, নম্র এবং ভদ্র। এই ভাবমূর্তিটাই মিচিনাগা পছন্দ করেন।
তাদের মধ্যে এখন পত্রকবিতা বিনিময় হয়। মুরাসাকি কি কোনো রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িত হয়ে গেছেন? তার চেয়েও বড় কথা মিচিনাগার মনোভাবটা কী।
এ ব্যাপারে মুরাসাকি সচেতন। মিচিনাগা কবিতা লিখে পাঠালে তার জবাব না দিয়ে, টেকা মুস্কিল। কবিতার প্রত্যুত্তরে কবিতা লেখাও দোষের কিছু নয়, উদ্দেশ্যটাই মুখ্য। মুরাসাকি মিচিনাগাকে এড়িয়ে চলেন এবং নিজেকে রক্ষা করে চলার সামর্থ্য তার রয়েছে।
বাবারও এ বিশ্বাসে কোনো ঘাটতি নেই। তিনি মিচিনাগার প্রশ্নে মুরাসাকির অবস্থান জানলে হয়ত আরো আস্থাশীল হতেন এবং আভিজাত্যের মেকি প্রতিযোগিতায় তার না থাকায় স্বস্তিবোধ করতেন। তামেতোকি ভুলে গেলেও মুরাসাকি ভুলে যাননি তার পরিবারের দীর্ঘ ঐতিহ্যের কথা- যারা বিনয়ী এবং ভদ্র হিসেবে চলেছেন, গৌরবের অধিকারী হয়েছেন। পারিবারিক ঐতিহ্যের এই দিকটা তাকে বেপরোয়া, উদ্ধত, অহংকারী, কলহপ্রবণ, বদমেজাজী এবং প্রণয়বিলাসী হতে দেয়নি। দেয়নি অন্যদের মত মুখরা স্বভাবের হতেও। এতে তাকে সম্রাটের প্রাসাদে অনবরত নিদারুন যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে।
ইমন সবচেয়ে ভালো বলেন। সেদিন তর্ক করে সেই শোনাগনকেই বলেছিলেন তাকাকু সোজা কথার মানুষ, স্পষ্ট কথা বলে। অথচ তাতেই বিনয় এবং নম্রতার প্রকাশ ঘটে। অন্য কবিদের তুলনায় সে অনেক বেশি শান্ত। শান্ত মানুষদের স্বভাব হচ্ছে এই, তারা আত্মাভিমানী হয়, অন্যদের সঙ্গে আপোষ করে না, বাগ মানে না।
লেডি সানুকি বললেন, তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব তার, অহংকারে পা পড়ে না।
তাচ্ছিল্য সে করবে না কখনো, অহংকার যদি করেও থাকে, সে যোগ্যতা তার আছে। কিন্তু অন্যের মধ্যে তা দেখেছি তাকাকুর মধ্যে নয়, সে একটু রিজার্ভ এই যা।
লেডি সেই শোনাগনের সঙ্গেও এই রিজার্ভ থাকা?
কেন? তাকে তো সম্মানই করে আমি যতটুকু দেখেছি। কী বল শোনাগন?
তাকে দেখে তো তা মনে হয় না। মনে হয় সে সান্নিধ্যের অতীত।
সমস্যাটা অন্য জায়গায়, তা ইমন ভালোভাবেই জানেন। বললেন, সবাই একরকম হবে এমন তো কথা নেই।
আপনি যাই বলুন সে কাঁটাযুক্ত।
শোনাগনের কথায়, একবার মনে হয় বলেন যে, তা তোমার গল্পের কাটা নয় তো? বললেন না। তিনি তার ভাবমূর্তি রক্ষা করে বললেন, এত কিছু দেখলে চলে না। কাউকে সবার করে নিতে হলে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হয়।
সানুকি বললেন, সে পরে এসেছে, তাকেই অন্য সকলের কাছে যেতে হবে সকল অহংকার ত্যাগ করে।
প্রবাদ আছে- ‘আপনি আচরি অন্যকে শেখাও’।
ইমনের কথায় এরা তর্ক বন্ধ করল। ক্রমশ...
ধারাবাহিক উপন্যাস : ছাব্বিশ
আবুল কাসেম
শনিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২১
(পূর্ব প্রকাশের পর)
অতসুমিচি ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠলেন তাকে দেখে। কাঁপা কণ্ঠে বললেন, তুমি এখানে?
হ্যাঁ আমি। খুব জরুরি কথা আছে।
বল।
ব্যাপারটা গোপনীয়।
দরবার থেকে খাস কামরায় গেলেন এরা।
সব শুনে প্রিন্স অসুমিচি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বললেন, তোমাকে এ সংবাদ কে দিল?
যে-ই দিক, আপনি নিজে খোঁজখবর নিন।
আচ্ছা। তুমি তাহলে এসো। আর এভাবে হুটহাট করে এসো না। প্রিন্সেস ঝামেলা করছে। এখান পর্যন্ত এসেছ শুনলে খুবই সমস্যা হবে।
আপনি বউকে ভয় করছেন?
বউকে সবাই ভয় করে, তোমাদের শক্তিমান সম্রাটও।
আপনি তো আমাকে ভয় পান না।
প্রিন্স বলতে যাচ্ছিলেন, তুমি তো আমার স্ত্রী না, বললেন না। বললেন, তোমাকে আমি ভালোবাসি ভয় পাব কেন?
ইঝোমি মনে মনে বললেন, জানি কত ভালো বাসেন। মুখে বললেন, যদি সম্রাট বানিয়ে দিই বউ করবেন তো, মানে সম্রাজ্ঞী?
তুমি?
কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?
তোমার ক্ষমতা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
কথা দিন, তারপর দেখুন। তবে আপনাকে বর্তমান সম্রাটের মৃত্যু বা সাম্রাজ্য পরিচালনায় অক্ষম না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
কেন? তুমি কি এই সম্রাটকেও ভালোবাসো?
আপনার বাবার সঙ্গে মিচিনাগার এরকমই কথা হয়েছে।
আচ্ছা, খোঁজখবর নিয়ে দেখি।
আপনি কিন্তু কথা দেননি।
সেটা তো সম্রাটের মৃত্যুর পর। তিনি এখনো যথেষ্ট তরুণ। আমি প্রায়ই তার দরবারে যাই মজা করতে।
তা আমি জানি। একজন সম্রাটের মৃত্যু যে কোনো সময় হতে পারে। এমনকি আজও।
আজও? এতে অবাক হবার কিছু নেই। প্রত্যেক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ঘাঁটিও। যে কোন সময় গণেশ উল্টাতে পারে।
আমি যতদূর জানি এখনো সে সম্ভাবনা নেই।
আপনি উচ্চাভিলাষী নন। যথেষ্ট উদাসীন।
কথাটা সত্য। তিনি ভোগপ্রবণ মানুষ। ভোগচিন্তা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা তার মাথায় নেই। সম্রাট হওয়ার উচ্চাভিলাষ নির্ঝঞ্ঝাট নয়। এ জন্য তার নিস্পৃহতা। এক সময় স্বপ্ন ছিল। এখন সব ছেড়ে ভোগে মত্ত। যার জন্য স্ত্রীকেও ভয়।
প্রিন্স বললেন, অনেক সময় হয়ে গেছে, তুমি এখন এসো।
এসেই যখন পড়েছি, প্রিন্সেস তা জানবেন। শাস্তি যা দেয়ার দেবেন। এখন আসুন। অন্তরবাসিনী, অঙ্কশাহিনী তো প্রদেশে পার হয়ে চলে গেছে। আসুন।
এখানে? এর জন্য নির্ধারিত স্থান আছে নাকি?
অতসুমিচি ইঝোমিকে যাই বলুন না কেন, বাবা রেইঝেইকে কথাটা সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন।
বাবা তাকে চারিত্রিকস্খলতার কারণে খুব একটা পছন্দ করেন না। তবুও তাকে আজ খাটো করে দেখলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি একথা কোথায় শুনলে?
বাবা, কোথায় শুনেছি তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কী শুনেছি তাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যা শুনেছ সত্য। ও তোমার বড় ভাই। তার অধিকার আগে।
তা মানলাম। কিন্তু তার অবর্তমানে আমি নই কেন?
কারণ সম্রাট ইচিজোর এক পুত্র রয়েছে।
এ ব্যাপারটা যদি এমনই হয়, তাহলে বড় ভাই নয়, আমিই সিংহাসন চাই।
সানজুর অধিকার মেনে নেয়ার পর তোমার মুখে একথা মানায়? মানায় না। সানজু বেঁচে থাকলে সেই সম্রাট হবে।
এটা আপনার শেষ কথা হতে পারে না।
তুমি এখন এসো। আমাকে কাজ করতে দাও।
রেইঝেই অত্যন্ত ধৈর্যশীল এবং বিচক্ষণ প্রকৃতির মানুষ। তার ব্যক্তিত্বের কাছে সবাই নতজানু। তার এই পুত্র এভাবে কথা বলবে ভাবতে পারেননি। ব্যাপারটাকে তিনি হালকাভাবে নিচ্ছেন না। ভাবলেন, ব্যাপারটা বেশ দূর গড়িয়েছে। তা নিয়ে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। না হয় যে কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে।
চুয়াল্লিশ.
লেখার দেবতা যেন হঠাৎ করেই মুরাসাকিকে সাক্ষাৎ দিলেন। তিনি আবার লিখতে শুরুকরলেন। বিয়াল্লিশতম অধ্যায়।
হিকারুগেঞ্জির মৃত্যু হয়েছে। এই আবেগাচ্ছন্ন করিৎকর্মা মানুষটি অনেক অকর্ম করে বিদায় নিয়েছে। তার বিদায়ে সাম্রাজ্যজুড়ে শোক। কারণ সম্রাট তার পুত্র। তবে অনেকেই যেমন শোকগ্রস্থ নয়, তেমনি গুনবান ব্যক্তিদের যারা প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের মধ্যে কেউই গেঞ্জির উৎকৃষ্টগুণের অনেকগুলোর সঙ্গেই একমত না বা মানিয়ে নিতে পারছেন না। তাদের মধ্যে রয়েছে নাইয়ো, কাওরো এবং তৃতীয় রাজকুমারী। যদিও সারা দুনিয়া বিশ্বাস করে কাওরো গেঞ্জির পুত্র, কাওরোর তাতে সন্দেহ রয়েছে। এ নিয়ে সে সমস্যায়ই আছে। সে এ জীবন ত্যাগ করে বৌদ্ধ ভিক্ষু হতে চায় (সংক্ষেপিত)।
লেখার এই অগ্রগতিতে উৎফুল্ল মুরাসাকি। আবার যেন জীবন ফিরে পেয়েছেন। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে কাওরোর জন্ম সন্দেহ তার জীবনযাপনে এক মনস্তাত্ত্বিক সংকটের সৃষ্টি করে। সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। গেঞ্জিকে মনে করা হয় বিশ্বের আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসেরও প্রতিভূ। গেঞ্জির ভোগাকাক্সক্ষা এবং দুর্ভোগের মধ্যে তা যেমন স্পষ্ট, তেমনি স্পষ্ট ভুল জন্মের কাওরোর মধ্যেও। কাওরো যেন তার অবৈধ জন্মকে মেনে নিতে পারছে না। মনস্তাত্ত্বিকভাবে সে নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। বাস্তব জীবনে ইচ্ছার নানা ব্যত্যয় সেই সমস্যায় ঘৃতাহুতি দিয়েছে। তবে মুরাসাকির শক্তিশালী লেখনিতে তা এতটা শিল্পায়িত যে, গ্রিক মিথের সে বংশ পরম্পরা পাপের শাস্তির অনিবার্যতা, এখানে তা মুখ্য নয়। প্রাচ্যে একথা তো প্রচলিত যে, পিতার অপরাধে পুত্র কেন শাস্তি ভোগ করবে। তাই উঁচুদরের একটা ট্র্যাজেডি রচনার সুযোগ পেয়েও মুরাসাকি তা হাতছাড়া করছেন।
কাওরোর মধ্যে যে সন্দেহ এবং তা থেকে সংকট, তা কিন্তু একই অবস্থায় সম্রাট সুজোকোর মধ্যে নেই, সম্রাট ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, পিতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে গেঞ্জিকে সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করেছেন। অবৈধ সন্তান বলে তার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি হয়নি।
ব্যাপারটা নিয়ে একদিন ঋদ্ধরমণী খ্যাত সেনশি মুরাসাকিকে প্রশ্ন করলেন। মুরাসাকি বললেন, মনোগাতারিতে চারশ’র বেশি চরিত্র রয়েছে। মানব চরিত্রের বহুরকম প্রবৃত্তি ধরার চেষ্টা করেছি চরিত্রগুলোয়। বহুমাত্রিকতা আমার উদ্দিষ্ট লক্ষ্য।
সবগুলোই কি তুমি বাস্তবে দেখেছ?
অনেকগুলোর সঙ্গে এই সম্রাটের প্রাসাদ এবং সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীদের দরবারে পরিচয় হয়েছে। কিছু কিছু বাস্তব এবং কল্পনায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে, কিছু কিছু এসেছে আমার পঠিত মনোগাতারিগুলোর আদলে। চীনা সাহিত্যের গীতিকাগুলোর কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লেখার সময় মনে ছিল, বিশেষ করে বায়বীয় গীতিকাগুলো।
আমরা তো পড়েই যাচ্ছি তাকাকু, তোমার দৃষ্টি কত গভীরে তোমার সঙ্গে কথা না বললে বুঝবার উপায় ছিল না।
শুনে মুরাসাকি হাসলেন।
সেনশি আবার বললেন, যুগের শ্রেষ্ঠ রচনা। লিখে যাও। উপভোগ্য করে তোলো। তার পরের পরিকল্পনা কি?
পঁয়তাল্লিশ অধ্যায় থেকে উজির পটভূমিতে যাবে কাহিনী।
উজি?
হ্যাঁ, তাই।
আমার মনে হয় বৈচিত্র্যপূর্ণ হবে ব্যাপারটা। লেখায় ইচিঝেন আসাতে অসাধারণ লেগেছে মানব প্রবৃত্তির সঙ্গে প্রকৃতির মেলবন্ধন।
ইচিঝেন আসলেই সুন্দর।
উজিও প্রাকৃতিকভাবে খুবই সুন্দর। সেখানকার জীবনমানে আভিজাত্য আছে।
চেষ্টা করবো তা ফুটিয়ে তোলার জন্য।
সে প্রত্যাশায় রইলাম আমরা। আমার এখানে হেইয়ানকিয়োর যেসব ভদ্রলোকেরা আসেন, তারাও তোমার লেখা নিয়ে মত বিনিময় করেন। সবাই জ্ঞানী ব্যক্তি তারা। সবচেয়ে ভালো দিক হলো তাদের ভেতর তোমার একটা ভালো অবস্থান তৈরি হয়েছে।
এবারও শুনে হাসলেন মুরাসাকি। সমগ্র প্রাসাদের মধ্যে এখানে তাঁর জন্য রাজকীয় পাথরচাপা ভাবটা নেই। তাই সেনশির সান্নিধ্য এবং আলোচনাগুলো বেশ উপভোগ করেন। অন্য লেডিরা তার কাছে যেতে সাহসই পান না।
মুরাসাকি আসার সময় সেনশি বললেন, এই কিমোনোটা তোমার জন্য। পছন্দ হয়েছে? তুমি লেখক, অভিজাত পোষকেই হবে তোমার ভূষণ।
বাবা তামেতোকি প্রাসাদে গিয়েছিলেন। সেখানে গেঞ্জি মনোগাতারির প্রশংসা শুনে এসেছেন। নিজের চাইতে সন্তানেরও প্রশাংসা যেন আরো বেশি সুখবর। টেরামাচি লেনের বাড়িতে এসে গর্ব করে বলছিলেন ছেলে নোবুতারিকে।
নোবুনোরি প্রাসাদে একটা ছোট চাকরি করে। বাবা তার ওপর সন্তুষ্ট নন। অনেক প্রত্যাশা ছিল। হলো না। আগে বলতেন এখন আর বলেন না। নোবুনোরি মুরাসাকির স্বামীর থেকে পাওয়া বিশাল সম্পত্তির দেখভালোও করে। অন্যদের সঙ্গে মুরাসাকির প্রশংসা শুনে শুনে নিজের মধ্যে হীনমন্যতা সৃষ্টি হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। আজ অবশ্য কিছু বলল না।
লেখক পরিবারে তার জন্ম। বইপুস্তকও তেমন পড়ে না। কবিতা লেখা তার বংশের ধারবাহিক ঐতিহ্য হলেও এসবে তার উৎসাহ নেই। আসলে তার জীবনে ব্যর্থতার সুতিকাগার হচ্ছে চীনা ধ্রুপদী ভাষা শিক্ষার কসরত থেকে সবকিছুতে নিরুৎসাহী হয়ে ওঠা। প্রায় সময়ই তাকে চুপচাপ দমমেরে বসে থাকতে দেখা যায়। বন্ধুবান্ধবও তেমন একটা নেই। নারী বন্ধু তো নয়ই। বিয়ে করতেও চায় না। বাবা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন আর বলেন না।
মুরাসাকি এ ব্যাপারে বাবাকে বুঝিয়েছেন। বড় বোনটা মারা গেছে। বাবার মন তাতেও খারাপ হয়েছে, বেশি মন খারাপ হয়েছে মুরাসাকির বৈধব্যে। স্বামী মারা যাবার পর অন্যেরা বিয়ে করে। মুরাসাকি আর বিয়ে করলেন না। তার সারাটা জীবন পড়ে আছে। বাবার জন্য তা যে কত ব্যথার কেউ তা বুঝল না। নিজের স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ কবছর আগে। নিজেও আর দ্বারপরিগ্রহ করেননি। তার জীবনটা আর দশ জনের মত না। চার বছরের জন্য ইচিঝেন গিয়েছিলেন, সাত বছর হয়ে গেছে আসেন না। কোথায় আসবেন? সেখানেই ভালো আছেন, একা আছেন, কাজে মশগুল হয়ে ডুবে থাকেন, বাকি সময় কাটে সাহিত্য নিয়ে। জীবনের শেষ সময়টা যেন ভাগ্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন, করেছেন আত্মসমর্পণও। তাকে কী সাফল্য বলা যায়? তার মনে এরকম অনেক প্রশ্ন জাগে।
এদিকে রাজধানী কিয়োটোতে রাজপ্রাসাদের ভেতরে বাইরে অভিজাত মানুষদের ব্যস্ততা, প্রতিযোগিতা, পোষাকের বাহাদুরী, চাকচিক্যপূর্ণ জীবনযাপন চারদিকে উজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে। সম্রাটের অমাত্য আর যারা প্রাসাদের বাসিন্দা এরা নিজেরা আভিজাত্য এবং চিন্তাভাবনায় উচ্চতর অবস্থান ধরে রাখার জন্য অথবা ওপরে ওঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এসবের পরিচয় পাওয়া যায় তাদের দামি পোশাক, পোশাকের রঙ, পোশাকের কারুকার্য, পোশাকে অঙ্কন শিল্পের অলংকরণ, দরবারের আবহ ও ঋতুবৈচিত্র্যের দিকে লক্ষ্য রেখে পোশাক নির্বাচন, সুগন্ধি ব্যবহার, সাজসজ্জাকরণ, কবিত্ব কিংবা সাহিত্যিক মনোভাবে। এসব রুচি ও আভিজাত্যবোধের পরিচায়ক। অভিজাত ও রুচিশীল নারীদের সৌন্দর্য নির্ণয়ের মাপকাঠি হচ্ছে মাটি স্পর্শ করা লম্বাচুল, গায়ের চামড়া কতটা সাদাটে ও উজ্জ্বল, মুখে কতটা ফর্সা দেখায়, তিনি লাস্যময়ী কিনা, ভালোবাসতে পারেন কিনা, তার প্রেমিক কোন অভিজাত অমাত্য, প্রিন্স হলে তো কথাই নেই, তিনি কবিতা এবং ডায়েরি লেখেন কিনা- এসব।
এসব ক্ষেত্রে কোনো অবস্থায়ই পিছিয়ে পড়া চলবেনা। নিত্য-নতুনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। না হয় গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে, ছিটকে পড়তে হবে প্রতিদিনকার অভিজাত জীবন থেকে। তখন কেউ তাকে মর্যাদা তো দেবেই না, কেমন আছো জিজ্ঞেসও করবে না।
আভিজাত্যের এই দৌড়ে তামেতোকির ছেলে মেয়ে কেউই নেই, এই কষ্ট তার মনে। অথচ তাদের সম্পদের অভাব নেই। তাকাকু লিখে নাম করছে, সম্রাজ্ঞীর লেডি-ইন-ওয়েটিং, কিন্তু অন্যদের মত আভিজাত্যের দৌড়ে নেই। অতিসাধারণ জীবন যাপন।
বাবা অবশ্য জানেন না তাকাকু (মুরাসাকি) এই সাধারণ থেকেই কারো কারো মন জয় করেছেন। মিচিনাগা তাদের মধ্যে অন্যতম। বিজ্ঞজনদের ধারণা মুরাসাকি শোনাগনের মত লোক দেখানো জাঁকজমকপূর্ণ কিংবা প্রণয় বিলাসী, এমনকি মুখরাও নন, নম্র এবং ভদ্র। এই ভাবমূর্তিটাই মিচিনাগা পছন্দ করেন।
তাদের মধ্যে এখন পত্রকবিতা বিনিময় হয়। মুরাসাকি কি কোনো রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িত হয়ে গেছেন? তার চেয়েও বড় কথা মিচিনাগার মনোভাবটা কী।
এ ব্যাপারে মুরাসাকি সচেতন। মিচিনাগা কবিতা লিখে পাঠালে তার জবাব না দিয়ে, টেকা মুস্কিল। কবিতার প্রত্যুত্তরে কবিতা লেখাও দোষের কিছু নয়, উদ্দেশ্যটাই মুখ্য। মুরাসাকি মিচিনাগাকে এড়িয়ে চলেন এবং নিজেকে রক্ষা করে চলার সামর্থ্য তার রয়েছে।
বাবারও এ বিশ্বাসে কোনো ঘাটতি নেই। তিনি মিচিনাগার প্রশ্নে মুরাসাকির অবস্থান জানলে হয়ত আরো আস্থাশীল হতেন এবং আভিজাত্যের মেকি প্রতিযোগিতায় তার না থাকায় স্বস্তিবোধ করতেন। তামেতোকি ভুলে গেলেও মুরাসাকি ভুলে যাননি তার পরিবারের দীর্ঘ ঐতিহ্যের কথা- যারা বিনয়ী এবং ভদ্র হিসেবে চলেছেন, গৌরবের অধিকারী হয়েছেন। পারিবারিক ঐতিহ্যের এই দিকটা তাকে বেপরোয়া, উদ্ধত, অহংকারী, কলহপ্রবণ, বদমেজাজী এবং প্রণয়বিলাসী হতে দেয়নি। দেয়নি অন্যদের মত মুখরা স্বভাবের হতেও। এতে তাকে সম্রাটের প্রাসাদে অনবরত নিদারুন যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে।
ইমন সবচেয়ে ভালো বলেন। সেদিন তর্ক করে সেই শোনাগনকেই বলেছিলেন তাকাকু সোজা কথার মানুষ, স্পষ্ট কথা বলে। অথচ তাতেই বিনয় এবং নম্রতার প্রকাশ ঘটে। অন্য কবিদের তুলনায় সে অনেক বেশি শান্ত। শান্ত মানুষদের স্বভাব হচ্ছে এই, তারা আত্মাভিমানী হয়, অন্যদের সঙ্গে আপোষ করে না, বাগ মানে না।
লেডি সানুকি বললেন, তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব তার, অহংকারে পা পড়ে না।
তাচ্ছিল্য সে করবে না কখনো, অহংকার যদি করেও থাকে, সে যোগ্যতা তার আছে। কিন্তু অন্যের মধ্যে তা দেখেছি তাকাকুর মধ্যে নয়, সে একটু রিজার্ভ এই যা।
লেডি সেই শোনাগনের সঙ্গেও এই রিজার্ভ থাকা?
কেন? তাকে তো সম্মানই করে আমি যতটুকু দেখেছি। কী বল শোনাগন?
তাকে দেখে তো তা মনে হয় না। মনে হয় সে সান্নিধ্যের অতীত।
সমস্যাটা অন্য জায়গায়, তা ইমন ভালোভাবেই জানেন। বললেন, সবাই একরকম হবে এমন তো কথা নেই।
আপনি যাই বলুন সে কাঁটাযুক্ত।
শোনাগনের কথায়, একবার মনে হয় বলেন যে, তা তোমার গল্পের কাটা নয় তো? বললেন না। তিনি তার ভাবমূর্তি রক্ষা করে বললেন, এত কিছু দেখলে চলে না। কাউকে সবার করে নিতে হলে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হয়।
সানুকি বললেন, সে পরে এসেছে, তাকেই অন্য সকলের কাছে যেতে হবে সকল অহংকার ত্যাগ করে।
প্রবাদ আছে- ‘আপনি আচরি অন্যকে শেখাও’।
ইমনের কথায় এরা তর্ক বন্ধ করল। ক্রমশ...