alt

সাময়িকী

আবুল হাসানের কবিতা

স্থির, দিঘল-দীর্ঘশ্বাস

এমরান হাসান

: শনিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২১

গত শতকের ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতায় এক অনিবার্য গতিধারা পরিলক্ষিত হয়। স্পষ্টত বাংলাদেশের কবিতার সংসারে একঝাঁক অতৃপ্ত প্রাণের কোরাস প্রতিধ্বনি তোলে পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে, যার ফলে ষাটের দশককে বাংলাদেশের কবিতার বাঁকবদলের চিহ্ন বলা যায় যৌক্তিকতার সঙ্গেই। কেননা রাজনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অস্থিরতার বিশাল বিবর্তনপ্রত্যাশী যখন সমগ্র শ্রেণীর মানুষ, ঠিক সেসব চিন্তাচেতনা থেকেই ষাটের কবিরা নির্মাণ করতে শুরুকরেছিলেন তাদের কবিতা। স্যাড জেনারেশন কিংবা কণ্ঠস্বর (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স¤পাদিত লিটলম্যাগ) থেকেই শুধু নয়, গোটা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের লেখক-কবিরাও স্বপ্ন দেখতে শুরুকরেন একটি নতুন ভূমি, নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার এবং সে সঙ্গে সাহিত্যের নতুন প্লাটফর্মের। এ দশকে রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, বুলবুল খান মাহবুব, আসাদ চৌধুরী প্রমুখের কবিতায় যখন উঠে আসছিল অস্থির স্বপ্নচেতনা, ঠিক তেমন সময়েই পবিত্র নির্জনতার খোলসাবৃত হয়ে নীরব বিপ্লবের মতোই ষাটের কবিতায় আসেন আবুল হাসান। মাত্র ২৯ বছর বয়সী এই কবি জীবনানন্দীয় চেতনার বলয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ভাবধারায় নির্মাণ করেছেন তার কবিতা।

মাত্র তিনটি গ্রন্থের মাধ্যমেই তিনি বাংলা কবিতার দিকদর্শনকে টেনে নিয়ে যান অবিমিশ্র এক মহাধ্যানী আখড়ায়। তার কাব্যগ্রন্থ- রাজা যায় রাজা আসে (প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ১৯৭২), যে তুমি হরণ করো (১৯৭৪) এবং পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫)। সময়ের প্রয়োজনেই আবুল হাসান হয়ে ওঠেন অভিমানী পাথর। মায়াবী করুণ কিংবা একান্ত ঋদ্ধ শিল্পের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে তার কবিতায়। ‘রাজা যায় রাজা আসে’ কাব্যগ্রন্থ থেকেই তাঁর কাব্যশক্তি ঘুরেফিরে বেড়ে ওঠে।

এ গ্রন্থের ভেতর তিনি প্রকাশ করেছেন আদিগন্ত স্বপ্নফসিল আর যাপিত জীবনবোধের জ্যামিতিক অস্তিত্ব। এই গ্রন্থেও ‘আবুল হাসান’ শীর্ষক কবিতার এই অংশই তার প্রমাণ বহন করে- ‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র, মায়াবী করুণ’ আবার এই কবিতার শেষ তিন চরণে নিজের ভেতর নিজেই ছুঁড়েছেন অনির্বচনীয় দ্বিধা-

‘তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল,

কোনদিন ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বাম হাতে পাঁচটি আঙ্গুল?

বিমূর্তবাদ, পরাবাস্তব ঘরানায় আবুল হাসানের কবিতা নির্মিত না হলেও নিপাট বাস্তবতার অপরিসীম দ্যোতকতা রয়েছে তার কবিতায়। তার রচিত অধিকাংশ কবিতার পঙ্ক্তিই এই মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করে

ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল?’

(আবুল হাসান/রাজা যায় রাজা আসে)

আবুল হাসানের কবিতায় মানুষের জীবনযাত্রা, দৈনন্দিন ঘর-গৃহস্থালি ইত্যাদির স্পষ্ট ছায়া পড়েছে। কেবল হাসি, আনন্দ, উল্লাসকে দূরে ঠেলে দিয়েও আবুল হাসানের কবিতায় খুঁজে পাওয়া সম্ভব মানুষের ছায়াচিত্র। কারণ তার কবিতায় দুঃখবোধ ও অতৃপ্তির পূর্ণতা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। বলা যায়, এক প্রকার সামাজিক ধ্যান-ধারণায় ডুবে না গিয়েও আবুল হাসান অকপটে সাজিয়েছেন শব্দের পর শব্দের দোলা, যা তার কবিতাকে সৌকর্যম-িত করেছে। একাকিত্ব আর চেতনার জগৎ থেকেই কবিতার শরীর নির্মাণ করেছেন তিনি। সহজিয়া ভাষার উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে তার কবিতায় তীব্র মজবুত গাঁথুনিতে উঠে এসেছে অদ্ভুত অনুভূতি ফুটে উঠেছে-

‘আমার ও বক্ষে একটি গর্ত প্রয়োজন! যার ফোকরের মধ্যে চালিয়ে চক্ষু

খোলা দরজার মতন মা মণি আমারই

সেই দূর থেকে দেখবেন, আমি দিনরাত

রেঁদা তুরপুন চালাচ্ছি কত তক্তায়-

(আর) সেলাই কলের সুতোর মতন কত হাত রক্ত নামিয়ে দিচ্ছি ভাগ্য বুননে’

(নিঃসন্দেহ গন্তব্য/রাজা যায় রাজা আসে)

আবুল হাসান শিল্পোত্তীর্ণ সময়ের নয়, সাময়িক বোধের সংস্পর্শেই তার কবিতায় নিয়ে এসেছেন পবিত্র চেতনার সংমিশ্রণ। কবিতার প্রয়োজনে সাবলীলতাই হয়তো তার প্রধান উপজীব্য ছিল, যার কারণে প্রতিটি মুহূর্তকেই ধারণ করেছেন তাঁর কবিতায়। প্রকাশিত তিনটি কাব্যগ্রন্থের বাইরেও যে কবিতাগুলো রয়ে গেছে, সেগুলোও বাংলাসাহিত্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।

একটি বিষয় আবুল হাসানের কবিতায় তীব্রভাবে ধরা পড়ে, সেটি চিত্রকল্প এবং সার্থক উপমার সঠিক ব্যবহার। উপমা, অলঙ্করণ বাংলা কবিতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটি সার্থক কবিতা হয়ে ওঠার জন্য উপমা এবং অলঙ্করণের প্রকাশ এবং তার সুষ্ঠু প্রয়োগ অবশ্যই জরুরি। বিমূর্তবাদ, পরাবাস্তব ঘরানায় আবুল হাসানের কবিতা নির্মিত না হলেও নিপাট বাস্তবতার অপরিসীম দ্যোতকতা রয়েছে তার কবিতায়। তার রচিত অধিকাংশ কবিতার পঙ্ক্তিই এই মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করে। সময়ের তাগিদ থেকে নয়, চেতনার কেন্দ্র থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এসব পঙ্ক্তিমালা।) তার কবিতায় সার্থক চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে ঋদ্ধ ভঙ্গিমায়।

অনেক কাব্যবোদ্ধাই এরকম মন্তব্য করেন যে, কবি তার চারপাশের নিত্য ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা সাংঘাতিকভাবে আক্রান্ত হন। এ মন্তব্যের সাথে আরেকটি বিষয় যুক্ত করলে বোধকরি ভুল হবে না যে, একজন প্রকৃত কবি তার চারপাশে যা কিছু ঘটে সেগুলোর পাশাপাশিই তিনি ঋদ্ধ হতে শুরুকরেন। কেবল কোনো একটি দেশ-সমাজ-সংস্কৃতিতেই আবদ্ধ থাকেন না কবি বরং আরো গভীরতর স্বভাবে সম্পৃক্ত হতে শুরুকরেন সেইসময় থেকে যে সময়ে তার চিন্তা এবং পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিরোধ একটা দুর্নিবার পরিস্থিতিতে গিয়ে চুপচাপ থেমে আসে। তিনি এইসব দায়ের ভেতর থেকেই তৈরি করেছেন তার অসামান্য একেকটি কবিতা। একজন কবিই জানেন তার অন্তর্নিহিত চিন্তাসত্তার আদি এবং অনন্ত অন্তিম পরিচয়। কেবল তার পক্ষেই জানা সম্ভব হয়ে ওঠে তার সামগ্রিক চিন্তা আর দর্শনের আদ্যপানন্ত। কবিতা সৃষ্টির প্রাক্কালে যাবতীয় দর্শনকে কবি আশ্রয় করেন কেবলি কী তার চিন্তার আয়োজন সম্পন্ন করতে নাকি আরো গভীরতর কোনো বোধের বিনির্মাণের তাগিদে? এরকম প্রশ্ন তার কবিতায় খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। তার কবিতায় আদিগন্ত যাপিত জীবনের মৌন এক ভয়াবহতা উন্মোচিত হয়েছে। আসলে কবি সব কিছুর পাশাপাশি তার কবিতায় দৈনন্দিন জীবন-অনুভূতিই তুলে ধরেন অনেক ক্ষেত্রেই। যদিও সবটাতেই এই প্রক্রিয়া সমানভাবে কাজ করে না। কবিতার ভেতরে কবি তার নিজস্ব ভাবনা বুননের পাশাপাশি তুলে আনেন সময় আর আনুষঙ্গিকতার বিরল চিত্রকল্প।

কবিতার ভেতর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে একেবারেই আড়াল করেননি আবুল হাসান। আসলে এটা সম্ভবও হয় না একজন কবির পক্ষে কারণ, কবি তার চারপাশের ঘটনাবলী এবং যাপিত জীবনাচারের ভেতরে ডুবেই তার কবিতা নির্মাণ করেন। যে সাহিত্যে তার চারপাশের প্রতিচ্ছবিই ফুটে ওঠে। আবুল হাসান এসবের ব্যতিক্রম নন, ব্যতিক্রম নয় তার কবিতার উঠোন। জীবনের প্রয়োজনে একজন কবিকেও বদলে যেতে হয হয়তো, তার সাথে বদলে যায় তার কবিতাযাপনের নানা উপাচার।

বাংলাদেশ তথা বাংলা কবিতায় ষাটের দশকের প্রেক্ষাপটে মুখ্য ছিল রাজনৈতিক চেতনা এবং সামগ্রিক অস্থিতিশীল পরিবেশ। আবুল হাসান তার বোধকে পুরোপুরি এই বলয় আর দায়বদ্ধতার বাইরে টেনে নিয়ে যেতে পারেননি। তার অধিকাংশ কবিতায় রাজনৈতিক আবহের ছায়া পড়েছে পরোক্ষভাবে। কোনো কোনো কবিতার চিত্রকল্প রূপকার্থে রাজনৈতিক ভাবধারামুখী হলেও মূলত মানবজীবনযাত্রাকেন্দ্রিক। কবিতার সপক্ষে আবুল হাসান আবহ সৃষ্টি করতে পেরেছেন নতুন আলোর ঠিকানা। যদিও সভ্যতার তীব্র ধ্বংসযজ্ঞেও তিনি বারবার গেয়ে উঠেছেন নৈঃশব্দ্যিক বিমূর্ত বেহালার সুর। আবার প্রেমের পঙ্ক্তিমালা রচনায়ও পুরোদমে সিদ্ধহস্ত তিনি। যথারীতি লৌকিক ভাববাদিতার সপক্ষেই তার অবস্থান। প্রেমের কাঙাল হিসেবে নয়, মুহূর্তের শূন্যতাকে আবুল হাসান প্রেমের ভাষায় নিয়ে যান এক দীর্ঘায়ু শূন্যতায়!-

‘তুমি নেমে গেলে এই বক্ষতলে কি সত্যিই ফুরোবে?

মুখের ভিতরে এই মলিন দাঁতের পঙ্ক্তি- তাহলে এ চোখ

মাথার খুলির নিচে নরম নির্জন এক অবিনাশী ফুল :

আমার আঙ্গুলগুলি, আমার আকাক্সক্ষাগুলি, অভিলাষগুলি?

জানি কিছু চিরকাল ভাস্বর উজ্জ্বল থাকে, চির অমলিন!

তুমি চলে গেলে তবু থাকবে আমার তুমি, চিরায়ত তুমি!

(অপরূপ বাগান/পৃথক পালঙ্ক)

আবার তার কবিতায় সহজিয়া চিত্রকল্পও লক্ষণীয় হয় শক্তিশালী ভিত্তির সঙ্গে। কবিতার পঙ্ক্তিতে আবুল হাসান সুবোধ্য এবং সাবলীলতার সঙ্গে নির্মাণ করেছেন কিছু কিছু চিত্রকল্প। কবিতার শরীর নির্মাণের জন্যই আবুল হাসান বারবার নতজানু হয়েছেন নির্জনতার কাছে, পবিত্র ¯িœগ্ধতার কাছে। তার প্রতিটি কবিতায়ই বিশদভাবে মুখ্য হয়েছে শুদ্ধতার বোধচিত্র। তার উপমেয়তা কিংবা শব্দের সাদৃশ্যতা প্রশ্নাতীত। কবিতার শরীর নির্মাণে এ বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। আবুল হাসান তার সার্থক ব্যবহার করেছেন। শব্দের মোহে নেশাগ্রস্ত বোধগুলো লিপিবদ্ধ হয়েছে তার কবিতায়। তার প্রকাশিত তিনটি কাব্যগ্রন্থের বাইরেও অগ্রন্থিত কবিতায়ও এসব উপমার সার্থক ব্যবহার রয়েছে। কবিতার ভেতরে একদিকে যেমন ভাবের সম্পৃক্ততা প্রবল, অন্যদিকে জীবন-চেতনা আর রূপকার্থে বোধব্যাপ্তির চৌম্বকত্বের ব্যবহার প্রবল। কবিতা যেন বাস্তবতার স্বপক্ষের সৌকর্য। আবুল হাসানের কবিতায় সম্পূরক সৌকর্য নিয়ে উঠে এসেছে গোপন বাস্তবতা।

আবুল হাসানের কবিতা সম্পর্কে শামসুর রাহমান একটি ভূমিকায় লিখেছেন- গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের মিলিত অভিজ্ঞতা তার কবিতাকে বর্ণাঢ্য, সমৃদ্ধ করেছে। তিনি নৈঃসঙ্গ এবং দীর্ঘশ্বাসের কবি। শামসুর রাহমানের উক্তির যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায় তার কবিতায়। তার কবিতায় একদিকে রয়েছে ভাসমান জীবনাচার, একাকিত্ব; অন্যদিকে রয়েছে বিরামহীন উচ্ছন্নতার প্রকাশ। কবিতার আড়ালে আবুল হাসান ছন্নছাড়া জীবনের স্থিরচিত্র আঁকতে গিয়ে জীবনের অন্তদর্শনের মানচিত্র এঁকেছেন সবল হাতে।

‘মাতৃভাষা’ শীর্ষক কবিতার দুটি অংশ থেকে খুব সহজেই দুই রকম দৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়-

‘ঐ যে নষ্ট গলি, নিশ্চুপ দরোজা ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা,

গণিকারা মধ্য রাতে উলঙ্গ শয্যায় ওরা কিসের ভাষায় কথা বলে

আবার, এই কবিতার শেষ অংশে ধরা পড়ে অন্য এক দৃশ্যকল্প-

শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা’

(মাতৃভাষা/রাজা যায় রাজা আসে)

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল এই কবিকে। তার বেশকিছু কবিতায় তীব্রভাবে প্রকাশ হয়েছে এসবের অন্তর্নিহিত বোধ। নিবিড় মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়েও আবুল হাসান নির্মাণ করেছেন ভিন্ন দৃষ্টির ছায়ায় লেপ্টে থাকা এমন কিছু কবিতা- যা বাংলাসাহিত্যের আঙিনাকে সমৃদ্ধ করেছে।

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বর্ণনাই শুধু নয়, আবুল হাসানের কবিতায় জেগে উঠেছে অনন্য এক চিত্রকল্পের প্রাজন্মিক ভাবনা, যেখানে মাতৃভাষা প্রকাশের উপমা পৃথক পরিবেশে বর্ণিত হয়েছে, নন্দিত হয়েছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিন্দিতও হয়েছে সময় আর সভ্যতার প্রয়োজনে।

মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতার চেতনায় অনুপ্রাণিত আবুল হাসান যেন অন্য মানুষ। মাতৃভাষার চেতনাকে রাজনৈতিক এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে দাঁড় করালেও স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা প্রকাশে তিনি আবেগ, উচ্ছ্বাসের কাছেই পরাজিত হয়েছেন বারবার-

‘কেবল পতাকা দেখি কেবল উৎসব দেখি স্বাধীনতা দেখি, তবে

কি আমার ভাই আজ ঐ স্বাধীন পতাকা?

তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?’

(উচ্চারণগুলি শোকের)

আবুল হাসানের চেতনায় স্বপ্নগুলো রাজহাঁস ও সারসপাখি। এসব স্বপ্ন আর স্বপ্ন¯পর্শ নিয়েই আবুল হাসান তার কবিতা নির্মাণ করেছেন, সাজিয়েছেন শব্দের পর শব্দ। কবিতার উঠোনে আবুল হাসান নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরপরই। তার কবিতার মূল উপজীব্য একাকিত্ব এবং একান্ত নৈঃশব্দ্যিক ওঙ্কার।

গত শতকের তিরিশের দশকের জীবনানন্দ দাশ যেমন নির্জনতার স্বপক্ষে থেকেই ঘটিয়েছিলেন বোধের বিস্ফোরণ, ষাটের আবুল হাসান ঠিক একই রকম করে দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে স্বপ্ন আর স্বপ্নচিন্তার ব্যবধান দেখিয়েছেন ঋদ্ধতার সঙ্গে। আবুল হাসানের কবিতায় মুহূর্তের উচ্ছ্বাস নেই, আছে শান্ত, স্থির, দিঘল দীর্ঘশ্বাস। গোপন স্বপ্নের মতন তীব্র নয়, প্রকাশ্য স্থবিরতার একান্ত পবিত্রতা আবুল হাসানের কবিতা।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

আবুল হাসানের কবিতা

স্থির, দিঘল-দীর্ঘশ্বাস

এমরান হাসান

শনিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২১

গত শতকের ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতায় এক অনিবার্য গতিধারা পরিলক্ষিত হয়। স্পষ্টত বাংলাদেশের কবিতার সংসারে একঝাঁক অতৃপ্ত প্রাণের কোরাস প্রতিধ্বনি তোলে পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে, যার ফলে ষাটের দশককে বাংলাদেশের কবিতার বাঁকবদলের চিহ্ন বলা যায় যৌক্তিকতার সঙ্গেই। কেননা রাজনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অস্থিরতার বিশাল বিবর্তনপ্রত্যাশী যখন সমগ্র শ্রেণীর মানুষ, ঠিক সেসব চিন্তাচেতনা থেকেই ষাটের কবিরা নির্মাণ করতে শুরুকরেছিলেন তাদের কবিতা। স্যাড জেনারেশন কিংবা কণ্ঠস্বর (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স¤পাদিত লিটলম্যাগ) থেকেই শুধু নয়, গোটা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের লেখক-কবিরাও স্বপ্ন দেখতে শুরুকরেন একটি নতুন ভূমি, নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার এবং সে সঙ্গে সাহিত্যের নতুন প্লাটফর্মের। এ দশকে রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, বুলবুল খান মাহবুব, আসাদ চৌধুরী প্রমুখের কবিতায় যখন উঠে আসছিল অস্থির স্বপ্নচেতনা, ঠিক তেমন সময়েই পবিত্র নির্জনতার খোলসাবৃত হয়ে নীরব বিপ্লবের মতোই ষাটের কবিতায় আসেন আবুল হাসান। মাত্র ২৯ বছর বয়সী এই কবি জীবনানন্দীয় চেতনার বলয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ভাবধারায় নির্মাণ করেছেন তার কবিতা।

মাত্র তিনটি গ্রন্থের মাধ্যমেই তিনি বাংলা কবিতার দিকদর্শনকে টেনে নিয়ে যান অবিমিশ্র এক মহাধ্যানী আখড়ায়। তার কাব্যগ্রন্থ- রাজা যায় রাজা আসে (প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ১৯৭২), যে তুমি হরণ করো (১৯৭৪) এবং পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫)। সময়ের প্রয়োজনেই আবুল হাসান হয়ে ওঠেন অভিমানী পাথর। মায়াবী করুণ কিংবা একান্ত ঋদ্ধ শিল্পের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে তার কবিতায়। ‘রাজা যায় রাজা আসে’ কাব্যগ্রন্থ থেকেই তাঁর কাব্যশক্তি ঘুরেফিরে বেড়ে ওঠে।

এ গ্রন্থের ভেতর তিনি প্রকাশ করেছেন আদিগন্ত স্বপ্নফসিল আর যাপিত জীবনবোধের জ্যামিতিক অস্তিত্ব। এই গ্রন্থেও ‘আবুল হাসান’ শীর্ষক কবিতার এই অংশই তার প্রমাণ বহন করে- ‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র, মায়াবী করুণ’ আবার এই কবিতার শেষ তিন চরণে নিজের ভেতর নিজেই ছুঁড়েছেন অনির্বচনীয় দ্বিধা-

‘তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল,

কোনদিন ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বাম হাতে পাঁচটি আঙ্গুল?

বিমূর্তবাদ, পরাবাস্তব ঘরানায় আবুল হাসানের কবিতা নির্মিত না হলেও নিপাট বাস্তবতার অপরিসীম দ্যোতকতা রয়েছে তার কবিতায়। তার রচিত অধিকাংশ কবিতার পঙ্ক্তিই এই মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করে

ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল?’

(আবুল হাসান/রাজা যায় রাজা আসে)

আবুল হাসানের কবিতায় মানুষের জীবনযাত্রা, দৈনন্দিন ঘর-গৃহস্থালি ইত্যাদির স্পষ্ট ছায়া পড়েছে। কেবল হাসি, আনন্দ, উল্লাসকে দূরে ঠেলে দিয়েও আবুল হাসানের কবিতায় খুঁজে পাওয়া সম্ভব মানুষের ছায়াচিত্র। কারণ তার কবিতায় দুঃখবোধ ও অতৃপ্তির পূর্ণতা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। বলা যায়, এক প্রকার সামাজিক ধ্যান-ধারণায় ডুবে না গিয়েও আবুল হাসান অকপটে সাজিয়েছেন শব্দের পর শব্দের দোলা, যা তার কবিতাকে সৌকর্যম-িত করেছে। একাকিত্ব আর চেতনার জগৎ থেকেই কবিতার শরীর নির্মাণ করেছেন তিনি। সহজিয়া ভাষার উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে তার কবিতায় তীব্র মজবুত গাঁথুনিতে উঠে এসেছে অদ্ভুত অনুভূতি ফুটে উঠেছে-

‘আমার ও বক্ষে একটি গর্ত প্রয়োজন! যার ফোকরের মধ্যে চালিয়ে চক্ষু

খোলা দরজার মতন মা মণি আমারই

সেই দূর থেকে দেখবেন, আমি দিনরাত

রেঁদা তুরপুন চালাচ্ছি কত তক্তায়-

(আর) সেলাই কলের সুতোর মতন কত হাত রক্ত নামিয়ে দিচ্ছি ভাগ্য বুননে’

(নিঃসন্দেহ গন্তব্য/রাজা যায় রাজা আসে)

আবুল হাসান শিল্পোত্তীর্ণ সময়ের নয়, সাময়িক বোধের সংস্পর্শেই তার কবিতায় নিয়ে এসেছেন পবিত্র চেতনার সংমিশ্রণ। কবিতার প্রয়োজনে সাবলীলতাই হয়তো তার প্রধান উপজীব্য ছিল, যার কারণে প্রতিটি মুহূর্তকেই ধারণ করেছেন তাঁর কবিতায়। প্রকাশিত তিনটি কাব্যগ্রন্থের বাইরেও যে কবিতাগুলো রয়ে গেছে, সেগুলোও বাংলাসাহিত্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।

একটি বিষয় আবুল হাসানের কবিতায় তীব্রভাবে ধরা পড়ে, সেটি চিত্রকল্প এবং সার্থক উপমার সঠিক ব্যবহার। উপমা, অলঙ্করণ বাংলা কবিতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটি সার্থক কবিতা হয়ে ওঠার জন্য উপমা এবং অলঙ্করণের প্রকাশ এবং তার সুষ্ঠু প্রয়োগ অবশ্যই জরুরি। বিমূর্তবাদ, পরাবাস্তব ঘরানায় আবুল হাসানের কবিতা নির্মিত না হলেও নিপাট বাস্তবতার অপরিসীম দ্যোতকতা রয়েছে তার কবিতায়। তার রচিত অধিকাংশ কবিতার পঙ্ক্তিই এই মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করে। সময়ের তাগিদ থেকে নয়, চেতনার কেন্দ্র থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এসব পঙ্ক্তিমালা।) তার কবিতায় সার্থক চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে ঋদ্ধ ভঙ্গিমায়।

অনেক কাব্যবোদ্ধাই এরকম মন্তব্য করেন যে, কবি তার চারপাশের নিত্য ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা সাংঘাতিকভাবে আক্রান্ত হন। এ মন্তব্যের সাথে আরেকটি বিষয় যুক্ত করলে বোধকরি ভুল হবে না যে, একজন প্রকৃত কবি তার চারপাশে যা কিছু ঘটে সেগুলোর পাশাপাশিই তিনি ঋদ্ধ হতে শুরুকরেন। কেবল কোনো একটি দেশ-সমাজ-সংস্কৃতিতেই আবদ্ধ থাকেন না কবি বরং আরো গভীরতর স্বভাবে সম্পৃক্ত হতে শুরুকরেন সেইসময় থেকে যে সময়ে তার চিন্তা এবং পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিরোধ একটা দুর্নিবার পরিস্থিতিতে গিয়ে চুপচাপ থেমে আসে। তিনি এইসব দায়ের ভেতর থেকেই তৈরি করেছেন তার অসামান্য একেকটি কবিতা। একজন কবিই জানেন তার অন্তর্নিহিত চিন্তাসত্তার আদি এবং অনন্ত অন্তিম পরিচয়। কেবল তার পক্ষেই জানা সম্ভব হয়ে ওঠে তার সামগ্রিক চিন্তা আর দর্শনের আদ্যপানন্ত। কবিতা সৃষ্টির প্রাক্কালে যাবতীয় দর্শনকে কবি আশ্রয় করেন কেবলি কী তার চিন্তার আয়োজন সম্পন্ন করতে নাকি আরো গভীরতর কোনো বোধের বিনির্মাণের তাগিদে? এরকম প্রশ্ন তার কবিতায় খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। তার কবিতায় আদিগন্ত যাপিত জীবনের মৌন এক ভয়াবহতা উন্মোচিত হয়েছে। আসলে কবি সব কিছুর পাশাপাশি তার কবিতায় দৈনন্দিন জীবন-অনুভূতিই তুলে ধরেন অনেক ক্ষেত্রেই। যদিও সবটাতেই এই প্রক্রিয়া সমানভাবে কাজ করে না। কবিতার ভেতরে কবি তার নিজস্ব ভাবনা বুননের পাশাপাশি তুলে আনেন সময় আর আনুষঙ্গিকতার বিরল চিত্রকল্প।

কবিতার ভেতর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে একেবারেই আড়াল করেননি আবুল হাসান। আসলে এটা সম্ভবও হয় না একজন কবির পক্ষে কারণ, কবি তার চারপাশের ঘটনাবলী এবং যাপিত জীবনাচারের ভেতরে ডুবেই তার কবিতা নির্মাণ করেন। যে সাহিত্যে তার চারপাশের প্রতিচ্ছবিই ফুটে ওঠে। আবুল হাসান এসবের ব্যতিক্রম নন, ব্যতিক্রম নয় তার কবিতার উঠোন। জীবনের প্রয়োজনে একজন কবিকেও বদলে যেতে হয হয়তো, তার সাথে বদলে যায় তার কবিতাযাপনের নানা উপাচার।

বাংলাদেশ তথা বাংলা কবিতায় ষাটের দশকের প্রেক্ষাপটে মুখ্য ছিল রাজনৈতিক চেতনা এবং সামগ্রিক অস্থিতিশীল পরিবেশ। আবুল হাসান তার বোধকে পুরোপুরি এই বলয় আর দায়বদ্ধতার বাইরে টেনে নিয়ে যেতে পারেননি। তার অধিকাংশ কবিতায় রাজনৈতিক আবহের ছায়া পড়েছে পরোক্ষভাবে। কোনো কোনো কবিতার চিত্রকল্প রূপকার্থে রাজনৈতিক ভাবধারামুখী হলেও মূলত মানবজীবনযাত্রাকেন্দ্রিক। কবিতার সপক্ষে আবুল হাসান আবহ সৃষ্টি করতে পেরেছেন নতুন আলোর ঠিকানা। যদিও সভ্যতার তীব্র ধ্বংসযজ্ঞেও তিনি বারবার গেয়ে উঠেছেন নৈঃশব্দ্যিক বিমূর্ত বেহালার সুর। আবার প্রেমের পঙ্ক্তিমালা রচনায়ও পুরোদমে সিদ্ধহস্ত তিনি। যথারীতি লৌকিক ভাববাদিতার সপক্ষেই তার অবস্থান। প্রেমের কাঙাল হিসেবে নয়, মুহূর্তের শূন্যতাকে আবুল হাসান প্রেমের ভাষায় নিয়ে যান এক দীর্ঘায়ু শূন্যতায়!-

‘তুমি নেমে গেলে এই বক্ষতলে কি সত্যিই ফুরোবে?

মুখের ভিতরে এই মলিন দাঁতের পঙ্ক্তি- তাহলে এ চোখ

মাথার খুলির নিচে নরম নির্জন এক অবিনাশী ফুল :

আমার আঙ্গুলগুলি, আমার আকাক্সক্ষাগুলি, অভিলাষগুলি?

জানি কিছু চিরকাল ভাস্বর উজ্জ্বল থাকে, চির অমলিন!

তুমি চলে গেলে তবু থাকবে আমার তুমি, চিরায়ত তুমি!

(অপরূপ বাগান/পৃথক পালঙ্ক)

আবার তার কবিতায় সহজিয়া চিত্রকল্পও লক্ষণীয় হয় শক্তিশালী ভিত্তির সঙ্গে। কবিতার পঙ্ক্তিতে আবুল হাসান সুবোধ্য এবং সাবলীলতার সঙ্গে নির্মাণ করেছেন কিছু কিছু চিত্রকল্প। কবিতার শরীর নির্মাণের জন্যই আবুল হাসান বারবার নতজানু হয়েছেন নির্জনতার কাছে, পবিত্র ¯িœগ্ধতার কাছে। তার প্রতিটি কবিতায়ই বিশদভাবে মুখ্য হয়েছে শুদ্ধতার বোধচিত্র। তার উপমেয়তা কিংবা শব্দের সাদৃশ্যতা প্রশ্নাতীত। কবিতার শরীর নির্মাণে এ বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। আবুল হাসান তার সার্থক ব্যবহার করেছেন। শব্দের মোহে নেশাগ্রস্ত বোধগুলো লিপিবদ্ধ হয়েছে তার কবিতায়। তার প্রকাশিত তিনটি কাব্যগ্রন্থের বাইরেও অগ্রন্থিত কবিতায়ও এসব উপমার সার্থক ব্যবহার রয়েছে। কবিতার ভেতরে একদিকে যেমন ভাবের সম্পৃক্ততা প্রবল, অন্যদিকে জীবন-চেতনা আর রূপকার্থে বোধব্যাপ্তির চৌম্বকত্বের ব্যবহার প্রবল। কবিতা যেন বাস্তবতার স্বপক্ষের সৌকর্য। আবুল হাসানের কবিতায় সম্পূরক সৌকর্য নিয়ে উঠে এসেছে গোপন বাস্তবতা।

আবুল হাসানের কবিতা সম্পর্কে শামসুর রাহমান একটি ভূমিকায় লিখেছেন- গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের মিলিত অভিজ্ঞতা তার কবিতাকে বর্ণাঢ্য, সমৃদ্ধ করেছে। তিনি নৈঃসঙ্গ এবং দীর্ঘশ্বাসের কবি। শামসুর রাহমানের উক্তির যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায় তার কবিতায়। তার কবিতায় একদিকে রয়েছে ভাসমান জীবনাচার, একাকিত্ব; অন্যদিকে রয়েছে বিরামহীন উচ্ছন্নতার প্রকাশ। কবিতার আড়ালে আবুল হাসান ছন্নছাড়া জীবনের স্থিরচিত্র আঁকতে গিয়ে জীবনের অন্তদর্শনের মানচিত্র এঁকেছেন সবল হাতে।

‘মাতৃভাষা’ শীর্ষক কবিতার দুটি অংশ থেকে খুব সহজেই দুই রকম দৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়-

‘ঐ যে নষ্ট গলি, নিশ্চুপ দরোজা ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা,

গণিকারা মধ্য রাতে উলঙ্গ শয্যায় ওরা কিসের ভাষায় কথা বলে

আবার, এই কবিতার শেষ অংশে ধরা পড়ে অন্য এক দৃশ্যকল্প-

শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা’

(মাতৃভাষা/রাজা যায় রাজা আসে)

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল এই কবিকে। তার বেশকিছু কবিতায় তীব্রভাবে প্রকাশ হয়েছে এসবের অন্তর্নিহিত বোধ। নিবিড় মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়েও আবুল হাসান নির্মাণ করেছেন ভিন্ন দৃষ্টির ছায়ায় লেপ্টে থাকা এমন কিছু কবিতা- যা বাংলাসাহিত্যের আঙিনাকে সমৃদ্ধ করেছে।

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বর্ণনাই শুধু নয়, আবুল হাসানের কবিতায় জেগে উঠেছে অনন্য এক চিত্রকল্পের প্রাজন্মিক ভাবনা, যেখানে মাতৃভাষা প্রকাশের উপমা পৃথক পরিবেশে বর্ণিত হয়েছে, নন্দিত হয়েছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিন্দিতও হয়েছে সময় আর সভ্যতার প্রয়োজনে।

মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতার চেতনায় অনুপ্রাণিত আবুল হাসান যেন অন্য মানুষ। মাতৃভাষার চেতনাকে রাজনৈতিক এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে দাঁড় করালেও স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা প্রকাশে তিনি আবেগ, উচ্ছ্বাসের কাছেই পরাজিত হয়েছেন বারবার-

‘কেবল পতাকা দেখি কেবল উৎসব দেখি স্বাধীনতা দেখি, তবে

কি আমার ভাই আজ ঐ স্বাধীন পতাকা?

তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?’

(উচ্চারণগুলি শোকের)

আবুল হাসানের চেতনায় স্বপ্নগুলো রাজহাঁস ও সারসপাখি। এসব স্বপ্ন আর স্বপ্ন¯পর্শ নিয়েই আবুল হাসান তার কবিতা নির্মাণ করেছেন, সাজিয়েছেন শব্দের পর শব্দ। কবিতার উঠোনে আবুল হাসান নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরপরই। তার কবিতার মূল উপজীব্য একাকিত্ব এবং একান্ত নৈঃশব্দ্যিক ওঙ্কার।

গত শতকের তিরিশের দশকের জীবনানন্দ দাশ যেমন নির্জনতার স্বপক্ষে থেকেই ঘটিয়েছিলেন বোধের বিস্ফোরণ, ষাটের আবুল হাসান ঠিক একই রকম করে দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে স্বপ্ন আর স্বপ্নচিন্তার ব্যবধান দেখিয়েছেন ঋদ্ধতার সঙ্গে। আবুল হাসানের কবিতায় মুহূর্তের উচ্ছ্বাস নেই, আছে শান্ত, স্থির, দিঘল দীর্ঘশ্বাস। গোপন স্বপ্নের মতন তীব্র নয়, প্রকাশ্য স্থবিরতার একান্ত পবিত্রতা আবুল হাসানের কবিতা।

back to top