alt

সাময়িকী

শালুক সাহিত্যসন্ধ্যায় বাংলা সাহিত্যের ইংরেজিকরণের জোরালো দাবি উত্থাপিত

রিসতিয়াক আহমেদ

: সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

সময়ের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’ সবসময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে প্রতিমাসের প্রথম শুক্রবার একটি করে সাহিত্যসন্ধ্যার আয়োজন। মাঝে দুই বছর করোনাসংক্রান্ত জটিলতায় তা স্থগিত থাকলেও এ বছর এপ্রিল থেকে আবার তা শুরু হয়েছে।

https://sangbad.net.bd/images/2022/September/26Sep22/news/01.jpg

শালুক সাহিত্যসন্ধ্যা ২০-এ মঞ্চে বসা আলোচকবৃন্দ

গত ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ছিল ‘শালুক’ আয়োজিত সাহিত্যসন্ধ্যার ২০তম পর্ব। এবারের আয়োজনটিও অনষ্ঠিত হয় রাজধানীর কাঁটাবনস্থ পাঠক সমাবেশের নতুন আউটলেটে। বিকাল সাড়ে চারটা থেকে শুরু হয়ে চলে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত। শুরুর দিকে আয়োজনগুলো পাঠক সমাবেশের শাহবাগ শাখায় অনুষ্ঠিত হলেও, বেশ কিছু আয়োজন হয়ে গেল কাঁটাবন শাখায়।

বরাবারের মতো আয়োজনে এবারও ছিল একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন, প্রবন্ধের উপর আলোচনা, প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত ও কবিতাপাঠ। অধিকাংশ আয়োজনে বই নিয়ে আলোচনা হলেও এবার বই আলোচনাপর্বটি রাখা সম্ভব হয়নি। এবং এবার একই মাসে দুটি আড্ডার আয়োজন করা হয়েছে।

https://sangbad.net.bd/images/2022/September/26Sep22/news/02.jpg

অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত কবি-লেখক-দর্শনার্থীদের একাংশের ফটোসেশন

দুটি আড্ডা অনুষ্ঠানের কারণ একই বিষয়ের উপর সিরিজ আলোচনা। আলোচনার বিষয় : “বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ: অন্তরায় ও সম্ভাবনা”। বিষয়টি এতটাই প্রাসঙ্গিক যে, এই আলোচনা সিরিজ আকারে সময়ান্তরে চলতে থাকবে বলে জানান শালুক সম্পাদক ও সময়ের ব্যতিক্রমধারার কবি ওবায়েদ আকাশ এবং সহযোগী সম্পাদক বিশিষ্ট কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক মাহফুজ আল-হোসেন।

https://sangbad.net.bd/images/2022/September/26Sep22/news/03.jpg

অনুষ্ঠানে উপস্থিত কবি-লেখক-দর্শনার্থীদের একাংশ

এবারের আলোচনার মূল প্রবন্ধটি পাঠ করেন কবি ও অনুবাদক আরণ্যক শামছ। এবং আলোচনা পর্বে আলোচনা করেন বিশিষ্ট কবি ও অনুবাদক জুয়েল মাজহার; বিশিষ্ট অনুবাদক মাহফুজ আল-হোসেন (সঞ্চালকের দায়িত্বও ছিল তার হাতে), অনুবাদক স্বপন নাথ এবং কথাসাহিত্যিক-অনুবাদক মোজাফফর হোসেন।

শুরুতেই অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্য রাখেন কবি ওবায়েদ আকাশ। তিনি জানান, শালুকের এই সাহিত্যসন্ধ্যা প্রতি মাসে একটি করে আয়োজিত হয়ে থাকলেও এই মাসে দুটো আয়োজন করা হলো। কারণ এটি একই বিষয়ের উপর সিরিজ আলোচনা। শালুকের এই নিয়মিত আড্ডার উদ্দেশ্য হলো শিল্প-সাহিত্যের অনালোকিত জায়গাগুলোতে আলো ফেলা, কিংবা অনালোচিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসা। তিনি বলেন গত কিছু বছর ধরে তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে ঘুরে একটি বিষয় লক্ষ্য করছেন যে, বাংলা ভাষার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ও পঞ্চম বৃহত্তম ভাষার সাহিত্য পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাভাষিদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। কারণ অনুবাদের অভাব। বাংলা ভাষার ইংরেজিকরণের সংকট। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ভাষা থেকে সাহিত্য অনূদিত হয়ে আসলেও বাংলা সাহিত্য ইংরেজি কিংবা অন্য ভাষায় তেমন অনূদিত হচ্ছে না। সেই অভাব বোধ থেকেই তাঁর এই বিষয় নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে জাগে। অনুবাদ বিষয়ে তিনি সৈয়দ শামসুল হকের উক্তি উল্লেখ করেন যে, অনুবাদের কাজটি হলো অনেকটা এরকম যে, তুমি একটি ঘড়ি সম্পর্কে কিছুই জানো না। তুমি ঘড়িটাকে পুরোপুরি ভাবে খুলে ফেললে এবং পুনরায় তা আমার অবিকল সেট করলে। যদি পুনরায় তা অবিকল সেট করতে না পারো, তাহলে ঘড়িটি চলবে না। অনুবাদকর্মটি এতটাই কষ্টসাধ্য। এই কষ্টসাধ্য কাজটি যারা করছেন, তিনি তাদের প্রতি সম্মান জানান। আগত দর্শক-শ্রোতা ও কবি-লেখকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান; যারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে এই আন্দোলনে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।

https://sangbad.net.bd/images/2022/September/26Sep22/news/04.jpg

অনুষ্ঠানে উপস্থিত কবি-লেখক-দর্শনার্থীদের একাংশ

এরপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আরণ্যক শামছ। প্রবন্ধে উঠে আসে অনুবাদের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা এবং এই সীমাবদ্ধতাগুলোকে কীভাবে কাটিয়ে-ওঠা যায় সেই দিকগুলো। প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক জানান, অনুবাদ কর্মে দেখা যাচ্ছে অনেক অনুবাদ গুগল ট্রান্সলেটের মাধ্যমে করা হচ্ছে এবং তাকেই ভালো অনুবাদ বলে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। এবং আক্ষরিক অনুবাদকে তিনি ভালো অনুবাদ বলে মনে করেন না। আবার অনুবাদের জন্য তিনি প্রশিক্ষণের দাবি করেন। ট্রান্সলেশন স্টাডিস নিয়ে পড়াশোনার কথা উল্লেখ করেন।

মূল প্যানেল আলোচনায় যাবার অগে কবি শোয়াইব জিবরান শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, প্রবন্ধে যে প্রাতিষ্ঠানিকতার উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে মাধ্যমিক পর্যায়ে খুব একটা কাজ করার আছে বলে তিনি মনে করেন না। কেননা, মাধ্যমিক পর্যায়ের যে কারিকুলাম নির্ধারণ করা হয়, তা ধরেই নেয়া সেখানে একটি শিক্ষার্থী ভালো মানুষ হবে। এবং মূলত সে প্রফেশনে যাবে। অনুবাদে আসবে এমনটি ধরে নেয়া হয় না। তিনি আরও বলেন, ইংরেজি কি একটি খুনি ভাষা? ভাষার সাম্রাজ্য কি ইংরেজি অন্যান্য ভাষাকে খুন করছে? ভাষা খুন মানে শুধু ভাষা নয়। ভাষা, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদকে খুন করা। এবং আরও বলেন, আমাদের অনুবাদের বাজার আছে কি না। মৌলিক কিছু আমরা দিতে পারছি কিনা। আমরা গীতগোবিন্দ, লালন কিংবা কমলকুমার মজুমদারের যে মৌলিকত্ব তাকে অনুবাদে নিয়ে যাচ্ছি কিনা। বঙ্কিম থেকে শুরু করে যে সব অনুবাদের কাজ হচ্ছে তা ইউরোপীয় ভঙ্গিমাই।

https://sangbad.net.bd/images/2022/September/26Sep22/news/05.jpg

শালুক সাহিত্যসন্ধ্যা ২০-এ মঞ্চে বসা আলোচকবৃন্দ

আলোচক মোজাফফর হোসেন আলোচনা করতে গিয়ে অনুবাদের ট্রান্সক্রিয়েশনের উপরই অনেকটা জোর দেন। এবং এও উল্লেখ করেন যে, এতে করে যে ইন্টারপ্রিটেশন করা হয়ে থাকে তা ঐ ভাষা সাম্রাজ্যই। মধ্যপ্রাচ্যের যে সব সাহিত্যের অনুবাদ ইউরোপীয়রা করে থাকেন সেখানে মুসলিম সমাজ নিয়ে বেসিক যে সব প্রপাগা-া রয়েছে সেগুলো তারা ব্যবহার করেন। এবং এ প্রপাগাণ্ডারই একটি বাজার তৈরি করা হয়েছে ইউরোপের বাজারে কিংবা এর মাধ্যমে অন্যান্য দেশে। মোজাফফর ট্রানস্লেশন স্টাডিজের সমালোচনা করে বলেন যে, যারা এর সাথে যুক্ত আছেন তারা অনুবাদ সাহিত্যে তেমন কাজ করছেন না। বলতে গেলে তারা ভালো অনুবাদক নন। ‘শালুক’ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের তিনি অভিনবত্ব খুঁজে পান যে, সাধারণত অন্যান্য ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করার ব্যাপারে কম বেশি আলোচনা থাকলেও বাংলা ভাষাকে ইংরেজিতে বা ইংরেজির মাধ্যমে অন্যান্য ভাষায় পৌঁছে দিয়ে যে বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিকরণ তা একেবারেই নেই। যে বিষয়টি শালুক সামনে নিয়ে এসেছে।

https://sangbad.net.bd/images/2022/September/26Sep22/news/06.jpg

শালুক সাহিত্যসন্ধ্যা ২০-এ মঞ্চে বসা আলোচকবৃন্দ

আলোচক স্বপন নাথ বলেন, আমাদের অনুবাদ আমাদেরই করতে হবে। তাহলেই অনুবাদের যে ট্রান্সক্রিয়েশনের ভেতর দিয়ে ইন্টারপ্রিটেশনের ভাষা সাম্রাজ্য তাকে মোকাবিলা করা সম্ভব। তিনি বেস্ট সেলার কোরিয়ান সাহিত্যের সাথে তুলনা করে বলেন যে, কোরিয়ান সাহিত্যের যে অনুবাদ ইউরোপীয় প্রকাশনা থেকে বের হয় তার সাথে কোরিয়ান সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তিনি এও উল্লেখ করেন যে, অনুবাদ করতে হবে আমাদেরই। কিন্তু ইউরোপীয় বাজারটা আমাদের ধরতে হবে। তাহলেই আমাদের সাহিত্যমান অক্ষুণ্ন থেকে আন্তর্জতিকতা লাভ করবে। বিশ্বের দরবারে বাংলা সাহিত্য নিজের জায়গা দখল করে নেবে।

আলোচক জুয়েল মাজহার অনুবাদের মান নিয়ে কথা বলেন। বলেন অনুবাদকে ছুঁতে হলে যে হাতের প্রয়োজন তা দানবের হাত নয়। ফলে তা গড়তে গিয়ে ভেঙে ফেলতে পারে কিংবা শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়তে পারে। তিনি বলেন, অনুবাদ করতে গিয়ে আমাদের যেতে হবে নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব পুরাণ , নিজস্ব মিথে। কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে তিনি ছন্দের উপর জোর দেন। বলেন, ছন্দ না জানলে গদ্যছন্দও লেখা সম্ভব নয়। এবং উল্লেখ করেন আমাদের গোষ্ঠীবদ্ধতাকে। প্রান্তিকের প্রতি অবহেলাকে, তরুণদের প্রতি অবহেলাকে। তিনি বলেন, অনেক অনেক তরুণ ভালো ভালো কাজ করেছে এবং করছেন। যাদের খোঁজ আমরা করি না। খোঁজার চেষ্টা করি না। কতকগুলো নামের প্রতিই অন্ধ আনুগত্য প্রকাশ করি। তিনি মনে করেন, আমাদের দেশে অনেক ভাল ভাল অনুবাদক আছেন, তাদের আমরা খুঁজি না। তাদের অনুবাদকে গুরুত্ব দেই না। অথচ তাদের অনুবাদ অনেক খ্যাতিমানদের অনুবাদের চেয়েও সাবলীল।

আলোচক মাহফুজ আল-হোসেন বলেন, আমাদের এই আলোচনায় অনুবাদ সাহিত্যের বিভিন্ন দিক উঠে আসলো। উঠে আসলো বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা এবং সেই সীমাবদ্ধতার ভেতর দিয়েও উঠে আসলো সীমাকে অতিক্রম করার পন্থা। এখন আমাদের কাজ করার প্রয়োজন। অনুবাদের বিপণন ব্যবস্থায় আমাদের অগ্রসর হতে হবে। বহির্বিশ্বের ছড়িয়ে দেয়ায় অগ্রসর হতে হবে। তিনি তাঁর অনূদিত ওবায়েদ আকাশের পোস্টমডার্ন বিড়াল কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ পড়ে শোনান। যা তিনি অন্ত্যমিল ঠিক রেখে বাংলা থেকে ইংরেজি করেছেন। সঙ্গে তিনি বাংলায় লেখা মূল কবিতাটিও পড়ে শোনান।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন কবি কামাল চৌধুরী। তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, অনুবাদ সাহিত্যের বিকল্প নেই; যদি আপনি অপরাপর সাহিত্যের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে চান। আমরা তো বিশ্ব সাহিত্যের সাথে পরিচিতই হয়েছি অনুবাদ সাহিত্যের ভেতর দিয়ে। এবং আরও বলেন, কবিতার অনুবাদ সবচেয়ে কঠিন। কেননা, সাহিত্যের সকল শাখার মধ্যে কবিতাই একমাত্র মাধ্যম যেখানে ভাষার সব কিছু ধারণ করা সম্ভব। যা অন্য কোনো মাধ্যমে এভাবে সম্ভব নয়।

অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন- কবি আবদুর রাজ্জাক, জুয়েল মাজহার, কবীর হোসেন, আদিত্য নজরুল, শেলী সেনগুপ্তা, জাফর সাদেক, আরণ্যক শামছ, পারভেজ আহসান, মনীষা সরকার, শারমিন ইসলাম, শাহ কামাল, বকুল আশরাফ, মামুন অপু, আমির হামজা প্রমুখ।

লিটল ম্যাগাজিন শালুকের এই আয়োজনে বরাবরের মতো ছিল কবি-সাহিত্যিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। প্রবন্ধ পাঠ, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এবং কবিতাপাঠের ভেতর দিয়ে সকলেই একটি ঋদ্ধ সময় অতিবাহিত করেন। সবশেষে শালুক-সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ আগামী আয়োজনের আমন্ত্রণ জানিয়ে এই আনুষ্ঠিকভাবে অনুষ্ঠানের এ পর্বের আপাত সমাপ্তি টানেন।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

শালুক সাহিত্যসন্ধ্যায় বাংলা সাহিত্যের ইংরেজিকরণের জোরালো দাবি উত্থাপিত

রিসতিয়াক আহমেদ

সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

সময়ের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’ সবসময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে প্রতিমাসের প্রথম শুক্রবার একটি করে সাহিত্যসন্ধ্যার আয়োজন। মাঝে দুই বছর করোনাসংক্রান্ত জটিলতায় তা স্থগিত থাকলেও এ বছর এপ্রিল থেকে আবার তা শুরু হয়েছে।

https://sangbad.net.bd/images/2022/September/26Sep22/news/01.jpg

শালুক সাহিত্যসন্ধ্যা ২০-এ মঞ্চে বসা আলোচকবৃন্দ

গত ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ছিল ‘শালুক’ আয়োজিত সাহিত্যসন্ধ্যার ২০তম পর্ব। এবারের আয়োজনটিও অনষ্ঠিত হয় রাজধানীর কাঁটাবনস্থ পাঠক সমাবেশের নতুন আউটলেটে। বিকাল সাড়ে চারটা থেকে শুরু হয়ে চলে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত। শুরুর দিকে আয়োজনগুলো পাঠক সমাবেশের শাহবাগ শাখায় অনুষ্ঠিত হলেও, বেশ কিছু আয়োজন হয়ে গেল কাঁটাবন শাখায়।

বরাবারের মতো আয়োজনে এবারও ছিল একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন, প্রবন্ধের উপর আলোচনা, প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত ও কবিতাপাঠ। অধিকাংশ আয়োজনে বই নিয়ে আলোচনা হলেও এবার বই আলোচনাপর্বটি রাখা সম্ভব হয়নি। এবং এবার একই মাসে দুটি আড্ডার আয়োজন করা হয়েছে।

https://sangbad.net.bd/images/2022/September/26Sep22/news/02.jpg

অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত কবি-লেখক-দর্শনার্থীদের একাংশের ফটোসেশন

দুটি আড্ডা অনুষ্ঠানের কারণ একই বিষয়ের উপর সিরিজ আলোচনা। আলোচনার বিষয় : “বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ: অন্তরায় ও সম্ভাবনা”। বিষয়টি এতটাই প্রাসঙ্গিক যে, এই আলোচনা সিরিজ আকারে সময়ান্তরে চলতে থাকবে বলে জানান শালুক সম্পাদক ও সময়ের ব্যতিক্রমধারার কবি ওবায়েদ আকাশ এবং সহযোগী সম্পাদক বিশিষ্ট কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক মাহফুজ আল-হোসেন।

https://sangbad.net.bd/images/2022/September/26Sep22/news/03.jpg

অনুষ্ঠানে উপস্থিত কবি-লেখক-দর্শনার্থীদের একাংশ

এবারের আলোচনার মূল প্রবন্ধটি পাঠ করেন কবি ও অনুবাদক আরণ্যক শামছ। এবং আলোচনা পর্বে আলোচনা করেন বিশিষ্ট কবি ও অনুবাদক জুয়েল মাজহার; বিশিষ্ট অনুবাদক মাহফুজ আল-হোসেন (সঞ্চালকের দায়িত্বও ছিল তার হাতে), অনুবাদক স্বপন নাথ এবং কথাসাহিত্যিক-অনুবাদক মোজাফফর হোসেন।

শুরুতেই অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্য রাখেন কবি ওবায়েদ আকাশ। তিনি জানান, শালুকের এই সাহিত্যসন্ধ্যা প্রতি মাসে একটি করে আয়োজিত হয়ে থাকলেও এই মাসে দুটো আয়োজন করা হলো। কারণ এটি একই বিষয়ের উপর সিরিজ আলোচনা। শালুকের এই নিয়মিত আড্ডার উদ্দেশ্য হলো শিল্প-সাহিত্যের অনালোকিত জায়গাগুলোতে আলো ফেলা, কিংবা অনালোচিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসা। তিনি বলেন গত কিছু বছর ধরে তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে ঘুরে একটি বিষয় লক্ষ্য করছেন যে, বাংলা ভাষার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ও পঞ্চম বৃহত্তম ভাষার সাহিত্য পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাভাষিদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। কারণ অনুবাদের অভাব। বাংলা ভাষার ইংরেজিকরণের সংকট। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ভাষা থেকে সাহিত্য অনূদিত হয়ে আসলেও বাংলা সাহিত্য ইংরেজি কিংবা অন্য ভাষায় তেমন অনূদিত হচ্ছে না। সেই অভাব বোধ থেকেই তাঁর এই বিষয় নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে জাগে। অনুবাদ বিষয়ে তিনি সৈয়দ শামসুল হকের উক্তি উল্লেখ করেন যে, অনুবাদের কাজটি হলো অনেকটা এরকম যে, তুমি একটি ঘড়ি সম্পর্কে কিছুই জানো না। তুমি ঘড়িটাকে পুরোপুরি ভাবে খুলে ফেললে এবং পুনরায় তা আমার অবিকল সেট করলে। যদি পুনরায় তা অবিকল সেট করতে না পারো, তাহলে ঘড়িটি চলবে না। অনুবাদকর্মটি এতটাই কষ্টসাধ্য। এই কষ্টসাধ্য কাজটি যারা করছেন, তিনি তাদের প্রতি সম্মান জানান। আগত দর্শক-শ্রোতা ও কবি-লেখকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান; যারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে এই আন্দোলনে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।

https://sangbad.net.bd/images/2022/September/26Sep22/news/04.jpg

অনুষ্ঠানে উপস্থিত কবি-লেখক-দর্শনার্থীদের একাংশ

এরপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আরণ্যক শামছ। প্রবন্ধে উঠে আসে অনুবাদের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা এবং এই সীমাবদ্ধতাগুলোকে কীভাবে কাটিয়ে-ওঠা যায় সেই দিকগুলো। প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক জানান, অনুবাদ কর্মে দেখা যাচ্ছে অনেক অনুবাদ গুগল ট্রান্সলেটের মাধ্যমে করা হচ্ছে এবং তাকেই ভালো অনুবাদ বলে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। এবং আক্ষরিক অনুবাদকে তিনি ভালো অনুবাদ বলে মনে করেন না। আবার অনুবাদের জন্য তিনি প্রশিক্ষণের দাবি করেন। ট্রান্সলেশন স্টাডিস নিয়ে পড়াশোনার কথা উল্লেখ করেন।

মূল প্যানেল আলোচনায় যাবার অগে কবি শোয়াইব জিবরান শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, প্রবন্ধে যে প্রাতিষ্ঠানিকতার উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে মাধ্যমিক পর্যায়ে খুব একটা কাজ করার আছে বলে তিনি মনে করেন না। কেননা, মাধ্যমিক পর্যায়ের যে কারিকুলাম নির্ধারণ করা হয়, তা ধরেই নেয়া সেখানে একটি শিক্ষার্থী ভালো মানুষ হবে। এবং মূলত সে প্রফেশনে যাবে। অনুবাদে আসবে এমনটি ধরে নেয়া হয় না। তিনি আরও বলেন, ইংরেজি কি একটি খুনি ভাষা? ভাষার সাম্রাজ্য কি ইংরেজি অন্যান্য ভাষাকে খুন করছে? ভাষা খুন মানে শুধু ভাষা নয়। ভাষা, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদকে খুন করা। এবং আরও বলেন, আমাদের অনুবাদের বাজার আছে কি না। মৌলিক কিছু আমরা দিতে পারছি কিনা। আমরা গীতগোবিন্দ, লালন কিংবা কমলকুমার মজুমদারের যে মৌলিকত্ব তাকে অনুবাদে নিয়ে যাচ্ছি কিনা। বঙ্কিম থেকে শুরু করে যে সব অনুবাদের কাজ হচ্ছে তা ইউরোপীয় ভঙ্গিমাই।

https://sangbad.net.bd/images/2022/September/26Sep22/news/05.jpg

শালুক সাহিত্যসন্ধ্যা ২০-এ মঞ্চে বসা আলোচকবৃন্দ

আলোচক মোজাফফর হোসেন আলোচনা করতে গিয়ে অনুবাদের ট্রান্সক্রিয়েশনের উপরই অনেকটা জোর দেন। এবং এও উল্লেখ করেন যে, এতে করে যে ইন্টারপ্রিটেশন করা হয়ে থাকে তা ঐ ভাষা সাম্রাজ্যই। মধ্যপ্রাচ্যের যে সব সাহিত্যের অনুবাদ ইউরোপীয়রা করে থাকেন সেখানে মুসলিম সমাজ নিয়ে বেসিক যে সব প্রপাগা-া রয়েছে সেগুলো তারা ব্যবহার করেন। এবং এ প্রপাগাণ্ডারই একটি বাজার তৈরি করা হয়েছে ইউরোপের বাজারে কিংবা এর মাধ্যমে অন্যান্য দেশে। মোজাফফর ট্রানস্লেশন স্টাডিজের সমালোচনা করে বলেন যে, যারা এর সাথে যুক্ত আছেন তারা অনুবাদ সাহিত্যে তেমন কাজ করছেন না। বলতে গেলে তারা ভালো অনুবাদক নন। ‘শালুক’ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের তিনি অভিনবত্ব খুঁজে পান যে, সাধারণত অন্যান্য ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করার ব্যাপারে কম বেশি আলোচনা থাকলেও বাংলা ভাষাকে ইংরেজিতে বা ইংরেজির মাধ্যমে অন্যান্য ভাষায় পৌঁছে দিয়ে যে বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিকরণ তা একেবারেই নেই। যে বিষয়টি শালুক সামনে নিয়ে এসেছে।

https://sangbad.net.bd/images/2022/September/26Sep22/news/06.jpg

শালুক সাহিত্যসন্ধ্যা ২০-এ মঞ্চে বসা আলোচকবৃন্দ

আলোচক স্বপন নাথ বলেন, আমাদের অনুবাদ আমাদেরই করতে হবে। তাহলেই অনুবাদের যে ট্রান্সক্রিয়েশনের ভেতর দিয়ে ইন্টারপ্রিটেশনের ভাষা সাম্রাজ্য তাকে মোকাবিলা করা সম্ভব। তিনি বেস্ট সেলার কোরিয়ান সাহিত্যের সাথে তুলনা করে বলেন যে, কোরিয়ান সাহিত্যের যে অনুবাদ ইউরোপীয় প্রকাশনা থেকে বের হয় তার সাথে কোরিয়ান সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তিনি এও উল্লেখ করেন যে, অনুবাদ করতে হবে আমাদেরই। কিন্তু ইউরোপীয় বাজারটা আমাদের ধরতে হবে। তাহলেই আমাদের সাহিত্যমান অক্ষুণ্ন থেকে আন্তর্জতিকতা লাভ করবে। বিশ্বের দরবারে বাংলা সাহিত্য নিজের জায়গা দখল করে নেবে।

আলোচক জুয়েল মাজহার অনুবাদের মান নিয়ে কথা বলেন। বলেন অনুবাদকে ছুঁতে হলে যে হাতের প্রয়োজন তা দানবের হাত নয়। ফলে তা গড়তে গিয়ে ভেঙে ফেলতে পারে কিংবা শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়তে পারে। তিনি বলেন, অনুবাদ করতে গিয়ে আমাদের যেতে হবে নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব পুরাণ , নিজস্ব মিথে। কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে তিনি ছন্দের উপর জোর দেন। বলেন, ছন্দ না জানলে গদ্যছন্দও লেখা সম্ভব নয়। এবং উল্লেখ করেন আমাদের গোষ্ঠীবদ্ধতাকে। প্রান্তিকের প্রতি অবহেলাকে, তরুণদের প্রতি অবহেলাকে। তিনি বলেন, অনেক অনেক তরুণ ভালো ভালো কাজ করেছে এবং করছেন। যাদের খোঁজ আমরা করি না। খোঁজার চেষ্টা করি না। কতকগুলো নামের প্রতিই অন্ধ আনুগত্য প্রকাশ করি। তিনি মনে করেন, আমাদের দেশে অনেক ভাল ভাল অনুবাদক আছেন, তাদের আমরা খুঁজি না। তাদের অনুবাদকে গুরুত্ব দেই না। অথচ তাদের অনুবাদ অনেক খ্যাতিমানদের অনুবাদের চেয়েও সাবলীল।

আলোচক মাহফুজ আল-হোসেন বলেন, আমাদের এই আলোচনায় অনুবাদ সাহিত্যের বিভিন্ন দিক উঠে আসলো। উঠে আসলো বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা এবং সেই সীমাবদ্ধতার ভেতর দিয়েও উঠে আসলো সীমাকে অতিক্রম করার পন্থা। এখন আমাদের কাজ করার প্রয়োজন। অনুবাদের বিপণন ব্যবস্থায় আমাদের অগ্রসর হতে হবে। বহির্বিশ্বের ছড়িয়ে দেয়ায় অগ্রসর হতে হবে। তিনি তাঁর অনূদিত ওবায়েদ আকাশের পোস্টমডার্ন বিড়াল কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ পড়ে শোনান। যা তিনি অন্ত্যমিল ঠিক রেখে বাংলা থেকে ইংরেজি করেছেন। সঙ্গে তিনি বাংলায় লেখা মূল কবিতাটিও পড়ে শোনান।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন কবি কামাল চৌধুরী। তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, অনুবাদ সাহিত্যের বিকল্প নেই; যদি আপনি অপরাপর সাহিত্যের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে চান। আমরা তো বিশ্ব সাহিত্যের সাথে পরিচিতই হয়েছি অনুবাদ সাহিত্যের ভেতর দিয়ে। এবং আরও বলেন, কবিতার অনুবাদ সবচেয়ে কঠিন। কেননা, সাহিত্যের সকল শাখার মধ্যে কবিতাই একমাত্র মাধ্যম যেখানে ভাষার সব কিছু ধারণ করা সম্ভব। যা অন্য কোনো মাধ্যমে এভাবে সম্ভব নয়।

অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন- কবি আবদুর রাজ্জাক, জুয়েল মাজহার, কবীর হোসেন, আদিত্য নজরুল, শেলী সেনগুপ্তা, জাফর সাদেক, আরণ্যক শামছ, পারভেজ আহসান, মনীষা সরকার, শারমিন ইসলাম, শাহ কামাল, বকুল আশরাফ, মামুন অপু, আমির হামজা প্রমুখ।

লিটল ম্যাগাজিন শালুকের এই আয়োজনে বরাবরের মতো ছিল কবি-সাহিত্যিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। প্রবন্ধ পাঠ, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এবং কবিতাপাঠের ভেতর দিয়ে সকলেই একটি ঋদ্ধ সময় অতিবাহিত করেন। সবশেষে শালুক-সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ আগামী আয়োজনের আমন্ত্রণ জানিয়ে এই আনুষ্ঠিকভাবে অনুষ্ঠানের এ পর্বের আপাত সমাপ্তি টানেন।

back to top