alt

সাময়িকী

সাময়িকী কবিতা

: বৃহস্পতিবার, ০৪ মে ২০২৩

কোমায় শুয়ে আছে

বন্ধু, ছুটির দিনে

হাসান কল্লোল
(সুহৃদ অনুজ বন্ধু সদ্য প্রয়াত ‘লিটন’কে নিবেদিত)

নীরবতার কোলে মাথা রেখে তুমি শুয়ে আছ
চোখগুলো কাচের গ্লাসে রাখা পানির ওপর ভাসছে।
দ্রাঘিমা রেখা চলে গেছে যেন তোমার কোমল বুকের ওপর দিয়ে-
যাবতীয় জামা জুতা প্রসাধনী প্রদর্শনীতে যাবে
আড়মোড়া ভেঙে জাগছে তাই হেমন্তের সকালে

একটা মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে এবং
কেউ যখন কোমায় থাকে তারা মূলত
এক ট্রেনের টিকেট কেটেও, পাশাপাশি বসতে পারে না!
কখনো বড়জোর একজন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে
কম্পার্টমেন্টে সারারাত ভালোবাসা হয়ে!

ট্রেন চঞ্চলতা সাথে করে নিয়ে যায়
তার নীরব অভিমান স্টেশনে পড়ে থাকে
অভুক্ত পুরাতন ভিখারীর পাশে
পড়ে থাকে নুড়িপাথর আরোগ্যের ক্যাপসুল হয়ে,
শীতের পাখিরা ফের আসবে বলে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাই মানুষ সাজিয়ে রাখে
নিরিবিলি জলজ বিছানা!
মানুষেরা কথা দিয়ে ভুলে যায় আর
ইতিহাসের বইয়ের মলাটে বিশ্বাসঘাতকতা
অট্টহাসিতে ষোলখান হয়ে নাচে-

কোমায় শুয়ে আছে বন্ধু, ছুটির দিনে
তার সজীব প্রত্যাবর্তনের জন্য তবু কিছু
চোখের বিশালতা, সজনে ফুলের জন্য অপেক্ষা করে!

শোকেরা নীরবে
হেঁটে আসে

জাহিদ মুস্তাফা

বারুদগন্ধময় ত্রাসে অগ্নিএকাত্তরে
জনপদে মৃত্যু এসে নেমেছিল
কালরাতের আঁধারে!
অনাকাক্সিক্ষত রক্তের আলপনা
এঁকেছিল যারা বাংলার পৃষ্ঠায়
সেই পংগপালের ঝাঁক এখনও রয়ে গেছে
আমাদের সমবেত ঘৃণার আগুনে
তাদের বিদ্বেষগুলো পুড়ে যাক, পুড়ে যাক।
শোকেরা নীরবে হেঁটে আসে
ভোরের আলোয় একে একে জড়ো হয় মানুষেরা বিদায়ী-কান্নায়।
আজরাইল তো কড়া নাড়ে জীর্ণ চৌকাঠে
বলে- বাড়ি আছ কে কে
শোধবোধ জীবনের দায়- চলো যাই
তেপান্তরের পরে অনন্ত মৃত্যুর হাটে।

স্বজনের লাশ বুকে তুলে নিয়ে পাথরের শোকে
শোকাহত হতে হতে এই বেঁচে থাকা!

উড়ালের গান
সোহরাব পাশা

বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ
তখনো ফোটেনি ভোর

ঘুম নেই, জেগে থাকে দুঃস্বপ্নের রাত
ছায়াছন্ন বারান্দায় বন্য নেকড়ের
কোলাহল
ভয়ানাক ক্ষিপ্রস্বর
ওড়ে তীব্র রুক্ষশীত

বিহ্বল পায়ের কাছে চোখের আগুন
পোড়া হৃৎপিণ্ডে অন্ধকীট

মানুষ ভোলে না রৌদ্রের তুমুল ঘ্রাণ
সুন্দরের বিশুদ্ধ উপমা

জীবন কেবল মৃত্যুর যাপন নয়
উড়ালের গান
রাতদুপুরে পথগুলো বাজায় বাঁশি

সমুদ্রপ্রবণ
মতিন রায়হান

হিম হিম শীত
তোমার উষ্ণতা পাই
বিস্মৃতিতে!
ফোটে হৃদয়কুসুম
কী যে শোভা তার
যে দেখে সে দেখে
যে শেখে সে শেখে
তুমিও যে শিখেছিলে
শিশির-প্রভাতে
লেলিহান অগ্নিময় খেলা
কাঁপে বুক
ধুকপুক
ফণা তোলা অন্ধকার
ডুবে যায় নদী
গগন অবধি
আমি তো মানুষ
সমুদ্রপ্রবণ
উত্তাল-উত্তুঙ্গঢেউ
ফেনারাশি
যে বাসে, বাসুক
পুষুক অন্তরে
রক্তজবা-স্মৃতি
কী নাম দেবে গো তার
মৃত্যু-নদী?
তোমার উষ্ণতা পাই
নিত্য যদি!

তোমার উচিত ছিল
মোহাম্মদ হোসাইন

তোমার উচিত ছিল রৌদ্রে একটু দাঁড়ানো

চারপাশ থেকে রৌদ্ররা লাল পতাকা নিয়ে আসছে হাসছে, খেলছে
তোমার উচিত ছিল রৌদ্রে একটু দাঁড়ানো

পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তিরতির হাওয়া, জলপাই রং নদী, তোমার উচিত ছিল... তোমার উচিত ছিল...

ধান ক্ষেত শুয়ে আছে সোনালি ধানের গন্ধ বুকে নিয়ে, টুকটুকে লাল ঠোঁটে কী অপরূপ মাধুর্যে গান গাইছে শিরিষের বন, মধুফুল- তার পাশে দাঁড়ানো তোমার উচিত ছিল...

তোমার উচিত ছিল সবুজ শিশুর পাশে দাঁড়ানো
তার নরম গাল টিপে দেওয়া তোমার উচিত ছিল
উচিত ছিল একটু রৌদ্রে দাঁড়ানো
পাশ দিয়ে কত মানুষ, কত বেহালা, কত সুর উঁকি দিয়ে যাচ্ছে- তোমার উচিত ছিল তাদের কাছে দাঁড়ানো
নতুন বউ যাচ্ছে কাছে থেকে, মৃত্যুও যাচ্ছে তুড়ি মেরে মেরে, পাখির পালক বরাবর কত হত্যা ম্লান দাঁড়িয়ে আছে- তোমার উচিত ছিল তাদের পাশে দাঁড়ানো... উচিত ছিল একটু কাঁধ ছুঁয়ে দেওয়া

আমাদের কী আছে আর... উচিত ছিল... উচিত ছিল... এই সুবর্ণ সময়ে
এইটুকু করা খুব উচিত ছিল...

তোমার উচিত ছিল রৌদ্রজলে মুখ ধুয়ে নেওয়া...!

সান্তালপাড়ায় সুপারমুন
মিলটন রহমান

একটি রুমাল দে
ঢকে দিই চাঁদের মুখ
গলে গলে যে রূপঙ্কর মূর্তমান হচ্ছে
ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রান্তর
তার সাথে আমার পিঞ্জরাবদ্ধ সম্পর্ক নেই
আমি চাঁদের মত একা
গলে পড়ি একা
চোখের কার্নিশ বেয়ে যে জল গড়িয়ে পড়ছে
তাকে বিভ্রমে সোনালি মনে হলেও
সেখানে রয়েছে কৃষ্ণগহব্বর
ওরে আমি কোথাও আলো দেখি না
প্রলম্বিত অন্ধকার হয়ে উঠছে গ্রীবাময়
আমি কি অন্ধ হয়ে গেলাম, নাকি তুমি,
তোমার আমার চাঁদ দেখার চোখ এক নয়
চাঁদের আলো দেখার জন্য
মাছের চোখের মত জ্বলছে আমার চোখ
তোমার চোখে উড়ছে সোনালি পারদ
চলো আজ আর চাঁদ দেখাদেখি নয়
আগে নিজেদের চোখ এক করি

বিজয় স্তম্ভ
শামস হক

আমি রেসকোর্স ময়দানের বিজয়স্তম্ভের সম্মুখে দাঁড়িয়ে
শপথ করে বলছি এটা পৃথিবীর সেরা স্তম্ভ।
এটা সর্বোচ্চ, গগনচুম্বী এবং সুকঠিন।
শক্তিশালী দুবাহু- পেশীর মধ্যভাগের স্ফীত শিরার এক সুদঢ় মস্তক যা দুর্দমনীয়।
কবি যাকে বলেছেন,
“কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।”

আমি সূর্য শপথ করে বলছি
এই স্তম্ভ কোনো মাটিতে নির্মিত নয়, জমাট বাঁধা রক্তের শিলাখণ্ডে
এর ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপিত
রিক্টর স্কেলের শেষ ঝাঁকুনিও একে টলাতে পারেনি।

আমি আত্মবলীয়ান হয়ে বলছি, পুবের ঐ সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের দিকে তাকাও
দেখো তো কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ঐ সব
বরাহ-জাতকদের চিনতে পারো কিনা!
ইয়াহিয়া, ভুট্ট, টিক্কা?
হ্যাঁ, ঠি...ক ধরেছো।

আমি উদাত্ত কণ্ঠে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরের, প্রতিটি জীবকে বলছি
একাত্তরে বেয়নেট বিদ্ধ সেই ,পচা গলিত মাছি ভন ভন
নসিমন আর করিমনদের লাশের দুর্গন্ধ এখন
সুরভিত সুমিষ্ট মৌ মৌ গন্ধবিধূর!
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে গোলাপের পাপড়িসহ
সে বাতাস দোল খাচ্ছে এক অপূর্ব মহিমায়।

লজ্জা পেও না এলেক্সিস জনসন, লজ্জা পেও না হেনরি কিসিঞ্জার
তোমাদের লজ্জা পাওয়া ও মুখের লাল আভা গোলাপের পাপড়িতে
লীন হয়ে দোলায় দোলায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে
তলানীর পাটাতন এখন নিশ্ছিদ্র।

স্বীকৃতি
আদিত্য নজরুল

আমি আজ অনেক কিছুই উৎসর্গ করে দেবো...

কেউ কেউ তো
তার প্রেমিকাকে একটি বই
উৎসর্গ করে দিয়ে
ভালোবাসার ঐতিহ্য বহন করতে চায়।

কেউ কেউ
মতালোভী হয়েও বলে
নিজেকে সে উৎসর্গ করেছে
দেশ ও জাতির নামে।

আজ আমি সত্যি সত্যি
নিজেকে বিপন্ন করে
অনেক কিছুই উৎসর্গ করে যেতে ।

ভালোবাসা আমি বিরহকে উৎসর্গ করে দিলাম।

এক খণ্ড বাংলাদেশ
নূরে জান্নাত

পাক ধরা চুলে রাস্তার এক কোণে
বকুল গাছটার নিচে অবহেলিত বৃদ্ধা
প্রতিদিন আঁকিবুঁকি করে
মাটি এবং পাটশোলাই।
কেউ পাগল বলে, কেউ বলে দুঃখী
কেউবা বলে পাক হানাদারের রক্ষিতা!
ওরা মূলত জানেই না- ও নারী রক্ষিতা
ছিল না- ছিল বীরাঙ্গনা!
শকুনেরা তিরষ্কারে জিজ্ঞেস করে একদিন
কী করো মাটিতে প্রতিদিন?
বৃদ্ধা দাঁতহীন মাড়িতে খলখলিয়ে
হেসে উঠে বলে...
ইতিহাস অ্যাঁইকত্যাছি- মুক্তিযুদ্ধ
অ্যাঁইকত্যাছি
শ্যাখ মুজিবের বোহের মদ্যে একখণ্ড
বাংলাদেশ অ্যাঁইকত্যাছি।

একদিন নিঃশব্দে
সূর্য ডোবার মতো
আফিফ জাহাঙ্গীর আলি

একসুতোর জ্বলন্ত মোমের মতো জীবন-
জীবদ্দশায় কেউ নেভাতে পারে না!
মনের কোণে লালিত ইচ্ছেগুলো-
রোপণ করে যেতে চাই উর্বর মৃত্তিকায়
যদি তরূ জন্মে- ক্লান্ত পথিক জিরিয়ে নেবে তার ছায়ায়,
আঁজলাভরা পিপাসার জল কারো চোখের সাগরে ঢেলে
লুকানো বিষাদ ভাসিয়ে দেবো জলে পানাফুলে,
মায়াবী প্রকৃতির মুগ্ধতায়
জোড়ানেত্র প্রদান করে যেতে চাই নীলিমায়
যেখানে আকাশ ছুঁয়েছে দিগন্তের অবারিত খোলা মাঠ
গোধূলিক্ষণে স্বর্ণালি সাঁঝতল পেরিয়ে-
উড়ে উড়ে পাখি ফিরে শান্তির নীড়ে
যখন সন্ধ্যাতারা জ্বলে উঠে রাতের আমন্ত্রণে
আদিগন্ত আকাশের তারায় তারায়-জ্যোৎস্নালোকিতে,
কণ্টকাকীর্ণ যে পথে হাঁটি
সে পথ চাই নীলাকাশের ন্যায় নিরাপদ মায়ের আঁচল
একদিন নিঃশব্দে সূর্য ডোবার মতো নিভে হারিয়ে যাবো।

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

tab

সাময়িকী

সাময়িকী কবিতা

বৃহস্পতিবার, ০৪ মে ২০২৩

কোমায় শুয়ে আছে

বন্ধু, ছুটির দিনে

হাসান কল্লোল
(সুহৃদ অনুজ বন্ধু সদ্য প্রয়াত ‘লিটন’কে নিবেদিত)

নীরবতার কোলে মাথা রেখে তুমি শুয়ে আছ
চোখগুলো কাচের গ্লাসে রাখা পানির ওপর ভাসছে।
দ্রাঘিমা রেখা চলে গেছে যেন তোমার কোমল বুকের ওপর দিয়ে-
যাবতীয় জামা জুতা প্রসাধনী প্রদর্শনীতে যাবে
আড়মোড়া ভেঙে জাগছে তাই হেমন্তের সকালে

একটা মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে এবং
কেউ যখন কোমায় থাকে তারা মূলত
এক ট্রেনের টিকেট কেটেও, পাশাপাশি বসতে পারে না!
কখনো বড়জোর একজন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে
কম্পার্টমেন্টে সারারাত ভালোবাসা হয়ে!

ট্রেন চঞ্চলতা সাথে করে নিয়ে যায়
তার নীরব অভিমান স্টেশনে পড়ে থাকে
অভুক্ত পুরাতন ভিখারীর পাশে
পড়ে থাকে নুড়িপাথর আরোগ্যের ক্যাপসুল হয়ে,
শীতের পাখিরা ফের আসবে বলে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাই মানুষ সাজিয়ে রাখে
নিরিবিলি জলজ বিছানা!
মানুষেরা কথা দিয়ে ভুলে যায় আর
ইতিহাসের বইয়ের মলাটে বিশ্বাসঘাতকতা
অট্টহাসিতে ষোলখান হয়ে নাচে-

কোমায় শুয়ে আছে বন্ধু, ছুটির দিনে
তার সজীব প্রত্যাবর্তনের জন্য তবু কিছু
চোখের বিশালতা, সজনে ফুলের জন্য অপেক্ষা করে!

শোকেরা নীরবে
হেঁটে আসে

জাহিদ মুস্তাফা

বারুদগন্ধময় ত্রাসে অগ্নিএকাত্তরে
জনপদে মৃত্যু এসে নেমেছিল
কালরাতের আঁধারে!
অনাকাক্সিক্ষত রক্তের আলপনা
এঁকেছিল যারা বাংলার পৃষ্ঠায়
সেই পংগপালের ঝাঁক এখনও রয়ে গেছে
আমাদের সমবেত ঘৃণার আগুনে
তাদের বিদ্বেষগুলো পুড়ে যাক, পুড়ে যাক।
শোকেরা নীরবে হেঁটে আসে
ভোরের আলোয় একে একে জড়ো হয় মানুষেরা বিদায়ী-কান্নায়।
আজরাইল তো কড়া নাড়ে জীর্ণ চৌকাঠে
বলে- বাড়ি আছ কে কে
শোধবোধ জীবনের দায়- চলো যাই
তেপান্তরের পরে অনন্ত মৃত্যুর হাটে।

স্বজনের লাশ বুকে তুলে নিয়ে পাথরের শোকে
শোকাহত হতে হতে এই বেঁচে থাকা!

উড়ালের গান
সোহরাব পাশা

বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ
তখনো ফোটেনি ভোর

ঘুম নেই, জেগে থাকে দুঃস্বপ্নের রাত
ছায়াছন্ন বারান্দায় বন্য নেকড়ের
কোলাহল
ভয়ানাক ক্ষিপ্রস্বর
ওড়ে তীব্র রুক্ষশীত

বিহ্বল পায়ের কাছে চোখের আগুন
পোড়া হৃৎপিণ্ডে অন্ধকীট

মানুষ ভোলে না রৌদ্রের তুমুল ঘ্রাণ
সুন্দরের বিশুদ্ধ উপমা

জীবন কেবল মৃত্যুর যাপন নয়
উড়ালের গান
রাতদুপুরে পথগুলো বাজায় বাঁশি

সমুদ্রপ্রবণ
মতিন রায়হান

হিম হিম শীত
তোমার উষ্ণতা পাই
বিস্মৃতিতে!
ফোটে হৃদয়কুসুম
কী যে শোভা তার
যে দেখে সে দেখে
যে শেখে সে শেখে
তুমিও যে শিখেছিলে
শিশির-প্রভাতে
লেলিহান অগ্নিময় খেলা
কাঁপে বুক
ধুকপুক
ফণা তোলা অন্ধকার
ডুবে যায় নদী
গগন অবধি
আমি তো মানুষ
সমুদ্রপ্রবণ
উত্তাল-উত্তুঙ্গঢেউ
ফেনারাশি
যে বাসে, বাসুক
পুষুক অন্তরে
রক্তজবা-স্মৃতি
কী নাম দেবে গো তার
মৃত্যু-নদী?
তোমার উষ্ণতা পাই
নিত্য যদি!

তোমার উচিত ছিল
মোহাম্মদ হোসাইন

তোমার উচিত ছিল রৌদ্রে একটু দাঁড়ানো

চারপাশ থেকে রৌদ্ররা লাল পতাকা নিয়ে আসছে হাসছে, খেলছে
তোমার উচিত ছিল রৌদ্রে একটু দাঁড়ানো

পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তিরতির হাওয়া, জলপাই রং নদী, তোমার উচিত ছিল... তোমার উচিত ছিল...

ধান ক্ষেত শুয়ে আছে সোনালি ধানের গন্ধ বুকে নিয়ে, টুকটুকে লাল ঠোঁটে কী অপরূপ মাধুর্যে গান গাইছে শিরিষের বন, মধুফুল- তার পাশে দাঁড়ানো তোমার উচিত ছিল...

তোমার উচিত ছিল সবুজ শিশুর পাশে দাঁড়ানো
তার নরম গাল টিপে দেওয়া তোমার উচিত ছিল
উচিত ছিল একটু রৌদ্রে দাঁড়ানো
পাশ দিয়ে কত মানুষ, কত বেহালা, কত সুর উঁকি দিয়ে যাচ্ছে- তোমার উচিত ছিল তাদের কাছে দাঁড়ানো
নতুন বউ যাচ্ছে কাছে থেকে, মৃত্যুও যাচ্ছে তুড়ি মেরে মেরে, পাখির পালক বরাবর কত হত্যা ম্লান দাঁড়িয়ে আছে- তোমার উচিত ছিল তাদের পাশে দাঁড়ানো... উচিত ছিল একটু কাঁধ ছুঁয়ে দেওয়া

আমাদের কী আছে আর... উচিত ছিল... উচিত ছিল... এই সুবর্ণ সময়ে
এইটুকু করা খুব উচিত ছিল...

তোমার উচিত ছিল রৌদ্রজলে মুখ ধুয়ে নেওয়া...!

সান্তালপাড়ায় সুপারমুন
মিলটন রহমান

একটি রুমাল দে
ঢকে দিই চাঁদের মুখ
গলে গলে যে রূপঙ্কর মূর্তমান হচ্ছে
ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রান্তর
তার সাথে আমার পিঞ্জরাবদ্ধ সম্পর্ক নেই
আমি চাঁদের মত একা
গলে পড়ি একা
চোখের কার্নিশ বেয়ে যে জল গড়িয়ে পড়ছে
তাকে বিভ্রমে সোনালি মনে হলেও
সেখানে রয়েছে কৃষ্ণগহব্বর
ওরে আমি কোথাও আলো দেখি না
প্রলম্বিত অন্ধকার হয়ে উঠছে গ্রীবাময়
আমি কি অন্ধ হয়ে গেলাম, নাকি তুমি,
তোমার আমার চাঁদ দেখার চোখ এক নয়
চাঁদের আলো দেখার জন্য
মাছের চোখের মত জ্বলছে আমার চোখ
তোমার চোখে উড়ছে সোনালি পারদ
চলো আজ আর চাঁদ দেখাদেখি নয়
আগে নিজেদের চোখ এক করি

বিজয় স্তম্ভ
শামস হক

আমি রেসকোর্স ময়দানের বিজয়স্তম্ভের সম্মুখে দাঁড়িয়ে
শপথ করে বলছি এটা পৃথিবীর সেরা স্তম্ভ।
এটা সর্বোচ্চ, গগনচুম্বী এবং সুকঠিন।
শক্তিশালী দুবাহু- পেশীর মধ্যভাগের স্ফীত শিরার এক সুদঢ় মস্তক যা দুর্দমনীয়।
কবি যাকে বলেছেন,
“কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।”

আমি সূর্য শপথ করে বলছি
এই স্তম্ভ কোনো মাটিতে নির্মিত নয়, জমাট বাঁধা রক্তের শিলাখণ্ডে
এর ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপিত
রিক্টর স্কেলের শেষ ঝাঁকুনিও একে টলাতে পারেনি।

আমি আত্মবলীয়ান হয়ে বলছি, পুবের ঐ সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের দিকে তাকাও
দেখো তো কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ঐ সব
বরাহ-জাতকদের চিনতে পারো কিনা!
ইয়াহিয়া, ভুট্ট, টিক্কা?
হ্যাঁ, ঠি...ক ধরেছো।

আমি উদাত্ত কণ্ঠে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরের, প্রতিটি জীবকে বলছি
একাত্তরে বেয়নেট বিদ্ধ সেই ,পচা গলিত মাছি ভন ভন
নসিমন আর করিমনদের লাশের দুর্গন্ধ এখন
সুরভিত সুমিষ্ট মৌ মৌ গন্ধবিধূর!
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে গোলাপের পাপড়িসহ
সে বাতাস দোল খাচ্ছে এক অপূর্ব মহিমায়।

লজ্জা পেও না এলেক্সিস জনসন, লজ্জা পেও না হেনরি কিসিঞ্জার
তোমাদের লজ্জা পাওয়া ও মুখের লাল আভা গোলাপের পাপড়িতে
লীন হয়ে দোলায় দোলায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে
তলানীর পাটাতন এখন নিশ্ছিদ্র।

স্বীকৃতি
আদিত্য নজরুল

আমি আজ অনেক কিছুই উৎসর্গ করে দেবো...

কেউ কেউ তো
তার প্রেমিকাকে একটি বই
উৎসর্গ করে দিয়ে
ভালোবাসার ঐতিহ্য বহন করতে চায়।

কেউ কেউ
মতালোভী হয়েও বলে
নিজেকে সে উৎসর্গ করেছে
দেশ ও জাতির নামে।

আজ আমি সত্যি সত্যি
নিজেকে বিপন্ন করে
অনেক কিছুই উৎসর্গ করে যেতে ।

ভালোবাসা আমি বিরহকে উৎসর্গ করে দিলাম।

এক খণ্ড বাংলাদেশ
নূরে জান্নাত

পাক ধরা চুলে রাস্তার এক কোণে
বকুল গাছটার নিচে অবহেলিত বৃদ্ধা
প্রতিদিন আঁকিবুঁকি করে
মাটি এবং পাটশোলাই।
কেউ পাগল বলে, কেউ বলে দুঃখী
কেউবা বলে পাক হানাদারের রক্ষিতা!
ওরা মূলত জানেই না- ও নারী রক্ষিতা
ছিল না- ছিল বীরাঙ্গনা!
শকুনেরা তিরষ্কারে জিজ্ঞেস করে একদিন
কী করো মাটিতে প্রতিদিন?
বৃদ্ধা দাঁতহীন মাড়িতে খলখলিয়ে
হেসে উঠে বলে...
ইতিহাস অ্যাঁইকত্যাছি- মুক্তিযুদ্ধ
অ্যাঁইকত্যাছি
শ্যাখ মুজিবের বোহের মদ্যে একখণ্ড
বাংলাদেশ অ্যাঁইকত্যাছি।

একদিন নিঃশব্দে
সূর্য ডোবার মতো
আফিফ জাহাঙ্গীর আলি

একসুতোর জ্বলন্ত মোমের মতো জীবন-
জীবদ্দশায় কেউ নেভাতে পারে না!
মনের কোণে লালিত ইচ্ছেগুলো-
রোপণ করে যেতে চাই উর্বর মৃত্তিকায়
যদি তরূ জন্মে- ক্লান্ত পথিক জিরিয়ে নেবে তার ছায়ায়,
আঁজলাভরা পিপাসার জল কারো চোখের সাগরে ঢেলে
লুকানো বিষাদ ভাসিয়ে দেবো জলে পানাফুলে,
মায়াবী প্রকৃতির মুগ্ধতায়
জোড়ানেত্র প্রদান করে যেতে চাই নীলিমায়
যেখানে আকাশ ছুঁয়েছে দিগন্তের অবারিত খোলা মাঠ
গোধূলিক্ষণে স্বর্ণালি সাঁঝতল পেরিয়ে-
উড়ে উড়ে পাখি ফিরে শান্তির নীড়ে
যখন সন্ধ্যাতারা জ্বলে উঠে রাতের আমন্ত্রণে
আদিগন্ত আকাশের তারায় তারায়-জ্যোৎস্নালোকিতে,
কণ্টকাকীর্ণ যে পথে হাঁটি
সে পথ চাই নীলাকাশের ন্যায় নিরাপদ মায়ের আঁচল
একদিন নিঃশব্দে সূর্য ডোবার মতো নিভে হারিয়ে যাবো।

back to top