alt

সাময়িকী

জাহাজী বাড়ি

শিপা সুলতানা

: বৃহস্পতিবার, ০৪ মে ২০২৩

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

সবুজ সবুজ দ্বীপের মতো একেকটি বাড়ি গ্রামের ভেতর। ঘাসে ছাওয়া, গাছে ছাওয়া, অহেতুক বনবাদাড়ে ছাওয়া বাড়িগুলো অভিশপ্ত বিধবার মতো নিঃসঙ্গ।

মানুষের যেমন মানুষ লাগে, জলের যেমন জল, বাড়িদেরও বাড়ি লাগার কথা, তা না, চ্যাপ্টা, ফ্ল্যাট, বিস্তৃত গ্রামে শুধু সবুজ আর সবুজ। দূরদূরান্তে একেকটি বাড়ি। এই যে পুরোদস্তুর মাঘ মাস, তবু গ্রামখানি বিদঘুটে সবুজ। প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে শিম লাউয়ের মাচা, শিমের ভারে, পাতার ভারে পড়ো পড়ো এক একটি মাচার দিকে দূর থেকে তাকালে মনে হবে কালো কালো শয়তানেরা লোমশ শরীর নিয়ে খাপ ধরে বসে আছে, আপনি যাবেন আর খপ করে গিলে ফেলবে, কেউ দেখবে না, কেউ বাঁচাবে না কারণ এই শীতেও লকলকে ভেজা ঘাসে আপনার পা অবশ হয়ে পড়বে।

আমাকে ঠিক নীনা আপার কবরের পাশে কবর দেয়া হচ্ছে। রাত কি দিন আমি বুঝতে পারছি না, সবকিছু মহিষের দইয়ের মতো ঘন আর ভারি! আমি ছোট আব্বুর হাত ধরতে চাইছি বারবার, বারবার বলতে চাইছি বাবুকে নিয়ে আমি নীনা আপার সাথে মাটিতে শুবো না, বাবুর ঠাণ্ডা লাগবে

এইরকম দ্বীপের মতো একটা বাড়ি আমাদের। এক ঘরেই একটা বাড়ি। তিন ভাইয়ের এক সংসার। সেই ঘরগুলোতেও পাল পাল বাদামী শয়তান।

বাড়ির ভেতর ঢোকার পর এতোটা খারাপ আর লাগছে না। ভেতরটা গোছানো লেপাপুছা বলে কেমন একটু উষ্ণ, বাইরে থেকে যেমন সব বাড়িকে একই রকম মনে হয়, ভেতরে ঢুকতে পারলে রক্ষা।

দোতলা কাঠের ঘরটিতে আটটি কক্ষ। কালো মিশমিশে একটি ঘর। যতই আনন্দ হোক, ভাল কিছু ঘটুক, ঈদ অথবা বিবাহ, বাড়িটা যেনো জেগে ওঠে না, বাড়িটা যেনো শ্বাসকষ্টের রোগী। জাহাজের কালো কালো কাঠের বীমে যেন ডুবে যাওয়া মানুষের অভিশাপ খোঁদাই করে রাখা। যদিও শুনেছি ‘এক কথা আর এক চরিত্রে’র মানুষ ছিলেন দাদাজী, মনসুর আলী জাহাজী। নাবিক টাবিক কেউ বলে না, জাহাজীই বলে। বাড়ির গদা গদা বীমগুলো এমনই ক্ষমতাধর যে মনসুর আলীর তিন ছেলেকে বাড়ির বাইরে চাকরি করতে দেয় নাই। এরা তাদের দাদার বাণিজ্য, ধানী জমি, ফসলী ক্ষেত, ফলের বাগান আর বাপের সুনাম খেতে খেতে কুঁজো হয়ে গেছে, ভীত হয়ে গেছে। যদিও তার উপর নেমপ্লেট বসিয়েছে ‘ব্যক্তিত্ব’। তাদের ব্যক্তিত্বে বাইরে গিয়ে কাজ করা মানায় না।

রোদ উঠি উঠি করছে, হয়তো উঠেই গেছে কিন্তু কুয়াশার কারণে বাইরে আসতে পারছে না। পুরো গ্রামখানি কুয়াশার ভারে উবু হয়ে আছে, যেনো জলে ভেজা ভারি একটি কাঁথা বিছিয়ে রেখেছে কেউ গ্রামের উপর। এমন ভারি আর ভেজা ভেজা ভোরে দাদিজি বাড়ি থেকে বের হলে গাছের চারাদের, এক জায়গায় জমে থাকা ঘাসের ঢিবিকে, গুচ্ছ গুচ্ছ সরিষার ঝোপকেও নাতী নাতনী মনে করে আদর করে ডাক দিতেন! ভাবতেন নাতি নাতনীরা বাড়ির বাইরে বসে রোদ পোহাচ্ছে!

উঠানে আমি একাই দাঁড়িয়ে আছি, একেবারে একা। এত ভোরে কেউ ওঠে না এই বাড়িতে। যদিও সকলেই হজ্ব করে হাজী হয়েছে, সেটা হয়েছে তাদের ভারের সাথে ধার বাড়াতে, তাই বলে নামাজের ওক্তে মসজিদে যেতে হয় না। ঘরে না ঢুকে উঠান ঘুরে বাড়ির পিছনের ছোট উঠানটিতে গেলাম আমি, এইদিকে আরেকটি উঠান, দুই সারি সুপারি গাছ, তারপর থেকেই ধানী জমি, জমির এক কোনায় বর্গাচাষী বজলু চাচা, কুদ্দুস চাচাদের বাড়ি। বাড়ির লাগোয়া খাল, খাল ভরা বোয়াল আর বাঁশপাতা মাছ, রানীমাছ। মনসুর আলীর তিন পুত্রই ধূর্ত শিকারী।

বোয়াল শিকারী। একেকজনের চোখ ফাঁকি দেয়ার সাধ্য নাই জলের মাছেদের। সেই খাল তথা নদীর উপর মহিষের দইয়ের মতো কুয়াশা জমে প্রতি বছর। নদী না দধির খাল টের মিলে না, যেমন মিলে না অন্ধকারের পরে কী আছে ঐপারে!

মিশু ভাই...প্লিজ না... না মিশু ভাই...

পরেরবার তাও বলি না আর। শেষরাত, গাড়ির বাইরে ঘন ঠাণ্ডা, ঘন কুয়াশা। আমি কোথায় যাবো বেরিয়ে, আমার সাহস হয় না, আমার পা চলে না। আমার বমি আসে। মিশু ভাই আমার ভাসুর, একই বাড়িতে, একই পাতিলে খেতে হবে আজীবন। আমি পরেরবার জ্ঞান হারাই...

আমার ক্ষুধা লাগে, বমি বমি ভাবের পরেও খুব ক্ষুধা লাগে। রান্নাঘরে কি নাস্তা হচ্ছে কে জানে, চাচাত দুই বোন ছাড়া কেউ আমাকে দেখতে আসেও নাই। তারা চিতল পিঠা চিবুতে চিবুতে দেখতে আসছে কিন্তু ভেতরে ঢুকে নাই। মনসুর আলীর তিন ছেলেই এখন রান্নাঘরের টেবিলে, কেউ কারো মুখের দিকে তাকাবে না, কেউ কারো বউ ছাড়া আর কারো কাছে নুনটাও চাইবে না, কেউ কোনো অভিযোগ বা আনন্দও করবে না একসাথে, কিন্তু এক পাতিলে একভাতে খাবে। কেবল সম্মানের উপর আঘাত এলে এক সাথে দাঁড়াবে যেন এক সারি গুহাবাসী শয়তান। মেজো চাচার বড় ছেলে যখন আত্মহত্যা করলো, তিন ভাই জপতে লাগলো তার ডায়েরিয়া হয়েছিলো, ছোট চাচার মেয়ে যখন আত্মহত্যা করলো, তার নাকি কিডনি বিকল হয়ে গেছিলো। আমি আত্মহত্যা করতে পারবো না বলে বাড়িই ফিরলাম না, হল থেকে সোজা গিয়ে উঠলাম নিশুদের মানে ফুফুর বাড়ি। পালিয়ে যাবার পর যে ফুফু গত ত্রিশ বছরেও বাপের ভিটায় পা রাখতে পারেন নাই, মৃত মায়ের মুখ দেখতে পান নাই মানে গ্রামেই ঢুকতে পারেন নাই, সেই ফুফুর বাড়ি গেলেন ছোট চাচা। পুরনো বিবাদ কন্টিনিউ করতে চান না, আমি অলরেডি প্রেগনেন্ট, এখনো গ্রামের কেউ কিছু জানে না, নতুন করে বিবাহানুষ্ঠান হবে।

বিরাট আয়োজন হবে, ধুমধাম করে বিয়ে হবে, ফুফু নিজে গিয়ে বউ তুলে আনবেন। ছোট বাবা ‘আশা’ নিয়ে ফিরে গেলে আমি ফুফুর পায়ে উপুড় হয়ে পড়ি, কবির ভাই আর নীনা আপার কথা বলি, বলি আমাকে না পাঠাতে, আমাকেও মেরে ফেলা হবে।

বাপের বাড়ি যাবার লোভ চক চক করে উঠে ফুফুর চোখে, ত্রিশ বছর পর বাপের ভিটায় যাবেন, বাপ মায়ের কবর দেখবেন!

নিশু যাওয়া নিরাপদ না, ফুফু তার ভাইদের চিনেন, মনে কু তো ডাকছেই, তাই পাঁচ দিন পর মধ্যরাতে মিশু ভাই আমাকে নিয়ে ড্রাইভ করে রওয়ানা দেয় বাইশ মাইল দূরের পথে, ভোরের আগে আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আসবে, গ্রামের কেউ টের পাবে না। পথে থেমে থেমে দুইবার মিশু ভাই...

আমি কেবল ভাবছিলাম শহরে গিয়ে কোন নিশুর সাথে দেখা হলো, ফুফাত ভাই হয় জেনে ফুফুর প্রতি করা সব অবিচার কেন আমি একা শুধরাতে গেলাম! আমি কি সব কিছু বলে দিবো নিশুকে...

ঘরের কোথাও কি আনারসের ভর্তা হচ্ছে! পুড়া রসুন আর বিলাতি ধনেপাতা দিয়ে আনারস ভর্তা। এই অসময়েও এই বাড়ির আনাচে কানাচে প্রচুর আনারস হয়, কে এমন সকাল সকাল ভর্তা খাচ্ছে! ক্ষুধা মরে গিয়ে ভর্তার জন্য মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো আমার।

সারাদিন এক টক খাবার নেশা নির্লজ্জ করে ফেলছে আমাকে! শোবার ঘর থেকে বের হতে গিয়ে টের পাই ট্রেতে করে আম্মা চিতই পিঠা আর হাঁসের মাংস নিয়ে ঢুকছেন, পাশেই একটা বাটিতে অল্প করে আনারস ভর্তা, সেটা হয়তো চেয়ে নিয়ে আসছেন টিনা লীনা কাছ থেকে। আমার লজ্জা লাগার কথা আম্মার সামনে, আম্মাও নিশ্চয় জানেন আমি প্রেগনেন্ট, চাচাই তো বললেন আম্মা আকুল হয়ে কাঁদতেছেন আমার জন্য, না হলে বাবা চাচারা কেউ রাজি হতো না এইসবে। আমি আম্মার দিকে তাকাই, অভিযোগ অভিমান বা কিছুই লেখা নেই সেখানে, হয়তো শকড, আমি জড়িয়ে ধরতে যাই তাকে, আম্মা পিছিয়ে যান-

- নাস্তা খাও, খেয়ে গোছল করো, বিকেলে তোমার গায়ে হলুদ।

আম্মা বেরিয়ে যান, আমি পাগলের মতো আনারসের বাটি টেনে নেই হাতে। ফুফু আম্মা বলেন ছেলে বাবু হবে বলে এতো টক খাচ্ছি আমি, মেয়ে বাবু হলে ঝাল খেতাম। আর টক খেলে বমি কন্ট্রোল থাকে বলে অন্য কিছু অল্প হলেও খেতে পারি।

আশেপাশে মেহমান কাউকেই দেখছি না, মেহমানেরা কি বিকেলে আসবে? এত দ্রুত নাকি কার্ড ছাপানো যাবে না, বন্ধুদের কাউকে জানাতেও পারলাম না! মেহমানেরা হয়তো অন্য ঘরে, হয়তো দুপুরের পর থেকে আসতে থাকবেন, তবু উঠে গিয়ে গোছল করা দরকার। গোছল করতে হবে নিচতলায় গিয়ে, আমার যদিও মিশু ভাইয়ের উপর কোনো ঘেন্না বা রাগ হচ্ছে না, রাগ হলে বাবুর ক্ষতি হয়, তবু উঠে দাঁড়ালাম, তারপর নিচে যেতে গিয়ে মনে হলো পাখির পালকের মতো ভেসে ভেসে মেঝেতে পড়ে গেলাম আমি।

আমাকে ঠিক নীনা আপার কবরের পাশে কবর দেয়া হচ্ছে। রাত কি দিন আমি বুঝতে পারছি না, সবকিছু মহিষের দইয়ের মতো ঘন আর ভারি! আমি ছোট আব্বুর হাত ধরতে চাইছি বারবার, বার বার বলতে চাইছি বাবুকে নিয়ে আমি নীনা আপার সাথে মাটিতে শুবো না, বাবুর ঠাণ্ডা লাগবে, টেবিলের উপর চিতই পিঠা শক্ত হয়ে যাচ্ছে, আর আনারস খাবো না, আনারস এত তিতা কেন, আমার গলা জ্বলে যাচ্ছে! ছোট আব্বু মিথ্যে বলতেছো কেন? আমার টাইফয়েড হয়েছিলো হলে থাকতে? আমার তো শরীর ভিজে যাচ্ছে রক্তে, ছোট আব্বু আমার ঠাণ্ডা লাগতেছে খুব...

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

জাহাজী বাড়ি

শিপা সুলতানা

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ০৪ মে ২০২৩

সবুজ সবুজ দ্বীপের মতো একেকটি বাড়ি গ্রামের ভেতর। ঘাসে ছাওয়া, গাছে ছাওয়া, অহেতুক বনবাদাড়ে ছাওয়া বাড়িগুলো অভিশপ্ত বিধবার মতো নিঃসঙ্গ।

মানুষের যেমন মানুষ লাগে, জলের যেমন জল, বাড়িদেরও বাড়ি লাগার কথা, তা না, চ্যাপ্টা, ফ্ল্যাট, বিস্তৃত গ্রামে শুধু সবুজ আর সবুজ। দূরদূরান্তে একেকটি বাড়ি। এই যে পুরোদস্তুর মাঘ মাস, তবু গ্রামখানি বিদঘুটে সবুজ। প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে শিম লাউয়ের মাচা, শিমের ভারে, পাতার ভারে পড়ো পড়ো এক একটি মাচার দিকে দূর থেকে তাকালে মনে হবে কালো কালো শয়তানেরা লোমশ শরীর নিয়ে খাপ ধরে বসে আছে, আপনি যাবেন আর খপ করে গিলে ফেলবে, কেউ দেখবে না, কেউ বাঁচাবে না কারণ এই শীতেও লকলকে ভেজা ঘাসে আপনার পা অবশ হয়ে পড়বে।

আমাকে ঠিক নীনা আপার কবরের পাশে কবর দেয়া হচ্ছে। রাত কি দিন আমি বুঝতে পারছি না, সবকিছু মহিষের দইয়ের মতো ঘন আর ভারি! আমি ছোট আব্বুর হাত ধরতে চাইছি বারবার, বারবার বলতে চাইছি বাবুকে নিয়ে আমি নীনা আপার সাথে মাটিতে শুবো না, বাবুর ঠাণ্ডা লাগবে

এইরকম দ্বীপের মতো একটা বাড়ি আমাদের। এক ঘরেই একটা বাড়ি। তিন ভাইয়ের এক সংসার। সেই ঘরগুলোতেও পাল পাল বাদামী শয়তান।

বাড়ির ভেতর ঢোকার পর এতোটা খারাপ আর লাগছে না। ভেতরটা গোছানো লেপাপুছা বলে কেমন একটু উষ্ণ, বাইরে থেকে যেমন সব বাড়িকে একই রকম মনে হয়, ভেতরে ঢুকতে পারলে রক্ষা।

দোতলা কাঠের ঘরটিতে আটটি কক্ষ। কালো মিশমিশে একটি ঘর। যতই আনন্দ হোক, ভাল কিছু ঘটুক, ঈদ অথবা বিবাহ, বাড়িটা যেনো জেগে ওঠে না, বাড়িটা যেনো শ্বাসকষ্টের রোগী। জাহাজের কালো কালো কাঠের বীমে যেন ডুবে যাওয়া মানুষের অভিশাপ খোঁদাই করে রাখা। যদিও শুনেছি ‘এক কথা আর এক চরিত্রে’র মানুষ ছিলেন দাদাজী, মনসুর আলী জাহাজী। নাবিক টাবিক কেউ বলে না, জাহাজীই বলে। বাড়ির গদা গদা বীমগুলো এমনই ক্ষমতাধর যে মনসুর আলীর তিন ছেলেকে বাড়ির বাইরে চাকরি করতে দেয় নাই। এরা তাদের দাদার বাণিজ্য, ধানী জমি, ফসলী ক্ষেত, ফলের বাগান আর বাপের সুনাম খেতে খেতে কুঁজো হয়ে গেছে, ভীত হয়ে গেছে। যদিও তার উপর নেমপ্লেট বসিয়েছে ‘ব্যক্তিত্ব’। তাদের ব্যক্তিত্বে বাইরে গিয়ে কাজ করা মানায় না।

রোদ উঠি উঠি করছে, হয়তো উঠেই গেছে কিন্তু কুয়াশার কারণে বাইরে আসতে পারছে না। পুরো গ্রামখানি কুয়াশার ভারে উবু হয়ে আছে, যেনো জলে ভেজা ভারি একটি কাঁথা বিছিয়ে রেখেছে কেউ গ্রামের উপর। এমন ভারি আর ভেজা ভেজা ভোরে দাদিজি বাড়ি থেকে বের হলে গাছের চারাদের, এক জায়গায় জমে থাকা ঘাসের ঢিবিকে, গুচ্ছ গুচ্ছ সরিষার ঝোপকেও নাতী নাতনী মনে করে আদর করে ডাক দিতেন! ভাবতেন নাতি নাতনীরা বাড়ির বাইরে বসে রোদ পোহাচ্ছে!

উঠানে আমি একাই দাঁড়িয়ে আছি, একেবারে একা। এত ভোরে কেউ ওঠে না এই বাড়িতে। যদিও সকলেই হজ্ব করে হাজী হয়েছে, সেটা হয়েছে তাদের ভারের সাথে ধার বাড়াতে, তাই বলে নামাজের ওক্তে মসজিদে যেতে হয় না। ঘরে না ঢুকে উঠান ঘুরে বাড়ির পিছনের ছোট উঠানটিতে গেলাম আমি, এইদিকে আরেকটি উঠান, দুই সারি সুপারি গাছ, তারপর থেকেই ধানী জমি, জমির এক কোনায় বর্গাচাষী বজলু চাচা, কুদ্দুস চাচাদের বাড়ি। বাড়ির লাগোয়া খাল, খাল ভরা বোয়াল আর বাঁশপাতা মাছ, রানীমাছ। মনসুর আলীর তিন পুত্রই ধূর্ত শিকারী।

বোয়াল শিকারী। একেকজনের চোখ ফাঁকি দেয়ার সাধ্য নাই জলের মাছেদের। সেই খাল তথা নদীর উপর মহিষের দইয়ের মতো কুয়াশা জমে প্রতি বছর। নদী না দধির খাল টের মিলে না, যেমন মিলে না অন্ধকারের পরে কী আছে ঐপারে!

মিশু ভাই...প্লিজ না... না মিশু ভাই...

পরেরবার তাও বলি না আর। শেষরাত, গাড়ির বাইরে ঘন ঠাণ্ডা, ঘন কুয়াশা। আমি কোথায় যাবো বেরিয়ে, আমার সাহস হয় না, আমার পা চলে না। আমার বমি আসে। মিশু ভাই আমার ভাসুর, একই বাড়িতে, একই পাতিলে খেতে হবে আজীবন। আমি পরেরবার জ্ঞান হারাই...

আমার ক্ষুধা লাগে, বমি বমি ভাবের পরেও খুব ক্ষুধা লাগে। রান্নাঘরে কি নাস্তা হচ্ছে কে জানে, চাচাত দুই বোন ছাড়া কেউ আমাকে দেখতে আসেও নাই। তারা চিতল পিঠা চিবুতে চিবুতে দেখতে আসছে কিন্তু ভেতরে ঢুকে নাই। মনসুর আলীর তিন ছেলেই এখন রান্নাঘরের টেবিলে, কেউ কারো মুখের দিকে তাকাবে না, কেউ কারো বউ ছাড়া আর কারো কাছে নুনটাও চাইবে না, কেউ কোনো অভিযোগ বা আনন্দও করবে না একসাথে, কিন্তু এক পাতিলে একভাতে খাবে। কেবল সম্মানের উপর আঘাত এলে এক সাথে দাঁড়াবে যেন এক সারি গুহাবাসী শয়তান। মেজো চাচার বড় ছেলে যখন আত্মহত্যা করলো, তিন ভাই জপতে লাগলো তার ডায়েরিয়া হয়েছিলো, ছোট চাচার মেয়ে যখন আত্মহত্যা করলো, তার নাকি কিডনি বিকল হয়ে গেছিলো। আমি আত্মহত্যা করতে পারবো না বলে বাড়িই ফিরলাম না, হল থেকে সোজা গিয়ে উঠলাম নিশুদের মানে ফুফুর বাড়ি। পালিয়ে যাবার পর যে ফুফু গত ত্রিশ বছরেও বাপের ভিটায় পা রাখতে পারেন নাই, মৃত মায়ের মুখ দেখতে পান নাই মানে গ্রামেই ঢুকতে পারেন নাই, সেই ফুফুর বাড়ি গেলেন ছোট চাচা। পুরনো বিবাদ কন্টিনিউ করতে চান না, আমি অলরেডি প্রেগনেন্ট, এখনো গ্রামের কেউ কিছু জানে না, নতুন করে বিবাহানুষ্ঠান হবে।

বিরাট আয়োজন হবে, ধুমধাম করে বিয়ে হবে, ফুফু নিজে গিয়ে বউ তুলে আনবেন। ছোট বাবা ‘আশা’ নিয়ে ফিরে গেলে আমি ফুফুর পায়ে উপুড় হয়ে পড়ি, কবির ভাই আর নীনা আপার কথা বলি, বলি আমাকে না পাঠাতে, আমাকেও মেরে ফেলা হবে।

বাপের বাড়ি যাবার লোভ চক চক করে উঠে ফুফুর চোখে, ত্রিশ বছর পর বাপের ভিটায় যাবেন, বাপ মায়ের কবর দেখবেন!

নিশু যাওয়া নিরাপদ না, ফুফু তার ভাইদের চিনেন, মনে কু তো ডাকছেই, তাই পাঁচ দিন পর মধ্যরাতে মিশু ভাই আমাকে নিয়ে ড্রাইভ করে রওয়ানা দেয় বাইশ মাইল দূরের পথে, ভোরের আগে আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আসবে, গ্রামের কেউ টের পাবে না। পথে থেমে থেমে দুইবার মিশু ভাই...

আমি কেবল ভাবছিলাম শহরে গিয়ে কোন নিশুর সাথে দেখা হলো, ফুফাত ভাই হয় জেনে ফুফুর প্রতি করা সব অবিচার কেন আমি একা শুধরাতে গেলাম! আমি কি সব কিছু বলে দিবো নিশুকে...

ঘরের কোথাও কি আনারসের ভর্তা হচ্ছে! পুড়া রসুন আর বিলাতি ধনেপাতা দিয়ে আনারস ভর্তা। এই অসময়েও এই বাড়ির আনাচে কানাচে প্রচুর আনারস হয়, কে এমন সকাল সকাল ভর্তা খাচ্ছে! ক্ষুধা মরে গিয়ে ভর্তার জন্য মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো আমার।

সারাদিন এক টক খাবার নেশা নির্লজ্জ করে ফেলছে আমাকে! শোবার ঘর থেকে বের হতে গিয়ে টের পাই ট্রেতে করে আম্মা চিতই পিঠা আর হাঁসের মাংস নিয়ে ঢুকছেন, পাশেই একটা বাটিতে অল্প করে আনারস ভর্তা, সেটা হয়তো চেয়ে নিয়ে আসছেন টিনা লীনা কাছ থেকে। আমার লজ্জা লাগার কথা আম্মার সামনে, আম্মাও নিশ্চয় জানেন আমি প্রেগনেন্ট, চাচাই তো বললেন আম্মা আকুল হয়ে কাঁদতেছেন আমার জন্য, না হলে বাবা চাচারা কেউ রাজি হতো না এইসবে। আমি আম্মার দিকে তাকাই, অভিযোগ অভিমান বা কিছুই লেখা নেই সেখানে, হয়তো শকড, আমি জড়িয়ে ধরতে যাই তাকে, আম্মা পিছিয়ে যান-

- নাস্তা খাও, খেয়ে গোছল করো, বিকেলে তোমার গায়ে হলুদ।

আম্মা বেরিয়ে যান, আমি পাগলের মতো আনারসের বাটি টেনে নেই হাতে। ফুফু আম্মা বলেন ছেলে বাবু হবে বলে এতো টক খাচ্ছি আমি, মেয়ে বাবু হলে ঝাল খেতাম। আর টক খেলে বমি কন্ট্রোল থাকে বলে অন্য কিছু অল্প হলেও খেতে পারি।

আশেপাশে মেহমান কাউকেই দেখছি না, মেহমানেরা কি বিকেলে আসবে? এত দ্রুত নাকি কার্ড ছাপানো যাবে না, বন্ধুদের কাউকে জানাতেও পারলাম না! মেহমানেরা হয়তো অন্য ঘরে, হয়তো দুপুরের পর থেকে আসতে থাকবেন, তবু উঠে গিয়ে গোছল করা দরকার। গোছল করতে হবে নিচতলায় গিয়ে, আমার যদিও মিশু ভাইয়ের উপর কোনো ঘেন্না বা রাগ হচ্ছে না, রাগ হলে বাবুর ক্ষতি হয়, তবু উঠে দাঁড়ালাম, তারপর নিচে যেতে গিয়ে মনে হলো পাখির পালকের মতো ভেসে ভেসে মেঝেতে পড়ে গেলাম আমি।

আমাকে ঠিক নীনা আপার কবরের পাশে কবর দেয়া হচ্ছে। রাত কি দিন আমি বুঝতে পারছি না, সবকিছু মহিষের দইয়ের মতো ঘন আর ভারি! আমি ছোট আব্বুর হাত ধরতে চাইছি বারবার, বার বার বলতে চাইছি বাবুকে নিয়ে আমি নীনা আপার সাথে মাটিতে শুবো না, বাবুর ঠাণ্ডা লাগবে, টেবিলের উপর চিতই পিঠা শক্ত হয়ে যাচ্ছে, আর আনারস খাবো না, আনারস এত তিতা কেন, আমার গলা জ্বলে যাচ্ছে! ছোট আব্বু মিথ্যে বলতেছো কেন? আমার টাইফয়েড হয়েছিলো হলে থাকতে? আমার তো শরীর ভিজে যাচ্ছে রক্তে, ছোট আব্বু আমার ঠাণ্ডা লাগতেছে খুব...

back to top