alt

সাময়িকী

কূটনৈতিক মুক্তিযুদ্ধ

আবুল কাসেম

: বৃহস্পতিবার, ০৪ মে ২০২৩

(পূর্ব প্রকাশের পর)

পাঁচ.

জাতিসংঘ সঠিক দয়িত্ব পালন করেনি। মহাসচিব উথান্ট বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। বিশ্ব জনমতকে তিনি উপেক্ষা করেছেন। প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের প্রভাবে জাতিসংঘ তার যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। তখন সাধারণ পরিষদের সভাপতি আদম মালিক ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের গভীর বন্ধূত্ব। এ সম্পর্কও জাতিসংঘের যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা ডেকে আনে। অবশ্য ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে প্রায় একশ পৃষ্ঠার কভারেজ রয়েছে।

মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি দেশের প্রধান হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের বিরোধিতা ও চাপের কারণে তাকে ভাষণ দিতে দেয়া হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে ভারতের কপি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিলি করার অনুমতি প্রদান করা হয়।

প্রথম থেকেই জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট মার্চ মাসে বাংলাদেশ থেকে তাদের কর্মীদের প্রত্যাহার করে নেন। তিনি গণহত্যা বন্ধের কোনো উদ্যোগই নিলেন না। সাংবাদিকদের চাপের মুখে এপ্রিল মাসে তার এক মুখপাত্র বললেন, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে যে মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা মহাসচিব অবগত আছেন। মে মাসে তিনি পাকিস্তানে পত্র লেখেন। তাতে বলেন, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর ঢাকা থেকে জাতিসংঘের যেসব কর্মকর্তা ফেরত এসেছেন তাদের মাধ্যমে এবং অন্যান্য সূত্রের সাহায্যে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, পাকিস্তানে এক নেতিবাচক পরিস্থিত বিরাজ করছে। পাকিস্তানের সম্মতি পেলে জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থাগুলো এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।

এটুকু লিখেই জাতিসংঘ তার দায়িত্ব শেষ করে। অথচ প্রথম থেকেই ভারত ঢাকার পরিস্থিতি জানিয়ে জাতিসংঘে পত্র লেখে। শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য আবেদন জানায়। চার মাস পর জাতিসংঘ তার শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রধান প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানকে ঢাকায় পাঠায়। আগা খান ঢাকা থেকে দিল্লি যান। তিনি দেখে-শুনে যা বললেন, তা খুবই কার্যকরী বলা যাবে। তিনি বললেন, পূর্বপাকিস্তানে যতক্ষণ ভয়ের কারণসমূহ বিদ্যমান থাকবে, ততক্ষণ শরণার্থীরা ভারত থেকে ফেরত যাবে না।

মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি দেশের প্রধান হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের বিরোধিতা ও চাপের কারণে তাকে ভাষণ দিতে দেয়া হয়নি

২ আগস্ট জাতিসংঘ তার রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনাইটেড নেশনস ইস্ট পাকিস্তান, রিলিফ অপারেশন, সংক্ষেপে ‘ইউনিপোরও’ গঠন করে। বলা হয়, এই মিশন মানবিক বিপর্যয় রোধে কাজ করবে। শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করবে না। রিলিফের পাশাপাশি প্রয়োজন ছিল শান্তির। জাতিসংঘ এ কাজে এগিয়ে আসেনি।

জাতিসংঘ সিংহভাগ ত্রাণসামগ্রী পাঠায় পূর্ব পাকিস্তানে। এ ত্রাণসামগ্রী দুস্থ মানুষের কাজে আসেনি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে বলেছেন, পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি জান্তা জাতিসংঘের ত্রাণসামগ্রী লুট করেছে। অথচ ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের দেয়া আন্তর্জাতিক সাহায্য তাৎপর্যপূর্ণভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। বিরাট এক মানবিক বিপর্যয় থেকে এক কোটি শরণার্থী রক্ষা পেয়েছে।

এপ্রিল মাসের শেষের দিকে জাতিসংঘে তৎকালীন ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের আবেদন করেন। মহাসচিব মে মাসের মাঝামাঝি বিভিন্ন দেশের সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও জনসাধারণের প্রতি সাহায্যের আহ্বান জানান। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু দেশ এবং সংস্থা ভারতকে জুন মাস পর্যন্ত ২৬ কোটি ৩০ লাখ ৬ হাজার ডলার সাহায্য দান করে। আগস্টে জাতিসংঘ থেকেও ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্বপাকিস্তানের সীমান্তে ট্রানজিট ক্যাম্প খুলে দিয়ে শরণার্থীদের ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানান। তা ছিল লোক দেখানো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার জন্য। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরানো। কিন্তু প্রেসিডেন্টের এই চালাকি কাজে আসেনি।

জাতিসংঘের মহাসচিব মনে করেছিলেন, এতে শরণার্থী সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। পরে বুঝতে পারলেন তার ধারণা সঠিক নয়। জাতিসংঘের সংগঠনসমূহের বার্ষিক প্রতিবেদনে লিখলেন, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের দেশে ফিরে আসার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক আপসরফা, রাজনৈতিক পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন এবং ত্রাণ কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়ন। তিনি আরো বলেন, পরিস্থিতি এমন যে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের কারণে এমন এক দুষ্টচক্রের সৃষ্টি হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই ব্যাপক মানবিক সমস্যার মোকাবেলা করতে পারছে না।

তিনি দার্শনিকের মতো মানবিক বিপর্যয়ের গভীর তাৎপর্য অনুসন্ধান করেছেন। ইতিহাস ঘেঁটে বিপর্যয়ের গভীর তাৎপর্য উদ্ঘাটন করে বলেন, এক ধরনের ধ্বংসাত্মক মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। তাতে পুরো উপমহাদেশের ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক এ সমস্যার একটি দিক। রাষ্ট্রদ্বয়ের ভূখ-গত অখ-তা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে বিরোধের জের হিসেবে সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেশ দুটির মধ্যে বহু আত্মঘাতী সংঘাতের জন্ম হয়েছে। এসব ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে একটি অতিরিক্ত বিপদের দিক যুক্ত করেছে।

তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে উপলব্ধি করতেই ব্যর্থ হলেন। একে ভারত-পাকিস্তানের আত্মঘাতী সংঘাত বললেন। তার বক্তব্য পরে আরো স্পষ্ট করল যে, তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধকে আমলেই নেননি। তিনি বলেন, পূর্বপাকিস্তানের সীমান্ত পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। সীমান্ত সংঘাত, গুপ্ত আক্রমণ প্রভৃতি অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শরণার্থীরা এ সমস্যা সংকূল সীমান্ত অতিক্রম করে সমস্যা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

এতবড় একটা দায়িত্বশীল পদে বসে তিনি একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধকে বলছেন সীমান্ত সংঘাত, গেরিলা যুদ্ধকে বলেছেন গুপ্ত আক্রমণ এবং তা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা।

এসব দেখে মজা করে এক কূটনীতিক বলেছেন, জাতিসংঘ হচ্ছে একটি সামন্তবাদী রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান। এখানে যারা চাকরি করতে আসেন তাদের প্রভুভক্ত হতে হয়, বিপ্লবী হলে চলে না। এ মহাজ্ঞান সম্ভবত মহাজ্ঞানী মহাসচিব উথান্টেরও ছিল।

ছয়.

৩ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে বসে। শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। তাতে আন্তর্জাতিক বিশ্ব এবং পরাশক্তিগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। ভারতের পাশে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সামরিক এবং কূটনৈতিক উভয় ফ্রন্টে দেশটি তৎপর হয়ে ওঠে।

অপরদিকে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সহায়তা করার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা পাকিস্তান তার পূর্বাঞ্চল হারাচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানও যে অক্ষত থাকবে, বিশেষ করে কাশ্মীর, কারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই সে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে মুক্ত প্রায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পতন ঠেকানোর জন্য নৌ, বিমান ও স্থল তৎপরতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল তাতে বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌ-তৎপরতা বা অবরোধ ব্যর্থ হয়ে যাবে, ভারতীয় বিমান অভিযান প্রতিহত হবে এবং মার্কিন নৌ-সেনারা পাকিস্তানি স্থলবাহিনীর কাজে সহায়তা ছাড়াও নৌ এবং আকাশ পথে আক্রমণকারী যৌথবাহিনীকে ঠেকানো যাবে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তাদের নতুন বন্ধু চীনকে প্ররোচনা দেয় এরা যেন ভারতীয় সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করে ভারতের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। চীন এ ভুল করেনি। কারণ চীন-সৌভিয়েত সীমান্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন আগেই বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়োজিত করে রেখেছিল। শুধু তাই নয়, সপ্তম নৌবহর আসার আগেই ভারত মহাসাগরে সৌভিয়েত ইউনিয়ন ষষ্ঠ নৌবহর মোতায়েন করে ফেলে। তাদের ডুবোজাহাজগুলো অতন্ত্র প্রহরীর মতো বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে প্রহরা দিতে থাকে।

ডিসেম্বরে ভারতে আসেন সোভিয়েত সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান কুদরিয়াভেৎসেভ। তিনি সুপ্রিম সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

এ সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে সংগ্রাম চলছে তা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তি আন্দোলনে তাদের সঙ্গে থাকবে। আর ভারত আক্রমণ হলে তাকে সাহায্য করবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, সম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বর্তমান বন্ধুত্বে ভীত হয়ে পড়েছে। এরা সাম্প্রতিককালে স্বাক্ষরিত ভারত-সোভিয়েত চুক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাতে কোনো কাজ হবে না।

তারপরই ৬ষ্ঠ নৌবহর এবং কসমস ৪৬৪ পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ প্রেরণ ও উৎক্ষেপণ করে।

জাতিসংঘও তখন এক রণাঙ্গণে পরিণত হয়েছে। পরাশক্তিগুলো পরস্পরবিরোধী দুটি ফ্রন্টে ভাগ হয়ে তৎপরতা চালাতে শুরু করে। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হলে ৪ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠকে বসে। বৈঠকে সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিক বলেন, বাংলাদেশের মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হোক এবং তার আগে তার বক্তব্য নিরাপত্তা পরিষদে দলিল হিসেবে বিলি করা হোক।

তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে চীনা প্রতিনিধি তার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানোর অর্থ হবে জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্রের বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়া। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নিশ্চয়ই এমন কাজ করবে না, যা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না এবং যার জন্য তার কোনো সদস্য দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহী জোরালোভাবে বলেন, কথিত প্রতিনিধি দলকে স্বীকৃতি দিলে নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের অখ-তায় ছুরিকাঘাত করা হবে। তাই কোনো অবস্থায়ই তাদের বক্তব্য দিতে দেয়া যাবে না।

ইয়াকভ মালিক বলেছিলেন, মিস্টার চৌধুরী সে দলের প্রতিনিধি যারা পাকিস্তানের সংসদীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন এবং প্রাদেশিক পরিষদে প্রায় সব আসন লাভ করেছেন। পাকিস্তানের কথা মেনে নিলেও তাদেরই তো প্রতিনিধিত্ব করা উচিত।

বাংলাদেশ বিরোধীরা তা মানতে নারাজ। এ ইস্যুতে জাতিসংঘ যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এখানেও আক্রমণকারী পাকিস্তানের মিত্ররা আর প্রতিরক্ষাত্মক ভূমিকায় বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো।

প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার শকুনের চক্ষু নিয়ে নখ আর ঠোঁটের হিংস্রতা যেন বাংলাদেশের ওপর বসাতে ব্যস্ত। প্রেসিডেন্ট দেখলেন তার একার শক্তিতে হবে না। ডিসেম্বরেই কিসিঞ্জারকে চীনে পাঠালেন। চীন তাদের সঙ্গেই আছে, তবুও কোথাও যেন কূটনৈতিক চাল চালতে বাকি রয়ে গেছে। চীনকে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে নামাতে হবে। তার আগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাতিসংঘের ওপর যুদ্ধবিরতি এবং অধিকৃত অঞ্চল থেকে ভারতকে সৈন্য প্রত্যাহারের চাপ প্রয়োগ করতে হবে। তারা তাই করলেন। আক্রমণ করেছিল পাকিস্তান, পরাজিত হতে হতে তাদের শরণাপন্ন হয়েছে নির্লজ্জের মতো-যেন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। সোভিয়েত রাশিয়া এগিয়ে এলো যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে।

নিরাপত্তা পরিষদে ব্যর্থ হয়ে এরা ইউএস অ্যাকশন গ্রুপ গঠন করে। অধিকতর বৃহত্তর পরিসরে বিষয়টি নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিষদের তাদের ঘনিষ্ঠ ছয় অস্থায়ী সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধবিরতির বিষয়টিকে সাধারণ পরিষদে পাঠায়।

বাংলাদেশের অধিকাংশ জায়গা তখন মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর দখলে। এ অবস্থায় পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং কয়েকটি দেশ মিলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের কূটনৈতিক রণাঙ্গনে দাবি তোলে যুদ্ধ বন্ধ করে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নিতে হবে। চীনের প্রতিনিধি হুয়াং হুয়াই যেন বেশি সরব। তিনি বলেন, ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন ও পাকিস্তান রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানের ভূখ- দখলের নগ্ন হামলা করেছে। এ মুহূর্তে উপমহাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অবিলম্বে এ পাকিস্তানবিরোধী তৎপরতা ও আগ্রাসন বন্ধ করে পাকিস্তানের ভূখ- থেকে ভারতকে নিঃশর্তে ও পূর্ণাঙ্গরূপে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।

সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাস হয়ে যায়। তার সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের নারকীয় উল্লাস।

সাধারণ পরিষদের সাধারণ সদস্যদের বিভ্রান্ত করে একটা সুপারিশমূলক প্রস্তাব পাস করে নৈতিক চাপ দেয়া হলো বটে! তাতে কিন্তু কোনো কাজ হলো না। ওয়াশিংটন অ্যাকশন গ্রুপের উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিয়ে ভারত তার অবস্থানে অনড় থাকে, প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

সাত.

সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব ভারত প্রত্যাখ্যান করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা হতাশ হয়ে পড়ে। এ হতাশা প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে মারাত্মক এক সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। ১২ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে এক জরুরি সভা বসে। এ সভায় কোনো রাজনৈতিক আলোচনা নয়, আলোচনা হয় সামরিক হস্তক্ষেপ বিষয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন কিসিঞ্জার এবং জেনারেল হেইগ। আলোচনা শেষে এরা বোম্বাটে বা বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন।

এরা মোটামুটি নিশ্চিত যে, চীন পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে জড়াবে। তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন চুপ করে থাকবে না। যুদ্ধে নেমে পড়বে। ফলে পরাশক্তিগুলো পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে যাবে। নিক্সন ব্যক্তিগতভাবে এ ঝুঁকি নিতে মনস্থির করে ফেলেন।

যুক্তরাষ্ট্র ১২ ডিসেম্বরে পুনরায় জাতিসংঘকে নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বানে প্রভাবিত করে। বলে যে, সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের এ সভা। ১২ তারিখেই জরুরি সভা বসে। পরদিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধ বিরতি এবং সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাসের উদ্যোগ নেয়। এবারও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিটো প্রয়োগ করে প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা জানে যে এ প্রস্তাব পাস হবে না। তবুও সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটু বাজিয়ে দেখা। তারপরই যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে ওঠে। তাদের পারমাণবিক জাহাজ এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে আটটি জাহাজের একটি টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগরে পাঠায়। লক্ষ্য দিল্লি ও মস্কোর ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা।

চীন মুখে বললেও এ পরিকল্পনার অধীনে যুদ্ধ জড়াল না। এখানে যুক্তরাষ্ট্র একটি ধাক্কা খেলো। যুক্তরাষ্ট্র আরেক জায়গায়ও হোঁচট খেলো। বিশ্বের পুঁজিবাদী দুটি দেশ- যারা নিরাপত্তা পরিষদেরও সদস্য, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করল না, নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদানে বিরত থাকে। জুলফিকার আলী ভুট্টো এদের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এখন এরা নির্লজ্জ ধামাধরা চাটুকারের ভূমিকা পালন করতে পারে। স্যালিক যুক্তি এবং অ্যাংলো ম্যাক্সন অভিজ্ঞতার কারণে আমরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ভুট্টো আরো বলেন, গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্স উপমহাদেশে ক্লাইভ আর ডুপ্লে হিসেবেই আবার আসতে চাইছে। এরা আসতে চাইছে ভিন্ন চেহারায়, শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে। পূর্বপাকিস্তানে ব্রিটিশদের চা বাগান রয়েছে তাই ব্রিটেন এরকম সুবিধাবাদী ভূমিকা নিতেই পারে। কিন্তু ফ্রান্স? পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পূর্ব পাকিস্তান থেকে এরা কি ব্রিটেনের মতোই পাটের প্রত্যাশা করে?

ফ্রান্স এবং ব্রিটেন জানে তাদের ভোট যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায় যুদ্ধরত ভারতের যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের কোনো ভূমিকাই রাখবে না, কারণ স্থায়ী সদস্যদের একজনের ভেটোই প্রস্তাব পাসে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় এটাই মনে হয় যে, তাদের ভূমিকা ছিল সঠিক। ভুট্টোর কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্যে পাকিস্তানের অশিষ্ট চরিত্রই প্রকাশ পেয়েছে।

ডিসেম্বরে ভারতে আসেন সোভিয়েত সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান কুদরিয়াভেৎসেভ। তিনি সুপ্রিম সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন

পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তান পরাজিত হতে হতে যখন ঢাকায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তাদের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র আশ্বাস দিল যে, উত্তর থেকে পীতরা এবং পশ্চিম থেকে শ্বেতরা আসছে তাদের সাহায্য করতে। তা শুনে আশায় বুক বেঁধে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং তার পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখই অন্ধ করে ফেললেন। তাদের অবাধ্য ঘাড়ও যেন একেবারে বাঁকা হয়ে গেল।

আট.

কোনো দিক থেকেই সাহায্য এলো না। তাদের মিত্ররা বুঝে গেছে বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের ঠেকিয়ে আর পাকিস্তানকে রক্ষা করা যাবে না। তাই অনিবার্যভাবে ডুবন্ত সূর্যের জন্য সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়নি। পাকিস্তান বুঝতে পারে এটা স্রেফ প্রতারণা। সপ্তম নৌবহর লোক দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়।

১৫ ডিসেম্বর ছিল কূটনৈতিক যুদ্ধের শেষ দিন। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে জাতিসংঘ আবার নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান করে। সোভিয়েত ইউনিয়নও প্রচ- চাপে আছে। সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে প্রায় সব দেশেরই ভারতের যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মতি রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদ তা শুধু অনুমোদন করবে। ১২ তারিখে উত্থাপিত হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রদানের কারণে তা অনুমোদন করা যায়নি। ১৫ তারিখে শেষ চেষ্টা।

প্রচ- চাপে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি বড় ভুল করে ফেলল। নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পোল্যান্ডকে দিয়ে বৈঠকে একটি সংশোধিত প্রস্তাব পাঠায়। তাতে কতগুলো শর্তাধীনে যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের কথা রয়েছে। তীরে এসে তরী ডুবে যাবে না তো।

সবাই জানে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবারও ভেটো প্রয়োগ করবে। ওরা ওসব কাগজপত্র পড়েনি। পাকিস্তানের প্রতিনিধি জুলফিকার আলী ভুট্টো বৈঠকে উপস্থিত হয়েছেন। তাকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি বেশ উত্তেজিত। মনে হয় রাতে তার ঘুম হয়নি। ভারতের প্রতিনিধি পোল্যান্ডের সংশোধিত প্রস্তাব পাঠ করে জিহ্বা কামড়াচ্ছেন।

লাড়কানার প্রিন্স ভুট্টো তার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফেললেন সেভিয়েত প্রতিনিধির দিকে। সমস্ত হলে নিস্তব্ধ নীরবতা। ভুট্টোর উত্তেজনা আরো বাড়ছে। হঠাৎ করেই তিনি ফ্লোর নিয়ে বক্তব্য দিতে শুরু করলেন। তার বক্তব্যে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পোল্যান্ডসহ সোভিয়েত ব্লকের দেশসমূহের প্রচুর সমালোচনা হলো। তবে নির্মম কঠিন সব বাক্য এবং শব্দ উচ্চারিত হলো নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দুই দেশ ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের বন্ধুরাও বাদ গেল না। সার্বিক বিচারে জাতিসংঘও কিছু ভাগ পেল। সব শেষে ভুট্টো বললেন, যে কোনো সিদ্ধান্তই চাপিয়ে দেয়া হোক না কেন, ভার্সাইয়ের চেয়ে জঘন্য কোনো চুক্তি হোক, আগ্রাসন আইনি মোড়ক পাক, দখলদারিত্বকে বৈধতা দেয়া হোক, আজ ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনাকে বৈধতা দেয়া হোক, তাতে আমি অংশীদার হতে চাই না। আমরা যুদ্ধই করে যাবÑ বলেই তিনি উত্তেজিতভাবে প্রস্তাব সম্বলিত কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলে রণভঙ্গ দিয়ে বৈঠকস্থল থেকে হনহন করে বের হয়ে যান।

তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের কোনো কোনো স্থায়ী-অস্থায়ী সদস্যের মনে হলো পাকিস্তানের প্রতিনিধি কি পোল্যান্ডের প্রস্তাব সম্বলিত কাগজপত্র পড়েননি, তার তো কাগজপত্র না পড়ার কথা নয়। রহস্যটা কী!

একই দৃশ্য দেখে ভারতীয় প্রতিনিধি চোখ বুজলেন। তার অজান্তেই তাকে সমস্ত ভার থেকে রেহাই দিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেল। এবারে হাসলেন তিনি। বিজয়ীর হাসি। (সমাপ্ত)

ছবি

দূরের তারাটিকে

ছবি

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

ছবি

যেদিন সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন

ছবি

ফিরবে না তা জানি

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

কূটনৈতিক মুক্তিযুদ্ধ

আবুল কাসেম

বৃহস্পতিবার, ০৪ মে ২০২৩

(পূর্ব প্রকাশের পর)

পাঁচ.

জাতিসংঘ সঠিক দয়িত্ব পালন করেনি। মহাসচিব উথান্ট বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। বিশ্ব জনমতকে তিনি উপেক্ষা করেছেন। প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের প্রভাবে জাতিসংঘ তার যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। তখন সাধারণ পরিষদের সভাপতি আদম মালিক ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের গভীর বন্ধূত্ব। এ সম্পর্কও জাতিসংঘের যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা ডেকে আনে। অবশ্য ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে প্রায় একশ পৃষ্ঠার কভারেজ রয়েছে।

মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি দেশের প্রধান হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের বিরোধিতা ও চাপের কারণে তাকে ভাষণ দিতে দেয়া হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে ভারতের কপি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিলি করার অনুমতি প্রদান করা হয়।

প্রথম থেকেই জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট মার্চ মাসে বাংলাদেশ থেকে তাদের কর্মীদের প্রত্যাহার করে নেন। তিনি গণহত্যা বন্ধের কোনো উদ্যোগই নিলেন না। সাংবাদিকদের চাপের মুখে এপ্রিল মাসে তার এক মুখপাত্র বললেন, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে যে মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা মহাসচিব অবগত আছেন। মে মাসে তিনি পাকিস্তানে পত্র লেখেন। তাতে বলেন, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর ঢাকা থেকে জাতিসংঘের যেসব কর্মকর্তা ফেরত এসেছেন তাদের মাধ্যমে এবং অন্যান্য সূত্রের সাহায্যে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, পাকিস্তানে এক নেতিবাচক পরিস্থিত বিরাজ করছে। পাকিস্তানের সম্মতি পেলে জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থাগুলো এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।

এটুকু লিখেই জাতিসংঘ তার দায়িত্ব শেষ করে। অথচ প্রথম থেকেই ভারত ঢাকার পরিস্থিতি জানিয়ে জাতিসংঘে পত্র লেখে। শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য আবেদন জানায়। চার মাস পর জাতিসংঘ তার শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রধান প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানকে ঢাকায় পাঠায়। আগা খান ঢাকা থেকে দিল্লি যান। তিনি দেখে-শুনে যা বললেন, তা খুবই কার্যকরী বলা যাবে। তিনি বললেন, পূর্বপাকিস্তানে যতক্ষণ ভয়ের কারণসমূহ বিদ্যমান থাকবে, ততক্ষণ শরণার্থীরা ভারত থেকে ফেরত যাবে না।

মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি দেশের প্রধান হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের বিরোধিতা ও চাপের কারণে তাকে ভাষণ দিতে দেয়া হয়নি

২ আগস্ট জাতিসংঘ তার রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনাইটেড নেশনস ইস্ট পাকিস্তান, রিলিফ অপারেশন, সংক্ষেপে ‘ইউনিপোরও’ গঠন করে। বলা হয়, এই মিশন মানবিক বিপর্যয় রোধে কাজ করবে। শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করবে না। রিলিফের পাশাপাশি প্রয়োজন ছিল শান্তির। জাতিসংঘ এ কাজে এগিয়ে আসেনি।

জাতিসংঘ সিংহভাগ ত্রাণসামগ্রী পাঠায় পূর্ব পাকিস্তানে। এ ত্রাণসামগ্রী দুস্থ মানুষের কাজে আসেনি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে বলেছেন, পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি জান্তা জাতিসংঘের ত্রাণসামগ্রী লুট করেছে। অথচ ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের দেয়া আন্তর্জাতিক সাহায্য তাৎপর্যপূর্ণভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। বিরাট এক মানবিক বিপর্যয় থেকে এক কোটি শরণার্থী রক্ষা পেয়েছে।

এপ্রিল মাসের শেষের দিকে জাতিসংঘে তৎকালীন ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের আবেদন করেন। মহাসচিব মে মাসের মাঝামাঝি বিভিন্ন দেশের সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও জনসাধারণের প্রতি সাহায্যের আহ্বান জানান। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু দেশ এবং সংস্থা ভারতকে জুন মাস পর্যন্ত ২৬ কোটি ৩০ লাখ ৬ হাজার ডলার সাহায্য দান করে। আগস্টে জাতিসংঘ থেকেও ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্বপাকিস্তানের সীমান্তে ট্রানজিট ক্যাম্প খুলে দিয়ে শরণার্থীদের ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানান। তা ছিল লোক দেখানো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার জন্য। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরানো। কিন্তু প্রেসিডেন্টের এই চালাকি কাজে আসেনি।

জাতিসংঘের মহাসচিব মনে করেছিলেন, এতে শরণার্থী সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। পরে বুঝতে পারলেন তার ধারণা সঠিক নয়। জাতিসংঘের সংগঠনসমূহের বার্ষিক প্রতিবেদনে লিখলেন, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের দেশে ফিরে আসার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক আপসরফা, রাজনৈতিক পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন এবং ত্রাণ কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়ন। তিনি আরো বলেন, পরিস্থিতি এমন যে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের কারণে এমন এক দুষ্টচক্রের সৃষ্টি হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই ব্যাপক মানবিক সমস্যার মোকাবেলা করতে পারছে না।

তিনি দার্শনিকের মতো মানবিক বিপর্যয়ের গভীর তাৎপর্য অনুসন্ধান করেছেন। ইতিহাস ঘেঁটে বিপর্যয়ের গভীর তাৎপর্য উদ্ঘাটন করে বলেন, এক ধরনের ধ্বংসাত্মক মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। তাতে পুরো উপমহাদেশের ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক এ সমস্যার একটি দিক। রাষ্ট্রদ্বয়ের ভূখ-গত অখ-তা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে বিরোধের জের হিসেবে সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেশ দুটির মধ্যে বহু আত্মঘাতী সংঘাতের জন্ম হয়েছে। এসব ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে একটি অতিরিক্ত বিপদের দিক যুক্ত করেছে।

তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে উপলব্ধি করতেই ব্যর্থ হলেন। একে ভারত-পাকিস্তানের আত্মঘাতী সংঘাত বললেন। তার বক্তব্য পরে আরো স্পষ্ট করল যে, তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধকে আমলেই নেননি। তিনি বলেন, পূর্বপাকিস্তানের সীমান্ত পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। সীমান্ত সংঘাত, গুপ্ত আক্রমণ প্রভৃতি অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শরণার্থীরা এ সমস্যা সংকূল সীমান্ত অতিক্রম করে সমস্যা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

এতবড় একটা দায়িত্বশীল পদে বসে তিনি একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধকে বলছেন সীমান্ত সংঘাত, গেরিলা যুদ্ধকে বলেছেন গুপ্ত আক্রমণ এবং তা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা।

এসব দেখে মজা করে এক কূটনীতিক বলেছেন, জাতিসংঘ হচ্ছে একটি সামন্তবাদী রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান। এখানে যারা চাকরি করতে আসেন তাদের প্রভুভক্ত হতে হয়, বিপ্লবী হলে চলে না। এ মহাজ্ঞান সম্ভবত মহাজ্ঞানী মহাসচিব উথান্টেরও ছিল।

ছয়.

৩ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে বসে। শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। তাতে আন্তর্জাতিক বিশ্ব এবং পরাশক্তিগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। ভারতের পাশে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সামরিক এবং কূটনৈতিক উভয় ফ্রন্টে দেশটি তৎপর হয়ে ওঠে।

অপরদিকে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সহায়তা করার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা পাকিস্তান তার পূর্বাঞ্চল হারাচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানও যে অক্ষত থাকবে, বিশেষ করে কাশ্মীর, কারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই সে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে মুক্ত প্রায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পতন ঠেকানোর জন্য নৌ, বিমান ও স্থল তৎপরতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল তাতে বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌ-তৎপরতা বা অবরোধ ব্যর্থ হয়ে যাবে, ভারতীয় বিমান অভিযান প্রতিহত হবে এবং মার্কিন নৌ-সেনারা পাকিস্তানি স্থলবাহিনীর কাজে সহায়তা ছাড়াও নৌ এবং আকাশ পথে আক্রমণকারী যৌথবাহিনীকে ঠেকানো যাবে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তাদের নতুন বন্ধু চীনকে প্ররোচনা দেয় এরা যেন ভারতীয় সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করে ভারতের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। চীন এ ভুল করেনি। কারণ চীন-সৌভিয়েত সীমান্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন আগেই বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়োজিত করে রেখেছিল। শুধু তাই নয়, সপ্তম নৌবহর আসার আগেই ভারত মহাসাগরে সৌভিয়েত ইউনিয়ন ষষ্ঠ নৌবহর মোতায়েন করে ফেলে। তাদের ডুবোজাহাজগুলো অতন্ত্র প্রহরীর মতো বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে প্রহরা দিতে থাকে।

ডিসেম্বরে ভারতে আসেন সোভিয়েত সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান কুদরিয়াভেৎসেভ। তিনি সুপ্রিম সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

এ সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে সংগ্রাম চলছে তা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তি আন্দোলনে তাদের সঙ্গে থাকবে। আর ভারত আক্রমণ হলে তাকে সাহায্য করবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, সম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বর্তমান বন্ধুত্বে ভীত হয়ে পড়েছে। এরা সাম্প্রতিককালে স্বাক্ষরিত ভারত-সোভিয়েত চুক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাতে কোনো কাজ হবে না।

তারপরই ৬ষ্ঠ নৌবহর এবং কসমস ৪৬৪ পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ প্রেরণ ও উৎক্ষেপণ করে।

জাতিসংঘও তখন এক রণাঙ্গণে পরিণত হয়েছে। পরাশক্তিগুলো পরস্পরবিরোধী দুটি ফ্রন্টে ভাগ হয়ে তৎপরতা চালাতে শুরু করে। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হলে ৪ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠকে বসে। বৈঠকে সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিক বলেন, বাংলাদেশের মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হোক এবং তার আগে তার বক্তব্য নিরাপত্তা পরিষদে দলিল হিসেবে বিলি করা হোক।

তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে চীনা প্রতিনিধি তার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানোর অর্থ হবে জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্রের বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়া। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নিশ্চয়ই এমন কাজ করবে না, যা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না এবং যার জন্য তার কোনো সদস্য দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহী জোরালোভাবে বলেন, কথিত প্রতিনিধি দলকে স্বীকৃতি দিলে নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের অখ-তায় ছুরিকাঘাত করা হবে। তাই কোনো অবস্থায়ই তাদের বক্তব্য দিতে দেয়া যাবে না।

ইয়াকভ মালিক বলেছিলেন, মিস্টার চৌধুরী সে দলের প্রতিনিধি যারা পাকিস্তানের সংসদীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন এবং প্রাদেশিক পরিষদে প্রায় সব আসন লাভ করেছেন। পাকিস্তানের কথা মেনে নিলেও তাদেরই তো প্রতিনিধিত্ব করা উচিত।

বাংলাদেশ বিরোধীরা তা মানতে নারাজ। এ ইস্যুতে জাতিসংঘ যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এখানেও আক্রমণকারী পাকিস্তানের মিত্ররা আর প্রতিরক্ষাত্মক ভূমিকায় বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো।

প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার শকুনের চক্ষু নিয়ে নখ আর ঠোঁটের হিংস্রতা যেন বাংলাদেশের ওপর বসাতে ব্যস্ত। প্রেসিডেন্ট দেখলেন তার একার শক্তিতে হবে না। ডিসেম্বরেই কিসিঞ্জারকে চীনে পাঠালেন। চীন তাদের সঙ্গেই আছে, তবুও কোথাও যেন কূটনৈতিক চাল চালতে বাকি রয়ে গেছে। চীনকে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে নামাতে হবে। তার আগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাতিসংঘের ওপর যুদ্ধবিরতি এবং অধিকৃত অঞ্চল থেকে ভারতকে সৈন্য প্রত্যাহারের চাপ প্রয়োগ করতে হবে। তারা তাই করলেন। আক্রমণ করেছিল পাকিস্তান, পরাজিত হতে হতে তাদের শরণাপন্ন হয়েছে নির্লজ্জের মতো-যেন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। সোভিয়েত রাশিয়া এগিয়ে এলো যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে।

নিরাপত্তা পরিষদে ব্যর্থ হয়ে এরা ইউএস অ্যাকশন গ্রুপ গঠন করে। অধিকতর বৃহত্তর পরিসরে বিষয়টি নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিষদের তাদের ঘনিষ্ঠ ছয় অস্থায়ী সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধবিরতির বিষয়টিকে সাধারণ পরিষদে পাঠায়।

বাংলাদেশের অধিকাংশ জায়গা তখন মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর দখলে। এ অবস্থায় পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং কয়েকটি দেশ মিলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের কূটনৈতিক রণাঙ্গনে দাবি তোলে যুদ্ধ বন্ধ করে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নিতে হবে। চীনের প্রতিনিধি হুয়াং হুয়াই যেন বেশি সরব। তিনি বলেন, ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন ও পাকিস্তান রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানের ভূখ- দখলের নগ্ন হামলা করেছে। এ মুহূর্তে উপমহাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অবিলম্বে এ পাকিস্তানবিরোধী তৎপরতা ও আগ্রাসন বন্ধ করে পাকিস্তানের ভূখ- থেকে ভারতকে নিঃশর্তে ও পূর্ণাঙ্গরূপে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।

সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাস হয়ে যায়। তার সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের নারকীয় উল্লাস।

সাধারণ পরিষদের সাধারণ সদস্যদের বিভ্রান্ত করে একটা সুপারিশমূলক প্রস্তাব পাস করে নৈতিক চাপ দেয়া হলো বটে! তাতে কিন্তু কোনো কাজ হলো না। ওয়াশিংটন অ্যাকশন গ্রুপের উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিয়ে ভারত তার অবস্থানে অনড় থাকে, প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

সাত.

সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব ভারত প্রত্যাখ্যান করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা হতাশ হয়ে পড়ে। এ হতাশা প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে মারাত্মক এক সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। ১২ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে এক জরুরি সভা বসে। এ সভায় কোনো রাজনৈতিক আলোচনা নয়, আলোচনা হয় সামরিক হস্তক্ষেপ বিষয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন কিসিঞ্জার এবং জেনারেল হেইগ। আলোচনা শেষে এরা বোম্বাটে বা বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন।

এরা মোটামুটি নিশ্চিত যে, চীন পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে জড়াবে। তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন চুপ করে থাকবে না। যুদ্ধে নেমে পড়বে। ফলে পরাশক্তিগুলো পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে যাবে। নিক্সন ব্যক্তিগতভাবে এ ঝুঁকি নিতে মনস্থির করে ফেলেন।

যুক্তরাষ্ট্র ১২ ডিসেম্বরে পুনরায় জাতিসংঘকে নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বানে প্রভাবিত করে। বলে যে, সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের এ সভা। ১২ তারিখেই জরুরি সভা বসে। পরদিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধ বিরতি এবং সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাসের উদ্যোগ নেয়। এবারও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিটো প্রয়োগ করে প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা জানে যে এ প্রস্তাব পাস হবে না। তবুও সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটু বাজিয়ে দেখা। তারপরই যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে ওঠে। তাদের পারমাণবিক জাহাজ এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে আটটি জাহাজের একটি টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগরে পাঠায়। লক্ষ্য দিল্লি ও মস্কোর ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা।

চীন মুখে বললেও এ পরিকল্পনার অধীনে যুদ্ধ জড়াল না। এখানে যুক্তরাষ্ট্র একটি ধাক্কা খেলো। যুক্তরাষ্ট্র আরেক জায়গায়ও হোঁচট খেলো। বিশ্বের পুঁজিবাদী দুটি দেশ- যারা নিরাপত্তা পরিষদেরও সদস্য, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করল না, নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদানে বিরত থাকে। জুলফিকার আলী ভুট্টো এদের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এখন এরা নির্লজ্জ ধামাধরা চাটুকারের ভূমিকা পালন করতে পারে। স্যালিক যুক্তি এবং অ্যাংলো ম্যাক্সন অভিজ্ঞতার কারণে আমরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ভুট্টো আরো বলেন, গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্স উপমহাদেশে ক্লাইভ আর ডুপ্লে হিসেবেই আবার আসতে চাইছে। এরা আসতে চাইছে ভিন্ন চেহারায়, শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে। পূর্বপাকিস্তানে ব্রিটিশদের চা বাগান রয়েছে তাই ব্রিটেন এরকম সুবিধাবাদী ভূমিকা নিতেই পারে। কিন্তু ফ্রান্স? পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পূর্ব পাকিস্তান থেকে এরা কি ব্রিটেনের মতোই পাটের প্রত্যাশা করে?

ফ্রান্স এবং ব্রিটেন জানে তাদের ভোট যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায় যুদ্ধরত ভারতের যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের কোনো ভূমিকাই রাখবে না, কারণ স্থায়ী সদস্যদের একজনের ভেটোই প্রস্তাব পাসে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় এটাই মনে হয় যে, তাদের ভূমিকা ছিল সঠিক। ভুট্টোর কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্যে পাকিস্তানের অশিষ্ট চরিত্রই প্রকাশ পেয়েছে।

ডিসেম্বরে ভারতে আসেন সোভিয়েত সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান কুদরিয়াভেৎসেভ। তিনি সুপ্রিম সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন

পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তান পরাজিত হতে হতে যখন ঢাকায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তাদের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র আশ্বাস দিল যে, উত্তর থেকে পীতরা এবং পশ্চিম থেকে শ্বেতরা আসছে তাদের সাহায্য করতে। তা শুনে আশায় বুক বেঁধে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং তার পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখই অন্ধ করে ফেললেন। তাদের অবাধ্য ঘাড়ও যেন একেবারে বাঁকা হয়ে গেল।

আট.

কোনো দিক থেকেই সাহায্য এলো না। তাদের মিত্ররা বুঝে গেছে বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের ঠেকিয়ে আর পাকিস্তানকে রক্ষা করা যাবে না। তাই অনিবার্যভাবে ডুবন্ত সূর্যের জন্য সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়নি। পাকিস্তান বুঝতে পারে এটা স্রেফ প্রতারণা। সপ্তম নৌবহর লোক দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়।

১৫ ডিসেম্বর ছিল কূটনৈতিক যুদ্ধের শেষ দিন। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে জাতিসংঘ আবার নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান করে। সোভিয়েত ইউনিয়নও প্রচ- চাপে আছে। সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে প্রায় সব দেশেরই ভারতের যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মতি রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদ তা শুধু অনুমোদন করবে। ১২ তারিখে উত্থাপিত হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রদানের কারণে তা অনুমোদন করা যায়নি। ১৫ তারিখে শেষ চেষ্টা।

প্রচ- চাপে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি বড় ভুল করে ফেলল। নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পোল্যান্ডকে দিয়ে বৈঠকে একটি সংশোধিত প্রস্তাব পাঠায়। তাতে কতগুলো শর্তাধীনে যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের কথা রয়েছে। তীরে এসে তরী ডুবে যাবে না তো।

সবাই জানে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবারও ভেটো প্রয়োগ করবে। ওরা ওসব কাগজপত্র পড়েনি। পাকিস্তানের প্রতিনিধি জুলফিকার আলী ভুট্টো বৈঠকে উপস্থিত হয়েছেন। তাকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি বেশ উত্তেজিত। মনে হয় রাতে তার ঘুম হয়নি। ভারতের প্রতিনিধি পোল্যান্ডের সংশোধিত প্রস্তাব পাঠ করে জিহ্বা কামড়াচ্ছেন।

লাড়কানার প্রিন্স ভুট্টো তার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফেললেন সেভিয়েত প্রতিনিধির দিকে। সমস্ত হলে নিস্তব্ধ নীরবতা। ভুট্টোর উত্তেজনা আরো বাড়ছে। হঠাৎ করেই তিনি ফ্লোর নিয়ে বক্তব্য দিতে শুরু করলেন। তার বক্তব্যে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পোল্যান্ডসহ সোভিয়েত ব্লকের দেশসমূহের প্রচুর সমালোচনা হলো। তবে নির্মম কঠিন সব বাক্য এবং শব্দ উচ্চারিত হলো নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দুই দেশ ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের বন্ধুরাও বাদ গেল না। সার্বিক বিচারে জাতিসংঘও কিছু ভাগ পেল। সব শেষে ভুট্টো বললেন, যে কোনো সিদ্ধান্তই চাপিয়ে দেয়া হোক না কেন, ভার্সাইয়ের চেয়ে জঘন্য কোনো চুক্তি হোক, আগ্রাসন আইনি মোড়ক পাক, দখলদারিত্বকে বৈধতা দেয়া হোক, আজ ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনাকে বৈধতা দেয়া হোক, তাতে আমি অংশীদার হতে চাই না। আমরা যুদ্ধই করে যাবÑ বলেই তিনি উত্তেজিতভাবে প্রস্তাব সম্বলিত কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলে রণভঙ্গ দিয়ে বৈঠকস্থল থেকে হনহন করে বের হয়ে যান।

তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের কোনো কোনো স্থায়ী-অস্থায়ী সদস্যের মনে হলো পাকিস্তানের প্রতিনিধি কি পোল্যান্ডের প্রস্তাব সম্বলিত কাগজপত্র পড়েননি, তার তো কাগজপত্র না পড়ার কথা নয়। রহস্যটা কী!

একই দৃশ্য দেখে ভারতীয় প্রতিনিধি চোখ বুজলেন। তার অজান্তেই তাকে সমস্ত ভার থেকে রেহাই দিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেল। এবারে হাসলেন তিনি। বিজয়ীর হাসি। (সমাপ্ত)

back to top