তিন বছরের ছেলে ইয়াসিনকে বুকে জড়িয়েই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন মা নাদিরা আক্তার পপি। আগুনে পড়ে যেভাবে সন্তানকে বুকে আগলে রেখেছিলেন, ঢাকা মেডিকেলের মর্গের বাইরে লাশবাহী সাদা ব্যাগেও একইভাবে রাখা ছিল তাদের লাশ। চলন্ত ট্রেন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন, হুড়োহুড়ির ভেতর দিয়ে ছোট ভাই ও এক ছেলে নিরাপদে সরে গেলেও, পারেননি নিহত পপি। আগুন নেভাতে যখন ফায়ার সার্ভিস এগিয়ে যায়, তখন মা ও সন্তানের এমন মৃত্যু দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এই নির্মম মৃত্যু, স্বজনদের আহাজারিতে ঢাকা মেডিকেলের সামনের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। ঢাকা মেডিকেলের সামনে বসে স্ত্রী ও ছেলেকে হারিয়ে কাঁদছিলেন শিশু ইয়াসিনের বাবা মিজানুর রহমান। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, কী অপরাধে এমন নির্মম মৃত্যু হলো স্ত্রীর, কী অপরাধ ছিল শিশু সন্তান ইয়াসিনের। আগুনে পোড়া স্ত্রী-সন্তানের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) জরুরি বিভাগের মর্গে। বাইরে অপেক্ষায় থাকা মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, কী অপরাধে আমার সব শেষ হয়ে গেল জানি না। আমি কারও কাছে বিচার চাইবো না। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে মিজানুর রহমান থাকেন পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকায়। বড় ছেলে রিয়াদ হাসান ফাহিম চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। ফাহিমের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ৩ ডিসেম্বর দুই সন্তান নিয়ে নাদিরা আক্তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় যান। তেজগাঁও এলাকায় হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী-সন্তানকে যেন আর কাটাছেঁড়া করা না হয়। শুধু অক্ষত লাশ ফেরত চাই।
পপি ছিলেন মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী, ছোট ভাই ও দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় আসছিলেন তিনি। মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোরে বিএনপির হরতাল শুরুর আগে আগে ট্রেনটি যখন ঢাকায় ঢুকছিল, তখনই ট্রেনের ভেতরে থাকা যাত্রীবেশী নাশকতাকারীরা আগুন দেয় বলে পুলিশের ভাষ্য। ভয়াবহ ওই ঘটনায় পুড়ে ছাই হয়েছে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের তিনটি বগি। পপি ও তার ছেলে ইয়াসিন ছাড়াও এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অজ্ঞাতপরিচয় দুই পুরুষ। তাদের লাশও এখন মর্গের বাইরে রাখা হয়েছে, শরীর এতটাই পুড়ে গেছে যে, পরিচয় জানতে এখন ডিএনএ পরীক্ষা লাগবে।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নিহত পপির ভাই হাবিবুর রহমান বলেন, নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম একই পরিবারের ৯ জন। গত সোমবার রাতে ট্রেনে ওঠি। বিমানবন্দর স্টেশনে আমাদের মধ্যে ৫ জন নেমে যান। ট্রেন বিমানবন্দর থেকে কমলাপুরের উদ্দেশে রওনা করে। আমরা ‘জ’ বগিতে ছিলাম। হঠাৎ ধোঁয়ায় ভরে যায় কামরা। ‘আগুন আগুন’ বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয় চারদিকে। তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেন থামতে থামতে সবাই হুড়োহুড়ি করে নেমে যান। এর মধ্যে আমার বড় ভাগিনা মাহিমকে নিয়ে আমিও নেমে যাই। কিন্তু আমার বড় বোন নাদিরা আক্তার পপি ও তিন বছরের ছোট ভাগিনা ইয়াসিন বের হতে পারেনি। তিনি জানান, আগুন নেভানোর পর চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে আমার বোন ও ভাগনে ছিল। যখন আমার বোনের মরদেহ উদ্ধার করা হয় তখনও তার বুকে জড়ানো ছিল আমার ভাগনে। দুজন একসঙ্গে পুড়ে মারা গেছে।
পপির স্বামী মিজানুর রহমান কারওয়ান বাজারে ব্যবসা করেন। স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যুর খবরে ছুটে যান হাসপাতালে। মিজানুরের ভাই দেলোয়ার হোসেন টিটু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, পপি তার দুই সন্তান ও ছোট ভাইকে নিয়ে ঢাকায় আসার জন্য ট্রেনে উঠেছিলেন। ভাইটিও বয়সে কিশোর। ট্রেনে আগুন লাগার পর বড় ছেলে তার মামার সঙ্গে বের হয়ে আসতে পারলেও পপি ও তার ছোট ছেলে বের হতে পারেনি। ‘আমরা তার লাশ পেয়েছি মায়ের কোলে, মাকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থায়।’
নিরাপদ ভেবে ট্রেনে গেছিল পপি, হেইখানে মরলো : আক্ষেপ পপির বাবার
বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্কুল বন্ধ হওয়ায় দুই ছেলেকে নিয়ে নেত্রকোনার সদর উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন নাদিরা আক্তার পপি। হরতাল-অবরোধের মধ্যে বাসের চেয়ে ট্রেনকেই নিরাপদ মনে হয়েছিল পরিবারের কাছে। কিন্তু সেই যাত্রাই কাল হলো নাদিরার জীবনে। মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে নেত্রকোনা থেকে ছেড়ে যাওয়া আসা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনে পুড়ে নিহত হন পপিসহ তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিন রহমান পিয়াস। এ সময় পপির ছোট ভাই তার বড় ছেলেকে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ায় তারা বেঁচে যান।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার বৈরাটি গ্রামের মো. ফজলুল হকের মেয়ে। ১১ বছর আগে সদর উপজেলার দক্ষিণ বিশিউড়া গ্রামের বরুনা গ্রামের মিজানুরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। মিজানুর ঢাকায় ব্যবসা করেন। তিনি পরিবার নিয়ে কারওয়ান বাজার এলাকায় থাকতেন। মৃত্যুর খবর পেয়ে বাবা ফজলুর রহমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ছুটে আসেন। সেই বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। কান্নায় ভেঙে পড়ছেন পপির বাবা-মা ও স্বজনরা।
নাদিরার বাবা ফজলুল হক আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘মেয়ে নিরাপদের জন্যে ট্রেনে কইর্যা গেছে। আর এই টেইনে গিয়েই মারা গেছে। এই ঘটনার বিচার চাই। আপনারা সঠিকভাবে বিচার করবেন।’ পরিবার জানায়, গত সোমবার রাতে দুই সন্তানকে নিয়ে নাদিরা তার ভাই হাবিবুর রহমানের সঙ্গে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে চড়ে ঢাকার বাসায় ফিরছিলেন। ট্রেনে আগুনের ঘটনার সময় হাবিবুর রহমান ভাগনে ফাহিমকে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে জীবন বাঁচাতে পারলেও ট্রেনে আটক পড়ে আগুনে দগ্ধ হয়ে শিশু সন্তানসহ মারা যান নাদিরা।
নাদিরার দেবর আবদুল কাদির মিলন বলেন, ‘স্কুল বন্ধের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল নাদিরাসহ তার দুই সন্তান। রাতে ওদেরকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে আসি। ঢাকার বাসায় যাচ্ছিল। ‘পরে শুনি ট্রেনে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। এখনও লাশ আসেনি। জানাজার সময় নির্ধারণ করা হয়নি। সবাইকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ নাদিরার বোন লিপি আক্তার বলেন, ‘আমার বোনের সঙ্গে শেষমেষ দুইটা কথাও বলতে পারছি না। আমরার বুকে যেমন আগুন দিছে হেরার বুকেও তেমন যেন আগুন লাগে। আমরা সরকারের কাছে বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ হত্যার বিচার চাই।’
মা-ছেলের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়া হস্তান্তর
তেজগাঁওয়ে ট্রেনে আগুনের ঘটনায় পরিচয় পাওয়া মা-ছেলের মরদেহ বিনা ময়নাতদন্তে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন- নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার ছেলে ইয়াসিন (৩)। মঙ্গলবার বিকেলে ঢামেক মর্গ থেকে পরিবারের সদস্যরা তাদের মরদেহ বুঝে নিয়ে যান। ঢাকা রেলওয়ে ওসি ফেরদৌস আহামেদ বিশ্বাস বলেন, আরও একজনের মরদেহ শনাক্ত হয়েছে বলে শুনেছি। তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। নাদিরা আক্তার পপি নেত্রকোনার সদর উপজেলার বরুনা গ্রামের মিজানুর রহমানের স্ত্রী। নিহত নাদিরা একই জেলার পূর্বধলা উপজেলার আলমপুর গ্রামের ফজলুল রহমানের মেয়ে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওই সন্তানটি ভয় পেয়ে হয়তো তার মাকে জড়িয়ে ধরেছিল, তার মা ও হয়তো সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুজনকেই মৃত্যু আলিঙ্গন করতে হয়েছে। ওই অবস্থাতেই পাওয়া গেছে তাদের লাশ।’
যাত্রীদের বরাত দিয়ে তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন জানান, ট্রেনটি খিলক্ষেতে এলে যাত্রীরা বগিতে আগুন দেখতে পান। তারা চিৎকার শুরু করলে চালক ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে থামান। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভাতে কাজ শুরু করে। রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, তারা এ ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক নাশকতা’ হিসেবেই সন্দেহ করছেন।
তিনি জানান, ট্রেনের দুই বগির সংযোগস্থলে প্রথমে আগুন দেখতে পান রেলওয়ে স্টাফরা। তারা ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশাপাশি দুটি কোচে। এ সময় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিলে অনেকে হুড়োহুড়ি করে নামার চেষ্টা করেন। আবার ভোরের ঘুম ঘুম পরিবেশে অনেকে শুরুতে বুঝতেই পারেননি কী ঘটতে যাচ্ছে। ওই ঘটনায় ট্রেন থেকে নামতে গিয়েও কয়েকজন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে মাথায় আঘাত পাওয়া একজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত ওই ব্যক্তির নাম নুরুল হক ওরফে আবদুল কাদের (৫৩)। নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় তার বাড়ি। ঢাকায় তিনি হামীম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিবহন শাখায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।
মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩
তিন বছরের ছেলে ইয়াসিনকে বুকে জড়িয়েই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন মা নাদিরা আক্তার পপি। আগুনে পড়ে যেভাবে সন্তানকে বুকে আগলে রেখেছিলেন, ঢাকা মেডিকেলের মর্গের বাইরে লাশবাহী সাদা ব্যাগেও একইভাবে রাখা ছিল তাদের লাশ। চলন্ত ট্রেন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন, হুড়োহুড়ির ভেতর দিয়ে ছোট ভাই ও এক ছেলে নিরাপদে সরে গেলেও, পারেননি নিহত পপি। আগুন নেভাতে যখন ফায়ার সার্ভিস এগিয়ে যায়, তখন মা ও সন্তানের এমন মৃত্যু দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এই নির্মম মৃত্যু, স্বজনদের আহাজারিতে ঢাকা মেডিকেলের সামনের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। ঢাকা মেডিকেলের সামনে বসে স্ত্রী ও ছেলেকে হারিয়ে কাঁদছিলেন শিশু ইয়াসিনের বাবা মিজানুর রহমান। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, কী অপরাধে এমন নির্মম মৃত্যু হলো স্ত্রীর, কী অপরাধ ছিল শিশু সন্তান ইয়াসিনের। আগুনে পোড়া স্ত্রী-সন্তানের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) জরুরি বিভাগের মর্গে। বাইরে অপেক্ষায় থাকা মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, কী অপরাধে আমার সব শেষ হয়ে গেল জানি না। আমি কারও কাছে বিচার চাইবো না। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে মিজানুর রহমান থাকেন পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকায়। বড় ছেলে রিয়াদ হাসান ফাহিম চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। ফাহিমের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ৩ ডিসেম্বর দুই সন্তান নিয়ে নাদিরা আক্তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় যান। তেজগাঁও এলাকায় হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী-সন্তানকে যেন আর কাটাছেঁড়া করা না হয়। শুধু অক্ষত লাশ ফেরত চাই।
পপি ছিলেন মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী, ছোট ভাই ও দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় আসছিলেন তিনি। মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোরে বিএনপির হরতাল শুরুর আগে আগে ট্রেনটি যখন ঢাকায় ঢুকছিল, তখনই ট্রেনের ভেতরে থাকা যাত্রীবেশী নাশকতাকারীরা আগুন দেয় বলে পুলিশের ভাষ্য। ভয়াবহ ওই ঘটনায় পুড়ে ছাই হয়েছে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের তিনটি বগি। পপি ও তার ছেলে ইয়াসিন ছাড়াও এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অজ্ঞাতপরিচয় দুই পুরুষ। তাদের লাশও এখন মর্গের বাইরে রাখা হয়েছে, শরীর এতটাই পুড়ে গেছে যে, পরিচয় জানতে এখন ডিএনএ পরীক্ষা লাগবে।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নিহত পপির ভাই হাবিবুর রহমান বলেন, নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম একই পরিবারের ৯ জন। গত সোমবার রাতে ট্রেনে ওঠি। বিমানবন্দর স্টেশনে আমাদের মধ্যে ৫ জন নেমে যান। ট্রেন বিমানবন্দর থেকে কমলাপুরের উদ্দেশে রওনা করে। আমরা ‘জ’ বগিতে ছিলাম। হঠাৎ ধোঁয়ায় ভরে যায় কামরা। ‘আগুন আগুন’ বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয় চারদিকে। তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেন থামতে থামতে সবাই হুড়োহুড়ি করে নেমে যান। এর মধ্যে আমার বড় ভাগিনা মাহিমকে নিয়ে আমিও নেমে যাই। কিন্তু আমার বড় বোন নাদিরা আক্তার পপি ও তিন বছরের ছোট ভাগিনা ইয়াসিন বের হতে পারেনি। তিনি জানান, আগুন নেভানোর পর চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে আমার বোন ও ভাগনে ছিল। যখন আমার বোনের মরদেহ উদ্ধার করা হয় তখনও তার বুকে জড়ানো ছিল আমার ভাগনে। দুজন একসঙ্গে পুড়ে মারা গেছে।
পপির স্বামী মিজানুর রহমান কারওয়ান বাজারে ব্যবসা করেন। স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যুর খবরে ছুটে যান হাসপাতালে। মিজানুরের ভাই দেলোয়ার হোসেন টিটু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, পপি তার দুই সন্তান ও ছোট ভাইকে নিয়ে ঢাকায় আসার জন্য ট্রেনে উঠেছিলেন। ভাইটিও বয়সে কিশোর। ট্রেনে আগুন লাগার পর বড় ছেলে তার মামার সঙ্গে বের হয়ে আসতে পারলেও পপি ও তার ছোট ছেলে বের হতে পারেনি। ‘আমরা তার লাশ পেয়েছি মায়ের কোলে, মাকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থায়।’
নিরাপদ ভেবে ট্রেনে গেছিল পপি, হেইখানে মরলো : আক্ষেপ পপির বাবার
বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্কুল বন্ধ হওয়ায় দুই ছেলেকে নিয়ে নেত্রকোনার সদর উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন নাদিরা আক্তার পপি। হরতাল-অবরোধের মধ্যে বাসের চেয়ে ট্রেনকেই নিরাপদ মনে হয়েছিল পরিবারের কাছে। কিন্তু সেই যাত্রাই কাল হলো নাদিরার জীবনে। মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে নেত্রকোনা থেকে ছেড়ে যাওয়া আসা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনে পুড়ে নিহত হন পপিসহ তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিন রহমান পিয়াস। এ সময় পপির ছোট ভাই তার বড় ছেলেকে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ায় তারা বেঁচে যান।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার বৈরাটি গ্রামের মো. ফজলুল হকের মেয়ে। ১১ বছর আগে সদর উপজেলার দক্ষিণ বিশিউড়া গ্রামের বরুনা গ্রামের মিজানুরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। মিজানুর ঢাকায় ব্যবসা করেন। তিনি পরিবার নিয়ে কারওয়ান বাজার এলাকায় থাকতেন। মৃত্যুর খবর পেয়ে বাবা ফজলুর রহমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ছুটে আসেন। সেই বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। কান্নায় ভেঙে পড়ছেন পপির বাবা-মা ও স্বজনরা।
নাদিরার বাবা ফজলুল হক আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘মেয়ে নিরাপদের জন্যে ট্রেনে কইর্যা গেছে। আর এই টেইনে গিয়েই মারা গেছে। এই ঘটনার বিচার চাই। আপনারা সঠিকভাবে বিচার করবেন।’ পরিবার জানায়, গত সোমবার রাতে দুই সন্তানকে নিয়ে নাদিরা তার ভাই হাবিবুর রহমানের সঙ্গে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে চড়ে ঢাকার বাসায় ফিরছিলেন। ট্রেনে আগুনের ঘটনার সময় হাবিবুর রহমান ভাগনে ফাহিমকে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে জীবন বাঁচাতে পারলেও ট্রেনে আটক পড়ে আগুনে দগ্ধ হয়ে শিশু সন্তানসহ মারা যান নাদিরা।
নাদিরার দেবর আবদুল কাদির মিলন বলেন, ‘স্কুল বন্ধের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল নাদিরাসহ তার দুই সন্তান। রাতে ওদেরকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে আসি। ঢাকার বাসায় যাচ্ছিল। ‘পরে শুনি ট্রেনে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। এখনও লাশ আসেনি। জানাজার সময় নির্ধারণ করা হয়নি। সবাইকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ নাদিরার বোন লিপি আক্তার বলেন, ‘আমার বোনের সঙ্গে শেষমেষ দুইটা কথাও বলতে পারছি না। আমরার বুকে যেমন আগুন দিছে হেরার বুকেও তেমন যেন আগুন লাগে। আমরা সরকারের কাছে বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ হত্যার বিচার চাই।’
মা-ছেলের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়া হস্তান্তর
তেজগাঁওয়ে ট্রেনে আগুনের ঘটনায় পরিচয় পাওয়া মা-ছেলের মরদেহ বিনা ময়নাতদন্তে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন- নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার ছেলে ইয়াসিন (৩)। মঙ্গলবার বিকেলে ঢামেক মর্গ থেকে পরিবারের সদস্যরা তাদের মরদেহ বুঝে নিয়ে যান। ঢাকা রেলওয়ে ওসি ফেরদৌস আহামেদ বিশ্বাস বলেন, আরও একজনের মরদেহ শনাক্ত হয়েছে বলে শুনেছি। তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। নাদিরা আক্তার পপি নেত্রকোনার সদর উপজেলার বরুনা গ্রামের মিজানুর রহমানের স্ত্রী। নিহত নাদিরা একই জেলার পূর্বধলা উপজেলার আলমপুর গ্রামের ফজলুল রহমানের মেয়ে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওই সন্তানটি ভয় পেয়ে হয়তো তার মাকে জড়িয়ে ধরেছিল, তার মা ও হয়তো সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুজনকেই মৃত্যু আলিঙ্গন করতে হয়েছে। ওই অবস্থাতেই পাওয়া গেছে তাদের লাশ।’
যাত্রীদের বরাত দিয়ে তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন জানান, ট্রেনটি খিলক্ষেতে এলে যাত্রীরা বগিতে আগুন দেখতে পান। তারা চিৎকার শুরু করলে চালক ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে থামান। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভাতে কাজ শুরু করে। রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, তারা এ ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক নাশকতা’ হিসেবেই সন্দেহ করছেন।
তিনি জানান, ট্রেনের দুই বগির সংযোগস্থলে প্রথমে আগুন দেখতে পান রেলওয়ে স্টাফরা। তারা ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশাপাশি দুটি কোচে। এ সময় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিলে অনেকে হুড়োহুড়ি করে নামার চেষ্টা করেন। আবার ভোরের ঘুম ঘুম পরিবেশে অনেকে শুরুতে বুঝতেই পারেননি কী ঘটতে যাচ্ছে। ওই ঘটনায় ট্রেন থেকে নামতে গিয়েও কয়েকজন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে মাথায় আঘাত পাওয়া একজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত ওই ব্যক্তির নাম নুরুল হক ওরফে আবদুল কাদের (৫৩)। নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় তার বাড়ি। ঢাকায় তিনি হামীম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিবহন শাখায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।