দেশ-বিদেশে চায়ের রাজধানী বলে খ্যাত, পর্যটন নগরী, চারদিকে সবুজ চা বাগানে ঘেরা শ্রীমঙ্গল উপজেলার চা শ্রমিক সম্প্রদায়ের কন্যা মুক্তা দোষাদ। চা বাগানের গণ্ডি পেরিয়ে মুক্তা বর্তমানে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেন্স থেকে ২০২৪ সালে এপারেল এন্ড রিটেল ম্যানেজমেন্ট সাবজেক্ট এর উপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে।
জানা গেছে, শ্রীমঙ্গল থানার রাজঘাট চা বাগানের মৃত দীপচাঁন দোষাদ এর কন্যা মুক্তা দোষাদ। তাঁর মাতার সুমিত্রা দোষাদ। তারা তিন বোন। মুক্তা বোনদের মাঝে দ্বিতীয়।
চা পাতার নরম সবুজে ঘেরা পাহাড়ে শৈশব-কৈশোর কাটলেও পথচলার প্রতিটি বাঁকে মুক্তাকে সম্মুখীন হতে হয়েছে কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে। অল্পবয়সেই তিনি বাবাকে হারান । চা বাগানের রীতি অনুযায়ী মুক্তার মাকে বলা হয় চা শ্রমিকের কাজ নিতে। নাহলে ছেড়ে দিতে তাদের মাথাগোঁজার একমাত্র আশ্রয়। তিন কন্যাকে নিয়ে শুরু হয় মুক্তার মায়ের সংগ্রাম।ঐ সময়ে দিনে ৭০ টাকা মজুরিতে সেই সংসার চালানো ছিল অসম্ভব।
মুক্তা বলেন, ‘আমরা সপ্তাহে একদিন মাছ খেতাম। মাংস হয়তো দুই মাসে একদিন।’ তবু থেমে থাকেনি তাঁর স্বপ্ন। ভালো স্কুলের অভাব, পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার ঘাটতি , আর ক্রমাগত আর্থিক সংকট- সবকিছুর মাঝেও মুক্তা তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন।
বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলেন তিনি। পড়াশোনার খরচ যোগাতে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় থেকেই শুরু করেন টিউশনি। ভোর সাতটায় উঠে দুটো টিউশন করানো। তারপর কলেজ করে কোচিং শেষে আরও তিনটি টিউশন করে রাতে বাড়ি ফিরতেন। এভাবে নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেকেই চালাতে হয়েছে কিশোরী মুক্তাকে। তিনি বুঝতে পারতেন মায়ের একার আয়ে তাঁর আর ছোট বোনের পড়াশোনা সম্ভব নয়।
মুক্তার উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয় চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন থেকে একটি শিক্ষাবৃত্তি অর্জনের মাধ্যমে।
সমাজ ও পরিবারের বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে যায় মেধাবী মুক্তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মা-ই ছিলেন তাঁর সবচেয়ে বড় ভরসা। অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও মা তাঁকে সাহস দিয়ে বলেন, ‘তুই যদি যেতে চাস মা, তাহলে যা। নিজের স্বপ্ন পূরণ কর।’
চা শ্রমিকদের জীবনের কঠিন বাস্তবতা মুক্তা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাই নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার ভাবনা প্রতিনিয়ত তাঁকে আলোড়িত করতো। সেই তাড়না থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি যুক্ত হন University Tea Students Association (UTSA)-এর সাথে। এই সংগঠনটি চা বাগানের সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে।
মুক্তা বিশ্বাস মনে করেন চা বাগানের প্রতিটি শিশুকে সঠিক শিক্ষা আর সুযোগ দেওয়া গেলে বদলে যাবে তাদের জীবন। শিক্ষা অর্জনের সাথে সাথে সকল প্রতিকূলতা থেকেও মুক্তি মিলবে। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ ও স্বেচ্ছাসেবী কর্মকান্ডে মুক্তার অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে।
মূল্যবোধ ভিত্তিক সামাজিক নেতৃত্বে দক্ষতা বাড়াতে ২০২২ সালে তিনি অংশগ্রহণ করেন আমরা নতুন নেটওয়ার্কের চেইঞ্জমেকার ট্রেনিং-এর চট্টগ্রাম কোহর্টে।
২০২২ সালেই একজন তরুণ অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে তিনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নির্বাচিত ১০০ জন যুব প্রতিনিধি’র একজন হন এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পান।
২০২৩ সালে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর আইসিডিডিআরবি ( ওঈউউজই) আয়োজিত একটি জাতীয় পর্যায়ের একটি প্রকল্প সম্মেলনে তিনি মোট ১০০ জন নির্বাচিত প্রার্থীদের মধ্য থেকে অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত হন এবং সেখানে “সেরা প্রকল্প লিডার” পুরস্কার লাভ করেন।
Teach for Bangladesh-এর ২০২৪ কোহর্টের একজন প্রতিশ্রুতিশীল ফেলো হিসেবেও নির্বাচিত হন তিনি।
মুক্তা দোষাদ প্রমাণ করেছেন, স্বপ্ন দেখতে হয় । আর সেই স্বপ্নের পথে লড়াই করার সাহস থাকতে হয়।
মুক্তা মনে করেন তাঁর নিজের সংগ্রাম যদি এতদূর পৌঁছাতে পারে তাহলে চা বাগানের প্রতিটি সন্তানকে সঠিক সুযোগ আর শিক্ষা দিলে তারাও দেশের গর্ব হয়ে উঠবে।
শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫
দেশ-বিদেশে চায়ের রাজধানী বলে খ্যাত, পর্যটন নগরী, চারদিকে সবুজ চা বাগানে ঘেরা শ্রীমঙ্গল উপজেলার চা শ্রমিক সম্প্রদায়ের কন্যা মুক্তা দোষাদ। চা বাগানের গণ্ডি পেরিয়ে মুক্তা বর্তমানে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেন্স থেকে ২০২৪ সালে এপারেল এন্ড রিটেল ম্যানেজমেন্ট সাবজেক্ট এর উপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে।
জানা গেছে, শ্রীমঙ্গল থানার রাজঘাট চা বাগানের মৃত দীপচাঁন দোষাদ এর কন্যা মুক্তা দোষাদ। তাঁর মাতার সুমিত্রা দোষাদ। তারা তিন বোন। মুক্তা বোনদের মাঝে দ্বিতীয়।
চা পাতার নরম সবুজে ঘেরা পাহাড়ে শৈশব-কৈশোর কাটলেও পথচলার প্রতিটি বাঁকে মুক্তাকে সম্মুখীন হতে হয়েছে কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে। অল্পবয়সেই তিনি বাবাকে হারান । চা বাগানের রীতি অনুযায়ী মুক্তার মাকে বলা হয় চা শ্রমিকের কাজ নিতে। নাহলে ছেড়ে দিতে তাদের মাথাগোঁজার একমাত্র আশ্রয়। তিন কন্যাকে নিয়ে শুরু হয় মুক্তার মায়ের সংগ্রাম।ঐ সময়ে দিনে ৭০ টাকা মজুরিতে সেই সংসার চালানো ছিল অসম্ভব।
মুক্তা বলেন, ‘আমরা সপ্তাহে একদিন মাছ খেতাম। মাংস হয়তো দুই মাসে একদিন।’ তবু থেমে থাকেনি তাঁর স্বপ্ন। ভালো স্কুলের অভাব, পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার ঘাটতি , আর ক্রমাগত আর্থিক সংকট- সবকিছুর মাঝেও মুক্তা তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন।
বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলেন তিনি। পড়াশোনার খরচ যোগাতে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় থেকেই শুরু করেন টিউশনি। ভোর সাতটায় উঠে দুটো টিউশন করানো। তারপর কলেজ করে কোচিং শেষে আরও তিনটি টিউশন করে রাতে বাড়ি ফিরতেন। এভাবে নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেকেই চালাতে হয়েছে কিশোরী মুক্তাকে। তিনি বুঝতে পারতেন মায়ের একার আয়ে তাঁর আর ছোট বোনের পড়াশোনা সম্ভব নয়।
মুক্তার উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয় চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন থেকে একটি শিক্ষাবৃত্তি অর্জনের মাধ্যমে।
সমাজ ও পরিবারের বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে যায় মেধাবী মুক্তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মা-ই ছিলেন তাঁর সবচেয়ে বড় ভরসা। অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও মা তাঁকে সাহস দিয়ে বলেন, ‘তুই যদি যেতে চাস মা, তাহলে যা। নিজের স্বপ্ন পূরণ কর।’
চা শ্রমিকদের জীবনের কঠিন বাস্তবতা মুক্তা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাই নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার ভাবনা প্রতিনিয়ত তাঁকে আলোড়িত করতো। সেই তাড়না থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি যুক্ত হন University Tea Students Association (UTSA)-এর সাথে। এই সংগঠনটি চা বাগানের সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে।
মুক্তা বিশ্বাস মনে করেন চা বাগানের প্রতিটি শিশুকে সঠিক শিক্ষা আর সুযোগ দেওয়া গেলে বদলে যাবে তাদের জীবন। শিক্ষা অর্জনের সাথে সাথে সকল প্রতিকূলতা থেকেও মুক্তি মিলবে। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ ও স্বেচ্ছাসেবী কর্মকান্ডে মুক্তার অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে।
মূল্যবোধ ভিত্তিক সামাজিক নেতৃত্বে দক্ষতা বাড়াতে ২০২২ সালে তিনি অংশগ্রহণ করেন আমরা নতুন নেটওয়ার্কের চেইঞ্জমেকার ট্রেনিং-এর চট্টগ্রাম কোহর্টে।
২০২২ সালেই একজন তরুণ অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে তিনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নির্বাচিত ১০০ জন যুব প্রতিনিধি’র একজন হন এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পান।
২০২৩ সালে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর আইসিডিডিআরবি ( ওঈউউজই) আয়োজিত একটি জাতীয় পর্যায়ের একটি প্রকল্প সম্মেলনে তিনি মোট ১০০ জন নির্বাচিত প্রার্থীদের মধ্য থেকে অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত হন এবং সেখানে “সেরা প্রকল্প লিডার” পুরস্কার লাভ করেন।
Teach for Bangladesh-এর ২০২৪ কোহর্টের একজন প্রতিশ্রুতিশীল ফেলো হিসেবেও নির্বাচিত হন তিনি।
মুক্তা দোষাদ প্রমাণ করেছেন, স্বপ্ন দেখতে হয় । আর সেই স্বপ্নের পথে লড়াই করার সাহস থাকতে হয়।
মুক্তা মনে করেন তাঁর নিজের সংগ্রাম যদি এতদূর পৌঁছাতে পারে তাহলে চা বাগানের প্রতিটি সন্তানকে সঠিক সুযোগ আর শিক্ষা দিলে তারাও দেশের গর্ব হয়ে উঠবে।