alt

অর্থ-বাণিজ্য

অর্থনীতি ‘খুবই নাজুক’, ৩৪ বছরে এমন ‘টানাপোড়েন দেখেননি’ ব্যবসায়ীরা

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক : রোববার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫

দেশের অর্থনীতি ‘খুব নাজুক’ বলে বলছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। এই অবস্থা চলতে থাকলে বিনিয়োগ অন্যদেশে চলে যাবে বলে তাদের আশঙ্কা। প্রবৃদ্ধির ‘ধার কমে গেছে’, ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ ‘কমে গেছে’, কর্মসংস্থানে সমস্যা ‘রয়ে গেছে’ বলে তাদের অভিমত। তারা এও বললেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার ‘আগের সরকারের মতোই’ কাজ করছে।

একজন ব্যবসায়ি, যিনি ৩৪ বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করেন, বললেন ‘এমন টানাপোড়েন’ তার ব্যবসায়িক জীবনে ‘দেখেননি’। আর এই সময়ে ‘অবিবেচকের’ মত ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে বলেও মন্তব্য তাদের।

শনিবার (১৮ জানুয়ারি) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিআইসিসির কার্নিভ্যাল হলে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি-২০২৪ আয়োজিত ‘শ্বেতপত্র এবং অতঃপর : অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার, জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক সিম্পোজিয়ামে এসব কথা ওঠে আসে।

সেখানে কেউ কেউ বললেন, এখন প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ‘যতটা মনোযোগ’ পাচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ততটা মনোযোগ ‘পাচ্ছে না’। এই সরকার কী ধরনের অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার রেখে যাবে সেই প্রশ্নও তুলেন কেউ কেউ।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তাদের মত এখনই আলোচনা করা দরকার।

এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘আমরা অর্থনৈতিক অস্বস্তি এবং নিরাপত্তার অভাববোধ করছি। আমাদের ভোক্তাদের আত্মবিশ্বাস খুবই কম। আর অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ইনভেস্টরদের (বিনিয়োগকারীদের) নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। এই বিষয়গুলো আমরা আগে থেকেই প্রাইভেট সেক্টর থেকে বলেছি।’

নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘আমরা এখন খুবই সিরিয়াসলি বলছি, আমাদের অর্থনীতি খুবই নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। আমি ৩৪ বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করি, এমন টানাপোড়েন আমার পুরো ব্যবসায়িক সময়ে দেখিনি। আমাদের একটি ভুল ধারণা হচ্ছে, বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশে বিনিয়োগ করার জায়গা নেই।’

সিম্পোজিয়ামের প্রথম অধিবেশনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ও সিটিজেনস প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজিএস বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘অবিবেচনাপ্রসূতভাবে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। কর সংগ্রহ করতে হলে ক্রমান্বয়ে প্রত্যক্ষ করের কাছে যেতে হয়। আমরা প্রত্যক্ষ কর আহরণে কোনো পরিকল্পনা দেখিনি। যারা কর দেয় না তাদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেটা জানা গেলো না। আমাদের এটা চিন্তিত করেছে। আগামী গরমে জ্বালানি পরিস্থিতি আরও জটিল হবে এই আশঙ্কা করছি।’

সরকার গত ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে অধ্যাদেশ জারি করে। পরে বিভিন্ন মহল থেকে সমালচনার মুখে কিছু ক্ষেত্রে তা কমানো হয়।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার যতটা মনোযোগ পাচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ততটা মনোযোগ পাচ্ছে না। অনেকেই বলছেন অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই সরকার আগের সরকারের মতোই কাজ করছে। এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা, প্রবৃদ্ধির ধারা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে আমরা যারা সংস্কারকে গতিশীল করতে চাই তারা ধৈর্যহারা হয়ে যাবেন। সংস্কারের পক্ষের মানুষগুলো অর্থনৈতিক অস্বস্তি ও নিরাপত্তার অভাব থেকে সুষম সংস্কারের পক্ষ থেকে সরে যেতে পারে।’

রেকর্ড পরিমাণ আমন উৎপাদন করেও সংগ্রহ অভিযানে সাফল্য নেই জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সংগ্রহ অভিযানে আগে যেমন দুর্নীতি ছিল, তা এখনো আছে। কৃষক তার ফসলের মূল্য পাচ্ছে না। সামাজিক সুরক্ষা বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে আছে।’ এই সরকার কী ধরনের অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার রেখে যাবে প্রশ্ন তুলেন এই অর্থনীতিবিদ। সুষম অর্ন্তভুক্তিমূলক, টেকসই অর্থনীতি গড়ে তুলতে যে ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো দরকার বা সংস্কার দরকার সেই রকমের কোনো রূপরেখা আমরা দেখলাম না, অভিযোগ তার।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত বাজেটের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।‘ এই সরকার সংশোধিত বাজেট পেশ না করায় আগের সরকারের দিয়ে যাওয়া বাজেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সূচকই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য তার।

অন্তর্বর্তী সরকার ‘সুস্পষ্ট কোনো’ অর্থনৈতিক ইশতেহারও তৈরি ‘করেনি’ জানিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ‘আগামী বাজেটকে কেন্দ্র করে সরকারের অর্থনৈতিক আলোচনা দরকার। প্রবৃদ্ধির ধার কমে গেছে, ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ কমে গেছে, কর্মসংস্থানে সমস্যা রয়ে গেছে।’

নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান দামের প্রেক্ষাপটে সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্যের দাম বাড়িয়ে এর আওতা বাড়ানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তবে এখন টিসিবির পণ্যের দাম বাড়ানো হলে ব্যাপক সমালোচনা হবে জানিয়ে এই উপদেষ্টা বলেন, ‘এই চিন্তাগুলো সাহসের সঙ্গে করতে হবে।’

দীর্ঘদিন ধরে টিসিবির পণ্যের দাম সমন্বয় করা হয়নি জানিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল হতে পারে। আমরা রাজনীতিবিদ না। আমরা কি দীর্ঘমেয়াদে ১৭৫-১৮০টাকায় তেল কিনে ১০০টাকায় বিক্রি করবো? নাকি ১২৫-১৩০টাকা করে এক কোটির জায়গায় দেড় কোটি বা দুই কোটি সুবিধাভগীতে প্রসারিত করবো? এই চিন্তাগুলো আমাদের সাহসের সঙ্গে করতে হবে। যদি তা না করি তাহলে আমরাও একই বৃত্তে থেকে যাবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘এক কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে টিসিবির পণ্য সরবরাহ করা হয়। এটাকে যখন ডিজিটাইজড করেছি তখন দেখেছি ৩৭ লাখ ভুয়া কার্ডধারী এখানে। বৃহৎ কিছু প্রতিষ্ঠান টিসিবির টেন্ডারে অংশ নিতে পারে। টিসিবির আকার, পেমেন্ট পলিসি, আর্থিক অবকাঠামো চলছে বাণিজ্যিক ঋণে, যা টেকসই নয়।’

টিসিবির সেবাগ্রহীতা কমানোর কথা বলে তিনি বলেন, ‘আমরা টিকেট সাইজ ছোট করার চেষ্টা করছি। ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে টিসিবির সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছি। যাতে টিসিবি যে পণ্যটা কেনে, তার মানটা ভালো হয়।’

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ‘সরকার কোনো একটি খাতকে গুরুত্ব না দিয়ে সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাতকে গুরুত্ব দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করবে বলে আশা করি। ১০০ ইকোনমিক জোন হবে না, সরকারিভাবে সেটা পাঁচটিতে নামিয়ে এনেছি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, ‘গত ১৫ বছরে উন্নয়নের গালগল্প শোনানো হয়েছে। সরকারি পরিসংখানের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের মিল নেই। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কী কী চুক্তি হয়েছে তা আমাদের জানা দরকার, আমাদের শোষণ করা হয়েছে, ভারতের অঙ্গরাজ্যে আমাদের পরিণত করা হয়েছিল। সরকার এখনো এই বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেয়নি।’

তিনি বলেন, ‘আমলাদের সুবিধা দেয়া হয়েছে নানাভাবে, কিন্তু তারা কাঠামো নষ্ট করেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। যারা টাকা পাচার করেছে, দেশের ভেতরেও আছে তাদের টাকা, সেখান থেকে টাকা উদ্ধার করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে খরচ করা উচিত বর্তমান সরকারের।’

ছবি

শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে ডিএসইর একগুচ্ছ পদক্ষেপ

ছবি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি মূল্যস্ফীতি

সবজিতে স্বস্তি মিললেও পেঁয়াজ, মুরগি ও চাল বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে

ছবি

জেসিআই মুন্সিগঞ্জ চ্যাপ্টারের লোকাল প্রেসিডেন্ট সাকিফ আহমেদ

ছবি

বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্ণরের সাথে ঢাকা চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদের সাক্ষাৎ

ছবি

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সিদ্ধান্তে পরিবর্তন এনেছে এনবিআর

ছবি

সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার বৃদ্ধি: সর্বোচ্চ ১২.৫৫ শতাংশ

ছবি

নীতি সংশোধনের আগে অংশীজনদের সাথে পরামর্শ না করা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ফিকি

ছবি

ডিসিসিআইতে ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিজনেস ফোরাম’ বিষয়ক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

অর্থনৈতিক সংস্কার ও বাজেট বিষয়ে শ্বেতপত্র কমিটির দিনব্যাপী সিম্পোজিয়াম

ছবি

নতুন বছর উপলেক্ষে ক্যামন সিরিজে বিশেষ অফার দিচ্ছে টেকনো

ছবি

দিনে দুই হাজার কোটি টাকা লেনদেনের মাইলফলকে নগদ

ছবি

মনির হোসেনের সম্পদ জব্দ, ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ

ছবি

মোবাইল ইন্টারনেট সেবায় ফিরল ছোট মেয়াদের ডেটা প্যাকেজ

ছবি

রিয়াদে ইউএনসিসিডি ‘সিওপি-১৬’ সম্মেলনে প্রিয়শপ

ছবি

ন্যাশনাল পেমেন্ট এগ্রিগেটর হিসেবে আসছে ‘একপে’

ছবি

উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় শতাধিক পণ্যে বাড়ল ভ্যাট-শুল্ক, আতঙ্কে ভোক্তারা

ছবি

সবজিতে ভরপুর বাজার, কমেছে দামও

ছবি

মেরামতের জন্য মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল থেকে ৭২ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ

ছবি

গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনায় ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্তি: বাণিজ্য উপদেষ্টা

ছবি

একনেকে ৪,২৪৬ কোটি টাকার ১০ প্রকল্প অনুমোদন

ছবি

চালের দাম অযৌক্তিকভাবে বেড়েছে: মজুতদারির অভিযোগ তুলে সরকারের উদ্যোগ

ছবি

মোটরসাইকেল ও এসি শিল্পে কর দ্বিগুণ, রাজস্ব বাড়াতে সরকারের নতুন পদক্ষেপ

ছবি

মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, এসি শিল্পে আয়কর দ্বিগুণ হল

প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৬ লাখ কোটি টাকারও বেশি : বাংলাদেশ ব্যাংক

বিবিএস এর পরিসংখ্যান : প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি তলানিতে, বছর শেষে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে

ছবি

জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে ৪.২৩ শতাংশ

ছবি

আরো পাঁচ ব্যাংকের এমডি বাধ্যতামূলক ছুটিতে

‘এই চালতো খামু ৫০ টাকায়, ৬৮ টাকায় ক্যা?’

ছবি

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা: ডলার কেনাবেচায় সর্বোচ্চ ১ টাকা ব্যবধান নির্ধারণ

ছবি

ডিসেম্বরে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ১৮%, তৈরি পোশাকে স্বস্তি

ছবি

জেসিআই ঢাকা পাইওনিয়ার এর নতুন প্রেসিডেন্ট তাসদীখ হাবীব

ছবি

ডিসেম্বরে রেকর্ড রেমিটেন্স: এক মাসে এলো ২৬৪ কোটি ডলার

ছবি

বেক্সিমকোর তিন কোম্পানিতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে বিএসইসি

ছবি

বিকাশ-এর সেন্ড মানি সেবার আদ্যোপান্ত

ছবি

দেশসেরা ব্র্যান্ডগুলোকে পুরষ্কৃত করলো বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম

tab

অর্থ-বাণিজ্য

অর্থনীতি ‘খুবই নাজুক’, ৩৪ বছরে এমন ‘টানাপোড়েন দেখেননি’ ব্যবসায়ীরা

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

রোববার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫

দেশের অর্থনীতি ‘খুব নাজুক’ বলে বলছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। এই অবস্থা চলতে থাকলে বিনিয়োগ অন্যদেশে চলে যাবে বলে তাদের আশঙ্কা। প্রবৃদ্ধির ‘ধার কমে গেছে’, ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ ‘কমে গেছে’, কর্মসংস্থানে সমস্যা ‘রয়ে গেছে’ বলে তাদের অভিমত। তারা এও বললেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার ‘আগের সরকারের মতোই’ কাজ করছে।

একজন ব্যবসায়ি, যিনি ৩৪ বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করেন, বললেন ‘এমন টানাপোড়েন’ তার ব্যবসায়িক জীবনে ‘দেখেননি’। আর এই সময়ে ‘অবিবেচকের’ মত ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে বলেও মন্তব্য তাদের।

শনিবার (১৮ জানুয়ারি) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিআইসিসির কার্নিভ্যাল হলে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি-২০২৪ আয়োজিত ‘শ্বেতপত্র এবং অতঃপর : অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার, জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক সিম্পোজিয়ামে এসব কথা ওঠে আসে।

সেখানে কেউ কেউ বললেন, এখন প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ‘যতটা মনোযোগ’ পাচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ততটা মনোযোগ ‘পাচ্ছে না’। এই সরকার কী ধরনের অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার রেখে যাবে সেই প্রশ্নও তুলেন কেউ কেউ।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তাদের মত এখনই আলোচনা করা দরকার।

এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘আমরা অর্থনৈতিক অস্বস্তি এবং নিরাপত্তার অভাববোধ করছি। আমাদের ভোক্তাদের আত্মবিশ্বাস খুবই কম। আর অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ইনভেস্টরদের (বিনিয়োগকারীদের) নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। এই বিষয়গুলো আমরা আগে থেকেই প্রাইভেট সেক্টর থেকে বলেছি।’

নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘আমরা এখন খুবই সিরিয়াসলি বলছি, আমাদের অর্থনীতি খুবই নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। আমি ৩৪ বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করি, এমন টানাপোড়েন আমার পুরো ব্যবসায়িক সময়ে দেখিনি। আমাদের একটি ভুল ধারণা হচ্ছে, বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশে বিনিয়োগ করার জায়গা নেই।’

সিম্পোজিয়ামের প্রথম অধিবেশনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ও সিটিজেনস প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজিএস বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘অবিবেচনাপ্রসূতভাবে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। কর সংগ্রহ করতে হলে ক্রমান্বয়ে প্রত্যক্ষ করের কাছে যেতে হয়। আমরা প্রত্যক্ষ কর আহরণে কোনো পরিকল্পনা দেখিনি। যারা কর দেয় না তাদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেটা জানা গেলো না। আমাদের এটা চিন্তিত করেছে। আগামী গরমে জ্বালানি পরিস্থিতি আরও জটিল হবে এই আশঙ্কা করছি।’

সরকার গত ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে অধ্যাদেশ জারি করে। পরে বিভিন্ন মহল থেকে সমালচনার মুখে কিছু ক্ষেত্রে তা কমানো হয়।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার যতটা মনোযোগ পাচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ততটা মনোযোগ পাচ্ছে না। অনেকেই বলছেন অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই সরকার আগের সরকারের মতোই কাজ করছে। এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা, প্রবৃদ্ধির ধারা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে আমরা যারা সংস্কারকে গতিশীল করতে চাই তারা ধৈর্যহারা হয়ে যাবেন। সংস্কারের পক্ষের মানুষগুলো অর্থনৈতিক অস্বস্তি ও নিরাপত্তার অভাব থেকে সুষম সংস্কারের পক্ষ থেকে সরে যেতে পারে।’

রেকর্ড পরিমাণ আমন উৎপাদন করেও সংগ্রহ অভিযানে সাফল্য নেই জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সংগ্রহ অভিযানে আগে যেমন দুর্নীতি ছিল, তা এখনো আছে। কৃষক তার ফসলের মূল্য পাচ্ছে না। সামাজিক সুরক্ষা বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে আছে।’ এই সরকার কী ধরনের অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার রেখে যাবে প্রশ্ন তুলেন এই অর্থনীতিবিদ। সুষম অর্ন্তভুক্তিমূলক, টেকসই অর্থনীতি গড়ে তুলতে যে ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো দরকার বা সংস্কার দরকার সেই রকমের কোনো রূপরেখা আমরা দেখলাম না, অভিযোগ তার।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত বাজেটের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।‘ এই সরকার সংশোধিত বাজেট পেশ না করায় আগের সরকারের দিয়ে যাওয়া বাজেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সূচকই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য তার।

অন্তর্বর্তী সরকার ‘সুস্পষ্ট কোনো’ অর্থনৈতিক ইশতেহারও তৈরি ‘করেনি’ জানিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ‘আগামী বাজেটকে কেন্দ্র করে সরকারের অর্থনৈতিক আলোচনা দরকার। প্রবৃদ্ধির ধার কমে গেছে, ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ কমে গেছে, কর্মসংস্থানে সমস্যা রয়ে গেছে।’

নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান দামের প্রেক্ষাপটে সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্যের দাম বাড়িয়ে এর আওতা বাড়ানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তবে এখন টিসিবির পণ্যের দাম বাড়ানো হলে ব্যাপক সমালোচনা হবে জানিয়ে এই উপদেষ্টা বলেন, ‘এই চিন্তাগুলো সাহসের সঙ্গে করতে হবে।’

দীর্ঘদিন ধরে টিসিবির পণ্যের দাম সমন্বয় করা হয়নি জানিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল হতে পারে। আমরা রাজনীতিবিদ না। আমরা কি দীর্ঘমেয়াদে ১৭৫-১৮০টাকায় তেল কিনে ১০০টাকায় বিক্রি করবো? নাকি ১২৫-১৩০টাকা করে এক কোটির জায়গায় দেড় কোটি বা দুই কোটি সুবিধাভগীতে প্রসারিত করবো? এই চিন্তাগুলো আমাদের সাহসের সঙ্গে করতে হবে। যদি তা না করি তাহলে আমরাও একই বৃত্তে থেকে যাবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘এক কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে টিসিবির পণ্য সরবরাহ করা হয়। এটাকে যখন ডিজিটাইজড করেছি তখন দেখেছি ৩৭ লাখ ভুয়া কার্ডধারী এখানে। বৃহৎ কিছু প্রতিষ্ঠান টিসিবির টেন্ডারে অংশ নিতে পারে। টিসিবির আকার, পেমেন্ট পলিসি, আর্থিক অবকাঠামো চলছে বাণিজ্যিক ঋণে, যা টেকসই নয়।’

টিসিবির সেবাগ্রহীতা কমানোর কথা বলে তিনি বলেন, ‘আমরা টিকেট সাইজ ছোট করার চেষ্টা করছি। ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে টিসিবির সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছি। যাতে টিসিবি যে পণ্যটা কেনে, তার মানটা ভালো হয়।’

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ‘সরকার কোনো একটি খাতকে গুরুত্ব না দিয়ে সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাতকে গুরুত্ব দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করবে বলে আশা করি। ১০০ ইকোনমিক জোন হবে না, সরকারিভাবে সেটা পাঁচটিতে নামিয়ে এনেছি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, ‘গত ১৫ বছরে উন্নয়নের গালগল্প শোনানো হয়েছে। সরকারি পরিসংখানের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের মিল নেই। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কী কী চুক্তি হয়েছে তা আমাদের জানা দরকার, আমাদের শোষণ করা হয়েছে, ভারতের অঙ্গরাজ্যে আমাদের পরিণত করা হয়েছিল। সরকার এখনো এই বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেয়নি।’

তিনি বলেন, ‘আমলাদের সুবিধা দেয়া হয়েছে নানাভাবে, কিন্তু তারা কাঠামো নষ্ট করেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। যারা টাকা পাচার করেছে, দেশের ভেতরেও আছে তাদের টাকা, সেখান থেকে টাকা উদ্ধার করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে খরচ করা উচিত বর্তমান সরকারের।’

back to top