অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ন একটি সূচক বিনিয়োগ। দেশে বিনিয়োগের অবস্থা ভালো থাকলে অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য পরিবেশক থাকে, নতুন কমংসংস্থানও ভালো হয়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগের অবস্থা খুব ভালো নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে চলতি মূল্যে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদনের) আকার দাঁড়িয়েছে ৫০ লাখ ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে দেশে বিনিয়োগ হয়েছে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, অর্থ বছরে (২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত) জিডিপির ৩০ দশমিক ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে যা পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জিডিপির ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছিল। ওই বছরে জিডিরি আকার ছিল ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। বিনিয়োগ হয়েছিল ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরে জিডিপির ৩২ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ অর্থ দেশে বিনিয়োগ হয়, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ। ওই অর্থ বছরে জিডিপির আকার ছিল ৩৯ লাখ ৭১ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। বিনিয়োগ হয়েছিল ১২ লাখ ৭২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে জিডিপির ৩০ দশমিক ৯৫ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ হয় দেশে। ওই অর্থ বছরে জিডিপির আকার ছিল ৪৪ লাখ ৯০ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। বিনিয়োগ হয়েছিল ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো ঘিরে দেশে বিনিয়োগের একটি আবহ তৈরি হয়েছিল, তার প্রভাবেই ২০২৩-২৩ অর্থ বছরে দেশে প্রথবারের মতো বিনিয়োগ জিডিপির ৩২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ১০ বছর আগে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে জিডিপির ২৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ হয়েছিল দেশে। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ছিল ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে দেশে জিডিপির ৩০ দশমিক ৫১ শতাংশ বিনিয়োগ হয়। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে তা বেড়ে হয় ৩১ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে তা আরও বেড়ে ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশে ওঠে। ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছিল ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও ৩১ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ।
নানা সংকটের মধ্যেও দেশে বিনিয়োগ অল্প অল্প করে বাড়ছিল। কিন্তু এখন যে নিম্ন মুখী ধারা চলছে, তা কত নিচে গিয়ে ঠেকবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদন ও ব্যবসায়ীরা। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর বড় ব্যবসায়ীদের বেশ কয়েকজন এখন কারাবন্দি। অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন, বিদেশেও পালিয়ে গেছেন কেউ কেউ। তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই অচল হয়ে আছে।
অর্থ বছর শেষ হওয়ার সাত মাস পর গত ১০ ফেব্রুয়ারি পরিসংখ্যান ব্যুরো জিডিপি প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাবের পাশাপাশি জাতীয় বিনিয়োগের তথ্যও প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে চলতি মূল্যে জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৫০ লাখ ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা বা ৪৫০ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৩৮ ডলার।
সাময়িক হিসাবে জিডিপির আকার ছিল ৫০ লাখ ৪৮ হাজার ২৭ কোটি টাকা বা ৪৫৯ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৭৮৪ ডলার। ২০২০-২১ অর্থ বছরে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৯১ ডলার। ২০১৯-২০ ও ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ছিল যথাক্রমে ২ হাজার ৩২৬ ও ২ হাজার ২০৯ ডলার। গত বছরের ২০ মে ৭ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) হিসাব কষে বিবিএস সাময়িক যে হিসাব প্রকাশ করেছিল, তাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল। তবে চূড়ান্ত হিসাবে তা ১ দশমিক ৬০ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে ৪ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে আসে।
কোভিড মহামারির আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) বেড়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ (ভিত্তি বছর পরিবর্তনের পর ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি।
পরিসংখ্যান ব্যুরো চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, এই প্রান্তিকে মাত্র ১ দশমিক ৮১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এই হার গত অর্থ বছরের একই প্রান্তিকের চেয়ে ৪ দশমিক ২৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কম।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য শ্লথ গতির কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছে বলে মনে করছেন পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা। কৃষি, শিল্প ও সেবা—এই তিন খাতের উপাত্ত নিয়ে জিডিপি প্রকাশ করা হয়। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে কৃষি খাতে। এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মানে, কৃষি খাতে নাম মাত্র প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে, সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ২২ ও ৫ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।
দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি কতটা নাজুক, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ষষ্ঠ মাস এবং গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির তথ্য আছে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে। এসব তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এত কম প্রবৃদ্ধি গত ১০ বছরে কখনও হয়নি। কোভিড মহামারির সময় ২০২০ সালের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমলেও তা ছিল ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। প্রথম মাস জুলাইয়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। বিদেশি বিনিয়োগের তথ্যে চোখ রাখলে দেখা যায়, চলতি অর্থ বছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) মাত্র ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) এসেছে দেশে। গত অর্থ বছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ৭৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ হিসাবে এই ছয় মাসে এফডিআই কমেছে ৭১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
অর্থনীতির আরেক গুরুত্বপূর্ণ সূচক আমদানি। এই সূচকের জানুয়ারি পর্যন্ত তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনী যন্ত্রপাতি) আমদানির জন্য ১০০ কোটি ৫৭ লাখ (১ বিলিয়ন) ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ কম। নিষ্পত্তি কমেছে ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
জুলাই-জানুয়ারি সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমেডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি কমেছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। নিস্পত্তি কমেছে ১২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানির এলসি কমেছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। নিস্পত্তি কমেছে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ন একটি সূচক বিনিয়োগ। দেশে বিনিয়োগের অবস্থা ভালো থাকলে অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য পরিবেশক থাকে, নতুন কমংসংস্থানও ভালো হয়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগের অবস্থা খুব ভালো নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে চলতি মূল্যে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদনের) আকার দাঁড়িয়েছে ৫০ লাখ ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে দেশে বিনিয়োগ হয়েছে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, অর্থ বছরে (২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত) জিডিপির ৩০ দশমিক ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে যা পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জিডিপির ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছিল। ওই বছরে জিডিরি আকার ছিল ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। বিনিয়োগ হয়েছিল ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরে জিডিপির ৩২ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ অর্থ দেশে বিনিয়োগ হয়, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ। ওই অর্থ বছরে জিডিপির আকার ছিল ৩৯ লাখ ৭১ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। বিনিয়োগ হয়েছিল ১২ লাখ ৭২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে জিডিপির ৩০ দশমিক ৯৫ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ হয় দেশে। ওই অর্থ বছরে জিডিপির আকার ছিল ৪৪ লাখ ৯০ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। বিনিয়োগ হয়েছিল ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো ঘিরে দেশে বিনিয়োগের একটি আবহ তৈরি হয়েছিল, তার প্রভাবেই ২০২৩-২৩ অর্থ বছরে দেশে প্রথবারের মতো বিনিয়োগ জিডিপির ৩২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ১০ বছর আগে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে জিডিপির ২৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ হয়েছিল দেশে। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ছিল ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে দেশে জিডিপির ৩০ দশমিক ৫১ শতাংশ বিনিয়োগ হয়। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে তা বেড়ে হয় ৩১ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে তা আরও বেড়ে ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশে ওঠে। ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছিল ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও ৩১ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ।
নানা সংকটের মধ্যেও দেশে বিনিয়োগ অল্প অল্প করে বাড়ছিল। কিন্তু এখন যে নিম্ন মুখী ধারা চলছে, তা কত নিচে গিয়ে ঠেকবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদন ও ব্যবসায়ীরা। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর বড় ব্যবসায়ীদের বেশ কয়েকজন এখন কারাবন্দি। অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন, বিদেশেও পালিয়ে গেছেন কেউ কেউ। তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই অচল হয়ে আছে।
অর্থ বছর শেষ হওয়ার সাত মাস পর গত ১০ ফেব্রুয়ারি পরিসংখ্যান ব্যুরো জিডিপি প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাবের পাশাপাশি জাতীয় বিনিয়োগের তথ্যও প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে চলতি মূল্যে জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৫০ লাখ ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা বা ৪৫০ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৩৮ ডলার।
সাময়িক হিসাবে জিডিপির আকার ছিল ৫০ লাখ ৪৮ হাজার ২৭ কোটি টাকা বা ৪৫৯ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৭৮৪ ডলার। ২০২০-২১ অর্থ বছরে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৯১ ডলার। ২০১৯-২০ ও ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ছিল যথাক্রমে ২ হাজার ৩২৬ ও ২ হাজার ২০৯ ডলার। গত বছরের ২০ মে ৭ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) হিসাব কষে বিবিএস সাময়িক যে হিসাব প্রকাশ করেছিল, তাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল। তবে চূড়ান্ত হিসাবে তা ১ দশমিক ৬০ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে ৪ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে আসে।
কোভিড মহামারির আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) বেড়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ (ভিত্তি বছর পরিবর্তনের পর ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি।
পরিসংখ্যান ব্যুরো চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, এই প্রান্তিকে মাত্র ১ দশমিক ৮১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এই হার গত অর্থ বছরের একই প্রান্তিকের চেয়ে ৪ দশমিক ২৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কম।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য শ্লথ গতির কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছে বলে মনে করছেন পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা। কৃষি, শিল্প ও সেবা—এই তিন খাতের উপাত্ত নিয়ে জিডিপি প্রকাশ করা হয়। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে কৃষি খাতে। এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মানে, কৃষি খাতে নাম মাত্র প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে, সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ২২ ও ৫ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।
দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি কতটা নাজুক, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ষষ্ঠ মাস এবং গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির তথ্য আছে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে। এসব তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এত কম প্রবৃদ্ধি গত ১০ বছরে কখনও হয়নি। কোভিড মহামারির সময় ২০২০ সালের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমলেও তা ছিল ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। প্রথম মাস জুলাইয়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। বিদেশি বিনিয়োগের তথ্যে চোখ রাখলে দেখা যায়, চলতি অর্থ বছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) মাত্র ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) এসেছে দেশে। গত অর্থ বছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ৭৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ হিসাবে এই ছয় মাসে এফডিআই কমেছে ৭১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
অর্থনীতির আরেক গুরুত্বপূর্ণ সূচক আমদানি। এই সূচকের জানুয়ারি পর্যন্ত তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনী যন্ত্রপাতি) আমদানির জন্য ১০০ কোটি ৫৭ লাখ (১ বিলিয়ন) ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ কম। নিষ্পত্তি কমেছে ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
জুলাই-জানুয়ারি সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমেডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি কমেছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। নিস্পত্তি কমেছে ১২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানির এলসি কমেছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। নিস্পত্তি কমেছে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।