২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন মফস্বল এলাকা থেকে আসা শিক্ষার্থী সাদিক কাইয়ুম (ছদ্মনাম)। ঢাকা শহরে তার থাকার কোন জায়গা নেই। তাই তাকে হলেই উঠতে হবে। তার সংযুক্তি ছিল শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে।
জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে একদিন সাদিক হলে উঠতে যায়। হলের গেটে যেতে না যেতেই তাকে দুই-তিনজন শিক্ষার্থী ঘিরে ধরে। তারা নিজেদের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের কর্মী বলে পরিচয় দেয়। তারা সবাই সাদিককে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। অবশেষে একজন সাদিককে হলের বর্ধিত ভবনের একটি কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে সাদিকের মতো আরও ৩০-৩৫ জন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অবস্থান করছিল।
সাদিককে বলা হয়, এই গণরুমগুলো ‘ছাত্রলীগ দ্বারা পরিচালিত’। প্রথম-দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে উঠার ‘নিয়ম নেই’। ‘ছাত্রলীগ তাদের হলে উঠিয়েছে। এর বিনিময়ে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে হবে।’
ওই শিক্ষার্থী সংবাদকে বলেন, ‘বিভিন্ন পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম হয়, সেগুলোতে আমাদের বাধ্যতামূলক অংশ নিতে হয়। ভাইটাল প্রোগ্রাম হলে ক্লাস মিস দিতে হয়। রিডিং রুম থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়। হলে থাকতে হবে, তাই নিরুপায় হয়েই ছাত্রলীগের নিয়ম মেনে চলি।’
উপরের অভিজ্ঞতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর হলে উঠা প্রায় সব শিক্ষার্থীর।
হলে থাকার জন্য ছাত্রলীগের রয়েছে ‘নিজস্ব শাসনব্যবস্থা’। যেগুলো প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে মেনে চলতে হয়। যদিও বিষয়টি অস্বীকার করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন। তিনি বলেন, ‘হলে কে থাকবে না থাকবে সেটা ছাত্রলীগের বিষয় না।’
আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তাদের কাছে ‘কখনো’ এ ধরনের ‘কোন অভিযোগ আসেনি’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলের প্রতিটিরই রয়েছে নির্দিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো। একজন প্রাধ্যক্ষের নেতৃত্বে আবাসিক শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এর অন্তর্ভুক্ত। হল সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে পরিচালনার বিনিময়ে তাদের জন্য আছে বেতন-ভাতা এবং আবাসিকসহ অন্যান্য সুবিধা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হল প্রশাসন হচ্ছে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’। তারা বলছেন, প্রাধ্যক্ষ কাগজ স্বাক্ষর ছাড়া আর ‘কিছুই করেন না’। ‘ছাত্রলীগের হাতেই’ হলের মূল কর্তৃত্ব। অনেক আবাসিক শিক্ষক এটাও ‘জানেন না’ তার দায়িত্বে হলের কোন কোন কক্ষ। জানলেও কোনদিন শিক্ষার্থীদের কক্ষে গিয়ে খোঁজ-খবর নেয়ারও ‘প্রয়োজন বোধ করেন না’।
ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে দেড় শতাধিক গণরুম
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে দেড় শতাধিক গণরুম রয়েছে। সাধারণত প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে উঠার পর গণরুমে জায়গা হয়। সেখানে তাদের গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এই রুমগুলোতে হলভেদে ৩০-৫০ জন শিক্ষার্থী থাকে।
গণরুম বাদে ছেলে শিক্ষার্থীদের ১৩টি হলের ৮৫ শতাংশের বেশি কক্ষ ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। বাকি অংশে তাবলিগে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, হলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার, প্রাধ্যক্ষ ও হাউজ টিউটরদের সুপারিশকৃত শিক্ষার্থীরা থাকে।
ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রিত কক্ষগুলো দুইভাগে বিভক্ত। সিঙ্গেল রুমগুলোতে (সাধারণত দুই সিটের কক্ষ) যারা ‘মোস্ট পলিটিক্যাল’ (ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে) তারা থাকে। বাকিগুলোতে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা থাকে। এ কক্ষগুলোতে কে উঠবে আর কে হল ছেড়ে চলে যাবে, তা ছাত্রলীগই নির্ধারণ করে দেয়।
যদিও মেয়েদের পাঁচটি হলে অন্য চিত্র দেখা যায়, সেখানে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ সরাসরি প্রশাসনের মাধ্যমে হলে উঠে। ফলে তাদের ওপর ছাত্রলীগের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তবে যারা ছাত্রলীগের মাধ্যমে হলে উঠে তাদের বাধ্যতামূলক ছাত্রলীগের নিয়ম মেনে চলতে হয়।
ছাত্রলীগের শাসনব্যবস্থা
প্রতিদিন রাতে অথবা সপ্তাহের বিশেষ কয়েকটি দিনে নিজ নিজ হলের গেস্টরুমে (অতিথিকক্ষ) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হয়। যেখানে ছাত্রলীগ নেতারা তাদের কথিত ‘শিষ্টাচার’ শেখান। এসব কথিত ‘শিষ্টাচার’ শিখতে প্রায় প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা গেস্টরুমে থাকতে হয় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের। দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ‘শিষ্টাচার’ শেখানোর জন্য থাকে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রলীগের কর্মী। যা ছাত্রলীগের ভাষায় ‘চেইন অব কমান্ড’ বলে পরিচিত।
ছাত্রলীগের কোন কর্মসূচিতে অংশ না নিলে বা ‘ম্যানার’ (রীতিনীতি) ভঙ্গ করলে চাওয়া হয় জবাবদিহি। জবাবে সন্তুষ্ট না হলে শিক্ষার্থীদের ওপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। শাস্তি হিসেবে রাত বারোটার পর হল থেকে বের করে দেয়া হয়। বলা হয়, ‘যে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ম্যানার ভঙ্গ করা হয়েছে তার কাছে মাফ চেয়ে তারপর হলে উঠতে হবে’। অনেককে একেবারে হল থেকে বের করে দেয়া হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবুদ্ধি ও গণতন্ত্র চর্চার জায়গা। এখানে ছাত্রলীগ কর্তৃক কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রশ্নই উঠে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কে ভর্তি হবে না হবে, কে হলে উঠবে না উঠবে এটা তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিষয়। এটা তো ছাত্র রাজনীতির বিষয় না।’
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যদি ‘সক্ষমতার বেশি বেতন-ফি’ নেয়া হয় তার প্রতিবাদ, শিক্ষার্থীদের জন্য ‘সুন্দর একাডেমিক পরিবেশ নিশ্চিতে ভূমিকা’ রাখা, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এগুলো হচ্ছে ছাত্র রাজনীতির বিষয়, বলেন সাদ্দাম।
হল প্রশাসন কেন ঠুঁটো জগন্নাথ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩-এ বলা আছে, ‘প্রাধ্যক্ষ হচ্ছেন হলের প্রধান। তার কাজ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক ছাত্রদের বাসস্থান ও শৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করা, তাদের পাঠ্যবহির্ভূত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতির ব্যবস্থা করা।’
অর্থাৎ একজন প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে হল পরিচালনা করা, আবাসিক শিক্ষার্থীদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান, হলে আসন বরাদ্দ নিশ্চিত করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত খাবারের মান পর্যবেক্ষণ, হলের সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা এবং শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিষয় দেখভাল করা।
হল প্রশাসন এসব কার্যক্রম থেকে ‘যোজন যোজন দূরে’ বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
প্রথম-দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে উঠার বৈধতা নেই- ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও বিষয়টিকে অর্থহীন বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির। তিনি বলেন, ‘প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ বর্ষ এবং মাস্টার্সের যাদের পরীক্ষা হয়নি এরা সবাই হলে থাকতে পারবে।’
হলে ছাত্রলীগের ‘সিট নিয়ন্ত্রণের’ বিষয়টি জানেন না বলে জানান অধ্যাপক বাছির। তিনি বলেন, ‘আমার সহকর্মীরা আমাকে কখনো এ বিষয়ে কিছু বলেনি। কারো কোন প্রভাব ছাড়াই এবং বৈধভাবে শিক্ষার্থীদের সিট দেয়া হয় বলে আমি জানি।’
‘আমার বিজয় একাত্তর হলে এ বছর ২০১ জনকে সিট দেয়া হয়েছে। কে কোন দলমতের সেটি বিবেচনায় নেয়া হয়নি বরং মেধা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে কারো প্রভাব ছাড়াই সিট বরাদ্দ দিয়েছি‘, বলেন অধ্যাপক বাছির।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘হল প্রশাসন থেকে এ ধরনের কোন তথ্য আমাদের জানা নেই। হলের নানা ধরনের যে আয়োজন সেটি হল প্রশাসনই নিয়ন্ত্রণ করে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন আয়োজন সক্রিয় অংশগ্রহণ করে প্রশাসনকে সহযোগিতা করে। মূল ব্যবস্থাপনায় থাকে হল কর্তৃপক্ষ।’
বুধবার, ৩১ আগস্ট ২০২২
২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন মফস্বল এলাকা থেকে আসা শিক্ষার্থী সাদিক কাইয়ুম (ছদ্মনাম)। ঢাকা শহরে তার থাকার কোন জায়গা নেই। তাই তাকে হলেই উঠতে হবে। তার সংযুক্তি ছিল শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে।
জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে একদিন সাদিক হলে উঠতে যায়। হলের গেটে যেতে না যেতেই তাকে দুই-তিনজন শিক্ষার্থী ঘিরে ধরে। তারা নিজেদের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের কর্মী বলে পরিচয় দেয়। তারা সবাই সাদিককে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। অবশেষে একজন সাদিককে হলের বর্ধিত ভবনের একটি কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে সাদিকের মতো আরও ৩০-৩৫ জন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অবস্থান করছিল।
সাদিককে বলা হয়, এই গণরুমগুলো ‘ছাত্রলীগ দ্বারা পরিচালিত’। প্রথম-দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে উঠার ‘নিয়ম নেই’। ‘ছাত্রলীগ তাদের হলে উঠিয়েছে। এর বিনিময়ে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে হবে।’
ওই শিক্ষার্থী সংবাদকে বলেন, ‘বিভিন্ন পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম হয়, সেগুলোতে আমাদের বাধ্যতামূলক অংশ নিতে হয়। ভাইটাল প্রোগ্রাম হলে ক্লাস মিস দিতে হয়। রিডিং রুম থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়। হলে থাকতে হবে, তাই নিরুপায় হয়েই ছাত্রলীগের নিয়ম মেনে চলি।’
উপরের অভিজ্ঞতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর হলে উঠা প্রায় সব শিক্ষার্থীর।
হলে থাকার জন্য ছাত্রলীগের রয়েছে ‘নিজস্ব শাসনব্যবস্থা’। যেগুলো প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে মেনে চলতে হয়। যদিও বিষয়টি অস্বীকার করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন। তিনি বলেন, ‘হলে কে থাকবে না থাকবে সেটা ছাত্রলীগের বিষয় না।’
আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তাদের কাছে ‘কখনো’ এ ধরনের ‘কোন অভিযোগ আসেনি’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলের প্রতিটিরই রয়েছে নির্দিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো। একজন প্রাধ্যক্ষের নেতৃত্বে আবাসিক শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এর অন্তর্ভুক্ত। হল সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে পরিচালনার বিনিময়ে তাদের জন্য আছে বেতন-ভাতা এবং আবাসিকসহ অন্যান্য সুবিধা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হল প্রশাসন হচ্ছে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’। তারা বলছেন, প্রাধ্যক্ষ কাগজ স্বাক্ষর ছাড়া আর ‘কিছুই করেন না’। ‘ছাত্রলীগের হাতেই’ হলের মূল কর্তৃত্ব। অনেক আবাসিক শিক্ষক এটাও ‘জানেন না’ তার দায়িত্বে হলের কোন কোন কক্ষ। জানলেও কোনদিন শিক্ষার্থীদের কক্ষে গিয়ে খোঁজ-খবর নেয়ারও ‘প্রয়োজন বোধ করেন না’।
ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে দেড় শতাধিক গণরুম
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে দেড় শতাধিক গণরুম রয়েছে। সাধারণত প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে উঠার পর গণরুমে জায়গা হয়। সেখানে তাদের গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এই রুমগুলোতে হলভেদে ৩০-৫০ জন শিক্ষার্থী থাকে।
গণরুম বাদে ছেলে শিক্ষার্থীদের ১৩টি হলের ৮৫ শতাংশের বেশি কক্ষ ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। বাকি অংশে তাবলিগে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, হলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার, প্রাধ্যক্ষ ও হাউজ টিউটরদের সুপারিশকৃত শিক্ষার্থীরা থাকে।
ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রিত কক্ষগুলো দুইভাগে বিভক্ত। সিঙ্গেল রুমগুলোতে (সাধারণত দুই সিটের কক্ষ) যারা ‘মোস্ট পলিটিক্যাল’ (ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে) তারা থাকে। বাকিগুলোতে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা থাকে। এ কক্ষগুলোতে কে উঠবে আর কে হল ছেড়ে চলে যাবে, তা ছাত্রলীগই নির্ধারণ করে দেয়।
যদিও মেয়েদের পাঁচটি হলে অন্য চিত্র দেখা যায়, সেখানে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ সরাসরি প্রশাসনের মাধ্যমে হলে উঠে। ফলে তাদের ওপর ছাত্রলীগের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তবে যারা ছাত্রলীগের মাধ্যমে হলে উঠে তাদের বাধ্যতামূলক ছাত্রলীগের নিয়ম মেনে চলতে হয়।
ছাত্রলীগের শাসনব্যবস্থা
প্রতিদিন রাতে অথবা সপ্তাহের বিশেষ কয়েকটি দিনে নিজ নিজ হলের গেস্টরুমে (অতিথিকক্ষ) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হয়। যেখানে ছাত্রলীগ নেতারা তাদের কথিত ‘শিষ্টাচার’ শেখান। এসব কথিত ‘শিষ্টাচার’ শিখতে প্রায় প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা গেস্টরুমে থাকতে হয় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের। দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ‘শিষ্টাচার’ শেখানোর জন্য থাকে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রলীগের কর্মী। যা ছাত্রলীগের ভাষায় ‘চেইন অব কমান্ড’ বলে পরিচিত।
ছাত্রলীগের কোন কর্মসূচিতে অংশ না নিলে বা ‘ম্যানার’ (রীতিনীতি) ভঙ্গ করলে চাওয়া হয় জবাবদিহি। জবাবে সন্তুষ্ট না হলে শিক্ষার্থীদের ওপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। শাস্তি হিসেবে রাত বারোটার পর হল থেকে বের করে দেয়া হয়। বলা হয়, ‘যে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ম্যানার ভঙ্গ করা হয়েছে তার কাছে মাফ চেয়ে তারপর হলে উঠতে হবে’। অনেককে একেবারে হল থেকে বের করে দেয়া হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবুদ্ধি ও গণতন্ত্র চর্চার জায়গা। এখানে ছাত্রলীগ কর্তৃক কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রশ্নই উঠে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কে ভর্তি হবে না হবে, কে হলে উঠবে না উঠবে এটা তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিষয়। এটা তো ছাত্র রাজনীতির বিষয় না।’
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যদি ‘সক্ষমতার বেশি বেতন-ফি’ নেয়া হয় তার প্রতিবাদ, শিক্ষার্থীদের জন্য ‘সুন্দর একাডেমিক পরিবেশ নিশ্চিতে ভূমিকা’ রাখা, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এগুলো হচ্ছে ছাত্র রাজনীতির বিষয়, বলেন সাদ্দাম।
হল প্রশাসন কেন ঠুঁটো জগন্নাথ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩-এ বলা আছে, ‘প্রাধ্যক্ষ হচ্ছেন হলের প্রধান। তার কাজ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক ছাত্রদের বাসস্থান ও শৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করা, তাদের পাঠ্যবহির্ভূত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতির ব্যবস্থা করা।’
অর্থাৎ একজন প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে হল পরিচালনা করা, আবাসিক শিক্ষার্থীদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান, হলে আসন বরাদ্দ নিশ্চিত করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত খাবারের মান পর্যবেক্ষণ, হলের সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা এবং শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিষয় দেখভাল করা।
হল প্রশাসন এসব কার্যক্রম থেকে ‘যোজন যোজন দূরে’ বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
প্রথম-দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে উঠার বৈধতা নেই- ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও বিষয়টিকে অর্থহীন বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির। তিনি বলেন, ‘প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ বর্ষ এবং মাস্টার্সের যাদের পরীক্ষা হয়নি এরা সবাই হলে থাকতে পারবে।’
হলে ছাত্রলীগের ‘সিট নিয়ন্ত্রণের’ বিষয়টি জানেন না বলে জানান অধ্যাপক বাছির। তিনি বলেন, ‘আমার সহকর্মীরা আমাকে কখনো এ বিষয়ে কিছু বলেনি। কারো কোন প্রভাব ছাড়াই এবং বৈধভাবে শিক্ষার্থীদের সিট দেয়া হয় বলে আমি জানি।’
‘আমার বিজয় একাত্তর হলে এ বছর ২০১ জনকে সিট দেয়া হয়েছে। কে কোন দলমতের সেটি বিবেচনায় নেয়া হয়নি বরং মেধা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে কারো প্রভাব ছাড়াই সিট বরাদ্দ দিয়েছি‘, বলেন অধ্যাপক বাছির।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘হল প্রশাসন থেকে এ ধরনের কোন তথ্য আমাদের জানা নেই। হলের নানা ধরনের যে আয়োজন সেটি হল প্রশাসনই নিয়ন্ত্রণ করে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন আয়োজন সক্রিয় অংশগ্রহণ করে প্রশাসনকে সহযোগিতা করে। মূল ব্যবস্থাপনায় থাকে হল কর্তৃপক্ষ।’