নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে প্রদর্শিত হচ্ছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংষ্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) স্বীকৃত দেশের ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প শীতল পাটি’র। দেশের লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে এটি একটি। অতীতকালে গরমের সময় খাটে বিছানো হতো বেত থেকে হাতে তৈরী করা এই শীতল পাটির। শুধু খাটের বিছানাই নয়, মাদুর, জায়নামাজ, ওয়ালম্যাট, টেবিলম্যাট, বিয়ে শাদী ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহার হতো এই আদী ঐতিহ্যের। কিন্তু কালের বিবর্তনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সরঞ্জাম ব্যবহারের ফলে চাহিদা হারিয়ে এখন লুপ্তপ্রায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই কুটির শিল্পটি।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের আয়োজনে মাসব্যাপী লোকজ মেলার প্রদর্শিত গ্যালারীর নিজের স্টলে বসে পাটি বুনন শিল্পী শ্রী গীতেশ চন্দ্র দাস জানান, তিনি মৌলভীবাজার থেকে এসেছেন। মৌলভবাজার ও সিলেটের আদী ঐতিহ্য এই শীতল পাটি। জীবিকা নির্বাহের জন্য পূর্বপুরুষদের পেশা হিসেবে তিনিও ধরে আছেন শীতল পাটি বুননের কাজে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মুর্তা বেত (পাটি তৈরীর বিশেষ বেত) সংগ্রহ করে দৃষ্টি নন্দন পাটি তৈরী করেন। একটি ৫ ফিট বাই ৭ ফিট পাটি তৈরী করতে এক থেকে দেড়শ বেত লাগে। যার মূল্য ৭ শ’ টাকা। মুর্তা থেকে বটি বা দা দিয়ে ফালি করে বেত তুলতে সময় লাগে অন্তত ৭ দিন। শ্রেণী ভেদে বিভিন্ন মাপের পাটি বানাতে সময় লাগে ৮ দিন থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত।
তার সাথে পাটি বুনন করেন তার স্ত্রী প্রীতি রানী দাসও। মান অনুযায়ী পাটির দাম নির্ধারণ হয়। সর্বনি¤œ ২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন মাপের শীতল পাটি তৈরী করেন।
একসময় খুব কদর ছিল শীতল পাটির। গরমকালে খাটে চাদরের পরিবর্তে ব্যবহার হতো শীতল পাটির। শুধু খাটের বিছানাই নয় ওয়ালম্যাট, মাটিতে বসার মাদুর, জায়নামাজ, টেবিলম্যাট, বিয়ে শাদীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহার হতো এই পাটির। মূলত পাটি বুনন করে জীবিকা নির্বাহ করতো তুলাপুর, যাত্রাপুর, টিনবাড়ি, সাদাপুর, ফতেহপুর, আব্দুল্লাহপুর ও জকিগঞ্জসহ মৌলভীবাজার ও সিলেটের অধিকাংশ অঞ্চলের মানুষ। এটিই ছিল জীবিকা নির্বাহের প্রধান পেশা। কিন্তু কালের বিবর্তনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সরঞ্জাম যেমন ফ্যান, এয়ারকুলার, এয়ারকন্ডিশন এবং প্লাষ্টিকের মাদুরের প্রভাবে বর্তমানে শীতল পাটির চাহিদা একেবারেই নেই। যার কারণে পূর্বপুরুষের এই পেশা ছেড়ে বিভিন্ন পেশায় চলে গেছেন পাটিকররা। কেউ করছেন ব্যবসা, কেউ চাকরি, আবার কেউ চালাচ্ছেন গাড়ি। তবে তুলাপুর এলাকায় তিনিসহ মাত্র দু’একটি পরিবার ধরে রেখেছেন এই পেশাটি। তার পরে হয়তো আর কেউ এই পেশায় আসবেনা। বাংলাদেশের লুপ্তপ্রায় এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি সহযোগিতা দিয়ে পাটিকরদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবে শীতল পাটি ও পাটিকর। তবে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ তাকে গত ২০ বছর যাবত মাসব্যাপী কারুশিল্প মেলায় শীতল পাটি প্রদর্শণের জন্য নিয়ে আসছে। মেলায় আসলেও বিক্রি নেই বললেই চলে। আদী ঐতিহ্য ধরে রাখার সুবাদে এরই মধ্যে তিনি পেয়েছেন শিল্পাচার্জ জয়নুল আবেদীন আজীবন সম্মাননা। যার মধ্যে রয়েছে তিন লাখ টাকার চেক, দেড় ভড়ি ওজনের স্বর্ণপদক ও সনদপত্র। এছাড়াও এই কুটির শিল্পের প্রদর্শণীর জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভ্রমণ করেছেন নেপাল, দক্ষিন কোরিয়া ও জাপান। লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে পরিবারসহ ঢাকার বনশ্রী থেকে আসা দর্শনার্থী ফারহানা সরকার জানান, শীতল পাটি দেশের লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য। একসময় শীতল পাটির ব্যহার ছিল দেশ জুড়ে। ঠান্ডা অনুভবের জন্য গরমকালে খাটে তোষকের উপর বিছিয়ে ঘুমাতো মানুষ। কিন্তু এখন কম দামের প্লাস্টিক পণ্যে বাজার সয়লাব হওয়ায় প্রায় হারিয়েই গেছে শীতল পাটি। এখন যতটুকুই আছে সেটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। না হলে দ্রুতই হারিয়ে যাবে আমাদের এই ঐতিহ্য শীতল পাটি। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক এ কে এম আজাদ সরকার জানান, শীতল পাটি আমাদের দেশের লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য। আর লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের প্রদর্শণ ও পুনর্জীবন দান করার লক্ষ্য নিয়ে প্রতি বছর এখানে আয়োজন করা হয় লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি বুনন শিল্পকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এছাড়াও এটিকে সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে সংস্থাটি।
রোববার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে প্রদর্শিত হচ্ছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংষ্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) স্বীকৃত দেশের ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প শীতল পাটি’র। দেশের লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে এটি একটি। অতীতকালে গরমের সময় খাটে বিছানো হতো বেত থেকে হাতে তৈরী করা এই শীতল পাটির। শুধু খাটের বিছানাই নয়, মাদুর, জায়নামাজ, ওয়ালম্যাট, টেবিলম্যাট, বিয়ে শাদী ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহার হতো এই আদী ঐতিহ্যের। কিন্তু কালের বিবর্তনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সরঞ্জাম ব্যবহারের ফলে চাহিদা হারিয়ে এখন লুপ্তপ্রায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই কুটির শিল্পটি।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের আয়োজনে মাসব্যাপী লোকজ মেলার প্রদর্শিত গ্যালারীর নিজের স্টলে বসে পাটি বুনন শিল্পী শ্রী গীতেশ চন্দ্র দাস জানান, তিনি মৌলভীবাজার থেকে এসেছেন। মৌলভবাজার ও সিলেটের আদী ঐতিহ্য এই শীতল পাটি। জীবিকা নির্বাহের জন্য পূর্বপুরুষদের পেশা হিসেবে তিনিও ধরে আছেন শীতল পাটি বুননের কাজে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মুর্তা বেত (পাটি তৈরীর বিশেষ বেত) সংগ্রহ করে দৃষ্টি নন্দন পাটি তৈরী করেন। একটি ৫ ফিট বাই ৭ ফিট পাটি তৈরী করতে এক থেকে দেড়শ বেত লাগে। যার মূল্য ৭ শ’ টাকা। মুর্তা থেকে বটি বা দা দিয়ে ফালি করে বেত তুলতে সময় লাগে অন্তত ৭ দিন। শ্রেণী ভেদে বিভিন্ন মাপের পাটি বানাতে সময় লাগে ৮ দিন থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত।
তার সাথে পাটি বুনন করেন তার স্ত্রী প্রীতি রানী দাসও। মান অনুযায়ী পাটির দাম নির্ধারণ হয়। সর্বনি¤œ ২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন মাপের শীতল পাটি তৈরী করেন।
একসময় খুব কদর ছিল শীতল পাটির। গরমকালে খাটে চাদরের পরিবর্তে ব্যবহার হতো শীতল পাটির। শুধু খাটের বিছানাই নয় ওয়ালম্যাট, মাটিতে বসার মাদুর, জায়নামাজ, টেবিলম্যাট, বিয়ে শাদীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহার হতো এই পাটির। মূলত পাটি বুনন করে জীবিকা নির্বাহ করতো তুলাপুর, যাত্রাপুর, টিনবাড়ি, সাদাপুর, ফতেহপুর, আব্দুল্লাহপুর ও জকিগঞ্জসহ মৌলভীবাজার ও সিলেটের অধিকাংশ অঞ্চলের মানুষ। এটিই ছিল জীবিকা নির্বাহের প্রধান পেশা। কিন্তু কালের বিবর্তনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সরঞ্জাম যেমন ফ্যান, এয়ারকুলার, এয়ারকন্ডিশন এবং প্লাষ্টিকের মাদুরের প্রভাবে বর্তমানে শীতল পাটির চাহিদা একেবারেই নেই। যার কারণে পূর্বপুরুষের এই পেশা ছেড়ে বিভিন্ন পেশায় চলে গেছেন পাটিকররা। কেউ করছেন ব্যবসা, কেউ চাকরি, আবার কেউ চালাচ্ছেন গাড়ি। তবে তুলাপুর এলাকায় তিনিসহ মাত্র দু’একটি পরিবার ধরে রেখেছেন এই পেশাটি। তার পরে হয়তো আর কেউ এই পেশায় আসবেনা। বাংলাদেশের লুপ্তপ্রায় এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি সহযোগিতা দিয়ে পাটিকরদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবে শীতল পাটি ও পাটিকর। তবে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ তাকে গত ২০ বছর যাবত মাসব্যাপী কারুশিল্প মেলায় শীতল পাটি প্রদর্শণের জন্য নিয়ে আসছে। মেলায় আসলেও বিক্রি নেই বললেই চলে। আদী ঐতিহ্য ধরে রাখার সুবাদে এরই মধ্যে তিনি পেয়েছেন শিল্পাচার্জ জয়নুল আবেদীন আজীবন সম্মাননা। যার মধ্যে রয়েছে তিন লাখ টাকার চেক, দেড় ভড়ি ওজনের স্বর্ণপদক ও সনদপত্র। এছাড়াও এই কুটির শিল্পের প্রদর্শণীর জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভ্রমণ করেছেন নেপাল, দক্ষিন কোরিয়া ও জাপান। লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে পরিবারসহ ঢাকার বনশ্রী থেকে আসা দর্শনার্থী ফারহানা সরকার জানান, শীতল পাটি দেশের লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য। একসময় শীতল পাটির ব্যহার ছিল দেশ জুড়ে। ঠান্ডা অনুভবের জন্য গরমকালে খাটে তোষকের উপর বিছিয়ে ঘুমাতো মানুষ। কিন্তু এখন কম দামের প্লাস্টিক পণ্যে বাজার সয়লাব হওয়ায় প্রায় হারিয়েই গেছে শীতল পাটি। এখন যতটুকুই আছে সেটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। না হলে দ্রুতই হারিয়ে যাবে আমাদের এই ঐতিহ্য শীতল পাটি। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক এ কে এম আজাদ সরকার জানান, শীতল পাটি আমাদের দেশের লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য। আর লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের প্রদর্শণ ও পুনর্জীবন দান করার লক্ষ্য নিয়ে প্রতি বছর এখানে আয়োজন করা হয় লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি বুনন শিল্পকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এছাড়াও এটিকে সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে সংস্থাটি।