ধূলিপথ আমারও ইচ্ছে করেছিল
আবদুর রাজ্জাক
তুমি ডাহুক, আজানুলম্বিত গলা, আমাকে নিয়ে গেছো অরণ্য বিরহে,
কড়িকাঠের চৌকাঠ ছেড়ে ঘুণপোকারা ঘুমায় নিখিলের বনতলে,
বহে করমচা ফুলের হাওয়া, ডাহুক যেভাবে ডাকে
ওইভাবে ডেকে যায় অব্যর্থ চিল।
তাদের শিরাভর্তি আগুন, শাশ্বত আকাশ, প্রণম্য, কোনো
পথচারীর কথা মনে রাখে না।
আমিও ঘর ছাড়া বাউল, আমারও একতারা ছলছল, মৃত্যু তরজমাহীন,
এই যে এতো নীরবতা পাখিদের গলায়, এতো গেরস্তালি
থমকে রয়েছে লাউফুলের শাখা-প্রশাখায়।
নির্লিপ্ত আকাশ, সহস্র ডাক ডাহুকের, ডাহুক ক্লান্ত হয়ে- পরাস্ত হয়ে
বস্তুত এইভাবে ডুবে যায় চাঁদ, এইভাবে বিব্রত কাল।
আধো আঙ্গিনায় জামগাছের নম্র ছায়া, তুমি সেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে, পাখি
পতঙ্গের ওড়াউড়ি দেখো।
দেখা হবে আগামী বৈশাখে
ফারুক মাহমুদ
নিষেধকণ্টক ঠুকে ঢেকে দিলে আমার আকাশ
উন্মুখ জানাল চাই। আলোমুখ। ফেলব না শ্বাস!
ইচ্ছের কপাট বোজা। রুক্ষ রাগে তুলে দিলে খিল
চৈত্রময়তায় আছি, স্থির কষ্ট- বাঁচা মুশকিল
তোমার চোখর হ্রদে ফোটে যদি আকাশের হাসি
কেউ তো বলতেই পারে, হে নির্জন, আজো ভালোবাসি
ভাটিপোড়া ঝামাগন্ধ... তা-ও থাকে রূঢ় রৌদ্রে মিশে
চেয়েছি জলের ধারা, উঁকিবৃষ্টি মেঘের কার্নিশে
যে ভোলার ভুলে যায়- খেরোখাতা- কেউ মনো রাখে
এবার হল না দেখা, দেখা হবে আগামী বৈশাখে
আপেল গাছ
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
রঙতুলি জমা দিয়েছো মিউজিয়ামে, পরিত্যাক্ত প্রত্নঘড়ি
তা গ্যালারির মধ্যাকর্ষণ, দর্শকের কাছে দামী দোলনা-পরী।
গত শীতে
বাতিল করে ফেলে দিয়েছো নদীতে
তা জল-দেবতা খোয়াজ খিজিরের ডুব-কথা
মিথ, জলপরীর রূপকথা!
যা অবহেলা করে রেখে এসেছিলে রেলের ধারে, আজ
তা আপেল গাছ!
প্রথম মাস, নব আশ্বাস
ভাগ্যধন বড়ুয়া
ভোরে ভরা থাকে গান, কলতান
নরম বাতাসে হেঁটে যায় প্রাতঃভ্রমণের দল
সূর্য উঁকি দিয়ে দেখে কারা এখনও ঘুমে!
জবা আড়মোড়া ভাঙে, প্রজাপতি উড়ে...
গোলকের আলো-অন্ধকার মাপে ঘড়ি
চলমান মনে ভাবি অনিবার্য অস্তিত্ব
টেনে নিয়ে যাই রক্ত, বীজদানা, আনন্দ, তিক্ততা
অস্পষ্ট অতীত ডালপালাসহ সামনে খোলাসা!
বিচ্ছুরিত আলোয় পাখির ডাক ক্রমাগত কমে
বেলা বাড়লে কোলাহলে বুঝা যায় না কূজন
ক্রোধ, দুঃখবোধে অস্থির মানুষ পালায় গভীরে
ব্যথা অনিবার্য জেনে যারা হাঁটে তারা পায় মাইলফলক!
শুকনো হাড়ের মতো কাণ্ড নিয়ে চৈতের গাছপালাও অপেক্ষায়;
কখন আসবে বৈশাখ?
দেখা যাবে শাখে শাখে আন্দোলিত পাতা!
ফুলের প্লাবন কোথাও, পতঙ্গ পাখির চলমান সুর
আবার সাজাবে মন নতুন আশায়, তীব্র ভালোবাসায়...
ধানগাছের পোয়াতি কাহন
ওবায়েদ আকাশ
হাওয়া হাওয়া, এখন নিশ্চুপ বসন্ত ঋতু
এখন ইলিশের কাঁটায় শৃঙ্খলিত গুগল সভ্যতা
সবুজ দ্যুতিময় তোমার পোশাকের আঁশ
প্রান্ত ধরে টান দিতেই ধূপসাদা মেঘফুল ঘিরে
প্রিয়তমার অবিশ্বাস্য বিরহযাপন
ষড়ঋতুর প্রসঙ্গ বিন্যাসে ধানগাছের পোয়াতি কাহন
তুমিও তো চেয়েছিলে
শ্যামল সন্ধেরা ঘাটে বাঁধা খেয়া পারাপারকালে
এই প্রথম ভ্রমণস্নাত হবে, আর
সোনালুফুলের স্বাস্থ্যকর হাটে তুমি আমি ফিরে যাবো
বিহঙ্গ যৌবনে
এই সেই বর্ষণক্লান্ত গরিমা?
পৃথিবীর টোলপড়া গাল ভরে আছে উদ্ভ্রান্ত মেহগনি ফলে
এই সকল বিধি ও সংক্রাম- তোমার বহুবঙ্কিম শরীরের গান
তোমার উড়ন্ত বাহুতে শঙ্খচিল, কোজাগরি রাত
ঊরুতে সন্তরণ প্রকার, ঘরের চালে চালকুমড়ার প্রভূত ফলন
খুশির চন্দ্রবিন্দু
সাইফুল্লাহ আল মামুন
কৃষ্ণচূড়ার লাল আলো ছড়ায় যত জাদু
প্রজাপ্রতির রঙিন পাখায় শুভ দিনের মধু
গানের বীণায় আনন্দ আবেগে মগ্ন যেন বধূ
অভিষেকের শিরোনামে
কাছে এসে নাচে নবীন সাধু
আশীর্বাদের রক্তিম পথে পাশে বস বন্ধু বৈশাখ!
আমার প্রানের ধ্বনি খুশির চন্দ্রবিন্দু।
নব প্রভাতের আলোকিত দিনে পুলকিত হই
চেতনার জাগরণে চিত্ত রসে নিত্য জেগে থাকি
প্রাণে প্রাণে খুশির বার্তা থই থই
কত যে কলরব কত রঙের হইচই
পুলকে পুলকে আলোক সন্তরণে রাঙা সিন্ধু
লাল শাড়ির সুন্দরিকা প্রতীক্ষার প্রহরে বন্ধু
বৈশাখ আমার প্রাণের ধ্বনি খুশির চন্দ্রবিন্দু
প্রকৃতি সাজায় খুশি আনন্দ অবিরাম
নতুন নামে ডাকবে বলে,
নতুন সাজে সেজে এলাম
নতুন কুঁড়ির ফুলঝুরি নববর্ষের সালাম
বৈশাখ আমার আত্মপরিচয়
চেতনার অনন্য নাম।
নববর্ষ আর আসবে না
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
নিয়ম পালনের জন্যে কখনো কখনো পাল্টে যায় বর্ষপঞ্জি
যেমন কেউ কেউ নিয়ম পালনার্থে সংসারী হয়
সং সেজে সার না খুঁজে সময়ের লেজে পাড়া না দিয়ে
চারপাশের ঘটনাকে অদেখার ভান করে
যারা উদাসী তাদের মতোই মাঝ মাঝে মাসগুলো নাম পাল্টায়,
পাল্টে যায় দিনের পরিচিতি, বছরগুলো সংখ্যা হয়ে ওঠে।
বর্তমানের বিবর্ণতাকে সাময়িক সঙ্কট ভেবে ভবিষ্যতের আলোয়
কেউ দেখার দৃষ্টি পেতে চেয়ে নববর্ষের প্রতীক্ষায় থাকে
গায়ে নতুন পোশাক মুখে মিষ্টির মাধুর্য আর বুকে বুনে রাখা স্বপ্নের
কল-কলাৎ সবই হয়, রাষ্ট্রে বৈশাখী ভাতা হয়, অনলাইন আড্ডা হয়
কিন্তু উৎসবের গায়ে কেউ পরায় না নতুন জামা, নতুন বছরকে
কেউ নিশ্চিৎ করে না নিরাপত্তা দিয়ে
সেই পুরোনো শকুনেরা বার বার ধর্মসম্মত নয় বলে নববর্ষকে অপমান করে
এতোসব অপমান হতমান নিয়ে বাঙালির নববর্ষ তবু আসে
নিয়ম পালনের জন্যে আসে, নিজে একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে আসে
কোন একদিন হয়তো তাকে বরণ করে নেবে সম্মিলিতভাবে
বিভক্তি নয়, ঐক্যের সমতানই উৎসবের শক্তি, উদযাপনের সৌন্দর্য।
নিয়ম পালনের জন্যে এদেশে নববর্ষ আসে, যেমন হাসে দিন, নামে রাত
বছর বা দিনের পরিবর্তনে এমন আহামরি কিছুই পাল্টায় না
সংখ্যা পাল্টালেও শঙ্কা পাল্টে যায় না, পাল্টায় না রক্তচক্ষু
যে মানুষ নতুন পোশাকে মুখে রং মেখে হেঁটে যায় শোভাযাত্রায়
সে-ও জানে, পরকালের প্রশান্তিকে বিপন্ন করে লোক দেখানোর উৎসবে
সে শামিল, ঠিক যেন শাবানার মতো
নববর্ষ এখানে মনে আসে না, আসে না চেতনাতেও
এখানে নববর্ষ আসে শেকড়কে উপহাসের জন্যে
এখানে নববর্ষ আসে বণিকের লাল খাতায়
এখানে নববর্ষ আসে কৃষকের পান্তাকে উপহাসের জন্যে
এখানে নববর্ষ আসে মিডিয়া ও কর্পোরেট জীবনের পণ্য শিকারের জন্যে
এখানে নববর্ষ আসে হারাম আর হালালের বিসংবাদ জিইয়ে রাখার জন্যে।
নববর্ষকে দূরে রাখতে এখানে মরুর ঊষর বালি দিয়ে
ঊর্বর পলিকে ঢেকে দিতে চায় অনেকেই
পশ্চিমা উগ্রতায় নববর্ষের কোমলতাকে পাল্টে দিতে উদগ্রীব আধুনিকতাবাদীরাও
প্রতিবেশির উৎসব বলে নববর্ষকে সৎ পুত্রের মতো
দূরে ঠেলে দেয় অসংখ্য উন্মত্ত জনতা
তবু চৈত্র এলেই এখানে নববর্ষের তোড়জোর শুরু হয়
এপ্রিল নয়, বৈশাখই যেন মুখ্য হয়ে ওঠে মেকি মানুষের ভিড়ে
অথচ কেউ জানে না, মানুষ না পাল্টালে, মন না পাল্টালে
এখানে সত্যিকারের নববর্ষ আর কোনদিন আসবে না।
যাই তবে মিশে যাই
দিলারা মেজবাহ
যাই তবে মিশে যাই মান্যবর! শেষবারের মতো শোনাও
তোমার সহি তেলাওয়াত, কচিৎ বিসমিল্লাহর সানাই।
যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর, নিধুয়া পাথার, বিদায়।
যাই অচেনা নির্জনে, কলবের ময়লা ঘষি-
কুয়াশার নিকাবে ঢাকি নিদানের চিহ্নগুলি।
মহাত্মা, জীবনের দৌড় ফুরাবে না বুঝি?
ঝরাপাতা যাই মাড়িয়ে প্রত্যুষে পদভারে।
শেষবারের মতো শোনাও তোমার সহি তেলাওয়াত।
মৃত্যু নিশানা নাচায়, লোবান আতর গোলাপপাশ।
গণ্ডুষ ভরে দাও জমজমের শীতল নহর। কলেমার ফুঁ-
যাই তবে মিশে যাই যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর।
পড়ে থাক তোমাদের ভ্রুকুটি, ব্যাবাক গীবতের গীত
মাটির পৃথিবী যাই? আরো কেন বাসি ভালো নিদানের কালে!
অভিমানী বৃক্ষ
মঈনউদ্দিন মুনশী
মানুষের ভালবাসা পেয়ে তার জন্ম,
বাতাস ভালবেসে ফোটাল ফুল,
পাখীদের ভালবাসা দিলো তার গান,
শুধু মাটির ভালবাসা পেল না বলে
সে দিয়ে গেল প্রাণ।
অনস্তিত্বের জটিলাবর্ত থেকে
মাহফুজ আল-হোসেন
ক্রমহ্রাসমান উপযোগ বিধির মন্দ দৃষ্টান্ত হয়ে
মৃদুমন্দ মুমূর্ষু হাওয়ায়- যখন তুমি
লঘু শ্বাস-প্রশ্বাসের অসহনীয় বেদনাকে
একান্ত আপন করে নিলে,
তখন আমি উদ্ভ্রান্ত উজবুক নাবিকের মতোই
সমূহ সর্বনাশের তটরেখাকেই
ভবিতব্য ভেবে নিয়ে ছিলাম আশ্চর্য মূঢ়তায়!
অথচ, মুখোশের অন্তরালে থেকেও
অনিশ্চিত অন্ধকারের সেই তুমি-
অনস্তিত্বের প্রহেলিকাময় জটিলাবর্ত থেকে
পরিসংখ্যানগত সম্ভাবনার এক
যৌক্তিক অনুমান হয়ে উঠেছো ক্রমশ
কোনো এক ঐশী ইশারায়।
তোমার অতিপ্রাকৃত অতন্দ্রিলা চাহনিতে
জটিল রাশিমালার অনির্ণেয় সমীকরণ,
নিখাদ ভালোবাসার সরলীকৃত
ক্ষুদেবার্তায় রূপান্তরিত হচ্ছে- বিনা প্ররোচনায়;
আর ওই ঔপনিবেশিক অনার্দ্র ওষ্ঠাধারের
দুষ্পাঠ্য? শিলালিপি- হঠাৎ করেই কেন জানি না
পেলব কোমল সুনাব্য চুম্বনের অনিবার্যতাকে
অনুবাদ করে চলেছে- নির্ভার সাবলীলতায়।
ভাঙা জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে
চয়ন শায়েরী
ঘর ভাঙতেই হলো-
অগোছালো ভাঙা বাড়ি
জানালাটা ওপড়ানো
নিয়তির অলঙ্ঘ্য নোটিশে;
নিয়ম মানতে হয়-
মিউনিসিপ্যালিটি তো আর কবিতার
আড়তদারি করে না;
এই রুমে কবিতার চাষ-আবাদ হয়েছে-
অতন্দ্রিলা ভবনের ভাঙচুরে তাই মাথাব্যথা নেই;
যে-ঘরের কোণে বসে
তোমাকে বাক্সময় করেছি
ওটার দরজা কপাট চৌকাঠ সব গেছে
খাড়া দেয়াল উঠেছে;
রাতভর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে
তোমাকে খোঁজার বদ-অভ্যাসের
জায়গাটুকুন আরও ছোটো হয়ে এল;
একটা জানালা অর্ধেকের মতো
রক্ষা পেয়েছিল-
কৌতুকী নিয়তি অনেক কৌশলী বোধ হয়;
দম নিতে কষ্ট হয়- এ-আবদ্ধ ঘরে,
চৌকাঠ পেরিয়ে যেতে পারি নি কখনো;
বেলকনি গেছে
ভাঙা জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি-
তোমার মনোদিঘির পাড় ঘেঁষে
শেকড়ের টান ছেড়ে কাত হয়ে পড়া
জারুল গাছটা যেন তুমি-
জলেতে বিম্বিতা জলছবি
থই থই বৈভবের ছবিকল্প আঁকে
কবিদের চিত্রকল্পের মতন
-মনোদিঘিটির জলে-
ভাঙা জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে শুধু
তোমারই জলছবি দেখি।
বনভূমি
জাফর সাদেক
আমার সাতদিন আমার মতো-
শুক্রবার নীলাভ দুঃখ, শনিবার পরিশ্রান্ত কষ্ট
রোববার আনন্দ নিতে পথের প্রান্তে মগপাড়ায়
পথের কাছে ঘুমিয়ে নিতে বজ্রপাত সরিয়ে বৃষ্টিপাত
উড়াল পাখির ডানা পেলে আকাশ হওয়া কতো সহজ
মেঘের দেশে উড়ে উড়ে বৃষ্টি বিলানো কতোটা সরল
সোমবার ডানামেলা পাখির সন্ধানে হারিয়ে যাই
মঙ্গলের পর দৌড়বিদ্যায় পারদর্শী হরিণীর পিছে
ছুটতে ছুটতে বলেছি- আমি ভয়াল থাবার ব্যাঘ্র নই
গাছের সজীবে, ছায়ার চলনে নিতান্ত এক বনভূমি
তুমি আমার ভেতরে প্রশান্ত হও, ঘুম নাও
এমন দিনপঞ্জিতে খালবিল সাঁতরে পথচ্যুত হতে হতে
বেঁচে থাকি, বেঁচে যাই- দেখি পথের শুরু হাসছে আবার
কাল যা শুরু হবে, শেষে এসে কিঞ্চিৎ কামার্ত কাঁপনে
কেউ কি চিনবে এই বনভূমি, ঘুমিয়ে বা ডানায় ভর করে
মনে মনে তো কতকিছুই ভাবি
আগাছার ফুল
ফারুখ সিদ্ধার্থ
মশুর ক্ষেতের সোনারঙ ছুঁয়ে দুটি চোখ- দুটি হাত
অনুভব করে শেফালির মতো একথালা শাদাভাত;
পাতলা ডালের হলুদ সুরায় যেটুকু আমিষ পাই
তাই নিয়ে যেন আরও কিছুদিন খেয়ে-পরে-বেঁচে যাই;
ঝাঁকবাঁধা ওই খয়েরি শালিখ-ঘুঘুদের কথা শুনে
ভাবে এইভাবে জীবনযাপন ভাগ করে নেবে গুনে;
বেগুনি আভায় হাতছানি দেয় কাঁটাময় লোহাগাড়া
কালো-নীল-কালো ভিমরুলগুলো সেই ডাকে দেয় সাড়া!
ওদের মিলন-সুখেই বাতাসে গুঞ্জরণের ঢেউ...
দুঃশব্দের শহরে সে-সুর টের পায় না তো কেউ;
বংশধারার স্বপনেই ফুল বীজ নিয়ে কোনওদিন
তুলা হয়ে যাবে চৈত্র-হাওয়ায়- মিহি কোনও মসলিন!
এক পেঁজা তার পড়ে যদি গিয়ে তোমার শ্রী-অঙ্গনে
বুঝে নিও কোনও আগাছার ফুল তোমাকে রেখেছে মনে...
কোজাগরী ঘুম
শেখর দেব
লক্ষ্মীমন্ত রাতে ঘুমের বুকের কাছে
আকুলি বিকুলি করি
মৃত্যুর ছায়ার মতো নিরবচ্ছিন্ন ঘুমেরা
যোগসিদ্ধ বুদ্ধের ফানুস হয়ে
উড়ে উড়ে কোথায় ফুরিয়ে গেলো?
যখন নেমেছে কোজাগরী রাত
অনুমোদিত চুরির অজুহাতে
ঘুম চুরি করে নিয়ে গেলো
মস্তিষ্ক পাড়ার চোর!
চাঁদজল খেলা দেখে পুকুর পেরোলে ক্ষেত
দুরন্তপনার রাতে চুরি চুরি মজা নিয়ে
ঘরে ফিরেই ঘুমের কাছে ছুটে গেছি
অথচ এমন রাতে নওয়াব বাড়ির হাটে
ক্রেতা হয়ে ঘুম বিক্রেতার কাছে যাই
ঘুমের দেখা মিলে না, বাজারে আগুন।
উপমা
মাসুদ মুস্তাফিজ
জোনাকিনৌকা
পাথররাত
জীবনগাছ
ধীর স্রোতে হারিয়ে যায়
চলে যাচ্ছে পথিক
ফেলে যাচ্ছে অতীত পথের দূরত্ব
চলে যাচ্ছে শীত
দিয়ে যাচ্ছে আগমনি গ্রীস্মের বীজগনিত ছায়ার উপমা
বয়ে যাচ্ছে নদী
নিয়ে যাচ্ছে নারীর মন ও প্রেম
থেকে যাচ্ছে কষ্ট-
রেখে যাচ্ছে তার স্বরচিত যাবতীয় নক্ষত্ররাতের ভার্জিনলাশ
বটকাল
ফারুক আফিনদী
০.
বয়সী বটের নিচে ঠাণ্ডা বাড়ি
সুন্দর... কিশোরী... এসে পানি খাওয়াচ্ছে
মেহেদি গাছটির কাছে
কচু গাছটি দাড়িয়ে
গামছা কাঁধে চেয়ে আছে মহিম ফকির- হলুদ পাতা ঝরছে
১.
সিলভার বাটিতে
জল নড়ে
মেন্দি পাতা ঝরে
নিরাগে
২.
ছায়া ছায়া ছবি
চৈত্রসংক্রান্তি শেষে, প্রাক্তন প্রেয়সীকে ভাবছি অবশেষে
গাফফার মাহমুদ
প্রাক্তন প্রেয়সীর সাথে হাওয়াই মিঠা, মালাই আইসক্রিম এই বৈশাখে রৌদ্রদিন ঘুরেছি অমলিন
লাল চুড়ি, আইলিনার এত্তো বড় কানের দুল, বেণীতে দোলা ঝুমকোফুল বেশ লাগতো পলাতকা
মাঠ জুড়েই কতো আয়োজন, মোহনবাঁশী, পোড়ামাটির খেলনাবাটি ওসব ছিলো ভীষণ পছন্দ তার
সুরে সুরে গান গেয়ে কাছে টানতো বায়োস্কোপওয়ালা
‘এই যে ঢাকার শহর, চড়ছে কতো ঘোড়ারগাড়ি, ওই যে বাহারী রিকসাওয়ালা’
জাদুকরী সুরে মত্ত হয়ে কাছাকাছি বায়োস্কোপে চোখ রাখতাম তুই-আমি
দুই টাকার বেলুন বাঁশি, থুত্থুরে বুড়োদাদুর পুতুল না কিনলেই কতো বায়না
রেশম ঘাসে বসে অনায়সে কতো খোশগল্প বলতো সেই প্রাক্তন প্রেয়সী
বৈশাখ আসে চৈত্রসংক্রান্তি শেষে প্রেম সংক্রান্ত জোট, ব্যারিকেট
অবশেষে ভাবি প্রাক্তন প্রেয়সী, খুব বেশি মিস করছি তোকে।
কোন বোধে ছোঁবে প্রিয়ভূমি!
এলিজা খাতুন
একদা কালো কালো কৃষক মাটির কাগজে
শস্য লিখতো সারি সারি
পাঠ-উদ্বেগ চোখ পড়ে নিতো শ্যামলিমা
এখন রুক্ষ চোখে ফিরে যাচ্ছে সবুজাভ মায়া
মুমূর্ষূ যোদ্ধার মতো ফিরে যাচ্ছে
বুদ্ধের অহিংস ভাষা
ক্ষেতের হাসিতে নিয়ত বাড়ছে ক্ষত
শস্য গোলায় নামে গলিত আঁধার
নিঃশেষের পথে হাঁটে-
পলিমাটি, চাষা আর চাষিবউ-প্রিয় পরিচয়
শস্য মাড়াইয়ের পরিচিত চান্নিরাত অমাবশ্যায় ঢাকা
বিনিদ্রতায় জেগে ওঠা কোন্ বোধে ছোঁবে প্রিয়ভূমি!
সড়কের সুরকি, পাথর, পিচের উপর
নিষেধ ঝুলিয়ে কতটুকু হয় অবরোধ!
মৌসুম এলে বীজগুলো সব ছড়িয়ে যাবে ঠিক
কেননা মনে হয়-
মানুষের মধ্যে এখনও মানুষ আছে
মানুষের মধ্যে এখনও কৃষক আছে
এবারের বৈশাখ
রেহেনা মাহমুদ
হালখাতা খুলেছে কৃষ্ণচূড়া দম্পতি
কেউ এলেই ফুরফুরে মেজাজে
স্বাগত জানায় তার কোমল পেলবতায়
পাখিরাও বৈশাখের ঊষালগ্নে
যোগ দিয়েছে নতুন বছরের মচ্ছবে
কৃষ্ণচূড়ার বাগানে গেলে
শুভ কামনায় তারা ঠোঁটে ছুঁয়ে দেয় হলদে রেনু
আর সে শুভবারতা ছড়িয়ে যায় সীমান্ত থেকে সীমান্তে।
নতুন বছরের হালনাগাদ জানিয়ে যায় ঝড়ো হাওয়া
না, বৃক্ষসমাবেশে কোনো নালিশ নেই
পাখিরা মুক্তকণ্ঠে গাইছে গান
যারা পালিয়েছিল তারাও ফিরে এসেছে নিজের রাজত্বে
না, কারোরই শ্বাসকষ্ট নেই
নেই সামাজিক দূরত্বের বাঁধাধরা কোন নিয়ম
এবারের বৈশাখ তাদের।
কী জানি! হয়তো রমনার বটমূলে ফুল, পাখিদের কোরাসেই
শুনতে পাব এবারের নববর্ষের গান-
“এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো:
বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১
ধূলিপথ আমারও ইচ্ছে করেছিল
আবদুর রাজ্জাক
তুমি ডাহুক, আজানুলম্বিত গলা, আমাকে নিয়ে গেছো অরণ্য বিরহে,
কড়িকাঠের চৌকাঠ ছেড়ে ঘুণপোকারা ঘুমায় নিখিলের বনতলে,
বহে করমচা ফুলের হাওয়া, ডাহুক যেভাবে ডাকে
ওইভাবে ডেকে যায় অব্যর্থ চিল।
তাদের শিরাভর্তি আগুন, শাশ্বত আকাশ, প্রণম্য, কোনো
পথচারীর কথা মনে রাখে না।
আমিও ঘর ছাড়া বাউল, আমারও একতারা ছলছল, মৃত্যু তরজমাহীন,
এই যে এতো নীরবতা পাখিদের গলায়, এতো গেরস্তালি
থমকে রয়েছে লাউফুলের শাখা-প্রশাখায়।
নির্লিপ্ত আকাশ, সহস্র ডাক ডাহুকের, ডাহুক ক্লান্ত হয়ে- পরাস্ত হয়ে
বস্তুত এইভাবে ডুবে যায় চাঁদ, এইভাবে বিব্রত কাল।
আধো আঙ্গিনায় জামগাছের নম্র ছায়া, তুমি সেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে, পাখি
পতঙ্গের ওড়াউড়ি দেখো।
দেখা হবে আগামী বৈশাখে
ফারুক মাহমুদ
নিষেধকণ্টক ঠুকে ঢেকে দিলে আমার আকাশ
উন্মুখ জানাল চাই। আলোমুখ। ফেলব না শ্বাস!
ইচ্ছের কপাট বোজা। রুক্ষ রাগে তুলে দিলে খিল
চৈত্রময়তায় আছি, স্থির কষ্ট- বাঁচা মুশকিল
তোমার চোখর হ্রদে ফোটে যদি আকাশের হাসি
কেউ তো বলতেই পারে, হে নির্জন, আজো ভালোবাসি
ভাটিপোড়া ঝামাগন্ধ... তা-ও থাকে রূঢ় রৌদ্রে মিশে
চেয়েছি জলের ধারা, উঁকিবৃষ্টি মেঘের কার্নিশে
যে ভোলার ভুলে যায়- খেরোখাতা- কেউ মনো রাখে
এবার হল না দেখা, দেখা হবে আগামী বৈশাখে
আপেল গাছ
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
রঙতুলি জমা দিয়েছো মিউজিয়ামে, পরিত্যাক্ত প্রত্নঘড়ি
তা গ্যালারির মধ্যাকর্ষণ, দর্শকের কাছে দামী দোলনা-পরী।
গত শীতে
বাতিল করে ফেলে দিয়েছো নদীতে
তা জল-দেবতা খোয়াজ খিজিরের ডুব-কথা
মিথ, জলপরীর রূপকথা!
যা অবহেলা করে রেখে এসেছিলে রেলের ধারে, আজ
তা আপেল গাছ!
প্রথম মাস, নব আশ্বাস
ভাগ্যধন বড়ুয়া
ভোরে ভরা থাকে গান, কলতান
নরম বাতাসে হেঁটে যায় প্রাতঃভ্রমণের দল
সূর্য উঁকি দিয়ে দেখে কারা এখনও ঘুমে!
জবা আড়মোড়া ভাঙে, প্রজাপতি উড়ে...
গোলকের আলো-অন্ধকার মাপে ঘড়ি
চলমান মনে ভাবি অনিবার্য অস্তিত্ব
টেনে নিয়ে যাই রক্ত, বীজদানা, আনন্দ, তিক্ততা
অস্পষ্ট অতীত ডালপালাসহ সামনে খোলাসা!
বিচ্ছুরিত আলোয় পাখির ডাক ক্রমাগত কমে
বেলা বাড়লে কোলাহলে বুঝা যায় না কূজন
ক্রোধ, দুঃখবোধে অস্থির মানুষ পালায় গভীরে
ব্যথা অনিবার্য জেনে যারা হাঁটে তারা পায় মাইলফলক!
শুকনো হাড়ের মতো কাণ্ড নিয়ে চৈতের গাছপালাও অপেক্ষায়;
কখন আসবে বৈশাখ?
দেখা যাবে শাখে শাখে আন্দোলিত পাতা!
ফুলের প্লাবন কোথাও, পতঙ্গ পাখির চলমান সুর
আবার সাজাবে মন নতুন আশায়, তীব্র ভালোবাসায়...
ধানগাছের পোয়াতি কাহন
ওবায়েদ আকাশ
হাওয়া হাওয়া, এখন নিশ্চুপ বসন্ত ঋতু
এখন ইলিশের কাঁটায় শৃঙ্খলিত গুগল সভ্যতা
সবুজ দ্যুতিময় তোমার পোশাকের আঁশ
প্রান্ত ধরে টান দিতেই ধূপসাদা মেঘফুল ঘিরে
প্রিয়তমার অবিশ্বাস্য বিরহযাপন
ষড়ঋতুর প্রসঙ্গ বিন্যাসে ধানগাছের পোয়াতি কাহন
তুমিও তো চেয়েছিলে
শ্যামল সন্ধেরা ঘাটে বাঁধা খেয়া পারাপারকালে
এই প্রথম ভ্রমণস্নাত হবে, আর
সোনালুফুলের স্বাস্থ্যকর হাটে তুমি আমি ফিরে যাবো
বিহঙ্গ যৌবনে
এই সেই বর্ষণক্লান্ত গরিমা?
পৃথিবীর টোলপড়া গাল ভরে আছে উদ্ভ্রান্ত মেহগনি ফলে
এই সকল বিধি ও সংক্রাম- তোমার বহুবঙ্কিম শরীরের গান
তোমার উড়ন্ত বাহুতে শঙ্খচিল, কোজাগরি রাত
ঊরুতে সন্তরণ প্রকার, ঘরের চালে চালকুমড়ার প্রভূত ফলন
খুশির চন্দ্রবিন্দু
সাইফুল্লাহ আল মামুন
কৃষ্ণচূড়ার লাল আলো ছড়ায় যত জাদু
প্রজাপ্রতির রঙিন পাখায় শুভ দিনের মধু
গানের বীণায় আনন্দ আবেগে মগ্ন যেন বধূ
অভিষেকের শিরোনামে
কাছে এসে নাচে নবীন সাধু
আশীর্বাদের রক্তিম পথে পাশে বস বন্ধু বৈশাখ!
আমার প্রানের ধ্বনি খুশির চন্দ্রবিন্দু।
নব প্রভাতের আলোকিত দিনে পুলকিত হই
চেতনার জাগরণে চিত্ত রসে নিত্য জেগে থাকি
প্রাণে প্রাণে খুশির বার্তা থই থই
কত যে কলরব কত রঙের হইচই
পুলকে পুলকে আলোক সন্তরণে রাঙা সিন্ধু
লাল শাড়ির সুন্দরিকা প্রতীক্ষার প্রহরে বন্ধু
বৈশাখ আমার প্রাণের ধ্বনি খুশির চন্দ্রবিন্দু
প্রকৃতি সাজায় খুশি আনন্দ অবিরাম
নতুন নামে ডাকবে বলে,
নতুন সাজে সেজে এলাম
নতুন কুঁড়ির ফুলঝুরি নববর্ষের সালাম
বৈশাখ আমার আত্মপরিচয়
চেতনার অনন্য নাম।
নববর্ষ আর আসবে না
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
নিয়ম পালনের জন্যে কখনো কখনো পাল্টে যায় বর্ষপঞ্জি
যেমন কেউ কেউ নিয়ম পালনার্থে সংসারী হয়
সং সেজে সার না খুঁজে সময়ের লেজে পাড়া না দিয়ে
চারপাশের ঘটনাকে অদেখার ভান করে
যারা উদাসী তাদের মতোই মাঝ মাঝে মাসগুলো নাম পাল্টায়,
পাল্টে যায় দিনের পরিচিতি, বছরগুলো সংখ্যা হয়ে ওঠে।
বর্তমানের বিবর্ণতাকে সাময়িক সঙ্কট ভেবে ভবিষ্যতের আলোয়
কেউ দেখার দৃষ্টি পেতে চেয়ে নববর্ষের প্রতীক্ষায় থাকে
গায়ে নতুন পোশাক মুখে মিষ্টির মাধুর্য আর বুকে বুনে রাখা স্বপ্নের
কল-কলাৎ সবই হয়, রাষ্ট্রে বৈশাখী ভাতা হয়, অনলাইন আড্ডা হয়
কিন্তু উৎসবের গায়ে কেউ পরায় না নতুন জামা, নতুন বছরকে
কেউ নিশ্চিৎ করে না নিরাপত্তা দিয়ে
সেই পুরোনো শকুনেরা বার বার ধর্মসম্মত নয় বলে নববর্ষকে অপমান করে
এতোসব অপমান হতমান নিয়ে বাঙালির নববর্ষ তবু আসে
নিয়ম পালনের জন্যে আসে, নিজে একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে আসে
কোন একদিন হয়তো তাকে বরণ করে নেবে সম্মিলিতভাবে
বিভক্তি নয়, ঐক্যের সমতানই উৎসবের শক্তি, উদযাপনের সৌন্দর্য।
নিয়ম পালনের জন্যে এদেশে নববর্ষ আসে, যেমন হাসে দিন, নামে রাত
বছর বা দিনের পরিবর্তনে এমন আহামরি কিছুই পাল্টায় না
সংখ্যা পাল্টালেও শঙ্কা পাল্টে যায় না, পাল্টায় না রক্তচক্ষু
যে মানুষ নতুন পোশাকে মুখে রং মেখে হেঁটে যায় শোভাযাত্রায়
সে-ও জানে, পরকালের প্রশান্তিকে বিপন্ন করে লোক দেখানোর উৎসবে
সে শামিল, ঠিক যেন শাবানার মতো
নববর্ষ এখানে মনে আসে না, আসে না চেতনাতেও
এখানে নববর্ষ আসে শেকড়কে উপহাসের জন্যে
এখানে নববর্ষ আসে বণিকের লাল খাতায়
এখানে নববর্ষ আসে কৃষকের পান্তাকে উপহাসের জন্যে
এখানে নববর্ষ আসে মিডিয়া ও কর্পোরেট জীবনের পণ্য শিকারের জন্যে
এখানে নববর্ষ আসে হারাম আর হালালের বিসংবাদ জিইয়ে রাখার জন্যে।
নববর্ষকে দূরে রাখতে এখানে মরুর ঊষর বালি দিয়ে
ঊর্বর পলিকে ঢেকে দিতে চায় অনেকেই
পশ্চিমা উগ্রতায় নববর্ষের কোমলতাকে পাল্টে দিতে উদগ্রীব আধুনিকতাবাদীরাও
প্রতিবেশির উৎসব বলে নববর্ষকে সৎ পুত্রের মতো
দূরে ঠেলে দেয় অসংখ্য উন্মত্ত জনতা
তবু চৈত্র এলেই এখানে নববর্ষের তোড়জোর শুরু হয়
এপ্রিল নয়, বৈশাখই যেন মুখ্য হয়ে ওঠে মেকি মানুষের ভিড়ে
অথচ কেউ জানে না, মানুষ না পাল্টালে, মন না পাল্টালে
এখানে সত্যিকারের নববর্ষ আর কোনদিন আসবে না।
যাই তবে মিশে যাই
দিলারা মেজবাহ
যাই তবে মিশে যাই মান্যবর! শেষবারের মতো শোনাও
তোমার সহি তেলাওয়াত, কচিৎ বিসমিল্লাহর সানাই।
যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর, নিধুয়া পাথার, বিদায়।
যাই অচেনা নির্জনে, কলবের ময়লা ঘষি-
কুয়াশার নিকাবে ঢাকি নিদানের চিহ্নগুলি।
মহাত্মা, জীবনের দৌড় ফুরাবে না বুঝি?
ঝরাপাতা যাই মাড়িয়ে প্রত্যুষে পদভারে।
শেষবারের মতো শোনাও তোমার সহি তেলাওয়াত।
মৃত্যু নিশানা নাচায়, লোবান আতর গোলাপপাশ।
গণ্ডুষ ভরে দাও জমজমের শীতল নহর। কলেমার ফুঁ-
যাই তবে মিশে যাই যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর।
পড়ে থাক তোমাদের ভ্রুকুটি, ব্যাবাক গীবতের গীত
মাটির পৃথিবী যাই? আরো কেন বাসি ভালো নিদানের কালে!
অভিমানী বৃক্ষ
মঈনউদ্দিন মুনশী
মানুষের ভালবাসা পেয়ে তার জন্ম,
বাতাস ভালবেসে ফোটাল ফুল,
পাখীদের ভালবাসা দিলো তার গান,
শুধু মাটির ভালবাসা পেল না বলে
সে দিয়ে গেল প্রাণ।
অনস্তিত্বের জটিলাবর্ত থেকে
মাহফুজ আল-হোসেন
ক্রমহ্রাসমান উপযোগ বিধির মন্দ দৃষ্টান্ত হয়ে
মৃদুমন্দ মুমূর্ষু হাওয়ায়- যখন তুমি
লঘু শ্বাস-প্রশ্বাসের অসহনীয় বেদনাকে
একান্ত আপন করে নিলে,
তখন আমি উদ্ভ্রান্ত উজবুক নাবিকের মতোই
সমূহ সর্বনাশের তটরেখাকেই
ভবিতব্য ভেবে নিয়ে ছিলাম আশ্চর্য মূঢ়তায়!
অথচ, মুখোশের অন্তরালে থেকেও
অনিশ্চিত অন্ধকারের সেই তুমি-
অনস্তিত্বের প্রহেলিকাময় জটিলাবর্ত থেকে
পরিসংখ্যানগত সম্ভাবনার এক
যৌক্তিক অনুমান হয়ে উঠেছো ক্রমশ
কোনো এক ঐশী ইশারায়।
তোমার অতিপ্রাকৃত অতন্দ্রিলা চাহনিতে
জটিল রাশিমালার অনির্ণেয় সমীকরণ,
নিখাদ ভালোবাসার সরলীকৃত
ক্ষুদেবার্তায় রূপান্তরিত হচ্ছে- বিনা প্ররোচনায়;
আর ওই ঔপনিবেশিক অনার্দ্র ওষ্ঠাধারের
দুষ্পাঠ্য? শিলালিপি- হঠাৎ করেই কেন জানি না
পেলব কোমল সুনাব্য চুম্বনের অনিবার্যতাকে
অনুবাদ করে চলেছে- নির্ভার সাবলীলতায়।
ভাঙা জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে
চয়ন শায়েরী
ঘর ভাঙতেই হলো-
অগোছালো ভাঙা বাড়ি
জানালাটা ওপড়ানো
নিয়তির অলঙ্ঘ্য নোটিশে;
নিয়ম মানতে হয়-
মিউনিসিপ্যালিটি তো আর কবিতার
আড়তদারি করে না;
এই রুমে কবিতার চাষ-আবাদ হয়েছে-
অতন্দ্রিলা ভবনের ভাঙচুরে তাই মাথাব্যথা নেই;
যে-ঘরের কোণে বসে
তোমাকে বাক্সময় করেছি
ওটার দরজা কপাট চৌকাঠ সব গেছে
খাড়া দেয়াল উঠেছে;
রাতভর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে
তোমাকে খোঁজার বদ-অভ্যাসের
জায়গাটুকুন আরও ছোটো হয়ে এল;
একটা জানালা অর্ধেকের মতো
রক্ষা পেয়েছিল-
কৌতুকী নিয়তি অনেক কৌশলী বোধ হয়;
দম নিতে কষ্ট হয়- এ-আবদ্ধ ঘরে,
চৌকাঠ পেরিয়ে যেতে পারি নি কখনো;
বেলকনি গেছে
ভাঙা জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি-
তোমার মনোদিঘির পাড় ঘেঁষে
শেকড়ের টান ছেড়ে কাত হয়ে পড়া
জারুল গাছটা যেন তুমি-
জলেতে বিম্বিতা জলছবি
থই থই বৈভবের ছবিকল্প আঁকে
কবিদের চিত্রকল্পের মতন
-মনোদিঘিটির জলে-
ভাঙা জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে শুধু
তোমারই জলছবি দেখি।
বনভূমি
জাফর সাদেক
আমার সাতদিন আমার মতো-
শুক্রবার নীলাভ দুঃখ, শনিবার পরিশ্রান্ত কষ্ট
রোববার আনন্দ নিতে পথের প্রান্তে মগপাড়ায়
পথের কাছে ঘুমিয়ে নিতে বজ্রপাত সরিয়ে বৃষ্টিপাত
উড়াল পাখির ডানা পেলে আকাশ হওয়া কতো সহজ
মেঘের দেশে উড়ে উড়ে বৃষ্টি বিলানো কতোটা সরল
সোমবার ডানামেলা পাখির সন্ধানে হারিয়ে যাই
মঙ্গলের পর দৌড়বিদ্যায় পারদর্শী হরিণীর পিছে
ছুটতে ছুটতে বলেছি- আমি ভয়াল থাবার ব্যাঘ্র নই
গাছের সজীবে, ছায়ার চলনে নিতান্ত এক বনভূমি
তুমি আমার ভেতরে প্রশান্ত হও, ঘুম নাও
এমন দিনপঞ্জিতে খালবিল সাঁতরে পথচ্যুত হতে হতে
বেঁচে থাকি, বেঁচে যাই- দেখি পথের শুরু হাসছে আবার
কাল যা শুরু হবে, শেষে এসে কিঞ্চিৎ কামার্ত কাঁপনে
কেউ কি চিনবে এই বনভূমি, ঘুমিয়ে বা ডানায় ভর করে
মনে মনে তো কতকিছুই ভাবি
আগাছার ফুল
ফারুখ সিদ্ধার্থ
মশুর ক্ষেতের সোনারঙ ছুঁয়ে দুটি চোখ- দুটি হাত
অনুভব করে শেফালির মতো একথালা শাদাভাত;
পাতলা ডালের হলুদ সুরায় যেটুকু আমিষ পাই
তাই নিয়ে যেন আরও কিছুদিন খেয়ে-পরে-বেঁচে যাই;
ঝাঁকবাঁধা ওই খয়েরি শালিখ-ঘুঘুদের কথা শুনে
ভাবে এইভাবে জীবনযাপন ভাগ করে নেবে গুনে;
বেগুনি আভায় হাতছানি দেয় কাঁটাময় লোহাগাড়া
কালো-নীল-কালো ভিমরুলগুলো সেই ডাকে দেয় সাড়া!
ওদের মিলন-সুখেই বাতাসে গুঞ্জরণের ঢেউ...
দুঃশব্দের শহরে সে-সুর টের পায় না তো কেউ;
বংশধারার স্বপনেই ফুল বীজ নিয়ে কোনওদিন
তুলা হয়ে যাবে চৈত্র-হাওয়ায়- মিহি কোনও মসলিন!
এক পেঁজা তার পড়ে যদি গিয়ে তোমার শ্রী-অঙ্গনে
বুঝে নিও কোনও আগাছার ফুল তোমাকে রেখেছে মনে...
কোজাগরী ঘুম
শেখর দেব
লক্ষ্মীমন্ত রাতে ঘুমের বুকের কাছে
আকুলি বিকুলি করি
মৃত্যুর ছায়ার মতো নিরবচ্ছিন্ন ঘুমেরা
যোগসিদ্ধ বুদ্ধের ফানুস হয়ে
উড়ে উড়ে কোথায় ফুরিয়ে গেলো?
যখন নেমেছে কোজাগরী রাত
অনুমোদিত চুরির অজুহাতে
ঘুম চুরি করে নিয়ে গেলো
মস্তিষ্ক পাড়ার চোর!
চাঁদজল খেলা দেখে পুকুর পেরোলে ক্ষেত
দুরন্তপনার রাতে চুরি চুরি মজা নিয়ে
ঘরে ফিরেই ঘুমের কাছে ছুটে গেছি
অথচ এমন রাতে নওয়াব বাড়ির হাটে
ক্রেতা হয়ে ঘুম বিক্রেতার কাছে যাই
ঘুমের দেখা মিলে না, বাজারে আগুন।
উপমা
মাসুদ মুস্তাফিজ
জোনাকিনৌকা
পাথররাত
জীবনগাছ
ধীর স্রোতে হারিয়ে যায়
চলে যাচ্ছে পথিক
ফেলে যাচ্ছে অতীত পথের দূরত্ব
চলে যাচ্ছে শীত
দিয়ে যাচ্ছে আগমনি গ্রীস্মের বীজগনিত ছায়ার উপমা
বয়ে যাচ্ছে নদী
নিয়ে যাচ্ছে নারীর মন ও প্রেম
থেকে যাচ্ছে কষ্ট-
রেখে যাচ্ছে তার স্বরচিত যাবতীয় নক্ষত্ররাতের ভার্জিনলাশ
বটকাল
ফারুক আফিনদী
০.
বয়সী বটের নিচে ঠাণ্ডা বাড়ি
সুন্দর... কিশোরী... এসে পানি খাওয়াচ্ছে
মেহেদি গাছটির কাছে
কচু গাছটি দাড়িয়ে
গামছা কাঁধে চেয়ে আছে মহিম ফকির- হলুদ পাতা ঝরছে
১.
সিলভার বাটিতে
জল নড়ে
মেন্দি পাতা ঝরে
নিরাগে
২.
ছায়া ছায়া ছবি
চৈত্রসংক্রান্তি শেষে, প্রাক্তন প্রেয়সীকে ভাবছি অবশেষে
গাফফার মাহমুদ
প্রাক্তন প্রেয়সীর সাথে হাওয়াই মিঠা, মালাই আইসক্রিম এই বৈশাখে রৌদ্রদিন ঘুরেছি অমলিন
লাল চুড়ি, আইলিনার এত্তো বড় কানের দুল, বেণীতে দোলা ঝুমকোফুল বেশ লাগতো পলাতকা
মাঠ জুড়েই কতো আয়োজন, মোহনবাঁশী, পোড়ামাটির খেলনাবাটি ওসব ছিলো ভীষণ পছন্দ তার
সুরে সুরে গান গেয়ে কাছে টানতো বায়োস্কোপওয়ালা
‘এই যে ঢাকার শহর, চড়ছে কতো ঘোড়ারগাড়ি, ওই যে বাহারী রিকসাওয়ালা’
জাদুকরী সুরে মত্ত হয়ে কাছাকাছি বায়োস্কোপে চোখ রাখতাম তুই-আমি
দুই টাকার বেলুন বাঁশি, থুত্থুরে বুড়োদাদুর পুতুল না কিনলেই কতো বায়না
রেশম ঘাসে বসে অনায়সে কতো খোশগল্প বলতো সেই প্রাক্তন প্রেয়সী
বৈশাখ আসে চৈত্রসংক্রান্তি শেষে প্রেম সংক্রান্ত জোট, ব্যারিকেট
অবশেষে ভাবি প্রাক্তন প্রেয়সী, খুব বেশি মিস করছি তোকে।
কোন বোধে ছোঁবে প্রিয়ভূমি!
এলিজা খাতুন
একদা কালো কালো কৃষক মাটির কাগজে
শস্য লিখতো সারি সারি
পাঠ-উদ্বেগ চোখ পড়ে নিতো শ্যামলিমা
এখন রুক্ষ চোখে ফিরে যাচ্ছে সবুজাভ মায়া
মুমূর্ষূ যোদ্ধার মতো ফিরে যাচ্ছে
বুদ্ধের অহিংস ভাষা
ক্ষেতের হাসিতে নিয়ত বাড়ছে ক্ষত
শস্য গোলায় নামে গলিত আঁধার
নিঃশেষের পথে হাঁটে-
পলিমাটি, চাষা আর চাষিবউ-প্রিয় পরিচয়
শস্য মাড়াইয়ের পরিচিত চান্নিরাত অমাবশ্যায় ঢাকা
বিনিদ্রতায় জেগে ওঠা কোন্ বোধে ছোঁবে প্রিয়ভূমি!
সড়কের সুরকি, পাথর, পিচের উপর
নিষেধ ঝুলিয়ে কতটুকু হয় অবরোধ!
মৌসুম এলে বীজগুলো সব ছড়িয়ে যাবে ঠিক
কেননা মনে হয়-
মানুষের মধ্যে এখনও মানুষ আছে
মানুষের মধ্যে এখনও কৃষক আছে
এবারের বৈশাখ
রেহেনা মাহমুদ
হালখাতা খুলেছে কৃষ্ণচূড়া দম্পতি
কেউ এলেই ফুরফুরে মেজাজে
স্বাগত জানায় তার কোমল পেলবতায়
পাখিরাও বৈশাখের ঊষালগ্নে
যোগ দিয়েছে নতুন বছরের মচ্ছবে
কৃষ্ণচূড়ার বাগানে গেলে
শুভ কামনায় তারা ঠোঁটে ছুঁয়ে দেয় হলদে রেনু
আর সে শুভবারতা ছড়িয়ে যায় সীমান্ত থেকে সীমান্তে।
নতুন বছরের হালনাগাদ জানিয়ে যায় ঝড়ো হাওয়া
না, বৃক্ষসমাবেশে কোনো নালিশ নেই
পাখিরা মুক্তকণ্ঠে গাইছে গান
যারা পালিয়েছিল তারাও ফিরে এসেছে নিজের রাজত্বে
না, কারোরই শ্বাসকষ্ট নেই
নেই সামাজিক দূরত্বের বাঁধাধরা কোন নিয়ম
এবারের বৈশাখ তাদের।
কী জানি! হয়তো রমনার বটমূলে ফুল, পাখিদের কোরাসেই
শুনতে পাব এবারের নববর্ষের গান-
“এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো: