দেবাহুতি চক্রবর্তী
বছর আসে, বছর যায়। আসা-যাওয়ার মাঝে জড়ানো জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সম্পদ-সংকট, হাসি-কান্না। সব কিছু মিলিয়ে জীবন যেন সদা তা-তা-থৈ-থৈ করেই কাটাতে হয়। নির্মল আনন্দের অবসর আমাদের জীবনে খুবই কম। আবার যা আছে তার গণ্ডিও নানা কারণে সীমিত। সবাইকে নিয়ে, সবার সাথে মিলেমিশে আনন্দে অবগাহনের সুযোগ নববর্ষ বরণ। বাঙালির জীবনে এতবড় অসাম্প্রদায়িক, বিভেদ-বৈষ্যমহীনভাবে মেলা আর মিলানোর সুযোগ দ্বিতীয়টি নেই। সেজন্যই বুঝি বাংলা আর বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী মানুষ যেমন নববর্ষ বরণের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে, বিপরীতে এই চেতনাকে খণ্ডিত করার জন্য, এই চেতনায় আঘাত আনার জন্য মৌলবাদী তৎপরতাও তেমনি সক্রিয় থাকে। এই দুইয়ের সংঘাত কম বেশি সাতচল্লিশের দেশভাগ পরবর্তী সময় হতেই চলে আসছে। বিরোধিতা যত বাড়ে, নববর্ষ বরণের উৎসবও ততই প্রাণ পায়। বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার সাধনার এ এক সন্ধিক্ষণ। করোনাকালীন দুর্যোগেও বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিরোধী অপশক্তি অনেক বেশি তৎপর। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালির হৃদয়ে তাই খুব বেশি তাগিদ থাকে নববর্ষ সাড়ম্বরে বরণের বা উদযাপনের। দুবছর ধরেই যা হচ্ছে তা নিতান্তই আনুষ্ঠানিক। দুকূল ভাসিয়ে নেওয়া প্রাণের জোয়ারের অনুপস্থিতি অনাকাক্সিক্ষত হলেও আজ সত্য।
নববর্ষের আনন্দ উচ্ছ্বাস আড়াল করে রয়েছে কোভিড-১৯-এর মুখব্যাদান। চারপাশে প্রিয়জনের মৃত্যুর মিছিল। চারপাশে চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় মানুষের আহাজারি। এখন সরাসরি শিয়রে করোনাক্রান্তি!
এই পরিস্থিতিতে এবারের নববর্ষের তাৎপর্য অন্যমাত্রা বহন করে। মৌলবাদী অপশক্তির নৃত্যনাচন, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানাবিধ দুর্বৃত্তায়ন, অবাধ দুর্নীতি আমাদের দীর্ঘদিনের অপসংস্কৃতির ধারক, বাহক হয়ে আছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে আমরা পরিচিত। আমাদের বাহ্যিক উন্নয়ন সত্যিই অনেকের ঈর্ষার কারণ। কিন্তু, লাগামহীন প্রাচুর্যের তেল একদিকে প্রদীপের গা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। অন্যদিকে প্রদীপের নিচের অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। কোভিড-১৯ আমাদের খুব কঠিনভাবে এই বৈপরীত্যের মুখোমুখি করেছে।
প্রতি নতুন বছরই তো আমাদের ফিরে দেখার দিন। পুরনো হিসেব-নিকেশ সুদেআসলে মিলিয়ে নতুনের হালখাতা খোলার দিন। এই লোকজ সংস্কৃতি আমাদের আদি ও অকৃত্রিম। আর সেই হিসাবের খাতায় আমাদের কী আছে আর কী নেই- মিলিয়ে নেওয়ার দিন। নববর্ষ বরণ সেই অর্থে আমাদের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পর্যালোচনার সূচক মুহূর্ত।
ভাবতেই হচ্ছে, বিদায়ী ১৪২৭ আমাদের কী দিয়ে গেল? বিশ্বের অনেক অনেক দেশে এই করোনাকালে জিডিপি
হার উদ্বেগজনকভাবে কমেছে। বাংলাদেশে বিস্ময়করভাবে অর্থনৈতিক চাকার অগ্রগতি সচল থেকেছে। প্রবাসী শ্রমিকের রেমিট্যান্স, দেশীয় শ্রমের প্রায় বাধাহীন যোগান, আর খেটে খাওয়া মানুষের লড়াই তিনের সংযোগে সরকারের সাফল্য সূচিত হয়েছে। পাশাপাশি আমরা দেখেছি এই সময়কালে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে অনেক বেশি। বেড়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের হার। নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ছেলে শিশু বলাৎকার, হত্যা, সন্ত্রাস, আত্মহত্যা, নারী ও শিশু পাচার, সাইবার ক্রাইম, কিশোর অপরাধ, মাদকের বহু বিস্তার- এমনতর বিভিন্ন ক্রমবর্ধমান ঘটনা আমাদের সামাজিক ও মানসিক জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমাদের শিশুরা শৈশব হারিয়ে, বয়সীরা জীবন সায়াহ্নের দিনগুলোয় নিজের অধিকার হারিয়ে, মধ্যবর্তীরা জীবন ও জীবিকার নিয়ত দ্বন্দ্বে জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়ে এক বিষাদগ্রস্ত অবসন্নতায় আচ্ছন্ন। এই চিত্র কী শুধু আমাদের দেশের? অবশ্যই নয়। পৃথিবীর দেশে দেশেই মানুষ এই ধরনের কিংবা অন্যান্য ধরনের সামাজিক মানসিক বিপর্যয়ে ক্লান্ত। জাতিসংঘের তথ্যসূত্র সেই সত্য প্রতিদিনই প্রকাশ করে যাচ্ছে। এর সাথে সবচেয়ে কঠিন সত্য, মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারের নিদারুণ লঙ্ঘন প্রায় সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাষ্ট্র তার নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিধি সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবা অভাবের নগ্নরূপ আমাদের সকল উন্নয়নকে পরিহাস করছে। অর্থবিত্তশালী ভুঁইফোড় শ্রেণি এক দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের সামান্যতম আঁচড়েও বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমিয়েছে। কোভিড-১৯ এই পলায়নপরতার পথ অনেকটাই সীমিত করেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক নারী পুরুষের শ্রমের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে অনেক বেশি। বিপরীতে নারীর গৃহশ্রম বেড়েছে কয়েকগুণ। অভিবাসী আর পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্ভোগ মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ জনিত এই অভূতপূর্ব দুর্যোগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভোগবাদী বিশ্বব্যবস্থার আধিপত্যবাদকেই সচেতন মানব সমাজ দায়ী করছে। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে মানুষের অভিযাত্রা যতই বিস্ময়কর হোক, যতই বিজ্ঞান আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছাক, বৃহত্তর মানব কল্যাণের সূচকে তা যে কতটা ব্যর্থ করোনার এই নতুন ভাইরাস তা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমরা প্রকৃতি ধ্বংস করছি তথাকথিত উন্নয়ন, মারণাস্ত্রের উল্লম্ফন আর রাসায়নিক পরীক্ষা নিরীক্ষায়। প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনের নিত্যনতুন রূপ পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে। মানুষের প্রতি মানুষের অসাম্যের অপরাধ এইভাবে মহাসংক্রামক বিপর্যয়ের আধার। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমরা দেখছি ক্ষমতার দাম্ভিকতা পূর্ণ অনেক বড় বড় দেশ অতিমারীর সামগ্রিক বিপর্যয় এড়াতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ কিউবার মতো অনেক ছোট ছোট দেশ অনেক বেশি শৃঙ্খলার সাথে নিজেরা বিপদ সামলে উঠছে। অন্যদেশের মানুষকে সহায়তা করছে। কেন পারছে? তারা সর্বপ্রথম মানব কল্যাণে নিজেদের স্লোগান ব্যবহার করছে,- বোম চাই না, চিকিৎসক চাই। অস্ত্র চাই না, চিকিৎসা চাই।
১৪২৮ বরণ করতে যেয়ে এসব কথা অনেক অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। অনেকের মনে হতে পারে এসব কথার সাথে আমাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যর সম্পর্ক কী? সম্পর্কটা যে কী সেটা যদি আমরা এখনো না বুঝি তাহলে সামনে মহাবিপর্যয় আমরা এড়াতে পারব না। বৈশ্বিক আর স্থানিক অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে, এই পৃথিবী নামক গ্রহে যতদিন মানুষ আছে, ভাইরাসের অগুণতি প্রাণকোষ ততদিনই লড়াইয়ে থাকবে। ততদিনই মানুষকে বলবে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিতে। ততদিনই- “কাল ও দেশের সীমা তছনছ হবে, সংক্রামী মারীবীজে আক্রান্ত হবে মানুষের পথ, চলাচল, রুদ্ধ হবে মানুষের পলায়ন, মড়কের বীজে ভারি হবে হাওয়া, তারপর সেই বিষাক্ত হাওয়ায় অবরুদ্ধ মানুষের সভ্যতায় সর্বত্র ঘটবে ভয়াবহ মারীর সংক্রমণ।” (শাহযাদ ফিরদাউস)। এই কথাগুলো সাহিত্যের কল্পকথা নয়। আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। যেমন প্রত্যক্ষ করছি মৌলবাদের মারী কীভাবে এক উদ্দীপ্ত জাতীয় চেতনার জনগোষ্ঠীকে ক্রমশ পিছে টানছে, অবরোধ করছে তার চেতনার দুয়ার, যেমন আমরা প্রত্যক্ষ করছি অপশাসন আর দুর্বৃত্তায়ন কীভাবে জাতির জাগ্রত সত্তাকে অবরুদ্ধ করছে। তেমনি আমরা প্রত্যক্ষ করছি প্রকৃতির প্রতি অন্যায় কীভাবে বিপর্যস্ত করছে আমাদের জীবন। অতিমারী অতিক্রমণের পথ পেরোতে আমাদের স্বাভাবিক জীবন সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ প্রায়।
অথচ মানুষের জীবনে চারপাশের এই অবরোধই শেষ কথা হতে পারে না। করোনাক্রান্তি কালে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, মানুষ আসলে কত অসহায়। মানুষ সত্যিই আজ কাঁদছে। মানুষের পাশে মানুষ হয়ে দাঁড়ানো ছাড়া পথ নেই। অবকাঠামোর উন্নয়ন আর বাহ্যিক চাকচিক্যময় জগতের আড়ম্বর থেকে, ভোগবাদী সমাজ থেকে দূরত্ব রচনা হোক নতুনতর উপলব্ধি। সেই উপলব্ধি নিয়েই নতুনের যাত্রা শুরু হোক।
“অন্ন চাই, প্রাণ চাই, চাই মুক্তবায়ু
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু”
প্রার্থনা নয়, আমাদের চাওয়া আর অধিকারবোধে জাগ্রত হোক ১৪২৮-এর বর্ষবরণের দাবি।
দেবাহুতি চক্রবর্তী
বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১
বছর আসে, বছর যায়। আসা-যাওয়ার মাঝে জড়ানো জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সম্পদ-সংকট, হাসি-কান্না। সব কিছু মিলিয়ে জীবন যেন সদা তা-তা-থৈ-থৈ করেই কাটাতে হয়। নির্মল আনন্দের অবসর আমাদের জীবনে খুবই কম। আবার যা আছে তার গণ্ডিও নানা কারণে সীমিত। সবাইকে নিয়ে, সবার সাথে মিলেমিশে আনন্দে অবগাহনের সুযোগ নববর্ষ বরণ। বাঙালির জীবনে এতবড় অসাম্প্রদায়িক, বিভেদ-বৈষ্যমহীনভাবে মেলা আর মিলানোর সুযোগ দ্বিতীয়টি নেই। সেজন্যই বুঝি বাংলা আর বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী মানুষ যেমন নববর্ষ বরণের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে, বিপরীতে এই চেতনাকে খণ্ডিত করার জন্য, এই চেতনায় আঘাত আনার জন্য মৌলবাদী তৎপরতাও তেমনি সক্রিয় থাকে। এই দুইয়ের সংঘাত কম বেশি সাতচল্লিশের দেশভাগ পরবর্তী সময় হতেই চলে আসছে। বিরোধিতা যত বাড়ে, নববর্ষ বরণের উৎসবও ততই প্রাণ পায়। বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার সাধনার এ এক সন্ধিক্ষণ। করোনাকালীন দুর্যোগেও বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিরোধী অপশক্তি অনেক বেশি তৎপর। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালির হৃদয়ে তাই খুব বেশি তাগিদ থাকে নববর্ষ সাড়ম্বরে বরণের বা উদযাপনের। দুবছর ধরেই যা হচ্ছে তা নিতান্তই আনুষ্ঠানিক। দুকূল ভাসিয়ে নেওয়া প্রাণের জোয়ারের অনুপস্থিতি অনাকাক্সিক্ষত হলেও আজ সত্য।
নববর্ষের আনন্দ উচ্ছ্বাস আড়াল করে রয়েছে কোভিড-১৯-এর মুখব্যাদান। চারপাশে প্রিয়জনের মৃত্যুর মিছিল। চারপাশে চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় মানুষের আহাজারি। এখন সরাসরি শিয়রে করোনাক্রান্তি!
এই পরিস্থিতিতে এবারের নববর্ষের তাৎপর্য অন্যমাত্রা বহন করে। মৌলবাদী অপশক্তির নৃত্যনাচন, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানাবিধ দুর্বৃত্তায়ন, অবাধ দুর্নীতি আমাদের দীর্ঘদিনের অপসংস্কৃতির ধারক, বাহক হয়ে আছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে আমরা পরিচিত। আমাদের বাহ্যিক উন্নয়ন সত্যিই অনেকের ঈর্ষার কারণ। কিন্তু, লাগামহীন প্রাচুর্যের তেল একদিকে প্রদীপের গা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। অন্যদিকে প্রদীপের নিচের অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। কোভিড-১৯ আমাদের খুব কঠিনভাবে এই বৈপরীত্যের মুখোমুখি করেছে।
প্রতি নতুন বছরই তো আমাদের ফিরে দেখার দিন। পুরনো হিসেব-নিকেশ সুদেআসলে মিলিয়ে নতুনের হালখাতা খোলার দিন। এই লোকজ সংস্কৃতি আমাদের আদি ও অকৃত্রিম। আর সেই হিসাবের খাতায় আমাদের কী আছে আর কী নেই- মিলিয়ে নেওয়ার দিন। নববর্ষ বরণ সেই অর্থে আমাদের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পর্যালোচনার সূচক মুহূর্ত।
ভাবতেই হচ্ছে, বিদায়ী ১৪২৭ আমাদের কী দিয়ে গেল? বিশ্বের অনেক অনেক দেশে এই করোনাকালে জিডিপি
হার উদ্বেগজনকভাবে কমেছে। বাংলাদেশে বিস্ময়করভাবে অর্থনৈতিক চাকার অগ্রগতি সচল থেকেছে। প্রবাসী শ্রমিকের রেমিট্যান্স, দেশীয় শ্রমের প্রায় বাধাহীন যোগান, আর খেটে খাওয়া মানুষের লড়াই তিনের সংযোগে সরকারের সাফল্য সূচিত হয়েছে। পাশাপাশি আমরা দেখেছি এই সময়কালে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে অনেক বেশি। বেড়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের হার। নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ছেলে শিশু বলাৎকার, হত্যা, সন্ত্রাস, আত্মহত্যা, নারী ও শিশু পাচার, সাইবার ক্রাইম, কিশোর অপরাধ, মাদকের বহু বিস্তার- এমনতর বিভিন্ন ক্রমবর্ধমান ঘটনা আমাদের সামাজিক ও মানসিক জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমাদের শিশুরা শৈশব হারিয়ে, বয়সীরা জীবন সায়াহ্নের দিনগুলোয় নিজের অধিকার হারিয়ে, মধ্যবর্তীরা জীবন ও জীবিকার নিয়ত দ্বন্দ্বে জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়ে এক বিষাদগ্রস্ত অবসন্নতায় আচ্ছন্ন। এই চিত্র কী শুধু আমাদের দেশের? অবশ্যই নয়। পৃথিবীর দেশে দেশেই মানুষ এই ধরনের কিংবা অন্যান্য ধরনের সামাজিক মানসিক বিপর্যয়ে ক্লান্ত। জাতিসংঘের তথ্যসূত্র সেই সত্য প্রতিদিনই প্রকাশ করে যাচ্ছে। এর সাথে সবচেয়ে কঠিন সত্য, মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারের নিদারুণ লঙ্ঘন প্রায় সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাষ্ট্র তার নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিধি সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবা অভাবের নগ্নরূপ আমাদের সকল উন্নয়নকে পরিহাস করছে। অর্থবিত্তশালী ভুঁইফোড় শ্রেণি এক দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের সামান্যতম আঁচড়েও বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমিয়েছে। কোভিড-১৯ এই পলায়নপরতার পথ অনেকটাই সীমিত করেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক নারী পুরুষের শ্রমের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে অনেক বেশি। বিপরীতে নারীর গৃহশ্রম বেড়েছে কয়েকগুণ। অভিবাসী আর পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্ভোগ মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ জনিত এই অভূতপূর্ব দুর্যোগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভোগবাদী বিশ্বব্যবস্থার আধিপত্যবাদকেই সচেতন মানব সমাজ দায়ী করছে। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে মানুষের অভিযাত্রা যতই বিস্ময়কর হোক, যতই বিজ্ঞান আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছাক, বৃহত্তর মানব কল্যাণের সূচকে তা যে কতটা ব্যর্থ করোনার এই নতুন ভাইরাস তা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমরা প্রকৃতি ধ্বংস করছি তথাকথিত উন্নয়ন, মারণাস্ত্রের উল্লম্ফন আর রাসায়নিক পরীক্ষা নিরীক্ষায়। প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনের নিত্যনতুন রূপ পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে। মানুষের প্রতি মানুষের অসাম্যের অপরাধ এইভাবে মহাসংক্রামক বিপর্যয়ের আধার। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমরা দেখছি ক্ষমতার দাম্ভিকতা পূর্ণ অনেক বড় বড় দেশ অতিমারীর সামগ্রিক বিপর্যয় এড়াতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ কিউবার মতো অনেক ছোট ছোট দেশ অনেক বেশি শৃঙ্খলার সাথে নিজেরা বিপদ সামলে উঠছে। অন্যদেশের মানুষকে সহায়তা করছে। কেন পারছে? তারা সর্বপ্রথম মানব কল্যাণে নিজেদের স্লোগান ব্যবহার করছে,- বোম চাই না, চিকিৎসক চাই। অস্ত্র চাই না, চিকিৎসা চাই।
১৪২৮ বরণ করতে যেয়ে এসব কথা অনেক অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। অনেকের মনে হতে পারে এসব কথার সাথে আমাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যর সম্পর্ক কী? সম্পর্কটা যে কী সেটা যদি আমরা এখনো না বুঝি তাহলে সামনে মহাবিপর্যয় আমরা এড়াতে পারব না। বৈশ্বিক আর স্থানিক অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে, এই পৃথিবী নামক গ্রহে যতদিন মানুষ আছে, ভাইরাসের অগুণতি প্রাণকোষ ততদিনই লড়াইয়ে থাকবে। ততদিনই মানুষকে বলবে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিতে। ততদিনই- “কাল ও দেশের সীমা তছনছ হবে, সংক্রামী মারীবীজে আক্রান্ত হবে মানুষের পথ, চলাচল, রুদ্ধ হবে মানুষের পলায়ন, মড়কের বীজে ভারি হবে হাওয়া, তারপর সেই বিষাক্ত হাওয়ায় অবরুদ্ধ মানুষের সভ্যতায় সর্বত্র ঘটবে ভয়াবহ মারীর সংক্রমণ।” (শাহযাদ ফিরদাউস)। এই কথাগুলো সাহিত্যের কল্পকথা নয়। আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। যেমন প্রত্যক্ষ করছি মৌলবাদের মারী কীভাবে এক উদ্দীপ্ত জাতীয় চেতনার জনগোষ্ঠীকে ক্রমশ পিছে টানছে, অবরোধ করছে তার চেতনার দুয়ার, যেমন আমরা প্রত্যক্ষ করছি অপশাসন আর দুর্বৃত্তায়ন কীভাবে জাতির জাগ্রত সত্তাকে অবরুদ্ধ করছে। তেমনি আমরা প্রত্যক্ষ করছি প্রকৃতির প্রতি অন্যায় কীভাবে বিপর্যস্ত করছে আমাদের জীবন। অতিমারী অতিক্রমণের পথ পেরোতে আমাদের স্বাভাবিক জীবন সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ প্রায়।
অথচ মানুষের জীবনে চারপাশের এই অবরোধই শেষ কথা হতে পারে না। করোনাক্রান্তি কালে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, মানুষ আসলে কত অসহায়। মানুষ সত্যিই আজ কাঁদছে। মানুষের পাশে মানুষ হয়ে দাঁড়ানো ছাড়া পথ নেই। অবকাঠামোর উন্নয়ন আর বাহ্যিক চাকচিক্যময় জগতের আড়ম্বর থেকে, ভোগবাদী সমাজ থেকে দূরত্ব রচনা হোক নতুনতর উপলব্ধি। সেই উপলব্ধি নিয়েই নতুনের যাত্রা শুরু হোক।
“অন্ন চাই, প্রাণ চাই, চাই মুক্তবায়ু
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু”
প্রার্থনা নয়, আমাদের চাওয়া আর অধিকারবোধে জাগ্রত হোক ১৪২৮-এর বর্ষবরণের দাবি।