হাফিজ রশিদ খান
ফরাসি দেশের এক দার্শনিক, জাক লাকাঁ তাঁর নাম, বলেছিলেন : বড় শামিয়ানার নিচে অনেক-অনেক মানুষকে জড়ো করার চেয়ে প্রত্যেকের হাতে একটি করে ছোটো ছাতা ধরিয়ে দিতে হবে। তাহলে তারা নিজেদের মতো করে রোদবৃষ্টি তথা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে শিখবে। বেঁচেবত্তে থাকার কায়দা-কানুন রপ্ত করতে পারবে।
কথাটাকে আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ আর সময়োপযোগী মনে হওয়ায় ওটা দিয়েই লেখাটা শুরু করলাম। এ-বাক্যের অনুধাবনার ভেতর দিয়ে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পরিবেশ-পরিস্থিতির সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। সেই পরিবর্তনের উৎসমুখ একবিংশ শতাব্দী- যার পরিমণ্ডলে এখন আমাদের বসবাস।
মানুষের সভ্যতা বেশ কয়েকটি স্তর পেরিয়ে এসেছে, ইতিহাস বলে। প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক ইত্যাদি। যেহেতু প্রাচীন যুগ না পেরোলে মধ্যযুগ আর মধ্যযুগ না পেরোলে আধুনিক যুগে পা রাখা যায় না, তাই স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, আধুনিক যুগও কি ফুরিয়ে যায়নি আজও? অভ্যস্ততার অনুবৃত্তি হিশেবে আধুনিকতার ব্যবচ্ছেদ করে ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরার বক্তব্য বেশ প্রণিধানযোগ্য, বলেন তিনি :
‘যিনি অধিকাংশকে খুশি করতে চান, তাকে সবাই যা পছন্দ করে তা নিশ্চিত করতে হয়, তাকে পুরোনো ধারণার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে হয়। প্রচার মাধ্যমের কাজটি ঠিক অনুরূপ। প্রচার মাধ্যমের এই অধিকাংশকে খুশি করার প্রচেষ্টা আমাদের জীবনের শৈল্পিক ও নৈতিক বিধানে পরিণত হয়েছে। অতিসাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত আধুনিকতা বলতে গৃহীত ধারণাবলীর বিরোধিতা করাকে বোঝাতো। কিন্তু আজ আধুনিকতার ধারণা প্রচার মাধ্যমের কাজের সঙ্গে মিলিয়ে গিয়েছে। আধুনিকতা এখন মিলিয়ে চলা, মেনে নেয়া, পুরোপুরি মেনে নেয়াকে বোঝায়। আধুনিকতা এই অধিকাংশকে খুশি করার প্রয়াসের পোশাক পরেছে। গৃহীত ধারণাবলীর প্রতি নিরাসক্ত থাকা ও অধিকাংশকে খুশি করার প্রয়াস একই জিনিস। এ হচ্ছে তিন-মাথা বিশিষ্ট শত্রু, যার জন্ম ঈশ্বরের হাসির প্রতিধ্বনিরূপে।
জেরুজালেম বক্তৃতা: দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর নৈতিক বিপর্যয়, মানবিক সংকট, মূল্যবোধের অবক্ষয়, আণবিক বোমার বর্ষণ, অবদমন আর নেতিচেতনার বিচিত্রবিধ গলিঘুঁজি ও আলো-অন্ধকার পেরোনো আধুনিকতার দীর্ঘকালের রথে জং ধরেছে, সন্দেহ নেই। তাই জবাব হচ্ছে এই : হ্যাঁ, এখন আধুনিকোত্তর, উত্তর উপনিবেশিকতা, উত্তর আধুনিক বা পোস্টমডার্ন যুগই চলছে আমাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে। তার আলামতও চারপাশে সুস্পষ্ট। বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে শিল্পকলায় সাহিত্যে ধর্মচিন্তায় চলচ্চিত্রে ফ্যাশনে সঙ্গীতে নির্মাণে আর চলমান জীবনধারার একেবারে হালহকিকতে। চক্ষুষ্মান ও খাসচেতনার বাসিন্দারা ঠিকই তা মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করছেন। সেই অর্থে এখন জগতের সকল মানুষই, প্রকৃত বিবেচনায়, উত্তর ঔপনিবেশিক বা আধুনিকোত্তর সময়ের নিজস্ব ভূখণ্ডের নাগরিক বৈ নয়।
জাক লাকাঁ আসলে ওই উক্তির মধ্য দিয়ে বিংশ শতাব্দী ও তার পূর্বেকার সমস্ত তামাদি মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘ওয়ালাইকুম সালাম’
জানিয়েছেন। অর্থাৎ বিশ শতকীয় সময়চেতনা ও তার পক্ষে গৃহীত-কৃত প্রস্তাবনা ও করণকৌশলসমূহ আর প্রত্যাবর্তন করবে না। যত বিরাটত্ব, মহত্ত্ব, সৌন্দর্য আর সম্ভ্রান্ততা তার ভেতরে লুক্কায়িত থাকুক না কেন। প্রাচীন, মধ্য, আধুনিকের সেই আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত সাম্রাজ্য, তার বীরোচিত স্বৈরাচারী নৃপতিবৃন্দ- দারায়ূস, আলেকজান্ডার, অগাস্টিন, হর্ষবর্ধন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক, অজাতশত্রু, মোগল আকবর, এমনকি মহামতি লেলিন কি যোসেফ স্ট্যালিন, মাও সে তুং একালের আয়নায় আর প্রার্থিত মুখাবয়ব নন মোটেও। সেই ভূরাজনীতি, সেই ব্যাপক ভাবমূর্তির প্রতি নতজানু মানবমনের সেই পরিপ্রেক্ষিতও আর অবশিষ্ট নেই এখন। এ হলো সময়ের অভ্রান্ত, অনিবার্য তর্জনী সংকেত। শিল্পসাহিত্যেও একই বিধানের ছায়া পড়েছে। বহুমাত্রিক তাৎপর্যভরা জীবনগাথার রূপকার তলস্তয়, পিকাসো, দস্তয়েভস্কি, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, অমিয়ভূষণ মজুমদার, নজরুল, জয়নুল, এসএম সুলতানেরা পুরাকালের মহত্ত্বের ঘেরাটোপে আরও বহুদিনই স্বপ্ন জাগাবেন হয়তো, কিন্তু সেই বড়ত্বের অনুকরণ-অনুসরণ আর নয়, তা হবে না আর, হবার নয় বলেই।
স্পষ্টতই জাক লাকাঁ এখানে বিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষপাদের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়, সেই সূত্রে কম্যুনিস্ট মানবতাবাদের উচ্চাঙ্গিক মহিমার পতন ও তৎপরবর্তী সৃষ্টি নয়া বাস্তবতার সুতীক্ষè অবলোকন সামনে রেখে ওই অভিসন্দর্ভ প্রণয়ণ করেছেন। কেউ-কেউ হয়তো এর মধ্যে পশ্চিমা পুঁজিবাদী মনোভঙ্গির উল্লাসজনিত তরঙ্গের সন্ধান পেয়ে এর বিরোধী তত্ত্ব-তালাশে গলদঘর্ম হতে পারেন। বস্তুত তা ফসিলের জন্যে মায়াকান্না বলে দ্রুত প্রতিভাত হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ জাক লাকাঁ সময়ের ধমনিতে প্রকৃত টংকারই তুলেছেন, তাতে সংশয় নেই বিন্দুমাত্র। বরং এ চেতনা সামনে রেখে একালের ভাবনারাশি চালিত হচ্ছে এই ভেবে যে, তৃতীয়বিশ্বের স্বল্পোন্নত কি উন্নয়নশীল দেশজাতিগুলো এ শতকের পরিবর্তমান সময়প্রবাহকে কীভাবে নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার পক্ষে কাজে লাগাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপন, তাদের সাংস্কৃতিক ও মনোজাগতিক অভিপ্রায়সমূহ নিশ্চয়ই একই প্রবাহের ভেতর চলমান। অর্থাৎ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির হার মানানোর বেগবান গতির একালে আমরা কি রক্ষণশীলতার দুর্গে আশ্রয় নেবো, নাকি দেশজ জীবনধারার নানামাত্রিক বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য, রঙ ও রূপের সমন্বয়ে একটি সচল, অন্যরকম জাতীয় অবয়ব রচনায় ব্রতী হবো?
সাধারণভাবে আবহমানকালের বাংলা ও বাঙালির জীবনধারায় সমন্বয় ও আত্তীকরণের বিষয়টি গৌণ নয়, বরং মুখ্য। বেশ পরিচ্ছন্ন ও আয়ত আকারেই এ সমন্বয়ের অনুষঙ্গগুলো দৃশ্যমান। ওই সমন্বয় চেতনাটি কোনো ভাবাবেগ বা কল্পনাবিলাস থেকে উপজাত নয়। মানুষ অস্তিত্বের প্রগাঢ় দাবিতে বিপন্ন ও বিষণœ অবস্থায় অনেকটা কেজো বৃদ্ধির অনুরোধেই সমন্বয়ের পথে জীবনের সুতোটি ঝুলিয়ে রাখে। ব্যক্তি ও সমষ্টি চেতনায় একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষমাত্রই জাত রক্ষণশীল। এটা জীব ও প্রাণিজগতেরও সাধারণ বৈশিষ্ট্য। শুধু দুর্যোগ-দুর্বিপাকের অনুমানে বা তার মুখোমুখি হওয়ার শংকায় কি মানুষ কি জীব কি প্রাণী সকলেই স্বতন্ত্রতার নির্মোক খুলে ফেলে এক হয়েছে। বেঁচে থাকার নতুন চুক্তিনামা নির্মাণ করেছে। যেমন এদেশের ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস কি প্রাকৃতিক বড় ধরনের সংকট-সমস্যায় বিপন্ন মানুষ ও বিষাক্ত প্রাণীর সহবাস লক্ষ করা যায় একটি ভাসমান কাঠখণ্ডকে অবলম্বন করে। এ দুর্বিপাকের আগে তারা পরস্পর শত্রু হলেও সংকটের উপস্থিতিতে উভয়েই স্বভাবসম্মত স্বতন্ত্রতায় ছাড় দিয়ে সম্প্রীতির সহাবস্থান নির্মাণে বাধ্য হয়।
চলমান পরিবর্তনশীল বিশ্বের বিশ্বায়ন-অশ্বের ধাবমান অভিযাত্রায় বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসরত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীসহ সকল মানুষের বেলায় এ কথার সত্যতা অনুধাবনার সময় সমুপস্থিত বলে মনে হয়। বহুজাতিক পুঁজির সৌজন্য ও প্রকৌশলসম্মত নিখুঁত বিস্তার ও প্রয়োগে এদেশের সাধারণ মানুষ না পারছে এর বিরোধিতায় জোরালো অবস্থান নিতে, না পারছে এর স্মিত, উদার আহবানের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে। স্বীকার বা অস্বীকারের বিষয় নয় এটি, বরং বাস্তবতার কাচস্বচ্ছ অবলোকন থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছে, বাংলার আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলো ওই বহুজাতিক পুঁজি ও তার ছোটো-ছোটো প্যাকেজ প্রোগ্রামের পক্ষপুটে আশ্রয় নিচ্ছে বেশ হাস্যমুখেই। কারণ সেখানে তারা পাচ্ছে জীবনের ক্রমবর্ধমান চাহিদার আপাত অর্থনৈতিক সুরাহা- সেই সূত্রে জাগতিক নিরাপত্তা ও মনোজাগতিক কিছু প্রশান্তিও। বিষয়টি যত বিতর্কেরই জন্ম দিক না কেন, যেহেতু ওই জীবনচাহিদা ও টিকে থাকার প্রশ্নটাই বড়, অতএব, অন্যসব গৌণ হতে বাধ্য। এখানে আদর্শবাদ ও বড় পরিপ্রেক্ষিতের রাজনৈতিক কমিটমেন্টের দীর্ঘস্থায়ী প্রচার-প্রপাগাণ্ডা খুব একটা ফলপ্রসুরূপ পাবার আশা পরাহত। কেননা বিংশ শতাব্দীর অভিজ্ঞতা থেকে একবিংশে পদার্পণকারী বিশ্বমানবতা দেখেছে, ‘বড়’র পিরিতি’ সত্যিকার অর্থেই বালির বাঁধ বৈ নয়। সে দার্শনিক প্রত্যয়ে হোক, ভূরাজনৈতিক অর্থে হোক, জাতিগত কি সম্প্রদায়গত অর্থেই হোক। ক্ষুদ্র বলে, সংখ্যালঘু বলে জাতিরাষ্ট্র যদি কোনো না কোনো দিক থেকে অনবরত বৈষম্য কি অবহেলার তাস ছুড়ে দেয় তাদের দিকে, তা নীরবে-নিভৃতে হজম হবার সময় নয় এখন। নানা প্রযুক্তিগত অন্তর্জাল কিংবা ব্যক্তিচেতনার উন্মাদনায় তার বিপক্ষে ডালপালা বিস্তার এখন সহজ, অবশ্যম্ভাবী।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এ সময়ের রাষ্ট্রব্যবস্থা বহিঃপুঁজি, বহিঃসংস্কৃতি কিংবা ধ্যান-ধারণাকে অবরুদ্ধ করে রাখতে সমর্থ নয়। তথ্যের অবিরল আদান-প্রদানে যে বিপুল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ ও প্রচার সম্ভব হয়ে উঠছে একালে, তার অনিবার্য পরিণতিই নিয়ে এসেছে জনগোষ্ঠীতে-জনগোষ্ঠীতে, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিপুল সচেতনতাবোধ। আর এই সচেতনতাকে হত্যা করার কোনো লৌকিক-অলৌকিক তরিকা এ সময়, এ কালপ্রবাহ মেনে নিচ্ছে না। কাজেই খুব গভীর সংবেদন ও সহভাগিতার অনুভূতি নিয়ে দেশজসংস্কৃতির ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র পরিম-লগুলোতে নজর ফেলার দাবি আজ বাড়ছে দিন দিন, বাংলাদেশেও।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোর উৎসব, মেলা ও সার্বজনীন পালা-পার্বণগুলোর একটা ফলপ্রসূ মূল্যায়ন হওয়া দরকার। এর মধ্যে ‘বৈসাবি’ একটি উল্লেখযোগ্য আদিবাসী মিলনমেলা। ত্রিপুরা জাতির ‘বৈসু’ বা ‘বৈসুক’, মারমা জাতির ‘সাংগ্রাই’, চাকমা ও তন্চংগ্যা জাতির ‘বিজু’-‘বিষু’র আদ্যক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি’ ধারণাটি নির্মিত হলেও এ উৎসব কিন্তু প্রতীকী তাৎপর্যে সকলের সঙ্গে সংহতি ও সমন্বয়ের কথাই বলে। আরও যে-জাতিগোষ্ঠীগুলো আছে পাহাড়ে, যেমন : লুসাই পাংখো বম খুমি চাক ম্রো বা মুরং খিয়াং- এরাও নতুন বছরের সংক্রান্তিকে মিলনের, আনন্দের, দুঃখভোলার, পুরোনো বেদনা মুছে ফেলার, নতুন বন্ধুগ্রহণের আবেদন থেকেই বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকে। এ বাঁধভাঙা অংশগ্রহণের মহাস্রোতে ওই অঞ্চলের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমানেরাও শামিল হতে অন্তরের তাগিদ অনুভব করে পারিপার্শ্বিকতার উদারতার আবহে। এ যেন রবিঠাকুরের ‘সবার রঙে রং মিশাতে হবে’রই বাস্তব পরিপ্রেক্ষা।
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমানুষের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব, পণ্যসামগ্রী বেচাকেনার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবের এ ‘বৈসাবি’ বিভিন্ন প্রান্তিকতাকে একস্থানে দাঁড় করিয়ে দেয় একেবারে অকৃত্রিম নৈকট্যে। এতে সকলের মনোদেশে অজান্তে জাগে অসাম্প্রদায়িকতার অমল অনুভূতি, বহুস্তরিক সংস্কৃতির দিগন্ত হয় উন্মোচিত। বিগত বছরের শ্রমজ ঘাম, অশ্রুকণা, বিসর্জন ও অর্জনের আলোছায়ায় মায়াবী জীবনের নতুন আল্পনা আঁকে এ সহজিয়া সম্মিলন। বাসন্তী স্নিগ্ধতা আর গ্রীষ্মের দাবদাহের সন্ধিক্ষণে প্রকৃতি ও জীবনের দিকে মানুষের পক্ষপাতকে এ উৎসব এমন উন্মীলিত ও দর্শনীয়ভাবে তুলে ধরে যে, প্রতœজীবনের অন্বেষণে হৃদয় ও চেতনায় জাগে বহুদূর থেকে আগত জাতিস্মরতা ও সমমর্মিতার গান। তাই এই উৎসবের কোলাহলে পাওয়া যায় নিজেকে জানার ও অপরে নিজেকে হারিয়ে ফেলার বিরল মানবিক উৎকর্ষ।
এই মেলার জনস্রোতে স্থানিক জীবন, স্থানিক সংস্কৃতির যে-সমন্বয়ী অবয়ব ফুটে ওঠে, তার ভেতর আরও পাই জাক লাকাঁর ওই অজর, উদ্ভাসিত উক্তির প্রত্যক্ষ মর্মার্থও। ওই পাহাড় ও ঝিরির, ওই কুহেলি ঝোপ ও সবুজপাতার সান্দ্র আড়ালে ওখানকার ভূমিজ জীবনের যে প্রাণদীপ্ত ক্যানভাস ছড়িয়ে আছে, তা কখনও মলিন হবে না- যদি তাকে নিজের মতো করে বিকাশের পথ করে দেয়া যায়।
বড় শামিয়ানার নিচে তাদের জন্যে ঘেরাবেড়ার দমবন্ধ আয়োজনে ব্যস্ত না থেকে তাদের জন্যে যেন পারা যায় অরণ্য থেকে অরণ্যে, পাহাড় থেকে পাহাড়ে অবাধে গান গেয়ে বেড়ানোর রৌদ্রোজ্জ্বল ছায়াবীথি খুলে দিতে। সম্পন্ন সহাবস্থানের এ বাতাবরণ নির্মাণ ও তার যথাযথ পরিপোষণে একবিংশের কল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থা সফলকাম হবে, এ কোনো ইউটোপিয়া নয় আর।
মানুষের সৃষ্টিকুশল মস্তিষ্কের নিউরনসজ্জা তা বলেছে শতাব্দীতে-শতাব্দীতে, বিভিন্ন তাৎপর্যবহ উল্লম্ফনে, উল্লম্ফনে।
হাফিজ রশিদ খান
বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১
ফরাসি দেশের এক দার্শনিক, জাক লাকাঁ তাঁর নাম, বলেছিলেন : বড় শামিয়ানার নিচে অনেক-অনেক মানুষকে জড়ো করার চেয়ে প্রত্যেকের হাতে একটি করে ছোটো ছাতা ধরিয়ে দিতে হবে। তাহলে তারা নিজেদের মতো করে রোদবৃষ্টি তথা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে শিখবে। বেঁচেবত্তে থাকার কায়দা-কানুন রপ্ত করতে পারবে।
কথাটাকে আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ আর সময়োপযোগী মনে হওয়ায় ওটা দিয়েই লেখাটা শুরু করলাম। এ-বাক্যের অনুধাবনার ভেতর দিয়ে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পরিবেশ-পরিস্থিতির সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। সেই পরিবর্তনের উৎসমুখ একবিংশ শতাব্দী- যার পরিমণ্ডলে এখন আমাদের বসবাস।
মানুষের সভ্যতা বেশ কয়েকটি স্তর পেরিয়ে এসেছে, ইতিহাস বলে। প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক ইত্যাদি। যেহেতু প্রাচীন যুগ না পেরোলে মধ্যযুগ আর মধ্যযুগ না পেরোলে আধুনিক যুগে পা রাখা যায় না, তাই স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, আধুনিক যুগও কি ফুরিয়ে যায়নি আজও? অভ্যস্ততার অনুবৃত্তি হিশেবে আধুনিকতার ব্যবচ্ছেদ করে ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরার বক্তব্য বেশ প্রণিধানযোগ্য, বলেন তিনি :
‘যিনি অধিকাংশকে খুশি করতে চান, তাকে সবাই যা পছন্দ করে তা নিশ্চিত করতে হয়, তাকে পুরোনো ধারণার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে হয়। প্রচার মাধ্যমের কাজটি ঠিক অনুরূপ। প্রচার মাধ্যমের এই অধিকাংশকে খুশি করার প্রচেষ্টা আমাদের জীবনের শৈল্পিক ও নৈতিক বিধানে পরিণত হয়েছে। অতিসাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত আধুনিকতা বলতে গৃহীত ধারণাবলীর বিরোধিতা করাকে বোঝাতো। কিন্তু আজ আধুনিকতার ধারণা প্রচার মাধ্যমের কাজের সঙ্গে মিলিয়ে গিয়েছে। আধুনিকতা এখন মিলিয়ে চলা, মেনে নেয়া, পুরোপুরি মেনে নেয়াকে বোঝায়। আধুনিকতা এই অধিকাংশকে খুশি করার প্রয়াসের পোশাক পরেছে। গৃহীত ধারণাবলীর প্রতি নিরাসক্ত থাকা ও অধিকাংশকে খুশি করার প্রয়াস একই জিনিস। এ হচ্ছে তিন-মাথা বিশিষ্ট শত্রু, যার জন্ম ঈশ্বরের হাসির প্রতিধ্বনিরূপে।
জেরুজালেম বক্তৃতা: দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর নৈতিক বিপর্যয়, মানবিক সংকট, মূল্যবোধের অবক্ষয়, আণবিক বোমার বর্ষণ, অবদমন আর নেতিচেতনার বিচিত্রবিধ গলিঘুঁজি ও আলো-অন্ধকার পেরোনো আধুনিকতার দীর্ঘকালের রথে জং ধরেছে, সন্দেহ নেই। তাই জবাব হচ্ছে এই : হ্যাঁ, এখন আধুনিকোত্তর, উত্তর উপনিবেশিকতা, উত্তর আধুনিক বা পোস্টমডার্ন যুগই চলছে আমাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে। তার আলামতও চারপাশে সুস্পষ্ট। বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে শিল্পকলায় সাহিত্যে ধর্মচিন্তায় চলচ্চিত্রে ফ্যাশনে সঙ্গীতে নির্মাণে আর চলমান জীবনধারার একেবারে হালহকিকতে। চক্ষুষ্মান ও খাসচেতনার বাসিন্দারা ঠিকই তা মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করছেন। সেই অর্থে এখন জগতের সকল মানুষই, প্রকৃত বিবেচনায়, উত্তর ঔপনিবেশিক বা আধুনিকোত্তর সময়ের নিজস্ব ভূখণ্ডের নাগরিক বৈ নয়।
জাক লাকাঁ আসলে ওই উক্তির মধ্য দিয়ে বিংশ শতাব্দী ও তার পূর্বেকার সমস্ত তামাদি মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘ওয়ালাইকুম সালাম’
জানিয়েছেন। অর্থাৎ বিশ শতকীয় সময়চেতনা ও তার পক্ষে গৃহীত-কৃত প্রস্তাবনা ও করণকৌশলসমূহ আর প্রত্যাবর্তন করবে না। যত বিরাটত্ব, মহত্ত্ব, সৌন্দর্য আর সম্ভ্রান্ততা তার ভেতরে লুক্কায়িত থাকুক না কেন। প্রাচীন, মধ্য, আধুনিকের সেই আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত সাম্রাজ্য, তার বীরোচিত স্বৈরাচারী নৃপতিবৃন্দ- দারায়ূস, আলেকজান্ডার, অগাস্টিন, হর্ষবর্ধন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক, অজাতশত্রু, মোগল আকবর, এমনকি মহামতি লেলিন কি যোসেফ স্ট্যালিন, মাও সে তুং একালের আয়নায় আর প্রার্থিত মুখাবয়ব নন মোটেও। সেই ভূরাজনীতি, সেই ব্যাপক ভাবমূর্তির প্রতি নতজানু মানবমনের সেই পরিপ্রেক্ষিতও আর অবশিষ্ট নেই এখন। এ হলো সময়ের অভ্রান্ত, অনিবার্য তর্জনী সংকেত। শিল্পসাহিত্যেও একই বিধানের ছায়া পড়েছে। বহুমাত্রিক তাৎপর্যভরা জীবনগাথার রূপকার তলস্তয়, পিকাসো, দস্তয়েভস্কি, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, অমিয়ভূষণ মজুমদার, নজরুল, জয়নুল, এসএম সুলতানেরা পুরাকালের মহত্ত্বের ঘেরাটোপে আরও বহুদিনই স্বপ্ন জাগাবেন হয়তো, কিন্তু সেই বড়ত্বের অনুকরণ-অনুসরণ আর নয়, তা হবে না আর, হবার নয় বলেই।
স্পষ্টতই জাক লাকাঁ এখানে বিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষপাদের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়, সেই সূত্রে কম্যুনিস্ট মানবতাবাদের উচ্চাঙ্গিক মহিমার পতন ও তৎপরবর্তী সৃষ্টি নয়া বাস্তবতার সুতীক্ষè অবলোকন সামনে রেখে ওই অভিসন্দর্ভ প্রণয়ণ করেছেন। কেউ-কেউ হয়তো এর মধ্যে পশ্চিমা পুঁজিবাদী মনোভঙ্গির উল্লাসজনিত তরঙ্গের সন্ধান পেয়ে এর বিরোধী তত্ত্ব-তালাশে গলদঘর্ম হতে পারেন। বস্তুত তা ফসিলের জন্যে মায়াকান্না বলে দ্রুত প্রতিভাত হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ জাক লাকাঁ সময়ের ধমনিতে প্রকৃত টংকারই তুলেছেন, তাতে সংশয় নেই বিন্দুমাত্র। বরং এ চেতনা সামনে রেখে একালের ভাবনারাশি চালিত হচ্ছে এই ভেবে যে, তৃতীয়বিশ্বের স্বল্পোন্নত কি উন্নয়নশীল দেশজাতিগুলো এ শতকের পরিবর্তমান সময়প্রবাহকে কীভাবে নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার পক্ষে কাজে লাগাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপন, তাদের সাংস্কৃতিক ও মনোজাগতিক অভিপ্রায়সমূহ নিশ্চয়ই একই প্রবাহের ভেতর চলমান। অর্থাৎ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির হার মানানোর বেগবান গতির একালে আমরা কি রক্ষণশীলতার দুর্গে আশ্রয় নেবো, নাকি দেশজ জীবনধারার নানামাত্রিক বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য, রঙ ও রূপের সমন্বয়ে একটি সচল, অন্যরকম জাতীয় অবয়ব রচনায় ব্রতী হবো?
সাধারণভাবে আবহমানকালের বাংলা ও বাঙালির জীবনধারায় সমন্বয় ও আত্তীকরণের বিষয়টি গৌণ নয়, বরং মুখ্য। বেশ পরিচ্ছন্ন ও আয়ত আকারেই এ সমন্বয়ের অনুষঙ্গগুলো দৃশ্যমান। ওই সমন্বয় চেতনাটি কোনো ভাবাবেগ বা কল্পনাবিলাস থেকে উপজাত নয়। মানুষ অস্তিত্বের প্রগাঢ় দাবিতে বিপন্ন ও বিষণœ অবস্থায় অনেকটা কেজো বৃদ্ধির অনুরোধেই সমন্বয়ের পথে জীবনের সুতোটি ঝুলিয়ে রাখে। ব্যক্তি ও সমষ্টি চেতনায় একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষমাত্রই জাত রক্ষণশীল। এটা জীব ও প্রাণিজগতেরও সাধারণ বৈশিষ্ট্য। শুধু দুর্যোগ-দুর্বিপাকের অনুমানে বা তার মুখোমুখি হওয়ার শংকায় কি মানুষ কি জীব কি প্রাণী সকলেই স্বতন্ত্রতার নির্মোক খুলে ফেলে এক হয়েছে। বেঁচে থাকার নতুন চুক্তিনামা নির্মাণ করেছে। যেমন এদেশের ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস কি প্রাকৃতিক বড় ধরনের সংকট-সমস্যায় বিপন্ন মানুষ ও বিষাক্ত প্রাণীর সহবাস লক্ষ করা যায় একটি ভাসমান কাঠখণ্ডকে অবলম্বন করে। এ দুর্বিপাকের আগে তারা পরস্পর শত্রু হলেও সংকটের উপস্থিতিতে উভয়েই স্বভাবসম্মত স্বতন্ত্রতায় ছাড় দিয়ে সম্প্রীতির সহাবস্থান নির্মাণে বাধ্য হয়।
চলমান পরিবর্তনশীল বিশ্বের বিশ্বায়ন-অশ্বের ধাবমান অভিযাত্রায় বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসরত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীসহ সকল মানুষের বেলায় এ কথার সত্যতা অনুধাবনার সময় সমুপস্থিত বলে মনে হয়। বহুজাতিক পুঁজির সৌজন্য ও প্রকৌশলসম্মত নিখুঁত বিস্তার ও প্রয়োগে এদেশের সাধারণ মানুষ না পারছে এর বিরোধিতায় জোরালো অবস্থান নিতে, না পারছে এর স্মিত, উদার আহবানের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে। স্বীকার বা অস্বীকারের বিষয় নয় এটি, বরং বাস্তবতার কাচস্বচ্ছ অবলোকন থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছে, বাংলার আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলো ওই বহুজাতিক পুঁজি ও তার ছোটো-ছোটো প্যাকেজ প্রোগ্রামের পক্ষপুটে আশ্রয় নিচ্ছে বেশ হাস্যমুখেই। কারণ সেখানে তারা পাচ্ছে জীবনের ক্রমবর্ধমান চাহিদার আপাত অর্থনৈতিক সুরাহা- সেই সূত্রে জাগতিক নিরাপত্তা ও মনোজাগতিক কিছু প্রশান্তিও। বিষয়টি যত বিতর্কেরই জন্ম দিক না কেন, যেহেতু ওই জীবনচাহিদা ও টিকে থাকার প্রশ্নটাই বড়, অতএব, অন্যসব গৌণ হতে বাধ্য। এখানে আদর্শবাদ ও বড় পরিপ্রেক্ষিতের রাজনৈতিক কমিটমেন্টের দীর্ঘস্থায়ী প্রচার-প্রপাগাণ্ডা খুব একটা ফলপ্রসুরূপ পাবার আশা পরাহত। কেননা বিংশ শতাব্দীর অভিজ্ঞতা থেকে একবিংশে পদার্পণকারী বিশ্বমানবতা দেখেছে, ‘বড়’র পিরিতি’ সত্যিকার অর্থেই বালির বাঁধ বৈ নয়। সে দার্শনিক প্রত্যয়ে হোক, ভূরাজনৈতিক অর্থে হোক, জাতিগত কি সম্প্রদায়গত অর্থেই হোক। ক্ষুদ্র বলে, সংখ্যালঘু বলে জাতিরাষ্ট্র যদি কোনো না কোনো দিক থেকে অনবরত বৈষম্য কি অবহেলার তাস ছুড়ে দেয় তাদের দিকে, তা নীরবে-নিভৃতে হজম হবার সময় নয় এখন। নানা প্রযুক্তিগত অন্তর্জাল কিংবা ব্যক্তিচেতনার উন্মাদনায় তার বিপক্ষে ডালপালা বিস্তার এখন সহজ, অবশ্যম্ভাবী।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এ সময়ের রাষ্ট্রব্যবস্থা বহিঃপুঁজি, বহিঃসংস্কৃতি কিংবা ধ্যান-ধারণাকে অবরুদ্ধ করে রাখতে সমর্থ নয়। তথ্যের অবিরল আদান-প্রদানে যে বিপুল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ ও প্রচার সম্ভব হয়ে উঠছে একালে, তার অনিবার্য পরিণতিই নিয়ে এসেছে জনগোষ্ঠীতে-জনগোষ্ঠীতে, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিপুল সচেতনতাবোধ। আর এই সচেতনতাকে হত্যা করার কোনো লৌকিক-অলৌকিক তরিকা এ সময়, এ কালপ্রবাহ মেনে নিচ্ছে না। কাজেই খুব গভীর সংবেদন ও সহভাগিতার অনুভূতি নিয়ে দেশজসংস্কৃতির ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র পরিম-লগুলোতে নজর ফেলার দাবি আজ বাড়ছে দিন দিন, বাংলাদেশেও।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোর উৎসব, মেলা ও সার্বজনীন পালা-পার্বণগুলোর একটা ফলপ্রসূ মূল্যায়ন হওয়া দরকার। এর মধ্যে ‘বৈসাবি’ একটি উল্লেখযোগ্য আদিবাসী মিলনমেলা। ত্রিপুরা জাতির ‘বৈসু’ বা ‘বৈসুক’, মারমা জাতির ‘সাংগ্রাই’, চাকমা ও তন্চংগ্যা জাতির ‘বিজু’-‘বিষু’র আদ্যক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি’ ধারণাটি নির্মিত হলেও এ উৎসব কিন্তু প্রতীকী তাৎপর্যে সকলের সঙ্গে সংহতি ও সমন্বয়ের কথাই বলে। আরও যে-জাতিগোষ্ঠীগুলো আছে পাহাড়ে, যেমন : লুসাই পাংখো বম খুমি চাক ম্রো বা মুরং খিয়াং- এরাও নতুন বছরের সংক্রান্তিকে মিলনের, আনন্দের, দুঃখভোলার, পুরোনো বেদনা মুছে ফেলার, নতুন বন্ধুগ্রহণের আবেদন থেকেই বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকে। এ বাঁধভাঙা অংশগ্রহণের মহাস্রোতে ওই অঞ্চলের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমানেরাও শামিল হতে অন্তরের তাগিদ অনুভব করে পারিপার্শ্বিকতার উদারতার আবহে। এ যেন রবিঠাকুরের ‘সবার রঙে রং মিশাতে হবে’রই বাস্তব পরিপ্রেক্ষা।
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমানুষের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব, পণ্যসামগ্রী বেচাকেনার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবের এ ‘বৈসাবি’ বিভিন্ন প্রান্তিকতাকে একস্থানে দাঁড় করিয়ে দেয় একেবারে অকৃত্রিম নৈকট্যে। এতে সকলের মনোদেশে অজান্তে জাগে অসাম্প্রদায়িকতার অমল অনুভূতি, বহুস্তরিক সংস্কৃতির দিগন্ত হয় উন্মোচিত। বিগত বছরের শ্রমজ ঘাম, অশ্রুকণা, বিসর্জন ও অর্জনের আলোছায়ায় মায়াবী জীবনের নতুন আল্পনা আঁকে এ সহজিয়া সম্মিলন। বাসন্তী স্নিগ্ধতা আর গ্রীষ্মের দাবদাহের সন্ধিক্ষণে প্রকৃতি ও জীবনের দিকে মানুষের পক্ষপাতকে এ উৎসব এমন উন্মীলিত ও দর্শনীয়ভাবে তুলে ধরে যে, প্রতœজীবনের অন্বেষণে হৃদয় ও চেতনায় জাগে বহুদূর থেকে আগত জাতিস্মরতা ও সমমর্মিতার গান। তাই এই উৎসবের কোলাহলে পাওয়া যায় নিজেকে জানার ও অপরে নিজেকে হারিয়ে ফেলার বিরল মানবিক উৎকর্ষ।
এই মেলার জনস্রোতে স্থানিক জীবন, স্থানিক সংস্কৃতির যে-সমন্বয়ী অবয়ব ফুটে ওঠে, তার ভেতর আরও পাই জাক লাকাঁর ওই অজর, উদ্ভাসিত উক্তির প্রত্যক্ষ মর্মার্থও। ওই পাহাড় ও ঝিরির, ওই কুহেলি ঝোপ ও সবুজপাতার সান্দ্র আড়ালে ওখানকার ভূমিজ জীবনের যে প্রাণদীপ্ত ক্যানভাস ছড়িয়ে আছে, তা কখনও মলিন হবে না- যদি তাকে নিজের মতো করে বিকাশের পথ করে দেয়া যায়।
বড় শামিয়ানার নিচে তাদের জন্যে ঘেরাবেড়ার দমবন্ধ আয়োজনে ব্যস্ত না থেকে তাদের জন্যে যেন পারা যায় অরণ্য থেকে অরণ্যে, পাহাড় থেকে পাহাড়ে অবাধে গান গেয়ে বেড়ানোর রৌদ্রোজ্জ্বল ছায়াবীথি খুলে দিতে। সম্পন্ন সহাবস্থানের এ বাতাবরণ নির্মাণ ও তার যথাযথ পরিপোষণে একবিংশের কল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থা সফলকাম হবে, এ কোনো ইউটোপিয়া নয় আর।
মানুষের সৃষ্টিকুশল মস্তিষ্কের নিউরনসজ্জা তা বলেছে শতাব্দীতে-শতাব্দীতে, বিভিন্ন তাৎপর্যবহ উল্লম্ফনে, উল্লম্ফনে।