ফেরদৌস ওনু
রূপগঞ্জের জিন্দাপার্কে বটবৃক্ষতলে চলছে শালুক-এর আড্ডা।
লিটল ম্যাগাজিন চর্চা ও আন্দোলন, যুগে যুগে, কালে কালে সাহিত্য-শিল্পকে বেগবান করেছে। নতুন নতুন সৃষ্টির নেশায় কবি-লেখকদের ভেতর নতুনতর উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে। লিটল ম্যাগাজিন সবসময় বিকল্প চিন্তা ও নতুন সৃষ্টিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাক্লে-যা সর্বদা প্রচলিত বা গড্ডলে ভেসে যাওয়াকে অস্বীকার করে। গড্ডলে ভেসে গেলে বা জনপ্রিয়তার পিছনে ছুটলে কখনো নতুন কিছু সৃষ্টি করা যায় না। আবার সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় সাহিত্যকে পণ্য বিবেচনা করলেও সাহিত্যের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জিত হয় না। এসব কিছু বিবেচনা করেই সৃষ্টি হয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের বিকল্প ধারা। এই ধারা সর্বদাই প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রতিক্রিয়াশীলতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার এই বিপরীত কণ্ঠস্বর বা ভিন্ন চিন্তা। এমন চিন্তাচেতনা ও পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে সাহিত্যচর্চার মানসে আজ থেকে ২৩ বছর আগে সমকালীন কবিতার ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর, নব্বইয়ের দশকের অন্যতম প্রধান কবি ওবায়েদ আকাশের সম্পাদনায় শুরু হয়েছিল লিটল ম্যাগাজিন “শালুক”-এর। এখনো পর্যন্ত শালুক বাংলা ও বাঙালিত্বের অন্বেষায়, শেকড়ের সন্ধানে ও নতুন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় অধুনাবাদী চিন্তার তারুণ্যের মুখপত্র।
আড্ডার একাংশ
সম্প্রতি শালুকের সৃজনশীলতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রতিমাসে অন্তত একবার করে একটি সাহিত্যসন্ধ্যার আয়োজন; যা গত দুই বছর মহামারির কারণে স্থগিত থাকলেও আবার শুরু করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। দু’বছর আগে ‘শালুক’ প্রায় বারোটির মতো সাহিত্যসন্ধ্যা পরিচালনা করেছে। এবং ২০১৯ সালের নভেম্বরে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে শালুকের ২০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। যেখানে দেশ-বিদেশের হাজারো কবি-লেখক শুভাকাক্সক্ষীর সম্মিলন ঘটে। সেবারই প্রথম শালুক তার কয়েকজন লেখককে পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করে।
করোনার প্রকোপ কমে এলে গত ১ এপ্রিল “শালুক সাহিত্যআড্ডা”র ব্যানারে “প্রকৃতিমুগ্ধতা, প্রথাহীনতায় অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন শালুক-এর সাহিত্যআড্ডা” শিরোনাম ধারণ করে ঢাকা থেকে একঝাঁক কবি-লেখক রূপগঞ্জস্থ জিন্দাপার্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এক স্বতঃস্ফূর্ত ও জাঁকালো পরিবেশে সবুজ-হরিদ্র আবহে অনুষ্ঠিত হয় দিনব্যাপী সাহিত্যআড্ডা। বৃক্ষশোভিত, ঝিঁঝি ডাকা, কোকিল ডাকা নিমগ্নতায় একটি বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় শালুকের এই জমজমাট সাহিত্যআড্ডা। মুহুর্মুহু কবিতাপাঠ, আলোচনা, নতুন বইয়ের প্রথম পাঠ, আড্ডা, চাচক্র ছিল আড্ডার প্রাণ। আর এই প্রাণময়তাকে আরো বেশি মুখরতায় ভরিয়ে দেয় রৌদ্র-ছায়ার খেলা, বসন্ত সমিরণ আর গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলি, তাদের নানা সুর ও স্বরের ব্যাঞ্জনা।
আড্ডার একাংশ
সময়ের আলোচিত ও বিশিষ্ট কবি, নব্বইয়ের দশকের অন্যতম প্রধান ও ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর শালুক সম্পাদক ওবায়েদ আকাশ, প্রারম্ভ কথামালা দিয়ে উদ্বোধন করেন এই মহতী আড্ডার। তিনি শালুক-এর এই আড্ডা আয়োজনের যথার্থতা ব্যাখ্যা করে বলেন, শালুকের এই আয়োজন তার অতীতের আড্ডার ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং নতুন উদ্যমে নতুন করে শালুকের লেখক-পাঠক-শুভাকাক্সক্ষীদের জাগিয়ে তোলা। বলেন, এখন থেকে আবার শুরু হলো শালুকের ধারাবাহিক কার্যক্রম। প্রতিমাসে অন্তত একটি করে সাহিত্য আড্ডা করার ইচ্ছা আছে। তা ঢাকার বাইরে এবং ভিতরে সর্বত্র হতে পারে। তিনি আরো বলেন, নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য এমন আড্ডার বিকল্প বিরল। এই আড্ডা অনুষ্ঠানের জন্য তিনি ‘শালুক’-এর সহযোগী সম্পাদক, কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক মাহফুজ আল-হোসেন-এর বিশেষ ভূমিকার কথা স্বীকার করে তাঁকে বক্তৃতা দেবার জন্য মঞ্চে ডাকেন। কবি মাহফুজ আল-হোসেন তাঁর বক্তৃতার প্রথমেই জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা থেকে একমাত্র লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’কে পুরস্কৃত করার বিষয়টি উত্থাপন করে ‘শালুক’-সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানান। বলেন, এ অর্জন শালুকের বহুদিন আগেই প্রাপ্য ছিল।শালুক একটি অধুনাবদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন, এই যে প্রকৃতিমুগ্ধ একটি পরিবেশে আড্ডা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এটি অধুনাবাদচর্চা বা শেকড়ের অন্বেষার একটি অংশ। তিনি বলেন, অধুনাবাদ নতুন নতুন মেধার অন্বেষণে কাজ করে থাকে। উদ্ধৃতিস্বর্বস্বতা এবং গতানুগতিকতাকে পরিহার করে বাঙালিত্ব ও বাঙালিয়ানাকে বিশ^ পরিসরে তুলে ধরতে চায়। শালুকের আজকের আড্ডা তারই ধারাবাহিকতা, এবং শালুকের ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত সাহিত্যআড্ডার পুনর্জাগরণ।
আড্ডার একাংশ
এরপর শুরু হয় ‘নতুন বইয়ের প্রথম পাঠ’ পর্ব। এপর্বে ২০২২ সালে অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত কয়েকটি নতুন বইয়ের প্রথম পাঠ করা হয়। বইয়ের প্রথম পাঠ শুরু করেন শালুক-সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ ও সহযোগী সম্পাদক কবি মাহফুজ আল-হোসেন। প্রথমে প্রাবন্ধিক ও কবি জামিরুল শরীফের প্রবন্ধগ্রন্থ“প্রবন্ধগুচ্ছ”র প্রথম পাঠ দিয়ে শুরু করে পর্যায়ক্রমে কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগীর উপন্যাস “পুষ্পকথা”, কবি জাফর সাদেকের কাব্যগ্রন্থ “একা এক দারুগাছ”, কবি কাজল কাননের কাব্যগ্রন্থ “করি দেহে গাছ চাষ”, কবি কবীর হোসেনের কাব্যগ্রন্থ “মঙ্গলগ্রহের আড্ডা”, কবি ও কথাসাহিত্যিক শেলী সেনগুপ্তার উপন্যাস “ভুল ট্রেনের যাত্রী”, কবি আদিত্য নজরুলের কাব্যগ্রন্থ “তোমাকে ভালোবাসলেও মরে যাই”, কবি ও অনুবাদক মাহফুজ আল-হোসেনের কবিতার বই “নিজের হাতে খুন করেছি গতকাল” এবং সবশেষে কবি ওবায়েদ আকাশের কবিতার বই “কাগুজে দিন, কাগুজে রাত”-এর প্রথম পাঠ করা হয়। ‘প্রথম পাঠ’ পর্বের বিশেষত্ব ছিল কবি বা লেখক সম্পর্কে বলবেন একজন সঞ্চালক। এবং বইটি সম্পর্কে বলবেন লেখক নিজেই। এই ধারাবাহিকতায় ব্যতিক্রমী ইমেজে জমে ওঠে নতুন বইয়ের প্রথম পাঠ পর্বটি।
পরক্ষণেই শুরু হয় কবির স্বরচিত কবিতা পাঠ। যাঁদের বইয়ের প্রথম পাঠ করা হয় তাঁরা প্রত্যেকে তাঁদের কবিতা পাঠ করেন। এছাড়া কবিতা পাঠ করেন-সত্তরের দশকের শক্তিমান কবি আবদুর রাজ্জাক, কবি পারভেজ আহসান, কবি শারেফ আহমেদ, কবি মনিরুল মোমেন, কবি রিসতিয়াক আহমেদ প্রমুখ।
ফাঁকে ফাঁকে চলে সাহিত্যকেন্দ্রিক আলোচনা-প্রতিআলোচনা। এপর্বে বিশ^সাহিত্য ও আমাদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক স্বপন নাথ এবং কবি পারভেজ আহসান।
দেখতে দেখতে বেলা আড়াইটার ঘণ্টায় সকলের পেটের ক্ষুধা চাগিয়ে ওঠে। কিন্তু পাখি আর ঝিঁঝি পোকাদের যেন খাবারের দরকার পড়ে না। তারা আপন স্বরে ডেকেই চলেছে অবিরাম। এমন মাতাল মাতাল পরিবেশে আমাদের ডেকে নেয়া হলো এক অকৃত্রিম বাঙালি রেস্তরাঁয়। সম্পূর্ণ কাঠের চেয়ার-টেবিলে সম্পূর্ণ বাঙালি পদে আমাদের খানাপিনা চলে। সবার চোখমুখ যেন আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর উদ্যানের নিরবচ্ছিন্ন প্রকৃতিমুগ্ধতায় সবাই আরো বেশি কবি হয়ে ওঠে। আবার সেই বটবৃক্ষতলে আড্ডাস্থলে এসেই শুরু হয় আলোচনা ও কবিতাপাঠ। আলোচনা করেন স্বপন নাথ, পারভেজ আহসান, মোজাম্মেল হক নিয়োগী, ফেরদৌস ওনু, শারেফ আহমেদ, মাহফুজ আল-হোসেন। আলোচনায় সমসাময়িক সাহিত্যের গতিপথ ও চিরায়ত সাহিত্যের রূপ প্রকৃতি তুলে ধরা হয়। আড্ডায় একটি বিষয় কবি ওবায়েদ আকাশ ও কবি মাহফুজ আল-হোসেন স্পষ্ট করেন যে, শালুকের আড্ডা গড়পড়তা বা জনপ্রিয় লেখকদের এড়িয়ে চলে। শালুকের আড্ডায় তাঁদেরই উপিস্থিতি থাকে, যাঁরা প্রকৃতই মেধাবী, হয়তো সস্তা জনপ্রিয়তা তাঁদের নেই। তাঁরা গড্ডলে গা ভাসাতে পছন্দ করেন না। যে কারণে শালুকের আড্ডা প্রাণবন্ত করে তোলেন তাঁরাই, যাঁদের মুখ দেখে সহজে চেনা যায় না, তাঁদের মেধা দিয়ে চিনতে হয়। পণ্যসাহিত্য ও জনপ্রিয়তার নেশা যাঁদেরকে স্পর্শ করে না, তাঁরাই শালুকের লেখক এবং আড্ডার অংশীদার।
সবশেষে এ আড্ডা অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। সন্ধ্যার কাছাকাছি, মনোহর ও মায়াবী প্রকৃতির টান পেছনে ফেলে শালুক-এর লেখক শুভাকাক্সক্ষীদের গাড়িগুলো ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে। পেছন থেকে ডাকে প্রকৃতিজড়ানো মায়া...
ফেরদৌস ওনু
মঙ্গলবার, ০৫ এপ্রিল ২০২২
রূপগঞ্জের জিন্দাপার্কে বটবৃক্ষতলে চলছে শালুক-এর আড্ডা।
লিটল ম্যাগাজিন চর্চা ও আন্দোলন, যুগে যুগে, কালে কালে সাহিত্য-শিল্পকে বেগবান করেছে। নতুন নতুন সৃষ্টির নেশায় কবি-লেখকদের ভেতর নতুনতর উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে। লিটল ম্যাগাজিন সবসময় বিকল্প চিন্তা ও নতুন সৃষ্টিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাক্লে-যা সর্বদা প্রচলিত বা গড্ডলে ভেসে যাওয়াকে অস্বীকার করে। গড্ডলে ভেসে গেলে বা জনপ্রিয়তার পিছনে ছুটলে কখনো নতুন কিছু সৃষ্টি করা যায় না। আবার সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় সাহিত্যকে পণ্য বিবেচনা করলেও সাহিত্যের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জিত হয় না। এসব কিছু বিবেচনা করেই সৃষ্টি হয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের বিকল্প ধারা। এই ধারা সর্বদাই প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রতিক্রিয়াশীলতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার এই বিপরীত কণ্ঠস্বর বা ভিন্ন চিন্তা। এমন চিন্তাচেতনা ও পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে সাহিত্যচর্চার মানসে আজ থেকে ২৩ বছর আগে সমকালীন কবিতার ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর, নব্বইয়ের দশকের অন্যতম প্রধান কবি ওবায়েদ আকাশের সম্পাদনায় শুরু হয়েছিল লিটল ম্যাগাজিন “শালুক”-এর। এখনো পর্যন্ত শালুক বাংলা ও বাঙালিত্বের অন্বেষায়, শেকড়ের সন্ধানে ও নতুন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় অধুনাবাদী চিন্তার তারুণ্যের মুখপত্র।
আড্ডার একাংশ
সম্প্রতি শালুকের সৃজনশীলতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রতিমাসে অন্তত একবার করে একটি সাহিত্যসন্ধ্যার আয়োজন; যা গত দুই বছর মহামারির কারণে স্থগিত থাকলেও আবার শুরু করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। দু’বছর আগে ‘শালুক’ প্রায় বারোটির মতো সাহিত্যসন্ধ্যা পরিচালনা করেছে। এবং ২০১৯ সালের নভেম্বরে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে শালুকের ২০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। যেখানে দেশ-বিদেশের হাজারো কবি-লেখক শুভাকাক্সক্ষীর সম্মিলন ঘটে। সেবারই প্রথম শালুক তার কয়েকজন লেখককে পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করে।
করোনার প্রকোপ কমে এলে গত ১ এপ্রিল “শালুক সাহিত্যআড্ডা”র ব্যানারে “প্রকৃতিমুগ্ধতা, প্রথাহীনতায় অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন শালুক-এর সাহিত্যআড্ডা” শিরোনাম ধারণ করে ঢাকা থেকে একঝাঁক কবি-লেখক রূপগঞ্জস্থ জিন্দাপার্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এক স্বতঃস্ফূর্ত ও জাঁকালো পরিবেশে সবুজ-হরিদ্র আবহে অনুষ্ঠিত হয় দিনব্যাপী সাহিত্যআড্ডা। বৃক্ষশোভিত, ঝিঁঝি ডাকা, কোকিল ডাকা নিমগ্নতায় একটি বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় শালুকের এই জমজমাট সাহিত্যআড্ডা। মুহুর্মুহু কবিতাপাঠ, আলোচনা, নতুন বইয়ের প্রথম পাঠ, আড্ডা, চাচক্র ছিল আড্ডার প্রাণ। আর এই প্রাণময়তাকে আরো বেশি মুখরতায় ভরিয়ে দেয় রৌদ্র-ছায়ার খেলা, বসন্ত সমিরণ আর গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলি, তাদের নানা সুর ও স্বরের ব্যাঞ্জনা।
আড্ডার একাংশ
সময়ের আলোচিত ও বিশিষ্ট কবি, নব্বইয়ের দশকের অন্যতম প্রধান ও ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর শালুক সম্পাদক ওবায়েদ আকাশ, প্রারম্ভ কথামালা দিয়ে উদ্বোধন করেন এই মহতী আড্ডার। তিনি শালুক-এর এই আড্ডা আয়োজনের যথার্থতা ব্যাখ্যা করে বলেন, শালুকের এই আয়োজন তার অতীতের আড্ডার ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং নতুন উদ্যমে নতুন করে শালুকের লেখক-পাঠক-শুভাকাক্সক্ষীদের জাগিয়ে তোলা। বলেন, এখন থেকে আবার শুরু হলো শালুকের ধারাবাহিক কার্যক্রম। প্রতিমাসে অন্তত একটি করে সাহিত্য আড্ডা করার ইচ্ছা আছে। তা ঢাকার বাইরে এবং ভিতরে সর্বত্র হতে পারে। তিনি আরো বলেন, নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য এমন আড্ডার বিকল্প বিরল। এই আড্ডা অনুষ্ঠানের জন্য তিনি ‘শালুক’-এর সহযোগী সম্পাদক, কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক মাহফুজ আল-হোসেন-এর বিশেষ ভূমিকার কথা স্বীকার করে তাঁকে বক্তৃতা দেবার জন্য মঞ্চে ডাকেন। কবি মাহফুজ আল-হোসেন তাঁর বক্তৃতার প্রথমেই জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা থেকে একমাত্র লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’কে পুরস্কৃত করার বিষয়টি উত্থাপন করে ‘শালুক’-সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানান। বলেন, এ অর্জন শালুকের বহুদিন আগেই প্রাপ্য ছিল।শালুক একটি অধুনাবদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন, এই যে প্রকৃতিমুগ্ধ একটি পরিবেশে আড্ডা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এটি অধুনাবাদচর্চা বা শেকড়ের অন্বেষার একটি অংশ। তিনি বলেন, অধুনাবাদ নতুন নতুন মেধার অন্বেষণে কাজ করে থাকে। উদ্ধৃতিস্বর্বস্বতা এবং গতানুগতিকতাকে পরিহার করে বাঙালিত্ব ও বাঙালিয়ানাকে বিশ^ পরিসরে তুলে ধরতে চায়। শালুকের আজকের আড্ডা তারই ধারাবাহিকতা, এবং শালুকের ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত সাহিত্যআড্ডার পুনর্জাগরণ।
আড্ডার একাংশ
এরপর শুরু হয় ‘নতুন বইয়ের প্রথম পাঠ’ পর্ব। এপর্বে ২০২২ সালে অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত কয়েকটি নতুন বইয়ের প্রথম পাঠ করা হয়। বইয়ের প্রথম পাঠ শুরু করেন শালুক-সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ ও সহযোগী সম্পাদক কবি মাহফুজ আল-হোসেন। প্রথমে প্রাবন্ধিক ও কবি জামিরুল শরীফের প্রবন্ধগ্রন্থ“প্রবন্ধগুচ্ছ”র প্রথম পাঠ দিয়ে শুরু করে পর্যায়ক্রমে কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগীর উপন্যাস “পুষ্পকথা”, কবি জাফর সাদেকের কাব্যগ্রন্থ “একা এক দারুগাছ”, কবি কাজল কাননের কাব্যগ্রন্থ “করি দেহে গাছ চাষ”, কবি কবীর হোসেনের কাব্যগ্রন্থ “মঙ্গলগ্রহের আড্ডা”, কবি ও কথাসাহিত্যিক শেলী সেনগুপ্তার উপন্যাস “ভুল ট্রেনের যাত্রী”, কবি আদিত্য নজরুলের কাব্যগ্রন্থ “তোমাকে ভালোবাসলেও মরে যাই”, কবি ও অনুবাদক মাহফুজ আল-হোসেনের কবিতার বই “নিজের হাতে খুন করেছি গতকাল” এবং সবশেষে কবি ওবায়েদ আকাশের কবিতার বই “কাগুজে দিন, কাগুজে রাত”-এর প্রথম পাঠ করা হয়। ‘প্রথম পাঠ’ পর্বের বিশেষত্ব ছিল কবি বা লেখক সম্পর্কে বলবেন একজন সঞ্চালক। এবং বইটি সম্পর্কে বলবেন লেখক নিজেই। এই ধারাবাহিকতায় ব্যতিক্রমী ইমেজে জমে ওঠে নতুন বইয়ের প্রথম পাঠ পর্বটি।
পরক্ষণেই শুরু হয় কবির স্বরচিত কবিতা পাঠ। যাঁদের বইয়ের প্রথম পাঠ করা হয় তাঁরা প্রত্যেকে তাঁদের কবিতা পাঠ করেন। এছাড়া কবিতা পাঠ করেন-সত্তরের দশকের শক্তিমান কবি আবদুর রাজ্জাক, কবি পারভেজ আহসান, কবি শারেফ আহমেদ, কবি মনিরুল মোমেন, কবি রিসতিয়াক আহমেদ প্রমুখ।
ফাঁকে ফাঁকে চলে সাহিত্যকেন্দ্রিক আলোচনা-প্রতিআলোচনা। এপর্বে বিশ^সাহিত্য ও আমাদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক স্বপন নাথ এবং কবি পারভেজ আহসান।
দেখতে দেখতে বেলা আড়াইটার ঘণ্টায় সকলের পেটের ক্ষুধা চাগিয়ে ওঠে। কিন্তু পাখি আর ঝিঁঝি পোকাদের যেন খাবারের দরকার পড়ে না। তারা আপন স্বরে ডেকেই চলেছে অবিরাম। এমন মাতাল মাতাল পরিবেশে আমাদের ডেকে নেয়া হলো এক অকৃত্রিম বাঙালি রেস্তরাঁয়। সম্পূর্ণ কাঠের চেয়ার-টেবিলে সম্পূর্ণ বাঙালি পদে আমাদের খানাপিনা চলে। সবার চোখমুখ যেন আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর উদ্যানের নিরবচ্ছিন্ন প্রকৃতিমুগ্ধতায় সবাই আরো বেশি কবি হয়ে ওঠে। আবার সেই বটবৃক্ষতলে আড্ডাস্থলে এসেই শুরু হয় আলোচনা ও কবিতাপাঠ। আলোচনা করেন স্বপন নাথ, পারভেজ আহসান, মোজাম্মেল হক নিয়োগী, ফেরদৌস ওনু, শারেফ আহমেদ, মাহফুজ আল-হোসেন। আলোচনায় সমসাময়িক সাহিত্যের গতিপথ ও চিরায়ত সাহিত্যের রূপ প্রকৃতি তুলে ধরা হয়। আড্ডায় একটি বিষয় কবি ওবায়েদ আকাশ ও কবি মাহফুজ আল-হোসেন স্পষ্ট করেন যে, শালুকের আড্ডা গড়পড়তা বা জনপ্রিয় লেখকদের এড়িয়ে চলে। শালুকের আড্ডায় তাঁদেরই উপিস্থিতি থাকে, যাঁরা প্রকৃতই মেধাবী, হয়তো সস্তা জনপ্রিয়তা তাঁদের নেই। তাঁরা গড্ডলে গা ভাসাতে পছন্দ করেন না। যে কারণে শালুকের আড্ডা প্রাণবন্ত করে তোলেন তাঁরাই, যাঁদের মুখ দেখে সহজে চেনা যায় না, তাঁদের মেধা দিয়ে চিনতে হয়। পণ্যসাহিত্য ও জনপ্রিয়তার নেশা যাঁদেরকে স্পর্শ করে না, তাঁরাই শালুকের লেখক এবং আড্ডার অংশীদার।
সবশেষে এ আড্ডা অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। সন্ধ্যার কাছাকাছি, মনোহর ও মায়াবী প্রকৃতির টান পেছনে ফেলে শালুক-এর লেখক শুভাকাক্সক্ষীদের গাড়িগুলো ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে। পেছন থেকে ডাকে প্রকৃতিজড়ানো মায়া...