মাধবপুরে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাচারী ঘর বা বাংলা ঘর। ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে মাধবপুর উপজেলা গঠিত। এই উপজেলায় অধিকাংশ ইউনিয়নের গ্রামের অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে আভিজাত্যের প্রতীক ছিল কাছারি ঘর বা গ্রামের বাংলা ঘর।
বাড়ির বাহির আঙিনায় অতিথি, মুসাফির, ছাত্র ও জায়গিরদের থাকার এই ঘরটি কাছারি ঘর বা বাংলা ঘর নামে সমধিক পরিচিত ছিল। মাধবপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আন্দিউড়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী পরিবারের সন্তান হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাকির হোসেন চৌধুরী অসীম বলেন, বর্তমানে ড্রয়িং রুমের সাজ-সজ্জার মাধ্যমে কোনো অভিজাত পরিবারের আভিজাত্যের বহিঃ প্রকাশ ঘটে। ঝাড়বাতি, সোফাসেট, অ্যাকিউরিয়াম, ইন্টেরিয়র, রুচিশীল কোনো ছবি দিয়ে মনোমুগ্ধকর ভাবে সাজানো হয় অতিথিশালা বা ড্রয়িংরুম।
এক সময়ে গ্রামের বাড়ির একমাত্র আভিজাত্যের প্রতীকই ছিল বাড়ির বাহির আঙিনার বৈঠকখানা বা বাংলা ঘর। যা আর এখন চোখে পরে না। এই বাংলা ঘরের চৌকির ওপর থাকত বাড়ির অবিবাহিত ছেলে বা ছাত্ররা। আর মেহমান বা অতিথিরা এলে চৌকির ওপরে থাকতে দেয়া হতো। মাটিতে একঢালা হোগল পাতার বা বাঁশের চাটাই বিছিয়ে বিছানা করে থাকত বারোমাসি কামলারা ও রাখাল। গড় গড় শব্দে তারা হুক্কা টানত আর ধোঁয়া ছাড়ত।
প্রতি রাতেই পাড়ার সব কামলা/রাখাল বড় কোনো কাছারি ঘরে মিলিত হয়ে গানের আসর বসাতো। গান করত পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, রূপবান,গুনাই বিবি, আলোমতি, সাগরভাসা, বেহুলা লখিন্দরের পালা। মাঝে মাঝে গভীর রাত পর্যন্ত বসত শালিস বৈঠক। গৃহ অভ্যন্তরে যারা থাকতেন তাদের চোখেও ঘুম ছিলো না, চা আর পানের ফরমায়েশ রক্ষা করতে।
প্রায় প্রতিটি রাতে কাছারি ঘরওয়ালা বাড়িতে আসত অনাত্মীয়- অচেনা কোনো মুসাফির। ভেতর বাড়ি থেকে শোনা যেত কোনো অচেনা মুসাফিরদের কণ্ঠ : ‘বাড়িতে কেডা আছেন ? কাছে এলে বলত : থাকবার জাগা হবে ? “অনেক রাইত অইছে, বাড়িতে যাওয়া যাবে না” এই কারণেই বাঙালিরা হয়ে উঠেছিল- অতিথি পরায়ণ।
আরবের মানুষও অতিথি পরায়ণ হয়েছিল, শুধু মরুভূমির কারণে। যত রাতেই আসুক অতিথিদের না খেয়ে শুতে দিত না বাড়িওয়ালারা। মজার ব্যাপার হলো- এ সব অতিথিরা রাতের অন্ধকার থাকতেই উঠে চলে যেত, তবে বাড়ির কোনো কিছু হারায়নি কোনো দিন। কাছারি ঘরের সামনে ছিল বারান্দা। বারান্দায় সব সময় একটি হেলনা বেঞ্চ থাকত। ক্লান্ত পথিকরা এখানে বসে একটু জিড়িয়ে নিত। কখনো কখনো পান-তামাক (হুক্কা) খেয়ে যেত।
পশ্চিম মাধবপুরের মরহুম সমুজ আলী সর্দারের ছেলে মাসুদ আলী বলেন, আমাদের একটি কাচারী ঘর ছিল, যেটি আজ পরিত্যক্ত, এই ঘরটি ছিল আমাদের ঐতিহ্য, এক সময় এই ঘরের বারান্দার একপ্রান্তে ছোট কক্ষে থাকতেন মসজিদের মৌলভী বা মক্তবের শিক্ষক। এখন আর কোনো বাড়িতে বাংলা ঘর নেই। যে কয়টি আছে তা ব্যবহৃত না হওয়ায় অবহেলা, অযতেœ মৃত প্রায়।
বারোমাসি রাখালের প্রচলন নেই, নেই রাখালি গান। বাড়ির ছেলেদের রাতে বাইরে থাকার অনুমতি নেই। অবকাঠামো উন্নতির ফলে মাঠে ঘাটে যারা কাজ করে তারা দিন শেষে নিজ বাড়িতে চলে যায়। পরিবার গুলো ছোট ও খুব বেশী আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। তাই বিলুপ্ত হচ্ছে শতবর্ষের ঐতিহ্য কাছারি ঘর নামে খ্যাত বাহির বাড়ির বাংলো ঘরটি। মাধবপুর পৌরসভা মেয়র হাবিবুর রহমান মানিক বলেন, এখন সবাই শহর কেন্দ্রীক। নিজেদের পরিবার নিয়েই সবাই ব্যস্ত। বাবা দাদার ঐতিয্য নিয়ে মোটেও মাথা ব্যাথা নেই। বাবা দাদার সম্পদ ঠিকই বিক্রি করে নিয়ে যায় নিজের আভিজাত্য আরও অভিজাত করার জন্য।
সোমবার, ০৪ জুলাই ২০২২
মাধবপুরে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাচারী ঘর বা বাংলা ঘর। ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে মাধবপুর উপজেলা গঠিত। এই উপজেলায় অধিকাংশ ইউনিয়নের গ্রামের অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে আভিজাত্যের প্রতীক ছিল কাছারি ঘর বা গ্রামের বাংলা ঘর।
বাড়ির বাহির আঙিনায় অতিথি, মুসাফির, ছাত্র ও জায়গিরদের থাকার এই ঘরটি কাছারি ঘর বা বাংলা ঘর নামে সমধিক পরিচিত ছিল। মাধবপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আন্দিউড়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী পরিবারের সন্তান হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাকির হোসেন চৌধুরী অসীম বলেন, বর্তমানে ড্রয়িং রুমের সাজ-সজ্জার মাধ্যমে কোনো অভিজাত পরিবারের আভিজাত্যের বহিঃ প্রকাশ ঘটে। ঝাড়বাতি, সোফাসেট, অ্যাকিউরিয়াম, ইন্টেরিয়র, রুচিশীল কোনো ছবি দিয়ে মনোমুগ্ধকর ভাবে সাজানো হয় অতিথিশালা বা ড্রয়িংরুম।
এক সময়ে গ্রামের বাড়ির একমাত্র আভিজাত্যের প্রতীকই ছিল বাড়ির বাহির আঙিনার বৈঠকখানা বা বাংলা ঘর। যা আর এখন চোখে পরে না। এই বাংলা ঘরের চৌকির ওপর থাকত বাড়ির অবিবাহিত ছেলে বা ছাত্ররা। আর মেহমান বা অতিথিরা এলে চৌকির ওপরে থাকতে দেয়া হতো। মাটিতে একঢালা হোগল পাতার বা বাঁশের চাটাই বিছিয়ে বিছানা করে থাকত বারোমাসি কামলারা ও রাখাল। গড় গড় শব্দে তারা হুক্কা টানত আর ধোঁয়া ছাড়ত।
প্রতি রাতেই পাড়ার সব কামলা/রাখাল বড় কোনো কাছারি ঘরে মিলিত হয়ে গানের আসর বসাতো। গান করত পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, রূপবান,গুনাই বিবি, আলোমতি, সাগরভাসা, বেহুলা লখিন্দরের পালা। মাঝে মাঝে গভীর রাত পর্যন্ত বসত শালিস বৈঠক। গৃহ অভ্যন্তরে যারা থাকতেন তাদের চোখেও ঘুম ছিলো না, চা আর পানের ফরমায়েশ রক্ষা করতে।
প্রায় প্রতিটি রাতে কাছারি ঘরওয়ালা বাড়িতে আসত অনাত্মীয়- অচেনা কোনো মুসাফির। ভেতর বাড়ি থেকে শোনা যেত কোনো অচেনা মুসাফিরদের কণ্ঠ : ‘বাড়িতে কেডা আছেন ? কাছে এলে বলত : থাকবার জাগা হবে ? “অনেক রাইত অইছে, বাড়িতে যাওয়া যাবে না” এই কারণেই বাঙালিরা হয়ে উঠেছিল- অতিথি পরায়ণ।
আরবের মানুষও অতিথি পরায়ণ হয়েছিল, শুধু মরুভূমির কারণে। যত রাতেই আসুক অতিথিদের না খেয়ে শুতে দিত না বাড়িওয়ালারা। মজার ব্যাপার হলো- এ সব অতিথিরা রাতের অন্ধকার থাকতেই উঠে চলে যেত, তবে বাড়ির কোনো কিছু হারায়নি কোনো দিন। কাছারি ঘরের সামনে ছিল বারান্দা। বারান্দায় সব সময় একটি হেলনা বেঞ্চ থাকত। ক্লান্ত পথিকরা এখানে বসে একটু জিড়িয়ে নিত। কখনো কখনো পান-তামাক (হুক্কা) খেয়ে যেত।
পশ্চিম মাধবপুরের মরহুম সমুজ আলী সর্দারের ছেলে মাসুদ আলী বলেন, আমাদের একটি কাচারী ঘর ছিল, যেটি আজ পরিত্যক্ত, এই ঘরটি ছিল আমাদের ঐতিহ্য, এক সময় এই ঘরের বারান্দার একপ্রান্তে ছোট কক্ষে থাকতেন মসজিদের মৌলভী বা মক্তবের শিক্ষক। এখন আর কোনো বাড়িতে বাংলা ঘর নেই। যে কয়টি আছে তা ব্যবহৃত না হওয়ায় অবহেলা, অযতেœ মৃত প্রায়।
বারোমাসি রাখালের প্রচলন নেই, নেই রাখালি গান। বাড়ির ছেলেদের রাতে বাইরে থাকার অনুমতি নেই। অবকাঠামো উন্নতির ফলে মাঠে ঘাটে যারা কাজ করে তারা দিন শেষে নিজ বাড়িতে চলে যায়। পরিবার গুলো ছোট ও খুব বেশী আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। তাই বিলুপ্ত হচ্ছে শতবর্ষের ঐতিহ্য কাছারি ঘর নামে খ্যাত বাহির বাড়ির বাংলো ঘরটি। মাধবপুর পৌরসভা মেয়র হাবিবুর রহমান মানিক বলেন, এখন সবাই শহর কেন্দ্রীক। নিজেদের পরিবার নিয়েই সবাই ব্যস্ত। বাবা দাদার ঐতিয্য নিয়ে মোটেও মাথা ব্যাথা নেই। বাবা দাদার সম্পদ ঠিকই বিক্রি করে নিয়ে যায় নিজের আভিজাত্য আরও অভিজাত করার জন্য।