image

নতুন শিক্ষাক্রমের বই বিতরণে অনীহা, শ্রেণীকক্ষে মূল্যায়নে জটিলতার শঙ্কা

বুধবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৪
রাকিব উদ্দিন

চলতি শিক্ষাবর্ষের নতুন পাঠ্যবই ছাপা ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। রাজধানীসহ দেশের সব জেলায় ‘শতভাগ’ পাঠ্যবই পৌঁছেও দেয়া হয়েছে। এর পরও রাজধানীর বিভিন্ন হাইস্কুলের অষ্টম ও নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা সব বিষয়ের পাঠ্যবই পায়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। থানা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারাও সব বিষয়ের পাঠ্যবই ছাপা শেষ হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

রাজধানীর উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, নীলক্ষেত হাই স্কুল, বিটিসিএল আইডিয়াল স্কুলের মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরাও নতুন শিক্ষাক্রমের সব বিষয়ের পাঠ্যবই পায়নি বলে শিক্ষকরা জানিয়েছেন।

বিটিসিএল আইডিয়াল স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা অন্তত ছয়টি বিষয়ের বই বুধবার (৩১ জানুয়ারি) পর্যন্ত হাতে পায়নি। এগুলি হলো- বাংলা, শিল্প সংস্কৃতি, বিজ্ঞান অনুসন্ধান ও বিজ্ঞান অনুশীলন, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন এবং ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধান।

নীলক্ষেত হাইস্কুলেও ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানসহ কয়েকটি বিষয়ের বই পৌঁছেনি। স্কুলটির প্রধান শিক্ষক সুরমান আলী বলেন, শিক্ষকরা বলছে বই নেই, নতুন শিক্ষাক্রমে বই ছাড়া পড়ানোর সুযোগ কম। শিক্ষার্থীরাও একই কথা বলছে বলে জানান প্রধান শিক্ষক।

উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহুরা বেগম জানিয়েছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে ক্লাসরুমে মূল্যায়ন হওয়ার কথা। কিন্তু বই না পাওয়ায় মূল্যায়ন করা যাচ্ছে না। মূল্যায়ন প্র্যাকটিস বাসায় হওয়ার কথা সেটিও হচ্ছে না, বই না পেলে শিক্ষার্থীরা প্র্যাকটিস করবে কীভাবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীভিত্তিক মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। বার্ষিক ও অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা তুলে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষাবর্ষের একমাস অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়ে স্কুলগুলোতে বই না পৌঁছানোয় শিক্ষার্থীদের ‘মূল্যায়ন’ কার্যক্রম নিয়ে শঙ্কিত শিক্ষকরা।

এনসিটিবি থেকে জানা গেছে, গত বছর অষ্টম ও নবম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের পা-ুলিপি দেরিতে ছাপাখানা মালিকদের সরবরাহ করা হয়। এরপরও ১০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই ছাপা শেষ হওয়ার কথা।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম বুধবার সংবাদকে বলেছেন, ‘ঢাকা কেন দেশের কোথাও একটি বইও ছাপা বা সরবরাহের বাকি নেই। কেউ (প্রধান শিক্ষক) যদি ইচ্ছেকৃতভাবে বা গাফিলতি করে শিক্ষার্থীদের সব বই না দেন সেক্ষেত্রে অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, ছাপাখানা মালিকরা বই ছেপে থানা বা উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের বড় স্কুলগুলোতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেন জানিয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, ‘সেখান থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা নিজেদের দেয়া চাহিদাপত্র অনুযায়ী বই নিয়ে যান। এই ক্ষেত্রে বই আনা-নেয়ার গাড়ি ভাড়াও সরকার বহন করে।’

এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নোট ও গাইড বইয়ের ‘ডিমান্ড’ বাড়াতে কোনো কোনো স্কুলে সব বই বিতরণে সময়ক্ষেপণ করা হতে পারে। এটি হলে শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে বেশি টাকায় নোট-গাইড বই কিনে পড়বে।

সরকারকে সমর্থন করেন না এমন শিক্ষকরাও নতুন শিক্ষাক্রমে ‘শরীফা’ গল্পের ‘বিতর্কের’ সুযোগ নিয়ে সব বিষয়ের বই বিতরণে জটিলতা পাঁকানোর চেষ্টা করতে পারে বলে এনসিটিবি কর্মকর্তাদের আশঙ্কা।

আবার কেন্দ্র (অবকাঠামো সুবিধাসম্পন্ন বড় স্কুল যেখানে আশপাশের স্কুলের বই রাখা হয়) থেকে নির্দিষ্ট এলাকার স্কুলে বই পৌঁছে দেয়ার খরচও এনসিটিবি বহন করে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র প্রধানরা (প্রধান শিক্ষক) বই পৌঁছে দেয়ার খরচ অর্থাৎ যানবাহন ভাড়া স্কুলগুলোর ওপর চাপাতে বই বিতরণে গড়িমসি করতে পারে বলে এনসিটিবি কর্মকর্তাদের ধারণা।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা স্কুল পর্যন্ত বই পৌঁছে দিতে প্রতি বইয়ের জন্য ১৫ পয়সা যানবাহন ভাড়া ধরে কেন্দ্রগুলোতে টাকা পাঠিয়ে দেয়। স্কুলগুলো কেন্দ্র থেকে বই সংগ্রহ করলে তাদের কোনো টাকা-পয়সা খরচ হওয়া কথা নয়। এখন কোনো কেন্দ্র প্রধানরা যদি টাকা-পয়সা এদিক-সেদিক করার জন্য বই বিতরণে অনীহা দেখায় সেক্ষেত্রে অভিযোগ পেলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।’

রাজধানীর দু’জন থানা শিক্ষা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, নতুন শিক্ষাক্রমের কয়েকটি বই নিয়ে ‘বিতর্ক’ চলমান। এই পরিস্থিতিতে বইয়ের স্বল্পতা দেখিয়ে অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীদের ‘নোট-গাইড’ বই কিনতে, পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রকাশনীগুলো নিজেরাই স্কুলে গাইড বই পৌছে দিচ্ছে। চড়া দামে শিক্ষার্থীদের খাতাও কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরী বুধবার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা ডিইও’র (জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা) মাধ্যমে এ বিষয়ে খবর নেবো। কারো বিরুদ্ধে ইচ্ছেকৃতভাবে বই না দেয়ার তথ্য পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারি বই আটকে রেখে নোট-গাইড বিক্রির প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ওই শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণী এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের পুরো পাঠদান শুরু হয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ২০২৫ সালে প্রাথমিকের চতুর্থ ও পঞ্চম এবং মাধ্যমিকের দশম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে নবম শ্রেণীতে বিভাগ (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) বিভাজনও থাকছে না। এর ফলে শিক্ষার্থীদের আলাদা বিভাগ বেঁচে নেয়ার সুযোগ নেই। সব শিক্ষার্থীকে একই পাঠ্যবই পড়তে হবে।

২০২৫ সালে এ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণীতে উঠবে, তখনও বিভাগ বিভাজনের সুযোগ থাকবে না। ২০২৬ সালে এ শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। সেখানে তাদের পরীক্ষার বিষয় ও প্রশ্নপত্র একই থাকবে। ওই সময় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে সূচক বা চিহ্নভিত্তিক।

সরকার ২০১০ সালে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করে। এর পর ২০১২ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়। ২০১৩ সালে ওই শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়।

‘শিক্ষা’ : আরও খবর

» শিক্ষা ক্যাডারে ২৭০৬ জনের পদোন্নতি

সম্প্রতি