বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের পেছনে অর্থ ব্যয়ের প্রকৃত তথ্য পায়নি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচুত্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাঠ্যপুস্তক ছাপায় কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কিনা সেই বিষয়ে কোনো মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা না করেই একটি ‘শে^তপত্র’ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক ছাপার ওপর এই শে^তপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। সেটিকে অনেকটা ‘দায়সারা’ প্রতিবেদন বলছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান সংবাদকে বলেছেন, তারা ‘খাত ধরে ধরে’ অনিয়ম শনাক্তের কাজ করছেন। এজন্য একটু সময় লাগছে। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার কাজ শেষ হলে তারা অনিয়মের বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করবেন বলে জানান তিনি।
গত ২৪ অক্টোবর প্রকাশিথ শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম রুপরেখা, শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, শিখন সামগ্রী উন্নয়ন এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ খাতে ২৬ কোটি ৬৩ লাখ আট হাজার ৪১৯ টাকা ব্যয় হয়েছে।
এরমধ্যে এনসিটিবির তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়েছে ১৫ কোটি ৩৮ লাখ ১৬ হাজার ৭১৭ টাকা। বাকি ১১ কোটি ২৫ লাখ ৯১ হাজার ৭৪২ টাকা ইউনিসেফের সহায়তায় নির্বাহ করা হয়েছে।
কিন্তু শে^তপত্রে বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের ওপর সারাদেশের শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে সে সর্ম্পকে কোনো তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়নি। বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রম সর্ম্পকে নেতিবাচক বা বিরূপ কোনো মন্তব্যও করা হয়নি। বরং ওই শিক্ষাক্রমের কিছু ইতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে।
শে^তপত্রে নেতিবাচক দিক বলতে- শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে পরিপত্রের আলোকে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত করেছে সেটি হুবুহু তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়া প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পেছনে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে সে বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত উঠে আসেনি।
শুধু চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক সহায়িকা প্রণয়ন সর্ম্পকিত কর্মশালায় এক কোটি ৪২ লাখ ৭৮ হাজার ৪৮৬ টাকা ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে শে^তপত্রে। এই টাকা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া ‘প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি’ (ডিইডিপি-৪) থেকে যোগান দেয়া হয়েছে।
শে^তপত্রে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও উন্নয়নের কোনো ব্যয়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
এতে শুধু বলা হয়েছে, ‘শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসরণ করে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের জন্য প্রণীত অনুমোদিত জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ (প্রাথমিক স্তর) এর আলোকে প্রাক-প্রাথমিক, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি এবং ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকসমূহ সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকসমূহের পা-ুলিপি সক্রিয় শিখন পদ্ধতির পরিবর্তে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন পদ্ধতিতে প্রণয়ন করা হয়েছে। এ পা-ুলিপিসমূহ প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।’
৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকসমূহের পা-ুলিপি সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে আবারও প্রণয়ন করা এবং টেন্ডার প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় পরিমার্জিত প্রাথমিক শিক্ষাক্রম ২০১১ এর আলোকে প্রণয়নকৃত ৪র্থ এবং ৫ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকসমূহ প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করে মুদ্রণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে যা ২০২৫ সালে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হবে বলে শে^তপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিগত সরকারের প্রশংসা:
শে^তপত্রের ভূমিকায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত শিক্ষানীতি সর্ম্পকে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। এই শিক্ষানীতি অনুসারে শিক্ষার মাধ্যমে যুযোগপযোগী জনশক্তি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হয় শিক্ষাক্রমের উন্নয়ন এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন। এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে এ শিক্ষানীতি অনুসারে শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন এবং এরজন্য প্রয়োজন সে অনুসারে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন।’
এতে আরও বলা হয়, ‘বিগত সরকারের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্যও নতুন শিক্ষাক্রম উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ প্রণয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।’
শে^তপত্রে আরও বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ এরপর ২০২১ সালে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য একটি জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ প্রণয়ন করা হয়। এর আলোকে বিষয়ভিত্তিক বিস্তারিত শিক্ষাক্রম ও শিখন সামগ্রী প্রণয়ন করা হয়। যেখানে পাঠ্যপুস্তরে পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অন্যান্য শিখন সামগ্রী ব্যবহার করে কীভাবে শ্রেণী কার্যক্রমকে যৌক্তিকভাবে আরও বেশি আনন্দময় এবং শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক করা যায় তার উপর জোর দেয়া হয়েছে। শ্রেণী কার্যক্রমকে শুধু শ্রেণীকক্ষের ভেতরে সীমাবদ্ধ না রেখে শ্রেণীর বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ফলে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন পদ্ধতিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ প্রণয়ন করা হয়।’
‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২’ সর্ম্পকে শে^তপত্রে বলা হয়েছে, ‘যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম যেখানে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালিত হয় অভিজ্ঞাভিত্তিক শিখন পদ্ধতিতে। এখানে যেকোনো বিষয়ে জ্ঞান লাভের পূর্বে অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। মূল্যায়ন ব্যবস্থায় ৭টি স্তর নির্ধারণ করা হয়। সামষ্টিক মূল্যায়নের চেয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নকে প্রাধান্য দেয়া হয়।’
নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ এর বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা তথা অংশীজনদের অভিমত, গবেষণা ও জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকগণের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ঘাটতি, পাঠ্য বিষয়বস্তু এবং শিখন-শেখানো পদ্ধতি সর্ম্পকে অস্পষ্টতা ও নেতিবাচক ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রকট অভাব ইত্যাদি নানবিধ বাস্তব সমস্যা বিদ্যমান থাকায় উক্ত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বিধায় প্রতীয়মান হয়।’
সরকার ২০১০ সালে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করে। এরপর ২০১২ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়। ২০১৩ সালে ওই শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়। নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত হওয়ায় ২০১৩ সালের শিক্ষাক্রমেই ফেরত যাওয়া হয়েছে।
অর্থের খোঁজ পায়নি ২ কমিটি:
শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের পেছনে ব্যয় হওয়া খরচের হিসাব কষতে গত ২৪ অক্টোবর পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে এনসিটিবি। এই কমিটিকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করতে চার সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করে সংস্থাটি।
এরমধ্যে পাঁচ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক হলেন এনসিটিবি’র প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। সদস্য হিসেবে ছিলেন উৎপাদন নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আবু নাসের টুকু, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ আব্দুল মুমিন মোছাব্বির ও বিতরণ নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমান এবং সদস্য সচিব হিসেবে আছেন বিশেষজ্ঞ মীর রাহাত মাসুম।
কাগজপত্র সরবরাহের জন্য গঠিত কমিটিতে এনসিটিবি’র ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ সাইফা সুলতানা, গবেষণা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ প্রবীর চন্দ্র রায়, গবেষণা কর্মকর্তা শাহ্? জুলফিকার রহমান।
কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ‘বাতিল হওয়া’ শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। এ জন্য শে^তপত্রটি ‘দায়সারা গোচের’ হয়েছে।
জানা গেছে, মাউশি ও ডিপিই’র দুটি প্রকল্প এবং ‘ইউনিসেফ’র অর্থায়নে ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ওই তিনটি উৎসের মধ্যে শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ‘এসইডিপি’ প্রকল্পেই ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৮৫৫ কোটি ৮২ লাখ ১৬ হাজার টাকা।
এরমধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮২৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এই স্কিমের অনুকূলে মোট ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল; যার মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ওই টাকা ব্যয় দেখাতে পারছেন না কর্মকর্তারা।
মাউশির অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলাপমেন্ট প্রোগ্রামের’ (এসইডিপি) আওতায় ‘ডেসিমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিম’ গ্রহণ করা হয়েছিল। এই স্কিমের (নকশা বা কর্ম-পরিকল্পনা) মাধ্যমে ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের ব্যয় নির্বাহ করার কথা রয়েছে।
সরকার ২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করেছিল। প্রথম বছর প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণী এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদান শুরু হয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার সমালোচিত এই শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত করেছে।
২০২৫ সালে চতুর্থ ও পঞ্চম এবং দশম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের সিন্ধান্ত ছিল। নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর ২০২২ থেকে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে চার লাখের মতো শিক্ষককে সাতদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। অষ্টম ও নবম শ্রেণীতেও নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের জন্য গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর চার লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে এনসিটিবি থেকে জানা গেছে।
শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের পেছনে অর্থ ব্যয়ের প্রকৃত তথ্য পায়নি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচুত্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাঠ্যপুস্তক ছাপায় কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কিনা সেই বিষয়ে কোনো মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা না করেই একটি ‘শে^তপত্র’ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক ছাপার ওপর এই শে^তপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। সেটিকে অনেকটা ‘দায়সারা’ প্রতিবেদন বলছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান সংবাদকে বলেছেন, তারা ‘খাত ধরে ধরে’ অনিয়ম শনাক্তের কাজ করছেন। এজন্য একটু সময় লাগছে। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার কাজ শেষ হলে তারা অনিয়মের বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করবেন বলে জানান তিনি।
গত ২৪ অক্টোবর প্রকাশিথ শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম রুপরেখা, শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, শিখন সামগ্রী উন্নয়ন এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ খাতে ২৬ কোটি ৬৩ লাখ আট হাজার ৪১৯ টাকা ব্যয় হয়েছে।
এরমধ্যে এনসিটিবির তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়েছে ১৫ কোটি ৩৮ লাখ ১৬ হাজার ৭১৭ টাকা। বাকি ১১ কোটি ২৫ লাখ ৯১ হাজার ৭৪২ টাকা ইউনিসেফের সহায়তায় নির্বাহ করা হয়েছে।
কিন্তু শে^তপত্রে বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের ওপর সারাদেশের শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে সে সর্ম্পকে কোনো তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়নি। বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রম সর্ম্পকে নেতিবাচক বা বিরূপ কোনো মন্তব্যও করা হয়নি। বরং ওই শিক্ষাক্রমের কিছু ইতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে।
শে^তপত্রে নেতিবাচক দিক বলতে- শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে পরিপত্রের আলোকে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত করেছে সেটি হুবুহু তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়া প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পেছনে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে সে বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত উঠে আসেনি।
শুধু চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক সহায়িকা প্রণয়ন সর্ম্পকিত কর্মশালায় এক কোটি ৪২ লাখ ৭৮ হাজার ৪৮৬ টাকা ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে শে^তপত্রে। এই টাকা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া ‘প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি’ (ডিইডিপি-৪) থেকে যোগান দেয়া হয়েছে।
শে^তপত্রে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও উন্নয়নের কোনো ব্যয়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
এতে শুধু বলা হয়েছে, ‘শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসরণ করে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের জন্য প্রণীত অনুমোদিত জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ (প্রাথমিক স্তর) এর আলোকে প্রাক-প্রাথমিক, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি এবং ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকসমূহ সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকসমূহের পা-ুলিপি সক্রিয় শিখন পদ্ধতির পরিবর্তে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন পদ্ধতিতে প্রণয়ন করা হয়েছে। এ পা-ুলিপিসমূহ প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।’
৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকসমূহের পা-ুলিপি সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে আবারও প্রণয়ন করা এবং টেন্ডার প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় পরিমার্জিত প্রাথমিক শিক্ষাক্রম ২০১১ এর আলোকে প্রণয়নকৃত ৪র্থ এবং ৫ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকসমূহ প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করে মুদ্রণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে যা ২০২৫ সালে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হবে বলে শে^তপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিগত সরকারের প্রশংসা:
শে^তপত্রের ভূমিকায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত শিক্ষানীতি সর্ম্পকে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। এই শিক্ষানীতি অনুসারে শিক্ষার মাধ্যমে যুযোগপযোগী জনশক্তি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হয় শিক্ষাক্রমের উন্নয়ন এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন। এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে এ শিক্ষানীতি অনুসারে শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন এবং এরজন্য প্রয়োজন সে অনুসারে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন।’
এতে আরও বলা হয়, ‘বিগত সরকারের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্যও নতুন শিক্ষাক্রম উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ প্রণয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।’
শে^তপত্রে আরও বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ এরপর ২০২১ সালে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য একটি জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ প্রণয়ন করা হয়। এর আলোকে বিষয়ভিত্তিক বিস্তারিত শিক্ষাক্রম ও শিখন সামগ্রী প্রণয়ন করা হয়। যেখানে পাঠ্যপুস্তরে পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অন্যান্য শিখন সামগ্রী ব্যবহার করে কীভাবে শ্রেণী কার্যক্রমকে যৌক্তিকভাবে আরও বেশি আনন্দময় এবং শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক করা যায় তার উপর জোর দেয়া হয়েছে। শ্রেণী কার্যক্রমকে শুধু শ্রেণীকক্ষের ভেতরে সীমাবদ্ধ না রেখে শ্রেণীর বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ফলে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন পদ্ধতিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ প্রণয়ন করা হয়।’
‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২’ সর্ম্পকে শে^তপত্রে বলা হয়েছে, ‘যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম যেখানে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালিত হয় অভিজ্ঞাভিত্তিক শিখন পদ্ধতিতে। এখানে যেকোনো বিষয়ে জ্ঞান লাভের পূর্বে অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। মূল্যায়ন ব্যবস্থায় ৭টি স্তর নির্ধারণ করা হয়। সামষ্টিক মূল্যায়নের চেয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নকে প্রাধান্য দেয়া হয়।’
নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ এর বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা তথা অংশীজনদের অভিমত, গবেষণা ও জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকগণের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ঘাটতি, পাঠ্য বিষয়বস্তু এবং শিখন-শেখানো পদ্ধতি সর্ম্পকে অস্পষ্টতা ও নেতিবাচক ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রকট অভাব ইত্যাদি নানবিধ বাস্তব সমস্যা বিদ্যমান থাকায় উক্ত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বিধায় প্রতীয়মান হয়।’
সরকার ২০১০ সালে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করে। এরপর ২০১২ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়। ২০১৩ সালে ওই শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়। নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত হওয়ায় ২০১৩ সালের শিক্ষাক্রমেই ফেরত যাওয়া হয়েছে।
অর্থের খোঁজ পায়নি ২ কমিটি:
শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের পেছনে ব্যয় হওয়া খরচের হিসাব কষতে গত ২৪ অক্টোবর পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে এনসিটিবি। এই কমিটিকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করতে চার সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করে সংস্থাটি।
এরমধ্যে পাঁচ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক হলেন এনসিটিবি’র প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। সদস্য হিসেবে ছিলেন উৎপাদন নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আবু নাসের টুকু, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ আব্দুল মুমিন মোছাব্বির ও বিতরণ নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমান এবং সদস্য সচিব হিসেবে আছেন বিশেষজ্ঞ মীর রাহাত মাসুম।
কাগজপত্র সরবরাহের জন্য গঠিত কমিটিতে এনসিটিবি’র ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ সাইফা সুলতানা, গবেষণা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ প্রবীর চন্দ্র রায়, গবেষণা কর্মকর্তা শাহ্? জুলফিকার রহমান।
কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ‘বাতিল হওয়া’ শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। এ জন্য শে^তপত্রটি ‘দায়সারা গোচের’ হয়েছে।
জানা গেছে, মাউশি ও ডিপিই’র দুটি প্রকল্প এবং ‘ইউনিসেফ’র অর্থায়নে ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ওই তিনটি উৎসের মধ্যে শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ‘এসইডিপি’ প্রকল্পেই ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৮৫৫ কোটি ৮২ লাখ ১৬ হাজার টাকা।
এরমধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮২৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এই স্কিমের অনুকূলে মোট ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল; যার মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ওই টাকা ব্যয় দেখাতে পারছেন না কর্মকর্তারা।
মাউশির অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলাপমেন্ট প্রোগ্রামের’ (এসইডিপি) আওতায় ‘ডেসিমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিম’ গ্রহণ করা হয়েছিল। এই স্কিমের (নকশা বা কর্ম-পরিকল্পনা) মাধ্যমে ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের ব্যয় নির্বাহ করার কথা রয়েছে।
সরকার ২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করেছিল। প্রথম বছর প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণী এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদান শুরু হয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার সমালোচিত এই শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত করেছে।
২০২৫ সালে চতুর্থ ও পঞ্চম এবং দশম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের সিন্ধান্ত ছিল। নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর ২০২২ থেকে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে চার লাখের মতো শিক্ষককে সাতদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। অষ্টম ও নবম শ্রেণীতেও নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের জন্য গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর চার লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে এনসিটিবি থেকে জানা গেছে।