আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচারপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের কাছে জানতে চেয়েছেন জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা। রোববার (১৯ জানুয়ারি) ঢাকা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় পরিদর্শনে এসে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস এবং ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খান এ তথ্য জানতে চান।
তারা চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের সঙ্গে আলোচনা করেন। এ সময় ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে জাতিসংঘের প্রতি অনুরোধ জানায় চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়।
পরে আলোচনার বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের জানান চিফ প্রসিকিউটর।
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। এ সময় জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার ও তদন্তপ্রক্রিয়া কেমন এগোচ্ছে, কী পর্যায়ে আছে, কোনো সমস্যা আছে কি না। তাদের পক্ষ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা দরকার আছে কি না। এই বিচারপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, কী কী কাজ করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে জাতিসংঘের সহযোগিতা দরকার আছে কি না, এসব বিষয় নিয়ে তারা খোলামেলা আলোচনা করেছেন।’
জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের কাছে প্রসিকিউশন এবং তদন্ত সংস্থাকে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় অনুরোধ জানিয়েছে বলে জানান তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এই বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি জাতিসংঘের সমর্থন ব্যক্ত করার জন্য..., অব্যাহত সমর্থন যাতে তারা দেন, সে ব্যাপারে আমরা তাদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যা এবং বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা হচ্ছে।
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত দেয়ার বিষয়ে কোনো জবাব এখনো ভারত দেয়নি। না দিলেও আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। বিচারপ্রক্রিয়া তার নিজস্ব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চলবে।’
ট্রাইব্যুনাল
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আদালত) ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে স্থাপন করা হয় মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ওই বছরের ২৫ মার্চ। ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়, যা ট্রাইব্যুনাল-২ নামে পরিচিতি পায়। এরপর ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুই ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করে একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। ওই আন্দোলনে সহিংসতায় প্রাণ হারান অনেকে। গত বুধবার প্রকাশিত প্রথম গেজেটে সারাদেশের ৮৩৪ জন ‘শহীদের’ নাম প্রকাশ করা হয়।
হাসিনা সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
ট্রাইব্যুনালে ব্যাপক রদবদল করা হয়। বিচারক পাল্টানো হয়, তদন্ত সংস্থাতেও আসে নতুন মুখ। সংশোধন করা হয় আইনও। গত ১৪ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।
প্রসিকিউশন
গত ৫ সেপ্টেম্বর মো. তাজুল ইসলাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের মর্যাদা লাভ করেন।
চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ি, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় সরাসরি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যায় না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ করতে হয় ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে। এই কার্যালয়ের অধীন তদন্ত সংস্থার কাছেও অভিযোগ জমা দেয়া যায়। নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা যাচাই-বাছাই করে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের অধীন তদন্ত সংস্থা। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন চিফ প্রসিকিউটর।
অভিযোগ
প্রসিকিউশনের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, অভিযোগের সংখ্যা তিনশ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৬৮টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে তদন্ত সংস্থায় পাঠানো হয়েছে।
সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ এসেছে ১৮০টির বেশি। এরমধ্যে ১৫৩টি অভিযোগের বিশ্লেষণ পরবর্তি তথ্য বলছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকা-ের ঘটনায় ১১১টি, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত গুম-খুনের ঘটনায় ৩৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। অন্য চারটি অভিযোগের একটি মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে করা আবেদন।
১৫৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯৪টিতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, ১৪ দলের শীর্ষ নেতা, সাবেক ও বর্তমান আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সদস্য এবং এই ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর রয়েছেন।
*হাসিনা-রেহানা*
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ি, চিফ প্রসিকিউটর সাতটি মামলা করেছেন ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে পাঁচটি মামলা গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকা-ের ঘটনায়। দুটি মামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুমের ঘটনায়। সাতটি মামলার মধ্যে একটি মামলায় একমাত্র আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে গুম-খুন এবং গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। তাকে এসব অপরাধের প্রধান আসামি বা অপরাধের ‘নিউক্লিয়াস’ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে গত ১৭ ডিসেম্বর তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
*জয়-পুতুল-রাদওয়ান-টিউলিপ*
গণ-অভ্যুত্থানের আরেকটি মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা। এ ছাড়া আসামির তালিকায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও আমলাও রয়েছেন।
আরেকটি মামলায় পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের সাবেক কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে। আর গুমের দুটি মামলায় একটিতে রাঙামাটির পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুলের সাবেক পুলিশ সুপার মো. মহিউদ্দিন ফারুকীকে এবং আরেকটিতে বরিশাল রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলেপ উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গত ১৮ জুলাই ধানমন্ডি এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফারহান ফাইয়াজকে। এ ঘটনায় গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে ট্রাইব্যুনালে প্রথম অভিযোগ জমা হয়। ফারহানের বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া অভিযোগটি করেন।
জুলাই হত্যাকাণ্ডে মানবতাবিরোধী অপরাধে এখন পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের মধ্যে শেখ হাসিনা ছাড়াও রয়েছেন তার বোন শেখ রেহানা। হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক।
*কাদের-আরাফাত, সালমান-তৌফিক*
সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে রয়েছেন ওবায়দুল কাদের, আ ক ম মোজাম্মেল হক, আসাদুজ্জামান খান, আনিসুল হক, হাসান মাহমুদ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, ফারুক খান, শাজাহান খান, মতিয়া চৌধুরী (প্রয়াত), দীপু মনি, কামরুল ইসলাম, মহিবুল হাসান চৌধুরী, জুনাইদ আহ্?মেদ, মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও কামাল আহমেদ মজুমদার।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের মধ্যে রয়েছেন সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
*তাপস-পরশ*
আরও আছেন ঢাকার সাবেক দুই মেয়র আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপস। অভিযোগ এসেছে যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মইনুল হোসেন, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজী মেজবাউল হক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে।
সরকার পতনের পর গুমের প্রথম অভিযোগটি করা হয় গত ২২ সেপ্টেম্বর। ইশরাত রফিক নামের একজনকে বেআইনিভাবে আটক ও নির্যাতন করার অভিযোগ আনা হয় তাতে। জামায়াতে ইসলামীর কর্মী এনামুল কবিরকে বেআইনিভাবে আটক করে নির্যাতনের ঘটনায় ২৩ সেপ্টেম্বর গুমের দ্বিতীয় অভিযোগটি করা হয়।
*পুলিশ-র্যাব*
গুম-খুনের ঘটনায় যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক (পরে আইজিপি হন) বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, হাসান মাহমুদ খন্দকার ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আলমামুন। এ ছাড়া রয়েছেন র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. মোখলেছুর রহমান, এম খুরশীদ হোসেন ও মো. হারুন অর রশিদ।
আরও রয়েছেন ডিএমপি সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, খন্দকার গোলাম ফারুক ও মোহা. শফিকুল ইসলাম, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ প্রমুখ।
গুমের ঘটনায় সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জনের নামে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ এসেছে।
চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে জমা হওয়া বেশীরভাগ অভিযোগই তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা না পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে না বলে জানিয়েছে কার্যালয় সূত্র।
সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচারপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের কাছে জানতে চেয়েছেন জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা। রোববার (১৯ জানুয়ারি) ঢাকা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় পরিদর্শনে এসে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস এবং ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খান এ তথ্য জানতে চান।
তারা চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের সঙ্গে আলোচনা করেন। এ সময় ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে জাতিসংঘের প্রতি অনুরোধ জানায় চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়।
পরে আলোচনার বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের জানান চিফ প্রসিকিউটর।
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। এ সময় জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার ও তদন্তপ্রক্রিয়া কেমন এগোচ্ছে, কী পর্যায়ে আছে, কোনো সমস্যা আছে কি না। তাদের পক্ষ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা দরকার আছে কি না। এই বিচারপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, কী কী কাজ করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে জাতিসংঘের সহযোগিতা দরকার আছে কি না, এসব বিষয় নিয়ে তারা খোলামেলা আলোচনা করেছেন।’
জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের কাছে প্রসিকিউশন এবং তদন্ত সংস্থাকে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় অনুরোধ জানিয়েছে বলে জানান তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এই বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি জাতিসংঘের সমর্থন ব্যক্ত করার জন্য..., অব্যাহত সমর্থন যাতে তারা দেন, সে ব্যাপারে আমরা তাদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যা এবং বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা হচ্ছে।
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত দেয়ার বিষয়ে কোনো জবাব এখনো ভারত দেয়নি। না দিলেও আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। বিচারপ্রক্রিয়া তার নিজস্ব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চলবে।’
ট্রাইব্যুনাল
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আদালত) ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে স্থাপন করা হয় মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ওই বছরের ২৫ মার্চ। ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়, যা ট্রাইব্যুনাল-২ নামে পরিচিতি পায়। এরপর ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুই ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করে একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। ওই আন্দোলনে সহিংসতায় প্রাণ হারান অনেকে। গত বুধবার প্রকাশিত প্রথম গেজেটে সারাদেশের ৮৩৪ জন ‘শহীদের’ নাম প্রকাশ করা হয়।
হাসিনা সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
ট্রাইব্যুনালে ব্যাপক রদবদল করা হয়। বিচারক পাল্টানো হয়, তদন্ত সংস্থাতেও আসে নতুন মুখ। সংশোধন করা হয় আইনও। গত ১৪ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।
প্রসিকিউশন
গত ৫ সেপ্টেম্বর মো. তাজুল ইসলাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের মর্যাদা লাভ করেন।
চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ি, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় সরাসরি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যায় না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ করতে হয় ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে। এই কার্যালয়ের অধীন তদন্ত সংস্থার কাছেও অভিযোগ জমা দেয়া যায়। নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা যাচাই-বাছাই করে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের অধীন তদন্ত সংস্থা। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন চিফ প্রসিকিউটর।
অভিযোগ
প্রসিকিউশনের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, অভিযোগের সংখ্যা তিনশ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৬৮টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে তদন্ত সংস্থায় পাঠানো হয়েছে।
সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ এসেছে ১৮০টির বেশি। এরমধ্যে ১৫৩টি অভিযোগের বিশ্লেষণ পরবর্তি তথ্য বলছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকা-ের ঘটনায় ১১১টি, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত গুম-খুনের ঘটনায় ৩৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। অন্য চারটি অভিযোগের একটি মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে করা আবেদন।
১৫৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯৪টিতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, ১৪ দলের শীর্ষ নেতা, সাবেক ও বর্তমান আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সদস্য এবং এই ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর রয়েছেন।
*হাসিনা-রেহানা*
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ি, চিফ প্রসিকিউটর সাতটি মামলা করেছেন ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে পাঁচটি মামলা গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকা-ের ঘটনায়। দুটি মামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুমের ঘটনায়। সাতটি মামলার মধ্যে একটি মামলায় একমাত্র আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে গুম-খুন এবং গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। তাকে এসব অপরাধের প্রধান আসামি বা অপরাধের ‘নিউক্লিয়াস’ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে গত ১৭ ডিসেম্বর তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
*জয়-পুতুল-রাদওয়ান-টিউলিপ*
গণ-অভ্যুত্থানের আরেকটি মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা। এ ছাড়া আসামির তালিকায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও আমলাও রয়েছেন।
আরেকটি মামলায় পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের সাবেক কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে। আর গুমের দুটি মামলায় একটিতে রাঙামাটির পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুলের সাবেক পুলিশ সুপার মো. মহিউদ্দিন ফারুকীকে এবং আরেকটিতে বরিশাল রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলেপ উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গত ১৮ জুলাই ধানমন্ডি এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফারহান ফাইয়াজকে। এ ঘটনায় গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে ট্রাইব্যুনালে প্রথম অভিযোগ জমা হয়। ফারহানের বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া অভিযোগটি করেন।
জুলাই হত্যাকাণ্ডে মানবতাবিরোধী অপরাধে এখন পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের মধ্যে শেখ হাসিনা ছাড়াও রয়েছেন তার বোন শেখ রেহানা। হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক।
*কাদের-আরাফাত, সালমান-তৌফিক*
সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে রয়েছেন ওবায়দুল কাদের, আ ক ম মোজাম্মেল হক, আসাদুজ্জামান খান, আনিসুল হক, হাসান মাহমুদ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, ফারুক খান, শাজাহান খান, মতিয়া চৌধুরী (প্রয়াত), দীপু মনি, কামরুল ইসলাম, মহিবুল হাসান চৌধুরী, জুনাইদ আহ্?মেদ, মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও কামাল আহমেদ মজুমদার।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের মধ্যে রয়েছেন সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
*তাপস-পরশ*
আরও আছেন ঢাকার সাবেক দুই মেয়র আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপস। অভিযোগ এসেছে যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মইনুল হোসেন, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজী মেজবাউল হক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে।
সরকার পতনের পর গুমের প্রথম অভিযোগটি করা হয় গত ২২ সেপ্টেম্বর। ইশরাত রফিক নামের একজনকে বেআইনিভাবে আটক ও নির্যাতন করার অভিযোগ আনা হয় তাতে। জামায়াতে ইসলামীর কর্মী এনামুল কবিরকে বেআইনিভাবে আটক করে নির্যাতনের ঘটনায় ২৩ সেপ্টেম্বর গুমের দ্বিতীয় অভিযোগটি করা হয়।
*পুলিশ-র্যাব*
গুম-খুনের ঘটনায় যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক (পরে আইজিপি হন) বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, হাসান মাহমুদ খন্দকার ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আলমামুন। এ ছাড়া রয়েছেন র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. মোখলেছুর রহমান, এম খুরশীদ হোসেন ও মো. হারুন অর রশিদ।
আরও রয়েছেন ডিএমপি সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, খন্দকার গোলাম ফারুক ও মোহা. শফিকুল ইসলাম, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ প্রমুখ।
গুমের ঘটনায় সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জনের নামে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ এসেছে।
চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে জমা হওয়া বেশীরভাগ অভিযোগই তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা না পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে না বলে জানিয়েছে কার্যালয় সূত্র।